16-04-2020, 11:10 PM
।।৪।।
মাকে সঙ্গে করে বাবাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তার সেনের চেম্বারে।আগে নাম লিখিয়েছি একের পর এক ডাক পড়ছে।বাবা এমনভাবে হেলান দিয়ে বসে আছে বুঝতে পারলাম কষ্ট হচ্ছে।জনা কয়েক বাকি থাকতে আমাদের সুযোগ এল।বাবাকে ভাল করে পরীক্ষা করে ডাক্তার সেন বললেন,এমনিতে চিন্তার কিছু নেই।এই টেস্টগুলো ভালো জায়গা থেকে করিয়ে আনবেন।আপাতত এই ওষুধগুলো খাওয়াতে থাকুন। বাবাকে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে টেস্টগুলো করিয়েছি।পরের দিন রিপোর্ট নিয়ে হিজলতলিতে ফিরে শুনলাম, কলকাতা থেকে পুলিশ এসেছিল রমেশদাকে সঙ্গে নিয়ে। রমেশদার কোমরে দড়ী বাধা ছিল।বাড়ী সার্চ করে কিছু পায়নি। পাড়ার অনেকে ছিল সেখানে কেলোও নাকি ছিল। মলিনাবৌদি খুব কান্নাকাটি করেছে। লোক বলাবলি করছে রমেশদা নাকি সোনা চুরি করেছে। শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।
পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা রিপোর্ট নিয়ে বেরলাম ডাক্তার সেনের চেম্বারে যাবো বলে। মলিনাবৌদির বাড়ী পেরোতে গিয়ে কানে এল উত্তেজিত কথাবার্তা। পুলিশ আসার পর মলিনাবৌদির সঙ্গে দেখা হয়নি। কৌতূহল বশত উকি দিয়ে দেখলাম কেলোর সঙ্গে কি নিয়ে বচসা হচ্ছে।
--দ্যাখো বউদি বেশি গাড়চালাকি করবেনা। মাল গুলো কোথায় সরালে সত্যি করে বলো।
বউদি দমবার পাত্রি নয় গলা উঁচিয়ে বলে, এই হারামি এটা ভদ্রলোকের বাড়ী একদম খিস্তি করবিনা। মাল থাকলে পুলিশ ছাইড়া দিত?
--ও ভাল কথায় কাজ হবেনা দেখছি--।
--কি করবি রে তুই ?তোর মত ফুডা মস্তান ম্যালা দেখছি।
--তবেরে গুদ মারানি!
কে যেন আমাকে বলল তুমি না পুরুষমানুষ! তেড়ে যাবার আগেই আমি ঢুকে বললাম, খবরদার বলছি এটা ভদ্রলোকের পাড়া!
আমাকে দেখে কেলো ভুত দেখার মত চমকে উঠল। হা করে কিছুক্ষণ দেখে বলল, তুমি ভদ্রলোকের ছেলে এসব ঝামেলায় এসোনা,তুমি যাও।
--না আমি যাবনা।আমিও উত্তর দিলাম।
--দ্যাখো বউদি কাজটা ভাল করলে না। ঠিক আছে আজ না হোক কাল রমেশদা তো ছাড়া পাবে তখন ফয়সলা হবে।
কেলো গজগজ করতে করতে চলে গেল। মলিনাবৌদি এতক্ষণ অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল।
--ঠাকুর-পো তোমার এই ব্যাপারে আহন ঠিক হয়নাই। এরা ডাকাইত এগো অসাইধ্য কিছু নাই।
--কি নিয়ে গোলমাল?
--তোমার দাদায় নিকি বলছে অরে টাকা দিতে।বোকাচোদা--।মলিনাবৌদি লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করল,মনু অগো কথা বাদ দাও,বলো তুমি কি মনে কইর্যা?
--তোমার জিনিসটা ফেরত নেবে না?
--তোমার কাছে থাকা সেনা আমার কাছেই থাকা।
--কি আছে ওতে?
--ওমা তুমি দ্যাখো নাই? আচমকা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল।
--কি হচ্ছে কি কেউ যদি দেখে?
--ঘরের মইধ্যে কেডা দেখবো? বৌদি তার দেওররে সোহাগ করে তাতে কার বাপের কি?
এখানে আর থাকা সমীচীন হবে না। তা ছাড়া এতক্ষণে ডাক্তার সেন রুগী দেখা শুরু করে দিয়েছেন মনে হয়।দ্রুত বেরিয়ে এলাম।কোথাও কেলো ফেল ঘাপ্টি মেরে নেইতো?এদিক-ওদিক দেখে হন হন করে হাটতে শুরু করলাম।এতক্ষনে খেয়াল হতে রুমাল বের করে মুখ মুছলাম।
চেম্বারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার ডাক পড়ল। রিপোর্ট এগিয়ে দিলাম, ডাক্তার সেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন রিপোর্টগুলো।তারপর আমার দিকে তাকালেন মুখ গম্ভীর।
--তোমার বাবা কি অফিস থেকে চিকিৎসার খরচ পান?
--আমি ঠিক বলতে পারবো না। কেন ডাক্তার বাবু খুব খারাপ কিছু দেখলেন?
--হুম একটু ক্রিটিক্যাল--রোগটার নাম নিউমোকোনিয়াসিস--লাং-এ এ্যাফেক্ট করে।দিন দিন পলিউশন যেভাবে বাড়ছে তাতে তুমি-আমি এখনো এই রোগে আক্রান্ত হই নি সেটাই বিস্ময়।
চেম্বারের দরজায় উকি দিয়ে দময়ন্তী বলল, হয়ে গেলে উপরে আসবে।
--তুই ওকে চিনিস নাকি? ডাক্তার সেন বলেন।
--বাহ, কেন চিনবো না? একসঙ্গে পড়তাম।
--আগে জানলে তোমার কাছ থেকে ফিস নিতাম না। কি করো তুমি?
--পড়ছি।
--হা-হা-হা। পড়বে তো বটেই। যাও বা-দিকে সিঁড়ি আছে।
আমার সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আর পড়েনি জয়েণ্ট দিয়ে পাস করে ডাক্তারী পড়ছে।দময়ন্তী ডাকায় ভালো হয়েছে ডাক্তারবাবু হয়তো একটু গুরুত্ব দেবেন।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বসার ঘর।দময়ন্তী একটা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।আমাকে দেখে বলল এসো।
এতকাছে সামনা সামনি আগে ওকে দেখিনি। আটপৌরে সাজগোজ আজকালকার মেয়েদের মত নয়। মজা করে জিজ্ঞেস করি,তোমার গলায় স্টেথো কোথায়?
খিল খিল করে হেসে ওঠে দময়ন্তী সারাঘরে যেন একরাশ ফুল ছড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল, আমি ডাক্তার নাকি? ডাক্তার সেনের কাছে কেন এসেছিলে? জানলা দিয়ে দেখলাম তুমি ঢুকছো...কি ব্যাপার?
--বাবার জন্য।
--কি হয়েছে ওর?
--নিউকোনিয়াস না কি যেন...।
--নিউমোকোনিয়াস। দময়ন্তীর চোখে ছায়া ঘনালো।ডাক্তার সেন কি বলল?
--পলিউশন থেকে হয়।ওষুধ লিখে দিলেন।
--দেখি।ওকে প্রেসক্রিপশন দিতে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে।তারপর ঘাড় নাড়তে নাড়তে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ব্রজ বোষ্টমি ছেড়ে এখন বরেনদার চেলা হয়েছো?
--আমি কারো চেলা নই।
--রাগ করছ কেন? মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে,ব্রজো বোষ্টমি তোমাকে বলত না,আয় বেটা?
--না আমাকে বোলতো গোসাই। বোজোদিকে আমার ভাল লাগতো।
--গোসাই? জানো ব্রজ বোষ্টমি রেপড হয়েছিল?
--শুনেছি।
--কে করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
--তুমি উকিল না ডাক্তার? খালি জেরা করছো?
আবার সেই খিলখিল করে হাসি যে হাসিতে সব মালিন্য দূর হয়ে যায়।পাড়ায় মেশে না অথচ খবর রাখে।
মিসেস সেন চা নিয়ে ঢুকলেন। দময়ন্তী জিজ্ঞেস করে,কিছু খাবে?
--কিছু দরকার নেই।
দময়ন্তী আলাপ করিয়ে দিলেই আমার মা মিসেস মনোরমা সেন। আর ও মনোজ মোহন সোম। একসঙ্গে পড়তাম। ভীষণ ডাঁট ডেকে না আনলে আসেনা।
তাকিয়ে দেখলাম টকটকে ফরসা রঙ একটু ভারি চেহারা চওড়া মেরুন পাড়ের হলুদ জমির একটা শাড়ি পরা সিঁথিতে জ্বল জ্বল করছে সিন্দূর রেখা। বয়স আমার মায়ের মত। আমি উঠে প্রণাম করলাম।
--কলকাতা থেকে মিষ্টি এনেছি ওকে দাও।
আপত্তি করতে যাবো কিন্তু দময়ন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। মিসেস সেন চলে যাবার পর জিজ্ঞেস করি, আমাকে ডেকেছো কেন বললে নাতো?
--আমার ইচ্ছে হল তাই।
মিসেস সেন রসগোল্লা নিয়ে ঢুকলেন। দময়ন্তী জিজ্ঞেস করে,ডাক্তারবাবুর জন্য রেখেছো?
--হ্যাঁ আছে তোমরা খাও।মিসেস সেন চলে গেলেন।
--তুমি বাবাকে ডাক্তার সেন বলছো কেন?
--কারণ উনি ডাক্তার কারো বাবা নয়।
গভীর অভিমানের সুর শুনতে পেলাম। পারবারিক ব্যাপার অল্প পরিচয়ে নাক গলানো সমীচীন হবেনা। দময়ন্তীর সঙ্গে কথা বলে মনটা ফুরফুরে হবার কথা কিন্তু বাবার কথা ভেবে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ী ফিরলাম।প্রেসক্রিপশন দেখে দময়ন্তী কিছু বলল না কোনো কথা কি চেপে গেল?বাড়ীতে ঢুকলেই মা জিজ্ঞেস করবে,কি বললেন ডাক্তারবাবু?নিউকোমিয়াস না কি বললে কিছু বুঝবে মা?