16-04-2020, 09:17 PM
(This post was last modified: 19-04-2020, 05:03 PM by kumdev. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
।।৩।।
মাস্টার মশায়দের বকাঝকা ভর্ৎসনা এতকাল শুনেছি ছেলেদের মধ্যে গা সওয়া হয়ে গেছিল।অনেক সময় কান ধরেও দাড়াতে হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকে কো-এজুকেশন মেয়েরাও থাকবে ভেবে অস্বস্তি হয় মনে।অঞ্চলের সব চেয়ে নামকরা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। বলা যেতে পারে বাবার ইচ্ছেতে। যেবার দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠলাম তখন দময়ন্তী সেন ভর্তি হল আমাদের কলেজে।মনে হয় অন্য কলেজ হতে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে। ভাল ছাত্রী ওর বাবা অঞ্চলের সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার। ওকে দেখলে বুকের মধ্যে কেমন যেন হত।ভয়ে এড়িয়ে চলতাম। একদিন অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে ওর সঙ্গে আলাপ হল।
--তুমি হিজলতলিতে থাকনা? চমকে দিয়ে দময়ন্তী গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে।
আমি আমতা আমতা করছি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। ওকি জানে লেখাপড়ায় আমার মাথা নেই?
--তোমাকে চিনি তুমি তো সরোজ সোমের ভাই?
দাদার পরিচয়ে আমার পরিচয় নিজেকে ছোট মনে হল। বললাম, আমার নাম মনোজমোহন সোম, আপনাকে চিনি আপনি ডাক্তারবাবুর মেয়ে।
খিল খিল করে হেসে উঠল দময়ন্তী যেন হাসির কথা বললাম। গা জ্বলে গেল তাড়াতাড়ি ক্লাসের দিকে রওনা হলাম বিচ্ছু মেয়েদের সঙ্গে যত কম মেশা যায় তত ভাল। ওর নামটা বেশ সুন্দর।
কলেজের প্রার্থনা শেষ হবার পর ক্লাসে যাচ্ছি কটাবাপি গান ধরল 'দম মারো দম..।' দময়ন্তী ঘুরে দাড়াতে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগল কটাবাপি।
--দাঁত মাজোনা? ছ্যতলা পড়ে গেছে। দময়ন্তী বলল।
কটাবাপি অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত করে বাহাদুরি দেখাবার জন্য বলে, তোমায় কিস দেবার আগে দাঁত মেজে নেবো।
কটাবাপি কমরেড কল্যাণ ঘোষের দলের ছেলে। মনে মনে বলি,আমার ইচ্ছেশক্তি প্রখর এই শক্তি বলে আমি অসাধ্য সাধন করতে পারি।দময়ন্তী হয়তো চড় মারতে যাচ্ছিল তার আগেই আমি বললাম, তুমি মেয়েদের সম্মান করতে জানোনা?
--তুই কেরে বডিগার্ড? ফোট--।কটাবাপি পকেট থেকে ছুরি বের করে বলে,আমাকে চিনিস?
দময়ন্তী শিউরে ওঠে বলে, তুমি যাও।
--তুমি যেই হও ফের অসভ্যতা করলে একটি চড়ে তোমার মুখ ভেঙ্গে দেব।
রুখে দাড়াতে ম্যাজিকের মত ফল হল। ঠিক আছে বডিগার্ড চ্যালেঞ্জ রইল।ছুরি পকেটে ঢুকিয়ে কটাবাপি চলে গেল।যেতে যেতে কয়েকবার পিছন ফিরে আমাকে দেখে।
--তুমি কেন এলে তোমাকে কি আমি ডেকেছি?দময়ন্তী বলে।
--কারো ডাকের ধার ধারিনা আমি।হনহন করে ক্লাসে ঢুকে গেলাম। আমার মত হাবাগোবা ছেলের এই আচরণে আশপাশের ছেলেমেয়েরা বিস্মিত। অবশ্য অবাক নিজেও কম হই নি। একটা শক্তির অস্তিত্ব নিজের মধ্যে টের পাই যে আমার নিয়ন্ত্রণে নেই তার ইচ্ছেমত জেগে ওঠে।
উচ্চ-মাধ্যমিক প্রথম বিভাগে পাশ করেও বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম কলেজে। রাস্তাঘাটে কটাপাপির সঙ্গে দেখা হয়েছে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে বদলা নেবার কোন লক্ষণ দেখিনি। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে রাজনীতি করে। গ্রামের রাস্তাঘাটের হাল ভাল নয় কিন্তু দিনে দিনে পার্টির সমৃদ্ধি হচ্ছে।
অনেককে বলতে শুনেছি ছেলেটা দাদার ধারে কাছে যায়নি।মনে মনে ভাবি আমি দাদার মত হতে চাইনা। দাদা এমএসসি পাশ করে গ্রামে আসেনি। শুনেছি কলকাতায় একজন বড় লোকের আনুকূল্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। মাকে দেখে অবাক লাগে তার ছেলে কতদিন বাড়ী আসেনা সেই ব্যাপারে কোন চিন্তা নেই,যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে সারাক্ষণ সংসারের কাজে ডুবে আছে। ভুলক্রমে একটিবারের জন্য দাদার নাম মার মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি।
কলেজ থেকে ফিরে একদিন দেখলাম মার চোখদুটো ফোলা-ফোলা ,কাঁদলে যেমন হয়! তেল মাখা এক বাটি মুড়ির সঙ্গে এক টুকরো পেয়াজ আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে মা বলল,ব্রজবালা আর নেই।
মুড়ি চিবানো বন্ধ হয়ে গেল জিজ্ঞেস করলাম,কোথায় গেছে?
--আখড়ার পাশের ডোবায় লাশ ভেসে উঠেছে। ধরা গলায় মা বলল।
চারদিক ছায়া নেমে এল।বাদলের আগে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেলে যেমন হয়।
মা বলল, অনেক বেলায় পুলিশ এল,গ্রামের লোক ভেঙ্গে পড়েছিল।তুই তখন কলেজে,পার্টির লোকেরাও এসেছিল। লোকে নানা রকম সন্দেহ করছে।কে ওকে মারল কারো তো কোন ক্ষতি করেনি।
নিজের ঘরে গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে চোখ বুজলাম।মনে পড়ল একদিনের কথা।ব্রজদি স্নান করে বুক অবধি কাপড় জড়ানো আমাকে দেখে হেসে বলল,এদিকে এসো তোমার কথাই ভাবছিলাম।
কাছে যেতে বুকের কাপড় সরিয়ে আমার মুখ ব্রজদির বুকে চেপে বলল,শরীল একেবারে জুড়িয়ে গেল গো।
আমার গালে সদ্য স্নাত ভিজে বুকের শীতল স্পর্শ জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমায় এত ভালোবাসো কেন?
তার উত্তরে বোজোদি বলেছিল,ভালবাসি আবার ভক্তিও করি।ভক্তি বিনে ভালবাসা যায় নাকি?হঠাৎ গান ধরে--'গোসাই-ই-ই!তোমার বুকে রাখলে মাথা /ভুলে যাই গো বুকের ব্যথা...।তারপর গান থামিয়ে বলতো, গোসাই একদিন আমাদের মিলন হবে দেখে নিও।ঠোটে ঠোত রেখে চুমু খেল।চোখের কোল গড়িয়ে জল পড়ে। মিলনের আগেই বিচ্ছেদ হয়ে গেল বোজোদি,অপুর্ন আশা নিয়ে তুমি আজ কোথায় জানিনা।
লোকমুখে শুনেছি খুনের আগে আততায়ীরা বোজোদিকে ''. করেছিল। মেয়েদের কারো সঙ্গে শত্রুতা করতে হয়না তাদের শরীর তাদের শত্রু। ভ্যাদলা মুলের গন্ধ ভুলতে পারিনি এখনো।
তিন দিনের মাথায় মা আমাকে একশো টাকা দিয়ে বলল,আমার একটা কথা রাখবি বাবা? রুপাইয়ের ঘাটে গিয়ে ব্রজবালার নামে একটা ভুজ্জি দিয়ে আয়।তোকে খুব ভালবাসত তোর পিণ্ডি পেলে ওর আত্মা শান্তি পাবে।
ক-বছর আগেও আমাদের হিজলতলি ছিল শান্ত নির্জন।গাছপালা ফাকা জায়গা পুকুর মাঠ নির্মল বাতাস। সবাই চিনতো সবাইকে বিয়ে পার্বণে পরস্পর নিমন্ত্রিত হত বাড়িতে। হঠাৎ কি যে হল কাঁহা-কাঁহা মুলুক থেকে লোকজন এসে পালটে দিল হিজলতলির চরিত্র। রাস্তায় বাজারে স্টেশনে কিলবিল করছে লোক। রাস্তার ধার ধার গজিয়ে উঠছে ব্যাঙ্গের ছাতার মত দোকান।পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পার্টির রমরমা। কল্যাণ ঘোষ আর রঞ্জিত দাসের রেশারেশি। এই সুযোগে দালাল প্রোমোটারের দাপট বাড়ছে পার্টির ছত্রছায়ায়।কেউ কেউ এখান থেকে রোজগার করতে কলকাতায় যায়। শেষ ট্রেনে ঝিমোতে ঝিমোতে বাড়ী ফেরে। বাবার শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছেনা।শ্বাস কষ্ট বেড়েছে এই বয়সে সহ্য হচ্ছেনা ভীড় ট্রেনে যাতায়াতের ধকল। নানা অজুহাতে অফিস কামাই করছেন।
এ অঞ্চলে নাম করা ডাক্তার দিবানাথ সেন। সন্ধ্যে বেলা ডাক্তার সেনের চেম্বারে গেছিলাম নাম লেখাতে।পরশুদিন যেতে হবে। ভীষণ ভীড় অন্য অঞ্চল থেকেও লোকজন আসে দেখাতে। আগে থেকে নাম লেখাতে হয়।ডাক্তার সেনের মেয়েও কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যালে ডাক্তারি পড়ে,ট্রেনের নিত্য যাত্রী। ভাবছি একবার বান্ধব সমিতি ঘুরে যাই। বরেনদার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। হঠাৎ পাশ ঘেঁষে হুশ করে একটা বাইক চলে গেল।তাকিয়ে দেখলাম কেলোর বাইকের পিছনে রমেশদার বউ। রমেশদার বউ মলিনা বৌদিকে কেউ ভাল চোখে দেখেনা। উগ্র টাইপ চাল-চলন।রমেশ কর্মকার কলকাতায় সোনার দোকানে কাজ করে। পুর্ব বাংলা থেকে এসে হিজলতলিতে ঠাই গেড়েছে।
কারো বাপ-মা ছেলের নাম কখনো কেলো দেয়? হয়তো ওর নাম কালাচাঁদ বা কালিচরন। ছেলেটার আসল নাম কেউ জানেনা অঞ্চলে নতুন আমদানি, কল্যাণ ঘোষের পার্টির ছেলে। বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভাল নয় কি ভাবে বাইক জোগাড় করে এরা আমার কাছে গভীর রহস্য।
বরেনদা বলেন, এইসব নিয়ে তোর ভাবার দরকার নেই। ভাবার মত আরও অনেক বিষয় আছে। পাখির মত দূর থেকে দ্যাখ সবকিছু। পাখি যখন আকাশে ওড়ে তখন অনেকটা দেখতে পায়। মানচিত্রে হিজলতলি ছোট্ট একটা ফুটকি।লাইব্রেরিতে বসে সারাক্ষণ বই পড়েন বরেনদা। জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা বরেনদা বই পড়তে পড়তে তোমার ঘুম পায়না?
--মনের মত বিষয় না হলে ঘুম তো পাবেই। হেসে বলেন বরেনদা। শোন তোকে একটা কথা বলি, মানিয়ে নিয়ে চলতে শেখ চমকে যাবিনা। হঠাৎ কিছু ঘটছে মনে হলেও জানবি কোন কিছু হঠাৎ ঘটেনা। তার আগে একটা প্রস্তুতি থাকে। সেই প্রস্তুতির খবর জানা না থাকলে এরকম মনে হয়, আমরা চমকে উঠি।
--তুমি বলছ কটাবাপিরা যা করছে সব চুপচাপ মানিয়ে নিতে হবে?
--তুই দেখছি কটা বাপির কথা এখনো ভুলতে পারিস নি? শোন মনি, আমি সেকথা বলিনি। তুই আমার কথা বুঝতে পারিস নি। আমি বলছি বিশে কেলে কটা বাপি সমাজ বিবর্তনের অনিবার্য ফসল। অন্যায়কে আমি কখনো মেনে নিতে বলিনি। রাত হল এবার ভাগ।
দেওয়ালের ঘড়িতে দেখলাম নটা বাজে-বাজে। এরমধ্যেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে হিজলতলি। বরেনদার কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ফিরছি। পৃথিবীতে থেকে বুঝতে পারিনা দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটা কমলা লেবু।যত পড়ি চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গিয়ে নতুন জগতের সন্ধান দেয়। সুনসান নির্জন পথ,মাঠের মধ্যে দিয়ে গেলে পথ সংক্ষিপ্ত হয়। মনে হল কে যেন ডাকছে?
থমকে দাঁড়িয়ে দেখলাম আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে মলিনাবৌদি।একটু আগে দেখলাম কেলোর বাইকে চেপে কোথায় যাচ্ছিল।
--এতরাতে তুমি এখানে?
--কার কথা ভাবতেছো? তখন থেকে ডাকতেছি শুনতে পাওনা?
কোমর বেকিয়ে অজন্তা স্টাইলে দাড়িয়েছে। গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করি, কি বলছিলে বলো?
--আমার একখান কাজ কইরা দিবা? আমাকে দেখলেই সবার কাজের কথা মনে পড়ে। বিরক্ত হয়ে বললাম,কি কাজ?
এদিক-ওদিক বার কয়েক দেখে কাপড়টা হাঁটু পর্যন্ত তুলে ভিতর থেকে একটা কাপড়ের পুটুলি এগিয়ে দিয়ে বলল, মনা এইটা তুমার কাছে রাখবা? পরে একসময় চাইয়া নিমু।
--কি আছে এতে?
--ম্যালা কথা পরে শুইনো। যারে তারে ত বিশ্বাস কইরা দেওন যায়না।
মলিনাবৌদির কাছ থেকে পুটুলিটা নিলাম,আধ কিলোর মত ভারী হবে। আমাকে দেখলে কি সাধুপুরুষ মনে হয়? সবাই আমাকে হাবাগোবা মনে করে জানতাম।
মাস্টার মশায়দের বকাঝকা ভর্ৎসনা এতকাল শুনেছি ছেলেদের মধ্যে গা সওয়া হয়ে গেছিল।অনেক সময় কান ধরেও দাড়াতে হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকে কো-এজুকেশন মেয়েরাও থাকবে ভেবে অস্বস্তি হয় মনে।অঞ্চলের সব চেয়ে নামকরা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। বলা যেতে পারে বাবার ইচ্ছেতে। যেবার দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠলাম তখন দময়ন্তী সেন ভর্তি হল আমাদের কলেজে।মনে হয় অন্য কলেজ হতে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে। ভাল ছাত্রী ওর বাবা অঞ্চলের সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার। ওকে দেখলে বুকের মধ্যে কেমন যেন হত।ভয়ে এড়িয়ে চলতাম। একদিন অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে ওর সঙ্গে আলাপ হল।
--তুমি হিজলতলিতে থাকনা? চমকে দিয়ে দময়ন্তী গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে।
আমি আমতা আমতা করছি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। ওকি জানে লেখাপড়ায় আমার মাথা নেই?
--তোমাকে চিনি তুমি তো সরোজ সোমের ভাই?
দাদার পরিচয়ে আমার পরিচয় নিজেকে ছোট মনে হল। বললাম, আমার নাম মনোজমোহন সোম, আপনাকে চিনি আপনি ডাক্তারবাবুর মেয়ে।
খিল খিল করে হেসে উঠল দময়ন্তী যেন হাসির কথা বললাম। গা জ্বলে গেল তাড়াতাড়ি ক্লাসের দিকে রওনা হলাম বিচ্ছু মেয়েদের সঙ্গে যত কম মেশা যায় তত ভাল। ওর নামটা বেশ সুন্দর।
কলেজের প্রার্থনা শেষ হবার পর ক্লাসে যাচ্ছি কটাবাপি গান ধরল 'দম মারো দম..।' দময়ন্তী ঘুরে দাড়াতে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগল কটাবাপি।
--দাঁত মাজোনা? ছ্যতলা পড়ে গেছে। দময়ন্তী বলল।
কটাবাপি অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত করে বাহাদুরি দেখাবার জন্য বলে, তোমায় কিস দেবার আগে দাঁত মেজে নেবো।
কটাবাপি কমরেড কল্যাণ ঘোষের দলের ছেলে। মনে মনে বলি,আমার ইচ্ছেশক্তি প্রখর এই শক্তি বলে আমি অসাধ্য সাধন করতে পারি।দময়ন্তী হয়তো চড় মারতে যাচ্ছিল তার আগেই আমি বললাম, তুমি মেয়েদের সম্মান করতে জানোনা?
--তুই কেরে বডিগার্ড? ফোট--।কটাবাপি পকেট থেকে ছুরি বের করে বলে,আমাকে চিনিস?
দময়ন্তী শিউরে ওঠে বলে, তুমি যাও।
--তুমি যেই হও ফের অসভ্যতা করলে একটি চড়ে তোমার মুখ ভেঙ্গে দেব।
রুখে দাড়াতে ম্যাজিকের মত ফল হল। ঠিক আছে বডিগার্ড চ্যালেঞ্জ রইল।ছুরি পকেটে ঢুকিয়ে কটাবাপি চলে গেল।যেতে যেতে কয়েকবার পিছন ফিরে আমাকে দেখে।
--তুমি কেন এলে তোমাকে কি আমি ডেকেছি?দময়ন্তী বলে।
--কারো ডাকের ধার ধারিনা আমি।হনহন করে ক্লাসে ঢুকে গেলাম। আমার মত হাবাগোবা ছেলের এই আচরণে আশপাশের ছেলেমেয়েরা বিস্মিত। অবশ্য অবাক নিজেও কম হই নি। একটা শক্তির অস্তিত্ব নিজের মধ্যে টের পাই যে আমার নিয়ন্ত্রণে নেই তার ইচ্ছেমত জেগে ওঠে।
উচ্চ-মাধ্যমিক প্রথম বিভাগে পাশ করেও বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম কলেজে। রাস্তাঘাটে কটাপাপির সঙ্গে দেখা হয়েছে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে বদলা নেবার কোন লক্ষণ দেখিনি। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে রাজনীতি করে। গ্রামের রাস্তাঘাটের হাল ভাল নয় কিন্তু দিনে দিনে পার্টির সমৃদ্ধি হচ্ছে।
অনেককে বলতে শুনেছি ছেলেটা দাদার ধারে কাছে যায়নি।মনে মনে ভাবি আমি দাদার মত হতে চাইনা। দাদা এমএসসি পাশ করে গ্রামে আসেনি। শুনেছি কলকাতায় একজন বড় লোকের আনুকূল্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। মাকে দেখে অবাক লাগে তার ছেলে কতদিন বাড়ী আসেনা সেই ব্যাপারে কোন চিন্তা নেই,যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে সারাক্ষণ সংসারের কাজে ডুবে আছে। ভুলক্রমে একটিবারের জন্য দাদার নাম মার মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি।
কলেজ থেকে ফিরে একদিন দেখলাম মার চোখদুটো ফোলা-ফোলা ,কাঁদলে যেমন হয়! তেল মাখা এক বাটি মুড়ির সঙ্গে এক টুকরো পেয়াজ আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে মা বলল,ব্রজবালা আর নেই।
মুড়ি চিবানো বন্ধ হয়ে গেল জিজ্ঞেস করলাম,কোথায় গেছে?
--আখড়ার পাশের ডোবায় লাশ ভেসে উঠেছে। ধরা গলায় মা বলল।
চারদিক ছায়া নেমে এল।বাদলের আগে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেলে যেমন হয়।
মা বলল, অনেক বেলায় পুলিশ এল,গ্রামের লোক ভেঙ্গে পড়েছিল।তুই তখন কলেজে,পার্টির লোকেরাও এসেছিল। লোকে নানা রকম সন্দেহ করছে।কে ওকে মারল কারো তো কোন ক্ষতি করেনি।
নিজের ঘরে গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে চোখ বুজলাম।মনে পড়ল একদিনের কথা।ব্রজদি স্নান করে বুক অবধি কাপড় জড়ানো আমাকে দেখে হেসে বলল,এদিকে এসো তোমার কথাই ভাবছিলাম।
কাছে যেতে বুকের কাপড় সরিয়ে আমার মুখ ব্রজদির বুকে চেপে বলল,শরীল একেবারে জুড়িয়ে গেল গো।
আমার গালে সদ্য স্নাত ভিজে বুকের শীতল স্পর্শ জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমায় এত ভালোবাসো কেন?
তার উত্তরে বোজোদি বলেছিল,ভালবাসি আবার ভক্তিও করি।ভক্তি বিনে ভালবাসা যায় নাকি?হঠাৎ গান ধরে--'গোসাই-ই-ই!তোমার বুকে রাখলে মাথা /ভুলে যাই গো বুকের ব্যথা...।তারপর গান থামিয়ে বলতো, গোসাই একদিন আমাদের মিলন হবে দেখে নিও।ঠোটে ঠোত রেখে চুমু খেল।চোখের কোল গড়িয়ে জল পড়ে। মিলনের আগেই বিচ্ছেদ হয়ে গেল বোজোদি,অপুর্ন আশা নিয়ে তুমি আজ কোথায় জানিনা।
লোকমুখে শুনেছি খুনের আগে আততায়ীরা বোজোদিকে ''. করেছিল। মেয়েদের কারো সঙ্গে শত্রুতা করতে হয়না তাদের শরীর তাদের শত্রু। ভ্যাদলা মুলের গন্ধ ভুলতে পারিনি এখনো।
তিন দিনের মাথায় মা আমাকে একশো টাকা দিয়ে বলল,আমার একটা কথা রাখবি বাবা? রুপাইয়ের ঘাটে গিয়ে ব্রজবালার নামে একটা ভুজ্জি দিয়ে আয়।তোকে খুব ভালবাসত তোর পিণ্ডি পেলে ওর আত্মা শান্তি পাবে।
ক-বছর আগেও আমাদের হিজলতলি ছিল শান্ত নির্জন।গাছপালা ফাকা জায়গা পুকুর মাঠ নির্মল বাতাস। সবাই চিনতো সবাইকে বিয়ে পার্বণে পরস্পর নিমন্ত্রিত হত বাড়িতে। হঠাৎ কি যে হল কাঁহা-কাঁহা মুলুক থেকে লোকজন এসে পালটে দিল হিজলতলির চরিত্র। রাস্তায় বাজারে স্টেশনে কিলবিল করছে লোক। রাস্তার ধার ধার গজিয়ে উঠছে ব্যাঙ্গের ছাতার মত দোকান।পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পার্টির রমরমা। কল্যাণ ঘোষ আর রঞ্জিত দাসের রেশারেশি। এই সুযোগে দালাল প্রোমোটারের দাপট বাড়ছে পার্টির ছত্রছায়ায়।কেউ কেউ এখান থেকে রোজগার করতে কলকাতায় যায়। শেষ ট্রেনে ঝিমোতে ঝিমোতে বাড়ী ফেরে। বাবার শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছেনা।শ্বাস কষ্ট বেড়েছে এই বয়সে সহ্য হচ্ছেনা ভীড় ট্রেনে যাতায়াতের ধকল। নানা অজুহাতে অফিস কামাই করছেন।
এ অঞ্চলে নাম করা ডাক্তার দিবানাথ সেন। সন্ধ্যে বেলা ডাক্তার সেনের চেম্বারে গেছিলাম নাম লেখাতে।পরশুদিন যেতে হবে। ভীষণ ভীড় অন্য অঞ্চল থেকেও লোকজন আসে দেখাতে। আগে থেকে নাম লেখাতে হয়।ডাক্তার সেনের মেয়েও কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যালে ডাক্তারি পড়ে,ট্রেনের নিত্য যাত্রী। ভাবছি একবার বান্ধব সমিতি ঘুরে যাই। বরেনদার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। হঠাৎ পাশ ঘেঁষে হুশ করে একটা বাইক চলে গেল।তাকিয়ে দেখলাম কেলোর বাইকের পিছনে রমেশদার বউ। রমেশদার বউ মলিনা বৌদিকে কেউ ভাল চোখে দেখেনা। উগ্র টাইপ চাল-চলন।রমেশ কর্মকার কলকাতায় সোনার দোকানে কাজ করে। পুর্ব বাংলা থেকে এসে হিজলতলিতে ঠাই গেড়েছে।
কারো বাপ-মা ছেলের নাম কখনো কেলো দেয়? হয়তো ওর নাম কালাচাঁদ বা কালিচরন। ছেলেটার আসল নাম কেউ জানেনা অঞ্চলে নতুন আমদানি, কল্যাণ ঘোষের পার্টির ছেলে। বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভাল নয় কি ভাবে বাইক জোগাড় করে এরা আমার কাছে গভীর রহস্য।
বরেনদা বলেন, এইসব নিয়ে তোর ভাবার দরকার নেই। ভাবার মত আরও অনেক বিষয় আছে। পাখির মত দূর থেকে দ্যাখ সবকিছু। পাখি যখন আকাশে ওড়ে তখন অনেকটা দেখতে পায়। মানচিত্রে হিজলতলি ছোট্ট একটা ফুটকি।লাইব্রেরিতে বসে সারাক্ষণ বই পড়েন বরেনদা। জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা বরেনদা বই পড়তে পড়তে তোমার ঘুম পায়না?
--মনের মত বিষয় না হলে ঘুম তো পাবেই। হেসে বলেন বরেনদা। শোন তোকে একটা কথা বলি, মানিয়ে নিয়ে চলতে শেখ চমকে যাবিনা। হঠাৎ কিছু ঘটছে মনে হলেও জানবি কোন কিছু হঠাৎ ঘটেনা। তার আগে একটা প্রস্তুতি থাকে। সেই প্রস্তুতির খবর জানা না থাকলে এরকম মনে হয়, আমরা চমকে উঠি।
--তুমি বলছ কটাবাপিরা যা করছে সব চুপচাপ মানিয়ে নিতে হবে?
--তুই দেখছি কটা বাপির কথা এখনো ভুলতে পারিস নি? শোন মনি, আমি সেকথা বলিনি। তুই আমার কথা বুঝতে পারিস নি। আমি বলছি বিশে কেলে কটা বাপি সমাজ বিবর্তনের অনিবার্য ফসল। অন্যায়কে আমি কখনো মেনে নিতে বলিনি। রাত হল এবার ভাগ।
দেওয়ালের ঘড়িতে দেখলাম নটা বাজে-বাজে। এরমধ্যেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে হিজলতলি। বরেনদার কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ফিরছি। পৃথিবীতে থেকে বুঝতে পারিনা দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটা কমলা লেবু।যত পড়ি চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গিয়ে নতুন জগতের সন্ধান দেয়। সুনসান নির্জন পথ,মাঠের মধ্যে দিয়ে গেলে পথ সংক্ষিপ্ত হয়। মনে হল কে যেন ডাকছে?
থমকে দাঁড়িয়ে দেখলাম আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে মলিনাবৌদি।একটু আগে দেখলাম কেলোর বাইকে চেপে কোথায় যাচ্ছিল।
--এতরাতে তুমি এখানে?
--কার কথা ভাবতেছো? তখন থেকে ডাকতেছি শুনতে পাওনা?
কোমর বেকিয়ে অজন্তা স্টাইলে দাড়িয়েছে। গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করি, কি বলছিলে বলো?
--আমার একখান কাজ কইরা দিবা? আমাকে দেখলেই সবার কাজের কথা মনে পড়ে। বিরক্ত হয়ে বললাম,কি কাজ?
এদিক-ওদিক বার কয়েক দেখে কাপড়টা হাঁটু পর্যন্ত তুলে ভিতর থেকে একটা কাপড়ের পুটুলি এগিয়ে দিয়ে বলল, মনা এইটা তুমার কাছে রাখবা? পরে একসময় চাইয়া নিমু।
--কি আছে এতে?
--ম্যালা কথা পরে শুইনো। যারে তারে ত বিশ্বাস কইরা দেওন যায়না।
মলিনাবৌদির কাছ থেকে পুটুলিটা নিলাম,আধ কিলোর মত ভারী হবে। আমাকে দেখলে কি সাধুপুরুষ মনে হয়? সবাই আমাকে হাবাগোবা মনে করে জানতাম।