30-03-2020, 11:24 AM
(Update No. 255)
অজিত বয়স্কা তিন মহিলাকে প্রণাম করবার পর উঠোনের এক পাশে তুলসী তলায় এসে একটা জায়গায় হাঁটু গেঁড়ে বসে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করে উঠে বসতেই রতীশ আর রচনা দু’জনেই তার দিকে অবাক চোখে চাইতে সীমাদেবী রচনার ছেলেকে কোলে তুলে বললেন, “ওকে দেখে অবাক হচ্ছ বড়বৌমা? প্রথম দিন ওকে আমাদের বাড়িতে দেখে আমরাও এমনই অবাক হয়েছিলুম। মন্তি চলে যাবার পর থেকে ও যেদিনই রাজগঞ্জে আসে সেদিনই আমাদের বাড়ি এসে তুলসীতলার পাশে ঠিক ওই জায়গাটায় একটা প্রণাম না করে ও রাজগঞ্জ ছেড়ে যায় না” বলে অজিতের উদ্দেশ্যে বললেন, “অজিত, তুমি ওই বারান্দার চেয়ারটাতে বসো বাবা। একটু চা খেয়ে যেও। আর মনে রেখো, বাড়ির কর্তারা কিন্তু সকলেই তোমার ওপর সমস্ত দায়ভাড় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন। বড়খোকা তো এই মাত্র এল।”।
অজিতের মুখের হাসিটা যেন হঠাতই মিলিয়ে গেল। শুকনো মুখে সে জবাব দিল, “না মেজমা ভুলব না। বড়বাবু, মেজোবাবুরা তো সব কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকে আগেই। বাড়িতে ঢোকবার আগেই তো দেখে এলাম, প্যান্ডেলের স্ট্রাকচার হয়ে গেছে। প্যান্ডেলের বাকি যেটুকু কাজ আছে তা তো একবেলাতেই শেষ করে ফেলবে ওরা। তবু যাবার সময় ওদের আরেকটু ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে যাব। আর এদিকের কাজটার জন্যেও কাল সকালেই লোক চলে আসবে। আর বড়দাও তো এসে গেছেন। কাল সকালে আমি দুটো গাড়ি নিয়ে চলে আসব। আসবার সময় পরিতোষ স্যারদের আমার গাড়িতেই নিয়ে আসব। তারপরই কোমড় বেঁধে লেগে পড়ব কাজে”।
চন্দু রচনার হাত ধরে তাকে একটা ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “বৌমণি, এসো ঘরে এসো”।
রচনা চন্দ্রিকাকে নিয়ে ঘরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, “চন্দু, তোমার মেজদা মেজোবৌমণির তো আজই আসবার কথা। ওনারা কখন আসছেন, কিছু শুনেছ”?
চন্দ্রিকা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দিল, “মেজোবৌমণি নয় বৌমণি। আমার বৌমণি শুধু তুমি। উনি শুধু আমার মেজোবৌদি। তবে মেজদা আর মেজবৌদি আজ রাতে আসবেন”।
অজিতের পাশে একটা চেয়ারে রতীশ বসতেই অজিত তাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বড়দা, দিদি তো আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গত বছর ২১শে আগস্ট। তার বছর পূর্তি তো ২১ তারিখেই হওয়া উচিৎ। তাহলে তার বাৎসরিকীর এ অনুষ্ঠানটা ১৪ তারিখে করা হচ্ছে কেন”?
এমন সময় বাড়ির রান্নার লোক মমতাদি এসে রতীশ আর অজিতের হাতে খাবারের প্লেট গেল। রতীশ হাত মুখ না ধুয়ে খাবে না বলাতে মমতা অজিতের হাতে একটা প্লেট দিয়ে চলে যেতে রতীশ বলল, “তারিখ হিসেবে ধরলে তো সেটাই হওয়া উচিৎ ছিল ভাই। কিন্তু বাৎসরিক শ্রাদ্ধটা তিথি মিলিয়ে করতে হয় তো। তিথি মিলিয়ে ঠাকুর মশাইয়ের বিধান হিসেবে ১৪ তারিখেই সেটা করা হচ্ছে”।
সেদিন রাতে গঙ্গারামপুর থেকে সতীশ আর তার স্ত্রী দেবাংশী এসে পৌছালো। সতীশ সেখানেই একটা ব্যাঙ্কে চাকরী করে। বিয়ের পর তার স্ত্রীকে নিয়ে সে সেখানেই থাকে। পরদিন সকালে প্রথমেই এল মহিমা, বীথিকা, পরিতোষ, অর্চনা আর তাদের ছ’মাসের ছেলে প্রত্যুষ। তাদের সঙ্গে আব্দুলের স্ত্রী প্রীতি আর ডক্টর দিব্যেন্দুর স্ত্রী দীপাও এল। দীপার মেয়ে আকাঙ্ক্ষা তখন একটা কোচিং নিতে দিল্লীতে ছিল বলে তার আসা সম্ভব হয়নি। সেজন্যে তার মন খুব খারাপ। দুপুরের আগে আগেই আলিপুরদুয়ার থেকে সুলোচনা, শ্যামলেন্দু, দেবিকা, অমলেন্দু আর কালচিনি থেকে বিধুবাবু, বিভাদেবী আর নবনীতা এসে পৌছালো। সন্ধ্যের আগে শিলিগুড়ি থেকে কিংশুকও এসে হাজির হল। সে তখন পলিটিকাল সায়েন্সে মাস্টার্স করবার সাথে সাথে আইএএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিংশুক মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার দিদিভাইকে দেওয়া কথা তাকে রাখতেই হবে।
অজিতের তত্ত্বাবধানে বাড়ির পাশের বাগানে বেশ বড়সড় একটা প্যান্ড্যাল বানানো হল। আর বাইরে বাড়ির মেইন গেট থেকে তুলসী তলার চার পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে একটা প্যাসেজের মত বানিয়ে পেছনের প্যান্ড্যালের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। তুলসী তলার চার পাশে একটা সাত আট ফুট ব্যাসার্ধের বৃত্ত রচনা করে ডেকারেটাররা কাপড়ের ঘেরাও দিয়ে প্যাসেজটা বানিয়েছিল।
বিকেলে দিল্লী থেকে এক সাপ্লায়ার কোম্পানীর বিশেষ একটা গাড়িতে মহিমার অর্ডার দেওয়া একটা বিশেষ জিনিস এসে পৌছালো। গত বছর ২১শে আগস্ট বিকেলে, তুলসী তলার পাশে যে জায়গাটিতে সীমন্তিনীর প্রাণহীন দেহটাকে শুইয়ে শেষ বারের মত তার কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় ফুলের মালা দিয়ে, বাড়ির সকলে মিলে তাদের শেষ আশীর্বাদ আর ভালবাসার অর্ঘ্য দিয়েছিল, সেই জায়গাটাকে চারদিক ঘিরে নিয়ে সারা রাত ধরে সেখানে তারা কাজ করে গেল। একমাত্র মহিমাই সারা রাত তাদের কাজের তদারকি করে গেছে। সকালে বাড়ির লোকেরা ঘুম থেকে উঠে দেখল, দু’ফুট চওড়া আর চার ফুট উচ্চতার কিছু একটাকে সুন্দর রূপোলী রাংতা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির অনেকেই যদিও আগে থেকেই জানতেন যে মহিমা সেখানে তাদের সকলের অনুমতি নিয়ে কী করতে চলেছে, তারা জিনিসটা সম্বন্ধে কেউই তেমন অবহিত ছিলেন না। কিন্তু রচনা আর মহিমার অনুরোধে বাড়ির কেউ কোনও আপত্তি করেননি।
সকালে শ্রাদ্ধের কাজের সবরকম আয়োজন গুছিয়ে নেবার পর পুরোহিত যখন সীমন্তিনীর একটা ছবি চাইলেন, তখন মহিমার ঈশারা পেয়ে রচনা সীমাদেবী আর শশীকান্তবাবুকে হাত ধরে বৃত্তের মাঝখানে রাংতায় মোড়া জিনিসটার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল, “মেজোমা, মেজকাকু, তোমরা দুজনে মিলে এটার ওপর থেকে রাংতার মোড়কটা খুলে দাও। তাহলে আমাদের দিদিভাইয়ের আত্মা পরম শান্তি পাবে” বলে পেছনদিকে দাঁড়িয়ে থাকা অর্চনাকে ঈশারা করতেই অর্চনা, পরিতোষ, রতীশ, মহিমা আর বীথিকা মিলে সকল আত্মীয় স্বজনকে সেই বৃত্তের চারদিকে এনে দাঁড় করালো। সীমাদেবী নিজের জলে ভরা দুটো চোখ মুছে নিয়ে রাংতার আচ্ছাদন খুলতে লাগলেন। শশীকান্তবাবুও হাত লাগালেন। রাংতার আবরণ সরে যেতেই দেখা গেল দু’ ফুট বাই চার ফুট বাই চার ইঞ্চি একটা কৃস্টাল ব্লকের ভেতরে পুলিশের ইউনিফর্মে সীমন্তিনী স্যালিউট দেবার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক থেকেই একই ছবি দেখা যাচ্ছিল। ব্লকটার ঠিক তলায় সাদা রঙের চিনেমাটির একটা ডিম্বাকার বেদী। আর সেই বেদীর ওপর লেখাঃ-
সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি
জন্মঃ ১৪ অক্টোবর ১৯৮৪
মৃত্যুঃ ২১ আগস্ট ২০১৫
অর্চনা, নবনীতা, মহিমা আর চন্দ্রিকা মিলে কৃষ্টাল ব্লকটার চারদিকে বড় বড় রজনীগন্ধা আর গাঁদা ফুলের মালা ঝুলিয়ে দিল।
বাড়ির কর্তারা কিংবা সদস্যরাও অজিতের এমন একটা প্যাসেজ বানাবার যৌক্তিকতা বুঝতে পারেনি প্রথমে। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই যখন দলে দলে লোক এসে সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করল, তখন সবাই মনে মনে অজিতের প্রসংশা না করে পারল না। অমন ব্যবস্থা আগে থেকে না করে রাখলে পরে জনতার ভিড়কে সামাল দিতে খুব বেগ পেতে হত। বাড়ির মেইন গেটের একদিকে যেখান থেকে প্যাসেজটার শুরু হয়েছে সেখানে প্রচুর পরিমানে গোলাপ এবং রজনীগন্ধা ফুলের সম্ভার রাখা হয়েছিল। যারা সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল তারা সকলেই সেখান থেকে ফুল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিল। সুশৃঙ্খল ভাবে বাইরে থেকে ওই প্যাসেজ দিয়ে ভেতরে ঢুকেই সকলে সীমন্তিনীর প্রতিচ্ছবিটি দেখতে দেখতে সেখানে ফুল অর্পন করে ভেজা চোখে জোড়হাতে প্রণাম করে বৃত্তাকার পথ অনুসরন করেই পেছনের বাগানে তৈরী করা প্যান্ড্যালে চলে যাচ্ছিল। সেখানে আগে থেকেই ক্যাটারাররা নানাবিধ খাবারের আয়োজন পসরা সাজিয়ে রেখেছিল। যার যার পছন্দমত খাবার খেয়ে সেখান থেকেই আরেক প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে বাড়ির মেইন গেটের অন্য পাশ দিয়ে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাড়ির ভেতরের লোকেদের ভিড়ে কোন রকম ভাবে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়নি। রাত সাড়ে এগারোটা অব্দি লোকজনের যাতায়াত অব্যাহত ছিল।
সন্ধ্যের সময় বাড়ির সকলেই বেদীটার চারধারে একটা একটা করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল। রচনা প্রদীপ জ্বালিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে রতীশ আর ছেলের সাথে সীমন্তিনীকে প্রণাম করে অস্ফুটকণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, “তুমি ভাল থেকো দিদিভাই। আর এই পরিবার আর তোমার এই ছেলে মেয়েগুলোকে দেখে রেখো”। চারপাশে বসে থাকা সকলের চোখ থেকেই অশ্রুধারা বেয়ে নামছে। সকলেই জলভরা চোখে মনে মনে সীমন্তিনীর আত্মার শান্তি কামনা করল।
রচনা তার ছেলেকে সীমন্তিনীকে ‘বড়মামনি’ বলে ডাকতে শিখিয়েছে। রচনা তার কোলের মেয়েটার নাম রেখেছে মন্তিশ্রী। অর্চনা আর পরিতোষেরও ইচ্ছে তাদের ছেলে প্রত্যুষের মুখে বুলি ফুটলে তারাও তাকে সীমন্তিনীকে বড়মামনি বলে ডাকতে শেখাবে। ছোট্ট যিষ্ণু সীমন্তিনীর প্রতিচ্ছবিকে প্রণাম করে বলল, “ভাল থেকো বড়মামনি”।
ভাল থাকবেন আপনারাও সবাই।
শুভমস্তু
______________________________
ss_sexy
অজিত বয়স্কা তিন মহিলাকে প্রণাম করবার পর উঠোনের এক পাশে তুলসী তলায় এসে একটা জায়গায় হাঁটু গেঁড়ে বসে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করে উঠে বসতেই রতীশ আর রচনা দু’জনেই তার দিকে অবাক চোখে চাইতে সীমাদেবী রচনার ছেলেকে কোলে তুলে বললেন, “ওকে দেখে অবাক হচ্ছ বড়বৌমা? প্রথম দিন ওকে আমাদের বাড়িতে দেখে আমরাও এমনই অবাক হয়েছিলুম। মন্তি চলে যাবার পর থেকে ও যেদিনই রাজগঞ্জে আসে সেদিনই আমাদের বাড়ি এসে তুলসীতলার পাশে ঠিক ওই জায়গাটায় একটা প্রণাম না করে ও রাজগঞ্জ ছেড়ে যায় না” বলে অজিতের উদ্দেশ্যে বললেন, “অজিত, তুমি ওই বারান্দার চেয়ারটাতে বসো বাবা। একটু চা খেয়ে যেও। আর মনে রেখো, বাড়ির কর্তারা কিন্তু সকলেই তোমার ওপর সমস্ত দায়ভাড় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন। বড়খোকা তো এই মাত্র এল।”।
অজিতের মুখের হাসিটা যেন হঠাতই মিলিয়ে গেল। শুকনো মুখে সে জবাব দিল, “না মেজমা ভুলব না। বড়বাবু, মেজোবাবুরা তো সব কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকে আগেই। বাড়িতে ঢোকবার আগেই তো দেখে এলাম, প্যান্ডেলের স্ট্রাকচার হয়ে গেছে। প্যান্ডেলের বাকি যেটুকু কাজ আছে তা তো একবেলাতেই শেষ করে ফেলবে ওরা। তবু যাবার সময় ওদের আরেকটু ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে যাব। আর এদিকের কাজটার জন্যেও কাল সকালেই লোক চলে আসবে। আর বড়দাও তো এসে গেছেন। কাল সকালে আমি দুটো গাড়ি নিয়ে চলে আসব। আসবার সময় পরিতোষ স্যারদের আমার গাড়িতেই নিয়ে আসব। তারপরই কোমড় বেঁধে লেগে পড়ব কাজে”।
চন্দু রচনার হাত ধরে তাকে একটা ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “বৌমণি, এসো ঘরে এসো”।
রচনা চন্দ্রিকাকে নিয়ে ঘরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, “চন্দু, তোমার মেজদা মেজোবৌমণির তো আজই আসবার কথা। ওনারা কখন আসছেন, কিছু শুনেছ”?
চন্দ্রিকা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দিল, “মেজোবৌমণি নয় বৌমণি। আমার বৌমণি শুধু তুমি। উনি শুধু আমার মেজোবৌদি। তবে মেজদা আর মেজবৌদি আজ রাতে আসবেন”।
অজিতের পাশে একটা চেয়ারে রতীশ বসতেই অজিত তাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বড়দা, দিদি তো আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গত বছর ২১শে আগস্ট। তার বছর পূর্তি তো ২১ তারিখেই হওয়া উচিৎ। তাহলে তার বাৎসরিকীর এ অনুষ্ঠানটা ১৪ তারিখে করা হচ্ছে কেন”?
এমন সময় বাড়ির রান্নার লোক মমতাদি এসে রতীশ আর অজিতের হাতে খাবারের প্লেট গেল। রতীশ হাত মুখ না ধুয়ে খাবে না বলাতে মমতা অজিতের হাতে একটা প্লেট দিয়ে চলে যেতে রতীশ বলল, “তারিখ হিসেবে ধরলে তো সেটাই হওয়া উচিৎ ছিল ভাই। কিন্তু বাৎসরিক শ্রাদ্ধটা তিথি মিলিয়ে করতে হয় তো। তিথি মিলিয়ে ঠাকুর মশাইয়ের বিধান হিসেবে ১৪ তারিখেই সেটা করা হচ্ছে”।
সেদিন রাতে গঙ্গারামপুর থেকে সতীশ আর তার স্ত্রী দেবাংশী এসে পৌছালো। সতীশ সেখানেই একটা ব্যাঙ্কে চাকরী করে। বিয়ের পর তার স্ত্রীকে নিয়ে সে সেখানেই থাকে। পরদিন সকালে প্রথমেই এল মহিমা, বীথিকা, পরিতোষ, অর্চনা আর তাদের ছ’মাসের ছেলে প্রত্যুষ। তাদের সঙ্গে আব্দুলের স্ত্রী প্রীতি আর ডক্টর দিব্যেন্দুর স্ত্রী দীপাও এল। দীপার মেয়ে আকাঙ্ক্ষা তখন একটা কোচিং নিতে দিল্লীতে ছিল বলে তার আসা সম্ভব হয়নি। সেজন্যে তার মন খুব খারাপ। দুপুরের আগে আগেই আলিপুরদুয়ার থেকে সুলোচনা, শ্যামলেন্দু, দেবিকা, অমলেন্দু আর কালচিনি থেকে বিধুবাবু, বিভাদেবী আর নবনীতা এসে পৌছালো। সন্ধ্যের আগে শিলিগুড়ি থেকে কিংশুকও এসে হাজির হল। সে তখন পলিটিকাল সায়েন্সে মাস্টার্স করবার সাথে সাথে আইএএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিংশুক মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার দিদিভাইকে দেওয়া কথা তাকে রাখতেই হবে।
অজিতের তত্ত্বাবধানে বাড়ির পাশের বাগানে বেশ বড়সড় একটা প্যান্ড্যাল বানানো হল। আর বাইরে বাড়ির মেইন গেট থেকে তুলসী তলার চার পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে একটা প্যাসেজের মত বানিয়ে পেছনের প্যান্ড্যালের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। তুলসী তলার চার পাশে একটা সাত আট ফুট ব্যাসার্ধের বৃত্ত রচনা করে ডেকারেটাররা কাপড়ের ঘেরাও দিয়ে প্যাসেজটা বানিয়েছিল।
বিকেলে দিল্লী থেকে এক সাপ্লায়ার কোম্পানীর বিশেষ একটা গাড়িতে মহিমার অর্ডার দেওয়া একটা বিশেষ জিনিস এসে পৌছালো। গত বছর ২১শে আগস্ট বিকেলে, তুলসী তলার পাশে যে জায়গাটিতে সীমন্তিনীর প্রাণহীন দেহটাকে শুইয়ে শেষ বারের মত তার কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় ফুলের মালা দিয়ে, বাড়ির সকলে মিলে তাদের শেষ আশীর্বাদ আর ভালবাসার অর্ঘ্য দিয়েছিল, সেই জায়গাটাকে চারদিক ঘিরে নিয়ে সারা রাত ধরে সেখানে তারা কাজ করে গেল। একমাত্র মহিমাই সারা রাত তাদের কাজের তদারকি করে গেছে। সকালে বাড়ির লোকেরা ঘুম থেকে উঠে দেখল, দু’ফুট চওড়া আর চার ফুট উচ্চতার কিছু একটাকে সুন্দর রূপোলী রাংতা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির অনেকেই যদিও আগে থেকেই জানতেন যে মহিমা সেখানে তাদের সকলের অনুমতি নিয়ে কী করতে চলেছে, তারা জিনিসটা সম্বন্ধে কেউই তেমন অবহিত ছিলেন না। কিন্তু রচনা আর মহিমার অনুরোধে বাড়ির কেউ কোনও আপত্তি করেননি।
সকালে শ্রাদ্ধের কাজের সবরকম আয়োজন গুছিয়ে নেবার পর পুরোহিত যখন সীমন্তিনীর একটা ছবি চাইলেন, তখন মহিমার ঈশারা পেয়ে রচনা সীমাদেবী আর শশীকান্তবাবুকে হাত ধরে বৃত্তের মাঝখানে রাংতায় মোড়া জিনিসটার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল, “মেজোমা, মেজকাকু, তোমরা দুজনে মিলে এটার ওপর থেকে রাংতার মোড়কটা খুলে দাও। তাহলে আমাদের দিদিভাইয়ের আত্মা পরম শান্তি পাবে” বলে পেছনদিকে দাঁড়িয়ে থাকা অর্চনাকে ঈশারা করতেই অর্চনা, পরিতোষ, রতীশ, মহিমা আর বীথিকা মিলে সকল আত্মীয় স্বজনকে সেই বৃত্তের চারদিকে এনে দাঁড় করালো। সীমাদেবী নিজের জলে ভরা দুটো চোখ মুছে নিয়ে রাংতার আচ্ছাদন খুলতে লাগলেন। শশীকান্তবাবুও হাত লাগালেন। রাংতার আবরণ সরে যেতেই দেখা গেল দু’ ফুট বাই চার ফুট বাই চার ইঞ্চি একটা কৃস্টাল ব্লকের ভেতরে পুলিশের ইউনিফর্মে সীমন্তিনী স্যালিউট দেবার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক থেকেই একই ছবি দেখা যাচ্ছিল। ব্লকটার ঠিক তলায় সাদা রঙের চিনেমাটির একটা ডিম্বাকার বেদী। আর সেই বেদীর ওপর লেখাঃ-
সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি
জন্মঃ ১৪ অক্টোবর ১৯৮৪
মৃত্যুঃ ২১ আগস্ট ২০১৫
অর্চনা, নবনীতা, মহিমা আর চন্দ্রিকা মিলে কৃষ্টাল ব্লকটার চারদিকে বড় বড় রজনীগন্ধা আর গাঁদা ফুলের মালা ঝুলিয়ে দিল।
বাড়ির কর্তারা কিংবা সদস্যরাও অজিতের এমন একটা প্যাসেজ বানাবার যৌক্তিকতা বুঝতে পারেনি প্রথমে। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই যখন দলে দলে লোক এসে সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করল, তখন সবাই মনে মনে অজিতের প্রসংশা না করে পারল না। অমন ব্যবস্থা আগে থেকে না করে রাখলে পরে জনতার ভিড়কে সামাল দিতে খুব বেগ পেতে হত। বাড়ির মেইন গেটের একদিকে যেখান থেকে প্যাসেজটার শুরু হয়েছে সেখানে প্রচুর পরিমানে গোলাপ এবং রজনীগন্ধা ফুলের সম্ভার রাখা হয়েছিল। যারা সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল তারা সকলেই সেখান থেকে ফুল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিল। সুশৃঙ্খল ভাবে বাইরে থেকে ওই প্যাসেজ দিয়ে ভেতরে ঢুকেই সকলে সীমন্তিনীর প্রতিচ্ছবিটি দেখতে দেখতে সেখানে ফুল অর্পন করে ভেজা চোখে জোড়হাতে প্রণাম করে বৃত্তাকার পথ অনুসরন করেই পেছনের বাগানে তৈরী করা প্যান্ড্যালে চলে যাচ্ছিল। সেখানে আগে থেকেই ক্যাটারাররা নানাবিধ খাবারের আয়োজন পসরা সাজিয়ে রেখেছিল। যার যার পছন্দমত খাবার খেয়ে সেখান থেকেই আরেক প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে বাড়ির মেইন গেটের অন্য পাশ দিয়ে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাড়ির ভেতরের লোকেদের ভিড়ে কোন রকম ভাবে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়নি। রাত সাড়ে এগারোটা অব্দি লোকজনের যাতায়াত অব্যাহত ছিল।
সন্ধ্যের সময় বাড়ির সকলেই বেদীটার চারধারে একটা একটা করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল। রচনা প্রদীপ জ্বালিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে রতীশ আর ছেলের সাথে সীমন্তিনীকে প্রণাম করে অস্ফুটকণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, “তুমি ভাল থেকো দিদিভাই। আর এই পরিবার আর তোমার এই ছেলে মেয়েগুলোকে দেখে রেখো”। চারপাশে বসে থাকা সকলের চোখ থেকেই অশ্রুধারা বেয়ে নামছে। সকলেই জলভরা চোখে মনে মনে সীমন্তিনীর আত্মার শান্তি কামনা করল।
রচনা তার ছেলেকে সীমন্তিনীকে ‘বড়মামনি’ বলে ডাকতে শিখিয়েছে। রচনা তার কোলের মেয়েটার নাম রেখেছে মন্তিশ্রী। অর্চনা আর পরিতোষেরও ইচ্ছে তাদের ছেলে প্রত্যুষের মুখে বুলি ফুটলে তারাও তাকে সীমন্তিনীকে বড়মামনি বলে ডাকতে শেখাবে। ছোট্ট যিষ্ণু সীমন্তিনীর প্রতিচ্ছবিকে প্রণাম করে বলল, “ভাল থেকো বড়মামনি”।
ভাল থাকবেন আপনারাও সবাই।
শুভমস্তু
********** ********** ********** ********** **********
সমাপ্ত
______________________________
ss_sexy