30-03-2020, 11:21 AM
(Update No. 254)
তুলসীতলার কাছেই আগে থেকেই একটা ডালিতে ফুল, মালা, মিষ্টির প্লেট আর জলের গ্লাস সাজিয়ে রাখা ছিল। অর্চনা কাঁদতে কাঁদতে সেই ডালিটা কাছে টেনে নিয়ে সীমন্তিনীর পাশে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে তার মুখমন্ডল সাজাতে শুরু করল। চারপাশে কান্নার রোল সমান ভাবেই চলছে তখনও। চন্দনের ফোঁটার পর রজনীগন্ধা আর গাদা ফুলের মালা পড়িয়ে দেবার পর অনেকগুলো ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিয়ে প্লেট থেকে একটা মিষ্টির টুকরো নিয়ে সীমন্তিনীর ঠোঁটে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে সে আরেকবার কেঁদে উঠল। তারপর জলের গ্লাসটা সীমন্তিনীর ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিতেই রচনা হাতের ঈশারায় রতীশকে কাছে ডেকে নিল। রতীশ কাছে আসতে তাকে সীমন্তিনীর দেহের একপাশে বসিয়ে রচনা অন্যপাশে গিয়ে সেই ছোট্ট শিশিটা থেকে কিছুটা জল নিজের ডানহাতের তালুতে ঢেলে রতীশের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “তোমার আঙুলের ডগায় করে এখান থেকে জল নিয়ে দিদিভাইয়ের সিঁথিতে লাগিয়ে দাও সোনা। তিনবার দেবে এভাবে”।
রতীশ একটু অবাক হয়ে রচনার দিকে চাইতে রচনা বলল, “দেরী কোর না সোনা। তোমার মন্তিকে তুমি শেষ আশীর্বাদটুকু করবে না? এটা না করলে যে আমার দিদিভাইয়ের আত্মার শান্তি হবে না”।
রতীশ আর কিছু না বলে তিনবার ডানহাতের আঙুলের ডগায় রচনার হাতের তালু থেকে জল নিয়ে সীমন্তিনীর সিঁথিতে ঘসে দিল। তারপর রতীশ সরে যেতেই রচনা তার হাতের তালুর বাকি জলটুকু সীমন্তিনীর মাথার চুলে মাখিয়ে দিয়ে তার ঠোঁটে মিষ্টি আর জল ছুঁইয়ে মৃতদেহের দু’গালে অনেকগুলো চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে উঠে সেখান থেকে একদিকে ছুটে গেল। এর পর একে একে পরিতোষ, সতীশ, সূর্য্য, চঞ্চল, চন্দ্রিকা, কিংশুক, অর্চনা, লক্ষ্মী, নবনীতা সীমন্তিনীর মরদেহকে প্রণাম করল। তারপর বাড়ির বড়রাও কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে তাদের নিজেদের করণীয় সারলেন।
রচনা চন্দ্রাদেবীর কোল থেকে নিজের ছেলেকে নিয়ে ছেলেকে লক্ষ্মীর কোলে দিয়ে চন্দ্রাদেবীকে মাটি থেকে টেনে তুলে বলল, “চলো ছোটমা, দিদিভাইকে আশীর্বাদ করবে না? আর মেজমা কোথায় গো? তাকে তো দেখছি না”?
চন্দ্রাদেবী ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “মেজদি তো আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ওই ঘরে নিয়ে গিয়েছিল তো”।
কাছে নবনীতাকে দেখতে পেয়ে রচনা তাকে বলল, “নীতাদি, ছোটমাকে একটু ধরে দিদিভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও না। আমি মেজমাকে নিয়ে আসছি”।
পাশের একটা ঘরে গিয়ে দেখে সীমাদেবী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। একজন নার্সও তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রচনা খাটের ও’পাশ দিয়ে ঘুরে সীমাদেবীর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আজকের এমন দিনেও তুমি দিদিভাইয়ের ওপর রাগ করে থাকবে মেজমা। তিনি তো এখন আমাদের সকলের রাগ ভালবাসার ঊর্ধে চলে গেছেন গো। এ সময়েও তিনি তার মায়ের হাতের একটু ছোঁয়া পাবেন না”?
সীমাদেবী মাথাটা একটু তুলে রচনার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। তার ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপল খানিকটা।
রচনা তাকে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আজ এই দিনেও তুমি মেয়ের ওপর অভিমান করে থাকবে মেজ মা? তাহলে যে দিদিভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাবে গো। এসো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে সকলে দিদিভাইকে নিয়ে যাবার জন্য তাড়া দিচ্ছে যে”।
রচনা ক্রন্দনরতা সীমাদেবীকে ধরে খুব ধীরে ধীরে তুলসীতলায় নিয়ে এল। সীমাদেবী থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু ভেঙে বসে সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা গালে সামান্য হাত ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। রচনা তাড়াতাড়ি সীমাদেবীর হাতটা সীমন্তিনীর মাথায় ছুঁইয়ে আশপাশ থেকে সাহায্য চাইতেই কয়েকজন ধরাধরি করে আবার সীমাদেবীকে ঘরে নিয়ে গেল।
কালচিনি, নাগরাকাটা আর আলিপুরদুয়ার থেকে যারা এসেছিলেন তারাও সীমন্তিনীকে প্রণাম ও আশীর্বাদ করলেন। বিধুবাবু আর বিভাদেবী যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। ভোরবেলা থেকে কাঁদতে কাঁদতে তাদের শরীরের শেষ শক্তিবিন্দুটুকুও বুঝি বেরিয়ে গেছে। কোনমতে অন্যের সাহায্যে টলমল পায়ে এসে তারা সীমন্তিনীর কপালে আর মাথায় চুমু দিয়ে শেষবারের মত তাদের ‘মা অন্নপূর্ণা’কে আদর করলেন। তারপর কিংশুক এগিয়ে আসতেই রচনা ভাইকে টেনে সীমন্তিনীর মুখের সামনে বসিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “নে ভাই, আমাদের দিদিভাইকে শেষ বারের মত একটু আদর করে দে”।
কিংশুক আপ্রাণ চেষ্টায় নিজের কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে সীমন্তিনীর মুখটাকে দু’হাতের অঞ্জলীতে ধরে কয়েক মুহূর্ত অপলক নয়নে তার আদরের দিদিভাইয়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে তার পায়ের দিকে সরে যেতে লাগল। একেবারে সীমন্তিনীর পায়ের তলায় এসে কিংশুক নিজের পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করে সীমন্তিনীর হিম শীতল পায়ের তলায় ছোঁয়াতে লাগল। রচনা সেদিকে চেয়েই বুঝতে পারল, এটা সেই ক্যাডবেরি চকলেটের মোড়কটা, যেটা দিদিভাই প্রথম দিন কালচিনির বাড়িতে গিয়ে ভাইকে খেতে দিয়েছিল। এটা বুঝতে পেরেই রচনা কিংশুককে জড়িয়ে ধরে আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। এবার আর কিংশুক নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা পা দুটোর ওপর নিজের মুখ চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কেউ একজন তাকে উঠিয়ে নেবার চেষ্টা করতেই কিংশুক সীমন্তিনীর পা দুটোকে দু’হাতে শক্ত করে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এক সময় রচনাই ভাইকে টেনে উঠিয়ে তাকে বুকে চেপে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে সরিয়ে আনল।
গাড়ির ড্রাইভার ওই অজিত বলে ছেলেটা আর বেশ কিছু বাইরের লোক, যারা পুলিশের ব্যারিকেড এড়িয়ে ভেতরে এসে ঢুকেছিল তারাও কয়েকজন সীমন্তিনীকে প্রণাম করবার পর বাকিরা সীমন্তিনীর দেহের কাছে যেতে চাইলেও পুলিশ তাদের বাঁধা দিল।
সীমন্তিনী ছোটবেলা থেকে যে কলেজে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল, সেই কলেজের বিশাল মাঠে উঁচু করে বানানো একটা মঞ্চে যখন সীমন্তিনীর মৃতদেহ এনে রাখা হল, তখন বিকেল প্রায় চারটে। স্থানীয় এমএলএ, এমপি, সরকারী উচ্চপদস্থ আধিকারিক, পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, মহিলা সমিতি, এনসিসি, এনজিও, বাস লরি ট্যাক্সি অটো এসোসিয়েশন, রিক্সা এসোসিয়েশন, বিভিন্ন কলেজ কলেজের ছাত্র ছাত্রী এবং সুবিশাল জনসমাবেশের উপস্থিতিতে সীমন্তিনীর মৃতদেহের ওপর দেশের জাতীয় পতাকা বিছিয়ে দেওয়া হল। আকাশ বাতাস তখন সীমন্তিনীর জয়ধ্বনিতে মুখরিত। সেই শব্দ ছাপিয়ে এক সময় পুলিশের ব্যান্ড বেজে উঠল। একুশ জন বন্দুকধারী আকাশের দিকে মুখ করে একুশবার গুলি ছুঁড়ে সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর বিশাল জনতা সার বেঁধে মঞ্চে উঠে সীমন্তিনীকে পুষ্পার্ঘ্য দিল। সুবিশাল ভিড়কে আয়ত্ত্বে রাখতে মাইকে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে নানারকম নির্দেশ বাণী প্রচার করা হচ্ছিল।
সন্ধ্যে প্রায় ছ’টা নাগাদ পুলিশের সাহায্যে সীমন্তিনীর মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে আসা হল। মুখাগ্নি করবার আগে রতীশ শেষবারের মত সীমন্তিনীর কপালে বিদায় চুম্বন একে দিল।
*****************
______________________________
তুলসীতলার কাছেই আগে থেকেই একটা ডালিতে ফুল, মালা, মিষ্টির প্লেট আর জলের গ্লাস সাজিয়ে রাখা ছিল। অর্চনা কাঁদতে কাঁদতে সেই ডালিটা কাছে টেনে নিয়ে সীমন্তিনীর পাশে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে তার মুখমন্ডল সাজাতে শুরু করল। চারপাশে কান্নার রোল সমান ভাবেই চলছে তখনও। চন্দনের ফোঁটার পর রজনীগন্ধা আর গাদা ফুলের মালা পড়িয়ে দেবার পর অনেকগুলো ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিয়ে প্লেট থেকে একটা মিষ্টির টুকরো নিয়ে সীমন্তিনীর ঠোঁটে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে সে আরেকবার কেঁদে উঠল। তারপর জলের গ্লাসটা সীমন্তিনীর ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিতেই রচনা হাতের ঈশারায় রতীশকে কাছে ডেকে নিল। রতীশ কাছে আসতে তাকে সীমন্তিনীর দেহের একপাশে বসিয়ে রচনা অন্যপাশে গিয়ে সেই ছোট্ট শিশিটা থেকে কিছুটা জল নিজের ডানহাতের তালুতে ঢেলে রতীশের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “তোমার আঙুলের ডগায় করে এখান থেকে জল নিয়ে দিদিভাইয়ের সিঁথিতে লাগিয়ে দাও সোনা। তিনবার দেবে এভাবে”।
রতীশ একটু অবাক হয়ে রচনার দিকে চাইতে রচনা বলল, “দেরী কোর না সোনা। তোমার মন্তিকে তুমি শেষ আশীর্বাদটুকু করবে না? এটা না করলে যে আমার দিদিভাইয়ের আত্মার শান্তি হবে না”।
রতীশ আর কিছু না বলে তিনবার ডানহাতের আঙুলের ডগায় রচনার হাতের তালু থেকে জল নিয়ে সীমন্তিনীর সিঁথিতে ঘসে দিল। তারপর রতীশ সরে যেতেই রচনা তার হাতের তালুর বাকি জলটুকু সীমন্তিনীর মাথার চুলে মাখিয়ে দিয়ে তার ঠোঁটে মিষ্টি আর জল ছুঁইয়ে মৃতদেহের দু’গালে অনেকগুলো চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে উঠে সেখান থেকে একদিকে ছুটে গেল। এর পর একে একে পরিতোষ, সতীশ, সূর্য্য, চঞ্চল, চন্দ্রিকা, কিংশুক, অর্চনা, লক্ষ্মী, নবনীতা সীমন্তিনীর মরদেহকে প্রণাম করল। তারপর বাড়ির বড়রাও কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে তাদের নিজেদের করণীয় সারলেন।
রচনা চন্দ্রাদেবীর কোল থেকে নিজের ছেলেকে নিয়ে ছেলেকে লক্ষ্মীর কোলে দিয়ে চন্দ্রাদেবীকে মাটি থেকে টেনে তুলে বলল, “চলো ছোটমা, দিদিভাইকে আশীর্বাদ করবে না? আর মেজমা কোথায় গো? তাকে তো দেখছি না”?
চন্দ্রাদেবী ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “মেজদি তো আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ওই ঘরে নিয়ে গিয়েছিল তো”।
কাছে নবনীতাকে দেখতে পেয়ে রচনা তাকে বলল, “নীতাদি, ছোটমাকে একটু ধরে দিদিভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও না। আমি মেজমাকে নিয়ে আসছি”।
পাশের একটা ঘরে গিয়ে দেখে সীমাদেবী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। একজন নার্সও তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রচনা খাটের ও’পাশ দিয়ে ঘুরে সীমাদেবীর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আজকের এমন দিনেও তুমি দিদিভাইয়ের ওপর রাগ করে থাকবে মেজমা। তিনি তো এখন আমাদের সকলের রাগ ভালবাসার ঊর্ধে চলে গেছেন গো। এ সময়েও তিনি তার মায়ের হাতের একটু ছোঁয়া পাবেন না”?
সীমাদেবী মাথাটা একটু তুলে রচনার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। তার ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপল খানিকটা।
রচনা তাকে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আজ এই দিনেও তুমি মেয়ের ওপর অভিমান করে থাকবে মেজ মা? তাহলে যে দিদিভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাবে গো। এসো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে সকলে দিদিভাইকে নিয়ে যাবার জন্য তাড়া দিচ্ছে যে”।
রচনা ক্রন্দনরতা সীমাদেবীকে ধরে খুব ধীরে ধীরে তুলসীতলায় নিয়ে এল। সীমাদেবী থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু ভেঙে বসে সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা গালে সামান্য হাত ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। রচনা তাড়াতাড়ি সীমাদেবীর হাতটা সীমন্তিনীর মাথায় ছুঁইয়ে আশপাশ থেকে সাহায্য চাইতেই কয়েকজন ধরাধরি করে আবার সীমাদেবীকে ঘরে নিয়ে গেল।
কালচিনি, নাগরাকাটা আর আলিপুরদুয়ার থেকে যারা এসেছিলেন তারাও সীমন্তিনীকে প্রণাম ও আশীর্বাদ করলেন। বিধুবাবু আর বিভাদেবী যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। ভোরবেলা থেকে কাঁদতে কাঁদতে তাদের শরীরের শেষ শক্তিবিন্দুটুকুও বুঝি বেরিয়ে গেছে। কোনমতে অন্যের সাহায্যে টলমল পায়ে এসে তারা সীমন্তিনীর কপালে আর মাথায় চুমু দিয়ে শেষবারের মত তাদের ‘মা অন্নপূর্ণা’কে আদর করলেন। তারপর কিংশুক এগিয়ে আসতেই রচনা ভাইকে টেনে সীমন্তিনীর মুখের সামনে বসিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “নে ভাই, আমাদের দিদিভাইকে শেষ বারের মত একটু আদর করে দে”।
কিংশুক আপ্রাণ চেষ্টায় নিজের কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে সীমন্তিনীর মুখটাকে দু’হাতের অঞ্জলীতে ধরে কয়েক মুহূর্ত অপলক নয়নে তার আদরের দিদিভাইয়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে তার পায়ের দিকে সরে যেতে লাগল। একেবারে সীমন্তিনীর পায়ের তলায় এসে কিংশুক নিজের পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করে সীমন্তিনীর হিম শীতল পায়ের তলায় ছোঁয়াতে লাগল। রচনা সেদিকে চেয়েই বুঝতে পারল, এটা সেই ক্যাডবেরি চকলেটের মোড়কটা, যেটা দিদিভাই প্রথম দিন কালচিনির বাড়িতে গিয়ে ভাইকে খেতে দিয়েছিল। এটা বুঝতে পেরেই রচনা কিংশুককে জড়িয়ে ধরে আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। এবার আর কিংশুক নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা পা দুটোর ওপর নিজের মুখ চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কেউ একজন তাকে উঠিয়ে নেবার চেষ্টা করতেই কিংশুক সীমন্তিনীর পা দুটোকে দু’হাতে শক্ত করে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এক সময় রচনাই ভাইকে টেনে উঠিয়ে তাকে বুকে চেপে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে সরিয়ে আনল।
গাড়ির ড্রাইভার ওই অজিত বলে ছেলেটা আর বেশ কিছু বাইরের লোক, যারা পুলিশের ব্যারিকেড এড়িয়ে ভেতরে এসে ঢুকেছিল তারাও কয়েকজন সীমন্তিনীকে প্রণাম করবার পর বাকিরা সীমন্তিনীর দেহের কাছে যেতে চাইলেও পুলিশ তাদের বাঁধা দিল।
সীমন্তিনী ছোটবেলা থেকে যে কলেজে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল, সেই কলেজের বিশাল মাঠে উঁচু করে বানানো একটা মঞ্চে যখন সীমন্তিনীর মৃতদেহ এনে রাখা হল, তখন বিকেল প্রায় চারটে। স্থানীয় এমএলএ, এমপি, সরকারী উচ্চপদস্থ আধিকারিক, পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, মহিলা সমিতি, এনসিসি, এনজিও, বাস লরি ট্যাক্সি অটো এসোসিয়েশন, রিক্সা এসোসিয়েশন, বিভিন্ন কলেজ কলেজের ছাত্র ছাত্রী এবং সুবিশাল জনসমাবেশের উপস্থিতিতে সীমন্তিনীর মৃতদেহের ওপর দেশের জাতীয় পতাকা বিছিয়ে দেওয়া হল। আকাশ বাতাস তখন সীমন্তিনীর জয়ধ্বনিতে মুখরিত। সেই শব্দ ছাপিয়ে এক সময় পুলিশের ব্যান্ড বেজে উঠল। একুশ জন বন্দুকধারী আকাশের দিকে মুখ করে একুশবার গুলি ছুঁড়ে সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর বিশাল জনতা সার বেঁধে মঞ্চে উঠে সীমন্তিনীকে পুষ্পার্ঘ্য দিল। সুবিশাল ভিড়কে আয়ত্ত্বে রাখতে মাইকে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে নানারকম নির্দেশ বাণী প্রচার করা হচ্ছিল।
সন্ধ্যে প্রায় ছ’টা নাগাদ পুলিশের সাহায্যে সীমন্তিনীর মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে আসা হল। মুখাগ্নি করবার আগে রতীশ শেষবারের মত সীমন্তিনীর কপালে বিদায় চুম্বন একে দিল।
*****************
______________________________