Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 253)

রতীশ ফোন বের করতেই রচনা পরিতোষকে বলল, “পরিদা, তুমি একটু খবর নিয়ে দেখ না, নাগরাকাটা থানা থেকে আর কেউ এখন শিলিগুড়ি আসবে কি না”।

রতীশের ফোন থেকে নবনীতার নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে লাগাতেই ও’পাশ থেকে নবনীতা ভারী গলায় বলল, “আমরা শিলিগুড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি রতুদা। মনে হয় আর মিনিট পনের কুঁড়ির ভেতরেই মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে যাব”।

রচনা কথা বলতে গিয়ে “নীতাদি আমি ...” বলতেই আবার কেঁদে ফেলল। ওদিকে নবনীতাও “বৌদি” বলে কেঁদে ফেলতেই আরও একজনের কান্নার শব্দ শোনা গেল। রচনার বুঝতে অসুবিধে হল না এটা তার মায়ের কান্না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাতে সামলাতে রচনা বলল, “নীতাদি, সারা জীবন ধরেই তো আমাদের কাঁদতে হবে গো এখন। কিন্তু এখন যেটা বলছি সেটা শোন। লক্ষ্মীদি একা একা ওখানে কেঁদে মরছে। তার কাছে তো কেউ নেই। তাকে যদি কেউ একজন শিলিগুড়ি নিয়ে আসত তাহলে খুব ভাল হত। কিন্তু নাগরাকাটা থেকে বেশ কয়েকজন নাকি আগেই শিলিগুড়ি চলে এসেছে। তুমি তো ওখানে কিছুদিন ছিলে। এমন কাউকে কি তোমার মনে পড়ে যে এমন সময় আমাদের একটু সাহায্য করতে লক্ষ্মীদিকে শিলিগুড়ি অব্দি পৌঁছে দিতে পারে”?

নবনীতা জবাবে বলল, “ইশ লক্ষ্মীদির কথা তো আমার মাথাতেই আসেনি। তবে জয়া ম্যাম নিজেই খবরটা শুনে আজ ভোরবেলাতেই আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনিও তো দিদিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। বলেছিলেন যে কোন কিছুর প্রয়োজন হলে যেন তাকে জানাই। আমি তার সাথে একটু কথা বলে দেখি। মনে হয় উনি কোন একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করতে পারবেন। আমি এখনই তাকে ফোন করছি। তারপর তোমাদের জানাচ্ছি”।

ততক্ষণে রতীশ রচনার মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে। সেটা দেখে রচনা বলল, “আচ্ছা নীতাদি। মা বাবার শরীর ঠিক আছে তো”?

নবনীতা বলল, “এমন খবর পেয়ে কি আর কেউ ঠিক থাকতে পারে বৌদি। আর তুমি তো ভাল করেই জানো দিদি তাদের কাছে কী ছিল কতখানি ছিল। তাদের সামাল দিতে দিতেই তো আমি হিমশিম খাচ্ছি। তবে মোটামুটি ঠিকই আছেন”।

রচনা এবার বলল, “নীতাদি আরও কয়েকজনকে ফোন করতে হবে গো। তাই রাখছি এখন। তুমি ওই ব্যাপারে কিছু বন্দোবস্ত করতে পারলে আমার নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দিও” বলে ফোন কেটে দিয়ে ফোনটা রতীশের হাতে ফেরত দিয়ে নিজের ফোনটা নিয়ে বলল, “আচ্ছা শোনো, অনেক দেরী হয়ে গেছে। পরিদা তোমরা এবার বেরিয়ে পড়ো। মনে হয় লক্ষ্মীদিকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত আনবার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন থেকে ফোন আমার হাতেই রাখছি। প্রয়োজনে আমাকে ফোন কোর তোমরা”।

পরিতোষ বেরিয়ে যেতে রচনা রতীশের হাত ধরে তাকে পেছনে টেনে ধরে কাতর কন্ঠে বলল, “আমার একটা কথা রাখবে সোনা। দিদিভাইকে নিয়ে আসবার সময় তার মাথাটাকে তোমার কোলে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে রেখে তাকে বাড়ি নিয়ে এসো সোনা। গাড়ির ঝাঁকুনিতে তার যেন একটুও কষ্ট না হয়”।

রতীশ মুখে কিছু না বলে মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেল। পরিতোষের সাথে শুধু রতীশ ছাড়া বাড়ি থেকে আর কেউ গেল না। বাবা কাকাদের কথায় সতীশ বাড়িতে থেকে গেল।
 

******************

শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নাগরাকাটা থানার ওসি মিঃ সিকদার পরিতোষকে পুরোটা বিস্তারিত ভাবে বলে বোঝাতে জানাল যে নাগরাকাটা সুপারমার্কেটের পাশ দিয়ে তালঝোরা রোড বরাবর উত্তরদিকে গিয়ে নাগরাকাটা চা বাগানকে বাম পাশে রেখে চাম্পাগুড়ি বাজার ডান দিকে রেখে উত্তরাভিমুখে গেলে ২২ কিমি পর তালঝোরা বলে একটা সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আছে। তার পর থেকেই বেশ বড়সড় একটা চা বাগানের শুরু, যেটা ভূটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই চা বাগানের পাশ দিয়ে গিয়ে ভূটান সীমান্তের ভেতরে ঢুকে সীমান্ত বরাবর উত্তর পশ্চিম অভিমুখে আরও কিছুদুর যাবার পর ঘণ জঙ্গলে ভরা একটা জায়গায় ২০-২৫ জন উগ্রপন্থীর একটা গোপন আস্তানার খবর পেয়ে সীমন্তিনী একদল পুলিশ নিয়ে সেখানে রেইড করতে গিয়েছিল। সে জায়গাটা নাগরাকাটা থেকে প্রায় ৩৩ কিমি দুরে। ওই পথের শেষ চার কিমি পথ ভূটানের অন্তর্গত ছিল। তাই ভূটান পুলিশের সাথেও যোগাযোগ রাখা হয়েছিল।

উল্টোদিকে গৈরিবাস পুলিশ ক্যাম্প থেকেও তিনটে গাড়িতে ২০ জন সশস্ত্র পুলিশ আসবার কথা ছিল। আবার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ভূটান পুলিশের একটা দলও সেখানে আসবার কথা ছিল। গৈরিবাস থেকে সোজাসুজি সে জায়গাটার দুরত্ব মাত্র ৯-১০ কিমি হলেও সেদিক দিয়ে কোনও সড়ক যোগাযোগ নেই। তাই সেখান থেকে ওই স্পটে আসতে সড়কপথে অনেকটা ঘুরে প্রায় ৪১ কিমি দুরত্ব অতিক্রম করতে হয়। গাড়িতে আসতে প্রায় দেড় ঘন্টার মত সময় লাগে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে পাহাড়ে নানা জায়গায় ধ্বস নামবার ফলে দু’দিকেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবার দরুন ভূটান পুলিশ বা গৈরিবাসের পুলিশ দল কেউই আর সেখানে পৌঁছোতে পারেনি।
 

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে উগ্রপন্থীদের আস্তানা খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসবার পথে ৩ কিমি আসবার পরেই একটা ৯০ ডিগ্রী ব্লাইণ্ড কর্নারে আসতেই তারা দুর্ঘটণার মুখে পড়ে। ওই জায়গাটা থেকে নাগরাকাটার দুরত্ব ছিল ৩০ কিমি। সীমন্তিনীর সঙ্গে ৩টে গাড়িতে ২০ জন সশস্ত্র পুলিশ ছিল। সীমন্তিনীর সাথে একই গাড়িতে অন্য পাঁচজনের মধ্যে নতুন কাজে যোগ দিতে আসা সীমন্তিনীর পরিবর্ত বিশাল কুলকার্নীও ছিল। তারা ছিল মাঝের গাড়িটাতে। ওই জায়গাটায় প্রথম গাড়িটা ওই মোড়টা পেরিয়ে গেছে, সীমন্তিনীর গাড়িটা ঠিক মোড়ের কোনে, আর পেছনের গাড়িটা তখনও মোড়ের অন্যপাশে মোড় থেকে কিছুটা দুরে। ঠিক তখনই তাদের মনে হয়েছিল খুব জোরে পরপর দু’বার মেঘ গর্জে উঠল যেন। সঠিক ভাবে কিছু বুঝে উঠবার আগেই সীমন্তিনীর সামনের গাড়িটা যেন বাঁ পাশে গভীর খাঁদের দিকে ঢলে পড়ল। আর রাস্তা সমেত ডানদিকের পাহাড়ের বিশাল একটা অংশ একই সাথে ধ্বসে পড়েছিল বাঁদিকে। সীমন্তিনীর গাড়ির ড্রাইভার রামসিং ব্রেক কষে গাড়ি থামাতেই সকলে অবাক চোখে দেখল পেছনেও একই রকমের একটা ধ্বস নেমে এসেছে। তবে সেটা আগের ধ্বসটার মত অতটা বিশাল ছিল না। কিন্তু পেছনের গাড়ীটাও সেই ধ্বসের ধাক্কায় রাস্তা থেকে বাঁদিকে অনেকটাই নিচে নেমে গিয়েছিল। তবে সেখানে বাঁদিকে খাঁদটা খুব বেশী গভীর ছিলনা বলেই গাড়িটা বেশীদুর গড়িয়ে যায়নি। কিন্তু একই সাথে সামনে এবং পেছনে ডানদিকে অন্ধকার পাহাড়ের ওপর থেকে একনাগাড়ে গুলী আর গ্রেনেড নিক্ষেপ হতে শুরু করেছিল। প্রথম গাড়িটা তো ধ্বসের নিচে পুরোপুরি ভাবেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। দু’ একজন গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লেও ধ্বসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তারাও ধ্বসের নিচেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। উগ্রবাদীরা হামলা করেছে বুঝতে পেরেই পেছনের গাড়ির কয়েকজন আর সীমন্তিনীর গাড়িতে যারা ছিল, তারা রিটালিয়েট করতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে নিচে থেকে পাহাড়ের ওপরে লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতীদের বাগে আনা সহজ কথা নয়। আর পর্যাপ্ত লোক আর অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না তখন সঙ্গে। তিনটে টিমের মধ্যে দুটো টিম তো আসতেই পারেনি। আর সীমন্তিনীর দলেরও আট দশজন ততক্ষণে মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। তাই খুব বেশী কিছু করবার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। ওদিকে একের পর এক গ্রেনেডের বিস্ফোরণে অনবরতঃ ছোট খাটো ধ্বস নেমে আসছিল ওপর থেকে। সীমন্তিনীর পায়ে আর কাঁধে তিনটে গুলি লেগেছিল। এছাড়াও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে তার শরীরের অনেক জায়গায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে’সব দিকে তার তখন বোধহয় হুঁশ ছিল না। সে নির্ভীক যোদ্ধার মত লড়ে যাচ্ছিল। প্রায় আধ ঘন্টার মত সংঘর্ষের পর পাহাড়ের ওপর থেকে আর গোলাগুলির সাড়া শব্দ না পেয়ে অন্ধকারে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করতেই সীমন্তিনীদের গাড়িটার ঠিক নিচেই একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। খুব সম্ভবতঃ সেটা বোধহয় ল্যান্ড মাইনের বিস্ফোরণ ছিল। আর সেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় সীমন্তিনী বাঁপাশে অন্ধকার খাঁদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। আর তার ওপর পড়েছিল তাদের গাড়ি সহ আরও কয়েকটা দেহ। গাড়িটা অবশ্য সীমন্তিনীর শরীরের ওপর দিয়েই গড়িয়ে খাঁদের আরো নিচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু রাস্তা আর রাস্তার ওপর থেকে পাহাড় এমন ভাবে ভেঙে পড়ল যে সীমন্তিনী সে ধ্বসের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। সীমন্তিনীর দেহে তিনটে গুলি লাগলেও ময়না তদন্তে বলা হয়েছে শ্বাস রোধ হবার ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। সীমন্তিনীর কাছ থেকে চার্জ বুঝে নেবার জন্য যে বিশাল কুলকার্নী এসেছিল, সে-ও ওই দুর্ঘটণায় নিহত হয়েছে। তবে সে গুলির আঘাতেই মারা গেছে। আর তার বডিটা পাওয়া গেছে খাঁদের অনেক নিচে মাটির তলায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে থাকা অবস্থায়। সামনের গাড়িতে যে সাতজন ছিল তারা সকলেই মাটির তলায় চাপা পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। পেছনের গাড়িটার একজন বেশ ভালরকম আহত হলেও সে ঘটণার পর কোনও রকমে সে খাঁদ থেকে উঠে প্রায় এক কিলো মিটার দুরে ওই চা বাগানে গিয়ে পৌঁছোতে পেরেছিল। সে-ই ওই বাগানের ফোন থেকে থানার ল্যান্ডলাইন ফোনে ফোন করে দুর্ঘটণার খবরটা জানিয়েছিল। তার মুখেই পুরো ঘটণাটার বিবরণটা জানা গেছে। পেছনের গাড়ির আরও তিনজনকে গুরুতর আহত এবং প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থায় সকালে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। তারা এখন মেডিক্যাল কলেজেই চিকিৎসাধীন আছে। পুলিশ টিমের ওই চারজনই শুধু জীবিতাবস্থায় ফিরে এসেছে। সীমন্তিনীদের গাড়িতে যে ছ’জন ছিল, তাদের কাউকেই জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায় নি।

রাত বারোটা নাগাদ নাগরাকাটা থানা খবর পেলেও দুর্গতদের সাহায্যের জন্য তারা তেমন কিছুই প্রায় করে উঠতে পারে নি। ওই অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। তিনটে গাড়িতে তিনটে স্যাটেলাইট ফোন থাকলেও তাতে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। একটানা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফলে বিভিন্ন স্থানে রাস্তা ঘাট ধ্বসে যাবার ফলে সড়ক পথেও কোন রেসকিউ টিম পাঠানো সম্ভব হয়নি। আর্মির দুটো হেলিকপ্টার রাত প্রায় দুটো নাগাদ দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছলেও ওই অন্ধকার ঘণ জঙ্গলের মধ্যে ধ্বসে যাওয়া পাহাড়ে পাইলটরা কপ্টারগুলো ল্যান্ড করতে পারেনি। ওই চা বাগানে গিয়ে তারা অপেক্ষা করছিল। ভোরের আলো ফুটে উঠবার সাথে সাথেই কপ্টারদুটো ওই জায়গায় গিয়ে কয়েকজনকে সিঁড়ির সাহায্যে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এসেছিল ওই বাগানে। ঘন্টা তিনেকের পরিশ্রমে কপ্টার নামবার মত টেম্পোরারি একটা উপযোগী জায়গা তৈরী হতেই তারা উদ্ধার কার্য শুরু করেছিল। সকাল আটটার মধ্যেই জীবিত এবং মৃত অবস্থায় যাদের পাওয়া গিয়েছিল তাদের সকলকেই শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছিল। গাড়িগুলো এখনও সেখানেই পড়ে আছে। আর এমন সম্ভাবনাও আছে যে ধ্বসের ভেতরে আরও কোনও উগ্রপন্থীর বডি হয়ত পাওয়া যেতে পারে। তবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু না হওয়া অব্দি সেখানে আর কোনও ভাবে তল্লাশী করা বোধহয় সম্ভব হবে না। তবে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ সে বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করছে।

সকালে আর্মির হেলিকপ্টারের সাহায্যে দুর্ঘটণাস্থল থেকে সব মিলিয়ে মোট চল্লিশ জনের ডেডবডি আর গুরুতর আহত তিনজন পুলিশকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। আর আগে বাগানে পৌঁছে যাওয়া ওই আহত পুলিশটিকেও কপ্টারেই তুলে আনা হয়েছিল। এই চল্লিশ জনের মধ্যে ড্রাইভার তিনজন সহ পুলিশ টিমের মোট ঊণিশ জনের প্রাণ গেছে। বাকি একুশটা বডি উগ্রপন্থীদের বলে সনাক্ত করা হয়েছে। এই একুশ জনের মধ্যে ন’জন মাটির তলায় চাপা পড়ে মারা গেছে। আর বাকি বারো জনের প্রাণ গেছে গুলির আঘাতে। আর এই সব কটা গুলিই সীমন্তিনী ম্যাডামের রিভলভারের।
 

ডেডবডি আনতে আনতে বেলা দুটো বেজে গেল। সারা রাজগঞ্জ শহর তখন লোকে লোকারন্য। ছোট্ট শহরটাতে মানুষের ভিড় তখন আরও বেড়েছে। শহরটার প্রতিটা রাস্তা প্রতিটা গলিতেই শুধু মানুষ আর মানুষ। জায়গায় জায়গায় লোকের হাতে নানা ধরণের ব্যানার, পোস্টার আর সীমন্তিনীর ছবি।
 
“সীমন্তিনী- তুমি আমাদের গর্ব”,
 
“সীমন্তিনী- আমরা তোমায় ভুলব না”,
 
“সীমন্তিনীর মত সাহসিনী বীরাঙ্গনা প্রতিটা ঘরে জন্ম নিক”,
 
“মৃত্যু নয়, তুমি অমর হয়ে আমাদের সকলের মাঝে বেঁচে থাকবে সীমন্তিনী”,
 
“সীমন্তিনী- তুমি এ শহরের গর্ব, এ দেশের গর্ব”,
“অমর শহীদ সীমন্তিনীকে সশ্রদ্ধ প্রণাম”,
 
এমন নানা ধরণের বড় বড় ব্যানার, ছবি আর শ্লোগান দেখতে পাওয়া গেল। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি লোকের হাতে সীমন্তিনীর ছবি দেখা গেল।

কয়েকটা গাড়ি মিছিল করে রাজগঞ্জের সীমানায় ঢুকতেই রাস্তার দু’পাশের জনতা সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে সীমন্তিনীর নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। সমস্ত লোক দু’হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে সীমন্তিনীকে তাদের শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ জানাতে শুরু করল।
 

সীমন্তিনীকে নিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্সে রতীশ, কিংশুক আর পরিতোষ ছিল। পুলিশের অনুরোধ সত্বেও হাসপাতালের স্ট্রেচারে সীমন্তিনীকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয়নি। স্ট্রেচার এসেছিল শুধু সীমন্তিনীকে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। রতীশ, পরিতোষ আর কিংশুকের কোলের ওপর তুলে দেওয়া হয়েছিল সীমন্তিনীর নিথর দেহটাকে। রতীশ পরম যত্নে সীমন্তিনীর মাথাটাকে নিজের কোলের ওপর রেখে অনিমেষ নয়নে তার মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে এসেছে প্রায় গোটা রাস্তাটাই। ছোটবেলা থেকে সীমন্তিনীর হাজারো স্মৃতি সে রোমন্থন করে যাচ্ছিল। আর দু’চোখ থেকে অবিরত জলের ধারা বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল সীমন্তিনীর মাথায় আর মুখে। পরিতোষ সীমন্তিনীর দেহের মধ্যভাগটাকে নিজের কোলে নিয়ে বসেছিল। আর কিংশুক তার আদরের দিদিভাইয়ের পা দুটো নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে আকুল নয়নে কেঁদে যাচ্ছিল। আর বার বার সীমন্তিনীর হিম শীতল পায়ের পাতায় মাঝে মাঝে চুমু খাচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সের আগে পুলিশের একটা গাড়ি। তাতে রাজগঞ্জ থানার পুলিশেরা আছে। আর তারও আগে আরেকটা পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলেছে। পরিতোষের ভাড়া করা অজিতের ট্যাক্সিটা অ্যাম্বুলেন্সের ঠিক পেছনে ছিল। তাতে বসে ছিল লক্ষ্মী, অধিকারীবাবুরা দুই ভাই আর জয়া বসাক। তার পেছনের একটা গাড়িতে নবনীতা বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে নিয়ে বসেছিল। তার পেছনের দুটো গাড়িতে মহিমা, বীথিকা, ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া, তার স্ত্রী দীপা, মেয়ে আকাঙ্ক্ষা, প্রীতি আর আব্দুল। তারপরের দুটো গাড়িতে শ্যামলেন্দু, বিমলেন্দু, অমলেন্দুরা আর তাদের স্ত্রীরা এসেছেন। তার পেছনে আরও দুটো পুলিশের গাড়ি। তাতে এসপি, ডিএসপি সহ জেলা স্তরের আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারেরা এসেছেন জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার থেকে। এতগুলো গাড়ির মিছিল যত এগোচ্ছিল রাস্তার দু’পাশের জনতার মধ্যে সীমন্তিনীর জয় জয়কারের ধ্বণি যেন ততই বাড়তে শুরু করছিল।
 

বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামতেই বাড়ির প্রায় সকলেই গেটের সামনে ছুটে এল। ওই ভিড়ের মধ্যে ছুটে আসতে গিয়েই সরলাদেবী আর সীমাদেবী আবার জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। অন্যেরা ধরাধরি করে তাদের ঘরে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার নার্সরা তাদের উপচার শুরু করল। সবগুলো গাড়ি থেকে সকলে নেমে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভেতর ছুটতে লাগল। পুলিশের লোকেরা অনেক কষ্টে ভিড় সরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে এসপি সাহেবকে রতিকান্তবাবুদের সামনে এনে দাঁড় করাল।

এসপি সাহেব রতিকান্তবাবুকে সমবেদনা জানিয়ে বললেন, “আপনাদের সমবেদনা জানাবার ভাষাও এই মূহুর্তে আমার মুখে আসছে না। সীমন্তিনীর মত এমন দক্ষ মেয়ে আইপিএস অফিসার আমি আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে একটা ট্র্যাপে পড়ে গিয়ে ওকে এভাবে প্রাণটা হারাতে হল। এমনটা আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি কখনও। তবে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আমাদের ওপরে আদেশ আছে যে সীমন্তিনী ভট্টচার্যিকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদা দিয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবার। তাই এখানকার কলেজের শিক্ষকদের অনুরোধে সেই কলেজের মাঠেই তাকে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধাঞ্জলী দেওয়া হবে। তারপর সেখান থেকে তার মরদেহ আপনারা শ্মশানে নিয়ে যেতে পারবেন। আমরাও শেষ পর্যন্ত আপনাদের সাথেই থাকব। তবে যা শুনছি তাতে মনে হয় কলেজের মাঠে ওনাকে বেশ কিছুক্ষণ রাখতে হবে। অনেকগুলো স্থানীয় সরকারী বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে দলে দলে লোক সীমন্তিনীকে শেষ অভিবাদন জানাতে ইতিমধ্যেই কলেজের মাঠে গিয়ে হাজির হয়েছে। সেখানেই তাকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে গান স্যালিউট দেওয়া হবে। তাই বলছিলাম, আপনাদের বাড়িতে যা কিছু করণীয় সে’সব একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে পারলে ভাল হত”।

রতিকান্তবাবু মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের সম্মতি জানালেন। বাড়ির ভেতরে তখন আরেক প্রস্থ কান্নার রোল শুরু হয়েছে। আর তার তীব্রতা যেন এখন আগের থেকেও অনেক বেশী। ছেলেকে ছোটমার কোলে রেখে রচনা লক্ষ্মীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। বাড়ির ভেতর প্রত্যেকটা লোক তখন পাগলের মত করে কাঁদছে। এমন সময় সীমন্তিনীর দেহটাকে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে বের করতেই হঠাতই বাইরে থেকে তুমুল সমবেত কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। মনে হল আকাশে বাতাসে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে। আর প্রায় সাথে সাথেই অনেকগুলো পুলিশ ঠেলাঠেলি করে লোকজনদের সরিয়ে দিতে দিতে সীমন্তিনীর দেহটাকে বাড়ির ভেতর এনে ঢোকাতে লাগল। রতীশ, সতীশ, সূর্য্য, কিংশুক আর পরিতোষ মিলে ধরাধরি করে সীমন্তিনীর দেহটাকে উঠোনের তুলসীতলায় আগে থেকে পাতা একটা বিছানায় এনে শুইয়ে দিল। সাথে সাথে রচনা, অর্চনা, চন্দু আর নবনীতা সীমন্তিনীর দেহটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অবাধে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। পাশের ঘরের দড়জার সামনে দাঁড়ানো চন্দ্রাদেবীর পায়ের জোর যেন কমে আসছিল। রচনার ছেলেকে দু’হাতে প্রাণপণে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই বসে পড়লেন তিনি। বাইরের পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তখন অনেক লোক বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। বেশীর ভাগই পরিবারের লোকদের মতই হাউ হাউ করে কাঁদছে, কেউ কেউ হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।
 

কিছুক্ষণ বাদে একদিক থেকে সরলাদেবী পাগলের মত আলুথালু বেশে ছুটে এসে সীমন্তিনীর দেহের ওপর আছড়ে পড়লেন। ওদিকে অন্তঃসত্বা অর্চনা সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা শরীরের ওপরেই অজ্ঞান হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। সাথে সাথেই দু’জন নার্স ছুটে এসে অন্য কয়েকজনের সাহায্যে অর্চনাকে তুলে নিয়ে একটা ঘরের দিকে চলে গেল। বাড়ির এবং বাড়ির আশেপাশের আকাশ বাতাস সমবেত কান্নার স্বরে ভরে উঠল। তখন কে আর কাকে প্রবোধ দেয়, কে আর কাকে সামলায়। এভাবে প্রায় মিনিট কুড়ি পেরিয়ে যাবার পর কিছু পুলিশ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে সীমন্তিনীর দেহের খুব কাছে দাঁড়ানো ভিড়কে কিছুটা পেছনে সরিয়ে দিল। কয়েকজন মেয়ে পুলিশ এসে সীমন্তিনীর দেহের ওপর পড়ে কাঁদতে থাকা মেয়ে মহিলাদের প্রবোধ দিতে দিতে টেনে ওঠালো।

এক পুলিশ অফিসার বলল, “শুনুন। আপনারা একটু বোঝবার চেষ্টা করুন। এভাবেই এসব চলতে থাকলে তো দাহ করতে করতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। তাই আপনারা এখানে যা কিছু করণীয় আছে তা একটু তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন। আমরা কিন্তু আর আধঘণ্টা বাদেই ম্যাডামের মরদেহ নিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী দেবার জায়গায় নিয়ে যাব”।

কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেতেই অর্চনা পাগলীর মত ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এসে আবার সীমন্তিনীর শরীরের ওপর পড়ে ‘দিদিভাই দিদিভাই’ বলে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু তখন তার গলা দিয়ে আর এক ফোঁটা স্বরও বেরোচ্ছিল না। রচনা নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে লক্ষ্মীর কাছ থেকে ছোট্ট জলের শিশিটা হাতে নিয়ে অর্চনাকে টেনে তুলে বলল, “যা দিদি, আমাদের দিদিভাইকে শেষবারের মত একটু সাজিয়ে দে” বলেই আবার কেঁদে ফেলল।

______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 30-03-2020, 11:20 AM



Users browsing this thread: 11 Guest(s)