30-03-2020, 11:20 AM
(Update No. 252)
পুলিশের গাড়ির সাহায্যে বাকি রাস্তাটুকু পেরোতে আরও প্রায় পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। বাড়ির সামনে লোকের ভিড় আরও বেশী। তিল ধারনের জায়গা নেই বলা যায়। আশেপাশের বাড়িগুলোর ব্যালকনিতে আর ছাঁদেও মানুষের ভিড়। রাস্তার এপাশে ওপাশে উঁচু উঁচু গাছগুলোতেও অনেক ছেলে আর কম বয়সী পুরুষেরা উঠে সীমন্তিনীদের বাড়ির দিকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। পুলিশের লোকেরা আর রতনের সঙ্গী রিক্সাওয়ালারা গাড়ি থেকে তাদের নামিয়ে ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে তাদের সকলকে বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছে দিল। বাড়ির গেটে পুলিশের ব্যারিকেড। বাইরের কোন লোককে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না তারা। পরিতোষ রচনার ছেলেকে কোলে নিয়েই গেটের সামনে আসতে একজন পুলিশ অফিসার ছুটে এসে পরিতোষের হাত ধরে বলল, “খুবই মর্মান্তিক ঘটণা স্যার। কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। যান ভেতরে যান। ভেতরেও অবশ্য হুলুস্থুল চলছে। বাড়ির লোকেরা যে কেউ যখন তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। আমরা তিন চারজন ডাক্তার আর কয়েকজন নার্সকেও আনিয়েছি। তারা সাধ্যমত পরিচর্যা করছেন। অ্যাম্বুলেন্সও আছে”।
অন্যান্য সকলে ততক্ষণে বাচ্চাটাকে পরিতোষের কাছে ছেড়েই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। আর বাড়ির ভেতরে সেই সাথে সাথে কান্নার রোলও বেড়ে উঠল। পরিতোষ সেই অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “একটা কথা বলুন অফিসার। সীমন্তিনীর বডি এখানে কখন আসবে সে ব্যাপারে কোন খবর আছে আপনাদের কাছে”?
অফিসার বলল, “না স্যার, সে খবর এখনও পাই নি। তবে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে মনে হচ্ছে ভীষণ বড় ধরণের একটা অ্যাম্বুশ হয়েছিল। শুনেছি যে সকাল আটটা নাগাদ ভূটান সীমান্তের ওই জায়গা থেকে আর্মির দুটো হেলিকপ্টারের সাহায্যে সবশুদ্ধ ছত্রিশ জনের ডেডবডি, আর গুরুতর আহত অবস্থায় তিন চার জন পুলিশকে তুলে আনা হয়েছে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে। তার ভেতর নাকি সীমন্তিনী ম্যাডামের বডিও আছে। ওখানে পোস্টমর্টেম হবার পর বডিগুলো বোধহয় তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আমাকে এসপি অফিস থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে আর এ বাড়ির কাউকে শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে। এর পরে আর কোনও আপডেট পাইনি স্যার আমরা”।
পরিতোষদের ট্যাক্সির ড্রাইভার ছেলেটাও তাদের পাশে দাঁড়িয়েই দু’জনের কথা শুনছিল। পরিতোষ এবার অফিসারকে বলল, “নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ তো শিলিগুড়িতেই, তাই না অফিসার। এখান থেকে গাড়িতে সেখানে পৌঁছোতে কতটা সময় লাগতে পারে বলুন তো”?
অফিসার জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, শিলিগুড়িতেই। এখান থেকে কারে যেতে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন মিনিটের মত লাগে। কিন্তু এ বাড়িতে যা অবস্থা চলছে তাতে তো কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। এখান থেকে তার বডি আনতে কে যাবে না যাবে কিছুই বুঝতে পারছি না”।
পরিতোষ অফিসারকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমি সেটা দেখছি অফিসার। আপনি বরং এদিকটাই সামলান আপাততঃ। ভিড় যেভাবে বাড়ছে তাতে কিন্তু সিচুয়েশন কন্ট্রোলের বাইরে চলে যেতে পারে। একটু কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করবেন ব্যাপারটা প্লীজ। কাউকে যেন ফিজিক্যালি হ্যারাস না করা হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ দিন। আর আরও কিছু ফোর্স বা হোমগার্ড এনে রাস্তায় ডিউটিতে লাগিয়ে দিন। অনেকদুর পর্যন্ত কিন্তু রাস্তা পুরো জ্যাম হয়ে গেছে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিলিগুড়ি রওনা দেবার চেষ্টা করছি”।
অফিসারটি বললেন, “ঠিক আছে স্যার, আমি গাড়ির বন্দোবস্ত করছি”।
এমন সময় ড্রাইভার ছেলেটি হাত জোড় করে পরিতোষকে বলল, “স্যার সীমন্তিনী ম্যাডামের কথা আমি আগেও অনেক শুনেছি। বিশেষ করে কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্টে তো ম্যাডামের নাম সকলের মুখে মুখে ঘোরে। তাকে চাক্ষুষ দেখবার সুযোগ কখনও হয়নি। কিন্তু আজ তার জীবনের শেষ দিনে আমি তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি এ কথা ভাবতেও যেন অবাক হচ্ছি। স্যার এটা তো বুঝতেই পারছি আজ সারা দিনে আপনাদের অনেককে অনেক ছোটাছুটি করতে হবে এদিকে সেদিকে। গাড়িরও প্রয়োজন পড়বেই। তাই বলছি স্যার, যদি আমাকে একটু সুযোগ দেন, তাহলে যতক্ষণ অব্দি প্রয়োজন পড়ে আমি আপনাদের সাথে থাকতে চাই। না না, আমি গাড়ি ভাড়া দেবার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছি না স্যার। আমি এ জন্যে একটা পয়সাও নেব না। ধরে নিন না আমার মত নগন্য এক ট্যাক্সিচালক এভাবেই এক সত্যিকারের দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসারকে সম্মান জানাচ্ছে। প্লীজ স্যার। আমাকে এটুকু সুযোগ দিন। আমি সারাটা জীবন আজকের দিনটার কথা মনে করে গর্ব বোধ করব”।
কথাগুলো বলতে বলতে ড্রাইভারটার দু’চোখ থেকে জলের ধারা বইতে শুরু করল। পরিতোষের ভেতর থেকে যেন আরও একবার কান্না উথলে আসছিল। কিন্তু কোনরকমে নিজেকে সামলে সে ড্রাইভার ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “কি নাম তোমার”?
ছেলেটা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে জবাবে বলল, “আমার নাম অজিত স্যার। অজিত সূত্রধর। আমি শিলিগুড়ির শালুগাড়াতে থাকি”।
পরিতোষ তার কাঁধ থপথপিয়ে বলল, “শোনো ভাই, বুঝতেই তো পারছ যে এ অবস্থায় তোমার চা বা খাবারের কোনও বন্দোবস্ত করা কিন্তু আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সেটা যদি তুমি নিজে ম্যানেজ করতে পারো, আর এখানকার থানার অফিসারেরা যদি তোমাকে সে অনুমতি দেয়, তাহলে থাকো। তুমি এনার সাথে কথা বল এ ব্যাপারে। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি”।
পরিতোষ ভেতরে যেতেই আরেকবার কান্নার রোল প্রবল হয়ে উঠল। সকলেই পাগলের মত কান্নাকাটি করছে। পরিতোষ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে বুক ভরে দু তিনটে বড় বড় শ্বাস নিয়ে একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সে ঘরের ভেতর সরলাদেবী, সীমা দেবী, চন্দ্রাদেবীর সাথে অর্চনা, রচনা আর চন্দু, সতীশের স্ত্রী দেবাংশী আর বাড়ির কাজের মহিলারা ছাড়াও আরও দু’তিনজন মেয়ে মহিলারা সমস্বরে কেঁদে চলেছে। রচনা দড়জার খুব কাছেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছিল। পরিতোষ ঝুঁকে নিচু হয়ে রচনার একটা হাত ধরে টেনে তুলে ঘরের বাইরে এনে বলল, “খোকাকে একটু ধর বোন। এত চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ও বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার কোলের ভেতরে। এ সময় বাচ্চাদের মায়ের কোলেই রাখতে হয়। আর নিজেকে সামলাও রচু। তোমার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলাও। দেখ বোন, আমাদের কপালে যা ছিল সেটা তো ঘটেই গেছে। কিছুই তো আর ফিরিয়ে আনতে পারব না আমরা কেউ। কিন্তু নিজেদেরকে তো সামলাতে হবে। তাই বলছি বোন। নিজেকে শক্ত রাখবার চেষ্টা কর। ভুলে যেও না, তুমি এ বাড়ির বড় বৌ। এই মূহুর্তে নিজেকে শক্ত রেখে তোমাকেই সকলকে সামলাতে হবে বোন। আমাকে তো এখনই শিলিগুড়ি যেতে হবে আবার। ওখানে মেডিক্যাল কলেজেই নাকি পোস্ট মর্টেম হচ্ছে। পোস্ট মর্টেম শেষ হবার পরেই বডি দেবে। তাই আমাকে এখনই যেতে হবে নাও। তুমি ছেলেকে কোলে নাও। আর কাকুরা ভাইরা কোথায়? রতু কোথায়”?
রচনা ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজের কান্নার হেঁচকি সামলাতে সামলাতে একটা ঘরের দিকে ঈশারা করে ফ্যাসফেসে গলায় জবাব দিল, “বাবা কাকুরা বোধহয় ও ঘরে আছেন। উনিও হয়তো সেখানেই আছেন”।
পরিতোষ ছেলের দিকে ঈশারা করে বলল, “ওর এতক্ষণে নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। কিছু খাওয়াও ওকে। আমি ওদিকে দেখছি” বলে রচনার দেখানো ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে রতিকান্তবাবুরা তিন ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে চোখের জল ফেলছেন। অচেনা বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোকও সেখানে বসে আছেন। রতীশ আর সূর্যও সে ঘরে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখও লাল হয়ে গেছে। কিন্তু চঞ্চল আর সতীশকে সেখানে দেখা গেল না।
শশীকান্তবাবুর সাথে পরিতোষের চোখাচোখি হতেই পরিতোষ তার দিকেই এগিয়ে গেল। শশীকান্তবাবু পরিতোষের হাতটা ধরে হাউ হাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদবার পর কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “পরিতোষ বাবা। যে বাবা মা ছোট্ট মেয়ের একটা অপরাধের শাস্তি দিতে গিয়ে যদি তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়, সেই বাবা মায়ের কোল খালি করে ভগবান বুঝি এভাবেই শাস্তি দেন। এতদিনে এতগুলো বছর পরে ভগবান আজ আমাদের সে শাস্তিই দিলেন। তোমরাও কেউ আমাদের ক্ষমা কোর না বাবা। কেউ ক্ষমা কোর না। আমরা সবাই সকলের ক্ষমার অযোগ্য”।
পরিতোষ তার দুটো হাত ধরে শুধু ঈশারায় তাকে শান্ত থাকতে বলে রতীশকে ডেকে ঘরের বাইরে এনে বলল, “রতু, কালচিনির কারো কোনও খবর পেয়েছ? ওরা খবর পেয়েছে”?
রতীশ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “খবর তো সকলেই পেয়ে গেছে পরিদা। মা, বাবা, নীতাদি সকলেই শিলিগুড়ির পথে রওনা হয়েছে ন’টা নাগাদ। আর ভাই তো শিলিগুড়িতেই আছে। ও এখন মেডিক্যাল কলেজেই আছে। নীতারাও হয়তো সেখানেই যাবে। আর কোলকাতা থেকে মহিমা বৌদি, বীথিকা আর দীপা বৌদি বেলা এগারোটার ফ্লাইটে উঠছেন। ওনারাও হয়তো সাড়ে বারোটা একটার মধ্যে শিলিগুড়ি পৌঁছে যাবেন। আর ভাই খানিকক্ষণ আগেই ফোন করে জানাল যে নাগরাকাটা থেকে সুরজিত অধিকারী, থানার ওসি ছাড়াও আরও অনেক লোক সেখানে এসে গেছেন। আলিপুরদুয়ার থেকেও নাকি অনেকেই আসছেন শিলিগুড়িতে। এ ছাড়া আর তেমন কিছু জানি না”।
পরিতোষ সব শুনে বলল, “এদিকে বাইরে ওসির মুখে শুনলাম যে সকাল আটটা নাগাদ নাকি অনেক গুলো ডেডবডি দুর্ঘটণাস্থল থেকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে পোস্টমর্টেম হবার পর বডিগুলো যার যার আত্মীয় স্বজনদের হাতে দেওয়া হবে। তাই আমাদের তো এখনই বেরোতে হয় ভাই। বাড়ি থেকে কে কে যাবে, এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা হয়েছে”?
রতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে ব্যাপারে তো কেউ কিছু বলে নি। আমারও মাথা কোন কাজ করছে না পরিদা”।
এমন সময় রচনা ছেলেকে কোলে নিয়ে দড়জা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে রতিকান্তবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “বাবা, দিদিভাইকে তো বাড়িতে আনতে হবে। আমার মনে হয় এখনই বাড়ি থেকে দু’তিনজনের বেরিয়ে পড়া উচিৎ। পরিদা তো যাবেনই। আর আমি চাই পরিদার সাথে আপনার বড় ছেলেও যাক। আর আপনারা আর কেউ যেতে চাইলে তৈরী হয়ে নিন। আর দেরী না করাই ভাল” বলে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “পরিদা তুমি প্লীজ একটু আমার সঙ্গে এসো”।
রচনা পরিতোষকে সঙ্গে নিয়ে তারা আগে যে রুমে থাকত সেখানে এসে দেখে সতীশ আর চঞ্চল সেখানে বসে বসে কাঁদছে। রচনা ঘরে ঢুকে চঞ্চলকে বুকে জড়িয়ে ধরে সতীশের উদ্দেশ্যে বলল, “মেজদাভাই, তুমি চঞ্চুকে নিয়ে একটু ও’ঘরে জেঠুদের কাছে গিয়ে বসো না। আর যারা যারা দিদিভাইকে আনতে যাবেন, তাদের সকলকে প্রস্তুত হতে বলো”।
“ঠিক আছে বৌদিভাই” বলে সতীশ চঞ্চলকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে সীমন্তিনী ছেলেকে কোলে নিয়েই পরিতোষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সোজাসুজি তার চোখের দিকে চেয়ে বলল, “পরিদা, এখন আমি তোমাকে এমন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, যার জবাব একমাত্র তুমি ছাড়া এই মূহুর্তে এ পৃথিবীতে আর কেউ আমাকে দিতে পারবে না। হয়ত আরও দু’ একজন সে প্রশ্নের জবাবটা জানেন। আমার মামনি, মেজমা। কিন্তু এই মূহুর্তে তাদের এ প্রশ্নটা আমি করতে পারছি না। দিদিভাই আমাদের সকলকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। তোমরা তো এখন তার দেহটাকেই শুধু নিয়ে আসবে এখানে যাতে আমরা সকলে শেষ বারের মত আমার দিদিভাইয়ের খোলসটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে পারি। দিদিভাইয়ের কাছে এ প্রশ্নটা আমি বহুবার করেছি। দিদিভাই আমাকে কথা দিয়েছিলেন, যে একদিন না একদিন তিনি সে কথাটা আমাকে বলবেন। কিন্তু আজ ভগবান তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন। দিদিভাইয়ের কাছ থেকে সে জবাব আর আমার পাওয়া হল না। এ মূহুর্তে আমি সেই কথাটাই তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছি পরিদা”।
পরিতোষ রচনার মনের আসল কথাটা বুঝতে পেরে শান্ত কন্ঠেই জবাব দিল, “রচু বোন আমার। তোমার প্রশ্নের জবাব আমি আগেও যেমন দিতে পারিনি, আজও দিতে পারব না। মন্তি যে আমাকে বিশ্বাস করত। তুমি কি চাইছ আজ সে নেই বলেই আমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি? সরি রচু, আমার প্রাণ থাকতে আমি সেটা করতে পারব না”।
রচনা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি দিদিভাইকে যতটা ভালবাসো আমি কি তার চেয়ে তাকে কিছু কম ভালবাসি? কম শ্রদ্ধা করি পরিদা? আমি তো আগেই বললুম যে দিদিভাই নিজেই সে কথাটা আমাকে বলবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান সে সুযোগটুকু দিলেন না আমাকে। কিন্তু আজ এই মূহুর্তে সেটা জানা যে আমার খুব দরকার পরিদা। তুমি কি জানো না, সধবা স্ত্রীরা মারা গেলে তাদের সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে, ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে তাদের চিতায় ওঠাতে হয়। তুমি চাও না? তোমার মন্তি সধবার চিহ্ন নিয়ে এ পৃথিবীর বুক থেকে চলে যাক? বলো চাও না তুমি সেটা”?
পরিতোষ রচনার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “সেটা করা তো আর সম্ভব নয় রে বোন। আমি জানি, মন্তি যাকে নিজের স্বামী বলে মেনে নিয়েছিল সে এখনও বেঁচে আছে। আমিও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে আরও একশ’ বছর বেঁচে থাকুক। কিন্তু মন্তিকে তো তুমি আর সকলের চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তার সিঁথিতে সিঁদুর পড়াবার সুযোগ পাবে না রচু। আর সকলের সামনে সেটা করতে গেলে নানা জনে নানা কথা বলতে শুরু করবে। তাতে তো মন্তিকেই অপমান করা হবে। তবে আমি জানি, মন্তির সিঁথিতে তার স্বামীর নামের সিঁদুর এখনও লেগে আছে। কারো চোখে না পড়লেও আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত। ও সব সময় ওর সিঁথিতে সেই সিঁদুরের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখত”।
রচনা প্রায় স্বগতোক্তির মত করে বলল, “সব সময় সিঁদুরের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখতেন দিদিভাই? কিন্তু দিদিভাইকে তো আমি খুব কাছ থেকে খুব ভাল ভাবে দেখেছি। কখনও সিঁদুর তো দুরের কথা সিঁদুরের সামান্য আভাটুকু পর্যন্ত তার সিঁথিতে কখনও দেখিনি আমি”।
পরিতোষও যেন নিজের মনের সাথেই কথা বলছে, এমনভাবে বিড়বিড় করে বলল, “জলের দাগ কি আর কারো চোখে পড়ে অত সহজে”?
বিড়বিড় করে বলা কথাগুলোও রচনা পরিস্কার ভাবেই শুনতে পেল। তাই সে এবার বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, “জলের দাগ”?
পরিতোষ জল ভরা চোখে রচনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মন্তিকে যে তুমি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতে সে তো আমি জানিই বোন। আজ তুমি যেটা করতে চাইছ সেটা আমিও মনে প্রাণে সমর্থন করি। আমার মনে হয় মন্তির আত্মাও তাতে খুশী হবে। কিন্তু মন্তির কাছে আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাকে সে নিজের স্বামী বলে মানে, আমি বেঁচে থাকতে তার নাম কখনও কারো কাছে প্রকাশ করব না। তাই মন্তিকে দেওয়া কথা রক্ষা করে তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করবার জন্য আমার পক্ষে শুধু এটুকুই বলা সম্ভব বোন। মন্তির ব্যাগে সব সময় ছোট্ট একটা শিশিতে জল ভরা থাকত। মন্তি রোজ স্নানের পর সেই জলই তার সিঁথিতে ছোঁয়াতো। আমার সামনেও দু’একবার এমন করেছে হায়দ্রাবাদে থাকতে। ওই জলটাই ছিল ওর সেই স্বামীর পা ধোঁয়া জল। সেটাকেই সিঁদুর ভেবে ও নিজের সিঁথিতে ছোঁয়াতো রোজ। এর বেশী আর কিছু তোমাকে বলতে পারব না”।
রচনা পরিতোষের কথা শুনে চমকে উঠে মনে মনে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা পরিদা, লক্ষ্মীদির খবর কি গো? সে কোথায় আছে? সে কি শিলিগুড়ি বা এখানে আসছে? বলো না পরিদা”।
পরিতোষ এবার বলল, “না রচু, লক্ষ্মীদির খবর কিছু জানি না আমি। আসলে আমি আমার ফোন সুইচ অফ করে রেখেছি। রতুর কাছেই যা খবরাখবর আসছে”।
রচনা সাথে সাথে বলল, “ইশ, এতোসব ডামাডোলের ভেতরে লক্ষ্মীদির কথা মনেই পড়েনি আমার। ও পরিদা এখনই দিদিভাইয়ের কোয়ার্টারের ল্যান্ডলাইনে একটা কল করনা গো। আমি এখনই লক্ষ্মীদির সাথে একটু কথা বলতে চাই। লক্ষ্মীদিও তো সেখানে একা আছে। সে দিদিভাইকে খুব ভালবাসত। নাজানি সে একা একা কী করছে”।
পরিতোষ পকেট থেকে ফোন বের করে সুইচ অন করতেই হুড়হুড় করে অনেকগুলো মেসেজ আর মিস কলের ইনর্মেশন এসে ঢুকল। সে’সবের দিকে নজর না দিয়ে পরিতোষ সীমন্তিনীর কোয়ার্টারের ল্যান্ডলাইন নাম্বার ডায়াল করল। দু’তিনবার রিং হতেই ওদিক থেকে কান্না ভেজা গলায় লক্ষ্মী ‘হ্যালো’ বলতেই পরিতোষ রচনাকে ফোন দিতেই রচনা বলল, “লক্ষ্মীদি, আমি তোমার বৌদিমণি বলছি গো”।
এ’কথা শুনেই লক্ষ্মী হাউ মাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও বৌদিমণি গো। এ আমাদের কি সর্বনাশ হল গো। আমাদের কপালে ভগবান এই লিখে রেখেছিলেন? আচ্ছা বৌদিমণি, দিদিমণিকে নাকি শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেছে? তুমি কি ওখানেই আছ? আমার যে খুব ইচ্ছে করছে দিদিমণির মুখটা একটুখানি দেখতে গো। কিন্তু কে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে বল? আমি একাও তো যেতে পারব না। আমি কি
আমার দিদিমণির মুখটা একবারটি শেষ বারের জন্য দেখতেও পাব না, বৌদিমণি”?
লক্ষ্মীর কথা শুনে রচনাও কাঁদতে শুরু করল। ওদিক থেকে লক্ষ্মী এক নাগাড়ে কেঁদে কেঁদে বিলাপ করে যাচ্ছে। রচনা বেশ কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি যদি তোমার দিদিমণিকে শেষ দেখা দেখতে চাও তাহলে চট করে তোমার জামা কাপড় কিছু গুছিয়ে নাও। আমি তোমাকে আনবার ব্যবস্থা করছি। আর লক্ষ্মীদি তোমাকে সাথে করে দিদিভাইয়ের একটা জিনিস নিয়ে আসতে হবে গো। সে জিনিসটার এখন খুব দরকার। আমি তোমাকে বলছি। একটু মন দিয়ে শোন। দিদিভাইয়ের ভ্যানিটি ব্যাগটার ভেতরে একটা ছোট্ট জলের শিশি আছে। সেই শিশিটা নিয়ে এস। আর যদি সেটা খুঁজে না পাও, বা তাতে যদি জল না থেকে থাকে, তাহলে ঠাকুরঘরে যে তোমার দিদিমণির দাদাভাইয়ের একটা ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে, সে ছবিটার পেছনে দেখবে একটা ছোট্ট তাকের মত আছে। সেই তাকের ওপর একটা জলের বোতল রাখা আছে। সেই বোতলটাকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। নইলে ওই বোতল থেকে ছোট্ট শিশিটাতে কিছুটা জল ঢেলে নিয়ে আসবে। বুঝেছ তো”?
লক্ষ্মী রাজি হতেই রচনা ফোন কেটে দিয়ে পরিতোষকে বলল, “তুমি একটু এখানেই থাকো পরিদা। আমি আসছি এখুনি” বলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আবার খানিক বাদেই রতীশের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে এসে রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা সোনা, নাগরাকাটা থেকে লক্ষ্মীদিকে যে আনতে হবে এখানে। সেখান থেকে কেউ কি শিলিগুড়ি বা এখানে আসছে”?
রতীশ বলল, “নাগরাকাটা থানার ওসি আর কয়েকজন শিলিগুড়িতে এসেছে জানি। কিন্তু তারা তো কেউ আর এখন শিলিগুড়ি থেকে সেখানে গিয়ে লক্ষ্মীদিকে আর আনতে পারবে না। শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ থেকে নাগরাকাটার দুরত্ব তো অনেক। প্রায় আশি কিলোমিটারের মত। যেতে আসতে তো প্রায় চার ঘন্টার মত সময় লেগে যাবে”।
রচনা সাথে সাথে হাত পেতে বলল, “আমার ফোনটা যে কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না। তুমি নীতাদির নাম্বার লাগিয়ে ফোনটা আমাকে দিয়ে একটু ও’ঘরে গিয়ে দেখ তো আমার ব্যাগটা সেখানে আছে কি না। ব্যাগের ভেতরেই ফোনটা আছে। পেলে একটু এনে দিও প্লীজ”।
______________________________
পুলিশের গাড়ির সাহায্যে বাকি রাস্তাটুকু পেরোতে আরও প্রায় পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। বাড়ির সামনে লোকের ভিড় আরও বেশী। তিল ধারনের জায়গা নেই বলা যায়। আশেপাশের বাড়িগুলোর ব্যালকনিতে আর ছাঁদেও মানুষের ভিড়। রাস্তার এপাশে ওপাশে উঁচু উঁচু গাছগুলোতেও অনেক ছেলে আর কম বয়সী পুরুষেরা উঠে সীমন্তিনীদের বাড়ির দিকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। পুলিশের লোকেরা আর রতনের সঙ্গী রিক্সাওয়ালারা গাড়ি থেকে তাদের নামিয়ে ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে তাদের সকলকে বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছে দিল। বাড়ির গেটে পুলিশের ব্যারিকেড। বাইরের কোন লোককে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না তারা। পরিতোষ রচনার ছেলেকে কোলে নিয়েই গেটের সামনে আসতে একজন পুলিশ অফিসার ছুটে এসে পরিতোষের হাত ধরে বলল, “খুবই মর্মান্তিক ঘটণা স্যার। কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। যান ভেতরে যান। ভেতরেও অবশ্য হুলুস্থুল চলছে। বাড়ির লোকেরা যে কেউ যখন তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। আমরা তিন চারজন ডাক্তার আর কয়েকজন নার্সকেও আনিয়েছি। তারা সাধ্যমত পরিচর্যা করছেন। অ্যাম্বুলেন্সও আছে”।
অন্যান্য সকলে ততক্ষণে বাচ্চাটাকে পরিতোষের কাছে ছেড়েই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। আর বাড়ির ভেতরে সেই সাথে সাথে কান্নার রোলও বেড়ে উঠল। পরিতোষ সেই অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “একটা কথা বলুন অফিসার। সীমন্তিনীর বডি এখানে কখন আসবে সে ব্যাপারে কোন খবর আছে আপনাদের কাছে”?
অফিসার বলল, “না স্যার, সে খবর এখনও পাই নি। তবে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে মনে হচ্ছে ভীষণ বড় ধরণের একটা অ্যাম্বুশ হয়েছিল। শুনেছি যে সকাল আটটা নাগাদ ভূটান সীমান্তের ওই জায়গা থেকে আর্মির দুটো হেলিকপ্টারের সাহায্যে সবশুদ্ধ ছত্রিশ জনের ডেডবডি, আর গুরুতর আহত অবস্থায় তিন চার জন পুলিশকে তুলে আনা হয়েছে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে। তার ভেতর নাকি সীমন্তিনী ম্যাডামের বডিও আছে। ওখানে পোস্টমর্টেম হবার পর বডিগুলো বোধহয় তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আমাকে এসপি অফিস থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে আর এ বাড়ির কাউকে শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে। এর পরে আর কোনও আপডেট পাইনি স্যার আমরা”।
পরিতোষদের ট্যাক্সির ড্রাইভার ছেলেটাও তাদের পাশে দাঁড়িয়েই দু’জনের কথা শুনছিল। পরিতোষ এবার অফিসারকে বলল, “নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ তো শিলিগুড়িতেই, তাই না অফিসার। এখান থেকে গাড়িতে সেখানে পৌঁছোতে কতটা সময় লাগতে পারে বলুন তো”?
অফিসার জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, শিলিগুড়িতেই। এখান থেকে কারে যেতে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন মিনিটের মত লাগে। কিন্তু এ বাড়িতে যা অবস্থা চলছে তাতে তো কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। এখান থেকে তার বডি আনতে কে যাবে না যাবে কিছুই বুঝতে পারছি না”।
পরিতোষ অফিসারকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমি সেটা দেখছি অফিসার। আপনি বরং এদিকটাই সামলান আপাততঃ। ভিড় যেভাবে বাড়ছে তাতে কিন্তু সিচুয়েশন কন্ট্রোলের বাইরে চলে যেতে পারে। একটু কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করবেন ব্যাপারটা প্লীজ। কাউকে যেন ফিজিক্যালি হ্যারাস না করা হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ দিন। আর আরও কিছু ফোর্স বা হোমগার্ড এনে রাস্তায় ডিউটিতে লাগিয়ে দিন। অনেকদুর পর্যন্ত কিন্তু রাস্তা পুরো জ্যাম হয়ে গেছে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিলিগুড়ি রওনা দেবার চেষ্টা করছি”।
অফিসারটি বললেন, “ঠিক আছে স্যার, আমি গাড়ির বন্দোবস্ত করছি”।
এমন সময় ড্রাইভার ছেলেটি হাত জোড় করে পরিতোষকে বলল, “স্যার সীমন্তিনী ম্যাডামের কথা আমি আগেও অনেক শুনেছি। বিশেষ করে কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্টে তো ম্যাডামের নাম সকলের মুখে মুখে ঘোরে। তাকে চাক্ষুষ দেখবার সুযোগ কখনও হয়নি। কিন্তু আজ তার জীবনের শেষ দিনে আমি তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি এ কথা ভাবতেও যেন অবাক হচ্ছি। স্যার এটা তো বুঝতেই পারছি আজ সারা দিনে আপনাদের অনেককে অনেক ছোটাছুটি করতে হবে এদিকে সেদিকে। গাড়িরও প্রয়োজন পড়বেই। তাই বলছি স্যার, যদি আমাকে একটু সুযোগ দেন, তাহলে যতক্ষণ অব্দি প্রয়োজন পড়ে আমি আপনাদের সাথে থাকতে চাই। না না, আমি গাড়ি ভাড়া দেবার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছি না স্যার। আমি এ জন্যে একটা পয়সাও নেব না। ধরে নিন না আমার মত নগন্য এক ট্যাক্সিচালক এভাবেই এক সত্যিকারের দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসারকে সম্মান জানাচ্ছে। প্লীজ স্যার। আমাকে এটুকু সুযোগ দিন। আমি সারাটা জীবন আজকের দিনটার কথা মনে করে গর্ব বোধ করব”।
কথাগুলো বলতে বলতে ড্রাইভারটার দু’চোখ থেকে জলের ধারা বইতে শুরু করল। পরিতোষের ভেতর থেকে যেন আরও একবার কান্না উথলে আসছিল। কিন্তু কোনরকমে নিজেকে সামলে সে ড্রাইভার ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “কি নাম তোমার”?
ছেলেটা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে জবাবে বলল, “আমার নাম অজিত স্যার। অজিত সূত্রধর। আমি শিলিগুড়ির শালুগাড়াতে থাকি”।
পরিতোষ তার কাঁধ থপথপিয়ে বলল, “শোনো ভাই, বুঝতেই তো পারছ যে এ অবস্থায় তোমার চা বা খাবারের কোনও বন্দোবস্ত করা কিন্তু আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সেটা যদি তুমি নিজে ম্যানেজ করতে পারো, আর এখানকার থানার অফিসারেরা যদি তোমাকে সে অনুমতি দেয়, তাহলে থাকো। তুমি এনার সাথে কথা বল এ ব্যাপারে। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি”।
পরিতোষ ভেতরে যেতেই আরেকবার কান্নার রোল প্রবল হয়ে উঠল। সকলেই পাগলের মত কান্নাকাটি করছে। পরিতোষ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে বুক ভরে দু তিনটে বড় বড় শ্বাস নিয়ে একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সে ঘরের ভেতর সরলাদেবী, সীমা দেবী, চন্দ্রাদেবীর সাথে অর্চনা, রচনা আর চন্দু, সতীশের স্ত্রী দেবাংশী আর বাড়ির কাজের মহিলারা ছাড়াও আরও দু’তিনজন মেয়ে মহিলারা সমস্বরে কেঁদে চলেছে। রচনা দড়জার খুব কাছেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছিল। পরিতোষ ঝুঁকে নিচু হয়ে রচনার একটা হাত ধরে টেনে তুলে ঘরের বাইরে এনে বলল, “খোকাকে একটু ধর বোন। এত চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ও বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার কোলের ভেতরে। এ সময় বাচ্চাদের মায়ের কোলেই রাখতে হয়। আর নিজেকে সামলাও রচু। তোমার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলাও। দেখ বোন, আমাদের কপালে যা ছিল সেটা তো ঘটেই গেছে। কিছুই তো আর ফিরিয়ে আনতে পারব না আমরা কেউ। কিন্তু নিজেদেরকে তো সামলাতে হবে। তাই বলছি বোন। নিজেকে শক্ত রাখবার চেষ্টা কর। ভুলে যেও না, তুমি এ বাড়ির বড় বৌ। এই মূহুর্তে নিজেকে শক্ত রেখে তোমাকেই সকলকে সামলাতে হবে বোন। আমাকে তো এখনই শিলিগুড়ি যেতে হবে আবার। ওখানে মেডিক্যাল কলেজেই নাকি পোস্ট মর্টেম হচ্ছে। পোস্ট মর্টেম শেষ হবার পরেই বডি দেবে। তাই আমাকে এখনই যেতে হবে নাও। তুমি ছেলেকে কোলে নাও। আর কাকুরা ভাইরা কোথায়? রতু কোথায়”?
রচনা ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজের কান্নার হেঁচকি সামলাতে সামলাতে একটা ঘরের দিকে ঈশারা করে ফ্যাসফেসে গলায় জবাব দিল, “বাবা কাকুরা বোধহয় ও ঘরে আছেন। উনিও হয়তো সেখানেই আছেন”।
পরিতোষ ছেলের দিকে ঈশারা করে বলল, “ওর এতক্ষণে নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। কিছু খাওয়াও ওকে। আমি ওদিকে দেখছি” বলে রচনার দেখানো ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে রতিকান্তবাবুরা তিন ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে চোখের জল ফেলছেন। অচেনা বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোকও সেখানে বসে আছেন। রতীশ আর সূর্যও সে ঘরে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখও লাল হয়ে গেছে। কিন্তু চঞ্চল আর সতীশকে সেখানে দেখা গেল না।
শশীকান্তবাবুর সাথে পরিতোষের চোখাচোখি হতেই পরিতোষ তার দিকেই এগিয়ে গেল। শশীকান্তবাবু পরিতোষের হাতটা ধরে হাউ হাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদবার পর কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “পরিতোষ বাবা। যে বাবা মা ছোট্ট মেয়ের একটা অপরাধের শাস্তি দিতে গিয়ে যদি তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়, সেই বাবা মায়ের কোল খালি করে ভগবান বুঝি এভাবেই শাস্তি দেন। এতদিনে এতগুলো বছর পরে ভগবান আজ আমাদের সে শাস্তিই দিলেন। তোমরাও কেউ আমাদের ক্ষমা কোর না বাবা। কেউ ক্ষমা কোর না। আমরা সবাই সকলের ক্ষমার অযোগ্য”।
পরিতোষ তার দুটো হাত ধরে শুধু ঈশারায় তাকে শান্ত থাকতে বলে রতীশকে ডেকে ঘরের বাইরে এনে বলল, “রতু, কালচিনির কারো কোনও খবর পেয়েছ? ওরা খবর পেয়েছে”?
রতীশ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “খবর তো সকলেই পেয়ে গেছে পরিদা। মা, বাবা, নীতাদি সকলেই শিলিগুড়ির পথে রওনা হয়েছে ন’টা নাগাদ। আর ভাই তো শিলিগুড়িতেই আছে। ও এখন মেডিক্যাল কলেজেই আছে। নীতারাও হয়তো সেখানেই যাবে। আর কোলকাতা থেকে মহিমা বৌদি, বীথিকা আর দীপা বৌদি বেলা এগারোটার ফ্লাইটে উঠছেন। ওনারাও হয়তো সাড়ে বারোটা একটার মধ্যে শিলিগুড়ি পৌঁছে যাবেন। আর ভাই খানিকক্ষণ আগেই ফোন করে জানাল যে নাগরাকাটা থেকে সুরজিত অধিকারী, থানার ওসি ছাড়াও আরও অনেক লোক সেখানে এসে গেছেন। আলিপুরদুয়ার থেকেও নাকি অনেকেই আসছেন শিলিগুড়িতে। এ ছাড়া আর তেমন কিছু জানি না”।
পরিতোষ সব শুনে বলল, “এদিকে বাইরে ওসির মুখে শুনলাম যে সকাল আটটা নাগাদ নাকি অনেক গুলো ডেডবডি দুর্ঘটণাস্থল থেকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে পোস্টমর্টেম হবার পর বডিগুলো যার যার আত্মীয় স্বজনদের হাতে দেওয়া হবে। তাই আমাদের তো এখনই বেরোতে হয় ভাই। বাড়ি থেকে কে কে যাবে, এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা হয়েছে”?
রতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে ব্যাপারে তো কেউ কিছু বলে নি। আমারও মাথা কোন কাজ করছে না পরিদা”।
এমন সময় রচনা ছেলেকে কোলে নিয়ে দড়জা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে রতিকান্তবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “বাবা, দিদিভাইকে তো বাড়িতে আনতে হবে। আমার মনে হয় এখনই বাড়ি থেকে দু’তিনজনের বেরিয়ে পড়া উচিৎ। পরিদা তো যাবেনই। আর আমি চাই পরিদার সাথে আপনার বড় ছেলেও যাক। আর আপনারা আর কেউ যেতে চাইলে তৈরী হয়ে নিন। আর দেরী না করাই ভাল” বলে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “পরিদা তুমি প্লীজ একটু আমার সঙ্গে এসো”।
রচনা পরিতোষকে সঙ্গে নিয়ে তারা আগে যে রুমে থাকত সেখানে এসে দেখে সতীশ আর চঞ্চল সেখানে বসে বসে কাঁদছে। রচনা ঘরে ঢুকে চঞ্চলকে বুকে জড়িয়ে ধরে সতীশের উদ্দেশ্যে বলল, “মেজদাভাই, তুমি চঞ্চুকে নিয়ে একটু ও’ঘরে জেঠুদের কাছে গিয়ে বসো না। আর যারা যারা দিদিভাইকে আনতে যাবেন, তাদের সকলকে প্রস্তুত হতে বলো”।
“ঠিক আছে বৌদিভাই” বলে সতীশ চঞ্চলকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে সীমন্তিনী ছেলেকে কোলে নিয়েই পরিতোষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সোজাসুজি তার চোখের দিকে চেয়ে বলল, “পরিদা, এখন আমি তোমাকে এমন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, যার জবাব একমাত্র তুমি ছাড়া এই মূহুর্তে এ পৃথিবীতে আর কেউ আমাকে দিতে পারবে না। হয়ত আরও দু’ একজন সে প্রশ্নের জবাবটা জানেন। আমার মামনি, মেজমা। কিন্তু এই মূহুর্তে তাদের এ প্রশ্নটা আমি করতে পারছি না। দিদিভাই আমাদের সকলকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। তোমরা তো এখন তার দেহটাকেই শুধু নিয়ে আসবে এখানে যাতে আমরা সকলে শেষ বারের মত আমার দিদিভাইয়ের খোলসটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে পারি। দিদিভাইয়ের কাছে এ প্রশ্নটা আমি বহুবার করেছি। দিদিভাই আমাকে কথা দিয়েছিলেন, যে একদিন না একদিন তিনি সে কথাটা আমাকে বলবেন। কিন্তু আজ ভগবান তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন। দিদিভাইয়ের কাছ থেকে সে জবাব আর আমার পাওয়া হল না। এ মূহুর্তে আমি সেই কথাটাই তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছি পরিদা”।
পরিতোষ রচনার মনের আসল কথাটা বুঝতে পেরে শান্ত কন্ঠেই জবাব দিল, “রচু বোন আমার। তোমার প্রশ্নের জবাব আমি আগেও যেমন দিতে পারিনি, আজও দিতে পারব না। মন্তি যে আমাকে বিশ্বাস করত। তুমি কি চাইছ আজ সে নেই বলেই আমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি? সরি রচু, আমার প্রাণ থাকতে আমি সেটা করতে পারব না”।
রচনা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি দিদিভাইকে যতটা ভালবাসো আমি কি তার চেয়ে তাকে কিছু কম ভালবাসি? কম শ্রদ্ধা করি পরিদা? আমি তো আগেই বললুম যে দিদিভাই নিজেই সে কথাটা আমাকে বলবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান সে সুযোগটুকু দিলেন না আমাকে। কিন্তু আজ এই মূহুর্তে সেটা জানা যে আমার খুব দরকার পরিদা। তুমি কি জানো না, সধবা স্ত্রীরা মারা গেলে তাদের সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে, ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে তাদের চিতায় ওঠাতে হয়। তুমি চাও না? তোমার মন্তি সধবার চিহ্ন নিয়ে এ পৃথিবীর বুক থেকে চলে যাক? বলো চাও না তুমি সেটা”?
পরিতোষ রচনার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “সেটা করা তো আর সম্ভব নয় রে বোন। আমি জানি, মন্তি যাকে নিজের স্বামী বলে মেনে নিয়েছিল সে এখনও বেঁচে আছে। আমিও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে আরও একশ’ বছর বেঁচে থাকুক। কিন্তু মন্তিকে তো তুমি আর সকলের চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তার সিঁথিতে সিঁদুর পড়াবার সুযোগ পাবে না রচু। আর সকলের সামনে সেটা করতে গেলে নানা জনে নানা কথা বলতে শুরু করবে। তাতে তো মন্তিকেই অপমান করা হবে। তবে আমি জানি, মন্তির সিঁথিতে তার স্বামীর নামের সিঁদুর এখনও লেগে আছে। কারো চোখে না পড়লেও আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত। ও সব সময় ওর সিঁথিতে সেই সিঁদুরের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখত”।
রচনা প্রায় স্বগতোক্তির মত করে বলল, “সব সময় সিঁদুরের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখতেন দিদিভাই? কিন্তু দিদিভাইকে তো আমি খুব কাছ থেকে খুব ভাল ভাবে দেখেছি। কখনও সিঁদুর তো দুরের কথা সিঁদুরের সামান্য আভাটুকু পর্যন্ত তার সিঁথিতে কখনও দেখিনি আমি”।
পরিতোষও যেন নিজের মনের সাথেই কথা বলছে, এমনভাবে বিড়বিড় করে বলল, “জলের দাগ কি আর কারো চোখে পড়ে অত সহজে”?
বিড়বিড় করে বলা কথাগুলোও রচনা পরিস্কার ভাবেই শুনতে পেল। তাই সে এবার বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, “জলের দাগ”?
পরিতোষ জল ভরা চোখে রচনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মন্তিকে যে তুমি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতে সে তো আমি জানিই বোন। আজ তুমি যেটা করতে চাইছ সেটা আমিও মনে প্রাণে সমর্থন করি। আমার মনে হয় মন্তির আত্মাও তাতে খুশী হবে। কিন্তু মন্তির কাছে আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাকে সে নিজের স্বামী বলে মানে, আমি বেঁচে থাকতে তার নাম কখনও কারো কাছে প্রকাশ করব না। তাই মন্তিকে দেওয়া কথা রক্ষা করে তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করবার জন্য আমার পক্ষে শুধু এটুকুই বলা সম্ভব বোন। মন্তির ব্যাগে সব সময় ছোট্ট একটা শিশিতে জল ভরা থাকত। মন্তি রোজ স্নানের পর সেই জলই তার সিঁথিতে ছোঁয়াতো। আমার সামনেও দু’একবার এমন করেছে হায়দ্রাবাদে থাকতে। ওই জলটাই ছিল ওর সেই স্বামীর পা ধোঁয়া জল। সেটাকেই সিঁদুর ভেবে ও নিজের সিঁথিতে ছোঁয়াতো রোজ। এর বেশী আর কিছু তোমাকে বলতে পারব না”।
রচনা পরিতোষের কথা শুনে চমকে উঠে মনে মনে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা পরিদা, লক্ষ্মীদির খবর কি গো? সে কোথায় আছে? সে কি শিলিগুড়ি বা এখানে আসছে? বলো না পরিদা”।
পরিতোষ এবার বলল, “না রচু, লক্ষ্মীদির খবর কিছু জানি না আমি। আসলে আমি আমার ফোন সুইচ অফ করে রেখেছি। রতুর কাছেই যা খবরাখবর আসছে”।
রচনা সাথে সাথে বলল, “ইশ, এতোসব ডামাডোলের ভেতরে লক্ষ্মীদির কথা মনেই পড়েনি আমার। ও পরিদা এখনই দিদিভাইয়ের কোয়ার্টারের ল্যান্ডলাইনে একটা কল করনা গো। আমি এখনই লক্ষ্মীদির সাথে একটু কথা বলতে চাই। লক্ষ্মীদিও তো সেখানে একা আছে। সে দিদিভাইকে খুব ভালবাসত। নাজানি সে একা একা কী করছে”।
পরিতোষ পকেট থেকে ফোন বের করে সুইচ অন করতেই হুড়হুড় করে অনেকগুলো মেসেজ আর মিস কলের ইনর্মেশন এসে ঢুকল। সে’সবের দিকে নজর না দিয়ে পরিতোষ সীমন্তিনীর কোয়ার্টারের ল্যান্ডলাইন নাম্বার ডায়াল করল। দু’তিনবার রিং হতেই ওদিক থেকে কান্না ভেজা গলায় লক্ষ্মী ‘হ্যালো’ বলতেই পরিতোষ রচনাকে ফোন দিতেই রচনা বলল, “লক্ষ্মীদি, আমি তোমার বৌদিমণি বলছি গো”।
এ’কথা শুনেই লক্ষ্মী হাউ মাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও বৌদিমণি গো। এ আমাদের কি সর্বনাশ হল গো। আমাদের কপালে ভগবান এই লিখে রেখেছিলেন? আচ্ছা বৌদিমণি, দিদিমণিকে নাকি শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেছে? তুমি কি ওখানেই আছ? আমার যে খুব ইচ্ছে করছে দিদিমণির মুখটা একটুখানি দেখতে গো। কিন্তু কে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে বল? আমি একাও তো যেতে পারব না। আমি কি
আমার দিদিমণির মুখটা একবারটি শেষ বারের জন্য দেখতেও পাব না, বৌদিমণি”?
লক্ষ্মীর কথা শুনে রচনাও কাঁদতে শুরু করল। ওদিক থেকে লক্ষ্মী এক নাগাড়ে কেঁদে কেঁদে বিলাপ করে যাচ্ছে। রচনা বেশ কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি যদি তোমার দিদিমণিকে শেষ দেখা দেখতে চাও তাহলে চট করে তোমার জামা কাপড় কিছু গুছিয়ে নাও। আমি তোমাকে আনবার ব্যবস্থা করছি। আর লক্ষ্মীদি তোমাকে সাথে করে দিদিভাইয়ের একটা জিনিস নিয়ে আসতে হবে গো। সে জিনিসটার এখন খুব দরকার। আমি তোমাকে বলছি। একটু মন দিয়ে শোন। দিদিভাইয়ের ভ্যানিটি ব্যাগটার ভেতরে একটা ছোট্ট জলের শিশি আছে। সেই শিশিটা নিয়ে এস। আর যদি সেটা খুঁজে না পাও, বা তাতে যদি জল না থেকে থাকে, তাহলে ঠাকুরঘরে যে তোমার দিদিমণির দাদাভাইয়ের একটা ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে, সে ছবিটার পেছনে দেখবে একটা ছোট্ট তাকের মত আছে। সেই তাকের ওপর একটা জলের বোতল রাখা আছে। সেই বোতলটাকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। নইলে ওই বোতল থেকে ছোট্ট শিশিটাতে কিছুটা জল ঢেলে নিয়ে আসবে। বুঝেছ তো”?
লক্ষ্মী রাজি হতেই রচনা ফোন কেটে দিয়ে পরিতোষকে বলল, “তুমি একটু এখানেই থাকো পরিদা। আমি আসছি এখুনি” বলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আবার খানিক বাদেই রতীশের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে এসে রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা সোনা, নাগরাকাটা থেকে লক্ষ্মীদিকে যে আনতে হবে এখানে। সেখান থেকে কেউ কি শিলিগুড়ি বা এখানে আসছে”?
রতীশ বলল, “নাগরাকাটা থানার ওসি আর কয়েকজন শিলিগুড়িতে এসেছে জানি। কিন্তু তারা তো কেউ আর এখন শিলিগুড়ি থেকে সেখানে গিয়ে লক্ষ্মীদিকে আর আনতে পারবে না। শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ থেকে নাগরাকাটার দুরত্ব তো অনেক। প্রায় আশি কিলোমিটারের মত। যেতে আসতে তো প্রায় চার ঘন্টার মত সময় লেগে যাবে”।
রচনা সাথে সাথে হাত পেতে বলল, “আমার ফোনটা যে কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না। তুমি নীতাদির নাম্বার লাগিয়ে ফোনটা আমাকে দিয়ে একটু ও’ঘরে গিয়ে দেখ তো আমার ব্যাগটা সেখানে আছে কি না। ব্যাগের ভেতরেই ফোনটা আছে। পেলে একটু এনে দিও প্লীজ”।
______________________________