30-03-2020, 11:19 AM
(Update No. 251)
এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটণাও ঘটে গেছে। পরিতোষ আর অর্চনা একে অপরকে নিয়ে খুব সুখে শান্তিতে সংসার করছে।
সীমন্তিনীর কথায় রতীশকে অর্চনার বিয়ের সময় ছুটি দেবার সময় মহিমা তাকে নিজেদের মালহোত্রা সেন যোগা ইনস্টিটিউট থেকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে দিয়েছিল অর্চনা আর পরিতোষের আশীর্বাদের তিন দিন আগে। তবে তার বিনিময়ে সীমন্তিনী আর রতীশকে মহিমার দুটো শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল। প্রথম শর্ত মতে উত্তর কলকাতায় মহিমা রতীশের জন্য বেশ বড়সড় জায়গায় একটা যোগা সেন্টার বানিয়ে দিয়ে সেটা রচনার নামে লিখে দিয়েছিল। রতীশও ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সেন্টারটা সাজিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করেছে ২০১৩ সালের মে মাস থেকে। তার তিন মাস বাদে ১৫ই আগস্টে মহিমার মার্কেট কমপ্লেক্সের উদ্বোধন হয়েছে। মহিমার দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে কলকাতায় মহিমার মার্কেট কমপ্লেক্সের উদ্বোধনের দিন সীমন্তিনীকে সেখানে উপস্থিত হতে হয়েছিল। সীমন্তিনীর সাথে পরিতোষ, অর্চনা, রতীশ আর রচনাও সে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। নবনীতাই শুধু যায় নি।
অর্চনা আর পরিতোষের বিয়ের মাস পাঁচেক পরে বিধুবাবুদের নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল। বিমল আগরওয়ালার অপারেশন থেকে যা টাকা পাওয়া গিয়েছিল তাতে বাড়ি তৈরী আর সমস্ত খরচ খরচার পরেও পঁচিশ লক্ষ টাকা পরিতোষের হাতে থেকে গিয়েছিল। অর্চনা আর পরিতোষের বিয়ের পরের বছর পরিতোষের সাথে পরামর্শ করে সীমন্তিনী কালচিনির বিধুবাবুর দোকানটাকে বড় করে সেই দোকানের ঠিক পাশেই আরও তিনটে রুমে নবনীতার জন্যে একটা বুটিক বানিয়ে দিয়েছিল দুর্গাপূজোর ঠিক আগে আগে। নবনীতা জয়া ম্যাডামের কারখানায় মাস ছয়েকের ভেতরেই সমস্তকিছু শিখে ফেলেছিল। অর্চনার বিয়ের প্রায় এগারো মাস বাদেই নবনীতা জয়া ম্যাডামের ওখান থেকে পাকাপাকিভাবে ছুটি নিয়ে সীমন্তিনীকে আর নাগরাকাটা ছেড়ে কালচিনিতে এসে নিজের বুটিক খুলে বিধুবাবু আর বিভাদেবীর আরেক মেয়ে হয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেছে। সে আর কলকাতা ফিরে আসতে রাজী ছিল না। বিধুবাবু আর বিভাদেবীও নবনীতাকে তাদের অন্য দুই মেয়ের মতই আপন করে নিয়েছেন। আর অমন স্নেহশীল এক পরিবারের একজন হয়ে নবনীতাও খুব সুখে আছে। এখন কালচিনিতে তার বুটিকের খুব নামডাক। নিজের ডিজাইন করা সামগ্রী ছাড়াও সে জয়া ম্যাডামের কারখানা থেকে থেকে প্রচুর মাল নিয়ে আসে। নবনীতার মিষ্টি কথায় আর ব্যবহারে তার দোকানের গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কিংশুক হায়ার সেকেন্ডারীতে রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েও কোনও বিশেষ কোর্স নিয়ে পড়তে চায়নি। মালবাজারের এক কলেজ থেকে বিএ পাশ করে সে এখন নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিকাল সায়েন্সে মাস্টার্স করছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেসের কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সীমন্তিনী এখনও তাকে সবরকম সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে ঠিক আগের মতই। শিলিগুড়িতে সীমন্তিনী তার এক বান্ধবীর বাড়িতে কিংশুককে পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ছুটি ছাটায় বাড়ি এলে কিংশুক তার নতুনদি আর বাবার ব্যবসায় যথাসম্ভব সাহায্য করে। অর্চনার বিয়ের সময় থেকেই সে নবনীতাকে নতুনদি বলে ডাকে আর নিজের দিদির মতই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। নবনীতাও বিধুবাবু, বিভাদেবী, আর কিংশুককে নিজের বাবা মা আর ছোট ভাই হিসেবে পেয়ে খুব খুশী। সে এখন মনে মনে ভাবে, ভাগ্য বিরূপ না হলে সে আমৃত্যু বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সংসারে তাদের পাশে নিজের মেয়ে হয়েই থাকবে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রচনা ফুটফুটে একটি পূত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। তবে তার আগেই তারা আগের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে পরিতোষদের বাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গায় একটা টু বেডরম ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে এসেছে। সীমন্তিনীই তার নাম রেখেছে যিষ্ণু। অর্চনা আর রচনার পরিবারের সাথে মহিমা, বীথিকা, ডঃ দিব্যেন্দু আর আব্দুল ও তার পরিবারের যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এরা সকলেই যেন সকলের নিকট আত্মীয়ও হয়ে উঠেছে। রচনার বাচ্চার জন্মের সময় রাজগঞ্জের বাড়ি থেকে সরলাদেবী, চন্দ্রাদেবী আর কালচিনি থেকে বিভাদেবী এসে কলকাতায় তাদের দু’মেয়ের বাড়িতে তিন মাস থেকে গেছেন। দু’দিনের জন্যে সীমন্তিনী আর নবনীতাও এসেছিল কলকাতায়।
দেশদ্রোহিতা, একাধিক খুন এবং তার সাথে আরও অনেকগুলো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হবার ফলে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারে বিমল আগরওয়ালার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। বিমল সুপ্রীম কোর্টে অ্যাপীল করেছে। তবে সুপ্রীম কোর্টে মামলার শুনানি এখনও চলছে। সবিতা আগরওয়ালা আর বিকি তাদের কলকাতার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত কিছু বিক্রী করে দিয়ে নিজেদের দেশের বাড়ি রাজস্থানে চলে গেছে।
২০১৫ সালের আগস্ট মাস। চার মাস আগেই ২৫শে এপ্রিল নেপালে ঘটে গেছে সেই বিধ্বংসী ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পে প্রায় ন’হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল। অনেক গ্রাম এবং শহরের প্রচুর পরিমান বাড়িঘর, মন্দির, পুল, রাস্তাঘাট ও স্থাপত্য ধুলিস্যাত হয়ে গিয়েছিল। ভূমিকম্প পরবর্তী আফটার শকেও নেপালের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় শ’ তিনেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের তীব্র স্পন্দন অনুভূত হয়েছিল ভূটান, তিব্বত এবং আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ উত্তর অঞ্চল এবং সিকিম সহ গোটা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে। এর চার বছর আগে সিকিমেও বড় ধরণের এক ভূমিকম্পে প্রচুর জান মানের ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল। এবারের এই ভূমিকম্পেও সিকিম সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের মাটিও কেঁপে উঠেছিল। উত্তরবঙ্গের এবং নিম্ন আসামের বেশ কয়েকটি জেলায় কম্পণের মাত্রা বেশ তীব্র ছিল। বেশ কিছু বাড়িঘরে ফাটল ধরে গিয়েছিল। দু’ এক জায়গায় বাড়ি ঘর ভেঙেও পড়েছিল। সিকিম এবং দার্জিলিং এর পাহাড়েও প্রচুর ফাটল দেখা দিয়েছিল। ভূমিকম্পের দু’মাস বাদেই বর্ষা এসে পৌঁছতেই ফাটলে জর্জরিত সিকিম, ভূটান, দার্জিলিং এবং নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন বিহার, উত্তর প্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ আর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় যত্র তত্র পাহাড় ধ্বসে ধসে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এ সবই এখন ইতিহাস। তবে ওই বড় দুটো ভূমিকম্পের ফলে নেপাল সীমান্তবর্তী ওই সব অঞ্চলে পাহাড়ের গায়ে যেসব ফাটল ধরে গিয়েছিল, সেই সব ফাটলে প্রতি বছর বর্ষার সময়ে বৃষ্টির জল ঢুকে পড়বার ফলে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যাচ্ছে। আর ধ্বসে ধ্বসে পড়েছে। এই ২০১৮ সালেও মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে বিহার থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশাল বিশাল ধ্বস নামবার ফলে প্রচুর বাড়িঘর রাস্তাঘাট ধুলিস্যাত হয়ে গেছে। বহু মানুষ আর গবাদি পশু নিহত হয়েছে।
সীমন্তিনী তখন তার নাগরাকাটার কোয়ার্টারে আবার আগের মতই একা। ঘরে সঙ্গী বলতে শুধু লক্ষ্মী। আগস্টের আঠার তারিখ সীমন্তিনী ওয়ারলেস মেসেজ মারফৎ নির্দেশ পেল যে তাকে মালবাজারে ওএসডি হিসেবে বদলী করা হয়েছে। তার জায়গায় বিশাল কুলকার্নী বলে এক আইপিএস অফিসার আসছেন। সাতদিনের মধ্যে নতুন ওএসডি কুলকার্নীকে সমস্ত দায়ভার বুঝিয়ে দিয়ে তাকে মালবাজার থানায় রিপোর্ট করতে হবে পঁচিশ তারিখের মধ্যে। পরিতোষের সাথে সীমন্তিনীর এ ব্যাপারে কথাও হয়েছে। ঊণিশ তারিখ থেকে একটানা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হয়ে চলেছে উত্তরবঙ্গের চারটি জেলায়।
একুশ তারিখ গভীর রাতে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অর্চনা যখন পরিতোষের বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন তখনই বিছানার পাশে রাখা পরিতোষের মোবাইলটা বেজে উঠল। ঘুম ভেঙে যেতে পরিতোষ খানিকটা বিরক্তি নিয়েই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল একটা অচেনা নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। রাত তখন প্রায় একটা। প্রচুর বিরক্ত হয়েই সে কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় ‘হ্যালো’ বলতেই ও’পাশ থেকে উদ্বিঘ্ন গলায় এক পুরুষকন্ঠ বলল, “স্যার, আমি নাগরাকাটা থানার ওসি সিকদার বলছি। একটা খারাপ খবর আছে স্যার”।
“হোয়াট”? বলেই এক ঝটকায় অর্চনাকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে পরিতোষ লাফ মেরে বিছানায় উঠে বসে বলল, “কী বলছেন মিঃ সিকদার? কী হয়েছে? আপনাদের ম্যাডাম ঠিক আছেন তো”?
ও’পাশ থেকে সিকদারবাবু আমতা আমতা করে কোনরকমে বললেন, “সরি স্যার। কথাটা বলতে আমার জিভ ভারী হয়ে উঠছে। কিন্তু তা সত্বেও অনেক চেষ্টা করে আপনার নাম্বারটা পেলাম বলেই আপনাকেই কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি স্যার। খুব দুঃখের সাথেই জানাচ্ছি, ম্যাডাম সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি আজ রাতে উগ্রপন্থীদের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন স্যার”।
পরিতোষ খাট থেকে লাফ মেরে নিচে নেমে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “হোয়াট ননসেন্স আর ইউ টকিং মিঃ সিকদার? এ কিছুতেই হতে পারে না। ইটস অ্যাবজার্ড, ইটস সিমপ্লি অ্যাবজার্ড। না না, আপনি নিশ্চয়ই ভুল কোন ইনফর্মেশন পেয়েছেন”।
অপরদিক থেকে সিকদারবাবু কান্না ভেজা গলায় বলল, “স্যার, ইনফর্মেশনটা ভুল হলে এ মূহুর্তে সবচেয়ে খুশী বোধহয় আমি হতাম। আমি জানি স্যার, আপনি ভট্টাচার্যি ম্যামের খুব ঘণিষ্ঠ বন্ধু। আমরা তো ম্যামের বাড়ির কারো নাম্বার খুঁজে পাইনি এখনও। জয়া বসাকের মাধ্যমে নবনীতা ম্যাডামের কাছ থেকে আপনার নাম্বারটা কোনভাবে কালেক্ট করতে পেরেই খবরটা আমি আপনাকেই প্রথম জানাচ্ছি স্যার। আর স্যার, বুঝতেই পাচ্ছেন, এদিকে এখন হুলুস্থুল চলছে। আমরাও এখন চরম ব্যস্ততার মধ্যে আছি। আপনার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তাহলে ম্যামের বাড়িতে খবরটা পাঠিয়ে দেবেন স্যার। নইলে কাল সকালের আগে আমাদের পক্ষে বোধহয় রাজগঞ্জে কোনও খবর পাঠানো সম্ভব হবে না। আর স্যার, গোটা ঘটণাটার ডিটেইলস আমার কাছে এখনও এসে পৌঁছয় নি। আপাততঃ শুধু এটুকুই বলতে পারি, মিসহ্যাপটা হয়েছে নাগরাকাটা থেকে প্রায় তেত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে ভূটানের একটা এলাকায়। আমাদের কাছে খবর এসেছে রাত বারোটা নাগাদ। পাহার ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবার দরুন সেখানে কোনও রেসকিউ টিম বা অন্য কোনও সাপোর্টও পাঠাতে পারছিনা স্যার আমরা। অবশেষে হাসিমারা এয়ারবেস থেকে আর্মির হেলিকপ্টারের রিকুইজিশন চেয়ে পাঠিয়েছি। মালবাজার আর জলপাইগুড়ি থেকে র*্যাফ আর এনডিআরএফ-এর কয়েকটা টিম আসছে। কপ্টার হয়ত আর পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে এখানে। সাথে সাথেই আমরা সেখানে যাচ্ছি। তারা প্রায় সকলেই ওই স্পটেই আছে। আমাদের টিমের একজন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে বোধহয় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সে-ই অনেক কষ্টে কাছের একটা চা বাগানে গিয়ে সেখান থেকেই ফোনে ঘটণাটা আমাদের জানিয়েছে” বলে একটুক্ষণ থেমেই সে আবার বলল, “স্যার আমাকে বেরোতে হচ্ছে এক্ষুনি। তাই ছাড়ছি এখন। আপনি কি করতে পারেন দেখুন” বলেই ফোন কেটে দিল।
নিজের বুক থেকে ঝটকা দিয়ে অর্চনাকে সরিয়ে দেবার সময়েই অর্চনা জেগে গিয়েছিল। তারপর পরিতোষের অবস্থা দেখে আর পরিতোষের মুখে ‘ম্যাডাম’ শব্দটা শুনেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। পরিতোষ ফোনে কথা শেষ করে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে দেখে অর্চনা তার কাছে এসে বলল, “কি হয়েছে গো? তুমি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোন ম্যাডামের কি হয়েছে গো? বলো না। তুমি চুপ করে আছ কেন”?
পরিতোষ অর্চনার কথার জবাবে কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বুকটা ঘণ ঘণ শ্বাস প্রশ্বাসের ফলে হাপরের মত ওঠানামা করছিল। অর্চনা এবার পরিতোষের দুটো কাঁধ শক্ত করে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “কি হল? কথা বলছ না কেন তুমি? কার কি হয়েছে বলো না”।
পরিতোষ এবার অর্চনাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে অর্চু। মন্তি... মন্তি ......” বলে থেমে গেল।
মন্তির নাম শুনেই অর্চনাও কেঁদে ফেলল। পাগলের মত পরিতোষকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলল, “কি হয়েছে দিদিভাইয়ের? বলো না কী হয়েছে? দিদিভাই ঠিক আছেন তো”?
পরিতোষ কান্নায় ভেঙে পড়ে আর্ত চিৎকার করে বলল, “মন্তি, মন্তি আর নেই অর্চু। তোমাদের দিদিভাই আমাদের সব্বাইকে ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের মত, ও হো হো” বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
অর্চনাও পরিতোষের থেকে দুরে ছিটকে গিয়ে “না আ আ আ.....” বলে চিৎকার করে উঠেই অজ্ঞান হয়ে বিছানার ওপর পড়ে গেল।
*****************
পরের দিন সকালের ফ্লাইটে পরিতোষ অর্চনা, রচনা, রতীশ আর রতীশের দেড় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে বাগডোগড়া হয়ে রাজগঞ্জ এসে পৌঁছল বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ। কলকাতা থেকে রওনা হবার আগে চেনাজানা সকলকে দুঃসংবাদটা জানিয়ে দিয়েই নিজের মোবাইল দুটোই সুইচ অফ করে দিয়েছিল। সারা রাজগঞ্জ শহরটাই যেন শোকস্তব্ধ। শহরের শুরু থেকেই সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু রাস্তায় প্রচুর ভিড় ভাট্টা। বাস, ট্যাক্সি, অটো রিক্সা কিছু চলছে না। শুধু লোক আর লোক। দু’একটা রিক্সায় দু’ একজন যাত্রী অবশ্য চোখে পড়ল। কিন্তু তাদের সকলের মুখেও দুঃখের ছায়া আর চোখের পাতা জলে ভেজা। আর রিক্সাগুলোও লোকের ভিড়ে এগোতে না পেরে রাস্তার পাশে গিয়ে থেমে আছে। বাগডোগড়া থেকে ভাড়া করা ট্যাক্সিটা আগা গোড়া বেশ ভাল গতিতে এলেও রাজগঞ্জ শহরের সীমায় ঢুকতে না ঢুকতেই জনতার ভিড়ে আর যেন এগোতেই পারছিল না। খুব সাবধানে ঠেলাগাড়ির গতিতে কিছুদুর এগিয়ে একসময় ড্রাইভার রাস্তার মাঝেই গাড়ি থামিয়ে দিতে বাধ্য হল। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে বাইরের ভিড়ের দিকে কাউকে উদ্দেশ্য না করেই জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে দাদা? রাস্তায় এত ভিড় কিসের? কোনও এক্সিডেন্ট ফেক্সিডেন্ট কিছু হয়েছে নাকি”।
ভিড়ের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন একসাথেই কিছু বলল। কিন্তু ড্রাইভার তাদের কথার একটা শব্দও বুঝে উঠতে না পেরে বলল, “আপনারা যে কোন একজন বলুন না। সবাই মিলে একসাথে যা বললেন, আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না”।
এবার একজন মধ্যবয়স্ক লোক ভারি গলায় বললেন, “আমাদের শহরের সকলের প্রিয় একজন মেয়ে গত রাতে ভূটান বর্ডারে উগ্রপন্থীদের গুলিতে শহীদ হয়েছে ভাই। তাই আমাদের সারা শহরের লোক এখন তার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে, তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে, তার পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে, আর সম্ভব হলে শেষ বারের মত তার দেহটাকে এক নজর দেখতে। এ রাস্তায় আর গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না”।
ড্রাইভার ছেলেটা বোধহয় এতক্ষণে বুঝতে পারল যে তার গাড়িতে বসে থাকা এই চার জন যাত্রী কেন আগাগোড়া এভাবে কেঁদে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে এ পর্যন্ত সারাটা পথই রচনা আর অর্চনা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। মাঝরাত থেকেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাদের গলা ভেঙে গেছে। এখন আর কান্নার শব্দও বের হচ্ছে না। দু’জনের গলা থেকে শুধু ফ্যাসফেসে শব্দই বেরোচ্ছে। কিন্তু অবিরাম। তাদের দু’চোখ থেকে অবিরত নদীর জলের মত অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই ওদের দু’জনকে শান্ত করা যায় নি। আর শান্ত করবেই বা কে? কাঁদছে রতীশও। তবে তার কান্নাটা প্রায় নিরব। অনবরত ঝরে পড়া চোখের জলে তার গাল গলা বুক ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কান্নার উথলে ওঠা আবেগ সইতে না পেরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দু’হাতে মুখ চোখ ঢেকে বলে উঠছে, “ওফ, হা ভগবান”। রচনার দেড় বছরের ছোট ছেলেটাকে পরিতোষই সামলে এনেছে গোটা পথটা। ওই ছোট্ট ছেলেটার মুখ থেকেই যা দু’ একটা শব্দ বের হচ্ছে এই মূহুর্তে। পরিতোষও পুরোটা সময় ছেলেটাকে কোলে নিয়ে স্থানুর মত বসে থাকলেও তার দু’চোখ দিয়ে অবিরত জলের ধারা বয়ে বেরোচ্ছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এতক্ষণ যেভাবে কেটেছে, কেটেছে। তাকে নিজেকে এখন সামলে নিতেই হবে। নইলে পরিস্থিতির মোকাবেলা করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মধ্যবয়স্ক লোকটির কথা শুনেই সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা রতীশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। রতীশদের বাড়ি তখনও দু’ কিলোমিটার দুরে। গাড়ি আর কিছুতেই এগোতে পারছে না। বেচারা ড্রাইভার হাল ছেড়ে দিয়েছে। পরিতোষ এ পরিস্থিতি থেকে বেরোবার কথা ভাবতে ভাবতেই বাইরের ভিড়ের মধ্যে থেকে এক যুবক প্রায় চেঁচিয়ে উঠে নিজের গলায় যত জোর আছে তা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, “আপনারা সবাই মাঝখান থেকে একটু সরে যান দয়া করে। এ গাড়িতে সীমন্তিনী দিদির দাদা-বৌদিরা আছেন। দয়া করে এনাদের গাড়িটাকে এগিয়ে যেতে দিন। আপনারা তাদের যাবার জন্য একটু রাস্তা দিন”।
রতীশ মুখ থেকে হাত সরিয়ে জলভরা চোখে চেয়ে দেখল চিৎকার করে ওঠা ছেলেটা রতন। রিক্সাওয়ালা। তার বাবা একসময় রতিকান্তবাবুদের ক্ষেতি জমিতে চাষবাসের কাজ করত। তাকে তারা কানাইকাকা বলে ডাকত। রতন রতীশের জানালার কাছে এসে ওঠানো কাঁচে টোকা দিতেই রতীশ জানালা খুলে দিল। আর ততক্ষণে নির্বাক বিশাল জনতার মধ্যে যেন হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। গাড়ির সামনে থেকে ভিড়টা অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছে। কিন্তু সামনে যতদুর চোখ যায় ততদুর লোকে লোকারণ্য।
জানালা খুলতেই রতন রতীশের একটা হাত নিজের দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “তুমি এসেছ বড়দা? এ কী হল বল তো? বড়দি আমাদের সকলকে এভাবে ছেড়ে চলে গেল”?
আর প্রায় সাথে সাথেই আশেপাশের প্রায় অনেকেই একসাথে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। ড্রাইভার বেচারা কিছু বুঝতে না পেরে পরিতোষের দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বলল, “স্যার, কাল রাতে ভূটান বর্ডারে উগ্রপন্থীদের সাথে বেশ বড় রকমের একটা সংঘর্ষ হয়েছে, আর তাতে অনেকগুলো টেররিস্টের সাথে বেশ কয়েকজন পুলিশের লোকও মারা গেছে। তার মধ্যে সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি নামের এক মহিলা পুলিশ অফিসারও নাকি ছিল। সে খবর তো বাগডোগড়াতেই আজ ভোরে পেয়েছিলাম। এরা কি ওনার কথাই বলছে? আর আপনারা কি তাদের বাড়িই যাচ্ছেন”?
পরিতোষ নিজের ঢোঁক গিলে কোনরকমে তার শুকিয়ে আসা গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ ভাই। সীমন্তিনী আমাদের আত্মীয়। আর তোমার পাশে যে বসে আছে সে সীমন্তিনীর দাদা। আর এরা দু’জন সীমন্তিনীর বোন আর বৌদি। আমরা সকলে কলকাতায় থাকি। সেখান থেকেই এলাম সকালের ফ্লাইটে। কিন্তু বাড়ি তো এখনও দেড় থেকে দু’ কিলোমিটার দুরে। আর এখানে যা অবস্থা দেখছি তাতে পুলিশের সাহায্য ছাড়া রাস্তা বের করা তো প্রায় অসম্ভব। এই ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এমন ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়াও তো নিরাপদ নয়”।
ড্রাইভারটা বলল, “স্যার, রাস্তার অবস্থা দেখে আমি তো এখানেই আপনাদের নামিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন যা সব শুনলাম তাতে করে এখন তেমনটা করলে সকলে আমাকে অমানুষ বলবে। যে করেই হোক, যেভাবেই হোক, আপনাদের বাড়ি অব্দি আমি নিয়ে যাবই। স্যার এখানকার থানার নম্বর আমার কাছে আছে। আমি থানায় ফোন করে তাদের কাছ থেকে সাহায্য চাইছি”।
পরিতোষ প্রায় সাথে সাথে বলল, “তুমি এক কাজ কর ভাই। থানার নাম্বারটা আমাকে বল। আমিও একজন পুলিশ অফিসার। তাই তাদের কাছে আমি সাহায্য চাইলে তারা নিশ্চয়ই সাহায্য করতে আসবে”।
ওদিকে রতীশ রতনের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে গাড়ির দড়জা খুলতে যেতেই রতন উল্টোদিক থেকে দড়জা চেপে ধরে বলল, “না না বড়দা, এই ভিড়ের মধ্যে তুমি গাড়ি থেকে বেড়িও না গো। পাবলিক তোমাদের দেখলে পাগল হয়ে উঠবে এখন। কাউকে সামলানো যাবে না। বড়দি এত বছর ধরে এ শহর ছেড়ে থাকলেও তাকে এ শহরের একটা লোকও যে এখনও ভুলে যায়নি, সেটা তো বুঝতেই পারছ। এতক্ষণ সবাই দুঃখে মনমরা হয়ে ধীরে ধীরে তোমাদের বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু তোমরা গাড়ি থেকে নামলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। আমি দেখছি, কিভাবে তোমাদের গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়”।
পরিতোষও রতনের কথায় সায় জানিয়ে রতীশের কাঁধে হাত দিয়ে চেপে দিতে রতীশ চুপ করে বসে আবার কাঁদতে শুরু করল। অর্চনা আর রচনাও এবার গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। তবে ওই কান্নারও একভাগ স্বর, আর বাকি তিন ভাগই শুধু ফুসফুসের হাওয়া। পরিতোষ থানার নাম্বার ডায়াল করে ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই বলল, “শুনুন, আমি সিনিয়র আইপিএস পরিতোষ সান্যাল বলছি। সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি আমার আত্মীয়া। আমরা কলকাতা থেকে বাগডোগড়া হয়ে রাজগঞ্জে ঢুকতে গিয়ে রাস্তার ভিড়ে আঁটকে গেছি। গাড়ি এগোতে পারছে না ভিড়ের জন্য। সীমন্তিনীর বোন আর দাদা বৌদিও আমার সঙ্গে আছে। আপনারা যদি রাস্তার ভিড়টা একটু সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতেন তাহলে খুব উপকৃত হতাম। আসলে সঙ্গে দেড় বছরের ছোট একটা বাচ্চাও আছে বলে আমরা এই ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যেতে পারছি না। তাছাড়া রাস্তার ভিড় এতক্ষণে জেনে গেছে যে সীমন্তিনীর দাদা বৌদিরা এ গাড়িতে আছে। তাই সকলেই আমাদের গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে। ব্যাপারটা আশা করি বুঝতে পারছেন”।
ও’পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “স্যার আমাদের থানা থেকে দুটো গাড়ি অনেক আগেই সীমন্তিনী ম্যাডামের বাড়িতে চলে গেছে। আমাদের স্যারও সেখানে আছেন। তবে স্যার, আপনারা এ মূহুর্তে ঠিক কোথায় আছেন বলুন তো। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে আপনাদের নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যায়”।
পরিতোষ রতীশের কাছ থেকে লোকেশানটা জেনে নিয়ে থানায় জানিয়ে দিল। এদিকে বাইরে ততক্ষণে রতন প্রায় পনের কুড়িজন রিক্সাওয়ালাকে একসাথে জুটিয়ে নিয়ে সকলে মিলে জনতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে রাস্তা ফাঁকা করে দেবার অনুরোধ জানাতে শুরু করেছে। সামনের কিছুটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যেতে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে ধীর গতিতে চালাতে লাগল। এভাবে প্রায় পনের মিনিটে কয়েকশ’ মিটারের মত যাবার পরেই উল্টো দিক থেকে সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটা পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হল।
______________________________
এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটণাও ঘটে গেছে। পরিতোষ আর অর্চনা একে অপরকে নিয়ে খুব সুখে শান্তিতে সংসার করছে।
সীমন্তিনীর কথায় রতীশকে অর্চনার বিয়ের সময় ছুটি দেবার সময় মহিমা তাকে নিজেদের মালহোত্রা সেন যোগা ইনস্টিটিউট থেকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে দিয়েছিল অর্চনা আর পরিতোষের আশীর্বাদের তিন দিন আগে। তবে তার বিনিময়ে সীমন্তিনী আর রতীশকে মহিমার দুটো শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল। প্রথম শর্ত মতে উত্তর কলকাতায় মহিমা রতীশের জন্য বেশ বড়সড় জায়গায় একটা যোগা সেন্টার বানিয়ে দিয়ে সেটা রচনার নামে লিখে দিয়েছিল। রতীশও ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সেন্টারটা সাজিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করেছে ২০১৩ সালের মে মাস থেকে। তার তিন মাস বাদে ১৫ই আগস্টে মহিমার মার্কেট কমপ্লেক্সের উদ্বোধন হয়েছে। মহিমার দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে কলকাতায় মহিমার মার্কেট কমপ্লেক্সের উদ্বোধনের দিন সীমন্তিনীকে সেখানে উপস্থিত হতে হয়েছিল। সীমন্তিনীর সাথে পরিতোষ, অর্চনা, রতীশ আর রচনাও সে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। নবনীতাই শুধু যায় নি।
অর্চনা আর পরিতোষের বিয়ের মাস পাঁচেক পরে বিধুবাবুদের নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল। বিমল আগরওয়ালার অপারেশন থেকে যা টাকা পাওয়া গিয়েছিল তাতে বাড়ি তৈরী আর সমস্ত খরচ খরচার পরেও পঁচিশ লক্ষ টাকা পরিতোষের হাতে থেকে গিয়েছিল। অর্চনা আর পরিতোষের বিয়ের পরের বছর পরিতোষের সাথে পরামর্শ করে সীমন্তিনী কালচিনির বিধুবাবুর দোকানটাকে বড় করে সেই দোকানের ঠিক পাশেই আরও তিনটে রুমে নবনীতার জন্যে একটা বুটিক বানিয়ে দিয়েছিল দুর্গাপূজোর ঠিক আগে আগে। নবনীতা জয়া ম্যাডামের কারখানায় মাস ছয়েকের ভেতরেই সমস্তকিছু শিখে ফেলেছিল। অর্চনার বিয়ের প্রায় এগারো মাস বাদেই নবনীতা জয়া ম্যাডামের ওখান থেকে পাকাপাকিভাবে ছুটি নিয়ে সীমন্তিনীকে আর নাগরাকাটা ছেড়ে কালচিনিতে এসে নিজের বুটিক খুলে বিধুবাবু আর বিভাদেবীর আরেক মেয়ে হয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেছে। সে আর কলকাতা ফিরে আসতে রাজী ছিল না। বিধুবাবু আর বিভাদেবীও নবনীতাকে তাদের অন্য দুই মেয়ের মতই আপন করে নিয়েছেন। আর অমন স্নেহশীল এক পরিবারের একজন হয়ে নবনীতাও খুব সুখে আছে। এখন কালচিনিতে তার বুটিকের খুব নামডাক। নিজের ডিজাইন করা সামগ্রী ছাড়াও সে জয়া ম্যাডামের কারখানা থেকে থেকে প্রচুর মাল নিয়ে আসে। নবনীতার মিষ্টি কথায় আর ব্যবহারে তার দোকানের গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কিংশুক হায়ার সেকেন্ডারীতে রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েও কোনও বিশেষ কোর্স নিয়ে পড়তে চায়নি। মালবাজারের এক কলেজ থেকে বিএ পাশ করে সে এখন নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিকাল সায়েন্সে মাস্টার্স করছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেসের কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সীমন্তিনী এখনও তাকে সবরকম সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে ঠিক আগের মতই। শিলিগুড়িতে সীমন্তিনী তার এক বান্ধবীর বাড়িতে কিংশুককে পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ছুটি ছাটায় বাড়ি এলে কিংশুক তার নতুনদি আর বাবার ব্যবসায় যথাসম্ভব সাহায্য করে। অর্চনার বিয়ের সময় থেকেই সে নবনীতাকে নতুনদি বলে ডাকে আর নিজের দিদির মতই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। নবনীতাও বিধুবাবু, বিভাদেবী, আর কিংশুককে নিজের বাবা মা আর ছোট ভাই হিসেবে পেয়ে খুব খুশী। সে এখন মনে মনে ভাবে, ভাগ্য বিরূপ না হলে সে আমৃত্যু বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সংসারে তাদের পাশে নিজের মেয়ে হয়েই থাকবে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রচনা ফুটফুটে একটি পূত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। তবে তার আগেই তারা আগের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে পরিতোষদের বাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গায় একটা টু বেডরম ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে এসেছে। সীমন্তিনীই তার নাম রেখেছে যিষ্ণু। অর্চনা আর রচনার পরিবারের সাথে মহিমা, বীথিকা, ডঃ দিব্যেন্দু আর আব্দুল ও তার পরিবারের যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এরা সকলেই যেন সকলের নিকট আত্মীয়ও হয়ে উঠেছে। রচনার বাচ্চার জন্মের সময় রাজগঞ্জের বাড়ি থেকে সরলাদেবী, চন্দ্রাদেবী আর কালচিনি থেকে বিভাদেবী এসে কলকাতায় তাদের দু’মেয়ের বাড়িতে তিন মাস থেকে গেছেন। দু’দিনের জন্যে সীমন্তিনী আর নবনীতাও এসেছিল কলকাতায়।
দেশদ্রোহিতা, একাধিক খুন এবং তার সাথে আরও অনেকগুলো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হবার ফলে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারে বিমল আগরওয়ালার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। বিমল সুপ্রীম কোর্টে অ্যাপীল করেছে। তবে সুপ্রীম কোর্টে মামলার শুনানি এখনও চলছে। সবিতা আগরওয়ালা আর বিকি তাদের কলকাতার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত কিছু বিক্রী করে দিয়ে নিজেদের দেশের বাড়ি রাজস্থানে চলে গেছে।
২০১৫ সালের আগস্ট মাস। চার মাস আগেই ২৫শে এপ্রিল নেপালে ঘটে গেছে সেই বিধ্বংসী ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পে প্রায় ন’হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল। অনেক গ্রাম এবং শহরের প্রচুর পরিমান বাড়িঘর, মন্দির, পুল, রাস্তাঘাট ও স্থাপত্য ধুলিস্যাত হয়ে গিয়েছিল। ভূমিকম্প পরবর্তী আফটার শকেও নেপালের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় শ’ তিনেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের তীব্র স্পন্দন অনুভূত হয়েছিল ভূটান, তিব্বত এবং আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ উত্তর অঞ্চল এবং সিকিম সহ গোটা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে। এর চার বছর আগে সিকিমেও বড় ধরণের এক ভূমিকম্পে প্রচুর জান মানের ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল। এবারের এই ভূমিকম্পেও সিকিম সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের মাটিও কেঁপে উঠেছিল। উত্তরবঙ্গের এবং নিম্ন আসামের বেশ কয়েকটি জেলায় কম্পণের মাত্রা বেশ তীব্র ছিল। বেশ কিছু বাড়িঘরে ফাটল ধরে গিয়েছিল। দু’ এক জায়গায় বাড়ি ঘর ভেঙেও পড়েছিল। সিকিম এবং দার্জিলিং এর পাহাড়েও প্রচুর ফাটল দেখা দিয়েছিল। ভূমিকম্পের দু’মাস বাদেই বর্ষা এসে পৌঁছতেই ফাটলে জর্জরিত সিকিম, ভূটান, দার্জিলিং এবং নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন বিহার, উত্তর প্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ আর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় যত্র তত্র পাহাড় ধ্বসে ধসে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এ সবই এখন ইতিহাস। তবে ওই বড় দুটো ভূমিকম্পের ফলে নেপাল সীমান্তবর্তী ওই সব অঞ্চলে পাহাড়ের গায়ে যেসব ফাটল ধরে গিয়েছিল, সেই সব ফাটলে প্রতি বছর বর্ষার সময়ে বৃষ্টির জল ঢুকে পড়বার ফলে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যাচ্ছে। আর ধ্বসে ধ্বসে পড়েছে। এই ২০১৮ সালেও মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে বিহার থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশাল বিশাল ধ্বস নামবার ফলে প্রচুর বাড়িঘর রাস্তাঘাট ধুলিস্যাত হয়ে গেছে। বহু মানুষ আর গবাদি পশু নিহত হয়েছে।
সীমন্তিনী তখন তার নাগরাকাটার কোয়ার্টারে আবার আগের মতই একা। ঘরে সঙ্গী বলতে শুধু লক্ষ্মী। আগস্টের আঠার তারিখ সীমন্তিনী ওয়ারলেস মেসেজ মারফৎ নির্দেশ পেল যে তাকে মালবাজারে ওএসডি হিসেবে বদলী করা হয়েছে। তার জায়গায় বিশাল কুলকার্নী বলে এক আইপিএস অফিসার আসছেন। সাতদিনের মধ্যে নতুন ওএসডি কুলকার্নীকে সমস্ত দায়ভার বুঝিয়ে দিয়ে তাকে মালবাজার থানায় রিপোর্ট করতে হবে পঁচিশ তারিখের মধ্যে। পরিতোষের সাথে সীমন্তিনীর এ ব্যাপারে কথাও হয়েছে। ঊণিশ তারিখ থেকে একটানা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হয়ে চলেছে উত্তরবঙ্গের চারটি জেলায়।
একুশ তারিখ গভীর রাতে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অর্চনা যখন পরিতোষের বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন তখনই বিছানার পাশে রাখা পরিতোষের মোবাইলটা বেজে উঠল। ঘুম ভেঙে যেতে পরিতোষ খানিকটা বিরক্তি নিয়েই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল একটা অচেনা নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। রাত তখন প্রায় একটা। প্রচুর বিরক্ত হয়েই সে কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় ‘হ্যালো’ বলতেই ও’পাশ থেকে উদ্বিঘ্ন গলায় এক পুরুষকন্ঠ বলল, “স্যার, আমি নাগরাকাটা থানার ওসি সিকদার বলছি। একটা খারাপ খবর আছে স্যার”।
“হোয়াট”? বলেই এক ঝটকায় অর্চনাকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে পরিতোষ লাফ মেরে বিছানায় উঠে বসে বলল, “কী বলছেন মিঃ সিকদার? কী হয়েছে? আপনাদের ম্যাডাম ঠিক আছেন তো”?
ও’পাশ থেকে সিকদারবাবু আমতা আমতা করে কোনরকমে বললেন, “সরি স্যার। কথাটা বলতে আমার জিভ ভারী হয়ে উঠছে। কিন্তু তা সত্বেও অনেক চেষ্টা করে আপনার নাম্বারটা পেলাম বলেই আপনাকেই কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি স্যার। খুব দুঃখের সাথেই জানাচ্ছি, ম্যাডাম সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি আজ রাতে উগ্রপন্থীদের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন স্যার”।
পরিতোষ খাট থেকে লাফ মেরে নিচে নেমে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “হোয়াট ননসেন্স আর ইউ টকিং মিঃ সিকদার? এ কিছুতেই হতে পারে না। ইটস অ্যাবজার্ড, ইটস সিমপ্লি অ্যাবজার্ড। না না, আপনি নিশ্চয়ই ভুল কোন ইনফর্মেশন পেয়েছেন”।
অপরদিক থেকে সিকদারবাবু কান্না ভেজা গলায় বলল, “স্যার, ইনফর্মেশনটা ভুল হলে এ মূহুর্তে সবচেয়ে খুশী বোধহয় আমি হতাম। আমি জানি স্যার, আপনি ভট্টাচার্যি ম্যামের খুব ঘণিষ্ঠ বন্ধু। আমরা তো ম্যামের বাড়ির কারো নাম্বার খুঁজে পাইনি এখনও। জয়া বসাকের মাধ্যমে নবনীতা ম্যাডামের কাছ থেকে আপনার নাম্বারটা কোনভাবে কালেক্ট করতে পেরেই খবরটা আমি আপনাকেই প্রথম জানাচ্ছি স্যার। আর স্যার, বুঝতেই পাচ্ছেন, এদিকে এখন হুলুস্থুল চলছে। আমরাও এখন চরম ব্যস্ততার মধ্যে আছি। আপনার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তাহলে ম্যামের বাড়িতে খবরটা পাঠিয়ে দেবেন স্যার। নইলে কাল সকালের আগে আমাদের পক্ষে বোধহয় রাজগঞ্জে কোনও খবর পাঠানো সম্ভব হবে না। আর স্যার, গোটা ঘটণাটার ডিটেইলস আমার কাছে এখনও এসে পৌঁছয় নি। আপাততঃ শুধু এটুকুই বলতে পারি, মিসহ্যাপটা হয়েছে নাগরাকাটা থেকে প্রায় তেত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে ভূটানের একটা এলাকায়। আমাদের কাছে খবর এসেছে রাত বারোটা নাগাদ। পাহার ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবার দরুন সেখানে কোনও রেসকিউ টিম বা অন্য কোনও সাপোর্টও পাঠাতে পারছিনা স্যার আমরা। অবশেষে হাসিমারা এয়ারবেস থেকে আর্মির হেলিকপ্টারের রিকুইজিশন চেয়ে পাঠিয়েছি। মালবাজার আর জলপাইগুড়ি থেকে র*্যাফ আর এনডিআরএফ-এর কয়েকটা টিম আসছে। কপ্টার হয়ত আর পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে এখানে। সাথে সাথেই আমরা সেখানে যাচ্ছি। তারা প্রায় সকলেই ওই স্পটেই আছে। আমাদের টিমের একজন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে বোধহয় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সে-ই অনেক কষ্টে কাছের একটা চা বাগানে গিয়ে সেখান থেকেই ফোনে ঘটণাটা আমাদের জানিয়েছে” বলে একটুক্ষণ থেমেই সে আবার বলল, “স্যার আমাকে বেরোতে হচ্ছে এক্ষুনি। তাই ছাড়ছি এখন। আপনি কি করতে পারেন দেখুন” বলেই ফোন কেটে দিল।
নিজের বুক থেকে ঝটকা দিয়ে অর্চনাকে সরিয়ে দেবার সময়েই অর্চনা জেগে গিয়েছিল। তারপর পরিতোষের অবস্থা দেখে আর পরিতোষের মুখে ‘ম্যাডাম’ শব্দটা শুনেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। পরিতোষ ফোনে কথা শেষ করে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে দেখে অর্চনা তার কাছে এসে বলল, “কি হয়েছে গো? তুমি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোন ম্যাডামের কি হয়েছে গো? বলো না। তুমি চুপ করে আছ কেন”?
পরিতোষ অর্চনার কথার জবাবে কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বুকটা ঘণ ঘণ শ্বাস প্রশ্বাসের ফলে হাপরের মত ওঠানামা করছিল। অর্চনা এবার পরিতোষের দুটো কাঁধ শক্ত করে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “কি হল? কথা বলছ না কেন তুমি? কার কি হয়েছে বলো না”।
পরিতোষ এবার অর্চনাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে অর্চু। মন্তি... মন্তি ......” বলে থেমে গেল।
মন্তির নাম শুনেই অর্চনাও কেঁদে ফেলল। পাগলের মত পরিতোষকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলল, “কি হয়েছে দিদিভাইয়ের? বলো না কী হয়েছে? দিদিভাই ঠিক আছেন তো”?
পরিতোষ কান্নায় ভেঙে পড়ে আর্ত চিৎকার করে বলল, “মন্তি, মন্তি আর নেই অর্চু। তোমাদের দিদিভাই আমাদের সব্বাইকে ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের মত, ও হো হো” বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
অর্চনাও পরিতোষের থেকে দুরে ছিটকে গিয়ে “না আ আ আ.....” বলে চিৎকার করে উঠেই অজ্ঞান হয়ে বিছানার ওপর পড়ে গেল।
*****************
পরের দিন সকালের ফ্লাইটে পরিতোষ অর্চনা, রচনা, রতীশ আর রতীশের দেড় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে বাগডোগড়া হয়ে রাজগঞ্জ এসে পৌঁছল বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ। কলকাতা থেকে রওনা হবার আগে চেনাজানা সকলকে দুঃসংবাদটা জানিয়ে দিয়েই নিজের মোবাইল দুটোই সুইচ অফ করে দিয়েছিল। সারা রাজগঞ্জ শহরটাই যেন শোকস্তব্ধ। শহরের শুরু থেকেই সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু রাস্তায় প্রচুর ভিড় ভাট্টা। বাস, ট্যাক্সি, অটো রিক্সা কিছু চলছে না। শুধু লোক আর লোক। দু’একটা রিক্সায় দু’ একজন যাত্রী অবশ্য চোখে পড়ল। কিন্তু তাদের সকলের মুখেও দুঃখের ছায়া আর চোখের পাতা জলে ভেজা। আর রিক্সাগুলোও লোকের ভিড়ে এগোতে না পেরে রাস্তার পাশে গিয়ে থেমে আছে। বাগডোগড়া থেকে ভাড়া করা ট্যাক্সিটা আগা গোড়া বেশ ভাল গতিতে এলেও রাজগঞ্জ শহরের সীমায় ঢুকতে না ঢুকতেই জনতার ভিড়ে আর যেন এগোতেই পারছিল না। খুব সাবধানে ঠেলাগাড়ির গতিতে কিছুদুর এগিয়ে একসময় ড্রাইভার রাস্তার মাঝেই গাড়ি থামিয়ে দিতে বাধ্য হল। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে বাইরের ভিড়ের দিকে কাউকে উদ্দেশ্য না করেই জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে দাদা? রাস্তায় এত ভিড় কিসের? কোনও এক্সিডেন্ট ফেক্সিডেন্ট কিছু হয়েছে নাকি”।
ভিড়ের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন একসাথেই কিছু বলল। কিন্তু ড্রাইভার তাদের কথার একটা শব্দও বুঝে উঠতে না পেরে বলল, “আপনারা যে কোন একজন বলুন না। সবাই মিলে একসাথে যা বললেন, আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না”।
এবার একজন মধ্যবয়স্ক লোক ভারি গলায় বললেন, “আমাদের শহরের সকলের প্রিয় একজন মেয়ে গত রাতে ভূটান বর্ডারে উগ্রপন্থীদের গুলিতে শহীদ হয়েছে ভাই। তাই আমাদের সারা শহরের লোক এখন তার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে, তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে, তার পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে, আর সম্ভব হলে শেষ বারের মত তার দেহটাকে এক নজর দেখতে। এ রাস্তায় আর গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না”।
ড্রাইভার ছেলেটা বোধহয় এতক্ষণে বুঝতে পারল যে তার গাড়িতে বসে থাকা এই চার জন যাত্রী কেন আগাগোড়া এভাবে কেঁদে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে এ পর্যন্ত সারাটা পথই রচনা আর অর্চনা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। মাঝরাত থেকেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাদের গলা ভেঙে গেছে। এখন আর কান্নার শব্দও বের হচ্ছে না। দু’জনের গলা থেকে শুধু ফ্যাসফেসে শব্দই বেরোচ্ছে। কিন্তু অবিরাম। তাদের দু’চোখ থেকে অবিরত নদীর জলের মত অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই ওদের দু’জনকে শান্ত করা যায় নি। আর শান্ত করবেই বা কে? কাঁদছে রতীশও। তবে তার কান্নাটা প্রায় নিরব। অনবরত ঝরে পড়া চোখের জলে তার গাল গলা বুক ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কান্নার উথলে ওঠা আবেগ সইতে না পেরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দু’হাতে মুখ চোখ ঢেকে বলে উঠছে, “ওফ, হা ভগবান”। রচনার দেড় বছরের ছোট ছেলেটাকে পরিতোষই সামলে এনেছে গোটা পথটা। ওই ছোট্ট ছেলেটার মুখ থেকেই যা দু’ একটা শব্দ বের হচ্ছে এই মূহুর্তে। পরিতোষও পুরোটা সময় ছেলেটাকে কোলে নিয়ে স্থানুর মত বসে থাকলেও তার দু’চোখ দিয়ে অবিরত জলের ধারা বয়ে বেরোচ্ছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এতক্ষণ যেভাবে কেটেছে, কেটেছে। তাকে নিজেকে এখন সামলে নিতেই হবে। নইলে পরিস্থিতির মোকাবেলা করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মধ্যবয়স্ক লোকটির কথা শুনেই সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা রতীশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। রতীশদের বাড়ি তখনও দু’ কিলোমিটার দুরে। গাড়ি আর কিছুতেই এগোতে পারছে না। বেচারা ড্রাইভার হাল ছেড়ে দিয়েছে। পরিতোষ এ পরিস্থিতি থেকে বেরোবার কথা ভাবতে ভাবতেই বাইরের ভিড়ের মধ্যে থেকে এক যুবক প্রায় চেঁচিয়ে উঠে নিজের গলায় যত জোর আছে তা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, “আপনারা সবাই মাঝখান থেকে একটু সরে যান দয়া করে। এ গাড়িতে সীমন্তিনী দিদির দাদা-বৌদিরা আছেন। দয়া করে এনাদের গাড়িটাকে এগিয়ে যেতে দিন। আপনারা তাদের যাবার জন্য একটু রাস্তা দিন”।
রতীশ মুখ থেকে হাত সরিয়ে জলভরা চোখে চেয়ে দেখল চিৎকার করে ওঠা ছেলেটা রতন। রিক্সাওয়ালা। তার বাবা একসময় রতিকান্তবাবুদের ক্ষেতি জমিতে চাষবাসের কাজ করত। তাকে তারা কানাইকাকা বলে ডাকত। রতন রতীশের জানালার কাছে এসে ওঠানো কাঁচে টোকা দিতেই রতীশ জানালা খুলে দিল। আর ততক্ষণে নির্বাক বিশাল জনতার মধ্যে যেন হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। গাড়ির সামনে থেকে ভিড়টা অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছে। কিন্তু সামনে যতদুর চোখ যায় ততদুর লোকে লোকারণ্য।
জানালা খুলতেই রতন রতীশের একটা হাত নিজের দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “তুমি এসেছ বড়দা? এ কী হল বল তো? বড়দি আমাদের সকলকে এভাবে ছেড়ে চলে গেল”?
আর প্রায় সাথে সাথেই আশেপাশের প্রায় অনেকেই একসাথে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। ড্রাইভার বেচারা কিছু বুঝতে না পেরে পরিতোষের দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বলল, “স্যার, কাল রাতে ভূটান বর্ডারে উগ্রপন্থীদের সাথে বেশ বড় রকমের একটা সংঘর্ষ হয়েছে, আর তাতে অনেকগুলো টেররিস্টের সাথে বেশ কয়েকজন পুলিশের লোকও মারা গেছে। তার মধ্যে সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি নামের এক মহিলা পুলিশ অফিসারও নাকি ছিল। সে খবর তো বাগডোগড়াতেই আজ ভোরে পেয়েছিলাম। এরা কি ওনার কথাই বলছে? আর আপনারা কি তাদের বাড়িই যাচ্ছেন”?
পরিতোষ নিজের ঢোঁক গিলে কোনরকমে তার শুকিয়ে আসা গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ ভাই। সীমন্তিনী আমাদের আত্মীয়। আর তোমার পাশে যে বসে আছে সে সীমন্তিনীর দাদা। আর এরা দু’জন সীমন্তিনীর বোন আর বৌদি। আমরা সকলে কলকাতায় থাকি। সেখান থেকেই এলাম সকালের ফ্লাইটে। কিন্তু বাড়ি তো এখনও দেড় থেকে দু’ কিলোমিটার দুরে। আর এখানে যা অবস্থা দেখছি তাতে পুলিশের সাহায্য ছাড়া রাস্তা বের করা তো প্রায় অসম্ভব। এই ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এমন ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়াও তো নিরাপদ নয়”।
ড্রাইভারটা বলল, “স্যার, রাস্তার অবস্থা দেখে আমি তো এখানেই আপনাদের নামিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন যা সব শুনলাম তাতে করে এখন তেমনটা করলে সকলে আমাকে অমানুষ বলবে। যে করেই হোক, যেভাবেই হোক, আপনাদের বাড়ি অব্দি আমি নিয়ে যাবই। স্যার এখানকার থানার নম্বর আমার কাছে আছে। আমি থানায় ফোন করে তাদের কাছ থেকে সাহায্য চাইছি”।
পরিতোষ প্রায় সাথে সাথে বলল, “তুমি এক কাজ কর ভাই। থানার নাম্বারটা আমাকে বল। আমিও একজন পুলিশ অফিসার। তাই তাদের কাছে আমি সাহায্য চাইলে তারা নিশ্চয়ই সাহায্য করতে আসবে”।
ওদিকে রতীশ রতনের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে গাড়ির দড়জা খুলতে যেতেই রতন উল্টোদিক থেকে দড়জা চেপে ধরে বলল, “না না বড়দা, এই ভিড়ের মধ্যে তুমি গাড়ি থেকে বেড়িও না গো। পাবলিক তোমাদের দেখলে পাগল হয়ে উঠবে এখন। কাউকে সামলানো যাবে না। বড়দি এত বছর ধরে এ শহর ছেড়ে থাকলেও তাকে এ শহরের একটা লোকও যে এখনও ভুলে যায়নি, সেটা তো বুঝতেই পারছ। এতক্ষণ সবাই দুঃখে মনমরা হয়ে ধীরে ধীরে তোমাদের বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু তোমরা গাড়ি থেকে নামলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। আমি দেখছি, কিভাবে তোমাদের গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়”।
পরিতোষও রতনের কথায় সায় জানিয়ে রতীশের কাঁধে হাত দিয়ে চেপে দিতে রতীশ চুপ করে বসে আবার কাঁদতে শুরু করল। অর্চনা আর রচনাও এবার গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। তবে ওই কান্নারও একভাগ স্বর, আর বাকি তিন ভাগই শুধু ফুসফুসের হাওয়া। পরিতোষ থানার নাম্বার ডায়াল করে ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই বলল, “শুনুন, আমি সিনিয়র আইপিএস পরিতোষ সান্যাল বলছি। সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি আমার আত্মীয়া। আমরা কলকাতা থেকে বাগডোগড়া হয়ে রাজগঞ্জে ঢুকতে গিয়ে রাস্তার ভিড়ে আঁটকে গেছি। গাড়ি এগোতে পারছে না ভিড়ের জন্য। সীমন্তিনীর বোন আর দাদা বৌদিও আমার সঙ্গে আছে। আপনারা যদি রাস্তার ভিড়টা একটু সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতেন তাহলে খুব উপকৃত হতাম। আসলে সঙ্গে দেড় বছরের ছোট একটা বাচ্চাও আছে বলে আমরা এই ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যেতে পারছি না। তাছাড়া রাস্তার ভিড় এতক্ষণে জেনে গেছে যে সীমন্তিনীর দাদা বৌদিরা এ গাড়িতে আছে। তাই সকলেই আমাদের গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে। ব্যাপারটা আশা করি বুঝতে পারছেন”।
ও’পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “স্যার আমাদের থানা থেকে দুটো গাড়ি অনেক আগেই সীমন্তিনী ম্যাডামের বাড়িতে চলে গেছে। আমাদের স্যারও সেখানে আছেন। তবে স্যার, আপনারা এ মূহুর্তে ঠিক কোথায় আছেন বলুন তো। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে আপনাদের নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যায়”।
পরিতোষ রতীশের কাছ থেকে লোকেশানটা জেনে নিয়ে থানায় জানিয়ে দিল। এদিকে বাইরে ততক্ষণে রতন প্রায় পনের কুড়িজন রিক্সাওয়ালাকে একসাথে জুটিয়ে নিয়ে সকলে মিলে জনতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে রাস্তা ফাঁকা করে দেবার অনুরোধ জানাতে শুরু করেছে। সামনের কিছুটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যেতে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে ধীর গতিতে চালাতে লাগল। এভাবে প্রায় পনের মিনিটে কয়েকশ’ মিটারের মত যাবার পরেই উল্টো দিক থেকে সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটা পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হল।
______________________________