Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 249)

নবনীতা চলে যেতেই চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “মন্তি মা, তোকে একটা কথা আগে থেকেই জানিয়ে রাখছি। বড়দা কিন্তু পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে অর্চুও আমাদের আরেকটা মেয়েই। তাই তার বিয়েটা আমাদের বাড়ি থেকেই দেওয়া হবে। আর মেয়ে পক্ষের তরফে যা কিছু করা প্রয়োজন তা আমাদের তরফ থেকেই করা হবে”।
 

সীমন্তিনী নিজের খাওয়া শেষ করে বলল, “জেঠু তো এ’কথা আমাকে আগেই বলেছিলেন কাকু। তবে এ’সব নিয়ে কথা তো যথাসময়েই হবে। তার আগে আরেকটা কথা বল তো আমায়। আমি যে এখান থেকে তোমাদের সকলের জন্য পূজোর কাপড় চোপড় পাঠিয়েছিলাম, সেগুলো কি এখনও তোমাদের কাছে গিয়ে পৌঁছোয় নি”?
 

এবারে সরলাদেবী জবাবে বললেন, “তোরা যেদিন চলে এলি সেদিন বিকেলেই কুরিয়ার কোম্পানীর লোকেরা এসে সেগুলো দিয়ে গেছে রে মা। তোকে হয়ত বলতে ভুলে গেছি আমি”।
 

সকলের খাওয়া হয়ে যেতে সীমন্তিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তারপর থেকে দিনগুলো যেভাবে কাটছে, আমারও তো সেটা মনেই ছিল না। এখন হঠাতই সেটা মনে হল বলে জিজ্ঞেস করলুম। তা বড়মা, জিনিসগুলো তোমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে তো? জানো বড়মা, নীতা যেখানে কাজ করে ওখান থেকেই সবকিছু কিনেছিলুম। ওটাই এখানকার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে নামী কাপড়ের দোকান”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু বেসিনে হাত মুখ ধুচ্ছিলেন। সরলাদেবী সীমন্তিনীর কথার জবাবে বলল, “হ্যাঁরে মা। সকলেরই সব কিছু খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এত দামী দামী জিনিস কেনবার কী দরকার ছিলরে মা? এত টাকা খরচ করবার কোনও মানে হয়”?

সীমন্তিনী তার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, “ও’সব কথা ছাড় তো বড়মা। রোজ রোজ তো আর এ’সব করি না। চাকরি পাবার পর প্রথমবার হায়দ্রাবাদ থেকে তোমাদের জন্যে পূজোর কাপড় পাঠিয়েছিলুম তিন বছর আগে। তার পরের দু’বছরে তো তোমাদের কাউকে আর কিছু দিই নি। এবারেই কিছু দিলাম। কিন্তু ঈশ, কথাটা তো আমার মনেই ছিল না একদম” বলে নিজের ঘরের দিকে মুখ করে নবনীতাকে ডাকল।

একটু বাদে নবনীতা এসে বলল, “দিদি ব্লাঙ্কেটগুলো ঠিকই আছে। একেবারে পেতে ওপরে বেডশীট পেতে দিয়ে বসবার ব্যবস্থা সেরে এলুম”।

সীমন্তিনী আর সরলাদেবীর হাত মুখ ধোওয়া হয়ে গেছে ততক্ষণে। সীমন্তিনী নবনীতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা নীতা, এ’ ক’দিনের এত হুলুস্থুলে কথাটা আমার মাথাতেই ছিল না। বলছি কালচিনির বাড়ির সকলের জন্য আর ডক্টর সোমের জন্য যা যা কেনা হয়েছিল, সেগুলো তো পাঠানো হয়নি রে। ওগুলো কোথায় আছে জানিস”?

নবনীতা বলল, “ওগুলো তো আমাদের ঘরেই আছে দিদি। তুমিই তো বলেছিলে এরপরে কালচিনি যাবার সময় ওগুলো নিয়ে যাবে। তুমি তো তার পর আর কালচিনি যাও নি”।

সীমন্তিনী একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “যাক বাবা, ঠিক আছে। এবারে ও গুলো পাঠাতে হবে। আমার একদম মনেই ছিল না রে। আচ্ছা আর একটা কথা শোন। আমি অফিস থেকে ফেরার পথে জয়া ম্যামের কাছে গিয়েছিলুম। তোদের কারখানার পাশে তাদের নিজস্ব একটা লজ আছে না। সেখানে তিনটে রুমে ছ’টা বিছানা আছে। বেশ ভাল এরেঞ্জমেন্ট আছে সেখানে। ওনারা অবশ্য নিজেদের মহাজন আর ক্লায়েন্ট ছাড়া সেখানে কাউকে থাকতে দেন না। তবে আমার কথা শুনে জয়া ম্যাম আজ তিনটে রুমে আমাদের অতিথিদের থাকতে দিতে রাজী হয়েছেন। আর আমি রামসিংকে সব কিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি। তাই রাতে সবকিছু চুকে বুকে যাবার পর তুই শুধু তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসিস। রামসিং তোর সাথে থাকবে। ওখানে তাদের থাকবার ব্যবস্থা ঠিকঠাক মত হয়েছে কিনা ভাল করে দেখে তবে আসবি। আর প্রয়োজন হলে আমাকে বা জয়া ম্যামকে ফোন করবি। তার সাথে এ ব্যাপারে সব কথা বলে এসেছি আমি। ঠিক আছে”?

নবনীতা সব শুনে বলল, “ঠিক আছে দিদি। কোন সমস্যা হবে না”।

সীমন্তিনী এবার সরলাদেবী আর সুলোচনাদেবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বড়মা, বড়বৌদি। তোমরা যদি কিছু মনে না করো তাহলে গেস্টরুম থেকে সবাইকে আমার রুমে একটু ডেকে আনো না। আমি ততক্ষণে কয়েকটা দরকারী ফোন সেরে নিই”।

সরলাদেবী, সুলোচনা আর নবনীতাকে নিয়ে গেস্টরুমের দিকে রওনা হতেই সীমন্তিনী নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর নিজেদের ডিপার্টমেন্টের কয়েকজনের সাথে ফোনে সংক্ষেপে কথা বলতে লাগল। খানিক বাদেই সকলে সীমন্তিনীর ঘরে এসে ঢুকতেই সীমন্তিনী ফোন সুইচ অফ করে বলল, “এসো পিসো, এসো কাকু। তোমরা আমার বিছানায় বোসো। মা আর পিসি তোমরাও খাটেই বোস। দাদারা এলে সোফায় বসতে দেব। আর বৌদিদের নিয়ে আমি অর্চু আর নীতা মেঝেয় বসব’খন”।

হৈমবতীদেবী অর্চনার হাত ধরে বললেন, “মন্তি মা, অর্চুকে আমার পাশে বসতে দাও না মা”।

সীমন্তিনী তার কথার ভঙ্গী দেখে হেসে ফেলে বলল, “আমার বোনটাকে তো চিরদিনের জন্য তোমার হাতেই তুলে দিলাম পিসি। আচ্ছা বেশ, অর্চু, তুই পিসির সাথেই বোস। আমি একটু লক্ষ্মীদির সাথে কথা বলে আসছি। নীতা আমার সাথে আয় একটু”।

নীতাকে নিয়ে রান্নাঘরে এসে দেখে লক্ষ্মীকে তখনও রান্নাঘর গোছোতে ব্যস্ত থাকতে দেখে সীমন্তিনী বলল, “বুঝতে পারছি লক্ষ্মীদি। তোমার ওপর আজ বড্ড বেশী চাপ পড়ে গেছে গো। কিন্তু কী করব বলো। আর যে কোন উপায় খুঁজে পেলুম না। এদিকে তিনটে তো বেজেই গেছে। একটু পরেই বোধহয় আবার আরেক পার্টি এসে পৌঁছবে। নীতা, আয় তো আমরা হাত লাগিয়ে চটপট রান্নাঘরটা গুছোতে লক্ষ্মীদিকে একটু সাহায্য করি”।

সীমন্তিনী আর নবনীতা কাজে হাত লাগাতেই লক্ষ্মী বলল, “না না দিদিমণি, আমার কাজ তো প্রায় হয়েই এসেছে। তোমরা গিয়ে তাদের সাথেই কথা বলো গিয়ে”।

সীমন্তিনী আর নবনীতা হাতে হাত মিলিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে নেবার পর সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “লক্ষ্মীদি, ওদের তো আসবার সময় হয়ে গেল। তবে শোনো। ওনারা এলে তো আমার ঘরেই গিয়ে বসবে। ওনারা আসবার পর প্রথমে সবাইকে কিছু মিষ্টি আর শরবৎ দিও। নীতা এসে তোমাকে সাহায্য করতে পারে। রাতের খাবার তো ওনারাই নিয়ে আসছেন। তাই রাতে রান্নার খুব বেশী ঝামেলা হবে না। আর ওদিকে আমরা তো আলোচনাতেই ব্যস্ত থাকব। আমি হয়তো তখন আর ও’ঘর থেকে বেরোতে পারব না। তাই কয়েকটা কথা এখনই বলে যাচ্ছি। নীতা, তুইও শুনে রাখ। প্রয়োজন মত তুই লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করিস। সন্ধ্যের ঠিক আগে আগে সকলকে চা আর স্ন্যাক্স দিও। কেউ যদি আলাদা করে কিছু খেতে চায় তাহলে সেটাও করতে হবে। নইলে রাত আটটার দিকে আরেকবার করে সকলকে চা দিয়ে তুমি রাতের খাবারগুলো দেখে নিয়ে গরম টরম করে রেখ। আর নীতা, তুই কয়েকটা কথা খুব মন দিয়ে শুনে রাখ। আমি যা যা বলছি, তুই কিন্তু ঠিক ঠিক সেটাই করবি। রাতে খাবার সময় পরির দাদা বৌদি আর ভাইপো ভাইঝিদের আগে খাইয়ে দিবি। ওদের খাওয়া হলেই বেশী দেরী না করে ওদের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বি। এখানে তোকে কয়েকটা কথা আগে থাকতেই বলে দিচ্ছি, নইলে তুই ভয় পেয়ে যেতে পারিস বা ভাবনায় পড়তে পারিস। তুই কিন্তু যাবার সময় রামসিং এর গাড়িটা পাবি না। তুই দাদাদের কোন একটা গাড়িতে উঠবি। খুব অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। তবে কথাটা তুই মনে রাখিস, যাবার সময় তুই কিন্তু আমাদের গাড়িটা দেখতে পাবি না। রামসিংকে আমি এ’সব বুঝিয়ে দিয়েছি। তবে দাদাদের দুটো গাড়ির পেছনে আমাদের কম্পাউন্ডের বাইরে থেকেই আরও একটা গাড়ি যাবে। সে গাড়িতে কে থাকবে না থাকবে তা নিয়ে তুই কিছু ভাবিস না। আর কাউকে কিছু বলবিও না। তবে তোরা গেস্ট হাউসের সামনে পৌঁছে গেলে পেছনের গাড়িটা অন্যদিকে চলে যাবে। আর তোদের কারখানার কাছাকাছি গিয়ে তুই জয়া ম্যামকে ফোন করে জানিয়ে দিবি যে তুই আমাদের অতিথিদের নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিস। জয়া ম্যাম নিজেই আসতে পারেন, নইলে অন্য কাউকে চাবি দিয়ে তাদের লজে পাঠিয়ে দেবেন। দাদাদের গাড়িগুলো রাখবার জায়গা তারা দেখিয়ে দেবে। সেখানে তাদের পৌঁছে দিয়ে, সব রুমে আলো, পাখা, জল, বাথরুম সব কিছুর আয়োজন ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে সবগুলো বিছানায় মশারী টাঙিয়ে, তাদের আর কিছু প্রয়োজন আছে কিনা জেনে নিয়ে, সে প্রয়োজন মিটিয়ে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসবি। জয়া ম্যামকে আমি সবরকম ভাবে বুঝিয়ে বলে এসেছি। উনি প্রয়োজন মত তোকে সাহায্য করবেন। তখন তুই বেরিয়ে এলে রামসিংএর গাড়িটাকে লজের ঠিক সামনেই দেখতে পাবি। আর সময় নষ্ট না করে গাড়ির মাঝের সীটে তুই উঠে বসবি। দাদাদের গাড়ির ড্রাইভার দু’জনকে পেছনে উঠতে বলবি। তবে দুটো কথা মাথায় রাখিস বোন। ফেরবার পথে রামসিং কিন্তু অন্য রাস্তা দিয়ে আসবে। আর সে গাড়িতে রামসিংএর পাশের সীটে আগে থেকেই আরেকজন বন্দুকধারী কনস্টেবল থাকবে। তাতে ভয় পাস নে। আর সেখান থেকে গাড়ি স্টার্ট দেবার আগেই আমার মোবাইলে একটা ফোন করবি। তারপর রামসিং তোকে বাড়ি নিয়ে আসবে। বুঝেছিস তো”?

সীমন্তিনীর এতসব উপদেশ শুনে নবনীতা চোখ বড় বড় করে বলল, “এত সতর্কতার কি খুব দরকার ছিল দিদি? এইটুকু তো পথ। দশ মিনিটেই তো সেখানে পৌঁছে যাব আমরা”।

সীমন্তিনী মুচকি হেসে বলল, “সেটা নিয়ে তুই ভাবিস নে। তবে জেনে রাখ, এ’সব পরির নির্দেশেই করতে বাধ্য হচ্ছি আমি। আর তুই তো জানিস পরিকে আমি আমার গুরু বলে মানি। শিষ্যা হয়ে আমি কি গুরুর আদেশ অমান্য করতে পারি বল? তবে পরি চায় তার আত্মীয় স্বজনরা যেন কোন রকম ঝামেলায় না পড়েন। আর বেশী রাতের ব্যাপার বলে আমিও তাতে আপত্তি করিনি। তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস নে। কিন্তু যেভাবে যেভাবে যা যা করতে বললুম সেগুলো মনে রেখে ঠিকঠাক মত করিস। আর সেখান থেকে রওনা হবার আগে কিন্তু আমাকে অবশ্যই একটা ফোন করবি। ভুলবি না কিন্তু”।

নবনীতা সীমন্তিনীর কথায় সায় জানাতেই সীমন্তিনী গেটের দিকে দুটো গাড়ি আসতে দেখে বলল, “এই নীতা, ওনারা বোধহয় এসে গেছেন রে, আয়” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

সিকিউরিটি গার্ডদের যথাযথ নির্দেশ সীমন্তিনী আগেই দিয়ে রেখেছিল। তারা গাড়ি চেক করবার নিয়মরক্ষা করতে করতেই সীমন্তিনী আর নবনীতা সিঁড়ির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। রামসিং গাড়ি দুটোকে ঈশারা করতেই গাড়ি গুলো সিঁড়ির কাছে এসে থামল। ততক্ষণে লক্ষ্মীও নিচে নেমে এসেছে। রামসিং আর লক্ষ্মী গাড়ি থেকে খাবার দাবারের কন্টেনারগুলো ঘরে নেবার ব্যবস্থা করতে লাগল। আর সীমন্তিনী আর নবনীতা আগতদের সকলকে আদর অভ্যর্থনা করে ঘরের দিকে রওনা হল। যেতে যেতেই একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে নিল। বাচ্চারাও অবাক চোখে সীমন্তিনীকে দেখতে দেখতে বারান্দায় উঠেই একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমিই কি আমাদের পুলিশ পিসি নাকি গো”?

সীমন্তিনী মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা, আমিই তোমাদের পুলিশ পিসি। আমার নাম সীমন্তিনী। তোমার নাম কি”?

ছেলেটা নিজের নামের সাথে অন্যান্য বাচ্চাদের নামগুলোও বলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা পুলিশ পিসি, তোমাদের এখানে নাকি খুব সুন্দর খেলবার জায়গা আছে? কোথায় গো? আমরা কিন্তু সেখানে খেলব বলে সাথে ফুটবল নিয়ে এসেছি। আমাদের বাড়িতে একটুও খেলার জায়গা নেই। এখানে কিন্তু আমরা খেলব”।

সীমন্তিনী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ঠিক আছে বাবা, খেলবে’খন। আর খেলার জায়গা তো আমাদের ঘরটার ঠিক পেছনেই। তবে তার আগে ঘরে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও, একটু কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে নাও”।

সকলকে নিয়ে ঘরে ঢোকবার পর সীমন্তিনী সবাইকে সোজা তার রুমেই নিয়ে এল। সকলের সঙ্গে সকলের পরিচয় হয়ে যাবার পর সুলোচনাদেবী তার দুই জাকে নিয়ে অর্চনার সামনে এসে তাদের সাথে অর্চনার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সকলেই অর্চনাকে দেখে খুব খুশী।
 

মিনিট দশেক বাদে লক্ষ্মী আর নবনীতা সবাইকে কোল্ড ড্রিঙ্কস আর মিস্টি খাইয়ে দেবার পরেই সকলে মিলে আলোচনা শুরু করল।

সকলে মিলে অনেকসময় ধরে বিশদ ভাবে সব কিছু আলোচনা করা হল। বিধুবাবুদের কালচিনির বাড়িতে শুভ গৃহারম্ভের ভূমি পূজোর অনুষ্ঠানটা হচ্ছে ১৮ই অক্টোবর। তখন তারা সাময়িক ভাবে একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যেই তিন চার জনের থাকা খাওয়া আর শোবার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হবেন। কারণ কিংশুকের ফাইনাল পরীক্ষা আর বিধুবাবুর দোকান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখবার ব্যাপার আছে। তাই সেটা অসম্ভব। আবার বাড়ির কাজ শুরু হবার তিনদিন বাদেই দুর্গাপূজো, আর তার পর লক্ষ্মীপূজো। সকলেই এক কথায় সম্মতি জানাল যে খুব তাড়াতাড়ি কাজ হলেও অন্ততঃ মাস ছয়েকের আগে কিছুতেই বাড়ি তৈরীর কাজ শেষ হবে না। তাই বিধুবাবু আর বিভাদেবী নিজেদের বাড়িতেই বিয়েটা দিতে চাইলে অন্ততঃ ছ’মাসের মধ্যে কিছুতেই বিয়েটা দেওয়া সম্ভব হবে না। আর ছ’মাসের মধ্যে বাড়ি কমপ্লিট হলেও গৃহপ্রবেশের দিনক্ষণ বাছাবাছি করতে হয়ত আরও কিছু দেরী হয়ে যেতে পারে। এতটা দেরী করতে কেউই রাজী হলেন না। তাছাড়া ', ঘরের বিধবা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বলে কালচিনির মত একটা ছোট্ট শহরের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ', সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টিও হতে পারে। সেটা নিয়েও কিছুটা ঝামেলা হবার সম্ভাবনা প্রবল। তাই কালচিনিতে বিধুবাবুদের নতুন বাড়ি নির্মাণ আর কিংশুকের পরীক্ষার কথা এবং কালচিনির লোকদের ক্ষোভের আশঙ্কা মাথায় রেখে ঠিক করা হল যে মেয়ের আশীর্বাদ হবে সীমন্তিনীর নাগরাকাটার এই কোয়ার্টারেই নভেম্বরের ২৩ তারিখে। আর একই দিনে পরিতোষের আশীর্বাদের অনুষ্ঠান হবে আলিপুরদুয়ারে তার পিসির বাড়িতে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা হবে রাজগঞ্জে আর বৌভাত ও ফুলশয্যা হবে পরিতোষের পিসির বাড়িতেই। বিভাদেবী চাইছিলেন যে ওদের দ্বিরাগমণের অনুষ্ঠানটা যেন কালচিনিতে তাদের নিজের বাড়িতেই হয়। কিন্তু তখনও নতুন বাড়ি তৈরীর কাজ শেষ হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে যেহেতু রাজগঞ্জের বাড়ি থেকেই বিয়েটা দেওয়া হচ্ছে, তাই দ্বিরাগমনের অনুষ্ঠানটাও সেই বাড়িতেই হবে। আলিপুরদুয়ারে বৌভাত আর ফুলশয্যা হবার পর পরিতোষ আর অর্চনা সেখান থেকেই রাজগঞ্জ চলে যাবে দ্বিরাগমণ সারতে। তারপর সেখান থেকেই তারা কলকাতা চলে যাবে।
 

আলোচনার মাঝেই বেশ কয়েকবার ফোনে রতিকান্তবাবু, পরিতোষ, বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সাথেও কথা বলা হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সামনের ২৩ নভেম্বরে, বাংলার ৭ই অঘ্রাণে দু’জনের বিয়ের আশীর্বাদের অনুষ্ঠান হবে। পরিতোষকে আলিপুরদুয়ারে গিয়ে আশীর্বাদ করবেন বিধুবাবু, বিভাদেবী, রতিকান্তবাবু এবং তার স্ত্রী সরলাদেবী। আর সেদিনই আলিপুরদুয়ার থেকে নিরঞ্জনবাবু, হৈমবতীদেবী, শ্যামলেন্দু আর সুলোচনা এসে সীমন্তিনীর কোয়ার্টারেই অর্চনাকে আশীর্বাদ করবেন। বিয়ের দিন স্থির করা হল ২৯শে নভেম্বর। বাংলার ১৩ই অঘ্রাণ। বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে রাজগঞ্জেই। নিরঞ্জনবাবু আর পরিতোষ আপত্তি করা সত্বেও রতিকান্তবাবু আর তার দুই ভাই মেয়ের অভিভাবক আর কন্যাপক্ষ হিসেবে বিয়ে এবং দ্বিরাগমণের সমস্ত খরচপত্রের দায়ভার স্বেচ্ছায় নিজেদের হাতে তুলে নিলেন। গ্রাম বাংলার রীতিতেই বিয়ের অনুষ্ঠান চলবে দুদিন ব্যাপী। বিয়ের দু’দিন বরপক্ষ কন্যাপক্ষ সব মিলিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ১০৮ জনের অভ্যর্থনা এবং থাকা খাওয়ার ব্যাপার পুরোটার দায়িত্বই পাত্রীর ছোটবোনের বাড়ির লোকেরাই সামলাবেন। পরিতোষের তরফ থেকে নিমন্ত্রিত থাকছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ জনের মত। এরা মূলতঃ কলকাতা, আলিপুরদুয়ার আর মালবাজার থেকে আলাদা আলাদা ভাবে আসবেন। কালচিনি, নাগরাকাটা আর কলকাতা থেকে কন্যাপক্ষের লোক হিসেবেও পঁয়তাল্লিশ জন আসবেন। এদের মধ্যে কলকাতার তিনজন, কালচিনির তিনজন আর নাগরাকাটার তিনজন বিয়ের দু’দিন আগেই রাজগঞ্জের বাড়িতে এসে যাবেন। বাকিরা বিয়ের দিন। রাজগঞ্জের বাড়ির আর রতিকান্তবাবুদের দু’চারজন ঘনিষ্ঠ লোক মিলিয়ে প্রায় ঊণত্রিশ জনের মত বিয়েতে হাজির থাকবেন। ক্যাটারার আট দশজন ছাড়া জনা দশেক সিকিউরিটির লোকও থাকবে। সব মিলিয়ে একশ’ চল্লিশ থেকে একশ’ পঞ্চাশ জন লোকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

গ্রাম বাংলার নিয়মে বাসি বিয়ের দিন বর-কনেকে নিয়ে বরপক্ষের লোকেরা আলিপুরদুয়ারে পরির পিসির বাড়িতে গিয়ে উঠবে। বধূবরণ, কালরাত্রি, বৌভাত, ফুলশয্যা এ’সব অনুষ্ঠান ও বাড়িতেই হবে। বৌভাতের অনুষ্ঠানে কনেপক্ষের তরফ থেকে কলকাতা, কালচিনি, রাজগঞ্জ এবং নাগরাকাটার কয়েকজন উপস্থিত থাকবেন। তার দু’দিন পর পরিতোষ আর অর্চনা রাজগঞ্জের বাড়িতে আসবে দ্বিরাগমণ সারতে। কালচিনির বাড়ি থেকে অর্চনার মা, ভাই বোনও তখন রাজগঞ্জেই থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আর পরিতোষের যথেষ্ট আপত্তি সত্বেও বরপক্ষ থেকে বিয়ের যাবতীয় আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনার ভার তুলে নিলেন পরির পিসি হৈমবতী দেবী, নিরঞ্জনবাবু, আর তাদের পূত্র ও পূত্রবধূরা।

সমস্ত আলাপ আলোচনা শেষ হয়ে যাবার পর সীমন্তিনী নিজেই উদ্যোগী হয়ে শ্যামলেন্দু, বিমলেন্দু, দেবিকা, রুমা আর বাচ্চাদেরকে আগে খাইয়ে দিল। তারপর নবনীতার সাথে তাদের সকলকে জয়া বসাকের লজে পাঠিয়ে দেবার সময় নবনীতাকে আরেকবার ভাল করে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বলল, “তোর মোবাইলটা সব সময় হাতে রাখিস। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবি। আর ওখান থেকে গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে অবশ্যই কিন্তু আমাকে ফোন করবি। আর শোন, পরিও হয়তো তোকে ফোন করতে পারে। তবে বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে চাইলে আমার ফোনে ফোন করতে বলিস। আর বেশী সময় কথা বলবি না ওর সাথে, বুঝলি”?

সীমন্তিনী নিজেও সকলের সাথে বাইরে এসে সকলকে যখন গাড়িতে তুলে দিচ্ছিল তখন শ্যামলেন্দুকে কিছুটা ইতস্ততঃ করতে দেখে সীমন্তিনী নিজেই জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবেন বড়দা”?
 

শ্যামলেন্দু কিছুটা ইতস্ততঃ করেই জবাব দিলেন, “একটা কথা ছিল দিদি। একটু এদিকে আসবেন”? বলে কিছুটা তফাতে যেতে ঈশারা করলেন।

সীমন্তিনী কিছুটা অবাক হলেও শ্যামলেন্দুর কাছে গিয়ে বলল, “বড়দা, আপনি আমার থেকে বয়সে বড়। আমাকে আপনি করে বলবেন না প্লীজ। আমাকে নাম ধরে তুমি করে বলবেন। আচ্ছা হ্যাঁ বলুন কী বলবেন”।

শ্যামলেন্দুর দ্বিধাগ্রস্ত ভাবটা যেন কাটতেই চাইছে না। ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে তিনি বললেন, “মানে, কিভাবে যে বলি কথাটা। আসলে কথাটা আমি পরিতোষকেও বলেছিলাম। কিন্তু ও তোমাকে সে ব্যাপারে কিছু বলেছে কিনা জানিনা”?

সীমন্তিনী মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করল, “না পরি তো সেভাবে কিছু বলেনি আমাকে। কিন্তু আপনি কি সেদিন পরিকে বলেছিলেন যে এদিকের কয়েকটা উগ্রপন্থীদের হিটলিস্টে আমার নাম আছে”?

শ্যামলেন্দু হতভম্বের মত সীমন্তিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে আর কোনও কথাই সরছিল না। তার অমন অবস্থা দেখে, আর তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সীমন্তিনী মৃদু হেসে বলল, “ও নিয়ে ভাববেন না বড়দা। পুলিশদের নাম উগ্রপন্থী বা টেররিস্টদের হিট লিস্টে সব সময়ই থাকে। আর সে ব্যাপারে আমরাও সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। আপনি ও নিয়ে অযথা চিন্তা করবেন না। আর চেষ্টা করবেন, আপনার মুখ থেকে যেন আর কেউ এ’সব কথা না শুনতে পায়। বড়বৌদিও যেন না জানেন”।


______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 30-03-2020, 11:16 AM



Users browsing this thread: 8 Guest(s)