30-03-2020, 11:14 AM
(Update No. 246)
এতগুলো কথা একসাথে বলে হৈমবতীদেবী থামতেই নিরঞ্জনবাবু বললেন, “এই হল আসল কথা। এমন সুন্দর করে সব কিছু তোমাদের গুছিয়ে বলতে পারতুম না আমি। এবার মন্তি মা, তুমি এবার আমায় বলো, তুমি আগে যেমন বললে, সেভাবে কি সত্যিই বিধু আর বিভাকে এ বিয়েতে রাজী করাতে পেরেছ? ওরা এ বিয়েতে সত্যি রাজী হয়েছে মা”?
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “একটু বোঝাতে হয়েছে তাদের অবশ্যই। প্রথম কথাতেই তারা রাজী হননি বটে। তবে হ্যাঁ পিসো, মাসি মেসোই শুধু নন, অর্চুর ভাইবোনেরাও সকলেই এ বিয়েতে রাজী আছে। আর বিয়েটা নিয়ে আমরা কিভাবে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম, তোমরা জানতে চাইলে সে’সবও আমি খুলে বলব তোমাদের। কিন্তু আমার মনে হয় এখন ডিনারটা সেরে নেওয়া উচিৎ। রাত দশটা তো পেরিয়ে গেল। খাবার পর তোমাদের পক্ষে যদি না ঘুমিয়ে সে’সব শোনা সম্ভব হয় তাহলে আজ রাতেই কথাগুলো বলব। কিন্তু আমার মনে হয় পিসির ওপর খুব চাপ পড়বে। সেটা একটু ভেবে দেখো। পিসি যদি চান তাহলে আমি সারা রাত জেগেও সে’সব কথা বলতে রাজী আছি। নইলে কাল সকালেই না হয় শুনো সে’সব।”
এবার সুলোচনা বললেন, “তুমি ঠিক বলেছ মন্তি। মা বাড়িতে রোজ রাত সাড়ে ন’টায় ডিনার করেন। তাই আমার মনে হয় এখন ডিনারটা সেরে নেওয়াই উচিৎ। বাকি আলোচনার ব্যাপারটা না হয় পরে ভেবে দেখা যাবে”।
অর্চনা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওমা, পিসির তো তাহলে অনিয়ম হয়ে গেল আজ। আমি দেখছি ওদিকে লক্ষ্মীদি একা একা ......”
তার কথার মাঝেই দড়জার কাছ থেকে লক্ষ্মী বলে উঠল, “দিদিমণি, খাবার তৈরী হয়ে গেছে। ওনাদের সবাইকে নিয়ে এসো”।
******************
পরিতোষের বৌদিরা মিলে অনেক রকমের খাবার বানিয়ে পাঠিয়েছিল। সঙ্গে চাটনি, দই ছানার পায়েস আর ভাত অব্দি বানিয়ে পাঠিয়েছিল। বাইরে থেকে শুধু মিষ্টির হাড়িটাই কিনে পাঠিয়েছিল। খাবার খেয়ে অর্চনা, নবনীতা, সীমন্তিনী এবং লক্ষ্মীও প্রচুর প্রশংসা করল রান্নার।
খেতে খেতেই হৈমবতীদেবী তার স্বামীকে বললেন, “শোনো না, বলছিলুম কি। খাবার পর তো আমি আধ ঘন্টা না ঘুমিয়েই থাকি। আজ আধ ঘন্টার বদলে এক ঘন্টা পর ঘুমোলে কি আর এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে বলো”?
নিরঞ্জনবাবু খেতে খেতেই বললেন, “তোমার মানসিক অবস্থাটা আমি বেশ ভালই বুঝতে পারছি হিমু। তোমার মনের অনেক কৌতূহল মিটে গেলেও এখনও অনেক কৌতুহলের নিবৃত্তি হয় নি জানি। অবশ্য এটা আমিও অস্বীকার করব না যে আমার মনেও আর কোন কৌতূহল বাকি নেই। বড়বৌমার মনেও যে আছে তাও জানি। কিন্তু আমার আর বড়বৌমার তো কোন অসুবিধে নেই। তোমার যদি মনে হয় আরও একটা ঘন্টা জেগে থাকলে তোমার কোন কষ্ট হবে না, তাহলে আমি তোমায় বাধা দেব না। কিন্তু দু’ আড়াই ঘন্টা জার্নি করে এসেছ, তারপর এতখানি সময় কত উদ্বেগ আর উত্তেজনায় কাটল। এখনও আরও এক ঘন্টা তুমি জেগে থাকবে? তোমার শরীরের কণ্ডিশন কেমন সেটা তুমি ভেবে দেখো”।
সুলোচনা বললেন, “হ্যাঁ মা, আগ্রহ কৌতূহল আছে বলেই শারীরিক অবস্থাটা তো ভুলে গেলে চলবে না। আমারও তো ইচ্ছে করছে আজ সারাটা রাত জেগে মন্তি, অর্চু আর নীতার সাথে কথা বলে যাই। বিশেষ করে মন্তি বিধুমামুকে আর মামীকে কিভাবে রাজী করিয়েছিল সেটা না শোনা অব্দি মনটা পুরোপুরি শান্ত হবে না। কিন্তু শুধু আমার চাওয়াটাকেই বড় করে দেখলে তো চলবে না। আমরা যেমন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় এতক্ষণ কাটিয়েছি, অর্চু আর মন্তিও তো একই সমান উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছে। ওরাও তো ক্লান্ত হতে পারে। মন্তি সারাটা দিন অফিস করেছে। আবার কাল সকাল ন’টার দিকেই হয়ত আবার বেরিয়ে যাবে। আলোচনার তো এখনও অনেক কিছুই বাকি আছে। কিন্তু তবু বলছি, আজ রাতে শুধু নিজেদের কৌতূহল মেটাব বলে ওদের সবাইকে আর কষ্ট দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না”।
এবার নবনীতা বলল, “আমি তো আজ সারা রাত জেগে কাটাতেও রাজী আছি। কাল রবিবার। আমার ডিউটিতে যেতে হবে না। আর কতদিন পর আমার জীবনে এমন একটা খুশীর দিন এসেছে”।
সীমন্তিনী সকলের কথা শুনে বলল, “পিসো, বড়বৌদি কিন্তু ঠিক কথাই বলেছেন। সত্যি বলতে এখন অব্দি শুধু পাত্র-পাত্রী পছন্দই হল। বিয়ের আলোচনা তো এখনও সেভাবে শুরুই হয় নি। অনেক কিছুই আছে আলোচনা করবার। অবশ্য এটাও ঠিক যে সব আলোচনাই তো আজ রাতেই আর শেষ করে ফেলা সম্ভব নয়। তবু পিসির যদি শরীর ঠিক থাকে তাহলে আরও একটা ঘন্টা আমরা কথা বলতে পারি। আমি তোমাদের মনের বাকি কৌতুহলটুকুর কিছুটা নিবৃত্তি করবার চেষ্টা করতে পারি”।
নিরঞ্জনবাবু তাতে সম্মতি দিলে সীমন্তিনী নবনীতা আর অর্চনাকে বলল, “নীতা, অর্চু, তোরা তাহলে একটা কাজ কর। তোদের খাওয়া শেষ হলে চটপট উঠে পড়িস। গেস্টরুমের বিছানাটা ঠিকঠাক করে মশারীটা টাঙিয়ে, তোদের ঘরের বিছানাও তৈরী করে ফেলিস। খাবার পর আমার ঘরেই সকলে মিলে বিছানার ওপর বসেই কথা বলব। আলোচনা শেষ হলে আমার বিছানাটা না হয় পরে আমিই পেতে দেব বড়বৌদির জন্য। গল্পে বসবার আগেই তোরা চটপট অন্যান্য বিছানাগুলো রেডি করে ফেলিস”।
খাবার পর নিরঞ্জনবাবুরা সকলে সীমন্তিনীর ঘরে এসে বিছানার ওপর বসলেন। সীমন্তিনী ঘরে এসেই নিজের মোবাইল থেকে রচনার মোবাইলে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাল “দুশ্চিন্তা করিস না সোনা। আজ আর তোর সাথে কথা বলতে পাচ্ছি না। এখানে সব ঠিক আছে। কাল সকালে হয়ত আমি ব্যস্ত থাকব। তুই আমাদের ফোন না পেলে, সকাল দশটা নাগাদ নীতা বা অর্চুকে ফোন করিস। সু-খবর পাবি। গুড নাইট”।
মিনিট দশেক বাদেই নবনীতা আর অর্চনা সীমন্তিনীর ঘরে চলে আসবার পর সময় নষ্ট না করে সীমন্তিনী বলল, “পিসি, শোনো এবার। তোমরা যে ভেবেছিলে মাসি মেসোরা তাদের বিধবা মেয়ের দ্বিতীয় বিবাহ দিতে চাইবেন না কিছুতেই, সে ধারণা একদম সঠিক ছিল। আমিও আগে থেকেই জানতুম, তারা এমন আপত্তি তুলবেনই। কিন্তু সেটা নিয়ে আমি অতটা চিন্তিত ছিলুম না কোনদিনই। আমি চিন্তিত ছিলুম শুধু অর্চুকে নিয়ে আর পরিকে নিয়ে। আমি যেদিন অর্চুকে কালচিনির হাসপাতালে প্রথম দেখেছিলুম সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম এমন নিষ্পাপ আর এমন ফুলের কুঁড়ির মত ফুটফুটে একটা মেয়ের জীবন আমি এভাবে কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। কিন্তু পরে মনে হল, আমি একা চাইলেই সেটা সম্ভব হবে না। অর্চু নিজে সেটা চায় কি না, সেটাই আগে বুঝতে হবে। আর ওর মত কোমল মনের একটা মেয়ে অমন বিভীষিকাময় সাতটা বছর কাটিয়ে শারীরিক ও মানসিক ভাবে যেভাবে ক্ষত বিক্ষত আর বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল, তার পক্ষে চট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই ভেবেছিলুম আগে ওকে সকারাত্মক চিন্তা ভাবনা করবার জন্যে তৈরী করতে হবে। ওকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলবার পাশাপাশি খুব কাছে থেকে ওকে কিছুটা গ্রুমিং করতে হবে। তাই হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর ওর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে আমি ডক্টর সোমের সাথে পরামর্শ করেই ওকে আমার এখানে নিয়ে আসি। ডক্টর সোম সত্যি খুব ভাল একজন ডাক্তার, আবার তার পাশাপাশি খুব ভাল মনের একজন মানুষও। তার সঠিক উপদেশেই অর্চু এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে ওকে আমার এখানে আনবার আসল উদ্দেশ্যটা আজ অব্দি কেউ জানে না। এমন কি ডক্টর সোমও জানতেন না। আজ প্রথম তোমাদের সকলের কাছে আমি সেটা প্রকাশ করছি। আমার মনে হয়েছিল ওকে আমার এখানে নিয়ে এলে আমি নীতা আর লক্ষ্মীদি, তিনজনে মিলে খুব তাড়াতাড়ি ওকে শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারব। মৌখিকভাবে এটাই সকলকে বলেছিলুম। আর সেটা হয়েছেও। লক্ষ্মীদি, নীতা আর আমার সাহচর্যে থাকতে থাকতে ঠাকুরের আশীর্বাদে ও দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই অনেক চনমনে হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার গোপন ইচ্ছেটা ছিল ওর অতীতের সব কথা ওর স্মৃতি থেকে মুছে দিতে না পারলেও ওকে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শেখানো। আর সেটা যখন ও করতে শুরু করবে তখন ওকে বোঝাবো যে ওর আরেকটা ভাল ছেলের সাথে বিয়ে করা উচিৎ। আমি মনে মনে ওকে আর পরিকে নিয়ে তো আগে থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলুম। কিন্তু সে’কথাটা তখন অব্দি নিজের মনে মনেই রেখেছিলুম। কিন্তু ভাল তো ওকে আরও অনেক আগে থেকেই বাসতুম আমি। ওকে দেখবার আগে থেকেই, যেদিন থেকে রচু, আর মাসি মেসোদের সাথে আমার হৃদ্যতা হয়েছিল সেদিন থেকেই ওকে আমি ভালবাসি। কিন্তু ওকে আমার এখানে নিয়ে আসবার খুব অল্পদিনের মধ্যেই ওকে ভালভাবে কাছ থেকে দেখে নবনীতা আর লক্ষ্মীদিও ওকে ভালবেসে ফেলল। তারপর আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় অর্চু আবার বিয়ে করতে রাজী হল। সেটা খুব সম্ভবতঃ এ মাসেরই পাঁচ বা ছ’ তারিখের কথা। তার পরেই প্রথমে আমি রচুর সাথে আলোচনা করি। রচু আমার সঙ্গে একমত হতেই দু’ তিনদিন বাদেই আমি কালচিনি গিয়ে অনেকভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাসি মেসোকে রাজী করাই। ভাই তো প্রথম থেকেই আমাকে সাপোর্ট করেছিল”।
এতটা বলে একটু দম নিয়ে আবার বলল, “প্রায় দু’মাসের চেষ্টায় অর্চুকে আর ওদের পরিবারের বাকি সকলকে রাজি করাবার পর আমি পরির সাথে ওর বিয়ে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলুম। সবদিক দিয়ে ভেবে মনে হল অর্চু বিধবা বলে পরির মনে কোনরকম দ্বিধা না থাকলে ওরা একে অপরের যোগ্যই হবে। পরি একটা সময় নীতাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। সাত বছর পর নীতাকে ফিরে পেয়ে নীতার সব কথা শুনেও ও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু নীতা আমার আর রচুর সামনেই পরির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল। আর আমি ঠিক ওই দিনটা থেকেই অর্চু আর পরিতোষের দু’জনের বিয়ে দেবার কথা মনে মনে ভাবছিলুম। কিন্তু নীতাও যে মনে মনে পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দেবার কথা ভাবছিল, সেটা আমিও বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি পরির কাছে অর্চুর জন্য প্রস্তাব দেবার আগে আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাইছিলাম যে নীতা এখন নিজের মন পরিবর্তন করে আবার পরিকে বিয়ে করতে চায় কি না। কিন্তু বাড়িতে অর্চুর সামনে নীতার সাথে ওই বিষয়ে কথা বলা সম্ভব ছিল না। তাই একদিন রাতে বাড়ির বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে বসে ওর সাথে কথা বলি। ও সেদিনও পরিস্কার ভাবে একই কথা বলে যে পরিকে ও বিয়ে করবে না। সেই সাথে এ’কথাও বলে যে ও চায় পরি অর্চুকে বিয়ে করুক”।
এমন সময় নবনীতা আদুরে গলায় বলে উঠল, “ও দিদি, ওই দিনের কথাটা আমাকে বলতে দাও না প্লীজ”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আচ্ছা বেশ, বল”।
নবনীতা সাথে সাথে বলল, “বৌদি, সেদিন যা একটা কাণ্ড হয়েছিল না কী বলব তোমাদের। তখন আমরা একটা রেস্টুরেন্টে। দিদি তখন বলছিল যে পরির জন্যে সে একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। আমি তার কথা শুনে মন খারাপ করে বলেছিলাম যে আমিও পরির জন্য মনে মনে একটা মেয়েকে পছন্দ করেছি। দিদির মুখে তখন একটা এগরোলের গ্রাস। তখন দিদি প্রথমে আমার পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি অর্চুর নাম বলতেই সে এমন বিষম খেয়েছিল যে রেস্টুরেন্টের সমস্ত লোক দৌড়ে আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল। বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে দিদির প্রায় দম বন্ধ হবার জো হয়েছিল। আর অমন মূহুর্তেই অর্চু দিদির ফোনে তখন ফোন করেছিল। দিদির তো তখন কাশতে কাশতে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমিই ফোনটা ধরে অর্চুর সাথে কথা বললাম। আর দিদিভাই নিজেকে সামলে নেবার পর যখন বলল যে সেও পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দিতে চায়, সে’কথা শুনে তখন আমার বিষম খাবার উপক্রম হয়েছিল। আমি তো আনন্দে নাচতে শুরু করে দিয়েছিলাম। তখনই সবাইকে কথাটা জানাতেই চাইছিলাম। কিন্তু দিদিই তখন আমাকে বোঝাল যে তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে সব বানচাল হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের ভাল করে ভেবে চিন্তে সকলের মনের ইচ্ছেটা জানতে হবে। তারপরই পরির কাছে আর অর্চুর কাছে সব কিছু খুলে বলতে হবে। তারপর দিদি প্রথমে অর্চুকে আমার আর পরিতোষের মধ্যে আগে কেমন সম্পর্ক ছিল সেটা জানায়। পরি যে দিদিকেও একসময় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সেটাও ওকে জানালাম। তারপর ঠাট্টার ছলে আমরা অর্চুর সামনেই ওদের দু’জনের বিয়ের কথা ওঠাতে শুরু করলাম। আমাদের কথায় ও লজ্জা পেত। আমাদের থামতে বলত। কিন্তু আমরা প্রায় রোজই পরিকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। আর ওদিকে রচনা বৌদির সাথেও পরির পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। রচনা বৌদিও পরিকে নিজের দাদার মত শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল। আর অর্চুর সাথে কথা বলবার সময় রচনা বৌদিও পরির খুব প্রশংসা করত। সে তারিখটা আমি বোধহয় কোনদিন ভুলব না। এ মাসেরই তেরো তারিখ। সেদিন আমি আর দিদি মিলে ওকে এমনভাবে চেপে ধরেছিলাম যে আমাদের কথায় সেদিন ও পরিকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল। মাসি মেসোকে দিদি তার আগেই পরি আর ওর বিয়ের ব্যাপারে রাজী করিয়েছিল। অবশ্য সে’কথাটা কালচিনির বাড়ির সবাই, এখানে আমরা আর কলকাতার রতুদা আর রচনাবৌদি জানলেও, দিদি সকলকেই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল যে অর্চু বা পরিকে এ’সব কথা কেউ যেন না জানায়। আর দিদির কথা তো কেউই ফেলতে পারে না। দিদির বাপের বাড়ির লোকজনদের সাথে তার যে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, সে বাড়ির কেউও দিদির কোন কথা অমান্য করেন না। তা সে যাই হোক, ততদিনে অর্চুর নাম উল্লেখ না করেই দিদি পরিকে জানায় যে আমরা পরির জন্য এমন এমন একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। অর্চুর অতীতের বিয়ের ব্যাপারে আর ওর রূপগুণ স্বভাব চরিত্রের কথা সবকিছু জানিয়ে দিদি পরির মতামত জানতে চেয়েছিল। পরি ঠিক আগের মতই দিদিকে বলেছিল যে ও’সব ব্যাপারে দেখবার বা ভাববার দায়িত্ব তার নয়, সে দায়িত্ব আমাদের দু’জনের। আমাদের পছন্দ হলে ওর কোনও আপত্তি নেই”।
এতখানি বলে নবনীতা সীমন্তিনীকে বলল, “এর পরের ঘটণাগুলো সবটা আমিও পুরোপুরি জানিনা দিদি। তাই পরের টুকু এবার তুমিই বলো”।
সীমন্তিনী তখন বলল, “পরের সময়টুকু আমাদের যত উদ্বেগ চিন্তা দুর্ভাবনা আর বিস্ময়ের সাথে কেটেছে তাতে সব কথা তোকে বলবার সুযোগও পাইনি রে নীতা। তবে পিসি, আমরা যে অর্চুর সাথে পরির বিয়ে দেবার কথা ভাবছিলুম এটা না জেনেও পরি যখন বিয়েতে রাজী হল তখন আমি বিয়ের আয়োজন নিয়ে ভাবতে শুরু করলুম। কিন্তু একই সাথে কালচিনির মেসোদের বাড়ি তৈরী, ভাইয়ের পরীক্ষা, কলকাতায় আমার পরিচিত আরেকজনের একটা মার্কেট কমপ্লেক্স বানাবার ব্যাপার নিয়ে আমাকে খুব চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছিল। তার ওপর অফিসের ঝামেলা তো ছিলই। তাই নিজে আর কালচিনি যেতে পারিনি। কিন্তু মেসোর সাথে বেশ কয়েকবার আলোচনা করে জানতে পারলুম যে তাদের বাড়ি তৈরীর গৃহারম্ভ করতে হচ্ছে সামনের মাসের ১৮ তারিখে। বাংলার পয়লা কার্তিক। দুর্গাপূজো পড়েছে ২১ তারিখে, আর লক্ষ্মীপূজো ২৯ তারিখে। আর ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখের পর পরের মাস তিনেকের মধ্যে গৃহপ্রবেশের আর কোনও দিন নেই। গৃহারম্ভের আগেই বাড়ির পুরোন জর্জর ঘরগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। তখন টেম্পোরারি একটা কাঁচা ঘর বানিয়ে তাতে মাসি মেসোদের থাকবার বন্দোবস্ত করতে হবে। তাই নতুন ঘর তৈরী সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আর তাতে গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত ও বাড়িতে কোনও বিয়ের আয়োজন করা মোটেই সম্ভব হবে না। কিন্তু অক্টোবরের ১৮ তারিখে গৃহারম্ভ হলে দু’মাসের মধ্যেই নতুন বাড়ি তৈরী করে ফেলা হয়ত সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে গৃহপ্রবেশ পিছিয়ে যাবে আরো তিন চার মাসের মত। তাই ভেবে দেখলুম যে কালচিনির বাড়িতেই যদি বিয়ের আয়োজন করি তাহলে সামনের বৈশাখের আগে সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু এতটা দেরী আমি ঠিক মানতে পারছিলুম না। তাই মাসি মেসোকে সেভাবে না জানিয়েই আমি প্রথমে আমার কাকু আর বড়মার সাথে ফোনে কথা বললুম। রাজগঞ্জের বাড়ির ওই দু’জনই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। তাদের দু’জনকেই অর্চুর বিয়ের কথা বলতেই তারাও খুব খুশী হলেন। অবশ্য বড়মা খুব অভিমান করে ছিলেন। কিন্তু আমি যখন জানতে চাইলুম যে রাজগঞ্জের বাড়িতে ওদের বিয়ের আয়োজন করা আদৌ সম্ভব কিনা, তখন বড়মা পরিস্কার ভাবে আমাকে জানিয়ে দিলেন যে এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমাকে বাড়ি যেতেই হবে। নিরূপায় হয়ে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে গত ষোল তারিখে আমি অর্চু আর নীতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজগঞ্জ গিয়েছিলুম। তবে তখন ওরা কেউই জানত না যে রাজগঞ্জ যাবার পেছনে আমার আসল উদ্দেশ্যটা কী। আমি ওদের বলেছিলুম যে বড়মা আমাদের তিনজনকে দেখবেন বলেই আমাকে এমন করে যেতে বলেছিলেন। আর কথাটা যে মিথ্যেও ছিল না সেটা আমি জানতুমই। গিয়ে দেখি সেটাই সত্যি। আমাদের বাড়ির লোকেরা যে তাদের বাড়ি থেকেই অর্চুর বিয়ে দেবেন এ সিদ্ধান্ত তারা আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু আমাকে জানতে দেননি। বড়মা আমার সাথে অর্চু আর নীতাকে দেখেই তৃপ্ত হয়েছিলেন। অর্চুর নিষ্পাপ মুখটা দেখে ও বাড়ির বড় ছোট সকলেই ওকে এক মূহুর্তে আপন করে নিয়েছিল। সে রাতেই তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন যে অর্চু তো তাদের বড়বৌমারই দিদি। তাই তাদের মেয়েই। তাদের এই মেয়েটির বিয়ের সবরকম আয়োজন করতে তারা খুশী মনে প্রস্তুত আছেন। পরের দিনও তারা আমাদের আসতে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু সেদিনই তোমাদের আলিপুরদুয়ার কোর্টে অর্চুর কেসের হিয়ারিং ছিল বলে আমরা আর থাকতে পারিনি। এভাবে নিজে নিজেই গোটা ব্যাপারটার একটা পরিকল্পনা করেছিলুম। অপেক্ষা করছিলুম শুধু পরির সম্মতির। রচুর নিজের দিদি বিধবা অর্চুকে পরি বিয়ে করতে চাইবে কিনা সেটা নিয়ে তখনও আমার মনে একটু সংশয় ছিলই। কারন আগে নিজের সম্মতি জানালেও পরি তো তখনও জানত না যে আমরা অর্চুর সাথেই ওর বিয়ে দিতে যাচ্ছি। কিন্তু পরি তখন একটা বিশেষ কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ওর সাথে কথা বলবার তেমন সুযোগই পাচ্ছিলুম না। অবশ্য ও আগে থেকেই ওর এমন ব্যস্ততার কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলুম পরির ব্যস্ততা কেটে গেলেই ওর সাথে বিয়ের দিনক্ষণ আর আয়োজনের ব্যাপার নিয়ে কথা বলব। তারপর সিদ্ধান্তটা কালচিনির মাসি মেসোকে জানাব। কিন্তু তার দু’দিন বাদেই ঊণিশ তারিখ সকালে পরি দুম করে এখানে এসে হাজির হল। কিন্তু তখনও যে ওর সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা কেন বলতে পারিনি, সে’কথা তো তোমাদের আগেই বলেছি। কুড়ি তারিখেই ও তোমাদের কাছে গিয়ে পৌঁছোতেই মনে হয়েছিল যে আমার চিন্তা ভাবনা আর এগিয়ে না নেওয়াই ভাল”।
এতগুলো কথা বলে সীমন্তিনী থামতে অর্চনা সীমন্তিনীর হাত ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “আমাকে নিয়ে তুমি এভাবে এতকিছু ভেবে এত সব করে গেছ দিদিভাই? আর কাউকে তার আঁচটুকুও পেতে দাও নি? আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি যে এত চিন্তা ভাবনা করে এতকিছু করে আসছিলে, তার কিছুই আমাকে জানতে দাও নি। আমি তো এ’সব কথা আজই প্রথম শুনছি। আমি তো এতদিন ভাবতুম যে তুমি আমাকে যেভাবে মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলে তার জন্য তোমার কাছে আমার সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এখন তো দেখছি, এক জনম তো দুরের কথা, সাত জনমেও তো এ ঋণ শোধ হবার নয় গো” বলতে বলতে সীমন্তিনীর কোলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল।
সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় আর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ছিঃ অমন কথা কেন বলছিস বোন? তুই আমার বোন না? বোনের জন্য দিদিরা আরও অনেক কিছু করে থাকে। তাই বলে বোনের সাথে দিদির কি কখনও কৃতজ্ঞতার সম্পর্ক হয় রে? এমন কথা আর কখনও বলবি না। এবার কান্না থামা। অনেক রাত হল। পিসিকে আর জাগিয়ে রেখে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। ওঠ, ওনাদের নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে আয়, মশারীটা ভাল করে গুঁজে দিস চারদিকে। আর তোরাও আর গল্প কথায় সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে পর”।
অর্চনা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে সীমন্তিনীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হৈমবতীদেবী বিছানা থেকে নেমে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সীমন্তিনীর মাথায় সস্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “বিধু আর বিভার মুখে শুনেছি ওরা তোমাকে ‘মা অন্নপূর্ণা, মা দুর্গা, মা জগদ্ধাত্রী’ বলে ভাবে। সে শোনা শুধু কানে শোনাই ছিল। উপলব্ধি করতে পারিনি এতদিন। ভাবতুম ওরা তোমাকে ভালোবাসে বলেই হয়ত অমন বলে। আজ বুঝতে পারলুম ওদের ওই সম্মোধনগুলো কতটা সঠিক। তুমি সত্যি সত্যিই মা অন্নপূর্ণা। আর এই মা অন্নপূর্ণার জন্যই আমরা অর্চুর মত এমন একটা লক্ষ্মী প্রতিমাকে কাছে পেলুম। তুমি বয়সে আমার চেয়ে নেহাতই ছোট। তবু অর্চুর ভাঙা চোরা শরীর মন আর আত্মাকে যেভাবে তুমি সারিয়ে তুলেছ, যেভাবে ও আজ মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলতে পারছে, যেভাবে ওর আর পরির ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে এত কিছু তুমি করেছ, তার জন্য তোমায় আজ সত্যি প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে আমার”।
এতগুলো কথা একসাথে বলে হৈমবতীদেবী থামতেই নিরঞ্জনবাবু বললেন, “এই হল আসল কথা। এমন সুন্দর করে সব কিছু তোমাদের গুছিয়ে বলতে পারতুম না আমি। এবার মন্তি মা, তুমি এবার আমায় বলো, তুমি আগে যেমন বললে, সেভাবে কি সত্যিই বিধু আর বিভাকে এ বিয়েতে রাজী করাতে পেরেছ? ওরা এ বিয়েতে সত্যি রাজী হয়েছে মা”?
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “একটু বোঝাতে হয়েছে তাদের অবশ্যই। প্রথম কথাতেই তারা রাজী হননি বটে। তবে হ্যাঁ পিসো, মাসি মেসোই শুধু নন, অর্চুর ভাইবোনেরাও সকলেই এ বিয়েতে রাজী আছে। আর বিয়েটা নিয়ে আমরা কিভাবে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম, তোমরা জানতে চাইলে সে’সবও আমি খুলে বলব তোমাদের। কিন্তু আমার মনে হয় এখন ডিনারটা সেরে নেওয়া উচিৎ। রাত দশটা তো পেরিয়ে গেল। খাবার পর তোমাদের পক্ষে যদি না ঘুমিয়ে সে’সব শোনা সম্ভব হয় তাহলে আজ রাতেই কথাগুলো বলব। কিন্তু আমার মনে হয় পিসির ওপর খুব চাপ পড়বে। সেটা একটু ভেবে দেখো। পিসি যদি চান তাহলে আমি সারা রাত জেগেও সে’সব কথা বলতে রাজী আছি। নইলে কাল সকালেই না হয় শুনো সে’সব।”
এবার সুলোচনা বললেন, “তুমি ঠিক বলেছ মন্তি। মা বাড়িতে রোজ রাত সাড়ে ন’টায় ডিনার করেন। তাই আমার মনে হয় এখন ডিনারটা সেরে নেওয়াই উচিৎ। বাকি আলোচনার ব্যাপারটা না হয় পরে ভেবে দেখা যাবে”।
অর্চনা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওমা, পিসির তো তাহলে অনিয়ম হয়ে গেল আজ। আমি দেখছি ওদিকে লক্ষ্মীদি একা একা ......”
তার কথার মাঝেই দড়জার কাছ থেকে লক্ষ্মী বলে উঠল, “দিদিমণি, খাবার তৈরী হয়ে গেছে। ওনাদের সবাইকে নিয়ে এসো”।
******************
পরিতোষের বৌদিরা মিলে অনেক রকমের খাবার বানিয়ে পাঠিয়েছিল। সঙ্গে চাটনি, দই ছানার পায়েস আর ভাত অব্দি বানিয়ে পাঠিয়েছিল। বাইরে থেকে শুধু মিষ্টির হাড়িটাই কিনে পাঠিয়েছিল। খাবার খেয়ে অর্চনা, নবনীতা, সীমন্তিনী এবং লক্ষ্মীও প্রচুর প্রশংসা করল রান্নার।
খেতে খেতেই হৈমবতীদেবী তার স্বামীকে বললেন, “শোনো না, বলছিলুম কি। খাবার পর তো আমি আধ ঘন্টা না ঘুমিয়েই থাকি। আজ আধ ঘন্টার বদলে এক ঘন্টা পর ঘুমোলে কি আর এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে বলো”?
নিরঞ্জনবাবু খেতে খেতেই বললেন, “তোমার মানসিক অবস্থাটা আমি বেশ ভালই বুঝতে পারছি হিমু। তোমার মনের অনেক কৌতূহল মিটে গেলেও এখনও অনেক কৌতুহলের নিবৃত্তি হয় নি জানি। অবশ্য এটা আমিও অস্বীকার করব না যে আমার মনেও আর কোন কৌতূহল বাকি নেই। বড়বৌমার মনেও যে আছে তাও জানি। কিন্তু আমার আর বড়বৌমার তো কোন অসুবিধে নেই। তোমার যদি মনে হয় আরও একটা ঘন্টা জেগে থাকলে তোমার কোন কষ্ট হবে না, তাহলে আমি তোমায় বাধা দেব না। কিন্তু দু’ আড়াই ঘন্টা জার্নি করে এসেছ, তারপর এতখানি সময় কত উদ্বেগ আর উত্তেজনায় কাটল। এখনও আরও এক ঘন্টা তুমি জেগে থাকবে? তোমার শরীরের কণ্ডিশন কেমন সেটা তুমি ভেবে দেখো”।
সুলোচনা বললেন, “হ্যাঁ মা, আগ্রহ কৌতূহল আছে বলেই শারীরিক অবস্থাটা তো ভুলে গেলে চলবে না। আমারও তো ইচ্ছে করছে আজ সারাটা রাত জেগে মন্তি, অর্চু আর নীতার সাথে কথা বলে যাই। বিশেষ করে মন্তি বিধুমামুকে আর মামীকে কিভাবে রাজী করিয়েছিল সেটা না শোনা অব্দি মনটা পুরোপুরি শান্ত হবে না। কিন্তু শুধু আমার চাওয়াটাকেই বড় করে দেখলে তো চলবে না। আমরা যেমন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় এতক্ষণ কাটিয়েছি, অর্চু আর মন্তিও তো একই সমান উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছে। ওরাও তো ক্লান্ত হতে পারে। মন্তি সারাটা দিন অফিস করেছে। আবার কাল সকাল ন’টার দিকেই হয়ত আবার বেরিয়ে যাবে। আলোচনার তো এখনও অনেক কিছুই বাকি আছে। কিন্তু তবু বলছি, আজ রাতে শুধু নিজেদের কৌতূহল মেটাব বলে ওদের সবাইকে আর কষ্ট দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না”।
এবার নবনীতা বলল, “আমি তো আজ সারা রাত জেগে কাটাতেও রাজী আছি। কাল রবিবার। আমার ডিউটিতে যেতে হবে না। আর কতদিন পর আমার জীবনে এমন একটা খুশীর দিন এসেছে”।
সীমন্তিনী সকলের কথা শুনে বলল, “পিসো, বড়বৌদি কিন্তু ঠিক কথাই বলেছেন। সত্যি বলতে এখন অব্দি শুধু পাত্র-পাত্রী পছন্দই হল। বিয়ের আলোচনা তো এখনও সেভাবে শুরুই হয় নি। অনেক কিছুই আছে আলোচনা করবার। অবশ্য এটাও ঠিক যে সব আলোচনাই তো আজ রাতেই আর শেষ করে ফেলা সম্ভব নয়। তবু পিসির যদি শরীর ঠিক থাকে তাহলে আরও একটা ঘন্টা আমরা কথা বলতে পারি। আমি তোমাদের মনের বাকি কৌতুহলটুকুর কিছুটা নিবৃত্তি করবার চেষ্টা করতে পারি”।
নিরঞ্জনবাবু তাতে সম্মতি দিলে সীমন্তিনী নবনীতা আর অর্চনাকে বলল, “নীতা, অর্চু, তোরা তাহলে একটা কাজ কর। তোদের খাওয়া শেষ হলে চটপট উঠে পড়িস। গেস্টরুমের বিছানাটা ঠিকঠাক করে মশারীটা টাঙিয়ে, তোদের ঘরের বিছানাও তৈরী করে ফেলিস। খাবার পর আমার ঘরেই সকলে মিলে বিছানার ওপর বসেই কথা বলব। আলোচনা শেষ হলে আমার বিছানাটা না হয় পরে আমিই পেতে দেব বড়বৌদির জন্য। গল্পে বসবার আগেই তোরা চটপট অন্যান্য বিছানাগুলো রেডি করে ফেলিস”।
খাবার পর নিরঞ্জনবাবুরা সকলে সীমন্তিনীর ঘরে এসে বিছানার ওপর বসলেন। সীমন্তিনী ঘরে এসেই নিজের মোবাইল থেকে রচনার মোবাইলে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাল “দুশ্চিন্তা করিস না সোনা। আজ আর তোর সাথে কথা বলতে পাচ্ছি না। এখানে সব ঠিক আছে। কাল সকালে হয়ত আমি ব্যস্ত থাকব। তুই আমাদের ফোন না পেলে, সকাল দশটা নাগাদ নীতা বা অর্চুকে ফোন করিস। সু-খবর পাবি। গুড নাইট”।
মিনিট দশেক বাদেই নবনীতা আর অর্চনা সীমন্তিনীর ঘরে চলে আসবার পর সময় নষ্ট না করে সীমন্তিনী বলল, “পিসি, শোনো এবার। তোমরা যে ভেবেছিলে মাসি মেসোরা তাদের বিধবা মেয়ের দ্বিতীয় বিবাহ দিতে চাইবেন না কিছুতেই, সে ধারণা একদম সঠিক ছিল। আমিও আগে থেকেই জানতুম, তারা এমন আপত্তি তুলবেনই। কিন্তু সেটা নিয়ে আমি অতটা চিন্তিত ছিলুম না কোনদিনই। আমি চিন্তিত ছিলুম শুধু অর্চুকে নিয়ে আর পরিকে নিয়ে। আমি যেদিন অর্চুকে কালচিনির হাসপাতালে প্রথম দেখেছিলুম সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম এমন নিষ্পাপ আর এমন ফুলের কুঁড়ির মত ফুটফুটে একটা মেয়ের জীবন আমি এভাবে কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। কিন্তু পরে মনে হল, আমি একা চাইলেই সেটা সম্ভব হবে না। অর্চু নিজে সেটা চায় কি না, সেটাই আগে বুঝতে হবে। আর ওর মত কোমল মনের একটা মেয়ে অমন বিভীষিকাময় সাতটা বছর কাটিয়ে শারীরিক ও মানসিক ভাবে যেভাবে ক্ষত বিক্ষত আর বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল, তার পক্ষে চট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই ভেবেছিলুম আগে ওকে সকারাত্মক চিন্তা ভাবনা করবার জন্যে তৈরী করতে হবে। ওকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলবার পাশাপাশি খুব কাছে থেকে ওকে কিছুটা গ্রুমিং করতে হবে। তাই হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর ওর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে আমি ডক্টর সোমের সাথে পরামর্শ করেই ওকে আমার এখানে নিয়ে আসি। ডক্টর সোম সত্যি খুব ভাল একজন ডাক্তার, আবার তার পাশাপাশি খুব ভাল মনের একজন মানুষও। তার সঠিক উপদেশেই অর্চু এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে ওকে আমার এখানে আনবার আসল উদ্দেশ্যটা আজ অব্দি কেউ জানে না। এমন কি ডক্টর সোমও জানতেন না। আজ প্রথম তোমাদের সকলের কাছে আমি সেটা প্রকাশ করছি। আমার মনে হয়েছিল ওকে আমার এখানে নিয়ে এলে আমি নীতা আর লক্ষ্মীদি, তিনজনে মিলে খুব তাড়াতাড়ি ওকে শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারব। মৌখিকভাবে এটাই সকলকে বলেছিলুম। আর সেটা হয়েছেও। লক্ষ্মীদি, নীতা আর আমার সাহচর্যে থাকতে থাকতে ঠাকুরের আশীর্বাদে ও দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই অনেক চনমনে হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার গোপন ইচ্ছেটা ছিল ওর অতীতের সব কথা ওর স্মৃতি থেকে মুছে দিতে না পারলেও ওকে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শেখানো। আর সেটা যখন ও করতে শুরু করবে তখন ওকে বোঝাবো যে ওর আরেকটা ভাল ছেলের সাথে বিয়ে করা উচিৎ। আমি মনে মনে ওকে আর পরিকে নিয়ে তো আগে থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলুম। কিন্তু সে’কথাটা তখন অব্দি নিজের মনে মনেই রেখেছিলুম। কিন্তু ভাল তো ওকে আরও অনেক আগে থেকেই বাসতুম আমি। ওকে দেখবার আগে থেকেই, যেদিন থেকে রচু, আর মাসি মেসোদের সাথে আমার হৃদ্যতা হয়েছিল সেদিন থেকেই ওকে আমি ভালবাসি। কিন্তু ওকে আমার এখানে নিয়ে আসবার খুব অল্পদিনের মধ্যেই ওকে ভালভাবে কাছ থেকে দেখে নবনীতা আর লক্ষ্মীদিও ওকে ভালবেসে ফেলল। তারপর আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় অর্চু আবার বিয়ে করতে রাজী হল। সেটা খুব সম্ভবতঃ এ মাসেরই পাঁচ বা ছ’ তারিখের কথা। তার পরেই প্রথমে আমি রচুর সাথে আলোচনা করি। রচু আমার সঙ্গে একমত হতেই দু’ তিনদিন বাদেই আমি কালচিনি গিয়ে অনেকভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাসি মেসোকে রাজী করাই। ভাই তো প্রথম থেকেই আমাকে সাপোর্ট করেছিল”।
এতটা বলে একটু দম নিয়ে আবার বলল, “প্রায় দু’মাসের চেষ্টায় অর্চুকে আর ওদের পরিবারের বাকি সকলকে রাজি করাবার পর আমি পরির সাথে ওর বিয়ে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলুম। সবদিক দিয়ে ভেবে মনে হল অর্চু বিধবা বলে পরির মনে কোনরকম দ্বিধা না থাকলে ওরা একে অপরের যোগ্যই হবে। পরি একটা সময় নীতাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। সাত বছর পর নীতাকে ফিরে পেয়ে নীতার সব কথা শুনেও ও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু নীতা আমার আর রচুর সামনেই পরির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল। আর আমি ঠিক ওই দিনটা থেকেই অর্চু আর পরিতোষের দু’জনের বিয়ে দেবার কথা মনে মনে ভাবছিলুম। কিন্তু নীতাও যে মনে মনে পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দেবার কথা ভাবছিল, সেটা আমিও বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি পরির কাছে অর্চুর জন্য প্রস্তাব দেবার আগে আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাইছিলাম যে নীতা এখন নিজের মন পরিবর্তন করে আবার পরিকে বিয়ে করতে চায় কি না। কিন্তু বাড়িতে অর্চুর সামনে নীতার সাথে ওই বিষয়ে কথা বলা সম্ভব ছিল না। তাই একদিন রাতে বাড়ির বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে বসে ওর সাথে কথা বলি। ও সেদিনও পরিস্কার ভাবে একই কথা বলে যে পরিকে ও বিয়ে করবে না। সেই সাথে এ’কথাও বলে যে ও চায় পরি অর্চুকে বিয়ে করুক”।
এমন সময় নবনীতা আদুরে গলায় বলে উঠল, “ও দিদি, ওই দিনের কথাটা আমাকে বলতে দাও না প্লীজ”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আচ্ছা বেশ, বল”।
নবনীতা সাথে সাথে বলল, “বৌদি, সেদিন যা একটা কাণ্ড হয়েছিল না কী বলব তোমাদের। তখন আমরা একটা রেস্টুরেন্টে। দিদি তখন বলছিল যে পরির জন্যে সে একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। আমি তার কথা শুনে মন খারাপ করে বলেছিলাম যে আমিও পরির জন্য মনে মনে একটা মেয়েকে পছন্দ করেছি। দিদির মুখে তখন একটা এগরোলের গ্রাস। তখন দিদি প্রথমে আমার পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি অর্চুর নাম বলতেই সে এমন বিষম খেয়েছিল যে রেস্টুরেন্টের সমস্ত লোক দৌড়ে আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল। বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে দিদির প্রায় দম বন্ধ হবার জো হয়েছিল। আর অমন মূহুর্তেই অর্চু দিদির ফোনে তখন ফোন করেছিল। দিদির তো তখন কাশতে কাশতে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমিই ফোনটা ধরে অর্চুর সাথে কথা বললাম। আর দিদিভাই নিজেকে সামলে নেবার পর যখন বলল যে সেও পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দিতে চায়, সে’কথা শুনে তখন আমার বিষম খাবার উপক্রম হয়েছিল। আমি তো আনন্দে নাচতে শুরু করে দিয়েছিলাম। তখনই সবাইকে কথাটা জানাতেই চাইছিলাম। কিন্তু দিদিই তখন আমাকে বোঝাল যে তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে সব বানচাল হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের ভাল করে ভেবে চিন্তে সকলের মনের ইচ্ছেটা জানতে হবে। তারপরই পরির কাছে আর অর্চুর কাছে সব কিছু খুলে বলতে হবে। তারপর দিদি প্রথমে অর্চুকে আমার আর পরিতোষের মধ্যে আগে কেমন সম্পর্ক ছিল সেটা জানায়। পরি যে দিদিকেও একসময় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সেটাও ওকে জানালাম। তারপর ঠাট্টার ছলে আমরা অর্চুর সামনেই ওদের দু’জনের বিয়ের কথা ওঠাতে শুরু করলাম। আমাদের কথায় ও লজ্জা পেত। আমাদের থামতে বলত। কিন্তু আমরা প্রায় রোজই পরিকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। আর ওদিকে রচনা বৌদির সাথেও পরির পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। রচনা বৌদিও পরিকে নিজের দাদার মত শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল। আর অর্চুর সাথে কথা বলবার সময় রচনা বৌদিও পরির খুব প্রশংসা করত। সে তারিখটা আমি বোধহয় কোনদিন ভুলব না। এ মাসেরই তেরো তারিখ। সেদিন আমি আর দিদি মিলে ওকে এমনভাবে চেপে ধরেছিলাম যে আমাদের কথায় সেদিন ও পরিকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল। মাসি মেসোকে দিদি তার আগেই পরি আর ওর বিয়ের ব্যাপারে রাজী করিয়েছিল। অবশ্য সে’কথাটা কালচিনির বাড়ির সবাই, এখানে আমরা আর কলকাতার রতুদা আর রচনাবৌদি জানলেও, দিদি সকলকেই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল যে অর্চু বা পরিকে এ’সব কথা কেউ যেন না জানায়। আর দিদির কথা তো কেউই ফেলতে পারে না। দিদির বাপের বাড়ির লোকজনদের সাথে তার যে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, সে বাড়ির কেউও দিদির কোন কথা অমান্য করেন না। তা সে যাই হোক, ততদিনে অর্চুর নাম উল্লেখ না করেই দিদি পরিকে জানায় যে আমরা পরির জন্য এমন এমন একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। অর্চুর অতীতের বিয়ের ব্যাপারে আর ওর রূপগুণ স্বভাব চরিত্রের কথা সবকিছু জানিয়ে দিদি পরির মতামত জানতে চেয়েছিল। পরি ঠিক আগের মতই দিদিকে বলেছিল যে ও’সব ব্যাপারে দেখবার বা ভাববার দায়িত্ব তার নয়, সে দায়িত্ব আমাদের দু’জনের। আমাদের পছন্দ হলে ওর কোনও আপত্তি নেই”।
এতখানি বলে নবনীতা সীমন্তিনীকে বলল, “এর পরের ঘটণাগুলো সবটা আমিও পুরোপুরি জানিনা দিদি। তাই পরের টুকু এবার তুমিই বলো”।
সীমন্তিনী তখন বলল, “পরের সময়টুকু আমাদের যত উদ্বেগ চিন্তা দুর্ভাবনা আর বিস্ময়ের সাথে কেটেছে তাতে সব কথা তোকে বলবার সুযোগও পাইনি রে নীতা। তবে পিসি, আমরা যে অর্চুর সাথে পরির বিয়ে দেবার কথা ভাবছিলুম এটা না জেনেও পরি যখন বিয়েতে রাজী হল তখন আমি বিয়ের আয়োজন নিয়ে ভাবতে শুরু করলুম। কিন্তু একই সাথে কালচিনির মেসোদের বাড়ি তৈরী, ভাইয়ের পরীক্ষা, কলকাতায় আমার পরিচিত আরেকজনের একটা মার্কেট কমপ্লেক্স বানাবার ব্যাপার নিয়ে আমাকে খুব চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছিল। তার ওপর অফিসের ঝামেলা তো ছিলই। তাই নিজে আর কালচিনি যেতে পারিনি। কিন্তু মেসোর সাথে বেশ কয়েকবার আলোচনা করে জানতে পারলুম যে তাদের বাড়ি তৈরীর গৃহারম্ভ করতে হচ্ছে সামনের মাসের ১৮ তারিখে। বাংলার পয়লা কার্তিক। দুর্গাপূজো পড়েছে ২১ তারিখে, আর লক্ষ্মীপূজো ২৯ তারিখে। আর ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখের পর পরের মাস তিনেকের মধ্যে গৃহপ্রবেশের আর কোনও দিন নেই। গৃহারম্ভের আগেই বাড়ির পুরোন জর্জর ঘরগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। তখন টেম্পোরারি একটা কাঁচা ঘর বানিয়ে তাতে মাসি মেসোদের থাকবার বন্দোবস্ত করতে হবে। তাই নতুন ঘর তৈরী সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আর তাতে গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত ও বাড়িতে কোনও বিয়ের আয়োজন করা মোটেই সম্ভব হবে না। কিন্তু অক্টোবরের ১৮ তারিখে গৃহারম্ভ হলে দু’মাসের মধ্যেই নতুন বাড়ি তৈরী করে ফেলা হয়ত সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে গৃহপ্রবেশ পিছিয়ে যাবে আরো তিন চার মাসের মত। তাই ভেবে দেখলুম যে কালচিনির বাড়িতেই যদি বিয়ের আয়োজন করি তাহলে সামনের বৈশাখের আগে সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু এতটা দেরী আমি ঠিক মানতে পারছিলুম না। তাই মাসি মেসোকে সেভাবে না জানিয়েই আমি প্রথমে আমার কাকু আর বড়মার সাথে ফোনে কথা বললুম। রাজগঞ্জের বাড়ির ওই দু’জনই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। তাদের দু’জনকেই অর্চুর বিয়ের কথা বলতেই তারাও খুব খুশী হলেন। অবশ্য বড়মা খুব অভিমান করে ছিলেন। কিন্তু আমি যখন জানতে চাইলুম যে রাজগঞ্জের বাড়িতে ওদের বিয়ের আয়োজন করা আদৌ সম্ভব কিনা, তখন বড়মা পরিস্কার ভাবে আমাকে জানিয়ে দিলেন যে এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমাকে বাড়ি যেতেই হবে। নিরূপায় হয়ে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে গত ষোল তারিখে আমি অর্চু আর নীতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজগঞ্জ গিয়েছিলুম। তবে তখন ওরা কেউই জানত না যে রাজগঞ্জ যাবার পেছনে আমার আসল উদ্দেশ্যটা কী। আমি ওদের বলেছিলুম যে বড়মা আমাদের তিনজনকে দেখবেন বলেই আমাকে এমন করে যেতে বলেছিলেন। আর কথাটা যে মিথ্যেও ছিল না সেটা আমি জানতুমই। গিয়ে দেখি সেটাই সত্যি। আমাদের বাড়ির লোকেরা যে তাদের বাড়ি থেকেই অর্চুর বিয়ে দেবেন এ সিদ্ধান্ত তারা আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু আমাকে জানতে দেননি। বড়মা আমার সাথে অর্চু আর নীতাকে দেখেই তৃপ্ত হয়েছিলেন। অর্চুর নিষ্পাপ মুখটা দেখে ও বাড়ির বড় ছোট সকলেই ওকে এক মূহুর্তে আপন করে নিয়েছিল। সে রাতেই তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন যে অর্চু তো তাদের বড়বৌমারই দিদি। তাই তাদের মেয়েই। তাদের এই মেয়েটির বিয়ের সবরকম আয়োজন করতে তারা খুশী মনে প্রস্তুত আছেন। পরের দিনও তারা আমাদের আসতে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু সেদিনই তোমাদের আলিপুরদুয়ার কোর্টে অর্চুর কেসের হিয়ারিং ছিল বলে আমরা আর থাকতে পারিনি। এভাবে নিজে নিজেই গোটা ব্যাপারটার একটা পরিকল্পনা করেছিলুম। অপেক্ষা করছিলুম শুধু পরির সম্মতির। রচুর নিজের দিদি বিধবা অর্চুকে পরি বিয়ে করতে চাইবে কিনা সেটা নিয়ে তখনও আমার মনে একটু সংশয় ছিলই। কারন আগে নিজের সম্মতি জানালেও পরি তো তখনও জানত না যে আমরা অর্চুর সাথেই ওর বিয়ে দিতে যাচ্ছি। কিন্তু পরি তখন একটা বিশেষ কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ওর সাথে কথা বলবার তেমন সুযোগই পাচ্ছিলুম না। অবশ্য ও আগে থেকেই ওর এমন ব্যস্ততার কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলুম পরির ব্যস্ততা কেটে গেলেই ওর সাথে বিয়ের দিনক্ষণ আর আয়োজনের ব্যাপার নিয়ে কথা বলব। তারপর সিদ্ধান্তটা কালচিনির মাসি মেসোকে জানাব। কিন্তু তার দু’দিন বাদেই ঊণিশ তারিখ সকালে পরি দুম করে এখানে এসে হাজির হল। কিন্তু তখনও যে ওর সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা কেন বলতে পারিনি, সে’কথা তো তোমাদের আগেই বলেছি। কুড়ি তারিখেই ও তোমাদের কাছে গিয়ে পৌঁছোতেই মনে হয়েছিল যে আমার চিন্তা ভাবনা আর এগিয়ে না নেওয়াই ভাল”।
এতগুলো কথা বলে সীমন্তিনী থামতে অর্চনা সীমন্তিনীর হাত ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “আমাকে নিয়ে তুমি এভাবে এতকিছু ভেবে এত সব করে গেছ দিদিভাই? আর কাউকে তার আঁচটুকুও পেতে দাও নি? আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি যে এত চিন্তা ভাবনা করে এতকিছু করে আসছিলে, তার কিছুই আমাকে জানতে দাও নি। আমি তো এ’সব কথা আজই প্রথম শুনছি। আমি তো এতদিন ভাবতুম যে তুমি আমাকে যেভাবে মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলে তার জন্য তোমার কাছে আমার সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এখন তো দেখছি, এক জনম তো দুরের কথা, সাত জনমেও তো এ ঋণ শোধ হবার নয় গো” বলতে বলতে সীমন্তিনীর কোলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল।
সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় আর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ছিঃ অমন কথা কেন বলছিস বোন? তুই আমার বোন না? বোনের জন্য দিদিরা আরও অনেক কিছু করে থাকে। তাই বলে বোনের সাথে দিদির কি কখনও কৃতজ্ঞতার সম্পর্ক হয় রে? এমন কথা আর কখনও বলবি না। এবার কান্না থামা। অনেক রাত হল। পিসিকে আর জাগিয়ে রেখে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। ওঠ, ওনাদের নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে আয়, মশারীটা ভাল করে গুঁজে দিস চারদিকে। আর তোরাও আর গল্প কথায় সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে পর”।
অর্চনা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে সীমন্তিনীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হৈমবতীদেবী বিছানা থেকে নেমে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সীমন্তিনীর মাথায় সস্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “বিধু আর বিভার মুখে শুনেছি ওরা তোমাকে ‘মা অন্নপূর্ণা, মা দুর্গা, মা জগদ্ধাত্রী’ বলে ভাবে। সে শোনা শুধু কানে শোনাই ছিল। উপলব্ধি করতে পারিনি এতদিন। ভাবতুম ওরা তোমাকে ভালোবাসে বলেই হয়ত অমন বলে। আজ বুঝতে পারলুম ওদের ওই সম্মোধনগুলো কতটা সঠিক। তুমি সত্যি সত্যিই মা অন্নপূর্ণা। আর এই মা অন্নপূর্ণার জন্যই আমরা অর্চুর মত এমন একটা লক্ষ্মী প্রতিমাকে কাছে পেলুম। তুমি বয়সে আমার চেয়ে নেহাতই ছোট। তবু অর্চুর ভাঙা চোরা শরীর মন আর আত্মাকে যেভাবে তুমি সারিয়ে তুলেছ, যেভাবে ও আজ মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলতে পারছে, যেভাবে ওর আর পরির ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে এত কিছু তুমি করেছ, তার জন্য তোমায় আজ সত্যি প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে আমার”।
(To be cont'd .......)
______________________________