30-03-2020, 11:13 AM
(Update No. 245)
এমন সময় লক্ষ্মীকে সাথে করে হাতে শাঁখ নিয়ে নবনীতা ঘরে ঢুকে শাঁখে ফুঁ দিল। আর লক্ষ্মী উলু দিতে শুরু করল। তিনবার শঙ্খধ্বনি আর উলু দেবার পর লক্ষ্মী মিষ্টির থালা হাতে করে প্রথমে নিরঞ্জনবাবুর দিকে এগিয়ে গেল। নিচু হয়ে তাকে প্রণাম করে বলল, “পিসেমশাই, আপনারা যে আমাদের অভাগী বোনটাকে আপনাদের পায়ে ঠাঁই দিলেন, এতে আমরা সবাই খুব খুশী হয়েছি। নিন, একটু মিষ্টিমুখ করুন সকলে মিলে”।
অর্চনা আবার সীমন্তিনীর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে হৈমবতীদেবীকে বলল, “পিসি, তুমি পরিকে খবরটা জানিয়ে দাও। বেচারা বিকেল থেকে খুব টেনশনে আছে। আমাকে বারবার করে বলেছে যে তোমরা এখানে কী উদ্দেশ্যে এসেছ সেটা জানতে পারলেই যেন আমরা ওকে ফোন করি। তবে আমার মনে হয়, আমি বা নীতার বদলে তুমি নিজেই যদি কথাটা ওকে বলো, তাহলে ও বেশী খুশী হবে” বলে নিজের মোবাইল থেকেই পরির নাম্বার ডায়াল করে ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিল।
হৈমবতীদেবী ফোন কানে লাগাতেই ও’দিক থেকে পরিতোষ ব্যগ্র কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ মন্তি বলো। ওদিকের কী খবর”?
হৈমবতীদেবী বললেন, “মন্তি নয়। আমি বলছি রে, তোর পিসি”?
পরিতোষ একটু হতাশ হয়ে থতমত খেয়ে বলল, ‘ও পিসি, তুমি? হ্যাঁ বলো”।
হৈমবতীদেবী বললেন, “আমরা তোর বিয়ে ঠিক করে ফেললুম রে বাবা। তুই আবার বেঁকে বসবি না তো”?
পরিতোষ মনে মনে ভাবল, তার মনের ভেতরের ভয়টাই তাহলে সত্যি হল! এখন সে সীমন্তিনী আর নবনীতাকে কী জবাব দেবে! সে কোন মুখে ওদের মুখোমুখি হবে এরপর। পরিতোষকে চুপ করে থাকতে দেখে হৈমবতীদেবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে, কি হল? কোন জবাব দিচ্ছিস না যে? আমাদের পছন্দ করা মেয়েকে তুই বিয়ে করবি না”? বলে তার পাশে বসা সুলোচনাকে ঈশারায় ফোনের স্পীকার অন করে দিতে বললেন। সুলোচনাও মজা পেয়ে ফোনের স্পীকার অন করে দিলেন।
সবাই শুনল পরিতোষ ভাঙা ভাঙা গলায় বলছে, “কি বলব পিসি। এতটা বছর থেকে নিজেকে তো অনাথই ভেবে এসেছি আমি। নাগরাকাটা যাবার পর কোন ভাগ্যে অর্চনার মুখে ওর বাবার নামটা শুনেই আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠেছিল। সেই সূত্র ধরেই প্রথমে বিধুকাকু আর পরে তোমাকে খুঁজে পেলাম। তুমিই তো এখন আমার সব। তোমার কথার অন্যথা করা কি আর আমার পক্ষে সম্ভব। তুমি নিশ্চয়ই আমার ভালোর কথা ভেবেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কিন্তু পিসি, আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমি নীতা আর মন্তিকে কথা দিয়েছিলাম যে ওদের পছন্দ করা পাত্রীকেই আমি বিয়ে করব। যতদুর জানি, তোমার সাথে আমার দেখা হবার আগেই ওরা একটা পাত্রী পছন্দও করেছিল আমার জন্যে। ওখানে যাবার দিন পনের আগে থেকে আমি কাজে অসম্ভব ব্যস্ত ছিলাম বলে ওদের সাথে নিয়মিত ভাবে ফোনে যোগাযোগও করতে পারিনি। তাই ব্যাপারটা আর এগোয় নি। নইলে এতদিনে হয়ত ওরা বিয়েটা পাকা করে ফেলত। এখন আমি ওদের কী বলব, সেটাই ভাবছি”।
হৈমবতীদেবী সীমন্তিনী আর নবনীতার দিকে দেখতে দেখতে বললেন, “আরে ওরা তো কেউ আর অবুঝ বা অবিবেচক নয়। সত্যি কথাটাই ওদের কাছে খুলে বলবি। ওদের দুটিকেই তো আমার বেশ ভাল লেগেছে। খুব ভাল মেয়ে ওরা। আর আমরা এখানে এসেছিলুম ওদের দু’জনের কাউকে বলে কয়ে তোকে বিয়ে করতে রাজী করাবো বলে। কিন্তু ওরা দু’জনেই আমাদের বিমুখ করল। তাই তো আমাদের বাড়ির সকলে মিলে যে মেয়েটাকে তোর জন্যে পছন্দ করেছিলুম তার সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করলুম। আর তুই তো বলেছিলি যে মন্তি আর নীতা রাজী না হলে তুই বিয়ে করবি না। এখন মন্তি আর নীতা দু’জনেই আমাদের পছন্দ করা মেয়েটিকে পছন্দ করেছে। তাই আমরা আর সময় নষ্ট না করে ..........”
তার কথার মাঝেই বাধা দিয়ে পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “ওরা তোমাদের পছন্দ করা মেয়েটার সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারে রাজী আছে? সত্যি বলছ তুমি পিসি”?
হৈমবতীদেবী একটু অবাক হবার ভাণ করে বললেন, “ওমা, তোকে আমি মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন? আচ্ছা এই নে, আমি নীতাকে ফোন দিচ্ছি। তুই ওর সাথে কথা বল” বলে ফোনটা নবনীতার দিকে এগিয়ে দিলেন।
হৈমবতীদেবীর হাতে ধরা ফোনের কাছে মুখ এনে নবনীতা বলল, “হ্যাঁ পরি। পিসি একদম সত্যি কথাই বলছেন। পিসিরা যে মেয়েটিকে পছন্দ করেছেন তাকে আমার আর দিদির দু’জনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদেরও মনে হচ্ছে মেয়েটা তোমার উপযুক্ত। তবে একদিক দিয়ে বিচার করলে বলা যায় তোমার ভাগ্যটাই অমন। নইলে কি আর এমন হত”?
পরিতোষ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “এমন হত মানে? কী হত? একটু খুলে বলছ না কেন তুমি”?
নবনীতার মুখে চোখে কৌতুক ভরা দুষ্টুমির ভাব থাকলেও স্বাভাবিক গলায় বলল, “না তেমন কিছু না। আসলে আমরা তোমার জন্য যে মেয়েটা পছন্দ করেছিলাম সেই গরীব ঘরের মেয়েটা তো লেখাপড়ায় মাত্র মাধ্যমিক পাশ ছিল। তার আগে একটা বিয়েও হয়েছিল। পাঁচ বছর স্বামীর সাথে ঘরও করেছিল। ওর স্বামী বছর দুয়েক আগে মারা গেছে। অন্যান্য আর সব দিক থেকে ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু পিসি যখন তোমার জন্যে নিজেই একটা ভাল মেয়ে পছন্দ করেছেন, তখন ওই মেয়ের ব্যাপারে তো আর কোন কথাবার্তা বলছি না আমরা। কিন্তু পিসিরা সকলে মিলে তোমার জন্য যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছেন, তার ব্যাপারেও আমরা আজ তাদের মুখ থেকে সবটা শুনলাম। দেখলাম যে এ মেয়েটাও তোমার উপযুক্তই হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখো পরি। এ মেয়েটাও বিধবা। তাই তো বলছি যে তোমার ভাগ্যটাই বুঝি অমন। তোমার কপালে বিধাতা বিধবা মেয়ে বিয়ে করবার কথাই লিখে দিয়েছেন বোধহয়”।
পরিতোষ সাথে সাথে বলল, “আরে মেয়েটা বিধবা না সধবা এ’সব কথা ছাড়ো তো। তুমি বা মন্তি কি সেই মেয়েটাকে দেখেছ? আচ্ছা মন্তি কোথায়? কলটা তো ওরই ফোন থেকে এসেছে। সে কোথায়? আমি মন্তির সাথে কথা বলতে চাই। ফোনটা ওকে দাও দেখি”।
নবনীতা আরও মজা পেয়ে বলল, “দিদি তো এখানেই আছে। আমার পাশেই আছে। এখানে ফোনের স্পীকার অন করা আছে। আর এ’ঘরে দিদি, অর্চু, পিসি, পিসো, বৌদি আমরা সকলেই আছি। এমন কি লক্ষ্মীদি পর্যন্ত আছে। আমরা সকলেই তোমার কথা শুনছি তো। তুমি দিদিকে কি জিজ্ঞেস করতে চাও, করো না”।
সীমন্তিনীও খানিকটা ফোনের কাছাকাছি এসে বলল, “হ্যাঁ পরি, নীতা ঠিক বলছে। আমরা সবাই এখন গেস্টরুমে আছি। সকলেই তোমার কথা শুনছেন। এবার বলো দেখি, আমাকে কী বলতে চাইছ”?
পরিতোষ এবার বেশ কয়েক মূহুর্ত চুপ করে রইল। অর্চনা ছাড়া গেস্টরুমের সকলের মুখেই কৌতুকের ছোঁয়া তখন। কিছুক্ষণ পর পরি জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মন্তি, তোমার কি মনে হয়? আমি কি মেয়েটাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় তোমার”?
সীমন্তিনী ঠোঁট টিপে হেসে ছোট্ট করে জবাব দিল, “হ্যাঁ”।
অর্চনা লজ্জায় মাথা নুইয়ে আছে। একবার সে ঘর থেকে চলেও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সুলোচনা ওর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন বলে সে আর বেরিয়ে যেতে পারেনি। ও’পাশ থেকে অনেকক্ষণ পরিতোষের সাড়া না পেয়ে এবার সুলোচনা একটু উঁচু গলায় বললেন, “কি হল ভাইদা? চুপ করে আছ যে বড়? কিছু বলবে না”?
এবার পরিতোষ অনেকটা সহজ গলায় জবাব দিল, “বড়বৌদি, আর কিচ্ছু বলার নেই আমার। তোমরা যা ভাল বোঝ, তাই করো। তবে এ’সময় ফোনটা করেছ বলে তোমাদের সব্বাইকে আমার মন থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দুপুর বেলা থেকেই ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল একটা ধর্ম সঙ্কটে পড়েছি। কোন একটা সমাধানও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভেবেছিলাম আজ রাতে বোধহয় ঘুমোতেও পারব না। এবার সে চিন্তাটা দুর হল। তোমাদের সাথে পরে আবার কথা হবে। এখন রাখছি” বলেই ফোন কেটে দিল।
পরিতোষ এভাবে ফোন কেটে দিতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “ওমা! ফোনটা কেটে দিল? অনেক কথা তো আমার বলার ছিল আরও”।
সীমন্তিনী ফোনটা ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল, “পিসি, পরি সবটাই বুঝে গেছে। ওকে আর কিচ্ছু না বললেও চলবে। ভুলে যেও না তোমার ভাইপো একজন সিনিয়র আইপিএস অফিসার। অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান ও। গোটা বাংলার সমস্ত পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা ওর বুদ্ধির তারিফ করে। চাক্ষুস যারা ওকে দেখেনি তারাও পরিতোষ সান্যাল নামটার সাথে পরিচিত। আমি ওর মনের ভেতরের কথাও বুঝতে পারি। তাই আমি বলছি, ও এ বিয়েতে রাজী আছে। এবার তোমরা নিশ্চিন্তে ওদের বিয়ের আয়োজন করতে পারো”।
এবার হৈমবতীদেবী বা আর কেউ কিছু বলবার আগেই লক্ষ্মী বলে উঠল, “আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা আমি তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না গো দিদিমণি। ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে আমার” বলতে বলতে অর্চনার কপালে একটু চুমু খেয়ে বলল, “দিদিমণি যেদিন সোনাদিকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল, সেই দিনটি থেকে রোজ ভগবানের কাছে তার জন্যে প্রার্থনা করতুম আমি। গরীব মুখ্যুসুখ্যু মানুষ আমি। আমার তো আর সামর্থ্য ছিল না তার জন্যে কিছু করবার। সোনাদি এখানে আসবার পর তাকে দেখবার পর থেকে আমার মনটা আবার কেঁদে উঠেছিল। উচিৎ অনুচিত না ভেবে মনে মনে ভগবানকে কোষতুম। এমন সুন্দর মিষ্টি ফুলের মত মেয়েটার কপালে তিনি এত কষ্ট লিখে দিয়েছিলেন বলে। আজ ভগবানের কাছে আমি ক্ষমা চাইব” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।
সীমন্তিনী লক্ষ্মীর একটা হাত ধরে তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, “তোমার প্রার্থনার জোরেই হয়ত এমনটা হল লক্ষ্মীদি। নইলে পিসিরাও যে পরির জন্য অর্চুকেই পছন্দ করবেন এ কি আমরা কেউ ভাবতেও পারতুম? এবার কান্না থামাও। আর এক কাজ করো। রাত তো প্রায় সাড়ে ন’টা হতে চলল। তুমি খাবার আয়োজন করো। বেশী দেরী করে খেলে পিসি পিসোর অসুবিধে হতে পারে”।
লক্ষ্মী নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, করছি” বলে শাঁখ আর খালি মিষ্টির থালাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সীমন্তিনী এবার অর্চনাকে বলল, “অর্চু, তোর ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। যা, ট্যাবলেটটা খেয়ে আয়”।
অর্চনা বেরিয়ে যেতেই সুলোচনা জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের ট্যাবলেট খাচ্ছে ও”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “বৌদি, ওর ওই দুর্ঘটণাটার পর কালচিনি হাসপাতালের ডক্টর সোম ওকে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলেন। দিনের পর দিন অনাহারে অনিদ্রায় থাকতে থাকতে ওর ওনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি করে ডক্টর সোম ওকে মোটামুটি সুস্থ করে তুলে ওর মা বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওকে পুরোপুরি সুস্থ হতে মাস তিনেক সময় লাগবে বলেছিলেন ডাক্তার। আর এই তিন মাস ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধগুলো খেয়ে যেতে হবে। দু’মাস পেরিয়ে গেছে। আমার এখানে ওকে নিয়ে আসবার পর ও খুব তাড়াতাড়ি রিকভার করেছে। এখন ওকে আর অসুস্থ বলে মনেই হয় না। কিন্তু ওষুধের কোর্সটা পুরো হয়নি এখনও। অক্টোবর মাস অব্দি সেটা চলবে। ডাক্তার বারবার করে বলে দিয়েছেন কোর্সটা যেন পুরো করা হয়। কোর্স পুরো হবার আগেই ওষুধ বন্ধ করে দিলে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আরও মাসখানেক পর কোর্সটা শেষ হবে”।
সুলোচনা তার শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ মা, ডক্টর সোম তো আমাদেরকেও সে কথাটা বলেছিলেন, তাই না”?
হৈমবতীদেবী বললেন, “হ্যাঁ, বলেছিলেন তো”।
এবার নিরঞ্জনবাবু বললেন, “মন্তি মা। আমরা ওদের বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিয়ে দিতে চাই। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা তোমার কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য চাই মা”।
সীমন্তিনী আবার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “পিসো, এমন করে বোল না প্লীজ। এ বিয়েতে আমাদের অবস্থা তো কনের ঘরের পিসি আর বরের ঘরের মাসির মত। দু’তরফেই আমাদের আপনার জন। কাউকে কি আর আমরা এড়িয়ে যেতে পারব? তবে পিসো, আমি তো যখন তখন ছুটি ছাটা নিতে পারি না। তাই যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন হবে সেভাবেই ছুটে যেতে পারব না কোথাও। তবে ফোনের মাধ্যমেই যতটুকু সম্ভব করবো। শারিরীকভাবে হয়ত সব সময় সব জায়গায় উপস্থিত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তবু বলছি, আমার কাছ থেকে তোমাদের যখন যেমন সাহায্যের প্রয়োজন হবে আমাকে নির্দ্বিধায় জানিও। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব সেটা সমাধা করতে”।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, “ভগবানের আশীর্বাদে লোকবল আর অর্থবলের অভাব নেই আমাদের মা। তুমি শুধু তোমার বুদ্ধি আর বিবেচনা দিয়ে আমাদের সাহায্য কোর মা”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “পিসো, এ ব্যাপারে আমার কাছ থেকে তোমরা সব রকম সাহায্য পাবে। তবে আগে তো আমরা ধরেই নিয়েছিলুম যে ওদের বিয়ের সমস্ত আয়োজন আমাদেরকেই করতে হবে, আর পরি যখন রাজী ছিল তখন ধরেই নিয়েছিলুম যে বিয়েটা হচ্ছেই। তাই বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারেও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলুম আমরা। সে’সব জানতে চাইলে আমি সব কথাই তোমাদের খুলে বলব। কিন্তু সে’সব কথা বলবার আগে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে যে পরির জন্যে তোমরা কবে অর্চুকে পছন্দ করলে? আমার মন কেন জানিনা বলছে যে আমি আর নীতা ওকে পছন্দ করেছি বলেই তোমরাও সেটাই চাইছ? তোমাদের পছন্দ অন্য কেউ ছিল”।
এবার হৈমবতীদেবী বললেন, “না মা, তা নয়। আমরা আগে যা বলেছি সেটাই সত্যি। মাস দুয়েক আগে যেদিন বিধুর সাথে আমার চুয়াল্লিশ বছর পর দেখা হল, সেদিনই ওর সাথে কথায় কথায় ওর পরিবারের সকলের কথা শুনেছিলুম। তুমি যে তার অন্নপূর্ণা মা সে তো সেদিনই জানতে পেরেছি। বিধুর ছোটমেয়ের বিয়ে তুমিই দিয়েছ। বরের বোন হয়েও মেয়ের বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব তুমি নিজের হাতে সম্পন্ন করেছিলে। কিন্তু এক ঘটকের মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে একটা ভুল পাত্রের সাথে ওর বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল বলে বিধুর পরিতাপের শেষ ছিল না। পাশের গ্রামে বিয়ে দিলেও মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি যাবার পর থেকে সাতটা বছরের মধ্যে বিধুরা কেউ তার মেয়ের মুখটি পর্যন্ত একটি বারের জন্যেও দেখতে পারেনি। সাতবছর পর তার মা অন্নপূর্ণার দৌলতেই সে তার বড় মেয়েকে হাসপাতালের বেডে ফিরে পেয়েছিল। অতটুকু কচি একটা মেয়ের জীবনে এমন সর্বনাশের কথা শুনে আমার কান্না পেয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেদিনই মনে মনে ভেবেছিলুম যে আমার যদি আরেকটা ছেলে থাকত, আর বিধু যদি জাতপাতের গোঁড়ামি ছেড়ে আমার সেই ছেলের সাথে ওর বড়মেয়েটার বিয়ে দিতে রাজী হত, তাহলে আমি মেয়েটাকে আমার ঘরের বৌ করে এনে তুলতুম। কিন্তু আমারও ঘরে আর অবিবাহিত কোন ছেলে ছিল না। তাছাড়া বিধুদের মত গোঁড়া ', পরিবারের কেউই যে তাদের বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চাইবে না, এটাও মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলুম। তাই সে ভাবনা আমাদের মনেই চেপে রেখেছিলুম। পরিকে ফিরে পাবার পরের দিনই ওর তিন বৌদি আর আমার বারংবার চাপের ফলে ও তোমার আর নীতার সব কথা বলল। তারপর আমরা যখন বললুম যে এবার আমরা ওর বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগব, তখন ও বলল যে, ও আগেই এ দায়িত্বটা তোমাদের দু’জনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সে’কথা শুনে আমরা ওকে বলেছিলুম যে তোমাদের সাথে শলা পরামর্শ করেই আমরা এগোব এ ব্যাপারে। তখনও অবশ্য বিধুর এই মেয়ের কথাটা আমার মাথায় ছিল। কিন্তু বিধু যে তার বিধবা মেয়ের দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে চাইবে না, এ ধারনাই আমাদের মনে তখনও বদ্ধমূল ছিল। ওদিকে পরির মুখে যখন শুনলুম তোমরাও ওর জন্যে একটা বিধবা অথচ কূমারী মেয়েকে পছন্দ করেছ, আর পরি নিজেও যখন তোমাদের পছন্দকেই মেনে নিয়েছে, তখন আমরা ভেবেছিলুম তবে আমরাও তো বিধুর মেয়ের ব্যাপারেও ভাবতে পারি। অবশ্য তখনও আমরা কেউ অর্চুকে দেখিনি। তবু পরের দিন আমার নির্দেশে বিধু যখন বিভা আর কিংশুককে নিয়ে আমাদের বাড়ি এল, তখন আমরা সকলেই ভেবেছিলুম যে ওর স্ত্রী বিভা যখন এত সুন্দরী তাহলে ওর মেয়েরাও নিশ্চয়ই সুন্দরী হবে। আর সেদিনই আমাদের ছোট বৌমা প্রথম সন্দেহটা করেছিল। ও বলেছিল যে তুমি যখন বিধুদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠ, বিধু তোমাকে নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করে, তুমিও বিধুর ছোটমেয়েকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাস, অর্চুকেও ওই চরম বিপদ থেকে মুক্ত করে আনবার পেছনেও তোমারই হাত ছিল আর তোমাদের পছন্দ করা মেয়েটাও যখন বিধবা, তাহলে সেই মেয়েটা অর্চুই হবে হয়তো। ওর সন্দেহটা আমাদের কারো কাছেই একেবারে অমূলক বলে মনে হয়নি। অর্চনার চিকিৎসা যে কালচিনি হাসপাতালের এক ডাক্তার করেছিলেন, সেটা আমরা আগেই বিধুর মুখেই শুনেছিলুম। তাই ছোটবৌমার কথা শুনেই তোমার পিসো আমাদের ফ্যামিলী ডাক্তার ডঃ বিশ্বাসের সাথে কথা বলতেই ভাগ্যক্রমে আমরা ওই ডাক্তার সোমের ফোন নাম্বারটা জানতে পেরেছিলুম। সেদিন রাতেই তোমার পিসো ওই ডাক্তার সোমের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন যে পাঁচ বছর স্বামীর সঙ্গে সংসার করবার পরেও অর্চু এখনও একটা কূমারীই আছে। ওর সঙ্গে যে ওর স্বামীর একবারও শারীরিক সম্পর্ক হয়নি এটা উনি জোর দিয়েই বললেন। অবশ্য প্রথমেই উনি তার কোন পেশেন্টের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমাদের কাছে কিছু বলতে রাজী ছিলেন না। ভদ্রলোক সত্যিই খুব সজ্জন। আমরা আমাদের বাড়ির ডাক্তারের নাম করে বলতেও উনি রাজী হচ্ছিলেন না। তখন তোমার পিসো একটু ছলনার আশ্রয় নিয়েই ডাক্তার সোমকে তোমার নাম করে বলেছিলেন যে তিনি তোমার বিশেষ পরিচিত। আর আমরা আমাদের ভাইপো কলকাতার এক আইপিএস অফিসার পরিতোষ সান্যালের সাথে অর্চনার বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। আর সে ব্যাপারেই কথাগুলো জানা আমাদের প্রয়োজন। তোমার আর পরির নাম শুনেই ডক্টর সোম ওই কথাগুলো আমাদের বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন যে পরিতোষও নাকি দু’দিন আগেই তার হাসপাতালে গিয়ে তার সাথে দেখা করেছিল। ওই ডাক্তারের এক বোন নাকি কলকাতায় থাকে এবং পরি নাকি তাকে বৌদি বলে ডাকে। সে’কথা শুনেই আমাদের মনে আর কোন সন্দেহ রইল না যে তোমরাও পরির জন্যে বিধুর ওই মেয়েটাকেই পছন্দ করেছ। আর তোমাদের পছন্দ আর আমাদের পছন্দ যে একই, এটা উপলব্ধি করেই আমরা সকলেই যে কতটা আনন্দিত হয়েছিলুম, সে’কথা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না মা। কিন্তু মনের ভেতর ওই দুশ্চিন্তাটা কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। বিধু তার বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দিতে রাজী হবে কি না। তখন একবার ভেবেছিলুম যে কালচিনি গিয়ে বিধু আর বিভার সাথে সরাসরি এ ব্যাপারে কথা বলেই দেখা যাক, ওরা কী বলে। কিন্তু ... ওহ, এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়। পরির ফোনেই প্রথম দিন সন্ধ্যেয় আমি রচনার সাথে কথা বলেছিলুম। কিন্তু সেদিন রাতে আমার ফোন থেকে ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলুম আমি। তখনই শুনেছিলুম যে বিধুর পরিবারের সকলের কাছে তুমি কী, আর কতখানি। তোমার কোন কথাই নাকি ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা তো দুর, বিধু আর বিভাও অবহেলা করতে পারে না। সে’কথা মনে হতেই আমরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলুম যে এ ব্যাপারে সরাসরি বিধুর সাথে আলাপ করবার আগে তোমার শরণাপন্ন হলেই হয়ত আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে। তাই আজ এভাবে তোমাদের কাছে এসেছি আমরা। কিন্তু তবু বলছি মা, আমাদের পছন্দের তালিকায় অর্চুর ওপরে কিন্তু তোমার আর নীতার নামই ছিল। কারণ পরি তোমাদের দু’জনকেই কোন না কোন সময় ভালবেসেছিল। তাই আমরা এখানে আসবার আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করেছিলুম যে আমাদের প্রথম পছন্দ হবে তোমরা দু’জনই। আর পরি যেমনটা বলেছিল, তোমরা এখনও যদি সেই একই কথা বল, তবেই আমরা অর্চুর ব্যাপারে কথা তুলব। আর আমাদের বিশ্বাস ছিল যে অর্চুই আমাদের তোমাদের দু’তরফেরই পছন্দ। তাই অর্চুকে বা বিধু বিভাকে তুমি নিশ্চয়ই রাজী করাতে পারবে”।
______________________________
এমন সময় লক্ষ্মীকে সাথে করে হাতে শাঁখ নিয়ে নবনীতা ঘরে ঢুকে শাঁখে ফুঁ দিল। আর লক্ষ্মী উলু দিতে শুরু করল। তিনবার শঙ্খধ্বনি আর উলু দেবার পর লক্ষ্মী মিষ্টির থালা হাতে করে প্রথমে নিরঞ্জনবাবুর দিকে এগিয়ে গেল। নিচু হয়ে তাকে প্রণাম করে বলল, “পিসেমশাই, আপনারা যে আমাদের অভাগী বোনটাকে আপনাদের পায়ে ঠাঁই দিলেন, এতে আমরা সবাই খুব খুশী হয়েছি। নিন, একটু মিষ্টিমুখ করুন সকলে মিলে”।
অর্চনা আবার সীমন্তিনীর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে হৈমবতীদেবীকে বলল, “পিসি, তুমি পরিকে খবরটা জানিয়ে দাও। বেচারা বিকেল থেকে খুব টেনশনে আছে। আমাকে বারবার করে বলেছে যে তোমরা এখানে কী উদ্দেশ্যে এসেছ সেটা জানতে পারলেই যেন আমরা ওকে ফোন করি। তবে আমার মনে হয়, আমি বা নীতার বদলে তুমি নিজেই যদি কথাটা ওকে বলো, তাহলে ও বেশী খুশী হবে” বলে নিজের মোবাইল থেকেই পরির নাম্বার ডায়াল করে ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিল।
হৈমবতীদেবী ফোন কানে লাগাতেই ও’দিক থেকে পরিতোষ ব্যগ্র কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ মন্তি বলো। ওদিকের কী খবর”?
হৈমবতীদেবী বললেন, “মন্তি নয়। আমি বলছি রে, তোর পিসি”?
পরিতোষ একটু হতাশ হয়ে থতমত খেয়ে বলল, ‘ও পিসি, তুমি? হ্যাঁ বলো”।
হৈমবতীদেবী বললেন, “আমরা তোর বিয়ে ঠিক করে ফেললুম রে বাবা। তুই আবার বেঁকে বসবি না তো”?
পরিতোষ মনে মনে ভাবল, তার মনের ভেতরের ভয়টাই তাহলে সত্যি হল! এখন সে সীমন্তিনী আর নবনীতাকে কী জবাব দেবে! সে কোন মুখে ওদের মুখোমুখি হবে এরপর। পরিতোষকে চুপ করে থাকতে দেখে হৈমবতীদেবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে, কি হল? কোন জবাব দিচ্ছিস না যে? আমাদের পছন্দ করা মেয়েকে তুই বিয়ে করবি না”? বলে তার পাশে বসা সুলোচনাকে ঈশারায় ফোনের স্পীকার অন করে দিতে বললেন। সুলোচনাও মজা পেয়ে ফোনের স্পীকার অন করে দিলেন।
সবাই শুনল পরিতোষ ভাঙা ভাঙা গলায় বলছে, “কি বলব পিসি। এতটা বছর থেকে নিজেকে তো অনাথই ভেবে এসেছি আমি। নাগরাকাটা যাবার পর কোন ভাগ্যে অর্চনার মুখে ওর বাবার নামটা শুনেই আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠেছিল। সেই সূত্র ধরেই প্রথমে বিধুকাকু আর পরে তোমাকে খুঁজে পেলাম। তুমিই তো এখন আমার সব। তোমার কথার অন্যথা করা কি আর আমার পক্ষে সম্ভব। তুমি নিশ্চয়ই আমার ভালোর কথা ভেবেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কিন্তু পিসি, আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমি নীতা আর মন্তিকে কথা দিয়েছিলাম যে ওদের পছন্দ করা পাত্রীকেই আমি বিয়ে করব। যতদুর জানি, তোমার সাথে আমার দেখা হবার আগেই ওরা একটা পাত্রী পছন্দও করেছিল আমার জন্যে। ওখানে যাবার দিন পনের আগে থেকে আমি কাজে অসম্ভব ব্যস্ত ছিলাম বলে ওদের সাথে নিয়মিত ভাবে ফোনে যোগাযোগও করতে পারিনি। তাই ব্যাপারটা আর এগোয় নি। নইলে এতদিনে হয়ত ওরা বিয়েটা পাকা করে ফেলত। এখন আমি ওদের কী বলব, সেটাই ভাবছি”।
হৈমবতীদেবী সীমন্তিনী আর নবনীতার দিকে দেখতে দেখতে বললেন, “আরে ওরা তো কেউ আর অবুঝ বা অবিবেচক নয়। সত্যি কথাটাই ওদের কাছে খুলে বলবি। ওদের দুটিকেই তো আমার বেশ ভাল লেগেছে। খুব ভাল মেয়ে ওরা। আর আমরা এখানে এসেছিলুম ওদের দু’জনের কাউকে বলে কয়ে তোকে বিয়ে করতে রাজী করাবো বলে। কিন্তু ওরা দু’জনেই আমাদের বিমুখ করল। তাই তো আমাদের বাড়ির সকলে মিলে যে মেয়েটাকে তোর জন্যে পছন্দ করেছিলুম তার সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করলুম। আর তুই তো বলেছিলি যে মন্তি আর নীতা রাজী না হলে তুই বিয়ে করবি না। এখন মন্তি আর নীতা দু’জনেই আমাদের পছন্দ করা মেয়েটিকে পছন্দ করেছে। তাই আমরা আর সময় নষ্ট না করে ..........”
তার কথার মাঝেই বাধা দিয়ে পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “ওরা তোমাদের পছন্দ করা মেয়েটার সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারে রাজী আছে? সত্যি বলছ তুমি পিসি”?
হৈমবতীদেবী একটু অবাক হবার ভাণ করে বললেন, “ওমা, তোকে আমি মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন? আচ্ছা এই নে, আমি নীতাকে ফোন দিচ্ছি। তুই ওর সাথে কথা বল” বলে ফোনটা নবনীতার দিকে এগিয়ে দিলেন।
হৈমবতীদেবীর হাতে ধরা ফোনের কাছে মুখ এনে নবনীতা বলল, “হ্যাঁ পরি। পিসি একদম সত্যি কথাই বলছেন। পিসিরা যে মেয়েটিকে পছন্দ করেছেন তাকে আমার আর দিদির দু’জনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদেরও মনে হচ্ছে মেয়েটা তোমার উপযুক্ত। তবে একদিক দিয়ে বিচার করলে বলা যায় তোমার ভাগ্যটাই অমন। নইলে কি আর এমন হত”?
পরিতোষ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “এমন হত মানে? কী হত? একটু খুলে বলছ না কেন তুমি”?
নবনীতার মুখে চোখে কৌতুক ভরা দুষ্টুমির ভাব থাকলেও স্বাভাবিক গলায় বলল, “না তেমন কিছু না। আসলে আমরা তোমার জন্য যে মেয়েটা পছন্দ করেছিলাম সেই গরীব ঘরের মেয়েটা তো লেখাপড়ায় মাত্র মাধ্যমিক পাশ ছিল। তার আগে একটা বিয়েও হয়েছিল। পাঁচ বছর স্বামীর সাথে ঘরও করেছিল। ওর স্বামী বছর দুয়েক আগে মারা গেছে। অন্যান্য আর সব দিক থেকে ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু পিসি যখন তোমার জন্যে নিজেই একটা ভাল মেয়ে পছন্দ করেছেন, তখন ওই মেয়ের ব্যাপারে তো আর কোন কথাবার্তা বলছি না আমরা। কিন্তু পিসিরা সকলে মিলে তোমার জন্য যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছেন, তার ব্যাপারেও আমরা আজ তাদের মুখ থেকে সবটা শুনলাম। দেখলাম যে এ মেয়েটাও তোমার উপযুক্তই হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখো পরি। এ মেয়েটাও বিধবা। তাই তো বলছি যে তোমার ভাগ্যটাই বুঝি অমন। তোমার কপালে বিধাতা বিধবা মেয়ে বিয়ে করবার কথাই লিখে দিয়েছেন বোধহয়”।
পরিতোষ সাথে সাথে বলল, “আরে মেয়েটা বিধবা না সধবা এ’সব কথা ছাড়ো তো। তুমি বা মন্তি কি সেই মেয়েটাকে দেখেছ? আচ্ছা মন্তি কোথায়? কলটা তো ওরই ফোন থেকে এসেছে। সে কোথায়? আমি মন্তির সাথে কথা বলতে চাই। ফোনটা ওকে দাও দেখি”।
নবনীতা আরও মজা পেয়ে বলল, “দিদি তো এখানেই আছে। আমার পাশেই আছে। এখানে ফোনের স্পীকার অন করা আছে। আর এ’ঘরে দিদি, অর্চু, পিসি, পিসো, বৌদি আমরা সকলেই আছি। এমন কি লক্ষ্মীদি পর্যন্ত আছে। আমরা সকলেই তোমার কথা শুনছি তো। তুমি দিদিকে কি জিজ্ঞেস করতে চাও, করো না”।
সীমন্তিনীও খানিকটা ফোনের কাছাকাছি এসে বলল, “হ্যাঁ পরি, নীতা ঠিক বলছে। আমরা সবাই এখন গেস্টরুমে আছি। সকলেই তোমার কথা শুনছেন। এবার বলো দেখি, আমাকে কী বলতে চাইছ”?
পরিতোষ এবার বেশ কয়েক মূহুর্ত চুপ করে রইল। অর্চনা ছাড়া গেস্টরুমের সকলের মুখেই কৌতুকের ছোঁয়া তখন। কিছুক্ষণ পর পরি জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মন্তি, তোমার কি মনে হয়? আমি কি মেয়েটাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় তোমার”?
সীমন্তিনী ঠোঁট টিপে হেসে ছোট্ট করে জবাব দিল, “হ্যাঁ”।
অর্চনা লজ্জায় মাথা নুইয়ে আছে। একবার সে ঘর থেকে চলেও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সুলোচনা ওর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন বলে সে আর বেরিয়ে যেতে পারেনি। ও’পাশ থেকে অনেকক্ষণ পরিতোষের সাড়া না পেয়ে এবার সুলোচনা একটু উঁচু গলায় বললেন, “কি হল ভাইদা? চুপ করে আছ যে বড়? কিছু বলবে না”?
এবার পরিতোষ অনেকটা সহজ গলায় জবাব দিল, “বড়বৌদি, আর কিচ্ছু বলার নেই আমার। তোমরা যা ভাল বোঝ, তাই করো। তবে এ’সময় ফোনটা করেছ বলে তোমাদের সব্বাইকে আমার মন থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দুপুর বেলা থেকেই ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল একটা ধর্ম সঙ্কটে পড়েছি। কোন একটা সমাধানও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভেবেছিলাম আজ রাতে বোধহয় ঘুমোতেও পারব না। এবার সে চিন্তাটা দুর হল। তোমাদের সাথে পরে আবার কথা হবে। এখন রাখছি” বলেই ফোন কেটে দিল।
পরিতোষ এভাবে ফোন কেটে দিতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “ওমা! ফোনটা কেটে দিল? অনেক কথা তো আমার বলার ছিল আরও”।
সীমন্তিনী ফোনটা ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল, “পিসি, পরি সবটাই বুঝে গেছে। ওকে আর কিচ্ছু না বললেও চলবে। ভুলে যেও না তোমার ভাইপো একজন সিনিয়র আইপিএস অফিসার। অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান ও। গোটা বাংলার সমস্ত পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা ওর বুদ্ধির তারিফ করে। চাক্ষুস যারা ওকে দেখেনি তারাও পরিতোষ সান্যাল নামটার সাথে পরিচিত। আমি ওর মনের ভেতরের কথাও বুঝতে পারি। তাই আমি বলছি, ও এ বিয়েতে রাজী আছে। এবার তোমরা নিশ্চিন্তে ওদের বিয়ের আয়োজন করতে পারো”।
এবার হৈমবতীদেবী বা আর কেউ কিছু বলবার আগেই লক্ষ্মী বলে উঠল, “আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা আমি তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না গো দিদিমণি। ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে আমার” বলতে বলতে অর্চনার কপালে একটু চুমু খেয়ে বলল, “দিদিমণি যেদিন সোনাদিকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল, সেই দিনটি থেকে রোজ ভগবানের কাছে তার জন্যে প্রার্থনা করতুম আমি। গরীব মুখ্যুসুখ্যু মানুষ আমি। আমার তো আর সামর্থ্য ছিল না তার জন্যে কিছু করবার। সোনাদি এখানে আসবার পর তাকে দেখবার পর থেকে আমার মনটা আবার কেঁদে উঠেছিল। উচিৎ অনুচিত না ভেবে মনে মনে ভগবানকে কোষতুম। এমন সুন্দর মিষ্টি ফুলের মত মেয়েটার কপালে তিনি এত কষ্ট লিখে দিয়েছিলেন বলে। আজ ভগবানের কাছে আমি ক্ষমা চাইব” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।
সীমন্তিনী লক্ষ্মীর একটা হাত ধরে তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, “তোমার প্রার্থনার জোরেই হয়ত এমনটা হল লক্ষ্মীদি। নইলে পিসিরাও যে পরির জন্য অর্চুকেই পছন্দ করবেন এ কি আমরা কেউ ভাবতেও পারতুম? এবার কান্না থামাও। আর এক কাজ করো। রাত তো প্রায় সাড়ে ন’টা হতে চলল। তুমি খাবার আয়োজন করো। বেশী দেরী করে খেলে পিসি পিসোর অসুবিধে হতে পারে”।
লক্ষ্মী নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, করছি” বলে শাঁখ আর খালি মিষ্টির থালাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সীমন্তিনী এবার অর্চনাকে বলল, “অর্চু, তোর ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। যা, ট্যাবলেটটা খেয়ে আয়”।
অর্চনা বেরিয়ে যেতেই সুলোচনা জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের ট্যাবলেট খাচ্ছে ও”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “বৌদি, ওর ওই দুর্ঘটণাটার পর কালচিনি হাসপাতালের ডক্টর সোম ওকে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলেন। দিনের পর দিন অনাহারে অনিদ্রায় থাকতে থাকতে ওর ওনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি করে ডক্টর সোম ওকে মোটামুটি সুস্থ করে তুলে ওর মা বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওকে পুরোপুরি সুস্থ হতে মাস তিনেক সময় লাগবে বলেছিলেন ডাক্তার। আর এই তিন মাস ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধগুলো খেয়ে যেতে হবে। দু’মাস পেরিয়ে গেছে। আমার এখানে ওকে নিয়ে আসবার পর ও খুব তাড়াতাড়ি রিকভার করেছে। এখন ওকে আর অসুস্থ বলে মনেই হয় না। কিন্তু ওষুধের কোর্সটা পুরো হয়নি এখনও। অক্টোবর মাস অব্দি সেটা চলবে। ডাক্তার বারবার করে বলে দিয়েছেন কোর্সটা যেন পুরো করা হয়। কোর্স পুরো হবার আগেই ওষুধ বন্ধ করে দিলে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আরও মাসখানেক পর কোর্সটা শেষ হবে”।
সুলোচনা তার শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ মা, ডক্টর সোম তো আমাদেরকেও সে কথাটা বলেছিলেন, তাই না”?
হৈমবতীদেবী বললেন, “হ্যাঁ, বলেছিলেন তো”।
এবার নিরঞ্জনবাবু বললেন, “মন্তি মা। আমরা ওদের বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিয়ে দিতে চাই। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা তোমার কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য চাই মা”।
সীমন্তিনী আবার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “পিসো, এমন করে বোল না প্লীজ। এ বিয়েতে আমাদের অবস্থা তো কনের ঘরের পিসি আর বরের ঘরের মাসির মত। দু’তরফেই আমাদের আপনার জন। কাউকে কি আর আমরা এড়িয়ে যেতে পারব? তবে পিসো, আমি তো যখন তখন ছুটি ছাটা নিতে পারি না। তাই যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন হবে সেভাবেই ছুটে যেতে পারব না কোথাও। তবে ফোনের মাধ্যমেই যতটুকু সম্ভব করবো। শারিরীকভাবে হয়ত সব সময় সব জায়গায় উপস্থিত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তবু বলছি, আমার কাছ থেকে তোমাদের যখন যেমন সাহায্যের প্রয়োজন হবে আমাকে নির্দ্বিধায় জানিও। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব সেটা সমাধা করতে”।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, “ভগবানের আশীর্বাদে লোকবল আর অর্থবলের অভাব নেই আমাদের মা। তুমি শুধু তোমার বুদ্ধি আর বিবেচনা দিয়ে আমাদের সাহায্য কোর মা”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “পিসো, এ ব্যাপারে আমার কাছ থেকে তোমরা সব রকম সাহায্য পাবে। তবে আগে তো আমরা ধরেই নিয়েছিলুম যে ওদের বিয়ের সমস্ত আয়োজন আমাদেরকেই করতে হবে, আর পরি যখন রাজী ছিল তখন ধরেই নিয়েছিলুম যে বিয়েটা হচ্ছেই। তাই বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারেও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলুম আমরা। সে’সব জানতে চাইলে আমি সব কথাই তোমাদের খুলে বলব। কিন্তু সে’সব কথা বলবার আগে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে যে পরির জন্যে তোমরা কবে অর্চুকে পছন্দ করলে? আমার মন কেন জানিনা বলছে যে আমি আর নীতা ওকে পছন্দ করেছি বলেই তোমরাও সেটাই চাইছ? তোমাদের পছন্দ অন্য কেউ ছিল”।
এবার হৈমবতীদেবী বললেন, “না মা, তা নয়। আমরা আগে যা বলেছি সেটাই সত্যি। মাস দুয়েক আগে যেদিন বিধুর সাথে আমার চুয়াল্লিশ বছর পর দেখা হল, সেদিনই ওর সাথে কথায় কথায় ওর পরিবারের সকলের কথা শুনেছিলুম। তুমি যে তার অন্নপূর্ণা মা সে তো সেদিনই জানতে পেরেছি। বিধুর ছোটমেয়ের বিয়ে তুমিই দিয়েছ। বরের বোন হয়েও মেয়ের বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব তুমি নিজের হাতে সম্পন্ন করেছিলে। কিন্তু এক ঘটকের মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে একটা ভুল পাত্রের সাথে ওর বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল বলে বিধুর পরিতাপের শেষ ছিল না। পাশের গ্রামে বিয়ে দিলেও মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি যাবার পর থেকে সাতটা বছরের মধ্যে বিধুরা কেউ তার মেয়ের মুখটি পর্যন্ত একটি বারের জন্যেও দেখতে পারেনি। সাতবছর পর তার মা অন্নপূর্ণার দৌলতেই সে তার বড় মেয়েকে হাসপাতালের বেডে ফিরে পেয়েছিল। অতটুকু কচি একটা মেয়ের জীবনে এমন সর্বনাশের কথা শুনে আমার কান্না পেয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেদিনই মনে মনে ভেবেছিলুম যে আমার যদি আরেকটা ছেলে থাকত, আর বিধু যদি জাতপাতের গোঁড়ামি ছেড়ে আমার সেই ছেলের সাথে ওর বড়মেয়েটার বিয়ে দিতে রাজী হত, তাহলে আমি মেয়েটাকে আমার ঘরের বৌ করে এনে তুলতুম। কিন্তু আমারও ঘরে আর অবিবাহিত কোন ছেলে ছিল না। তাছাড়া বিধুদের মত গোঁড়া ', পরিবারের কেউই যে তাদের বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চাইবে না, এটাও মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলুম। তাই সে ভাবনা আমাদের মনেই চেপে রেখেছিলুম। পরিকে ফিরে পাবার পরের দিনই ওর তিন বৌদি আর আমার বারংবার চাপের ফলে ও তোমার আর নীতার সব কথা বলল। তারপর আমরা যখন বললুম যে এবার আমরা ওর বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগব, তখন ও বলল যে, ও আগেই এ দায়িত্বটা তোমাদের দু’জনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সে’কথা শুনে আমরা ওকে বলেছিলুম যে তোমাদের সাথে শলা পরামর্শ করেই আমরা এগোব এ ব্যাপারে। তখনও অবশ্য বিধুর এই মেয়ের কথাটা আমার মাথায় ছিল। কিন্তু বিধু যে তার বিধবা মেয়ের দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে চাইবে না, এ ধারনাই আমাদের মনে তখনও বদ্ধমূল ছিল। ওদিকে পরির মুখে যখন শুনলুম তোমরাও ওর জন্যে একটা বিধবা অথচ কূমারী মেয়েকে পছন্দ করেছ, আর পরি নিজেও যখন তোমাদের পছন্দকেই মেনে নিয়েছে, তখন আমরা ভেবেছিলুম তবে আমরাও তো বিধুর মেয়ের ব্যাপারেও ভাবতে পারি। অবশ্য তখনও আমরা কেউ অর্চুকে দেখিনি। তবু পরের দিন আমার নির্দেশে বিধু যখন বিভা আর কিংশুককে নিয়ে আমাদের বাড়ি এল, তখন আমরা সকলেই ভেবেছিলুম যে ওর স্ত্রী বিভা যখন এত সুন্দরী তাহলে ওর মেয়েরাও নিশ্চয়ই সুন্দরী হবে। আর সেদিনই আমাদের ছোট বৌমা প্রথম সন্দেহটা করেছিল। ও বলেছিল যে তুমি যখন বিধুদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠ, বিধু তোমাকে নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করে, তুমিও বিধুর ছোটমেয়েকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাস, অর্চুকেও ওই চরম বিপদ থেকে মুক্ত করে আনবার পেছনেও তোমারই হাত ছিল আর তোমাদের পছন্দ করা মেয়েটাও যখন বিধবা, তাহলে সেই মেয়েটা অর্চুই হবে হয়তো। ওর সন্দেহটা আমাদের কারো কাছেই একেবারে অমূলক বলে মনে হয়নি। অর্চনার চিকিৎসা যে কালচিনি হাসপাতালের এক ডাক্তার করেছিলেন, সেটা আমরা আগেই বিধুর মুখেই শুনেছিলুম। তাই ছোটবৌমার কথা শুনেই তোমার পিসো আমাদের ফ্যামিলী ডাক্তার ডঃ বিশ্বাসের সাথে কথা বলতেই ভাগ্যক্রমে আমরা ওই ডাক্তার সোমের ফোন নাম্বারটা জানতে পেরেছিলুম। সেদিন রাতেই তোমার পিসো ওই ডাক্তার সোমের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন যে পাঁচ বছর স্বামীর সঙ্গে সংসার করবার পরেও অর্চু এখনও একটা কূমারীই আছে। ওর সঙ্গে যে ওর স্বামীর একবারও শারীরিক সম্পর্ক হয়নি এটা উনি জোর দিয়েই বললেন। অবশ্য প্রথমেই উনি তার কোন পেশেন্টের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমাদের কাছে কিছু বলতে রাজী ছিলেন না। ভদ্রলোক সত্যিই খুব সজ্জন। আমরা আমাদের বাড়ির ডাক্তারের নাম করে বলতেও উনি রাজী হচ্ছিলেন না। তখন তোমার পিসো একটু ছলনার আশ্রয় নিয়েই ডাক্তার সোমকে তোমার নাম করে বলেছিলেন যে তিনি তোমার বিশেষ পরিচিত। আর আমরা আমাদের ভাইপো কলকাতার এক আইপিএস অফিসার পরিতোষ সান্যালের সাথে অর্চনার বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। আর সে ব্যাপারেই কথাগুলো জানা আমাদের প্রয়োজন। তোমার আর পরির নাম শুনেই ডক্টর সোম ওই কথাগুলো আমাদের বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন যে পরিতোষও নাকি দু’দিন আগেই তার হাসপাতালে গিয়ে তার সাথে দেখা করেছিল। ওই ডাক্তারের এক বোন নাকি কলকাতায় থাকে এবং পরি নাকি তাকে বৌদি বলে ডাকে। সে’কথা শুনেই আমাদের মনে আর কোন সন্দেহ রইল না যে তোমরাও পরির জন্যে বিধুর ওই মেয়েটাকেই পছন্দ করেছ। আর তোমাদের পছন্দ আর আমাদের পছন্দ যে একই, এটা উপলব্ধি করেই আমরা সকলেই যে কতটা আনন্দিত হয়েছিলুম, সে’কথা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না মা। কিন্তু মনের ভেতর ওই দুশ্চিন্তাটা কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। বিধু তার বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দিতে রাজী হবে কি না। তখন একবার ভেবেছিলুম যে কালচিনি গিয়ে বিধু আর বিভার সাথে সরাসরি এ ব্যাপারে কথা বলেই দেখা যাক, ওরা কী বলে। কিন্তু ... ওহ, এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়। পরির ফোনেই প্রথম দিন সন্ধ্যেয় আমি রচনার সাথে কথা বলেছিলুম। কিন্তু সেদিন রাতে আমার ফোন থেকে ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলুম আমি। তখনই শুনেছিলুম যে বিধুর পরিবারের সকলের কাছে তুমি কী, আর কতখানি। তোমার কোন কথাই নাকি ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা তো দুর, বিধু আর বিভাও অবহেলা করতে পারে না। সে’কথা মনে হতেই আমরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলুম যে এ ব্যাপারে সরাসরি বিধুর সাথে আলাপ করবার আগে তোমার শরণাপন্ন হলেই হয়ত আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে। তাই আজ এভাবে তোমাদের কাছে এসেছি আমরা। কিন্তু তবু বলছি মা, আমাদের পছন্দের তালিকায় অর্চুর ওপরে কিন্তু তোমার আর নীতার নামই ছিল। কারণ পরি তোমাদের দু’জনকেই কোন না কোন সময় ভালবেসেছিল। তাই আমরা এখানে আসবার আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করেছিলুম যে আমাদের প্রথম পছন্দ হবে তোমরা দু’জনই। আর পরি যেমনটা বলেছিল, তোমরা এখনও যদি সেই একই কথা বল, তবেই আমরা অর্চুর ব্যাপারে কথা তুলব। আর আমাদের বিশ্বাস ছিল যে অর্চুই আমাদের তোমাদের দু’তরফেরই পছন্দ। তাই অর্চুকে বা বিধু বিভাকে তুমি নিশ্চয়ই রাজী করাতে পারবে”।
______________________________