30-03-2020, 11:12 AM
(Update No. 244)
সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই ভেবেছিল ‘বিধবা’ শব্দটা শুনেই নিরঞ্জনবাবুরা সকলে আঁতকে উঠবেন। কিন্তু কাউকে চমকাতে না দেখে তারা নিজেরাই বরং অবাক হল। সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত ধরে সকলের মুখ দেখে নিজের মাথা নিচু করে বলল, “আমি জানি পিসি। তোমরা সবাই হয়ত এটাই ভাবছ যে পরির এত ঘণিষ্ঠ বন্ধু হয়েও এমন একটা বিধবা মেয়ের সাথে আমরা ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি কি করে। আর সেজন্যেই আমি কথাটা বলতে সঙ্কোচ করছিলুম। আমার আগেই ধারনা হয়েছিল যে মেয়ের বাবার আর্থিক অসচ্ছলতা, মেয়েটার অল্পশিক্ষিত হওয়া এ’সব মেনে নিতে পারলেও এ আশঙ্কা ছিলই যে তোমরা ওর বিধবা হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। হয়ত আমি আর নীতা দু’জনেই তাকে পছন্দ করেছি বলেই পরি এ বিয়েতে কোনও আপত্তি করেনি। কিন্তু কোনও ছেলের অভিভাবকই যে এটা মেনে নিতে রাজী হবে না, এটা আমরা আগেই বুঝেছিলুম। পরির মাথার ওপরে এতদিন অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। তাই ওর এমন কাজে বাধা দেবার কেউ নেই ভেবেই হয়ত আমাদের কথায় বিয়েতে রাজী হয়েছিল ও। কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা পালটে গেছে। এত বছর বাদে তোমাদের কাছে পেয়ে, তোমাদের মতামত উপেক্ষা করে সে আমাদের পছন্দের মেয়েটাকেই বিয়ে করুক, এটা আমরাও চাই না”।
সুলোচনা স্বাভাবিক গলায় বললেন, “শোনো মন্তি, আমরা এ’সব কথা আগেই শুনেছি ভাই। তাই তোমার মুখ থেকেও যে একই কথা শুনব সেটা জানতুমই আমরা। তাই তোমরা মনে মনে যেমন আশা করেছিলে আমরা কেউই তেমন চমকে উঠিনি। তুমি তো আমাদের ভাইদাকে এ’সব কথা আগেই বলেছ। আর ভাইদার কাছ থেকে আমরাও যে সব কিছু শুনেছি তা তো আগেই বলেছি আমরা। কিন্তু ভাইদাকে বোধহয় তোমরা মেয়েটার পরিচয় জানাও নি। কারন আমাদের প্রশ্নের জবাবে সে ওই কথাই বলেছিল। তবে ভাই, এবার তোমাদেরকেও একটা কথা বলি। আমরা যেদিন ভাইদাকে প্রথম দেখেছি, আর যখন অনেকভাবে তাকে প্রশ্ন করে বুঝতে পারলুম যে সে দুটো মেয়েকে ভালবাসলেও নিজের জীবনসঙ্গী বানাবার মত কোন মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক নেই, ওই মূহুর্ত থেকেই আমরা তিন জা-ই চাইছিলাম যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা ভাইদার বিয়ে দেব। তোমাদের দাদারা আর মা-বাবাও আমাদের পূর্ণ সমর্থন করলেন। আর তখনই মা একটা মেয়ের কথা বলেছিলেন। আর চাইছিলেন যে ওই মেয়ের সাথেই ভাইদার বিয়ে দেবেন। কিন্তু আমরা সকলেই ওই মেয়েটার ব্যাপারে আগে থেকে জানলেও তাকে আমরা কেউ কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু চোখে না দেখলেও আমাদের বাড়ির সকলেই ওই মেয়েটাকেই ভাইদার জন্য পছন্দ করে ফেলেছিল। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কী জানো? ওই মেয়েটাও বিধবা”।
সুলোচনার কথা শুনেই নবনীতা আর সীমন্তিনী একসাথে চাপা চিৎকার করে উঠে বলল, “ওমা! সেকি”?
সুলোচনা এবার একটু হেসে আবার বললেন, “হ্যাঁ ভাই, ঠিক তাই। তবে আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আমরা শুধু মেয়েটার নাম আর তার মা-বাবার পরিচয়টুকুই জানতুম। কিন্তু যেদিন মা মেয়েটার কথা বললেন, তার পরের দিনই ভাইদার মুখে শুনলুম যে তোমরাও তার জন্যে আগেই একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিলে। আর তোমাদের পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে তোমরা ভাইদাকে যা যা বলেছিলে, সে তার সবকিছুই আমাদের খুলে বলল। লক্ষ্য করলাম কাকতালীয় ভাবে ‘বিধবা’ শব্দটা দুটো মেয়ের সাথেই জড়িয়ে আছে। আর সেদিনই কালচিনি থেকে বিধুমামু মামী আর ভাইকে নিয়ে আমাদের ওখানে এলেন। সেদিন রাতেই বিধুমামুরা চলে যাবার পর পরই বাবা আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর, ডক্টর বিশ্বাসের সাথে কথা বলে তার কাছ থেকে আরেক ডক্টরের ফোন নাম্বার যোগার করলেন। আর তার মিনিট পনেরো বাদেই আমরা জানতে পারলুম যে আমরা যে মেয়েটাকে মনে মনে পছন্দ করেছিলুম সে মেয়েটাও আশ্চর্যজনক ভাবে বিধবা এবং কূমারী। কিন্তু মেয়েটার মা বাবার কাছে সম্মন্ধের প্রস্তাব নিয়ে যেতে আমাদের মধ্যে কেউই রাজী হচ্ছিল না, মানে ঠিক সাহসে কুলোচ্ছিল না আমাদের। এদিকে তোমরাও ভাইদার জন্য যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছিলে তাকেও দেখা উচিৎ। আর ভাইদাও একদিন কথায় কথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল যে আমাদের পছন্দের মেয়েটাকে তোমরা দু’জন পছন্দ না করলে সে ওই মেয়েকে বিয়ে করবে না। যেহেতু সে আগে থেকেই তোমাদের হাতে এ দায়িত্বটা তুলে দিয়েছিল, তাই তোমাদের মতামতটাও তার পক্ষে জরুরী। এদিকে দেখতে দেখতে সাত আটদিন কেটে গেল। আমরা আর সময় নষ্ট করতে চাইছিলুম না। তাই আজই আমরা আগাম কিছু না জানিয়েই তোমাদের এখানে চলে এসেছি”।
সুলোচনার কথা শুনে নবনীতা অবাক হয়ে সীমন্তিনীর দিকে চাইল। দেখল সীমন্তিনী মাথা নিচু করে গভীরভাবে কিছু একটা ভেবে চলেছে। নবনীতা এবার হৈমবতীদেবী আর নিরঞ্জনবাবুর দিকে চাইল। তাদের দু’জনের মুখেও চিন্তার ছাপ দেখতে পেল। মনে হল তারা দু’জনেই দম বন্ধ করে বসে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর সীমন্তিনী খুব শান্ত গলায় বলল, “বড়বৌদি, একটা ছোট্ট প্রশ্ন করছি। সত্যি জবাব দেবে? তোমরা কি তোমাদের পছন্দের ওই মেয়েটাকে আজই প্রথম দেখেছ? বা বলা ভাল, দেখলে”?
সুলোচনা কোন জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। কিন্তু হৈমবতীদেবী এবার কৌতুকভরা গলায় বললেন, “অনেক হয়েছে তোমাদের লুকোচুরি খেলা। এবার এ’সব বন্ধ করো দেখি। আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার” বলেই প্রায় চিৎকার করে উঠে দড়জার দিকে মুখ করে বললেন, “ওরে ও অর্চু। তুই গেলি কোথায় রে মুখপুড়ি”?
সীমন্তিনীও হেসে ফেলল। কিন্তু নবনীতা তখনও পুরো ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। হৈমবতীদেবীকে এভাবে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে সে আরও অবাক হল। শুধু নবনীতা বাদে ঘরে বসে থাকা সকলের চোখে মুখেই খুশীর ছোঁয়া। হৈমবতীদেবীর ওভাবে ডাক শুনেই অর্চনা পড়ি মরি করে ছুটে এসে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “কি হল পিসির? ও দিদিভাই পিসি ঠিক আছেন তো? তার কিছু .....” এটুকু বলতে বলতেই হৈমবতীদেবীর দিকে তাকিয়েই সে থেমে গেল।
নবনীতা এ’সব অপ্রত্যাশিত ঘটণা ঘটতে দেখে যেন আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে সীমন্তিনীর কাছে গিয়ে তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “ও দিদি, কী হচ্ছে গো এ’সব? আমি তো এ’সবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনে গো”!
সীমন্তিনী হেসে বলল, “এখনও বুঝতে পারিস নি? এত বোকা নাকি তুই? আরে পিসিরাও যে পরির জন্যে আমাদের অর্চুকেই পছন্দ করেছেন রে বোকা”।
নবনীতা একলাফে সুলোচনার কাছে এসে তার দুটো হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, “ও বৌদি, দিদি কী বলছে? আমি যে বিশ্বাসই করতে পারছি না গো। তুমি বল না বৌদি, দিদি যা বলল সেটাই কি সত্যি”?
সুলোচনা হেসে নবনীতার হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ নীতা, মন্তি ঠিকই বলেছে”।
অর্চনাও গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় সীমন্তিনীর পেছনে চলে আসতে সীমন্তিনী তাকে বলল, “আমার পেছনে যাচ্ছিস কেন সোনা? যা, এগিয়ে গিয়ে পিসি, পিসো আর বৌদিকে প্রণাম কর”।
অর্চনা লজ্জায় যেন মাটির সাথে মিশে যেতে চাইল। কিন্তু হৈমবতীদেবী তার উদ্দেশ্যে বললেন, “অর্চু সোনা মা। আয় আমার কাছে আয় মা”।
অর্চনার মন চাইলেও তার পা দুটো যেন মেঝের সাথে আঁটকে গেছে। পা দুটোকে অসম্ভব ভারী বলে মনে হচ্ছিল তার। কিছুতেই যেন এগোতে পারছিল না। আর তার মনের মধ্যে হঠাতই যেন একটা ঝড় বইতে লাগল। এতদিন ধরে রচনা, নবনীতা আর সীমন্তিনীর মুখে পরিতোষের কথা শুনতে শুনতে, পরিতোষ কিভাবে রচনাকে বিপদমুক্ত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিভাবে রচনা আর রতীশের ওপর সর্বদা নজর রেখে যাচ্ছিল, এ’সব শুনতে শুনতে তার মনটাও যেন পরিতোষের ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ক’দিন আগে লোকটা যখন এখানে এসেছিল তখন তার সাথে যতটুকু কথা সে বলেছে তাতে তারও মনে হয়েছিল যে পরিতোষ সত্যিই খুব সুন্দর মনের একটা লোক। পরদিন সকালে পরিতোষ তাদের কালচিনির বাড়িতে পৌঁছোবার পর যা যা হয়েছে তাতে একদিকে সে মনে মনে যেমন খুশী হয়েছিল, অন্যদিক দিয়ে সে এটাও বুঝতে পেরেছিল যে তার দিদিভাই এতদিন ধরে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সে প্রচেষ্টার সকারাত্মক পরিণতি বোধহয় আর হবে না। তবু সে পরিণতির কথা চিন্তা না করেও তার মন চাইছিল পরিতোষকে যেন তার পিসি আপন করে কাছে টেনে নেন। এ ভাবনা যে তার মনে কেন এসেছিল সেটা সে আগে বুঝতেও পারেনি। কিন্তু তার দিদিভাই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসবার পর তার সম্মুখে সে যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, তখন তার দিদিভাইই ধরে ফেলেছিলেন যে সে মনে মনে পরিতোষকে ভাল বেসে ফেলেছে। তখন সে নিজেও তার দিদিভাইয়ের কথা মনে মনে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সে’সময়েই তার দিদিভাই তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মনে মনে আগেই কোন রঙিন স্বপ্ন যেন সে না দেখে। তার দিদিভাই যে তাকে যথার্থ উপদেশই দিয়েছেন এ ব্যাপারে তার মনে একবিন্দু সন্দেহও নেই। কিন্তু তার মনের আয়না থেকে পরিতোষের ছবিটাকে সে যেন কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিল না। পরিতোষের পিসি পিসেমশাইরা আসবার পরেও তার মনের শঙ্কা কিন্তু ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছিল। যে মূহুর্তে গেস্টরুমের আলোচনার সময় পরিতোষের পিসি পিসেমশাইরা তার দিদিভাই আর নবনীতাকে রাজী করাবার চেষ্টা করছিলেন, তখনও তার মনটা যেন দ্বিধাবিভক্ত ছিল। কিন্তু তার দিদিভাই আর নীতাদি যখন পরিস্কার ভাবেই সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে তারা কোন অবস্থাতেই পরিতোষকে বিয়ে করবেন না, তখন অর্চনা ভেবেছিল, এবার বুঝি নিরঞ্জনবাবুরা তাদের পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে নীতাদি আর দিদিভাইয়ের সাথে আলোচনা করবেন। কিন্তু সেটা না করে যখন তারা এটা জানতে চাইলেন যে দিদিভাই আর নীতাদি মিলে কোন মেয়েটাকে পছন্দ করেছেন, তখন এবার তার কথা অবধারিত ভাবে উঠে আসবে ভেবেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। তার মনে হচ্ছিল সে তখনই ও’ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আর তার দিদিভাইও নিশ্চয়ই এটাই অনুমান করেছিলেন। তাই তিনি লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করবার অজুহাত দেখিয়ে তাকে সে ঘর ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রান্নাঘরে এসেও সে লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করবার মত তেমন কিছুই করেনি। তার বুকের ভেতরটা একই ভাবে ধকধক করে যাচ্ছিল। তার মনের ভেতরটা যেন একনাগাড়ে উথাল পাথাল হচ্ছিল। তার উদ্বেগ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তার মনে হচ্ছিল তার হৃৎপিণ্ডটা বুঝি তার গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার বেশ কিছুক্ষণ পর পরিতোষের পিসি জোরে তার নাম ধরে ডেকে উঠতেই তার চিন্তাভগ্ন হয়েছিল। সে ভেবেছিল হৈমবতী দেবীর শরীরটা বোধহয় ভাল নেই। এটা ভেবেই সে ছুটে এসেছিল এ’ঘরে। কিন্তু এ’ঘরে ঢুকেই নবনীতা, সীমন্তিনী আর সুলোচনার কথা শুনেই সে বুঝে গিয়েছিল, যে গত সাত আটদিন ধরে সে মনে মনে যে স্বপ্নটা দেখতে শুরু করেছিল, সেটা বোধহয় এবার বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। আর তখনই যেন দুনিয়ার লজ্জা এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল। নিজের লজ্জা লুকোতে সে আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তার দিদিভাইয়ের পেছনে গিয়ে নিজের মুখ লুকোতে চাইছিল। পিসির আহ্বানেও সে যেন আর নড়তে পারছিল না।
নবনীতা অর্চনার অবস্থা বুঝে নিজে এগিয়ে এসে অর্চনার একটা হাত ধরে তাকে টানতে টানতে বলল, “এসো অর্চু, পিসি, পিসো আর বৌদিকে প্রণাম করো”।
কিন্তু অর্চনা হঠাৎ করেই ও’পাশ দিয়ে ঘুরে সীমন্তিনীর পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে তার কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে ‘হু হু’ করে কেঁদে ফেলল। ঘরের আর বাকি সকলেই এটা দেখে অবাক হলেও সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নবনীতাকে বলল, “একটু দাঁড়া নীতা। ওকে দুটো মিনিট সময় দে। তুই তো বাড়ি ছিলিস না। বেচারী বিকেল থেকেই বড্ড টেনশনে ছিল রে। আমি বাড়ি এসে ওর মুখ চোখ দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। আর ওকেও তো কোনও দোষ দেওয়া যায় না। পিসিদের এখানে আসবার কথা শুনেই ও বুঝে গিয়েছিল যে পিসিরা এখানে কোন উদ্দেশ্যে আসছেন। আর আমরাও তো ভেবেছিলুম যে ওকে আর পরিকে নিয়ে আমরা এতদিন ধরে যা কিছু ভাবছিলুম তা বোধহয় আর বাস্তবরূপ নেবে না। ও নিজেও হয়তো তেমনটাই ভেবেছিল। আমিও একই আশঙ্কা করে সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত ওকে নানা ভাবে বুঝিয়েছি যে পিসিরা যদি সত্যি অন্য কোনও মেয়ের সাথে পরির বিয়ে দিতে চান তাহলে ওকে নিজেকে সামলাতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। আর আমি ওকে সব সময় আগলে আগলে রাখব। কিন্তু গত সাতদিন ধরে ওর মনের মধ্যে যে ভাবনা তোলপাড় করছিল, সেটা ও মুখ ফুটে আমাদের কাউকে বলেনি। আমার মনে কিছুটা সন্দেহ হলেও কথাটা আমি তোকে বা ওকে বলিনি। কিন্তু মনে মনে আমিও বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিলুম। সন্ধ্যের সময়েই কথায় কথায় আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে আমার সন্দেহটাই সত্যি। ও মনে মনে পরিকে ভাল বেসে ফেলেছে। তাই ওকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলুম যে এখন থেকেই যেন মনে মনে কোন স্বপ্ন ও সাজিয়ে না বসে। এইটুকু জীবনে বিনাদোষে কম কষ্ট তো ও পায়নি। আমি চাইনি পরিকে ভালবেসে তাকে নিজের করে নিতে না পেয়ে ও আরেকটা কষ্ট পাক। এই মূহুর্তে হঠাৎ করেই ও বুঝে গেল যে ও মনে মনে যে স্বপ্নটা দেখেছিল, সেটাই সত্যি হতে চলেছে। তাই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। ওর ভেতরের সমস্ত উদ্বেগ সমস্ত আশঙ্কা এখন চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসছে। ওকে একটু সামলে নিতে দে”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে সুলোচনা উঠে এসে অর্চনার গা ঘেঁসে বসে বললেন, “পাগলী মেয়ে, তোমাকে না আমি আগেই বলেছি যে আমাকে তুমি বৌদি নয় দিদি বলে ডাকবে। সেটা কি এমনি এমনি বলেছি”?
অর্চনার দমকে দমকে কান্না দেখে মনে হল সুলোচনার কথা বুঝি তার কানেই যায়নি। এবার হৈমবতীদেবী এসে অর্চনার আরেকপাশে বসে দু’হাতে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস নে মা। একদম কাঁদিস নে। তুই তো জানিস না, দু’মাস আগে আমি যখন চুয়াল্লিশ বছর পর তোর বাবাকে দেখতে পেলুম, আর তার মুখে তোদের সকলের কথা শুনলুম, সেদিনই ভেবেছিলুম আমার যদি আরেকটা ছেলে থাকত, তাহলে তোকেই আমি তার বৌ করে আমার ঘরে নিয়ে আসতুম। ভগবান বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি দয়া করে পরিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু কুলীন ',ের মেয়ে হলেও চুয়াল্লিশ বছর আগেই তো আমি ', সমাজচ্যুত হয়ে গিয়েছিলুম। আর তোর বাবাও যে তোর দ্বিতীয় বিয়ে দিতে রাজী হবেন এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আমি তো জানি, বিধবা বিবাহ এ যুগেও খুব সহজ ভাবে কেউ মেনে নিতে পারে না। আর তুই হলি একটা গোঁড়া ', ঘরের বিধবা মেয়ে। তাই গত সাত আটদিনে আমরা সকলে অনেক ভেবেও বিধুর কাছে আমার পরির জন্য তোর সম্মন্ধের কথা ওঠাবার সাহস জোটাতে পারছিলুম না। একটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছিল, আর পরির বিয়ে নিয়ে আমাদের চিন্তা বাড়ছিল। শেষে মন্তি আর নীতার শরণাপন্নই হতে হল আমাদের। পরির মুখে এদের দু’জনের সাথে ওর সম্পর্কের সবকিছুই আমরা শুনেছি। পরি শুধু আমাদের একটা কথারই জবাব দেয় নি। অবশ্য সে’ কথাটার জবাব আমি এতক্ষণে পেয়ে গেছি। এখানে আসবার আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল মন্তি বা নীতা যে কোন একজনকে বিয়েতে রাজী করানো। সেটা যদি কোনভাবেই সম্ভবপর করে না তুলতে পারি তাহলে ওরা পরির জন্য আগে যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছিল, সে মেয়ের সাথেই পরির বিয়ে দেবার চেষ্টা করব। প্রথম উদ্দেশ্যটা সফল না হতে, ওদের কাছে ওই মেয়েটার ব্যাপারে যখনই জানতে চাইলুম তখনই মন্তি তোকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিতেই আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, সেটা তুইই। অবশ্য এমন একটা ধারণা আমরা আগেও করেছিলুম, যখন শুনেছিলুম এই মন্তি মা-ই বিধুর মা অন্নপূর্ণা। তারপর তোর নাম উল্লেখ না করে মন্তি যা কিছু বলল তাতে আমাদের আর কারো বুঝতে বাকি রইল না। আমরা তো তোকে দেখার আগেই, শুধু তুই বিধুর মেয়ে বলেই, সকলেই তোকে পছন্দ করে ফেলেছিলুম। শুধু তোর বাবার কাছে প্রস্তাবটা দিতে পারছিলুম না। এখন বুঝতে পারছি, মন্তি সে কাজটা সেরে ফেলেছে। এবার তো আর ভাবনার কিছু রইল না। আমাদের অবশ্য তেমন কোনও লাভ হল না। আমি আগেও যেমন তোর পিসি ছিলুম তোদের বিয়ের পরেও তাই থাকব। তবে তফাৎ শুধু এটুকুই যে আগে এক তরফ থেকে পিসি ছিলুম, এখন দু’তরফেই পিসি হব। আয় না মা, এ খুশীতেই তোকে একটু আদর করি আমি”।
এবার আর অর্চনা নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। “পিসি” বলে হৈমবতীদেবীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। হৈমবতীদেবী অর্চনার গালে কপালে আর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বারবার তাকে কপালে আর গালে চুমু খেতে লাগলেন। এ দৃশ্য দেখে সীমন্তিনী নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। তার দু’চোখ বেয়েও জলের ধারা বইতে শুরু করল। নবনীতা তা দেখে সীমন্তিনীর চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “কাঁদছ কেন দিদি? আজ আমাদের কত বড় একটা খুশীর দিন বলো তো? আমাদের পরির সংসার গুছিয়ে দিতে পারছি আমরা। তোমার অর্চুসোনার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আজকের দিনে এ’ভাবে চোখের জল ফেলতে আছে”?
নবনীতার নিজের চোখ থেকেও যে জলের ধারা নামতে শুরু করেছিল তা যেন সে বুঝতেই পারেনি সে। সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে নবনীতার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস। তুইও যে কাঁদছিস, সেটা বুঝতে পারছিস না পাগলী”?
নবনীতা চোখে জল নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “জানি তো দিদি। আমরা দু’জনেই কাঁদছি। এমন খুশীর খবর জানতে পারলে চোখ থেকে এমনিই জল বেরিয়ে আসে গো। তোমার চোখের জলও যে কান্নার অশ্রু নয়, সেটাও আমি জানি। কিন্তু এখন তো এভাবে বসে বসে কাঁদলে চলবে না। এ সুখবরটা যে সবাইকে জানাতে হবে গো”।
সুলোচনা অর্চনাকে ধরে হৈমবতীদেবীর থেকে আলাদা করতে করতে বললেন, “আয় বোন। আমিও একটু তোকে আদর করি” বলে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরলেন।
নবনীতা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে বলল, “ও লক্ষ্মীদি, মিষ্টি কোথায় গো? শিগগীর বের করো। একটা প্লেটে সাত আটটা মিষ্টি বেড়ে দাও তাড়াতাড়ি”।
লক্ষ্মী নবনীতাকে ছটফট করতে দেখে অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে ছোড়দি? তুমি এমন করছ কেন”?
নবনীতা খুশীতে লক্ষ্মীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কী হয়েছে মানে? তোমার সোনাদির বিয়ে ঠিক হল গো। আর কার সাথে জানো? তোমার বড়দার সাথে গো”?
লক্ষ্মী বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি ছোড়দি? বড়দার সাথে আমার সোনাদির বিয়ে? সত্যি বলছ তুমি? আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না গো”।
নবনীতা আগের মতই আনন্দোচ্ছল ভাবে বলল, “হ্যাঁগো লক্ষ্মীদি, সেজন্যেই তো বলছি তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে ও’ঘরে এস। মিষ্টিমুখ করতে হবে তো। শাঁখ বাজাতে হবে। উলু দিতে হবে। ওঃ আমি তো উলু দিতে পারি না। তুমি উলু দিতে পার তো লক্ষ্মীদি”?
লক্ষ্মী একটা বড় প্লেটে মিষ্টি সাজাতে সাজাতে আনন্দের সাথে বলল, “হ্যাঁ ছোড়দি। পারি। তুমি তাহলে ঠাকুরঘর থেকে শাঁখটা নিয়ে ও’ঘরে যাও। আমি মিষ্টি আর জল নিয়ে যাচ্ছি”।
এদিকে ও’ঘরে সুলোচনা অর্চনাকে আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, “যা বোন, মা বাবাকে প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ নে”।
অর্চনা ততক্ষণে অনেকটাই সামলে উঠেছে। সুলোচনার কথা শুনে সীমন্তিনীর দিকে চাইতেই সীমন্তিনী এগিয়ে এসে অর্চনাকে নিয়ে নিরঞ্জনবাবুর সামনে দাঁড় করাতে অর্চনা নিচু হয়ে হাঁটু মুড়ে নিরঞ্জনবাবুকে প্রণাম করল। তারপর হৈমবতীদেবী আর সুলোচনাকেও প্রণাম করল। তারা তিনজনেই অর্চনাকে আশীর্বাদ করবার পর সুলোচনা নিজের গলা থেকে মোটা ভারী একটা সোনার হার খুলে অর্চনার গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “এটাকে তোর বিয়ের আশীর্বাদী বলে ভাবিস না অর্চু। এটা আজ আমি তোর দিদি হিসেবে তোকে উপহার দিচ্ছি। আজ থেকেই তুই আমার ছোট বোন হয়ে গেলি কিন্তু। তাই তোকে এখন থেকে আর ‘তুমি তুমি’
করে নয়, ‘তুই’ বলে সম্বোধন করব”।
______________________________
সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই ভেবেছিল ‘বিধবা’ শব্দটা শুনেই নিরঞ্জনবাবুরা সকলে আঁতকে উঠবেন। কিন্তু কাউকে চমকাতে না দেখে তারা নিজেরাই বরং অবাক হল। সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত ধরে সকলের মুখ দেখে নিজের মাথা নিচু করে বলল, “আমি জানি পিসি। তোমরা সবাই হয়ত এটাই ভাবছ যে পরির এত ঘণিষ্ঠ বন্ধু হয়েও এমন একটা বিধবা মেয়ের সাথে আমরা ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি কি করে। আর সেজন্যেই আমি কথাটা বলতে সঙ্কোচ করছিলুম। আমার আগেই ধারনা হয়েছিল যে মেয়ের বাবার আর্থিক অসচ্ছলতা, মেয়েটার অল্পশিক্ষিত হওয়া এ’সব মেনে নিতে পারলেও এ আশঙ্কা ছিলই যে তোমরা ওর বিধবা হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। হয়ত আমি আর নীতা দু’জনেই তাকে পছন্দ করেছি বলেই পরি এ বিয়েতে কোনও আপত্তি করেনি। কিন্তু কোনও ছেলের অভিভাবকই যে এটা মেনে নিতে রাজী হবে না, এটা আমরা আগেই বুঝেছিলুম। পরির মাথার ওপরে এতদিন অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। তাই ওর এমন কাজে বাধা দেবার কেউ নেই ভেবেই হয়ত আমাদের কথায় বিয়েতে রাজী হয়েছিল ও। কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা পালটে গেছে। এত বছর বাদে তোমাদের কাছে পেয়ে, তোমাদের মতামত উপেক্ষা করে সে আমাদের পছন্দের মেয়েটাকেই বিয়ে করুক, এটা আমরাও চাই না”।
সুলোচনা স্বাভাবিক গলায় বললেন, “শোনো মন্তি, আমরা এ’সব কথা আগেই শুনেছি ভাই। তাই তোমার মুখ থেকেও যে একই কথা শুনব সেটা জানতুমই আমরা। তাই তোমরা মনে মনে যেমন আশা করেছিলে আমরা কেউই তেমন চমকে উঠিনি। তুমি তো আমাদের ভাইদাকে এ’সব কথা আগেই বলেছ। আর ভাইদার কাছ থেকে আমরাও যে সব কিছু শুনেছি তা তো আগেই বলেছি আমরা। কিন্তু ভাইদাকে বোধহয় তোমরা মেয়েটার পরিচয় জানাও নি। কারন আমাদের প্রশ্নের জবাবে সে ওই কথাই বলেছিল। তবে ভাই, এবার তোমাদেরকেও একটা কথা বলি। আমরা যেদিন ভাইদাকে প্রথম দেখেছি, আর যখন অনেকভাবে তাকে প্রশ্ন করে বুঝতে পারলুম যে সে দুটো মেয়েকে ভালবাসলেও নিজের জীবনসঙ্গী বানাবার মত কোন মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক নেই, ওই মূহুর্ত থেকেই আমরা তিন জা-ই চাইছিলাম যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা ভাইদার বিয়ে দেব। তোমাদের দাদারা আর মা-বাবাও আমাদের পূর্ণ সমর্থন করলেন। আর তখনই মা একটা মেয়ের কথা বলেছিলেন। আর চাইছিলেন যে ওই মেয়ের সাথেই ভাইদার বিয়ে দেবেন। কিন্তু আমরা সকলেই ওই মেয়েটার ব্যাপারে আগে থেকে জানলেও তাকে আমরা কেউ কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু চোখে না দেখলেও আমাদের বাড়ির সকলেই ওই মেয়েটাকেই ভাইদার জন্য পছন্দ করে ফেলেছিল। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কী জানো? ওই মেয়েটাও বিধবা”।
সুলোচনার কথা শুনেই নবনীতা আর সীমন্তিনী একসাথে চাপা চিৎকার করে উঠে বলল, “ওমা! সেকি”?
সুলোচনা এবার একটু হেসে আবার বললেন, “হ্যাঁ ভাই, ঠিক তাই। তবে আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আমরা শুধু মেয়েটার নাম আর তার মা-বাবার পরিচয়টুকুই জানতুম। কিন্তু যেদিন মা মেয়েটার কথা বললেন, তার পরের দিনই ভাইদার মুখে শুনলুম যে তোমরাও তার জন্যে আগেই একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিলে। আর তোমাদের পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে তোমরা ভাইদাকে যা যা বলেছিলে, সে তার সবকিছুই আমাদের খুলে বলল। লক্ষ্য করলাম কাকতালীয় ভাবে ‘বিধবা’ শব্দটা দুটো মেয়ের সাথেই জড়িয়ে আছে। আর সেদিনই কালচিনি থেকে বিধুমামু মামী আর ভাইকে নিয়ে আমাদের ওখানে এলেন। সেদিন রাতেই বিধুমামুরা চলে যাবার পর পরই বাবা আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর, ডক্টর বিশ্বাসের সাথে কথা বলে তার কাছ থেকে আরেক ডক্টরের ফোন নাম্বার যোগার করলেন। আর তার মিনিট পনেরো বাদেই আমরা জানতে পারলুম যে আমরা যে মেয়েটাকে মনে মনে পছন্দ করেছিলুম সে মেয়েটাও আশ্চর্যজনক ভাবে বিধবা এবং কূমারী। কিন্তু মেয়েটার মা বাবার কাছে সম্মন্ধের প্রস্তাব নিয়ে যেতে আমাদের মধ্যে কেউই রাজী হচ্ছিল না, মানে ঠিক সাহসে কুলোচ্ছিল না আমাদের। এদিকে তোমরাও ভাইদার জন্য যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছিলে তাকেও দেখা উচিৎ। আর ভাইদাও একদিন কথায় কথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল যে আমাদের পছন্দের মেয়েটাকে তোমরা দু’জন পছন্দ না করলে সে ওই মেয়েকে বিয়ে করবে না। যেহেতু সে আগে থেকেই তোমাদের হাতে এ দায়িত্বটা তুলে দিয়েছিল, তাই তোমাদের মতামতটাও তার পক্ষে জরুরী। এদিকে দেখতে দেখতে সাত আটদিন কেটে গেল। আমরা আর সময় নষ্ট করতে চাইছিলুম না। তাই আজই আমরা আগাম কিছু না জানিয়েই তোমাদের এখানে চলে এসেছি”।
সুলোচনার কথা শুনে নবনীতা অবাক হয়ে সীমন্তিনীর দিকে চাইল। দেখল সীমন্তিনী মাথা নিচু করে গভীরভাবে কিছু একটা ভেবে চলেছে। নবনীতা এবার হৈমবতীদেবী আর নিরঞ্জনবাবুর দিকে চাইল। তাদের দু’জনের মুখেও চিন্তার ছাপ দেখতে পেল। মনে হল তারা দু’জনেই দম বন্ধ করে বসে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর সীমন্তিনী খুব শান্ত গলায় বলল, “বড়বৌদি, একটা ছোট্ট প্রশ্ন করছি। সত্যি জবাব দেবে? তোমরা কি তোমাদের পছন্দের ওই মেয়েটাকে আজই প্রথম দেখেছ? বা বলা ভাল, দেখলে”?
সুলোচনা কোন জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। কিন্তু হৈমবতীদেবী এবার কৌতুকভরা গলায় বললেন, “অনেক হয়েছে তোমাদের লুকোচুরি খেলা। এবার এ’সব বন্ধ করো দেখি। আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার” বলেই প্রায় চিৎকার করে উঠে দড়জার দিকে মুখ করে বললেন, “ওরে ও অর্চু। তুই গেলি কোথায় রে মুখপুড়ি”?
সীমন্তিনীও হেসে ফেলল। কিন্তু নবনীতা তখনও পুরো ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। হৈমবতীদেবীকে এভাবে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে সে আরও অবাক হল। শুধু নবনীতা বাদে ঘরে বসে থাকা সকলের চোখে মুখেই খুশীর ছোঁয়া। হৈমবতীদেবীর ওভাবে ডাক শুনেই অর্চনা পড়ি মরি করে ছুটে এসে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “কি হল পিসির? ও দিদিভাই পিসি ঠিক আছেন তো? তার কিছু .....” এটুকু বলতে বলতেই হৈমবতীদেবীর দিকে তাকিয়েই সে থেমে গেল।
নবনীতা এ’সব অপ্রত্যাশিত ঘটণা ঘটতে দেখে যেন আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে সীমন্তিনীর কাছে গিয়ে তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “ও দিদি, কী হচ্ছে গো এ’সব? আমি তো এ’সবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনে গো”!
সীমন্তিনী হেসে বলল, “এখনও বুঝতে পারিস নি? এত বোকা নাকি তুই? আরে পিসিরাও যে পরির জন্যে আমাদের অর্চুকেই পছন্দ করেছেন রে বোকা”।
নবনীতা একলাফে সুলোচনার কাছে এসে তার দুটো হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, “ও বৌদি, দিদি কী বলছে? আমি যে বিশ্বাসই করতে পারছি না গো। তুমি বল না বৌদি, দিদি যা বলল সেটাই কি সত্যি”?
সুলোচনা হেসে নবনীতার হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ নীতা, মন্তি ঠিকই বলেছে”।
অর্চনাও গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় সীমন্তিনীর পেছনে চলে আসতে সীমন্তিনী তাকে বলল, “আমার পেছনে যাচ্ছিস কেন সোনা? যা, এগিয়ে গিয়ে পিসি, পিসো আর বৌদিকে প্রণাম কর”।
অর্চনা লজ্জায় যেন মাটির সাথে মিশে যেতে চাইল। কিন্তু হৈমবতীদেবী তার উদ্দেশ্যে বললেন, “অর্চু সোনা মা। আয় আমার কাছে আয় মা”।
অর্চনার মন চাইলেও তার পা দুটো যেন মেঝের সাথে আঁটকে গেছে। পা দুটোকে অসম্ভব ভারী বলে মনে হচ্ছিল তার। কিছুতেই যেন এগোতে পারছিল না। আর তার মনের মধ্যে হঠাতই যেন একটা ঝড় বইতে লাগল। এতদিন ধরে রচনা, নবনীতা আর সীমন্তিনীর মুখে পরিতোষের কথা শুনতে শুনতে, পরিতোষ কিভাবে রচনাকে বিপদমুক্ত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিভাবে রচনা আর রতীশের ওপর সর্বদা নজর রেখে যাচ্ছিল, এ’সব শুনতে শুনতে তার মনটাও যেন পরিতোষের ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ক’দিন আগে লোকটা যখন এখানে এসেছিল তখন তার সাথে যতটুকু কথা সে বলেছে তাতে তারও মনে হয়েছিল যে পরিতোষ সত্যিই খুব সুন্দর মনের একটা লোক। পরদিন সকালে পরিতোষ তাদের কালচিনির বাড়িতে পৌঁছোবার পর যা যা হয়েছে তাতে একদিকে সে মনে মনে যেমন খুশী হয়েছিল, অন্যদিক দিয়ে সে এটাও বুঝতে পেরেছিল যে তার দিদিভাই এতদিন ধরে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সে প্রচেষ্টার সকারাত্মক পরিণতি বোধহয় আর হবে না। তবু সে পরিণতির কথা চিন্তা না করেও তার মন চাইছিল পরিতোষকে যেন তার পিসি আপন করে কাছে টেনে নেন। এ ভাবনা যে তার মনে কেন এসেছিল সেটা সে আগে বুঝতেও পারেনি। কিন্তু তার দিদিভাই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসবার পর তার সম্মুখে সে যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, তখন তার দিদিভাইই ধরে ফেলেছিলেন যে সে মনে মনে পরিতোষকে ভাল বেসে ফেলেছে। তখন সে নিজেও তার দিদিভাইয়ের কথা মনে মনে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সে’সময়েই তার দিদিভাই তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মনে মনে আগেই কোন রঙিন স্বপ্ন যেন সে না দেখে। তার দিদিভাই যে তাকে যথার্থ উপদেশই দিয়েছেন এ ব্যাপারে তার মনে একবিন্দু সন্দেহও নেই। কিন্তু তার মনের আয়না থেকে পরিতোষের ছবিটাকে সে যেন কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিল না। পরিতোষের পিসি পিসেমশাইরা আসবার পরেও তার মনের শঙ্কা কিন্তু ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছিল। যে মূহুর্তে গেস্টরুমের আলোচনার সময় পরিতোষের পিসি পিসেমশাইরা তার দিদিভাই আর নবনীতাকে রাজী করাবার চেষ্টা করছিলেন, তখনও তার মনটা যেন দ্বিধাবিভক্ত ছিল। কিন্তু তার দিদিভাই আর নীতাদি যখন পরিস্কার ভাবেই সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে তারা কোন অবস্থাতেই পরিতোষকে বিয়ে করবেন না, তখন অর্চনা ভেবেছিল, এবার বুঝি নিরঞ্জনবাবুরা তাদের পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে নীতাদি আর দিদিভাইয়ের সাথে আলোচনা করবেন। কিন্তু সেটা না করে যখন তারা এটা জানতে চাইলেন যে দিদিভাই আর নীতাদি মিলে কোন মেয়েটাকে পছন্দ করেছেন, তখন এবার তার কথা অবধারিত ভাবে উঠে আসবে ভেবেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। তার মনে হচ্ছিল সে তখনই ও’ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আর তার দিদিভাইও নিশ্চয়ই এটাই অনুমান করেছিলেন। তাই তিনি লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করবার অজুহাত দেখিয়ে তাকে সে ঘর ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রান্নাঘরে এসেও সে লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করবার মত তেমন কিছুই করেনি। তার বুকের ভেতরটা একই ভাবে ধকধক করে যাচ্ছিল। তার মনের ভেতরটা যেন একনাগাড়ে উথাল পাথাল হচ্ছিল। তার উদ্বেগ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তার মনে হচ্ছিল তার হৃৎপিণ্ডটা বুঝি তার গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার বেশ কিছুক্ষণ পর পরিতোষের পিসি জোরে তার নাম ধরে ডেকে উঠতেই তার চিন্তাভগ্ন হয়েছিল। সে ভেবেছিল হৈমবতী দেবীর শরীরটা বোধহয় ভাল নেই। এটা ভেবেই সে ছুটে এসেছিল এ’ঘরে। কিন্তু এ’ঘরে ঢুকেই নবনীতা, সীমন্তিনী আর সুলোচনার কথা শুনেই সে বুঝে গিয়েছিল, যে গত সাত আটদিন ধরে সে মনে মনে যে স্বপ্নটা দেখতে শুরু করেছিল, সেটা বোধহয় এবার বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। আর তখনই যেন দুনিয়ার লজ্জা এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল। নিজের লজ্জা লুকোতে সে আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তার দিদিভাইয়ের পেছনে গিয়ে নিজের মুখ লুকোতে চাইছিল। পিসির আহ্বানেও সে যেন আর নড়তে পারছিল না।
নবনীতা অর্চনার অবস্থা বুঝে নিজে এগিয়ে এসে অর্চনার একটা হাত ধরে তাকে টানতে টানতে বলল, “এসো অর্চু, পিসি, পিসো আর বৌদিকে প্রণাম করো”।
কিন্তু অর্চনা হঠাৎ করেই ও’পাশ দিয়ে ঘুরে সীমন্তিনীর পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে তার কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে ‘হু হু’ করে কেঁদে ফেলল। ঘরের আর বাকি সকলেই এটা দেখে অবাক হলেও সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নবনীতাকে বলল, “একটু দাঁড়া নীতা। ওকে দুটো মিনিট সময় দে। তুই তো বাড়ি ছিলিস না। বেচারী বিকেল থেকেই বড্ড টেনশনে ছিল রে। আমি বাড়ি এসে ওর মুখ চোখ দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। আর ওকেও তো কোনও দোষ দেওয়া যায় না। পিসিদের এখানে আসবার কথা শুনেই ও বুঝে গিয়েছিল যে পিসিরা এখানে কোন উদ্দেশ্যে আসছেন। আর আমরাও তো ভেবেছিলুম যে ওকে আর পরিকে নিয়ে আমরা এতদিন ধরে যা কিছু ভাবছিলুম তা বোধহয় আর বাস্তবরূপ নেবে না। ও নিজেও হয়তো তেমনটাই ভেবেছিল। আমিও একই আশঙ্কা করে সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত ওকে নানা ভাবে বুঝিয়েছি যে পিসিরা যদি সত্যি অন্য কোনও মেয়ের সাথে পরির বিয়ে দিতে চান তাহলে ওকে নিজেকে সামলাতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। আর আমি ওকে সব সময় আগলে আগলে রাখব। কিন্তু গত সাতদিন ধরে ওর মনের মধ্যে যে ভাবনা তোলপাড় করছিল, সেটা ও মুখ ফুটে আমাদের কাউকে বলেনি। আমার মনে কিছুটা সন্দেহ হলেও কথাটা আমি তোকে বা ওকে বলিনি। কিন্তু মনে মনে আমিও বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিলুম। সন্ধ্যের সময়েই কথায় কথায় আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে আমার সন্দেহটাই সত্যি। ও মনে মনে পরিকে ভাল বেসে ফেলেছে। তাই ওকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলুম যে এখন থেকেই যেন মনে মনে কোন স্বপ্ন ও সাজিয়ে না বসে। এইটুকু জীবনে বিনাদোষে কম কষ্ট তো ও পায়নি। আমি চাইনি পরিকে ভালবেসে তাকে নিজের করে নিতে না পেয়ে ও আরেকটা কষ্ট পাক। এই মূহুর্তে হঠাৎ করেই ও বুঝে গেল যে ও মনে মনে যে স্বপ্নটা দেখেছিল, সেটাই সত্যি হতে চলেছে। তাই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। ওর ভেতরের সমস্ত উদ্বেগ সমস্ত আশঙ্কা এখন চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসছে। ওকে একটু সামলে নিতে দে”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে সুলোচনা উঠে এসে অর্চনার গা ঘেঁসে বসে বললেন, “পাগলী মেয়ে, তোমাকে না আমি আগেই বলেছি যে আমাকে তুমি বৌদি নয় দিদি বলে ডাকবে। সেটা কি এমনি এমনি বলেছি”?
অর্চনার দমকে দমকে কান্না দেখে মনে হল সুলোচনার কথা বুঝি তার কানেই যায়নি। এবার হৈমবতীদেবী এসে অর্চনার আরেকপাশে বসে দু’হাতে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস নে মা। একদম কাঁদিস নে। তুই তো জানিস না, দু’মাস আগে আমি যখন চুয়াল্লিশ বছর পর তোর বাবাকে দেখতে পেলুম, আর তার মুখে তোদের সকলের কথা শুনলুম, সেদিনই ভেবেছিলুম আমার যদি আরেকটা ছেলে থাকত, তাহলে তোকেই আমি তার বৌ করে আমার ঘরে নিয়ে আসতুম। ভগবান বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি দয়া করে পরিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু কুলীন ',ের মেয়ে হলেও চুয়াল্লিশ বছর আগেই তো আমি ', সমাজচ্যুত হয়ে গিয়েছিলুম। আর তোর বাবাও যে তোর দ্বিতীয় বিয়ে দিতে রাজী হবেন এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আমি তো জানি, বিধবা বিবাহ এ যুগেও খুব সহজ ভাবে কেউ মেনে নিতে পারে না। আর তুই হলি একটা গোঁড়া ', ঘরের বিধবা মেয়ে। তাই গত সাত আটদিনে আমরা সকলে অনেক ভেবেও বিধুর কাছে আমার পরির জন্য তোর সম্মন্ধের কথা ওঠাবার সাহস জোটাতে পারছিলুম না। একটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছিল, আর পরির বিয়ে নিয়ে আমাদের চিন্তা বাড়ছিল। শেষে মন্তি আর নীতার শরণাপন্নই হতে হল আমাদের। পরির মুখে এদের দু’জনের সাথে ওর সম্পর্কের সবকিছুই আমরা শুনেছি। পরি শুধু আমাদের একটা কথারই জবাব দেয় নি। অবশ্য সে’ কথাটার জবাব আমি এতক্ষণে পেয়ে গেছি। এখানে আসবার আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল মন্তি বা নীতা যে কোন একজনকে বিয়েতে রাজী করানো। সেটা যদি কোনভাবেই সম্ভবপর করে না তুলতে পারি তাহলে ওরা পরির জন্য আগে যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছিল, সে মেয়ের সাথেই পরির বিয়ে দেবার চেষ্টা করব। প্রথম উদ্দেশ্যটা সফল না হতে, ওদের কাছে ওই মেয়েটার ব্যাপারে যখনই জানতে চাইলুম তখনই মন্তি তোকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিতেই আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, সেটা তুইই। অবশ্য এমন একটা ধারণা আমরা আগেও করেছিলুম, যখন শুনেছিলুম এই মন্তি মা-ই বিধুর মা অন্নপূর্ণা। তারপর তোর নাম উল্লেখ না করে মন্তি যা কিছু বলল তাতে আমাদের আর কারো বুঝতে বাকি রইল না। আমরা তো তোকে দেখার আগেই, শুধু তুই বিধুর মেয়ে বলেই, সকলেই তোকে পছন্দ করে ফেলেছিলুম। শুধু তোর বাবার কাছে প্রস্তাবটা দিতে পারছিলুম না। এখন বুঝতে পারছি, মন্তি সে কাজটা সেরে ফেলেছে। এবার তো আর ভাবনার কিছু রইল না। আমাদের অবশ্য তেমন কোনও লাভ হল না। আমি আগেও যেমন তোর পিসি ছিলুম তোদের বিয়ের পরেও তাই থাকব। তবে তফাৎ শুধু এটুকুই যে আগে এক তরফ থেকে পিসি ছিলুম, এখন দু’তরফেই পিসি হব। আয় না মা, এ খুশীতেই তোকে একটু আদর করি আমি”।
এবার আর অর্চনা নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। “পিসি” বলে হৈমবতীদেবীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। হৈমবতীদেবী অর্চনার গালে কপালে আর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বারবার তাকে কপালে আর গালে চুমু খেতে লাগলেন। এ দৃশ্য দেখে সীমন্তিনী নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। তার দু’চোখ বেয়েও জলের ধারা বইতে শুরু করল। নবনীতা তা দেখে সীমন্তিনীর চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “কাঁদছ কেন দিদি? আজ আমাদের কত বড় একটা খুশীর দিন বলো তো? আমাদের পরির সংসার গুছিয়ে দিতে পারছি আমরা। তোমার অর্চুসোনার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আজকের দিনে এ’ভাবে চোখের জল ফেলতে আছে”?
নবনীতার নিজের চোখ থেকেও যে জলের ধারা নামতে শুরু করেছিল তা যেন সে বুঝতেই পারেনি সে। সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে নবনীতার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস। তুইও যে কাঁদছিস, সেটা বুঝতে পারছিস না পাগলী”?
নবনীতা চোখে জল নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “জানি তো দিদি। আমরা দু’জনেই কাঁদছি। এমন খুশীর খবর জানতে পারলে চোখ থেকে এমনিই জল বেরিয়ে আসে গো। তোমার চোখের জলও যে কান্নার অশ্রু নয়, সেটাও আমি জানি। কিন্তু এখন তো এভাবে বসে বসে কাঁদলে চলবে না। এ সুখবরটা যে সবাইকে জানাতে হবে গো”।
সুলোচনা অর্চনাকে ধরে হৈমবতীদেবীর থেকে আলাদা করতে করতে বললেন, “আয় বোন। আমিও একটু তোকে আদর করি” বলে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরলেন।
নবনীতা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে বলল, “ও লক্ষ্মীদি, মিষ্টি কোথায় গো? শিগগীর বের করো। একটা প্লেটে সাত আটটা মিষ্টি বেড়ে দাও তাড়াতাড়ি”।
লক্ষ্মী নবনীতাকে ছটফট করতে দেখে অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে ছোড়দি? তুমি এমন করছ কেন”?
নবনীতা খুশীতে লক্ষ্মীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কী হয়েছে মানে? তোমার সোনাদির বিয়ে ঠিক হল গো। আর কার সাথে জানো? তোমার বড়দার সাথে গো”?
লক্ষ্মী বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি ছোড়দি? বড়দার সাথে আমার সোনাদির বিয়ে? সত্যি বলছ তুমি? আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না গো”।
নবনীতা আগের মতই আনন্দোচ্ছল ভাবে বলল, “হ্যাঁগো লক্ষ্মীদি, সেজন্যেই তো বলছি তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে ও’ঘরে এস। মিষ্টিমুখ করতে হবে তো। শাঁখ বাজাতে হবে। উলু দিতে হবে। ওঃ আমি তো উলু দিতে পারি না। তুমি উলু দিতে পার তো লক্ষ্মীদি”?
লক্ষ্মী একটা বড় প্লেটে মিষ্টি সাজাতে সাজাতে আনন্দের সাথে বলল, “হ্যাঁ ছোড়দি। পারি। তুমি তাহলে ঠাকুরঘর থেকে শাঁখটা নিয়ে ও’ঘরে যাও। আমি মিষ্টি আর জল নিয়ে যাচ্ছি”।
এদিকে ও’ঘরে সুলোচনা অর্চনাকে আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, “যা বোন, মা বাবাকে প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ নে”।
অর্চনা ততক্ষণে অনেকটাই সামলে উঠেছে। সুলোচনার কথা শুনে সীমন্তিনীর দিকে চাইতেই সীমন্তিনী এগিয়ে এসে অর্চনাকে নিয়ে নিরঞ্জনবাবুর সামনে দাঁড় করাতে অর্চনা নিচু হয়ে হাঁটু মুড়ে নিরঞ্জনবাবুকে প্রণাম করল। তারপর হৈমবতীদেবী আর সুলোচনাকেও প্রণাম করল। তারা তিনজনেই অর্চনাকে আশীর্বাদ করবার পর সুলোচনা নিজের গলা থেকে মোটা ভারী একটা সোনার হার খুলে অর্চনার গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “এটাকে তোর বিয়ের আশীর্বাদী বলে ভাবিস না অর্চু। এটা আজ আমি তোর দিদি হিসেবে তোকে উপহার দিচ্ছি। আজ থেকেই তুই আমার ছোট বোন হয়ে গেলি কিন্তু। তাই তোকে এখন থেকে আর ‘তুমি তুমি’
করে নয়, ‘তুই’ বলে সম্বোধন করব”।
______________________________