Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 243)

গেস্টরুমে এসে দেখে লক্ষ্মী সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিচ্ছে। সে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “পিসি, পিসো, আমায় ক্ষমা কোর। তোমাদের বসিয়ে রেখে এতক্ষণ ও’ঘরে ছিলুম বলে। আসলে বাথরুম থেকে বেরোবার সময়েই এসপি অফিস থেকে একটা ফোন এসেছিল। তাদের সাথে কথা বলতে বলতেই একটু দেরী হয়ে গেল”।

হৈমবতীদেবী বললেন, “ঠিক আছে মা। তাতে কিছু হয়নি। আমরা তো আর এক্ষুনি চলে যাচ্ছি না। আর আমাদের আলোচনা করতে অনেকটা সময় লাগবে বলেই তো এখানে রাতে থাকব বলে এসেছি। আর তুমি যে কতটা ব্যস্ত থাকো, সে’ কথা তো পরির মুখেই শুনেছি”।

সীমন্তিনী নিজের চায়ের কাঁপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “আসলে আমার ল্যান্ডলাইন ফোনটা তো আমার ঘরে। আর সেটার রিংটোন এ’ ঘর থেকে প্রায় শোনাই যায় না। আগে দু’বার নাকি তারা ওই নাম্বারে ফোন করেছিল। আমরা সবাই এখানে কথায় ব্যস্ত ছিলুম বলেই টেরই পাইনি। আচ্ছা, সে’ কথা বরং থাক। আমরা বরং যে ব্যাপারে কথা বলছিলুম সেটা নিয়েই কথা বলি”।
 

সীমন্তিনী আবার চায়ের কাপ ঠোঁটে ছোঁয়াতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “মন্তি মা, তার আগে আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছি মা। তুমি কিছু মনে করবে না তো”?

সীমন্তিনী একটু থমকে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ পিসি, বল না কী বলবে”?

হৈমবতীদেবী বললেন, “পরির মুখেই শুনেছি ও নীতাকে একটা সময় খুব ভালবাসত। আমার ভাই দুর্গা বেঁচে থাকতে ওদের দু’জনের বিয়েতে মতও দিয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরই কেমন নিষ্ঠুর একটা খেলা খেললেন ওদের নিয়ে। দুর্গাও চিরতরে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। আর নীতাও পরির জীবন থেকে হারিয়ে গেল। নীতার সাথে এতক্ষণ আমরা ওই সব নিয়েই আলোচনা করছিলুম। পরি নিজেই বলেছে যে এতসব ঘটণার পরেও নীতাকে বিয়ে করতে ও রাজি আছে। কিন্তু নীতা নিজেই আর এতে রাজি হচ্ছে না। আর আমি এটাও জানি যে নীতা ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাবার অনেকদিন পর পরির জীবনে তুমি এসেছিলে। কিন্তু তোমাদের দু’জনের মধ্যে ভালবাসাবাসির কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠবার আগেই তুমি পরিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। বুঝিয়ে দিয়েছিলে তাকে, তুমি কেন বিয়ে করবে না। তবে পরির সাথে এখনও তোমাদের দু’জনেরই বন্ধুত্ব অটুট আছে। আর এ’ ক’দিনে আমরা খুব ভালভাবে বুঝে গিয়েছি যে তোমরা দু’জনই পরির সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে বড় হিতৈষী। আমি নিজেও একজনকে ভালবেসেই বিয়ে করেছি। তাই নিখাদ ভালবাসা হলে সকলের ভালবাসাকেই আমি ও তোমাদের পিসো শ্রদ্ধা করি। আজ পরির অভিভাবক হিসেবে আমরা যখন ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি, তখন মনে হল তোমাদের দু’জনের সাথেই সবার আগে আমাদের কথা বলা উচিৎ। তোমাদের দেখে আমারও মনে হচ্ছে পরি যদি তোমাদের কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী করে নিতে পারে, তাহলে ও সত্যিই খুব সুখী হবে। আমরাও সকলেই কিন্তু তোমাদের দু’জনের সব কথা জেনেও তোমাদের যে কাউকে ওর স্ত্রী হিসেবে দেখতে পেলে খুব খুশী হব। তাই বলছি মা, তোমরা দু’জনেই ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দ্যাখ না”।

সীমন্তিনী এক মূহুর্ত সময় না নিয়েই বলল, “পিসি, আমি তোমাদের সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েই বলছি, আমার পক্ষে পরির ওই প্রস্তাবটা মেনে নেওয়া আগেও যেমন সম্ভব ছিল না, এখনও একই রকম অসম্ভব। আর আমি যতদিন বেঁচে থাকব, অমনটা কিছুতেই সম্ভব হবে না। তোমরা হয়ত নীতার সব কথাই পরির মুখে শুনে থাকবে, কিন্তু আমার মনে হয় না আমার রাজী না হবার পেছনে যে কারনটা আছে সেটা পরি তোমাদের বলতে পারে। যদিও পরিই এ পৃথিবীতে একমাত্র লোক যে আমার জীবনের ওই অধ্যায়টুকু জানে। তবে ও আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে সেটা প্রকাশ করবে না কোনদিন। ভালবাসাবাসির সম্পর্ক আমাদের মধ্যে না হলেও পরি যে আমাকে দেওয়া কথার খেলাপ কোনদিন করবে না, ওর ওপর সে বিশ্বাস আমার আছে। ওর সাথে আমার যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বছর তিনেক আগে শুরু হয়েছে, সে সম্পর্কের ওপর পুরো আস্থা আছে আমার। তাই আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে তোমাদের কাছেও ও সেটা প্রকাশ করেনি। আর তোমাদের সবাইকেও আমি অনুরোধ করছি পিসি, তোমরাও কেউ ও ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমি সে ব্যাপারে তোমাদের একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারব না। তবে মোদ্দা কথা এটাই যে আমি সারাটা জীবনই এমনভাবেই একা কাটিয়ে দেব। আমার বাড়ির লোকেরাও কেউই মন থেকে আমার এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি বলে আমি নিজেই নিজেকে সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছি। তাতে আমি সুখী আছি না কষ্টে আছি, সেটা ভাববার চেষ্টাও করিনা কখনো। তবে ভাল মন্দ যাই হোক না কেন, আমার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি এভাবেই থাকব”।

হৈমবতীদেবী মন দিয়ে সীমন্তিনীর কথাগুলো শুনে, নিজের সোফা থেকে সীমন্তিনীর পাশে এসে তার মাথায় হাত রেখে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “বুঝতে পারছি মা। ভালবাসা বড় সাংঘাতিক জিনিস। ভালবেসে যেমন অনেকে অনেক কিছু পায়, তেমনই অনেকে অনেক কিছু হারিয়েও বসে। আমি নিজেও তো কতকিছু হারিয়েছি। তুমিও হয়ত অপরিণত বয়সেই না জেনে না বুঝে কোন একটা ভুল করে ফেলেছিলে। আর সেই ভুলটাকেই তোমার মনের ভালবাসার আসনে বসিয়ে সারা জীবন ভর সে ভুলের খেসারত দিতেও তুমি পিছ-পা হবে না। পরি ঠিকই বলেছিল। ও আমায় বলেছিল যে যারা ভালবাসাকে সম্মান দিতে জানে, তারা তোমার ভালবাসার কাছে মাথা না নুইয়ে থাকতে পারবে না। তোমাকে আমাদের পরির বৌ হিসেবে কাছে পেলে আমরা সত্যিই খুব সুখী, খুব গর্বিত হতুম মা। তবু তোমার কথা শুনে কষ্ট হলেও নিজের মনের ভাবনাটাকে সরিয়ে ফেলে তোমার ভালবাসাকে আমি প্রণাম করছি মা। আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, আমি সারাটা জীবনে যদি ছিটেফোঁটা পূণ্যও অর্জন করে থাকি, ঈশ্বর সে পূণ্যের ফল যেন তোমার ভাগ্যের খাতায় যোগ করে দেন। বেঁচে থেক মা। ভাল থেক”।

নিরঞ্জনবাবু এবার বললেন, “ঠিক বলেছ হিমু। ভাল তো আমরাও বেসেছিলাম। আমাকে ভালবেসে তুমিও তো কম কষ্ট পাওনি। তবু অত কষ্ট সয়েও আমরা তো একে অপরকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পেরেছি। কিন্তু এমন ভালবাসার কথা তো শুধু গল্প উপন্যাসেই পড়েছি আমি এতদিন। বাস্তব জীবনে এমনভাবে যে কেউ কাউকে সত্যি ভালো বাসতে পারে তা আজ মন্তি-মার মুখোমুখি বসেই জীবনে প্রথমবার উপলব্ধি করলুম। ভালবাসার মাপদণ্ড থাকলে অন্য যে কারো ভালবাসা ওর ভালবাসার কাছে তুচ্ছ এবং হাল্কা প্রমাণিত হত। আমি বয়সে ওর থেকে অনেক বড়। তাই ও তো আমার প্রণাম স্বীকার করবে না, জানি। তবে মনে মনে আমিও ওর ভালবাসাকে প্রণাম জানাই। ঈশ্বর ওকে সুখে রাখুন, ভাল রাখুন”।

ঘরের প্রত্যেকেই কয়েকটা মূহুর্ত একেবারে চুপচাপ রইল। হৈমবতীদেবী আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসতে সুলোচনাদেবী বললেন, “সীমন্তিনী, বড় আশা নিয়ে এসেছিলুম তোমার কাছে ভাই। আর গাড়ি থেকে নেমে তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিল এমন একটা ছোট-জা পেলে আমরা ও বাড়ির তিন বৌয়েরই আনন্দের সীমা থাকবে না। কিন্তু তুমি আমাদের আবেদন উপেক্ষা করলেও আমরা কেউই কিন্তু তোমার ওপর রাগ করতে পারছি না। মা-বাবার মত একই সুরে সুর মিলিয়ে আমিও তোমাকে প্রানভরা আশীর্বাদ করছি। তবে ভাই, যার সাথেই ভাইদার বিয়ে হোক না কেন, চিরদিন তুমি ওর বন্ধু হয়ে ওর পাশে থেকো। আমি জানি, রাজগঞ্জে তোমার বাপের বাড়ির সকলের কাছ থেকে অনেকদিন আগেই তুমি নিজেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছ। কিন্তু বিধুমামু আর মামীর মুখে শুনলুম, তারাই নাকি এখন তোমার আপনজন। বিধুমামু, মামী, কিংশুক, অর্চনা, রচনা, রচনার বর আর এই নীতা আর লক্ষ্মীদি, এদের সকলকে নিয়েই তুমি বেঁচে আছ। তবে ভাই, আজ থেকে তোমার ওই লিস্টে সুলোচনা নামটাও ঢুকিয়ে দিও। আর চিরদিন মনে রেখো, সুলোচনা নামে তোমার এক দিদি রইল আলিপুরদুয়ারে। তার কথাটাও মাথায় রেখ ভাই”।

সীমন্তিনী ম্লান হেসে বলল, “আমার সৌভাগ্য। এতদিন দিদি বলে ডাকবার মত কেউ ছিল না আমার। আজ একটা দিদি পেলাম। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে কি আর জোর করে কিছু বলা যায় বড়বৌদি। তবে হ্যাঁ, এটুকু অন্ততঃ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পরি আমার পরম বন্ধুই থাকবে। তবে আমার মনে হয় এখন আমাকে নিয়ে আর কোনও জল্পনা কল্পনা না করে পরির বিয়ের প্রসঙ্গেই কথা বলা ভাল। আমি তো এখনও নীতাকে বলি পরির সাথে বিয়েতে ও রাজি হোক। পরি তো এখনও ওকে বিয়ে করতে রাজী আছে। কিন্তু আমি আর রচু মিলে ওকে নানাভাবে বুঝিয়েও রাজী করাতে পারিনি। এখন তোমরা চাইলে ওর সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলে দেখতে পার। তোমরা যদি ওকে রাজী করাতে পারো, তাহলে শুধু পরি নয় আমরা সকলেই খুব খুশী হব”।
 

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “হ্যাঁ, মন্তি-মা ঠিক কথাই বলেছে। আচ্ছা মা নীতা, আমরা পরির অভিভাবক হিসেবে তোমার কাছে সে আবেদন করলেও কি তুমি সেটা রাখবে না”?

নবনীতা একবার সীমন্তিনী আর অর্চনার দিকে দেখে মাথা নিচু করে বলল, “দিদির মত করে ভালবাসতে আমি শিখিনি কোনদিন। সারা জীবন ভর চেষ্টা করলেও আমি তেমন করতে পারব না। কিন্তু সত্যি বলছি পিসো, পরিকে আমি একটা সময় মনেপ্রাণেই ভালবাসতাম। ওকে নিয়ে আমি সংসার বাঁধবার স্বপ্নও দেখেছিলাম। পরির বাবাও আমাদের দু’জনের ভালবাসার কথা শুনেই মৌখিকভাবে আমাকে তার পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরি হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ যাবার আগেই উনি আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, পরির ট্রেনিং শেষ হবার পরেই আমাকে তার পুত্রবধূ বানিয়ে তার সংসারে নিয়ে তুলবেন। কিন্তু ভগবান ওই সুযোগটুকু আর আমাদের কাউকে দিলেন না। পরির বাবার শ্রাদ্ধ আর মৎস্যমুখী শেষ করে পরি আমার কথায় নিজেই উদ্যোগী হয়ে আমার মা-বাবার কাছে গিয়ে আমাকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমার মা-বাবাও তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। তখন সবাই মিলে স্থির করেছিল যে পরির বাবার ইচ্ছানুযায়ী পরির ট্রেনিং শেষ হবার পরই আমাদের বিয়ে হবে। সে’ দিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে খুশী আর আনন্দের দিন ছিল। কিন্তু ওই খুশীটুকু যে এতটাই ক্ষণস্থায়ী ছিল সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। পরির সাথে সংসার বাঁধবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে’দিন রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা বুঝতেও পারিনি। ঘুমের মাঝেই .......”

নবনীতার পাশে বসা সুলোচনা নবনীতার একটা হাত ধরে অপর হাতে তার মুখ চেপে ধরে বলল, “থাক নীতা। ওই কথাগুলো আর তুলো না প্লীজ। সেই রাতের পর থেকে পরের সাতটা বছরে তোমার ওপর দিয়ে যা কিছু ঝড় ঝাঁপটা বয়ে গেছে, তার সব কিছুই ভাইদা আমাদের খুলে বলেছেন। ওই কথাগুলোর আর পুনরাবৃত্তি কোর না ভাই। আমাদের কারোরই ভাল লাগবে না। তবে আমরা সকলে সে’সব কথা জেনেও তোমাদের দু’জনের বিয়ে দিতে রাজী আছি। তুমি শুধু রাজী হয়ে যাও ভাই। ভাইদা তো রাজীই আছে। তাহলে নিজের ভালবাসার লোকটার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা তুমি কেন ধরছ না ভাই”?
 

নবনীতার চোখ দিয়ে তখন জল গড়াতে শুরু করেছে। সুলোচনা নবনীতাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে তার চোখের জল মোছাতে মোছাতে বললেন, “কেঁদো না ভাই। বিনাদোষে তুমি সাতটা বছর ধরে তো অনেক কেঁদেছ। এবার ভগবান যখন তোমাকে সুযোগ দিচ্ছেন, সে সুযোগটা তুমি হাতছাড়া কোর না বোন, প্লীজ”।

নবনীতার কথা শুনতে শুনতে অর্চনার চোখ দুটোও জলে ভরে এসেছিল। সীমন্তিনীর একটা কাঁধ চেপে ধরে সে নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নার শব্দ আটকালো। নবনীতা অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে সুলোচনার একটা হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “তা হয় না গো বড়বৌদি। তা আর আমার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। যাকে একটা সময় মনে মনে দেবতার আসনে বসিয়ে পূজো করেছি, তার হাতে নিজের এই নোংড়া শরীরটা আমি কিছুতেই তুলে দিতে পারব না। আমি তো পুরোপুরি পাঁকে তলিয়ে গিয়েছিলাম। মন্তিদির সাথে যেদিন আমার দেখা হল, সেদিনই বুঝি আমার পূনর্জন্ম হয়েছিল। দিদি সেই প্রথম দিনেই আমাকে নিয়ে এসেছিল। দিদি আর রচনাবৌদির জন্যেই আজও আমি বেঁচে আছি। আর দিদির এখানে এসে তো খুব সুখেই আছি। এখন আমার স্বপ্ন বলতে শুধু দুটোই বাসনা। চিরটা কাল আমি যেন দিদির পাশে থাকতে পারি। আর পরিকে যেন আমি সুখী সংসারী হতে দেখতে পারি। আর কিচ্ছুটি আমি চাই নে। তোমরা পরির জন্য অন্য কোনও মেয়ে দেখ। পরি যদি তাকে বিয়ে করে তাহলে আমরাও খুব খুশী হব”।

এ’কথা শুনে ঘরের সকলেই আরও কিছুক্ষণ নীরব নির্বাক হয়ে রইল। তারপর সুলোচনাই প্রথম কথা বললেন, “এতগুলো বছর ধরে নিজেকে অনাথ ভেবে আসা আমাদের ভাইদা যে ভালবাসার দিক দিয়ে এতোটা ভাগ্যবান, সেটা বুঝতে পেরে আমার এখন ভাইদাকে প্রচণ্ড হিংসে হচ্ছে মা। এমন দু’দুটো লক্ষ্মী প্রতিমার মত মেয়ে আমাদের ভাইদাকে এ’ভাবে ভালোবাসে যে তার সুখের জন্যেই এরা নিজেদের সুখ বিসর্জন দিতে রাজী”।

এবার নিরঞ্জনবাবু বললেন, “বড়বৌমা, সে তো তুমি একেবারে ঠিক কথাই বলেছ। মা বাপ মরা আমাদের পরিকে এমন দু’দুটো পরী যে আগলে রেখেছে, এ’ভাবে তার মঙ্গল কামনা করছে এ’সব কথা পরির মুখ থেকে শোনবার পরেও আমার যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। আজ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। কিন্তু মা, এখন তাহলে আমরা কি করব বলো তো? এদের মত আরেকটা পরী আমরা পরির জন্য কোত্থেকে খুঁজে বের করব এখন”?
 

হৈমবতীদেবী বললেন, “আমাদের প্রথম প্রয়াসটা যে ব্যর্থ হল, তা তো পরিস্কার বোঝাই গেল। এবার দ্বিতীয় প্রয়াসটাই না হয় করে দেখা যাক”।

সুলোচনা বললেন, “হ্যাঁ মা, সেই ভাল”।

হৈমবতীদেবী এবার সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বললেন, “এ’কথাটা অবশ্য তোমাদের পিসো আগেই উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তখন আমি তাতে বাধা দিয়ে তোমাদের দু’জনের ব্যাপারটা আগে খতিয়ে দেখলুম। কিন্তু তাতে কাজ তো হল না। এবারে সেই প্রসঙ্গে আসছি। আচ্ছা মন্তি, পরির মুখেই শুনেছি যে ওর নিজের জন্য পাত্রী পছন্দ করবার দায়িত্ব ও তোমাদের দু’জনকে দিয়েছে। আর তোমরাও নাকি ওর জন্যে একটা ভাল মেয়ে খুঁজেও পেয়েছ”।

এ’টুকু শুনেই সীমন্তিনী বলে উঠল, “এক মিনিট পিসি” বলে অর্চনার দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্চু সোনা, আমরা সবাই তো এখানে বসে আছি। লক্ষ্মীদি একা বোধহয় হিমশিম খাচ্ছে রে। তুই একটু রান্নাঘরে গিয়ে দেখ না বোন”।
 

অর্চনা সীমন্তিনীর ঈঙ্গিত বুঝতে পেরে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ দিদিভাই, দেখছি আমি” বলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী তখন বলল, “পিসি, তোমাদের তো ও’কথা আগেই বললুম। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কোনও চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি এখনও। একটা মেয়েকে আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছিল। আমাদের মনে হয়েছিল মেয়েটা সত্যিই পরির উপযুক্ত। কিন্তু এমন কয়েকটা ব্যাপার আছে যা সাবেকি আর সম্ভ্রান্ত ঘরের লোকেরা মেনে নিতে পারবে না। হয়ত তোমাদের পক্ষেও সেগুলো মেনে নেওয়া কঠিন হবে। কিন্তু সত্যি বলছি পিসি, আমরা তো আর আগে ভাবিনি যে পরির অভিভাবক হিসেবে কেউ এগিয়ে আসবেন, পরিকে কাছে টেনে নেবেন, ওর বিয়ের দায়িত্ব নেবেন। আমাদের চিন্তাধারা আমাদের মানসিকতার সাথে তোমাদের ভাবনা চিন্তার তফাৎ হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। তবে আমার আর নীতার চিন্তাভাবনা আর পরির চিন্তাভাবনা এবং মানসিকতার মধ্যে অনেকটাই মিল আছে। আমি পরিকে প্রেমিক হিসেবে ভালবাসতে না পারলেও ও আমার জীবনের আদর্শ। আমার কর্মজীবনে ও আমার গুরু। আমি সব সময় ওকে অনুসরন করে চলতে চাই। ওর মত কাজ করতে চাই, ওর মত দক্ষ হতে চাই। তাই আমরা ভেবেছিলুম আমরা যাকে পছন্দ করব পরিও তাকে নিশ্চয়ই পছন্দ করবে। আর এ ব্যাপারে পরি আমাদের হাতেই সবটা ছেড়ে দিয়েছিল। তবে মেয়েটা নিজে এবং তার পরিবারের লোকেরাও প্রাথমিকভাবে আমাদের আবেদনে সাড়া দেয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে আমরা রাজী করাতে সক্ষম হয়েছিলুম। কিন্তু মেয়েটার ব্যাপারে সকলের চোখে আপত্তিকর যে ব্যাপারগুলো আছে, সে’সব নিয়ে সবার আগে আমি পরির সাথে কথা বলেছিলুম। পরি সেদিন আমায় বলেছিল যে আমার আর নীতার যদি পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তার নিজের আর কিছুই ভাববার নেই। তখন আমি ওই মেয়ে এবং তার মা-বাবার কাছে পরির ব্যাপারে সবকিছু জানাই। পরি কি কাজ করে, কোথায় থাকে, কেমন ছেলে, ওর পরিবারে পরি নিজে ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণী বলতে কেউ নেই, ওর আত্মীয় পরিজন বলতেও কেউ নেই, বিয়ের পর স্বামী ছাড়া মেয়েটা আর কাউকে কাছে পাবে না, এ সবই যথাযথ খুলে বলেছি তাদের। পরি যে বছর সাতেক আগে একসময় নীতাকে ভালবাসত, তারপর আমাকেও যে সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, আর আমরা দু’জনের কেউই যে পরিকে বিয়ে করতে পারছি না অথবা চাইনি, এ’ সমস্ত কথাই আমি তাদের খুলে বলেছি। মেয়ের বাড়ির লোকেরা সে’সব কথা শোনবার পরেও এ বিয়েতে মত দেয়। পরে আলাদাভাবে মেয়ের মনের ইচ্ছেটাও আমি জানতে পেরেছিলুম। মেয়ের বাড়ির লোকদের সাথে সম্ভাব্য বিয়ের দিন তারিখ নিয়েও কিছু আলোচনা হয়েছিল আমার। কিন্তু কোনকিছুই সে’ভাবে ফাইনাল করিনি। আসলে আমার মনে হয়েছিল, পরি মুখে যা-ই বলুক না কেন, আমাদের হাতে সবকিছুর অধিকার তুলে দিলেও বিয়ের ব্যাপারে পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নেবার আগে ও একবার মেয়েটাকে নিজের চোখে দেখে নিক। আমরা সেটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। সেদিন পরি যখন হঠাৎ করেই এখানে চলে এসেছিল তখন ভেবেছিলুম ও যদি দু’ তিনটে দিন এখানে থেকে যায়, তাহলে মেয়েটার সাথে ওর মুখোমুখি দেখা করিয়ে দেবার এবং কথা বলার সুযোগ করে দেব। কিন্তু ও তো মোটে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন সকালেই চলে গেল। আর সেটা করবার সুযোগ আমি পাই নি। আর সেদিনই তো তোমাদের কথা শুনতে পেলুম। তখনই আমাদের ভাবনা চিন্তা সেখানেই স্থগিত রেখেছি”।

একটানা এতগুলো কথা বলে থামতে নিরঞ্জনবাবু বললেন, “আচ্ছা মা, তোমার সব কথা তো খুব মন দিয়েই শুনলুম আমরা। পরির মুখেও এ ব্যাপারে আমরা অনেকটাই শুনেছি আগে। তোমাদের দু’জনের কথায় কোনও অসঙ্গতি নেই। তাই বুঝতে পারছি যে পরি আমাদের যা বলেছে তার সবটাই ঠিক। আর তোমাদের আর আমাদের মধ্যে এক জেনারেশনের গ্যাপ আছে সেটাও সত্যি। তবে মা, আমি ও তোমার এই পিসি দু’জনেই কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করি। আমার তিন ছেলের সাথেই আমি অনেকটা বন্ধুসুলভ আচরণই করে থাকি। অবশ্য বাড়িতে তো আমি খুব কম সময়ই কাটাই। রাতে ঘুমের সময়টুকু ছাড়া আমি দিনে মাত্র চার সাড়ে চার ঘন্টাই বাড়িতে থাকি। তাই আমাদের তিন বৌমাদের সাথে অতটা ফ্রি হয়ত হইনি। তবে আমরা কেউই বৌমাদের কাউকে ঘরের বৌ বলে ভাবি না। আর ওরা তিন জনই তাদের নিজেদের গুনেই আমাদের মেয়ে হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আর তাদের সকলের চিন্তাধারার সাথে আমাদের ভাবনা চিন্তার খুব একটা সংঘাত ঘটেনি কখনও। অবশ্য এর সবটাই যে আমাদের জন্যই হয়েছে তা বলা ভুল হবে। আমাদের পছন্দ অপছন্দ বুঝে বৌমারাও একই সমান প্রচেষ্টা করেছে। তাই ওরা সকলেই তোমার পিসির ছেলের বৌ থেকে তার মেয়ে হয়ে উঠেছে। সেটা হয়ত তোমরা এ মূহুর্তেই ঠিক বুঝতে পারবে না। তবে দু’চারদিন আমাদের বাড়ি গেলে তোমরা সেটা অনায়াসেই বুঝতে পারবে। তাই তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে আমাদের মনে হয় খুব বেশী কষ্ট হবে না”।
 

একটু থেমেই তিনি আবার বললেন, “তা মা, পরির ব্যাপারে তো মেয়ের বাড়ির লোকদের কাছে সব খুলে বলেছ এ তো বুঝলুম, কিন্তু মা, মেয়ের ব্যাপারে তো তুমি এখনও আমাদের কিছুই বললে না”।

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ পিসো, পরির মুখে তোমাদের বাড়ির অনেক কথাই আমরা শুনেছি। এমন একটা পরিবারের সকলেই ওকে আপন করে নিয়েছে শুনে আমরা সবাই খুব খুশী হয়েছি। তবে সত্যি বলছি পিসো, সে মেয়েটার ব্যাপারে তোমাদের সবকিছু খুলে বলতে আমার এখনও একটু দ্বিধাই হচ্ছে। আমার মন কেন জানিনা বলছে, এ সম্পর্ক হবার নয়। তবে তোমরা যখন জানতেই চাইছ তাহলে বলছি। মেয়েটা খুবই সুন্দরী। হাঁটা চলা, কথা বার্তা, আচার ব্যবহার অসম্ভব সুন্দর। পারিবারিক আর্থিক সঙ্গতি না থাকবার দরুন কলেজ কলেজের শিক্ষায় হয়ত বেশী এগোতে পারেনি, তবে নিজের মা-বাবার কাছে সাংসারিক সুশিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছে। রান্নাবান্না সহ ঘরোয়া সমস্ত কাজেই খুব চৌকস। পরির সাথে বয়সের ফারাক প্রায় সাত বছরের মত হবে। হাইটের দিক দিয়েও দু’জনকে বেশ ভাল মানাবে। তবে ওর বাবার আর্থিক অবস্থা এখন আগের মত অতটা খারাপ না হলেও এখনও খুব একটা সচ্ছল বলা যায় না। দেনা পাওনা যৌতুক দেবার সামর্থ তাদের নেই। তবে আমার মনে হয় সেটা খুব আপত্তিজনক কিছু নয়। কারন আমি জানি, পরি নিজেও যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবে না। কিন্তু মেয়েটা লেখাপড়ায় মোটে মাধ্যমিক পাশ, এটা একটা বড় নিগেটিভ পয়েন্ট। পরির মত একজন আইপিএস অফিসারের স্ত্রী নিদেন পক্ষেও গ্র্যাজুয়েট হওয়া উচিৎ। তবে তার চেয়েও আপত্তিকর ব্যাপার যেটা, সেটা হল .....” বলে একটু থেমে নবনীতার মুখের দিকে একবার দেখে বলল, “মেয়েটা বিধবা”।


______________________________
 
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 30-03-2020, 11:12 AM



Users browsing this thread: