Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 242)

হৈমবতীদেবী অর্চনার কথা শুনে বললেন, “হ্যাঁ, সে’কথা অবশ্য পরি নিজেও আমাদের বলেছে। তা তোমার দিদিভাই আর নীতা কি এরমধ্যে কোনও মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছে নাকি? এ ব্যাপারে তুমি কিছু জানো কি মা”?

অর্চনা খুব সতর্কভাবে সে প্রশ্নের জবাবে বলল, “তারা দু’জনে খোঁজাখুঁজি যে করছিলেন, সেটা জানি। তবে পিসি, তারা তেমনভাবে কাউকে পছন্দ করেছেন কিনা বা এ বিষয়ে আপনার ভাইপোকে কিছু জানিয়েছেন কি না, সেটা সঠিক বলতে পারব না আমি”।
 

হৈমবতীদেবী আবার কিছু বলে ওঠবার আগেই বসবার ঘর থেকে সীমন্তিনী তাদের ডেকে বলল, “বৌদি, পিসি, আপনারা চলে আসুন। খাবার এসে গেছে। অর্চু ওনাদের নিয়ে আয় বোন”।

অর্চনাও তাদের বলল, “হ্যাঁ পিসি, চলুন। এবার বরং ও’ঘরে যাওয়া যাক”।

দু’জনকে সাথে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে অর্চনা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই, তুমিও ওনাদের সাথে বসে পড়ো। আমি আর লক্ষ্মীদি পরিবেশন করছি”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “আমি আর লক্ষ্মীদি মিলে সকলের প্লেট সাজিয়ে ফেলেছি। তাই তোকে আর সে সব করতে হবে না এখন। আয় তুইও আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়। পরিবেশন লক্ষ্মীদি একাই সেরে ফেলতে পারবে। আয় বোস এখানে” বলে নিজের পাশের খালি চেয়ারের দিকে ঈশারা করল।
 

একটা বড় ট্রেতে চারটে খাবারের প্লেট এনে অতিথিদের দিতে দিতে লক্ষ্মী বলল, “হ্যাঁ সোনাদি, তুমিও এনাদের সকলের সাথেই বসে পড়ো। আমি এদিকে সামলে নিতে পারব”।

এবার নিরঞ্জনবাবু বললেন, “আচ্ছা মন্তি মা, অর্চু মা, তোমরা আমার একটা কথা শোনো আগে। এভাবে অনাহুতভাবে এসে যখন পড়েইছি তখন তোমাদের সকলের সাথেই অনেক কথাই হবে আমাদের। আর সে উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা এসেছি আজ। তবে সবার আগে তোমাদের দু’জনকেই আমি একটা কথা বলে নিতে চাই” বলে একটু থেমে সীমন্তিনী আর অর্চনার দিকে দেখতে দেখতে আবার বললেন, “আমি বা আমরা সবাই তোমাদের চেয়ে বয়সে যতই বড় হই না কেন, তোমরা যদি ‘আপনি’ না বলে আমাদের সাথে ‘তুমি তুমি’ করে কথা বলো, তাহলেই কিন্তু আমরা সবাই বেশী খুশী হব”।

সাথে সাথে হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি আমার মুখের কথাটা ছিনিয়ে নিলে। আমি তো এখনই এ কথাটা বলতে যাচ্ছিলুম। হ্যাঁ মা, মানছি তোমাদের সাথে এই আমাদের প্রথম দেখা প্রথম কথা। তবে পরিচয় নতুন হলেও তুমি আর নীতা যে আমাদের পরির সবচেয়ে ভাল বন্ধু। আর অর্চুর ব্যাপারে আর কি বলব। ও তো আমার নিজেরই ভাইঝি। ওর বাবা তো সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমার ভাই। বিধুকে তো আমি ছোটবেলায় ফোঁটাও দিতুম। আমি কপাল দোষে সবাইকে হারিয়ে ফেলেছিলুম বলেই না আমাদের এতদিন দেখা হয়নি। তাই বলে বাবার দিদিকে কেউ আপনি করে বললে কেমন লাগে শুনতে বলো? জানো অর্চু, তোমার বোন রচুর সাথে সেদিন যখন আমি ফোনে প্রথম কথা বললুম, সেদিন প্রথম থেকেই ও আমাকে ‘তুমি তুমি’ করে বলছিল। ওর মুখে অমন আপন করা সম্বোধন শুনে আমার কী যে ভাল লেগেছিল ওই মূহুর্তে সেটা তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না। আসলে মেয়েটা তো তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা আমার আর পরির মঙ্গল কামনা করে ও ওর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছিল। আর তখনই ওর সাথে আমি কথা বলেছিলুম। পরে অবশ্য ঘোরটা কেটে যেতেই ‘তুমি’ করে বলার জন্যে ক্ষমা চাইছিল। কিন্তু আমি ওকে অনুমতি দিয়েছি ও যেন আমাকে ও’ভাবেই সম্বোধন করে। আর আমাদের বড়বৌমা তো পরির সাথে বা বিধুর সাথে তোমাদের সম্পর্কসূত্র ধরে তোমাদের বৌদিই হবে। আর বৌদিকে ‘তুমি’ করে ডাকাই যায়। তাই তোমরা আমাদের সকলের সাথে সেভাবে কথা বললেই আমরা বেশী স্বাচ্ছন্দ অনুভব করব। আর আমি কিন্তু শুধু আমাদের এই তিনজনের কথা বলছি না মা তোমাদের। আমাদের পরিবারের সকলকেই তোমরা ও’ভাবেই ডেকো। আসলে ‘আপনি’র চেয়ে ‘তুমি’ বা ‘তুই’ সম্মোধনই বেশী কাছের বলে মনে হয়। তবে নীতাকেও এ’সময় সাথে পেলে আরও ভাল লাগত”।

সীমন্তিনী দেয়াল ঘড়ির দিকে দেখে বলল, “সাতটা তো প্রায় বাজতেই চলল। নীতা হয়ত আর ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই চলে আসবে পিসি। কিন্তু ওর জন্যে অপেক্ষা করলে তো এখন এ খাবারগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তাই এখন খেয়ে নিন। রাতে খাবার সময় ওকে আপনার ঠিক পাশেই পাবেন” বলে মিষ্টি করে হাসল।

হৈমবতীদেবী খাবারের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বললেন, “হ্যাঁ ঠিকই বলেছ তুমি মা। তবে মা, এবারেও কিন্তু তুমি আমাকে ‘আপনি’ করেই বললে”।

সীমন্তিনী নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার একটু হেসে বলল, “সরি পিসি। আর হবে না। এবার খাওয়া শুরু করো। পিসো, বৌদি তোমরাও হাত লাগাও”।
 

খেতে খেতে সকলে মিলে পরিতোষ, বিধুবাবু, কালচিনি, কুমারগ্রাম আর আলিপুরদুয়ারের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলল। খাওয়া শেষে সবাই মিলে গেস্টরুমে এসে আগের প্রসঙ্গের সূত্র ধরেই কথাবার্তা বলতে লাগল। ঠিক সওয়া আটটার সময় কলিং বেল বেজে উঠতেই সীমন্তিনী বলল, “ওই নীতা এসে গেছে বোধহয়”।

অর্চনা তাড়াতাড়ি গিয়ে দড়জা খুলে দিতেই নবনীতা ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে অর্চু? ওনারা সবাই কি চলে গেছেন নাকি”?

অর্চনা দড়জা বন্ধ করতে করতে বলল, “না নীতাদি। ওনারা তো রাতে থাকবেন বলেই এসেছেন। তোমার আর দিদিভাইয়ের সাথে নাকি তাদের অনেক কথা আছে। এখন সবাই গেস্টরুমে আছেন। তুমি কি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে? না আগে তাদের সাথে পরিচয়টা সেরে নেবে”।

নবনীতা বলল, “চল আগে পরিচয়পর্বটাই শেষ করে নিই। আয়” বলে অর্চনার হাত ধরে গেস্টরুমে গিয়ে ঢুকতেই সীমন্তিনী ঘরের সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই তো নীতা এসে গেছে। আয় নীতা, দেখ কারা এসেছেন। ইনি পরির পিসেমশাই, ইনি পিসি আর ইনি বড়বৌদি, মানে পরির বড় পিসতুতো দাদার স্ত্রী”।
 

নবনীতা এগিয়ে গিয়ে সকলকে প্রণাম করতে সীমন্তিনী বলল, “আর পিসি, তুমি এতক্ষণ ধরে যাকে দেখবার জন্যে উতলা হয়েছিলে, এই সেই নীতা, মানে নবনীতা। আমার মত ও-ও পরির বন্ধু। আর এখন আমার একটা বোনও হয়ে গেছে”।

নিরঞ্জনবাবু, হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা তিনজনেই নবনীতাকে আশীর্বাদ করলেন। হৈমবতীদেবী নীতার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন, “পরির মুখে তোমার সব কথা শুনেছি মা। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাদের সবাইকে। তাই এভাবে আজ বিনা নোটিশে এসে হাজির হলুম”।

নবনীতাও আন্তরিক সুরে জবাব দিল, “বেশ করেছেন পিসি। আমাদেরও আপনাদের সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু দিদি বা আমি কেউই কাজ থেকে ছুটি নিতে পারছিলাম না”।

হৈমবতীদেবী মিষ্টি হেসে বললেন, “উহু, ‘আপনি’ নয়। আমাদের সবাইকে ‘তুমি তুমি’ করে বলবে। আমি তো তোমার মায়ের মতই। মাকে কেউ আপনি করে বলে”?
 

নবনীতা অবাক চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, “মা? আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে পিসি। নিজের জন্মদাত্রী মাকে সাত বছর আগেই হারিয়েছি। তার চলে যাবার খবরটুকুও আমি সময়মত পাইনি। জানলাম সাত বছর বাদে। তারপর এখানে আসবার পর মাসির সাথে মানে অর্চুর মা-র সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই তাকে নিজের মা বলে মনে হচ্ছে। তাকে দেখবার সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি। আজ তোমাকেও পেলাম। আজ সত্যি খুব খুশীর দিন আমার”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে নবনীতাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, “নীতা, এখন আর পুরনো কথাগুলো টেনে আনিস না বোন। আর শোন, যা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আর তোর জন্যে জলখাবার রাখা আছে। লক্ষ্মীদির কাছ থেকে সেটা নিয়ে খেয়ে তারপর এখানে আসিস আবার”।
 

মিনিট পনের বাদেই নবনীতা আবার গেস্টরুমে আসতেই হৈমবতীদেবী তাকে নিজের পাশে বসিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবারে আর সময় নষ্ট না করে আমাদের আসল আলোচনাটা শুরু করো”।

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “আমি তোমার মত অমন গুছিয়ে কথা বলতে কবে শিখেছি বলো? তুমি আর বড়বৌমা মিলেই বরং শুরু করো। আমি মাঝে মধ্যে প্রয়োজনমত কথা বলব’খন”।
 

হৈমবতীদেবী এবার সীমন্তিনী আর নবনীতার দিকে দেখে বললেন, “শোনো মা। আজ থেকে চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে নিজের মা বাবা আর ভাইয়ের কাছ থেকে আমি কিভাবে হারিয়ে গিয়েছিলুম সে’সব কথাই হয়ত তোমরা এতদিনে জেনে গেছ। তাই সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সময় নষ্ট করছি না। তবে এত বছর কেটে যাবার পর, যখন কাউকে ফিরে পাবার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলুম, তখনই হঠাৎ করেই পরি নিজেই আমাদের ওখানে গিয়ে পৌঁছেছিল। নিজের মা বাবা আর ভাইকে তো ফিরে পেলুম না। তবে তোমাদের জন্যেই তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমার একমাত্র ভাইপোকে আমি ফিরে পেয়েছি। এ’ পাওয়াটাই বোধহয় আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। কিন্তু এর পেছনে সম্পূর্ণ অবদানই কিন্তু তোমাদের দু’জনের আর বিধুর। তোমরা যদি পরির বন্ধু না হতে তাহলে পরি কখনোই হয়ত এখানে আসত না। বিধুর নামটাও শুনতে পেত কিনা কে জানে। অর্চুর মুখে বিধুর নাম শুনেই ও কালচিনি গিয়েছিল। বিধু তার ছোট বেলার প্রাণের বন্ধুর ছেলেকে চিনতে পারে। পরিও তার বাবার ছোটবেলার বন্ধুকে খুঁজে পেল। তার মাসখানেক আগেই বিধুর সাথে আমার নতুন করে দেখা হয়েছিল। বিধুর মুখেই পরি ওর পিসির সম্বন্ধে প্রথম কোন কিছু জানতে পারে। তারপর প্রাণের টানে? না রক্তের সম্পর্কের টানে, সেটা জানিনে। কিন্তু ও আমার কাছে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু আমার ব্লাড প্রেসারটা বেড়েছিল বলে সবাই দুশ্চিন্তায় ছিলুম যে, নিজের ভাইপোকে ফিরে পাবার আনন্দ আর একই সাথে মা বাবা ভাই আর ভাই বৌয়ের মৃত্যুসংবাদ, এ’সব কিছু আমি সইতে পারব কিনা। কলকাতায় বসে বিধুর ছোট মেয়ে আমার জন্য দেড়টি ঘন্টা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছিল। এ যে নিজে কানে না শুনলে বিশ্বাসই হত না আমার। তাই গোটা ব্যাপারটার সাথেই তোমাদের তিনজনের সাথে সাথে অর্চু আর রচুর কাছেও আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব”।

বলতে বলতে তার গলা ধরে এসেছিল বলে তিনি একটু থামতে নবনীতা তার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “পিসি, থাক না ও’সব কথা। সে’সব কথা মনে করে চোখের জল ফেলে আর কি লাভ হবে বলো? আমরা এখন ভগবানের কাছে শুধু এটাই প্রার্থনা করি যে পরি তোমাদের নিয়ে সুখে থাকুক। ও যেন আর কখনও নিজেকে একটা অনাথ ছেলে ভেবে দুঃখ না পায়। আর তোমরাও সবাই পরিকে নিয়ে আনন্দে থাকো, সুখে থাকো”।

হৈমবতীদেবীর অন্যপাশে বসে থাকা সুলোচনা তার শাশুড়ির আরেকটা হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ মা, নীতা যা বলল, আমার মনের কথাও কিন্তু ঠিক তাই। তুমি শান্ত হও। এমন করে উতলা হয়ে পড়লে যে তোমার শরীর খারাপ করবে আবার। তখন যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এখানে এসেছি, সেটাই বানচাল হয়ে যাবে”।

হৈমবতীদেবী নিজেকে সামলাতে সামলাতে বললেন, “না না বড়বৌমা, ভেবনা, আমি ঠিক আছি। কিন্তু এই মেয়েগুলোর কাছে আমি যতটা ঋণী হয়ে পড়েছি, সে ঋণ শোধ আর কিকরে করব মা”?
 

সীমন্তিনী শান্ত স্বরে বলল, “পিসি, এমন করে বলছ কেন। এখানে ঋণ বা ঋণশোধের কথা আসছে কোত্থেকে? মেসো মানে তোমার কালচিনির ভাই কি বলেন জানো? উনি বলেন বিধাতা প্রত্যেকটা মানুষের কপালেই সুখ আর দুঃখ দুটোই লিখে দিয়েছেন। তবে কোনটাই সময়ের আগে কিছুতেই হয় না। সময় যখন আসবে তখন যা অসম্ভব বলে মনে হয় সেটাও চোখের পলকেই ঘটে যায়। আবার ঈশ্বরের নির্দেশিত সময়ের আগে সহজ একটা কাজও হাজার চেষ্টাতেও সমাধা করা যায় না। তোমার ভাইপোকে তোমার কাছে পাবার সময় ভগবান নিশ্চয়ই আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। আর সেই নির্ধারিত সময়েই তুমি তাকে পেয়েছ। আর বাকি সবকিছু সবাই তো একেকটা অছিলা বা উপলক্ষ মাত্র”।
 

নিরঞ্জনবাবু এবার বললেন, “ঠিক বলেছ মা। একেবারে যথার্থ বলেছ। সেদিন বিধুর হাতে লেখা চিঠিটা পেয়ে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। গত চুয়াল্লিশটা বছর ধরে যে দিনটার প্রতীক্ষা করতে করতে আমরা সবাই নিরাশ হয়ে পড়েছিলুম, তখনই পরিকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলুম। আজ বুঝতে পারছি, বিধুর কথা আর তোমার কথাটাই সার কথা। সময়ের আগে কোনকিছুই হবার নয়। তবে মা, তুমি আর নীতা যে পরির খুব ভাল বন্ধু, ওর সবচেয়ে বড় হিতৈষী তোমরা, এ’সব কথা পরির মুখেই আমরা শুনেছি। এ’ ক’টা দিনে পরির সাথে তোমাদের সকলের ব্যাপারেই আমাদের অনেক কথা হয়েছে। তোমাদের সাথে ওর যোগাযোগ কিভাবে হয়েছিল, তারপর থেকে কিভাবে তোমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছ, তার সবকিছুই পরি আমাদের কাছে খুলে বলেছে। তাতেই আমরা শুনেছি যে তোমরা দু’জন পরির বিয়ে দেবার জন্য মেয়ের খোঁজ করতে শুরু করেছিলে। পরি আমাদের এটাও বলেছে যে কোন একটা মেয়ে নাকি তোমরা খুঁজেও পেয়েছ। আমরা আজ কিন্তু মূলতঃ সে ব্যাপারেই তোমাদের সাথে কথা বলতে এসেছি মা। আসলে তোমরা তো জানোই, পরির ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনই ওর একটা বিয়ে দেওয়া দরকার বলে ভাবছি আমরা। তাছাড়া বেচারা কলকাতায় একা একটা বাড়িতে থাকে। ডিউটির তো কোনও বাঁধাধরা রুটিন নেই। কখন বাড়ি ফেরে, কখন রাঁধে, কখন খায়, কে জানে। শরীরে ক্লান্তি থাকলে হয়ত কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। তাই আমরা ভাবছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর একটা বিয়ে দেব আমরা। কিন্তু পরি যখন বলল যে তোমরা ওর জন্যে একটা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছ তখন ভাবলুম তোমাদের সাথে আগে কথা বলা দরকার। তোমাদের পছন্দের যে কোন মেয়েকেই যে পরি বিয়ে করবে বলেছে, এ’কথাও সে আমাদের বলেছে। আমরাও তাতে আপত্তি করব না। আমার ছেলেরা আর সব বৌমারাও তাতে রাজী। তবে পরির মুখে ও’ কথা শোনবার পর থেকেই তোমাদের পিসি তোমাদের মাধ্যমেই সেই মেয়ের বাড়ির লোকদের সাথে যোগাযোগ করে মেয়েটিকে দেখতে চায়। আর মেয়েটি যদি তার পছন্দ হয়ে যায়, তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা আমরা দিয়ে দিতে চাই”।

সীমন্তিনী মাথা নিচু করে নিরঞ্জনবাবুর কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্চুর ব্যাপারে ভাবছিল। এবার নিরঞ্জনবাবু থামতেই সে মাথা উঠিয়ে বলল, “পিসো। আপনারা যে... ওহ সরি। তোমরা যে এ উদ্দেশ্যেই আমাদের এখানে এসেছ এ’কথা শুনে খুব খুশী হলুম। তবে পিসো, পরিকে আমরা সেভাবে আগে বললেও আমরা কিন্তু এ বিয়ের ব্যাপারে চুড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত এখনও নিই নি। কারন সেটা করতে হলে পরির সাথে মুখোমুখি বসে বিশদভাবে একটা আলোচনা করবার দরকার আছে বলে আমরা ভেবেছিলুম। নাগরাকাটা আসবার দিন পনের আগে থেকে পরি এতোটাই কাজে ব্যস্ত ছিল যে আমাদের সাথে ফোনেও কথা বলতে পারত না। একসাথে বসবার সুযোগটাই হয়ে উঠছিল না। সেদিন কোন খবরাখবর না দিয়েই দুম করে ও এখানে এসে হাজির হল। আমার তখন অফিসে যাবার তাড়া। আমি যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছিলুম তখনই ও এসে হাজির। তাই সকালে আর ওর সাথে তেমন কথা বলতেই পারিনি। আর সন্ধ্যের পর অফিস থেকে ফিরে আরেকজনের সাথে আমি আর পরি একটা অন্য ব্যাপারে মিটিং করি। তারপর সবাই মিলে কথা বলতে বলতেই সময় গড়িয়ে গেল। আর ঠিক তখনই ও জানাল যে রাত ভোর হলেই ও কালচিনি যাবে। সেখান থেকে মালবাজার আর তারপর কলকাতা চলে যাবে। তাই ওর সাথে আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় বসবার সুযোগই পেলুম না। ও সকালে শুধু চাটুকু খেয়েই বেরিয়ে গেল। দুপুরে ওর মেসেজ পেয়ে জানলুম ও তোমাদের ওখানে গেছে। আর তারপর ওর সাথে আর কন্টাক্ট করতে পারছিলুম না। ও যে তোমাদের মত আপনজনদের খুঁজে পেয়েছে এটা শুনে আমরা সকলেই সেদিন খুব খুশী হয়েছিলুম। কিন্তু আমরা কেউই ওকে ফোনে পাচ্ছিলুম না। পরে শুনেছি ও ইচ্ছে করেই ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিল। রাত প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ রচু ফোন করে মোটামুটি ব্যাপারটা আমাদের জানিয়েছিল। আর পরি রাত প্রায় বারোটায় আমাকে ফোন করেছিল। তখন আমার আর নীতার কাছে ও সবটা খুলে বলেছিল। সবকিছু জানবার পর আমরাও প্রচণ্ড খুশী হয়েছিলুম। তবে মনে মনে তখনই ভেবেছিলুম যে এখন তোমরাই তো পরির অভিভাবক। আর তোমাদের মত এত ভাল একটা পরিবার পরিকে যখন এমনভাবে আপন করে নিয়েছ তখন ওর বিয়ে নিয়েও এবার তোমরাই ভাববে। তাই আমরাও ভেবেছিলুম যে আর ওই মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে না এগোনোই ভাল হবে। তবে তোমরা যখন সেটা জানতেই এসেছ, তাহলে তোমাদের সে’কথা নিশ্চয়ই বলব। তবে এ সময়ে তো আমরা একটু চা খাই। তোমাদের এখন চা খেতে আপত্তি নেই তো”?
 

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “এ’সময় আমারও একটু চা খেতে সত্যিই ইচ্ছে করছে”।

সীমন্তিনী উঠে অর্চনার হাত ধরে বলল, “নীতা, তুই এনাদের সাথে কথা বলতে থাক। আমি একটু বাথরুম সেরে আসছি” বলে অর্চনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
 

বসবার ঘরে এসে সীমন্তিনী অর্চনাকে ফিসফিস করে বলল, “তুই লক্ষ্মীদিকে সকলের জন্য চা বানাতে বলে আমার ঘরে আয়”।

অর্চনা রান্না ঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে চা বানাবার কথা বলে সীমন্তিনীর ঘরে এল। মিনিট খানেক বাদেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে সীমন্তিনী অর্চনার কাছে এসে শান্ত স্বরে বলল, “অর্চু সোনা। বুঝতেই তো পারছিস ঘটণা কোন দিকে ঘুরছে। মনকে শক্ত রাখিস বোন। তোকে আড়ালে রেখে তাদের সাথে আমি তোকে নিয়ে কথা বলতে চাই নে। কিন্তু এ আলোচনার যে সার্থক সমাপ্তি হবে, এ নিয়ে কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার মনে। তাই এ’কথা বলছি বোন। কারন তোকে ও’ঘর থেকে সরিয়ে দিলে তাদের মনে কিছু সন্দেহের উদ্রেক হতেই পারে। আর তুইও একটু চিন্তায় থাকবি। তাই বলছি, তুই ওই ঘরে আমার পাশেই থাকিস। আর যদি তোর মনে হয় যে তোর আর সে’ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না, বা উচিৎ নয়, তবে আস্তে করে আমায় একটা চিমটি কাটিস সকলের চোখের আড়ালে। আমি তখন কায়দা করে তোকে ও’ঘর থেকে বের করে দেব। তবে আমার মনে হয় তোর কথা যখন উঠবে তখন তোর ও’ঘরে না থাকাটাই ভাল। তাহলে আমি গোটা ব্যাপারটা আরও ভাল করে সামলাতে পারব। আর সত্যি যদি তোর কথা নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা আমাদের করতেই হয় তবে তোর জীবনের ওই সাতটা বছরের সমস্ত কথাও কিন্তু তাদের কাছে খুলে বলব। তুই যদি সেটা সহ্য করতে পারিস তবে থাকিস। আর না পারলে আমাকে ঈশারা করে দিস। আমি তোকে কোনও অজুহাত দেখিয়ে ও’ঘর থেকে বের করে দেব। তবে যতক্ষণ ও ঘরে থাকবি, সাবধান থাকবি। ওনারা যেন আগে থেকেই কিছুতেই বুঝতে না পারেন যে আমরা পরির জন্য তোকেই পছন্দ করেছিলুম। ঘটণা কোনদিকে গড়ায় সে’ভাবেই আমাদের চলতে হবে কিন্তু। বুঝেছিস তো”?

অর্চনা মাথা হেলিয়ে “ঠিক আছে দিদিভাই” বলতে সীমন্তিনী বলল, “কথাটা মনে রাখিস। আর তুই এখন তাদের ওখানে চলে যা। ওখানে গিয়ে তাদের বল যে আমি একজনের সাথে ফোনে কথা বলছি। একটু পরে আসছি”।
 

অর্চনা চলে যেতে সীমন্তিনী কয়েক মিনিট চুপ করে মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিয়ে ফোন হাতে নিয়ে একের পর এক দু’তিনটে ফোন করে ফোনটা হাতে নিয়েই গেস্টরুমের দিকে রওনা হল।


______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 30-03-2020, 11:11 AM



Users browsing this thread: 24 Guest(s)