30-03-2020, 11:08 AM
(Update No. 241)
রচনার সাথে কথা বলতে বলতে আলিপুরদুয়ার থেকে পরিতোষের পিসি পিসেমশাই আর বৌদির আসবার কথা জানিয়ে দিল। রচনাও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। কিন্তু সীমন্তিনী তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে কথা শেষ করে অর্চনার খোঁজ করতে করতে পাশের ঘরের দিকে যেতেই অর্চনা সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “দিদিভাই, নীতাদি বোধহয় খুব ব্যস্ত আছেন। দু’বার ফোন করলুম। ধরলেন না। আমি একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি শেষে”।
সীমন্তিনী বলল, “ভাল করেছিস। তবে এখন ম্যাক্সিটা ছেড়ে একটা চুড়িদার পড়ে নে চট করে। ওদের গাড়ি এলেই কিন্তু আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। নইলে জিনিসগুলো আনতে একা লক্ষ্মীদি হিমশিম খাবে। তুই ড্রেসটা চেঞ্জ করে আয় আমি রান্নাঘরের জানালা থেকে গেটের দিকে নজর রাখছি” বলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
সাড়ে ছ’টার একটু পরেই একটা হাল্কা বেগুনী রঙের বেশ বড়সড় একটা গাড়ি তাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়াতে সীমন্তিনী গাড়িটার নাম্বার দেখবার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটা ঠিক নজরে পড়ছিল না। কিন্তু গেটের একজন গার্ডকে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে দেখল। কয়েক সেকেন্ড পরেই সুন্দর শাড়ী পড়া এক ভদ্র মহিলাকে গাড়ির পেছনের জানালার সামনে বসে থাকতে দেখেই সীমন্তিনী রান্নাঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “লক্ষ্মীদি, চলে এস। ওনারা এসে পড়েছেন। অর্চু কোথায় গেলি রে? হয়নি এখনও তোর? ওরা এসে পড়েছেন তো”।
অর্চনা প্রায় সাথে সাথেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মূল দড়জা খুলে অর্চনাকে সাথে নিয়ে সীমন্তিনী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই দেখল দু’জন গার্ড গাড়ির পেছনের ডিকি খুলে পরীক্ষা করছেন। সীমন্তিনী দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই গার্ডেরা গেট খুলে দিল। গাড়িটা গেটের ভেতরে ঢুকতেই অর্চনা আর সীমন্তিনীর কাছাকাছি এসে পড়ল। ড্রাইভার তাদের দেখে গাড়ির গতি কমাতেই সীমন্তিনী ঘরের দিকে হাতের ঈশারা করে ড্রাইভারকে বলল, “ওই সিঁড়ির সামনে নিয়ে রাখুন”।
একদিক থেকে রামসিংও ছুটে এল। সিঁড়ির সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ির পেছন পেছন সীমন্তিনী আর অর্চনাও সেখানে পৌঁছে গেল। সীমন্তিনী পেছনের এক দড়জা নিজে হাতে খুলে দিয়ে আন্তরিকভাবে বলল, “আসুন আসুন। আমরা সবাই আপনাদের অপেক্ষা করছিলুম”।
অন্য দিকের দড়জাটা ততক্ষণে রামসিং খুলে দিয়েছে। গাড়ির ভেতর থেকে তারা তিনজন নেমে আসতেই সীমন্তিনী আর অর্চনা নিচু হয়ে সকলের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারা তিনজনেই প্রণাম নিতে না চাইলেও সীমন্তিনী আর অর্চনা তাদের প্রণাম করল। হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা দেবী দু’জনকে জড়িয়ে ধরলেন। নিরঞ্জনবাবু বললেন, “বিনা নোটিসে এভাবে হুট করে এসে তোমাদের নিশ্চয়ই খুব বিপাকে ফেলে দিয়েছি আমরা। এরজন্যে আগে ভাগেই তোমাদের সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “এমন করে বলবেন না পিসেমশাই। যেদিন থেকে আপনাদের কথা শুনেছি সেদিন থেকেই আপনাদের সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার খুব। কিন্তু কাজের এতটাই প্রেসার যে কিছুতেই সময় বের করে উঠতে পারছিলুম না। আপনারা যে নিজেরাই এসেছেন এতে আমি ব্যক্তিগত ভাবে কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। চলুন, ভেতরে চলুন, আসুন বৌদি, পিসি আসুন” বলে রামসিংকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ডিকির জিনিসগুলো ঘরে নিতে লক্ষ্মীদিকে একটু সাহায্য কোরো রামসিং। আর এনাদের ড্রাইভারকে গাড়ি রাখবার জায়গা আর তার থাকবার জায়গা দেখিয়ে দিও”।
হৈমবতীদেবী অর্চনার একটা হাত ধরে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যে সীমন্তিনী সেটা তো এতক্ষণে বুঝেই গেছি মা? কিন্তু এই মা-টি কে গো? এ কি নবনীতা? না আমার আরেক ভাইঝি অর্চু”?
সীমন্তিনী হৈমবতীদেবীর হাত ধরে ঘরের সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল, “ও অর্চু পিসি। নীতা এখনও বাড়ি ফেরেনি। আপনারা পরির মুখে হয়ত শুনেই থাকবেন যে নীতা এখানে একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। ওর ছুটি হয় রাত আটটায়। আর এখন তো পূজোর সীজন বলে ওদের শোরুমে ব্যস্ততা বেশী। তাই আপনাদের আসবার খবর পেয়েও বোধহয় আটটার আগে ছুটি পাবে না”।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সুলোচনাদেবী অর্চনার হাতটা ধরে বললেন, “তোমার বাবা বিধুমামুকে আমরা দেখেছি প্রায় মাস দুয়েক আগে। এরপর ভাইদা যেদিন আমাদের ওখানে এসেছিল, তার পরদিন মা-ই বিধুমামু মামী আর ভাইকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তোমাদের দু’বোনকেই দেখা বাকি ছিল। আজ তোমাকে দেখবার সৌভাগ্য হল। সত্যি তুমি ভারী মিষ্টি মেয়ে। তোমাকে দেখেই খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। তবে তুমি কিন্তু সম্পর্কে আমার ননদই। তবে ননদিনী রায়বাঘিনী হয়ো না যেন”।
অর্চনা লাজুক হেসে বলল, “এ মা, অমন করে বলবেন না বড়বৌদি”।
সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে বারান্দায় উঠে সুলোচনাদেবী হেসে বললেন, “আরে বিধুমামুর মত লোকের মেয়ে যে আমাদের ননদিনী রায়বাঘিনী কোনদিনই হবে না, সে আমরা সবাই জানি গো। আমি তো শুধু তোমার সাথে একটু ঠাট্টা করছিলুম ভাই। তবে আজ তোমাকে দেখে তোমাকে আমার ননদিনীর বদলে ছোট বোন বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে। আমাকেও তুমি তোমার দিদি বলে ভাবতে পার”।
******************
সকলে মিলে বসবার ঘরে বসবার পর অর্চনা সকলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। লক্ষ্মী আর রামসিং দু’জনে মিলে নিরঞ্জনবাবুদের গাড়ি থেকে অনেকগুলো কন্টেনার এনে রান্নাঘরে রেখেছে। অর্চনা কন্টেনারগুলো ঠিক জায়গা মত সাজিয়ে রাখতে লাগল। শেষবারে নিরঞ্জনবাবুদের লাগেজ গুলো লক্ষ্মী আর রামসিং গেস্টরুমে নিয়ে রাখল। সীমন্তিনী রামসিংকে আরও একবার নিরঞ্জনবাবুদের গাড়ির ড্রাইভারের কথা মনে করিয়ে দিল।
সীমন্তিনী সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে একটু জলখাবার খেয়ে নেবার অনুরোধ করতেই তারা সকলেই পোশাক বদলে নিতে চাইলেন। সে’কথা শুনে সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আসুন আমি আপনাদের থাকবার এবং শোবার জায়গাগুলো দেখিয়ে দিচ্ছি। সকলকে নিয়ে গেস্টরুমে এসে বলল, “পিসি, আপনি আর পিসেমশাই এ’ঘরে থাকবেন। ও’পাশে বাথরুম আছে। তবে জানালাগুলো এখন আর না খোলাই ভাল। এখানে এখন বাইরে প্রচুর মশার আনাগোনা শুরু হবে। জানালা খুললেই মশা ঢুকে পড়বে। ঘরে মশা তাড়াবার লিকুইড লাগানো আছে। আর রাতে মশারিও টাঙিয়ে দেব। আর বড়বৌদি, আপনি আমার সঙ্গে আমার ঘরে চলুন। আপনার লাগেজ কোনটা”?
সুলোচনা নিজের লাগেজটা নিয়ে বললেন, “তোমাকে নিতে হবে না ভাই, আমি নিচ্ছি”। সীমন্তিনী নিরঞ্জন বাবু আর হৈমবতীদেবীকে ফ্রেশ হতে বলে সুলোচনাকে নিয়ে নিজের ঘরে এল। সুলোচনাকে সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে সে আবার রান্নাঘরে এল।
সীমন্তিনীকে দেখেই অর্চনা বলে উঠল, “ও দিদিভাই, ওনাদের কাণ্ড দেখেছ। এতো খাবার এনেছেন যে দু’বেলাতেও শেষ হবে না”।
সীমন্তিনীও দেখল সত্যিই প্রচুর খাবার এসেছে। সে বলল, “ঠিক আছে, নিয়েই যখন এসেছেন তবে আর তো কিছু করার নেই। তবে অর্চু, তুই সোনা লক্ষ্মীদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে আগে তাদের জলখাবারটা দেবার বন্দোবস্ত করে ফ্যাল চট করে। আমি সবাইকে বসবার ঘরে নিয়ে আসছি”।
অর্চনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, তুমি তাদেরকেই সঙ্গ দাও। এদিকের সবকিছু আমি আর লক্ষ্মীদি দেখছি। তুমি কিচ্ছু ভেবো না”।
সীমন্তিনী লিভিং রুমে এসে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে চেয়ারগুলো সাজাতে সাজাতেই নিরঞ্জনবাবু আর হৈমবতীদেবী পোশাক পাল্টে সেখানে এসে হাজির হলেন। নিরঞ্জনবাবু বললেন, “তোমার কোয়ার্টারের লোকেশানটা সত্যিই খুব চমৎকার মন্তি মা। একটু বাদেই তো পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। একটু বাইরে গিয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখে আসা যাবে”?
নিরঞ্জনবাবুর মুখে ‘মন্তি মা’ সম্বোধন শুনে সীমন্তিনী এক মূহুর্তের জন্য চমকে উঠলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই জবাব দিল, “এখন সেটা না করাই ভাল পিসেমশাই। একটু আগেই বললুম না চারপাশে এখন প্রচুর মশার উৎপাত হবে। তাই এখন বাইরে না যাওয়াই ভাল। তবে আসুন আমি সবগুলো ঘর ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। সব ঘরেই কাঁচের জানালা আছে। বাইরের দৃশ্য দেখতে পাবেন। আপাততঃ ওটুকুতেই মন ভরিয়ে নিন। বাকিটুকু কাল সকালে বাইরে গিয়ে দেখবেন”।
হৈমবতীদেবী সীমন্তিনীর কথায় সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ সেই ভাল। মিছেমিছি মশার কামড় খেয়ে রোগ বাধাবার দরকার নেই”।
তখনই সুলোচনাও সীমন্তিনীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনজনকে নিয়ে এ’ঘরে সে’ঘরে গিয়ে সীমন্তিনী সবাইকে দেখাতে লাগল। আঁধার প্রায় ঘণিয়ে এসেছিল। বেশী দুরের জিনিস আর চোখে পড়ছিল না তেমন। এক সময় অর্চনা এসে শান্ত কন্ঠে বলল, “দিদিভাই, তোমাকে লক্ষ্মীদি একটু রান্নাঘরে যেতে বলছেন। তুমি যাও, বাকি ঘরগুলো নাহয় আমিই তাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছি। আর সন্ধ্যা প্রদীপটাও জ্বালিয়ে দিচ্ছি”।
সীমন্তিনী চলে যেতে বাকি ঘরগুলো তাদের দেখিয়ে অর্চনা ছোট ঠাকুরঘরের কাছে এসে বলল, “এটা হচ্ছে দিদিভাইয়ের ঠাকুরঘর। ভেতরে যাবেন? অবশ্য আমাকে এখন ঢুকতেই হবে। সন্ধ্যা প্রদীপটা জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছি”।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, “না থাক। ভেতরে আর ঢুকছি না”।
কিন্তু হৈমবতীদেবী নিরঞ্জনবাবুকে বললেন, “বেশ তুমি তাহলে বসবার ঘরে গিয়েই বোসো। আমি একটু ঠাকুরঘরটা দেখেই যাই”।
সুলোচনাও বললেন, “আমিও ঠাকুরঘরটা দেখব একটু”।
অর্চনা সামান্য হেসে বলল, “বেশ তো, আসুন তাহলে। তবে পিসি, এ ঘরে কিন্তু কোনও চেয়ার বা উচ্চাসন বলতে কিছু নেই। আর আসন শুধু একটাই। তাই বসতে হলে কিন্তু মেঝেতেই বসতে হবে। তাতে হয়তো আপনার অসুবিধে হতে পারে”।
হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা অর্চনার সাথে ভেতরে ঢুকেই প্রথমে ছোট্ট একটা সিংহাসনে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, মা সারদা, আর স্বামী বিবেকানন্দের ছবিকে প্রণাম করলেন। অর্চনাও ভক্তিভরে ঠাকুরকে প্রণাম করে মেঝেতে বসেই সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালাবার আয়োজন করতে করতে বলল, “পিসি, আমার তো সন্ধ্যারতি দিতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এ ঘরে তো বসতে দেবার মত কিছু নেই। আপনারা বরং বসবার ঘরে গিয়েই বসুন। আমি ঠাকুরের আরতিটুকু সেরেই আসছি”।
হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি তোমার কাজ করো মা। আমরা একটু সময় থাকি এখানে। তারপর যাবো’খন”।
অর্চনা আর কিছু না বলে ধুনুচি আর পঞ্চপ্রদীপ সাঁজাল। তারপর প্রথমে প্রদীপ আর তারপর ধুনুচি জ্বালিয়ে ঠাকুরের আরতি করতে শুরু করল। তারপর তিনবার শাঁখে ফুঁ দিয়ে পঞ্চপ্রদীপ আর ধুনুচি নিয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এল। এক এক করে সব ক’টা ঘরে প্রদীপ দেখিয়ে রান্নাঘরের সামনে আসতেই সীমন্তিনী আর লক্ষ্মী প্রদীপের ওম নিয়ে নিজেদের মাথায় হাত ছোঁয়াল। বসবার ঘর দিয়ে ফিরে আসবার সময় অর্চনা নিরঞ্জনবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনিও প্রদীপের ওম নিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। ঠাকুর ঘরে ফিরে এসে দেখে হৈমবতীদেবী আর সুলোচনাদেবী তখনও ঠাকুর ঘরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের কাছে যেতেই তারা দু’জনেও প্রদীপের ওম নেবার পর অর্চনা ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে প্রদীপের ওম নিয়ে নতজানু হয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করল। সব কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “আচ্ছা অর্চু মা, তুমি যদি কিছু মনে না করো, তবে এখন তোমাকে দুটো প্রশ্ন করতে পারি”?
অর্চনা হৈমবতীদেবীর দিকে হাসিমুখে চেয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ পিসি, বলুন কী জানতে চাইছেন”?
হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “এই এ ঘরে, মানে এই ঠাকুরঘরে বসবার জন্যে কোন চেয়ার বা টুল রাখা হয়নি, কেন গো”?
অর্চনা মুচকি হেসে বলল, “আসলে পিসি, আমি আর রচু যেমন আমাদের মা-বাবার মেয়ে, তেমনই দিদিভাইও আমাদের মা-বাবার আরেক মেয়ে। আমরাও সকলেই দিদিভাইকে আমাদের বড়দিদি বলেই মানি। আর আমাদের মা বাবা ছোটবেলাতেই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে বৈষ্ণব ধর্মমতে কোনরকম উচ্চাসনে বসে কৃষ্ণকথা শুনতে নেই, উচ্চাসনে বসে ভগবান দর্শন করতে নেই। দিদিভাইও বাবার কাছে এ’ শিক্ষাই পেয়েছেন। তাই এ’ঘরে কোনরকম উচ্চাসন রাখা হয় না। আর তাছাড়া তেমন প্রয়োজনও বোধ হয় পড়েনি”।
হৈমবতীদেবী অর্চনার মুখটা দু’হাতে অঞ্জলী করে ধরে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন, “বেঁচে থাকো মা। ঈশ্বর যেন তোমাকে চিরকাল সুখে রাখেন। সত্যি, বিধু তোমাদের খুব ভাল শিক্ষা দিয়েছে”।
সুলোচনাদেবী তার শাশুড়িকে বললেন, “মা, আমাদের বাড়িতেও তো ঠাকুরঘরে কোনও উচ্চাসন নেই। কিন্তু তা না থাকবার পেছনে কারন যে এটা, এ’কথা তো আমরাও কেউ জানতুম না। এটাই কি আসল কারন মা”?
হৈমবতীদেবী মিষ্টি করে হেসে তার জবাবে বললেন, “হ্যাঁ বড়বৌমা। অর্চু যেটা বলল সেটাই আসল কারন। আমার বাবা-মাও আমাকে ছোটবেলায় এ’কথা শিখিয়েছিলেন। আজকালকার ছেলে মেয়েরা তো এ’সব পাঠ প্রায় চুকিয়েই ফেলেছে” বলে আবার অর্চনাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, “আর আমি আরেকটা কথা যেটা তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছিলুম সেটা হল, তুমি সব জায়গায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেখালে কিন্তু এ ছবিটায় তো দেখালে না! এটা কার ছবি গো”?
অর্চনা একটু হেসে বলল, “জীবিত ব্যক্তির ছবিতে তো মালা পড়াতে, ধূপ বা প্রদীপ দেখাতে হয় না। ইনি আমাদের দিদিভাইয়ের দাদা, তার জেঠুর ছেলে। আর আমার ছোটবোন রচনার স্বামী রতু দা। দিদিভাইয়ের থেকে মাত্র ছ’মাসের বড়। প্রায় সমবয়সী আর দুই বন্ধুর মত একসাথে বড় হয়ে উঠলেও দিদিভাই তাকে ভীষণ ভালবাসেন, আর শ্রদ্ধাও করেন তেমনই। তাই ঠাকুর প্রণাম করতে এসে রোজই তার দাদাভাইকেও প্রণাম করেন। এখানে ছবিটা রাখলে কোনদিন প্রণাম করতে তার ভুল হবেনা বলে দিদিভাইই এই ছবিটা এখানে রেখেছেন”।
হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা অর্চনার কথা শুনে একপলক নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নিলেন। সুলোচনা রতীশের ছবিটার কাছে এসে বললেন, “বাঃ, খুব সুন্দর দেখতে কিন্তু! তাই না মা”?
হৈমবতীদেবীও ছবিটার কাছে এসে দেখতে দেখতে বললেন, “হ্যাঁ বড়বৌমা, ঠিক বলেছ তুমি। সত্যি খুব সুন্দর। বিধুর ছোটমেয়েকে তো এখনও দেখিনি আমরা। তবে ওর স্ত্রী,ছেলে আর বড়মেয়েকে দেখে মনে হয় রচনাও বেশ সুন্দরী রূপসীই হবে। দু’জনকে জুটিতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর দেখাবে। কিন্তু এ ছবিটা তো বেশ পুরনো। মনে হচ্ছে কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলে যেন। এটা কতদিন আগে তোলা ছবি, সেটা তুমি জানো অর্চু”?
অর্চনা মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ পিসি, ওদের দুটিকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। কালচিনিতে আমাদের প্রতিবেশীরা বলেন ওদের দেখলে নাকি হর-পার্বতীর জুটি বলে মনে হয়। তবে রতুদার এ ছবিটা সত্যিই অনেক পুরনো। তাদের বিয়ের আগের ছবি। তবে কতদিন আগে তোলা, সেটা আমার ঠিক জানা নেই গো”।
হৈমবতীদেবী বললেন, “তোমার ছোটবোন রচুও নাকি আমাদের পরিকে খুব ভালবাসে। তাকে নাকি নিজের দাদার মত শ্রদ্ধা করে। আর পরিকে যেদিন আমরা পেলুম সেদিন থেকেই জানি ও-ও মেয়েটাকে নিজের বোনের মতই ভালবাসে”।
এবার সুলোচনা বললেন, “জানো অর্চু, ভাইদার মুখে রচনার কথা শুনে আমরা ......”
অর্চনা সুলোচনার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের ভাইদা কে গো বৌদি”?
সুলোচনা হেসে বললেন, “ওহ, সত্যিই তো। সেটা না বললে বুঝবে কেমন করে। তবে বৌদি নয়, আগেই বলেছি না তুমি আমাকে দিদি বা বড়দি বলে ডাকবে। তবে শোনো, আমরা তিন জা পরি ঠাকুরপোকে ভাইদা বলে ডাকি। এবার বুঝেছ তো? তা যে’কথা বলছিলুম আর কি। মা-র সাথে দেখা হবার পর ভাইদা যখন সবার প্রথমে রচনাকে ফোন করতে চেয়েছিল, তখন আমরা সবাই ভেবেছিলুম রচনা বুঝি ভাইদার প্রেমিকা। কিন্তু ফোনের স্পীকার অন করে ভাইদা যখন রচনা আর ওর বরের সাথে কথা বলল, তখনই আমাদের ভুল ভেঙেছে”।
হৈমবতীদেবী আবার বললেন, “যে মূহুর্তে আমি প্রথম পরিকে দেখেছিলুম সেদিন, ওই মেয়েটা নাকি তখন প্রায় ঘন্টাদেড়েক ধরে ঠাকুরের কাছে আমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছে। ওর প্রার্থনার জোরেই সেদিন হয়ত আমার বড়সড় কোনও বিপদ হয়নি। জানিনা ওকে দেখবার সৌভাগ্য আমার কবে হবে”।
অর্চনা আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “অবশ্যই দেখা হবে পিসি। ওরা হয়ত পূজোর সময় আসবে। আর আমাদের গৃহারম্ভের সময়েও হয়ত আসবেই। তখন আশা করি আপনার সাথেও ওদের দেখা হবে। আর আপনারা যদি আপনাদের ভাইপোর বিয়ের আয়োজন করতে পারেন, তাহলে তো রচু আর রতুদাও সে বিয়েতে আসবেই। তখন তো দেখতেই পারবেন”।
হৈমবতীদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “আমরা যে পরির বিয়ের আয়োজন করব এ’ কথা তোমাকে কে বলল মা”?
অর্চনা সহজভাবেই জবাব দিল, “না, সেভাবে কেউ বলেনি। কিন্তু এতদিন তো আপনাদের ভাইপোর পাশে নিজের লোক, আপন বা অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। তাই আগেরবার যখন দিদিভাই কলকাতা গিয়েছিলেন, তখন রচু, দিদিভাই আর নীতাদিই অনেক কষ্টে আপনার ভাইপোকে বিয়ের জন্যে রাজী করিয়েছিলেন। দিদিভাই আর নীতাদির পছন্দ করা মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন বলে তাদের দু’জনের ওপরেই তার জন্য পাত্রী পছন্দ করবার ভারও তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু ক’দিন আগে তিনি যখন আপনাদের খুঁজে পেলেন তখন থেকেই দিদিভাই আর নীতাদি বলছিলেন যে এবারে আর তাদের ওপর পাত্রী পছন্দ করবার দায়িত্বটা রইল না। আপনারা ওনার আত্মীয়, ওনার স্বজন এবং অভিভাবক। তাই আপনারাই এখন দেখে শুনে তার বিয়ে দেবেন। আমিও সে’সব শুনেই এ’ কথা বলছি”।
রচনার সাথে কথা বলতে বলতে আলিপুরদুয়ার থেকে পরিতোষের পিসি পিসেমশাই আর বৌদির আসবার কথা জানিয়ে দিল। রচনাও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। কিন্তু সীমন্তিনী তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে কথা শেষ করে অর্চনার খোঁজ করতে করতে পাশের ঘরের দিকে যেতেই অর্চনা সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “দিদিভাই, নীতাদি বোধহয় খুব ব্যস্ত আছেন। দু’বার ফোন করলুম। ধরলেন না। আমি একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি শেষে”।
সীমন্তিনী বলল, “ভাল করেছিস। তবে এখন ম্যাক্সিটা ছেড়ে একটা চুড়িদার পড়ে নে চট করে। ওদের গাড়ি এলেই কিন্তু আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। নইলে জিনিসগুলো আনতে একা লক্ষ্মীদি হিমশিম খাবে। তুই ড্রেসটা চেঞ্জ করে আয় আমি রান্নাঘরের জানালা থেকে গেটের দিকে নজর রাখছি” বলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
সাড়ে ছ’টার একটু পরেই একটা হাল্কা বেগুনী রঙের বেশ বড়সড় একটা গাড়ি তাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়াতে সীমন্তিনী গাড়িটার নাম্বার দেখবার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটা ঠিক নজরে পড়ছিল না। কিন্তু গেটের একজন গার্ডকে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে দেখল। কয়েক সেকেন্ড পরেই সুন্দর শাড়ী পড়া এক ভদ্র মহিলাকে গাড়ির পেছনের জানালার সামনে বসে থাকতে দেখেই সীমন্তিনী রান্নাঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “লক্ষ্মীদি, চলে এস। ওনারা এসে পড়েছেন। অর্চু কোথায় গেলি রে? হয়নি এখনও তোর? ওরা এসে পড়েছেন তো”।
অর্চনা প্রায় সাথে সাথেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মূল দড়জা খুলে অর্চনাকে সাথে নিয়ে সীমন্তিনী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই দেখল দু’জন গার্ড গাড়ির পেছনের ডিকি খুলে পরীক্ষা করছেন। সীমন্তিনী দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই গার্ডেরা গেট খুলে দিল। গাড়িটা গেটের ভেতরে ঢুকতেই অর্চনা আর সীমন্তিনীর কাছাকাছি এসে পড়ল। ড্রাইভার তাদের দেখে গাড়ির গতি কমাতেই সীমন্তিনী ঘরের দিকে হাতের ঈশারা করে ড্রাইভারকে বলল, “ওই সিঁড়ির সামনে নিয়ে রাখুন”।
একদিক থেকে রামসিংও ছুটে এল। সিঁড়ির সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ির পেছন পেছন সীমন্তিনী আর অর্চনাও সেখানে পৌঁছে গেল। সীমন্তিনী পেছনের এক দড়জা নিজে হাতে খুলে দিয়ে আন্তরিকভাবে বলল, “আসুন আসুন। আমরা সবাই আপনাদের অপেক্ষা করছিলুম”।
অন্য দিকের দড়জাটা ততক্ষণে রামসিং খুলে দিয়েছে। গাড়ির ভেতর থেকে তারা তিনজন নেমে আসতেই সীমন্তিনী আর অর্চনা নিচু হয়ে সকলের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারা তিনজনেই প্রণাম নিতে না চাইলেও সীমন্তিনী আর অর্চনা তাদের প্রণাম করল। হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা দেবী দু’জনকে জড়িয়ে ধরলেন। নিরঞ্জনবাবু বললেন, “বিনা নোটিসে এভাবে হুট করে এসে তোমাদের নিশ্চয়ই খুব বিপাকে ফেলে দিয়েছি আমরা। এরজন্যে আগে ভাগেই তোমাদের সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “এমন করে বলবেন না পিসেমশাই। যেদিন থেকে আপনাদের কথা শুনেছি সেদিন থেকেই আপনাদের সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার খুব। কিন্তু কাজের এতটাই প্রেসার যে কিছুতেই সময় বের করে উঠতে পারছিলুম না। আপনারা যে নিজেরাই এসেছেন এতে আমি ব্যক্তিগত ভাবে কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। চলুন, ভেতরে চলুন, আসুন বৌদি, পিসি আসুন” বলে রামসিংকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ডিকির জিনিসগুলো ঘরে নিতে লক্ষ্মীদিকে একটু সাহায্য কোরো রামসিং। আর এনাদের ড্রাইভারকে গাড়ি রাখবার জায়গা আর তার থাকবার জায়গা দেখিয়ে দিও”।
হৈমবতীদেবী অর্চনার একটা হাত ধরে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যে সীমন্তিনী সেটা তো এতক্ষণে বুঝেই গেছি মা? কিন্তু এই মা-টি কে গো? এ কি নবনীতা? না আমার আরেক ভাইঝি অর্চু”?
সীমন্তিনী হৈমবতীদেবীর হাত ধরে ঘরের সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল, “ও অর্চু পিসি। নীতা এখনও বাড়ি ফেরেনি। আপনারা পরির মুখে হয়ত শুনেই থাকবেন যে নীতা এখানে একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। ওর ছুটি হয় রাত আটটায়। আর এখন তো পূজোর সীজন বলে ওদের শোরুমে ব্যস্ততা বেশী। তাই আপনাদের আসবার খবর পেয়েও বোধহয় আটটার আগে ছুটি পাবে না”।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সুলোচনাদেবী অর্চনার হাতটা ধরে বললেন, “তোমার বাবা বিধুমামুকে আমরা দেখেছি প্রায় মাস দুয়েক আগে। এরপর ভাইদা যেদিন আমাদের ওখানে এসেছিল, তার পরদিন মা-ই বিধুমামু মামী আর ভাইকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তোমাদের দু’বোনকেই দেখা বাকি ছিল। আজ তোমাকে দেখবার সৌভাগ্য হল। সত্যি তুমি ভারী মিষ্টি মেয়ে। তোমাকে দেখেই খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। তবে তুমি কিন্তু সম্পর্কে আমার ননদই। তবে ননদিনী রায়বাঘিনী হয়ো না যেন”।
অর্চনা লাজুক হেসে বলল, “এ মা, অমন করে বলবেন না বড়বৌদি”।
সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে বারান্দায় উঠে সুলোচনাদেবী হেসে বললেন, “আরে বিধুমামুর মত লোকের মেয়ে যে আমাদের ননদিনী রায়বাঘিনী কোনদিনই হবে না, সে আমরা সবাই জানি গো। আমি তো শুধু তোমার সাথে একটু ঠাট্টা করছিলুম ভাই। তবে আজ তোমাকে দেখে তোমাকে আমার ননদিনীর বদলে ছোট বোন বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে। আমাকেও তুমি তোমার দিদি বলে ভাবতে পার”।
******************
সকলে মিলে বসবার ঘরে বসবার পর অর্চনা সকলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। লক্ষ্মী আর রামসিং দু’জনে মিলে নিরঞ্জনবাবুদের গাড়ি থেকে অনেকগুলো কন্টেনার এনে রান্নাঘরে রেখেছে। অর্চনা কন্টেনারগুলো ঠিক জায়গা মত সাজিয়ে রাখতে লাগল। শেষবারে নিরঞ্জনবাবুদের লাগেজ গুলো লক্ষ্মী আর রামসিং গেস্টরুমে নিয়ে রাখল। সীমন্তিনী রামসিংকে আরও একবার নিরঞ্জনবাবুদের গাড়ির ড্রাইভারের কথা মনে করিয়ে দিল।
সীমন্তিনী সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে একটু জলখাবার খেয়ে নেবার অনুরোধ করতেই তারা সকলেই পোশাক বদলে নিতে চাইলেন। সে’কথা শুনে সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আসুন আমি আপনাদের থাকবার এবং শোবার জায়গাগুলো দেখিয়ে দিচ্ছি। সকলকে নিয়ে গেস্টরুমে এসে বলল, “পিসি, আপনি আর পিসেমশাই এ’ঘরে থাকবেন। ও’পাশে বাথরুম আছে। তবে জানালাগুলো এখন আর না খোলাই ভাল। এখানে এখন বাইরে প্রচুর মশার আনাগোনা শুরু হবে। জানালা খুললেই মশা ঢুকে পড়বে। ঘরে মশা তাড়াবার লিকুইড লাগানো আছে। আর রাতে মশারিও টাঙিয়ে দেব। আর বড়বৌদি, আপনি আমার সঙ্গে আমার ঘরে চলুন। আপনার লাগেজ কোনটা”?
সুলোচনা নিজের লাগেজটা নিয়ে বললেন, “তোমাকে নিতে হবে না ভাই, আমি নিচ্ছি”। সীমন্তিনী নিরঞ্জন বাবু আর হৈমবতীদেবীকে ফ্রেশ হতে বলে সুলোচনাকে নিয়ে নিজের ঘরে এল। সুলোচনাকে সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে সে আবার রান্নাঘরে এল।
সীমন্তিনীকে দেখেই অর্চনা বলে উঠল, “ও দিদিভাই, ওনাদের কাণ্ড দেখেছ। এতো খাবার এনেছেন যে দু’বেলাতেও শেষ হবে না”।
সীমন্তিনীও দেখল সত্যিই প্রচুর খাবার এসেছে। সে বলল, “ঠিক আছে, নিয়েই যখন এসেছেন তবে আর তো কিছু করার নেই। তবে অর্চু, তুই সোনা লক্ষ্মীদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে আগে তাদের জলখাবারটা দেবার বন্দোবস্ত করে ফ্যাল চট করে। আমি সবাইকে বসবার ঘরে নিয়ে আসছি”।
অর্চনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, তুমি তাদেরকেই সঙ্গ দাও। এদিকের সবকিছু আমি আর লক্ষ্মীদি দেখছি। তুমি কিচ্ছু ভেবো না”।
সীমন্তিনী লিভিং রুমে এসে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে চেয়ারগুলো সাজাতে সাজাতেই নিরঞ্জনবাবু আর হৈমবতীদেবী পোশাক পাল্টে সেখানে এসে হাজির হলেন। নিরঞ্জনবাবু বললেন, “তোমার কোয়ার্টারের লোকেশানটা সত্যিই খুব চমৎকার মন্তি মা। একটু বাদেই তো পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। একটু বাইরে গিয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখে আসা যাবে”?
নিরঞ্জনবাবুর মুখে ‘মন্তি মা’ সম্বোধন শুনে সীমন্তিনী এক মূহুর্তের জন্য চমকে উঠলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই জবাব দিল, “এখন সেটা না করাই ভাল পিসেমশাই। একটু আগেই বললুম না চারপাশে এখন প্রচুর মশার উৎপাত হবে। তাই এখন বাইরে না যাওয়াই ভাল। তবে আসুন আমি সবগুলো ঘর ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। সব ঘরেই কাঁচের জানালা আছে। বাইরের দৃশ্য দেখতে পাবেন। আপাততঃ ওটুকুতেই মন ভরিয়ে নিন। বাকিটুকু কাল সকালে বাইরে গিয়ে দেখবেন”।
হৈমবতীদেবী সীমন্তিনীর কথায় সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ সেই ভাল। মিছেমিছি মশার কামড় খেয়ে রোগ বাধাবার দরকার নেই”।
তখনই সুলোচনাও সীমন্তিনীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনজনকে নিয়ে এ’ঘরে সে’ঘরে গিয়ে সীমন্তিনী সবাইকে দেখাতে লাগল। আঁধার প্রায় ঘণিয়ে এসেছিল। বেশী দুরের জিনিস আর চোখে পড়ছিল না তেমন। এক সময় অর্চনা এসে শান্ত কন্ঠে বলল, “দিদিভাই, তোমাকে লক্ষ্মীদি একটু রান্নাঘরে যেতে বলছেন। তুমি যাও, বাকি ঘরগুলো নাহয় আমিই তাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছি। আর সন্ধ্যা প্রদীপটাও জ্বালিয়ে দিচ্ছি”।
সীমন্তিনী চলে যেতে বাকি ঘরগুলো তাদের দেখিয়ে অর্চনা ছোট ঠাকুরঘরের কাছে এসে বলল, “এটা হচ্ছে দিদিভাইয়ের ঠাকুরঘর। ভেতরে যাবেন? অবশ্য আমাকে এখন ঢুকতেই হবে। সন্ধ্যা প্রদীপটা জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছি”।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, “না থাক। ভেতরে আর ঢুকছি না”।
কিন্তু হৈমবতীদেবী নিরঞ্জনবাবুকে বললেন, “বেশ তুমি তাহলে বসবার ঘরে গিয়েই বোসো। আমি একটু ঠাকুরঘরটা দেখেই যাই”।
সুলোচনাও বললেন, “আমিও ঠাকুরঘরটা দেখব একটু”।
অর্চনা সামান্য হেসে বলল, “বেশ তো, আসুন তাহলে। তবে পিসি, এ ঘরে কিন্তু কোনও চেয়ার বা উচ্চাসন বলতে কিছু নেই। আর আসন শুধু একটাই। তাই বসতে হলে কিন্তু মেঝেতেই বসতে হবে। তাতে হয়তো আপনার অসুবিধে হতে পারে”।
হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা অর্চনার সাথে ভেতরে ঢুকেই প্রথমে ছোট্ট একটা সিংহাসনে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, মা সারদা, আর স্বামী বিবেকানন্দের ছবিকে প্রণাম করলেন। অর্চনাও ভক্তিভরে ঠাকুরকে প্রণাম করে মেঝেতে বসেই সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালাবার আয়োজন করতে করতে বলল, “পিসি, আমার তো সন্ধ্যারতি দিতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এ ঘরে তো বসতে দেবার মত কিছু নেই। আপনারা বরং বসবার ঘরে গিয়েই বসুন। আমি ঠাকুরের আরতিটুকু সেরেই আসছি”।
হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি তোমার কাজ করো মা। আমরা একটু সময় থাকি এখানে। তারপর যাবো’খন”।
অর্চনা আর কিছু না বলে ধুনুচি আর পঞ্চপ্রদীপ সাঁজাল। তারপর প্রথমে প্রদীপ আর তারপর ধুনুচি জ্বালিয়ে ঠাকুরের আরতি করতে শুরু করল। তারপর তিনবার শাঁখে ফুঁ দিয়ে পঞ্চপ্রদীপ আর ধুনুচি নিয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এল। এক এক করে সব ক’টা ঘরে প্রদীপ দেখিয়ে রান্নাঘরের সামনে আসতেই সীমন্তিনী আর লক্ষ্মী প্রদীপের ওম নিয়ে নিজেদের মাথায় হাত ছোঁয়াল। বসবার ঘর দিয়ে ফিরে আসবার সময় অর্চনা নিরঞ্জনবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনিও প্রদীপের ওম নিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। ঠাকুর ঘরে ফিরে এসে দেখে হৈমবতীদেবী আর সুলোচনাদেবী তখনও ঠাকুর ঘরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের কাছে যেতেই তারা দু’জনেও প্রদীপের ওম নেবার পর অর্চনা ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে প্রদীপের ওম নিয়ে নতজানু হয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করল। সব কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “আচ্ছা অর্চু মা, তুমি যদি কিছু মনে না করো, তবে এখন তোমাকে দুটো প্রশ্ন করতে পারি”?
অর্চনা হৈমবতীদেবীর দিকে হাসিমুখে চেয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ পিসি, বলুন কী জানতে চাইছেন”?
হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “এই এ ঘরে, মানে এই ঠাকুরঘরে বসবার জন্যে কোন চেয়ার বা টুল রাখা হয়নি, কেন গো”?
অর্চনা মুচকি হেসে বলল, “আসলে পিসি, আমি আর রচু যেমন আমাদের মা-বাবার মেয়ে, তেমনই দিদিভাইও আমাদের মা-বাবার আরেক মেয়ে। আমরাও সকলেই দিদিভাইকে আমাদের বড়দিদি বলেই মানি। আর আমাদের মা বাবা ছোটবেলাতেই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে বৈষ্ণব ধর্মমতে কোনরকম উচ্চাসনে বসে কৃষ্ণকথা শুনতে নেই, উচ্চাসনে বসে ভগবান দর্শন করতে নেই। দিদিভাইও বাবার কাছে এ’ শিক্ষাই পেয়েছেন। তাই এ’ঘরে কোনরকম উচ্চাসন রাখা হয় না। আর তাছাড়া তেমন প্রয়োজনও বোধ হয় পড়েনি”।
হৈমবতীদেবী অর্চনার মুখটা দু’হাতে অঞ্জলী করে ধরে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন, “বেঁচে থাকো মা। ঈশ্বর যেন তোমাকে চিরকাল সুখে রাখেন। সত্যি, বিধু তোমাদের খুব ভাল শিক্ষা দিয়েছে”।
সুলোচনাদেবী তার শাশুড়িকে বললেন, “মা, আমাদের বাড়িতেও তো ঠাকুরঘরে কোনও উচ্চাসন নেই। কিন্তু তা না থাকবার পেছনে কারন যে এটা, এ’কথা তো আমরাও কেউ জানতুম না। এটাই কি আসল কারন মা”?
হৈমবতীদেবী মিষ্টি করে হেসে তার জবাবে বললেন, “হ্যাঁ বড়বৌমা। অর্চু যেটা বলল সেটাই আসল কারন। আমার বাবা-মাও আমাকে ছোটবেলায় এ’কথা শিখিয়েছিলেন। আজকালকার ছেলে মেয়েরা তো এ’সব পাঠ প্রায় চুকিয়েই ফেলেছে” বলে আবার অর্চনাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, “আর আমি আরেকটা কথা যেটা তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছিলুম সেটা হল, তুমি সব জায়গায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেখালে কিন্তু এ ছবিটায় তো দেখালে না! এটা কার ছবি গো”?
অর্চনা একটু হেসে বলল, “জীবিত ব্যক্তির ছবিতে তো মালা পড়াতে, ধূপ বা প্রদীপ দেখাতে হয় না। ইনি আমাদের দিদিভাইয়ের দাদা, তার জেঠুর ছেলে। আর আমার ছোটবোন রচনার স্বামী রতু দা। দিদিভাইয়ের থেকে মাত্র ছ’মাসের বড়। প্রায় সমবয়সী আর দুই বন্ধুর মত একসাথে বড় হয়ে উঠলেও দিদিভাই তাকে ভীষণ ভালবাসেন, আর শ্রদ্ধাও করেন তেমনই। তাই ঠাকুর প্রণাম করতে এসে রোজই তার দাদাভাইকেও প্রণাম করেন। এখানে ছবিটা রাখলে কোনদিন প্রণাম করতে তার ভুল হবেনা বলে দিদিভাইই এই ছবিটা এখানে রেখেছেন”।
হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা অর্চনার কথা শুনে একপলক নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নিলেন। সুলোচনা রতীশের ছবিটার কাছে এসে বললেন, “বাঃ, খুব সুন্দর দেখতে কিন্তু! তাই না মা”?
হৈমবতীদেবীও ছবিটার কাছে এসে দেখতে দেখতে বললেন, “হ্যাঁ বড়বৌমা, ঠিক বলেছ তুমি। সত্যি খুব সুন্দর। বিধুর ছোটমেয়েকে তো এখনও দেখিনি আমরা। তবে ওর স্ত্রী,ছেলে আর বড়মেয়েকে দেখে মনে হয় রচনাও বেশ সুন্দরী রূপসীই হবে। দু’জনকে জুটিতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর দেখাবে। কিন্তু এ ছবিটা তো বেশ পুরনো। মনে হচ্ছে কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলে যেন। এটা কতদিন আগে তোলা ছবি, সেটা তুমি জানো অর্চু”?
অর্চনা মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ পিসি, ওদের দুটিকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। কালচিনিতে আমাদের প্রতিবেশীরা বলেন ওদের দেখলে নাকি হর-পার্বতীর জুটি বলে মনে হয়। তবে রতুদার এ ছবিটা সত্যিই অনেক পুরনো। তাদের বিয়ের আগের ছবি। তবে কতদিন আগে তোলা, সেটা আমার ঠিক জানা নেই গো”।
হৈমবতীদেবী বললেন, “তোমার ছোটবোন রচুও নাকি আমাদের পরিকে খুব ভালবাসে। তাকে নাকি নিজের দাদার মত শ্রদ্ধা করে। আর পরিকে যেদিন আমরা পেলুম সেদিন থেকেই জানি ও-ও মেয়েটাকে নিজের বোনের মতই ভালবাসে”।
এবার সুলোচনা বললেন, “জানো অর্চু, ভাইদার মুখে রচনার কথা শুনে আমরা ......”
অর্চনা সুলোচনার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের ভাইদা কে গো বৌদি”?
সুলোচনা হেসে বললেন, “ওহ, সত্যিই তো। সেটা না বললে বুঝবে কেমন করে। তবে বৌদি নয়, আগেই বলেছি না তুমি আমাকে দিদি বা বড়দি বলে ডাকবে। তবে শোনো, আমরা তিন জা পরি ঠাকুরপোকে ভাইদা বলে ডাকি। এবার বুঝেছ তো? তা যে’কথা বলছিলুম আর কি। মা-র সাথে দেখা হবার পর ভাইদা যখন সবার প্রথমে রচনাকে ফোন করতে চেয়েছিল, তখন আমরা সবাই ভেবেছিলুম রচনা বুঝি ভাইদার প্রেমিকা। কিন্তু ফোনের স্পীকার অন করে ভাইদা যখন রচনা আর ওর বরের সাথে কথা বলল, তখনই আমাদের ভুল ভেঙেছে”।
হৈমবতীদেবী আবার বললেন, “যে মূহুর্তে আমি প্রথম পরিকে দেখেছিলুম সেদিন, ওই মেয়েটা নাকি তখন প্রায় ঘন্টাদেড়েক ধরে ঠাকুরের কাছে আমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছে। ওর প্রার্থনার জোরেই সেদিন হয়ত আমার বড়সড় কোনও বিপদ হয়নি। জানিনা ওকে দেখবার সৌভাগ্য আমার কবে হবে”।
অর্চনা আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “অবশ্যই দেখা হবে পিসি। ওরা হয়ত পূজোর সময় আসবে। আর আমাদের গৃহারম্ভের সময়েও হয়ত আসবেই। তখন আশা করি আপনার সাথেও ওদের দেখা হবে। আর আপনারা যদি আপনাদের ভাইপোর বিয়ের আয়োজন করতে পারেন, তাহলে তো রচু আর রতুদাও সে বিয়েতে আসবেই। তখন তো দেখতেই পারবেন”।
হৈমবতীদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “আমরা যে পরির বিয়ের আয়োজন করব এ’ কথা তোমাকে কে বলল মা”?
অর্চনা সহজভাবেই জবাব দিল, “না, সেভাবে কেউ বলেনি। কিন্তু এতদিন তো আপনাদের ভাইপোর পাশে নিজের লোক, আপন বা অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। তাই আগেরবার যখন দিদিভাই কলকাতা গিয়েছিলেন, তখন রচু, দিদিভাই আর নীতাদিই অনেক কষ্টে আপনার ভাইপোকে বিয়ের জন্যে রাজী করিয়েছিলেন। দিদিভাই আর নীতাদির পছন্দ করা মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন বলে তাদের দু’জনের ওপরেই তার জন্য পাত্রী পছন্দ করবার ভারও তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু ক’দিন আগে তিনি যখন আপনাদের খুঁজে পেলেন তখন থেকেই দিদিভাই আর নীতাদি বলছিলেন যে এবারে আর তাদের ওপর পাত্রী পছন্দ করবার দায়িত্বটা রইল না। আপনারা ওনার আত্মীয়, ওনার স্বজন এবং অভিভাবক। তাই আপনারাই এখন দেখে শুনে তার বিয়ে দেবেন। আমিও সে’সব শুনেই এ’ কথা বলছি”।
(To be cont'd ......)
______________________________