30-03-2020, 05:13 AM
ক্যাব থেকে বাড়ির ঠিক সামনে নেমে পড়লো দুজনে | বিথী নেমে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল একপাশে আর আকাশ ড্রাইভারের নির্দিষ্ট ভাড়া মিটিয়ে বিথীকে নিয়ে বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো |
কলিং বেল বাজাতেই আকাশের মা এসে দরজা খুলে ওদের ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো | আকাশের মাও বিথীকে বেশ ছোটোবেলাতেই দেখেছিলো | তাই এতদিন পর দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল
"কিরে মা, কত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই | চেনাই যাচ্ছে না তো তোকে | যাই হোক, আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো রে? "
বিথী নিজের স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসিমুখ নিয়ে জবাব দিলো
"না না, কোনো অসুবিধা হয়নি | আকাশদা খুব ভালোভাবে যত্ন নিয়ে আমায় নিয়ে এসেছে"
এই বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করলো |
আকাশও ছোট্টো হাসির মধ্যে দিয়ে তার উত্তর দিলো |
এবার ড্রয়িং রুম দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দিদার সাথে দেখা | সোফায় বসে অপেক্ষা করছিল দিদা | ওকে দেখতে পেয়েই একগাল হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো |
বিথী এসেই প্রথমে দিদার পায়ে প্রণাম করতে গেলে দিদা কাঁধটা ধরে বুকে টেনে নিলো |
"থাক থাক মা, খুব ভালো থাকো আর অনেক বড় হও, তুমি ঠিক আছো তো মামনি? কোনো অসুবিধা হয়নি তো আসতে? "
আকাশ এতক্ষনে বুঝে গিয়েছে এখানে থাকা মানেই এখন এসবই চলবে | তাই ও সঙ্গে সঙ্গে মাকে বলল
"বলছি ওর ব্যাগ গুলো কোন ঘরে রাখবো? "
মা, ডানদিকের দ্বিতীয় ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বললো
"ওটায় রেখে দে | বিথীর জন্য ওই ঘরটা ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি |"
আকাশ সোজা ওখান থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ালো | ঘরে ঢুকে একটু অবাকই হল আকাশ |বেশ পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে ঘরটা | একটু ঈর্ষান্নিত মন নিয়েই বিড় বিড় করে উঠলো
"বাবা, আমার ঘরটা তো মা কোনোদিন এত ভালো করে গুছিয়ে দেয় নি, উল্টে পান থেকে চুন খসলে খালি বকবক করে"
সাথে সাথে এটাও বুঝে গেলো এই অতিথি আর পাঁচটা সাধারন অতিথি না | অনেক কাঠখর অপেক্ষা করছে ওর কপালেও এই সদ্দ্য আগত অতিথিকে কেন্দ্র করে | ব্যাগ দুটো ওপরের সেল্ফে রেখে নিজের মনেই বলল, যতসব আদিখ্যেতা |
আকাশ বেরোতে বেরোতেই আকাশের মা বিথীকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো আর আকাশ সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো কারণ না হলে একের পর এক আদেশ আসতেই থাকবে |
বিথী যে নিজের থাকার ঘরটি দেখে খুব খুশি হয়েছে তা তার মিষ্টি হাসির মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পাচ্ছিলো | আকাশের মা সেটা যথাযথ অনুমান করেই বলল
"কিরে মামনি, পছন্দ হয়েছে তো? "
বিথী মিষ্টি হাসিমুখটি নাড়িয়ে হ্যা, খুব পছন্দ হয়েছে সেটা বুঝিয়ে দিলো |
তাও আকাশের মা বলে দিলো যদি কোনোরকম অসুবিধা হয় বা কিছু লাগে তাহলে যেনো লুকিয়ে না রাখে
"মামনি, কিছু অসুবিধা হলে আমাদের নির্দিধায় বলবি | আর তোর ওপাশের সামনের ঘরটাই আকাশদার | ওকেও বলতে পারিস যদি কিছু দরকার হয় |"
বিথী মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলো
"আচ্ছা"
আকাশ আর বিথী দুজনেই স্নান সেরে বেরোতে বেরোতেই দুপুরের খাওয়ার ডাক পড়লো |
বিথী একটা ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে এলো | সবে স্নান করেছে বলে ভেজা চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে | ড্রয়িং রুমে আসার পথে আকাশের ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলো খুব মন দিয়ে চুল আঁচরাচ্ছে | নিজের মনেই একটু হেঁসে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো |
টেবিলে দিদা বসেই ছিলো আর আকাশের মা সব খাবার দাবারের বাটি প্লেট সব ঠিকঠাক করছিলো | বিথী হাসিমুখে বলল
"কাকিমা আমিও তোমার হাতে হাতে করে দি, দাও"
"এ মা না না মামনি, তুমি এতটা জার্নি করে এসেছো | তুমি বসে পড়ো আমার হয়ে গিয়েছে গোছানো"
তারপরেও বিথীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দিদা বলল
"কিরে মা, খেতে বোস | দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? "
বিথী আসতে করে উত্তর দিলো
"আকাশদা আসুক | তারপর না হয় একসাথে বসবো|"
এই শুনে আকাশের মা মুচকি হেসে জোরে ডাক দিলো আবার
"এই যে লাটসাহেব আপনার কি হয়েছে? আমরা সবাই অপেক্ষা করছি আপনার জন্য"
আকাশ ততক্ষনে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা মার দিকে তাকিয়ে একটু রাগ নিয়ে উত্তর দিলো
"শোনো মা, ঘরের মধ্যে সবসময় এরকম চিল্লামিল্লি করবে না তো, বিরক্তি লাগে"
কথাটা শেষ করেই বাঁদিকে দাঁড়ানো বিথীর দিকে চোখ পড়লো |
সদ্যস্নাত ভেজা খোলা চুলে বেশ লাগছিলো বিথীকে | আগের থেকে অনেকটা অন্যরকম | হয়ত ক্লান্তিটা অনেকটা কেটে গিয়েছে বলেই | ঘিয়ে রঙের সালোয়ারে বেশ মানিয়েছে বিথীকে | ওর পাশে দাঁড়িয়ে এক মূহুর্ত পর্যবেক্ষন করে নিলো বিথীকে | খোলা চুল কোমর ছাড়িয়ে নেমে গিয়েছে আরও খানিকটা নিচে |
"তুই না এলে বিথীও বসছিলো না | তাই ডাকতে বাধ্য হলাম | না হলে তো আপনার ঠিক থাকে না কতক্ষন লাগাবেন |"
এই শুনে একটু ইতস্তত হয়ে বিথীর দিকে তাকালো
"একি,তুমি বসোনি কেনো? আমি তো আসছিলামই | আচ্ছা বসো বসো |"
সবাই মিলে টেবিলে খেতে বসেই আকাশের চক্ষু চড়কগাছ | মাংশের সাথে দুরকমের চুনোমাছ | আকাশ মাছ মোটেই পছন্দ করে না কখনোই, আর চুনোমাছ তো একদমই না | আকাশের মা সবাইকে ভাত দিতে দিতে বিথীকে বললো
"মামনি, তুই ছোটো মাছ খুব ভালোবাসিস তো খেতে | তাই আর কি রান্না করবো ভেবে না পেয়ে দুরকমের মাছ করেছি | তোর অসুবিধা হবে না তো খেতে? "
"না না কাকিমনি, ছোটো মাছ আমার খুব প্রিয় | আমি খুব ভালো খাই এগুলো"
বিথীর মুখে কথাগুলো শোনার পর আকাশের মনে হলো কে যেনো ফিসফিস করে ওর আর এক কানে বলছে
"বাছাধন,হয়ে গেলো তোমার ছুটির দিনগুলোর দফারফা"
মা আকাশের পাতে খাবে না জেনেও একটু মাছ দিতে গেলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো আকাশ |
"আরে কি করছো কি? তুমি জানো না আমি এসব চুনোমাছ খাইনা | আমায় দিচ্ছো কেনো? আমায় খালি মাংশ দাও"
এই শুনে বিথী আকাশের দিকে তাকিয়ে অকপটে বললো
"আকাশদা তুমি চুনোমাছ খাও না? চুনোমাছ কিন্তু শরীরের জন্য খুব ভালো | বিশেষ করে চোখের জন্য | তোমার খাওয়া উচিত কিন্তু"
আকাশ এই অকপট বিজ্ঞপ্তি শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হলেও মুখে কিছু না বুঝিয়ে চুপচাপ মাংশ দিয়ে খেতে শুরু করে দিলো | আড় চোখে মাঝে মাঝে বিথীর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো ও ম্যান ইউ এর সাপোর্টার হয়ে যেনো ম্যান সিটির কোন হার্ডকোর ফ্যান এর সাথে খেতে বসেছে | মনে মনে ভাবতে লাগলো বাচ্চা মেয়ে, অল্প বয়সে বেশি বুঝে ফেলেছে সবকিছু | দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে এই মেয়ের থেকে, নাহলে আবার কখন কি বলে বসে তার ভরসা নেই | কোনোমতে খাওয়া শেষ করে "আমি উঠলাম" বলে হাত মুখ ধুয়েই হাঁটা দিলো নিজের ঘরের দিকে |
দুপুরে মা আর দিদা একটু ভাত ঘুম দেয় | তাই ওরা নিজেদের রুমে শুতে চলে গিয়েছে | এদিকে বিথী বেশ ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও ওর দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলো না | আসলে অন্য বিছানায় প্রথম প্রথম এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক | তাই এদিক ওদিক করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না | কিছুক্ষন পর ওদিকের ঘর থেকে অরিজিত সিং এর বেশ কিছু মিষ্টি হিন্দি গান ভেসে আসতে লাগলো | বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আকাশ গান চালিয়েছে | অরিজিত সিং বিথীর খুব পছন্দের | তাই নিজের মনেই গানের সাথে গুনগুন করতে করতে কখন যে দুই চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছে নিজেই বুঝতে পারে নি |
শাঁখের আওয়াজে ঘুম ভেঙে বুঝতে পারলো সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে | তরিঘরি উঠে হাত মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো | সোফায় দিদা বসে টিভি দেখছিলো আর আকাশের মা সব ঠাকুরদের ধূপ দেখাচ্ছিলো | বিথীকে দেখে দিদা হেঁসে ওকে সোফায় বসতে বললো |
"ঘুম হয়ে মা? "
"হ্যাঁ দিদান, খুব ভালো ঘুম হয়েছে"
আকাশের মার ততক্ষনে সন্ধ্যে দেওয়া হয়ে গিয়েছে | ওদের কাছে এসে বললো
"মামনি, তুই দিদার সাথে একটু গল্প কর, আমি চা বসাচ্ছি"
বিথী কয়েকবার নিজে চা করার কথা বললে আকাশের মা ভালোবাসার ধমক দিয়ে ওকে বসিয়ে দিলো
"বাচ্চা মেয়ে, চুপ করে বসো এখানে | আমি চা করে নিয়ে আসছি"
তারপর বিথীর মাথায় হাত বুলিয়ে হেঁসে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো |
চা আসতে আসতে দিদা ওর থেকে বাড়ির সবার আর গ্রামের বাকি পরিচিতদের কিছু কিছু খবরাখবর নিয়ে নিলো |
একটা চা এর কাপ টেবিলে রেখে ওদের দুজনকে দুটো কাপ আর সাথে এক ট্রে বিস্কুট রেখে আকাশের মা রাখা কাপ টা তুলে নিলো |
বিথী ওইদিকে তাকিয়ে বললো
"তুমি চা খাবে না কাকিমনি? "
"হ্যাঁ খাবো, কিন্তু তার আগে লাটসাহেবকে চা টা দিয়ে আসি"
বিথী সাথে সাথে চা এর কাপটা নিজের হাতে নিয়ে কাকিমনিকে জোর করে বসিয়ে দিলো
"না না, তুমি চা খাও | আমি আকাশদাকে চা দিয়ে আসছি"
চা এর কাপ নিয়ে আকাশের ঘরের দিকে যেতেই দিদা আসতে আসতে মাকে বললো
"দেখেছিস রমা, মেয়েটা কি লক্ষ্মী | একদিনেই কেমন সবাইকে নিজের করে নিয়েছে"
"হ্যাঁ মা, একদম ঠিক বলেছো"
আকাশের রুমের দরজা খোলাই ছিলো তাও বিথী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার ডাক দিলো
"ভেতরে আসতে পারি? চা নিয়ে এসেছি"
সাথে সাথে ভেতর থেকে আওয়াজ এলো
"আরে এসো এসো"
ভেতরে ঢুকতেই দেখলো আকাশ একটা গেঞ্জি আর একটা ফর্মাল পাজামা পরে রেডি হচ্ছে বেরোনোর জন্য | ঘরের চারদিকটা একটু চোখ বুলিয়ে যা বুঝলো তাতে মনে হলো ছেলেটা যথেষ্ট আগোছালো |
"তুমি কি কোথাও বেরোচ্ছো? "
"হ্যাঁ, ওই বন্ধুদের সাথে পাড়ার মোরের চা এর দোকানে একটু আড্ডা দিতে যাবো"
"ও আচ্ছা, তোমার চা টা কোথায় রাখবো? "
"এই তো আমায় দাও"
চা এর কাপটা আকাশের হাতে দিয়ে বেরিয়ে এসে সোফায় বসলো | কাকিমনি জিজ্ঞাসা করলো
"ও কি উঠেছে? "
"হ্যাঁ, রেডি হয়ে কোথায় যেনো বেরোচ্ছে"
আকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে টেবিলে ফাঁকা কাপটা রেখে বেরোতে যাবে এমন সময় যথারীতি দিদা বাঁধ সাধলো |
"বাবু তুই কি এখানেই যাবি না অন্য কোথাও? "
"না দিদা, এই মোড়ে"
"তাহলে এক কাজ কর না, বিথীকে একটু নিয়ে যা না সাথে করে | বেচারী বাচ্চা মেয়ে, আমাদের সাথে বসে একা একা কি করবে"
আকাশের ওইসময় মনে হচ্ছিলো ওর যদি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকতো তাহলে হয়ত ওর থেকে খুশি আর কেউ হতো না |
"আমি তো মোড়ের মাথায় আড্ডা দিতে যাচ্ছি, ও ওখানে গিয়ে কি করবে"
"আরে ওখানে কেনো নিয়ে যাবি, আমি বললাম ওকে নিয়ে একটু হাতিবাগান মার্কেটটা ঘুরিয়ে নিয়ে আয় | ওর যদি টুকটাক কিছু কেনার থাকে তাহলে কিনেও নিতে পারবে"
আকাশ বুঝে গেলো যে ওর সন্ধ্যের আড্ডাটাও আজ মাটি হতে চলেছে | তাই একটু বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে বিথীর দিকে তাকালো | বেচারি এতক্ষন বেশ উৎসাহের সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো কিন্তু ওর ওইরকম চাহনি দেখে কেমন যেনো ইতস্তত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলো | তাই মনে ইচ্ছা থাকলেও বেরোনোটা কাটানোর চেষ্টা করলো |
"না না দিদা, আমার এখন কিছু কেনার নেই | যখন দরকার হবে আমি নিজে থেকেই বলবো |আকাশদা তুমি বরং যেখানে যাচ্ছিলে যাও"
কিন্তু আকাশ ভালো করেই জানে দিদার মাথায় একবার যখন ঢুকেছে সেটা ওকে দিয়ে করিয়েই ছাড়বে | আর তা যদি না হয় তাহলে রাতে আবার অন্তত: একশোখানা ইমোশানাল অত্যাচারের সম্মূখীন হতে হবে ওকে | তাই সাথে সাথে মুখের ভাব ভঙ্গীমা বদলে দিয়ে বিথীকে বললো
"না না কোনো ব্যাপার না | আমার তেমন জরুরী কাজ নেই | চলো তোমায় মার্কেট থেকে ঘুরিয়ে আনি"
বিথী কয়েকবার না না করলেও দিদা একপ্রকার জোর করেই ওকে রেডি হতে পাঠিয়ে দিলো
"যা না মা, একটু ঘুরে আয় | খুব বড় মার্কেট এখানে | ভালো লাগবে তোর, যা ওর সাথে ঘুরে আয়"
অগত্যা বিথীও রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো আকাশের সাথে |
ময়ূরপঙ্খী রঙের সালোয়ার পরে আকাশের পাশে হাঁটছিলো বিথী | আকাশের কেমন যেনো নিজেকেই একটু বেমানান লাগছিলো ওর পাশে আর তার সাথেই দিদার ওপর আরও রাগ হচ্ছিলো | দিদা আগে কিছুই বলতে পারে না, তাহলে আর একটু ভালো কিছু পরে আসতাম, ধুর|
মোড়ে যেতেই দুই বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায় ওদের | দুজনেই জিজ্ঞাসু তার সাথে সাথে বেশ ভালোলাগার রেশ নিয়ে তাকিয়ে আছে বিথীর দিকে | আকাশ ভালো করেই চেনে ওর বন্ধুদের | কাল থেকেই বন্ধুমহলে এটা আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে | তাও নিরুপায় হয়ে সৌজন্যতাবোধ দেখিয়ে ওদের একে অপরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো |
"বিথী ওরা হলো আমার ছোটবেলার বন্ধু | ও দীপ আর ও সমর | আর ও হলো আমার কাকুর মেয়ে, বিথী"
দীপ সবে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করতে যাচ্ছিলো কিন্তু বিথী হাত জোর করে নমস্কার করায় একটু বেয়াকুব হয়ে ওরাও তাই করলো |
পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আকাশ সঙ্গে সঙ্গে বিথীকে নিয়ে ওখান থেকে এগিয়ে গেলো
"আচ্ছা, তোরা গল্প কর | আমি আজ ওকে নিয়ে মার্কেটটা একটু ঘুরে আসি"
হাতিবাগানের রাস্তায় ভর সন্ধ্যেবেলা যথারীতি ভীড় উপচে পড়ছে | দুজনে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে কোনোমতে মার্কেটের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে | ধাক্কাধাক্কি আর গরমের মধ্যে বিথীর এইভাবে হাঁটতে একদম ভালো লাগছিলো না
"আমার এরকম ভীড় ভাট্টার মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করতে একদম ভালো লাগে না"
"আমারও"
"এখানে কোনো বসার যায়গা নেই? "
"গঙ্গার ঘাট আছে, কিন্তু এই রাতে ওখানে না যাওয়াটাই ভালো"
"ওহ"
একটু মনমরা হয়ে চুপচাপ আকাশের পাশে পাশে হাঁটতে থাকে | দুজনেরই এই ভীড়ে হাঁটাটা বিরক্ত লাগছে বুঝতে পেরে আকাশ বিথীকে হাতিবাগান মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিলো |
"বিথী, এটা স্টার থিয়েটার | নিচে সিনেমা হল দেখতেই পাচ্ছো, কিন্তু ওপরে একটা সুন্দর বসার যায়গা আছে | যাবে? "
স্টার থিয়েটারের ওপরে সত্যি খুব সুন্দর একটা রুফ টপ আছে, মানে খোলা আকাশের নিচে টেবিল চেয়ার পাতা | চা, কফি, স্ন্যাক্স খেতে খেতে সুন্দর গল্প করা যায় | তার সাথে সাথে মাঝে মাঝে ভালো গান বাজনার প্রোগ্রামও হয় |
এতক্ষনে বিথীর ধরে যেনো প্রাণ ফিরে এলো | তাই এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করেই মত দিয়ে দিলো
"হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো | চলো ওখানেই যাই"
দুজনে সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেকটা ওঠার পর আকাশ বিথীকে একটু দাঁড়াতে বলে রুফ টপের দুটো এন্ট্রির কুপন কেটে নিলো | তারপর সোজা ওপরে উঠে গেলো বিথীকে সাথে নিয়ে | আকাশ ছোটো থেকেই এখানে এসেছে, তাই সবকিছুই জানা, কিন্তু বিথী প্রথমবার আসায় ওর খুব ভালো লাগলো খোলা আকাশের নিচে এই বসার আর গল্প করার যায়গাটা |
অনেক অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে দলে দলে বসে জমিয়ে আড্ডা আর তার সাথে খাওয়া-দাওয়া করছে | বিথী চারদিকের সেইসব মন দিয়ে দেখছিলো তখনই আকাশের ডাকে ওর দিকে তাকালো | আকাশ পাশেই একটা ফাঁকা টেবিল দেখে ওকে ওখানে বসতে ইশারা করলো | দুজনে বসে যায়গাটা নিয়ে টুকটাক কথা বলার পর আকাশ জিজ্ঞাসা করলো
"কি খাবে বলো? "
"না না, আমি কিছু খাবো না"
"সেকি তাই হয় নাকি, অন্তত: চা বা কফি খাও"
অনেক বলা কওয়ার পর ঠিক হলো দুজনে দুটো চা আর সাথে আকাশ জোর করেই দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলো |
বিথী সমানে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজের মনেই বলে উঠলো
"ইশশশ!! কি সব ড্রেস পরেছে"
আকাশ কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে তাকালো
"আমায় কি কিছু বললে? "
"না না, তোমায় না"
"তাহলে? "
"না কিছু না"
"আরে বলো, কোনো ব্যাপার না, কি হয়েছে? "
বিথী ডানদিকের একটা টেবিলে বসা কিছু মেয়েদের দিকে ইশারা করে বললো
"ওই যে ওরা, ওগুলো কোনো ড্রেস হলো? "
আকাশ ওর আঙুল বরাবর দেখে বুঝতে পারলো ও কি বলতে চাইছে, তাই ওকে বুঝিয়ে বললো
"আসলে, কলকাতায় এগুলোই নর্মাল বিথী | এগুলোই এখনকার ফ্যাশন, এতে খারাপের কিছু নেই"
বিথী একটু রাগের সাথে তাকালো আকাশের দিকে
"শোনো আকাশদা, আমিও খারাপ বা ভালো সেইসব বিচার করছি না | কিন্তু শালীনতা বলে একটা ব্যাপার আছে মেয়েদের | ফ্যাশন আমিও বুঝি | একটা মানুষের কাছে তার ফ্যাশন সেটাই যেটায় সে নিজে সাবলীল এবং তার সাথে সাথে নিজের কাছে সুন্দর | ওরা ওরকম ড্রেস পরেছে সেটা খারাপ না কিন্তু ওটাকে ওইভাবে মানিয়ে নিয়ে চলাটা হলো আসল |
আর একটা কথা বলি তোমায়, মেয়েদের আসল অলঙ্কার তার আভরণে, তার শৃঙ্গারে, তার লজ্জায় | একটা বইকে তুমি যতই যত্নে রাখো না কেনো, তাকে যদি তুমি সুন্দর করে মলাট দিয়ে সাজিয়ে রাখো, আগে সেটাই তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে"
বিথীর কথা শেষ হতে হতেই ওদের অর্ডার চলে আসে | কিন্তু বিথীর কথা গুলো কোথায় যেনো আকাশের মনের আকাশের মেঘটাকে আবার জমাট বাঁধিয়ে দেয়, হয়ত আরো একটু গভীর ভাবে | বিথী চা এর কাপটা হাতে নিয়ে নির্লিপ্তভাবে মাথা নিচু করে ফুঁ দিতে থাকে আর ওদিকে চা এর কাপ হাতে নিয়ে ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আকাশ
"কে এই মেয়েটা? বয়স অনুযায়ী একটু বেশী পাকা পাকা কথা বলে ঠিকই, কিন্তু প্রতিটা কথায়, প্রতিটা মত যেনো খুব নিজের, খুব খাঁটি | সত্যি এক অদভূত চূম্বকীয় আকর্ষণ শক্তি আছে মেয়েটার মধ্যে | নাহ: , নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে এর থেকে, নাহলেই বিপদ |"
কলিং বেল বাজাতেই আকাশের মা এসে দরজা খুলে ওদের ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো | আকাশের মাও বিথীকে বেশ ছোটোবেলাতেই দেখেছিলো | তাই এতদিন পর দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল
"কিরে মা, কত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই | চেনাই যাচ্ছে না তো তোকে | যাই হোক, আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো রে? "
বিথী নিজের স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসিমুখ নিয়ে জবাব দিলো
"না না, কোনো অসুবিধা হয়নি | আকাশদা খুব ভালোভাবে যত্ন নিয়ে আমায় নিয়ে এসেছে"
এই বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করলো |
আকাশও ছোট্টো হাসির মধ্যে দিয়ে তার উত্তর দিলো |
এবার ড্রয়িং রুম দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দিদার সাথে দেখা | সোফায় বসে অপেক্ষা করছিল দিদা | ওকে দেখতে পেয়েই একগাল হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো |
বিথী এসেই প্রথমে দিদার পায়ে প্রণাম করতে গেলে দিদা কাঁধটা ধরে বুকে টেনে নিলো |
"থাক থাক মা, খুব ভালো থাকো আর অনেক বড় হও, তুমি ঠিক আছো তো মামনি? কোনো অসুবিধা হয়নি তো আসতে? "
আকাশ এতক্ষনে বুঝে গিয়েছে এখানে থাকা মানেই এখন এসবই চলবে | তাই ও সঙ্গে সঙ্গে মাকে বলল
"বলছি ওর ব্যাগ গুলো কোন ঘরে রাখবো? "
মা, ডানদিকের দ্বিতীয় ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বললো
"ওটায় রেখে দে | বিথীর জন্য ওই ঘরটা ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি |"
আকাশ সোজা ওখান থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ালো | ঘরে ঢুকে একটু অবাকই হল আকাশ |বেশ পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে ঘরটা | একটু ঈর্ষান্নিত মন নিয়েই বিড় বিড় করে উঠলো
"বাবা, আমার ঘরটা তো মা কোনোদিন এত ভালো করে গুছিয়ে দেয় নি, উল্টে পান থেকে চুন খসলে খালি বকবক করে"
সাথে সাথে এটাও বুঝে গেলো এই অতিথি আর পাঁচটা সাধারন অতিথি না | অনেক কাঠখর অপেক্ষা করছে ওর কপালেও এই সদ্দ্য আগত অতিথিকে কেন্দ্র করে | ব্যাগ দুটো ওপরের সেল্ফে রেখে নিজের মনেই বলল, যতসব আদিখ্যেতা |
আকাশ বেরোতে বেরোতেই আকাশের মা বিথীকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো আর আকাশ সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো কারণ না হলে একের পর এক আদেশ আসতেই থাকবে |
বিথী যে নিজের থাকার ঘরটি দেখে খুব খুশি হয়েছে তা তার মিষ্টি হাসির মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পাচ্ছিলো | আকাশের মা সেটা যথাযথ অনুমান করেই বলল
"কিরে মামনি, পছন্দ হয়েছে তো? "
বিথী মিষ্টি হাসিমুখটি নাড়িয়ে হ্যা, খুব পছন্দ হয়েছে সেটা বুঝিয়ে দিলো |
তাও আকাশের মা বলে দিলো যদি কোনোরকম অসুবিধা হয় বা কিছু লাগে তাহলে যেনো লুকিয়ে না রাখে
"মামনি, কিছু অসুবিধা হলে আমাদের নির্দিধায় বলবি | আর তোর ওপাশের সামনের ঘরটাই আকাশদার | ওকেও বলতে পারিস যদি কিছু দরকার হয় |"
বিথী মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলো
"আচ্ছা"
আকাশ আর বিথী দুজনেই স্নান সেরে বেরোতে বেরোতেই দুপুরের খাওয়ার ডাক পড়লো |
বিথী একটা ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে এলো | সবে স্নান করেছে বলে ভেজা চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে | ড্রয়িং রুমে আসার পথে আকাশের ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলো খুব মন দিয়ে চুল আঁচরাচ্ছে | নিজের মনেই একটু হেঁসে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো |
টেবিলে দিদা বসেই ছিলো আর আকাশের মা সব খাবার দাবারের বাটি প্লেট সব ঠিকঠাক করছিলো | বিথী হাসিমুখে বলল
"কাকিমা আমিও তোমার হাতে হাতে করে দি, দাও"
"এ মা না না মামনি, তুমি এতটা জার্নি করে এসেছো | তুমি বসে পড়ো আমার হয়ে গিয়েছে গোছানো"
তারপরেও বিথীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দিদা বলল
"কিরে মা, খেতে বোস | দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? "
বিথী আসতে করে উত্তর দিলো
"আকাশদা আসুক | তারপর না হয় একসাথে বসবো|"
এই শুনে আকাশের মা মুচকি হেসে জোরে ডাক দিলো আবার
"এই যে লাটসাহেব আপনার কি হয়েছে? আমরা সবাই অপেক্ষা করছি আপনার জন্য"
আকাশ ততক্ষনে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা মার দিকে তাকিয়ে একটু রাগ নিয়ে উত্তর দিলো
"শোনো মা, ঘরের মধ্যে সবসময় এরকম চিল্লামিল্লি করবে না তো, বিরক্তি লাগে"
কথাটা শেষ করেই বাঁদিকে দাঁড়ানো বিথীর দিকে চোখ পড়লো |
সদ্যস্নাত ভেজা খোলা চুলে বেশ লাগছিলো বিথীকে | আগের থেকে অনেকটা অন্যরকম | হয়ত ক্লান্তিটা অনেকটা কেটে গিয়েছে বলেই | ঘিয়ে রঙের সালোয়ারে বেশ মানিয়েছে বিথীকে | ওর পাশে দাঁড়িয়ে এক মূহুর্ত পর্যবেক্ষন করে নিলো বিথীকে | খোলা চুল কোমর ছাড়িয়ে নেমে গিয়েছে আরও খানিকটা নিচে |
"তুই না এলে বিথীও বসছিলো না | তাই ডাকতে বাধ্য হলাম | না হলে তো আপনার ঠিক থাকে না কতক্ষন লাগাবেন |"
এই শুনে একটু ইতস্তত হয়ে বিথীর দিকে তাকালো
"একি,তুমি বসোনি কেনো? আমি তো আসছিলামই | আচ্ছা বসো বসো |"
সবাই মিলে টেবিলে খেতে বসেই আকাশের চক্ষু চড়কগাছ | মাংশের সাথে দুরকমের চুনোমাছ | আকাশ মাছ মোটেই পছন্দ করে না কখনোই, আর চুনোমাছ তো একদমই না | আকাশের মা সবাইকে ভাত দিতে দিতে বিথীকে বললো
"মামনি, তুই ছোটো মাছ খুব ভালোবাসিস তো খেতে | তাই আর কি রান্না করবো ভেবে না পেয়ে দুরকমের মাছ করেছি | তোর অসুবিধা হবে না তো খেতে? "
"না না কাকিমনি, ছোটো মাছ আমার খুব প্রিয় | আমি খুব ভালো খাই এগুলো"
বিথীর মুখে কথাগুলো শোনার পর আকাশের মনে হলো কে যেনো ফিসফিস করে ওর আর এক কানে বলছে
"বাছাধন,হয়ে গেলো তোমার ছুটির দিনগুলোর দফারফা"
মা আকাশের পাতে খাবে না জেনেও একটু মাছ দিতে গেলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো আকাশ |
"আরে কি করছো কি? তুমি জানো না আমি এসব চুনোমাছ খাইনা | আমায় দিচ্ছো কেনো? আমায় খালি মাংশ দাও"
এই শুনে বিথী আকাশের দিকে তাকিয়ে অকপটে বললো
"আকাশদা তুমি চুনোমাছ খাও না? চুনোমাছ কিন্তু শরীরের জন্য খুব ভালো | বিশেষ করে চোখের জন্য | তোমার খাওয়া উচিত কিন্তু"
আকাশ এই অকপট বিজ্ঞপ্তি শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হলেও মুখে কিছু না বুঝিয়ে চুপচাপ মাংশ দিয়ে খেতে শুরু করে দিলো | আড় চোখে মাঝে মাঝে বিথীর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো ও ম্যান ইউ এর সাপোর্টার হয়ে যেনো ম্যান সিটির কোন হার্ডকোর ফ্যান এর সাথে খেতে বসেছে | মনে মনে ভাবতে লাগলো বাচ্চা মেয়ে, অল্প বয়সে বেশি বুঝে ফেলেছে সবকিছু | দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে এই মেয়ের থেকে, নাহলে আবার কখন কি বলে বসে তার ভরসা নেই | কোনোমতে খাওয়া শেষ করে "আমি উঠলাম" বলে হাত মুখ ধুয়েই হাঁটা দিলো নিজের ঘরের দিকে |
দুপুরে মা আর দিদা একটু ভাত ঘুম দেয় | তাই ওরা নিজেদের রুমে শুতে চলে গিয়েছে | এদিকে বিথী বেশ ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও ওর দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলো না | আসলে অন্য বিছানায় প্রথম প্রথম এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক | তাই এদিক ওদিক করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না | কিছুক্ষন পর ওদিকের ঘর থেকে অরিজিত সিং এর বেশ কিছু মিষ্টি হিন্দি গান ভেসে আসতে লাগলো | বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আকাশ গান চালিয়েছে | অরিজিত সিং বিথীর খুব পছন্দের | তাই নিজের মনেই গানের সাথে গুনগুন করতে করতে কখন যে দুই চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছে নিজেই বুঝতে পারে নি |
শাঁখের আওয়াজে ঘুম ভেঙে বুঝতে পারলো সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে | তরিঘরি উঠে হাত মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো | সোফায় দিদা বসে টিভি দেখছিলো আর আকাশের মা সব ঠাকুরদের ধূপ দেখাচ্ছিলো | বিথীকে দেখে দিদা হেঁসে ওকে সোফায় বসতে বললো |
"ঘুম হয়ে মা? "
"হ্যাঁ দিদান, খুব ভালো ঘুম হয়েছে"
আকাশের মার ততক্ষনে সন্ধ্যে দেওয়া হয়ে গিয়েছে | ওদের কাছে এসে বললো
"মামনি, তুই দিদার সাথে একটু গল্প কর, আমি চা বসাচ্ছি"
বিথী কয়েকবার নিজে চা করার কথা বললে আকাশের মা ভালোবাসার ধমক দিয়ে ওকে বসিয়ে দিলো
"বাচ্চা মেয়ে, চুপ করে বসো এখানে | আমি চা করে নিয়ে আসছি"
তারপর বিথীর মাথায় হাত বুলিয়ে হেঁসে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো |
চা আসতে আসতে দিদা ওর থেকে বাড়ির সবার আর গ্রামের বাকি পরিচিতদের কিছু কিছু খবরাখবর নিয়ে নিলো |
একটা চা এর কাপ টেবিলে রেখে ওদের দুজনকে দুটো কাপ আর সাথে এক ট্রে বিস্কুট রেখে আকাশের মা রাখা কাপ টা তুলে নিলো |
বিথী ওইদিকে তাকিয়ে বললো
"তুমি চা খাবে না কাকিমনি? "
"হ্যাঁ খাবো, কিন্তু তার আগে লাটসাহেবকে চা টা দিয়ে আসি"
বিথী সাথে সাথে চা এর কাপটা নিজের হাতে নিয়ে কাকিমনিকে জোর করে বসিয়ে দিলো
"না না, তুমি চা খাও | আমি আকাশদাকে চা দিয়ে আসছি"
চা এর কাপ নিয়ে আকাশের ঘরের দিকে যেতেই দিদা আসতে আসতে মাকে বললো
"দেখেছিস রমা, মেয়েটা কি লক্ষ্মী | একদিনেই কেমন সবাইকে নিজের করে নিয়েছে"
"হ্যাঁ মা, একদম ঠিক বলেছো"
আকাশের রুমের দরজা খোলাই ছিলো তাও বিথী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার ডাক দিলো
"ভেতরে আসতে পারি? চা নিয়ে এসেছি"
সাথে সাথে ভেতর থেকে আওয়াজ এলো
"আরে এসো এসো"
ভেতরে ঢুকতেই দেখলো আকাশ একটা গেঞ্জি আর একটা ফর্মাল পাজামা পরে রেডি হচ্ছে বেরোনোর জন্য | ঘরের চারদিকটা একটু চোখ বুলিয়ে যা বুঝলো তাতে মনে হলো ছেলেটা যথেষ্ট আগোছালো |
"তুমি কি কোথাও বেরোচ্ছো? "
"হ্যাঁ, ওই বন্ধুদের সাথে পাড়ার মোরের চা এর দোকানে একটু আড্ডা দিতে যাবো"
"ও আচ্ছা, তোমার চা টা কোথায় রাখবো? "
"এই তো আমায় দাও"
চা এর কাপটা আকাশের হাতে দিয়ে বেরিয়ে এসে সোফায় বসলো | কাকিমনি জিজ্ঞাসা করলো
"ও কি উঠেছে? "
"হ্যাঁ, রেডি হয়ে কোথায় যেনো বেরোচ্ছে"
আকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে টেবিলে ফাঁকা কাপটা রেখে বেরোতে যাবে এমন সময় যথারীতি দিদা বাঁধ সাধলো |
"বাবু তুই কি এখানেই যাবি না অন্য কোথাও? "
"না দিদা, এই মোড়ে"
"তাহলে এক কাজ কর না, বিথীকে একটু নিয়ে যা না সাথে করে | বেচারী বাচ্চা মেয়ে, আমাদের সাথে বসে একা একা কি করবে"
আকাশের ওইসময় মনে হচ্ছিলো ওর যদি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকতো তাহলে হয়ত ওর থেকে খুশি আর কেউ হতো না |
"আমি তো মোড়ের মাথায় আড্ডা দিতে যাচ্ছি, ও ওখানে গিয়ে কি করবে"
"আরে ওখানে কেনো নিয়ে যাবি, আমি বললাম ওকে নিয়ে একটু হাতিবাগান মার্কেটটা ঘুরিয়ে নিয়ে আয় | ওর যদি টুকটাক কিছু কেনার থাকে তাহলে কিনেও নিতে পারবে"
আকাশ বুঝে গেলো যে ওর সন্ধ্যের আড্ডাটাও আজ মাটি হতে চলেছে | তাই একটু বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে বিথীর দিকে তাকালো | বেচারি এতক্ষন বেশ উৎসাহের সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো কিন্তু ওর ওইরকম চাহনি দেখে কেমন যেনো ইতস্তত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলো | তাই মনে ইচ্ছা থাকলেও বেরোনোটা কাটানোর চেষ্টা করলো |
"না না দিদা, আমার এখন কিছু কেনার নেই | যখন দরকার হবে আমি নিজে থেকেই বলবো |আকাশদা তুমি বরং যেখানে যাচ্ছিলে যাও"
কিন্তু আকাশ ভালো করেই জানে দিদার মাথায় একবার যখন ঢুকেছে সেটা ওকে দিয়ে করিয়েই ছাড়বে | আর তা যদি না হয় তাহলে রাতে আবার অন্তত: একশোখানা ইমোশানাল অত্যাচারের সম্মূখীন হতে হবে ওকে | তাই সাথে সাথে মুখের ভাব ভঙ্গীমা বদলে দিয়ে বিথীকে বললো
"না না কোনো ব্যাপার না | আমার তেমন জরুরী কাজ নেই | চলো তোমায় মার্কেট থেকে ঘুরিয়ে আনি"
বিথী কয়েকবার না না করলেও দিদা একপ্রকার জোর করেই ওকে রেডি হতে পাঠিয়ে দিলো
"যা না মা, একটু ঘুরে আয় | খুব বড় মার্কেট এখানে | ভালো লাগবে তোর, যা ওর সাথে ঘুরে আয়"
অগত্যা বিথীও রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো আকাশের সাথে |
ময়ূরপঙ্খী রঙের সালোয়ার পরে আকাশের পাশে হাঁটছিলো বিথী | আকাশের কেমন যেনো নিজেকেই একটু বেমানান লাগছিলো ওর পাশে আর তার সাথেই দিদার ওপর আরও রাগ হচ্ছিলো | দিদা আগে কিছুই বলতে পারে না, তাহলে আর একটু ভালো কিছু পরে আসতাম, ধুর|
মোড়ে যেতেই দুই বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায় ওদের | দুজনেই জিজ্ঞাসু তার সাথে সাথে বেশ ভালোলাগার রেশ নিয়ে তাকিয়ে আছে বিথীর দিকে | আকাশ ভালো করেই চেনে ওর বন্ধুদের | কাল থেকেই বন্ধুমহলে এটা আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে | তাও নিরুপায় হয়ে সৌজন্যতাবোধ দেখিয়ে ওদের একে অপরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো |
"বিথী ওরা হলো আমার ছোটবেলার বন্ধু | ও দীপ আর ও সমর | আর ও হলো আমার কাকুর মেয়ে, বিথী"
দীপ সবে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করতে যাচ্ছিলো কিন্তু বিথী হাত জোর করে নমস্কার করায় একটু বেয়াকুব হয়ে ওরাও তাই করলো |
পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আকাশ সঙ্গে সঙ্গে বিথীকে নিয়ে ওখান থেকে এগিয়ে গেলো
"আচ্ছা, তোরা গল্প কর | আমি আজ ওকে নিয়ে মার্কেটটা একটু ঘুরে আসি"
হাতিবাগানের রাস্তায় ভর সন্ধ্যেবেলা যথারীতি ভীড় উপচে পড়ছে | দুজনে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে কোনোমতে মার্কেটের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে | ধাক্কাধাক্কি আর গরমের মধ্যে বিথীর এইভাবে হাঁটতে একদম ভালো লাগছিলো না
"আমার এরকম ভীড় ভাট্টার মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করতে একদম ভালো লাগে না"
"আমারও"
"এখানে কোনো বসার যায়গা নেই? "
"গঙ্গার ঘাট আছে, কিন্তু এই রাতে ওখানে না যাওয়াটাই ভালো"
"ওহ"
একটু মনমরা হয়ে চুপচাপ আকাশের পাশে পাশে হাঁটতে থাকে | দুজনেরই এই ভীড়ে হাঁটাটা বিরক্ত লাগছে বুঝতে পেরে আকাশ বিথীকে হাতিবাগান মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিলো |
"বিথী, এটা স্টার থিয়েটার | নিচে সিনেমা হল দেখতেই পাচ্ছো, কিন্তু ওপরে একটা সুন্দর বসার যায়গা আছে | যাবে? "
স্টার থিয়েটারের ওপরে সত্যি খুব সুন্দর একটা রুফ টপ আছে, মানে খোলা আকাশের নিচে টেবিল চেয়ার পাতা | চা, কফি, স্ন্যাক্স খেতে খেতে সুন্দর গল্প করা যায় | তার সাথে সাথে মাঝে মাঝে ভালো গান বাজনার প্রোগ্রামও হয় |
এতক্ষনে বিথীর ধরে যেনো প্রাণ ফিরে এলো | তাই এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করেই মত দিয়ে দিলো
"হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো | চলো ওখানেই যাই"
দুজনে সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেকটা ওঠার পর আকাশ বিথীকে একটু দাঁড়াতে বলে রুফ টপের দুটো এন্ট্রির কুপন কেটে নিলো | তারপর সোজা ওপরে উঠে গেলো বিথীকে সাথে নিয়ে | আকাশ ছোটো থেকেই এখানে এসেছে, তাই সবকিছুই জানা, কিন্তু বিথী প্রথমবার আসায় ওর খুব ভালো লাগলো খোলা আকাশের নিচে এই বসার আর গল্প করার যায়গাটা |
অনেক অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে দলে দলে বসে জমিয়ে আড্ডা আর তার সাথে খাওয়া-দাওয়া করছে | বিথী চারদিকের সেইসব মন দিয়ে দেখছিলো তখনই আকাশের ডাকে ওর দিকে তাকালো | আকাশ পাশেই একটা ফাঁকা টেবিল দেখে ওকে ওখানে বসতে ইশারা করলো | দুজনে বসে যায়গাটা নিয়ে টুকটাক কথা বলার পর আকাশ জিজ্ঞাসা করলো
"কি খাবে বলো? "
"না না, আমি কিছু খাবো না"
"সেকি তাই হয় নাকি, অন্তত: চা বা কফি খাও"
অনেক বলা কওয়ার পর ঠিক হলো দুজনে দুটো চা আর সাথে আকাশ জোর করেই দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলো |
বিথী সমানে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজের মনেই বলে উঠলো
"ইশশশ!! কি সব ড্রেস পরেছে"
আকাশ কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে তাকালো
"আমায় কি কিছু বললে? "
"না না, তোমায় না"
"তাহলে? "
"না কিছু না"
"আরে বলো, কোনো ব্যাপার না, কি হয়েছে? "
বিথী ডানদিকের একটা টেবিলে বসা কিছু মেয়েদের দিকে ইশারা করে বললো
"ওই যে ওরা, ওগুলো কোনো ড্রেস হলো? "
আকাশ ওর আঙুল বরাবর দেখে বুঝতে পারলো ও কি বলতে চাইছে, তাই ওকে বুঝিয়ে বললো
"আসলে, কলকাতায় এগুলোই নর্মাল বিথী | এগুলোই এখনকার ফ্যাশন, এতে খারাপের কিছু নেই"
বিথী একটু রাগের সাথে তাকালো আকাশের দিকে
"শোনো আকাশদা, আমিও খারাপ বা ভালো সেইসব বিচার করছি না | কিন্তু শালীনতা বলে একটা ব্যাপার আছে মেয়েদের | ফ্যাশন আমিও বুঝি | একটা মানুষের কাছে তার ফ্যাশন সেটাই যেটায় সে নিজে সাবলীল এবং তার সাথে সাথে নিজের কাছে সুন্দর | ওরা ওরকম ড্রেস পরেছে সেটা খারাপ না কিন্তু ওটাকে ওইভাবে মানিয়ে নিয়ে চলাটা হলো আসল |
আর একটা কথা বলি তোমায়, মেয়েদের আসল অলঙ্কার তার আভরণে, তার শৃঙ্গারে, তার লজ্জায় | একটা বইকে তুমি যতই যত্নে রাখো না কেনো, তাকে যদি তুমি সুন্দর করে মলাট দিয়ে সাজিয়ে রাখো, আগে সেটাই তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে"
বিথীর কথা শেষ হতে হতেই ওদের অর্ডার চলে আসে | কিন্তু বিথীর কথা গুলো কোথায় যেনো আকাশের মনের আকাশের মেঘটাকে আবার জমাট বাঁধিয়ে দেয়, হয়ত আরো একটু গভীর ভাবে | বিথী চা এর কাপটা হাতে নিয়ে নির্লিপ্তভাবে মাথা নিচু করে ফুঁ দিতে থাকে আর ওদিকে চা এর কাপ হাতে নিয়ে ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আকাশ
"কে এই মেয়েটা? বয়স অনুযায়ী একটু বেশী পাকা পাকা কথা বলে ঠিকই, কিন্তু প্রতিটা কথায়, প্রতিটা মত যেনো খুব নিজের, খুব খাঁটি | সত্যি এক অদভূত চূম্বকীয় আকর্ষণ শক্তি আছে মেয়েটার মধ্যে | নাহ: , নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে এর থেকে, নাহলেই বিপদ |"