29-03-2020, 11:32 AM
(Update No. 238)
সীমন্তিনী তার কথা শুনে বলল, “ও আচ্ছা। তবে মেসো, এখন আমি রাখছি। তোমরা আর কোনও খবরাখবর জানতে পারলে আমাকে জানিও। তবে আমার কথাটা মাথায় রেখো কিন্তু। কাল আলিপুরদুয়ার গিয়ে ও বাড়িতে পরি আর অর্চুর বিয়ে নিয়ে একটা কথাও কিন্তু তোমরা বোল না। আবার একেবারে হতাশ হয়েও পোরো না। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। হাওয়া কোন দিকে বয় সেটা আগে দেখে নেওয়া দরকার। তারপর সিদ্ধান্ত নেব আমরা। ঠিক আছে”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা ঠিক আছে, তাই হবে। আমি খোকাকে আর ওর মাকেও সেটা বুঝিয়ে দেব”।
সীমন্তিনী তারপর কথা শেষ করে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে লাগল।
****************
এর পরের সাত আট দিনের মধ্যে অনেক কিছু হল। পরিতোষ সেদিন রাতে সীমন্তিনীকে ফোন করে পিসির সাথে দেখা হবার সব ঘটণা সীমন্তিনীকে জানিয়েছিল। আর হৈমবতীদেবীও সেদিন রাতে রচনার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। তাদের গোটা আলোচনাটাই সেদিন সীমন্তিনী আর নবনীতাকে ঘিরে ছিল। নবনীতা আর পরিতোষের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলেও, সীমন্তিনী কেন পরিতোষের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল সেটা হৈমবতীদেবী জানতে পারলেন না।
কলকাতায় মহিমার প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মহিমা প্রায় রোজই সীমন্তিনীর সাথে রাতে ফোন করে কাজের অগ্রগতীর খবর জানায়।
পরিতোষকে আরও তিনদিন আলিপুরদুয়ারে পিসির বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। পরিতোষের সাথে তার পিসির যেদিন দেখা হল তার পরের দিনই হৈমবতীদেবীর অনুরোধে কালচিনি থেকে বিধুবাবুরা সকলেই আলিপুরদুয়ারে তাদের বাড়ি এসেছিলেন। নিজের ভাইপোকে ফিরে পাবার জন্য বিধুবাবুকে হৈমবতীদেবী প্রাণভরা আশীর্বাদ আর ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পরিতোষের মাধ্যমে বাবার আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর সেদিন রাত থেকেই হৈমবতীদেবী অশৌচ পালন করতে শুরু করেছিলেন। বিধুবাবুর সাথে শলা পরামর্শ করে তিনদিন পর তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাবার শ্রাদ্ধকৃত্য সম্পন্ন করেছিলেন। তাই শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত পিসির অনুরোধে পরিতোষকে বাধ্য হয়েই আলিপুরদুয়ারে থাকতে হয়েছিল।
চতুর্থ দিন সকালে সে পিসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কালচিনিতে একবেলা কাটিয়ে বিকেলের ট্রেনে মালবাজার চলে গিয়েছিল। সেখানে এক রাত তার পূর্ব পরিচিত দেবাশীষ বক্সীর সাথে কাটিয়ে পরদিনই সে কলকাতা ফিরে এসেছিল। আর কলকাতায় ফিরে এসেই সেদিন রাতেই পরিতোষ ডক্টর বড়ুয়ার বাড়ি গিয়ে নাগরাকাটা থেকে কিনে আনা উপহার সামগ্রী গুলো তাদের সবাইকে দিয়েছিল। উপহার পেয়ে সবাই খুশী তো হয়েই ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশী খুশী হয়েছিল দীপা বড়ুয়া, যখন শুনলেন যে পরিতোষ কালচিনি গিয়ে তার বড়দার সাথে দেখা করে এসেছে আর পরিতোষ এতদিনে নিজের রক্তের সম্পর্কের পিসি আর তার বিশাল পরিবারকে খুঁজে পেয়েছে।
বিমল আগরওয়ালার অপারেশনে আর রতীশ ও রচনার ওপর নজর রাখবার জন্যে যতজনকে কাজে লাগানো হয়েছিল। তাদের সমস্ত পাওনাগন্ডা চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর রতীশ ও রচনার ওপর কেউ নজর রাখছে না। তবে পরিতোষ স্বয়ং রোজ সকালে রচনাকে আর বিকেলে রতীশকে ফোন করে তাদের সমস্ত সুবিধে অসুবিধের খবর নেয়। এ ছাড়াও তার টিমের প্রণবকেও বলে রেখেছে সে যেন রতীশদের ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখে। প্রণবের বাড়ি রতীশদের ফ্ল্যাট থেকে খুবই কাছে। বাড়ি থেকে যেতে আসতে তাকে রতীশদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। তাছাড়া রতীশদের ফ্ল্যাটের কাছেই যে পানের দোকানটা আছে তার মালিকের সাথেও প্রণবের খুব ঘণিষ্ঠতা আছে। প্রণব সেই দোকানীকেও রতীশদের ফ্ল্যাটের ওপর সর্বদা নজর রাখতে বলেছে। ওদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এলাকায় কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে বা সন্দেহজনক কিছু দেখলেই প্রণব সেটা জানতে পারবে।
কিন্তু পরিতোষ আর অর্চুর বিয়ে নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকা কলকাতা, নাগরাকাটা আর কালচিনির তিনটে পরিবারের লোকদের দুর্ভাবনা এখনও কাটেনি। পরিতোষের সাথে সীমন্তিনী আর নীতার প্রায় রোজই কথা হয়। পরিতোষ নানা বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলে, আগের মতই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে। তবে সীমন্তিনীর সাথে কথা বলবার সময় সে প্রায় রোজই সীমন্তিনীকে সব সময় সতর্ক আর সাবধান থাকতে বলে। রোজ পরিতোষ তাকে এমনভাবে সতর্ক করছে কেন তা জিজ্ঞেস করেও কোনও সদুত্তর পায়নি সীমন্তিনী। কিন্তু পরিতোষ তাকে বিশেষভাবে বারবার করে ফোনে তাকে বলেছে যে, ব্যক্তিগত কাজেই হোক বা অফিসের কাজেই হোক, সীমন্তিনী নাগরাকাটা থেকে বাইরে কোথাও গেলে যেন পরিতোষকে অবশ্যই সে’কথা জানিয়ে দেয় আগে থেকেই। আর রাতের বেলায় ডিউটি ছাড়া অন্য কোন কাজেই যেন সে কোয়ার্টার ছেড়ে না বেরোয়। আর রাতের বেলা কোথাও ডিউটিতে গেলেও যেন অতিরিক্ত সিকিউরিটি নিয়ে যায়। তবে পরিতোষ সীমন্তিনীর প্রশ্নের পরিস্কার জবাব না দিলেও সীমন্তিনীর ধারণা পরিতোষ হয়ত কোনভাবে জানতে পেরেছে যে সীমন্তিনীর ওপর কোনও আচমকা হামলা হতে পারে। এ ব্যাপারে অবশ্য সীমন্তিনী নিজেও অবহিত আছে মোটামুটি। কয়েকটা উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্যরা যে তার ওপর ক্ষেপে আছে তা সীমন্তিনী নিজেও জানে। জুলাই মাসে দার্জিলিং বর্ডারে অনুসন্ধানের সময়েই সে নিজেও সেটা বুঝতে পেরেছিল। দার্জিলিং বর্ডারে অনুসন্ধানে যাবার পর থেকেই সে উগ্রপন্থীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। আর পরিতোষের বন্ধু দেবাশীস বক্সীও তখনই সীমন্তিনীকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সীমন্তিনী নিজেও সেটা উপলব্ধি করেছে। আর নিজেও সর্বদা চোখ কান খোলা রেখে চলে। তাই সে ভেবেছে যে পরিতোষ যখন মালবাজার গিয়েছিল তখন নিশ্চয়ই দেবাশীস বক্সী পরিতোষকে সে’সব কথা বলেছেন। আর তার পর থেকেই পরিতোষও তাকে রোজ সতর্ক করে যাচ্ছে। আর এই কারনেই অনেক ইচ্ছে থাকা সত্বেও, কোনও অফিসিয়াল কাজ না পরার দরুন সীমন্তিনীর আর আলিপুরদুয়ারে যাওয়া হয়নি। ব্যক্তিগত কাজের অজুহাতে গেলে তার সঙ্গে সিকিউরিটি থাকবে না। তাই সে মনে মনে ভেবে রেখেছিল যে আবার আলিপুরদুয়ারে কোন একটা অফিসিয়াল মিটিং বা অন্য কোনও ধরণের অফিসিয়াল ডিউটি পড়লে সে পরিতোষের পিসি আর পিসেমশাইয়ের সাথে দেখা করবে। অবশ্য প্রথম দেখাতেই সে পরিতোষের বিয়ের প্রসঙ্গটা ওঠাতে পারবে না। তবে আন্তরিক ভাবে পরিচিত হতে পারলে, তাদের মন জয় করতে পারলে, নিশ্চয়ই তাদের ফোন নাম্বার চেয়ে আনা যাবে। আর পরে ফোনেও আসল কথাটা নিয়ে সময় বুঝে আলোচনা করা যাবে।
ওদিকে পরিতোষের জীবনটা কালচিনি আর আলিপুরদুয়ার যাবার পর থেকেই অনেকটাই পালটে গেছে। পিসির বাড়িতে তাকে চারটে দিন থাকতে হয়েছিল। সেখানে পিসি, পিসেমশাই, তিন দাদা, তিন বৌদি, আর পাঁচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝির সাথে কাটানো দিনগুলো যেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। সেখানে তিন দিনের দিন হৈমবতীদেবী আর নিরঞ্জনবাবুর আদেশে তাদের দুই মেয়েও তাদের স্বামী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলিপুরদুয়ারে এসেছিল। পিসি-পিসোর বড়মেয়ে নিহারিকা আর ছোটমেয়ে সুতনুকা। তারা দু’জনেই বয়সে পরির চেয়ে ন’ এবং সাত বছরের বড়। নিহারিকার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলেটির বয়স চৌদ্দ আর মেয়েটির সাত। সুতনুকারও একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। তার ছেলের বয়স বারো আর মেয়ের নয়। এতসব আত্মীয় স্বজনকে কাছে পেয়ে পরিতোষ সত্যিই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। তার পিসির সংসারে সেই কটা দিনের স্মৃতি যেন পরিতোষের মনের ভেতরের সমস্ত দুঃখ সমস্ত গ্লানি দুর করে দিয়েছে। এখনকার পরিতোষ আর সাতদিনের আগের পরিতোষ যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুটো লোক। কালচিনি আর আলিপুরদুয়ারে গিয়ে তার যেন এক নবজন্ম লাভ হয়েছে। কলকাতা ফিরে আসবার পর তার পিসতুতো তিন দাদা আর দু’ দিদি প্রায় রোজই ফোন করে তাকে। তার পিসি রোজ রাত ন’টার দিকে ফোন করেন। পরিতোষের জীবনের সব কথা শুনতে শুনতে তিনি যেন পরিতোষের বন্ধু হয়ে উঠেছেন। আর তার তিন বৌদি। তারাও রোজ পরিতোষকে ফোন করেন। ইয়ার্কি ফাজলামো করেন। তবে বড়বৌদি সুলোচনার আন্তরিকতা বা স্নেহে একফোঁটা খামতি না থাকলেও, তিনি নিজে পরিতোষের সাথে অতটা খোলামেলা কথা বলেন না। পরিতোষের আর তার সম্পর্কটা যেন সত্যিকার দিদি আর ভাইয়ের সম্পর্ক। পরিতোষের স্নান খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা। তার শরীর আর মন ভাল আছে কি না, কাজের ব্যস্ততা কেমন, মূলতঃ এ’সব বিষয়েই তিনি পরিতোষের সাথে কথা বলেন। কিন্তু মেজবৌদি রুমা আর ছোটবৌদি দেবিকার মুখের আগল যেন দিনে দিনে আলগা হচ্ছে। তাদের ভাইদার সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের মত আচরণ করতে শুরু করেছেন তারা। পরিতোষের অবশ্য এটাও মন্দ লাগে না। দিনের শেষে, অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ওই দু’জনের সাথে ঠাট্টা ইয়ার্কি আর খুনুসুটি করতে করতে সে যেন তার শরীরের ভেতরের জীবনীশক্তি ফিরে পায় আবার। নতুন করে তার মনে প্রাণে যেন উদ্যমের জোয়ার ফিরে আসে। আর ওই দু’জনের সাথে যত প্রসঙ্গেই কথা হোক না কেন, ঘুরে ফিরে বারবার পরিতোষের বিয়ের প্রসঙ্গই আসে। এই দুই বৌদি, আর পিসির সাথে বন্ধুত্বসুলভ কথাবার্তায় পরিতোষ তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার কথাও খুলে বলতে বাধ্য হয়েছে এই ক’দিনেই। হৈমবতীদেবী, রুমা আর দেবিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সীমন্তিনী আর নবনীতার সাথে পরিতোষের সম্পর্কের প্রায় সমস্ত খুঁটিনাটিই এ’ ক’দিনে জেনে ফেলেছেন। জীবনে প্রথমবার এতজন আত্মীয় পরিজনের সাথে কথা বলতে বলতে পরিতোষ নিজেও যেন বদলে গেছে। নিজের জীবনের সমস্ত ব্যক্তিগত কথাও সে অনায়াসে প্রকাশ করে ফেলেছে তাদের সাথে। তবে সীমন্তিনীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সে ভুলে যায়নি। তাই কবে কোনদিন সে নবনীতা আর সীমন্তিনীকে কিভাবে ভালবেসে ছিল, আর তার ওই ভালবাসার পরিণতি কিভাবে হয়েছিল, এ’সব কথা জানতে পারলেও তার পিসি এবং বৌদিরা সীমন্তিনীর ভালবাসার পাত্রটি আসলে কে, এ প্রশ্নের জবাব হাজার চেষ্টা করেও পরিতোষের কাছ থেকে জানতে পারেন নি।
সীমন্তিনী, নবনীতা, রচনা মাঝে মাঝে পরিতোষকে ফোন করে তার ফোন ব্যস্ত দেখে। পরে অবশ্য পরিতোষই নিজেই তাদের ফোন করে জানায় যে সে আলিপুরদুয়ারের কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল। পরিতোষ যে তার নিজের আত্মীয় পরিজনদের কাছে পেয়ে আগের চেয়ে অনেক ভাল আছে, আনন্দে আছে, এ’কথা বুঝতে পেরে তারা সবাই খুশী হলেও অর্চুর সাথে পরিতোষের বিয়েটা আদৌ আর সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে তাদের তিনজনেরই দুশ্চিন্তা বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে পরিতোষকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করতে পারছিল না। তিন জনের মনের মধ্যেই কেমন একটা দ্বিধাবোধ যেন জেগে উঠেছিল। কিন্তু তারা সকলেই সীমন্তিনীর নির্দেশ মেনে পরিস্থিতির গড়ান বোঝবার চেষ্টা করছে।
আর অর্চনা তো পরিতোষের আলিপুরদুয়ার যাবার পরের দিন থেকেই নিজে সীমন্তিনী, রচনা বা নবনীতার কাছে পরিতোষের সম্পর্কে কোন কথাই বলে না। তার দিদিভাইয়ের কথাকেই বেদবাক্য ধরে নিয়ে সে মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে যাচ্ছে। তবু যেন পুরোপুরি সফল হতে পারছে না সে। যখন সে বাড়িতে একা থাকে তখন বারবারই ঘুরে ফিরে পরিতোষের মুখটা তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। তার মনটা তখন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। পরক্ষণেই সীমন্তিনীর বলা কথাগুলো সে মনে করবার চেষ্টা করে। তখন বেশীরভাগ সময়েই সে রচনাকে ফোন করে নানা কথায় নিজের মন থেকে পরিতোষের ছবিটাকে সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা করে। তাতে সাময়িক ভাবে কিছুটা সফল হলেও, পরিতোষের ছবিটাকে নিজের মন থেকে যেন সে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছে না পুরোপুরি ভাবে। তার দিদিভাই আর নীতাদি যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন তারা সব সময় তাকে তাদের কাছে কাছে রেখে নানা রকম কথাবার্তায় ভুলিয়ে রাখেন। তার দিদিভাই তাকে এমন কথাও বলেছেন যে পরিতোষ যদি তার পিসির পছন্দমতই কাউকে বিয়ে করে তাহলে অর্চুর জন্যে তিনি ভাল আরেকটা ছেলে খুঁজে বের করবেনই। অর্চুকে তিনি সব সময় স্বচ্ছন্দ আর হাসিখুশী থাকতে নির্দেশ দেন। অর্চনাও তার দিদিভাইয়ের কথা সর্বতোভাবে পালন করবার চেষ্টা করে। সে নিজেই বুঝতে পেরেছে তার দিদিভাই তাকে সঠিক উপদেশই দিয়েছেন।
ক’দিন পর দুপুরবেলায় অফিস ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ করতে করতে সীমন্তিনী প্রথমে অর্চনা আর তারপর রচনার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল। খাওয়া শেষে টিফিন ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিয়ে নিজের চেম্বারে ফিরে আসতেই তার পার্সোনাল মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। এ’সময় তার এ মোবাইলে কে ফোন করতে পারে ভাবতে ভাবতে সে ফোনটা বের করে দেখে একটা আননোন ল্যান্ডলাইন নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। নাম্বারটা কয়েকবার দেখেও তার পরিচিত বলে মনে হল না। শুধু এটুকুই বোঝা গেল যে এটা আলিপুরদুয়ারের নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করবে কি করবে না, ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল। নিজের চেয়ারে বসে ফোনটা হাতে নিয়েই সে ভাবতে লাগল, সে কি কলব্যাক করবে ওই নাম্বারটায়? আবার ভাবল, না থাক, দরকার নেই। পরিচিত কেউ নতুন কোন নাম্বার থেকে ফোন করে থাকলে পরে অবশ্যই জানা যাবে। তখন না হয় অফিসের কাজের ছুতো দেখিয়ে সরি বলে দেবে। এই ভেবে ফোনটা আবার ব্যাগে রাখতে যেতেই সেটা আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে আবার সেই একই নাম্বার থেকে ফোন। কিন্তু এবারে আর বেশী ইতঃস্তত না করে সে কলটা রিসিভ করে ফোন কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যালো। কে বলছেন”?
ও’পাশ থেকে এক বয়স্কা মহিলাকন্ঠে জবাব এল, “আমি হৈমবতী মন্ডল বলছি আলিপুরদুয়ার থেকে। তুমি না না, আপনি হয়ত আমাকে চিনবেন না। আমি ......”
কে ফোন করেছে বুঝতে পেরেই সীমন্তিনী চমকে উঠে বলল, “আপনি করে বলতে হবে না। আপনি নিশ্চয়ই পরির পিসি, তাই তো”?
ও’পাশ থেকে হৈমবতীদেবী বললেন, “হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই চিনেছ। আমি পরির পিসিই বলছি। তবে মা, আমি আগেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এমন অসময়ে তোমাকে ফোন করছি বলে। পরি আমাকে আগেই বলেছিল যে আমি দিনের বেলায় তোমার সাথে কথা বলতে চাইলে যেন ঠিক দুপুর আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে ফোন করি। তোমার নাম্বারটা একটু আগে আমি ওর কাছ থেকেই নিয়েছি। তোমাকে আড়াইটে থেকেই আমি ফোন করে যাচ্ছিলুম। কিন্তু বারবার তোমার ফোন ব্যস্ত পাচ্ছিলুম। তাই .......”
সীমন্তিনী হৈমবতীর কথার মাঝেই তাকে থামিয়ে দিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, “না না পিসি, এতে এভাবে ক্ষমা চাইবার কী আছে? আসলে আমি এই সময়ে লাঞ্চ করতে করতেই আমার কাছের মানুষগুলোর সাথে একটু কথা বলি। বাকি সময়ে অফিসের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে কারো ফোন ধরতেও পারিনা। তবে আপনি যখন ফোন করেছিলেন তখন বোধহয় আমি অর্চু কিংবা রচুর সাথে কথা বলছিলুম। আমি রোজ নিয়ম করে ওই সময় ওদের সাথে কথা বলি তো। তাই আমার ফোন ব্যস্ত পেয়েছেন আপনি। তবে আপনি ভাববেন না। আপনার কথা শোনবার পর থেকেই আমারও মনটা চাইছিল আপনার সাথে একটু দেখা করতে। কিন্তু কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত আছি যে এখান থেকে বেরোবার ফুরসতই পাচ্ছি না। আপনার ফোন পেয়ে খুব ভাল লাগল। বলুন কি বলবেন”?
এমন সময় সীমন্তিনীর অফিসিয়াল মোবাইলটা বেজে উঠল। সেটা হাতে নিয়ে দেখে পরিতোষের ফোন। কলটা সে রিজেক্ট করে দিল।
হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি যে কতটা ব্যস্ত থাকো তা আমি পরির মুখে শুনেছি গো মা। আর আমার ছেলেদের মুখেও তোমার অনেক কথা শুনেছি। সবাই বলে আমি নাকি একটু বেশী কথা বলি। তাই বেশী কথা না বলে যেজন্য তোমাকে ফোন করেছি সেটাই সরাসরি বলছি। শোনো মা, তুমি আর নবনীতাই নাকি পরির সবচেয়ে ভাল বন্ধু। আর তোমরা দু’জনই নাকি ওর সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী। সেটা জেনেই বলছি মা, তোমাদের দু’জনের সাথেই আমি দেখা করতে চাই। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় আমাদের পক্ষে ততই মঙ্গল। কিন্তু আমি জানি তুমি নাগরাকাটায় অফিসের কোয়ার্টারে থাকো। আর নবনীতা আর অর্চুও এখন তোমার সাথে তোমার কোয়ার্টারেই আছে। আমি আসলে তোমাদের তিনজনকেই দেখতে চাইছি। হয়ত তুমি ইতিমধ্যে শুনে থাকবে যে অর্চুর বাবা বিধু, আমার ভাই মানে পরির বাবার ছোটবেলার বন্ধু। আমি বিধুকে ছোটবেলা থেকেই আমার আরেকটা ভাইয়ের মতই ভালবাসতুম। তাই ওর বড়মেয়ে অর্চুকে দেখবার বাসনাও আমার মনে আছে। কিন্তু পরির মুখেই শুনলুম তুমি নাকি নিজের ইচ্ছেমত যেখানে সেখানে যে কোন সময় যেতে পারো না। তাই হয়ত, আমি চাইলেও তুমি এখানে আসতে পারবে না চট করে। সেজন্যই আমি ভাবছিলুম আমি নিজেই তোমার ওখানে যাবো। কিন্তু আমার তো বয়স হয়েছে মা। আর বাড়ি থেকে আমাকে একা কোথাও যেতেও দেবে না কেউ। আর এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে তোমার কোয়ার্টারে এখনই তোমরা তিনজন আছ। হয়ত দু’একজন কাজের লোকও আছে। এরমধ্যে আমার সাথে যদি আরও দু’একজনকে নিয়ে যেতে হয়, তবে তো তোমার কোয়ার্টারে স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা হতে পারে। তাই জিজ্ঞেস করছি মা, নাগরাকাটায় তোমার কোয়ার্টারের কাছাকাছি কোথাও কোন থাকবার হোটেল আছে কি মা”?
সীমন্তিনী হৈমবতীর কথা শুনতে শুনতে মনে মনে অনেক কিছু ভেবে যাচ্ছিল। এবার তিনি থামতেই সে বলল, “পরি আমার সবচাইতে ভাল বন্ধু। আর আপনি তার নিজের পিসি। আপনি আমাকে দেখতে এসে যদি হোটেলে রাত কাটান, তাহলে পরির কাছে আমি কি আর মুখ দেখাতে পারবো পিসি? তবু আপনার কথার জবাবে বলছি, নাগরাকাটা আপনাদের আলিপুরদুয়ারের মত বড় জায়গা নয়। প্রায় গ্রামই বলা যায়। এখানে খাবার হোটেল মোটামুটি থাকলেও থাকবার মত ভাল হোটেল আমার কোয়ার্টারের কাছাকাছি তো দুর, গোটা নাগরাকাটাতেও নেই। নামমাত্র দু’একটা হোটেল অবশ্যই আছে। তবে ও’গুলোতে আপনাদের মত ভদ্রলোকেদের পক্ষে থাকা একেবারেই সম্ভব নয়”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে হৈমবতীদেবী খানিকটা হতাশ সুরে বললেন, “ওমা, তাই নাকি? তবে তো ভারী মুস্কিল হল। তুমি তো সারাটা দিনই অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকো। দিনের বেলায় আর কতটুকুই বা সময় তুমি আমাকে দিতে পারবে! আমার যে তোমাকে অনেক কথা বলার আছে মা”।
একজন কনস্টেবল সীমন্তিনীর কেবিনে ঢুকতেই সীমন্তিনী তাকে হাতের ঈশারা করতে সে সাথে সাথে বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী ফোনে বলল, “আচ্ছা পিসি, আপনারা কবে আসতে চাইছেন? আর কতজন আসবেন? পুরুষ মানুষ ক’জন থাকবে আপনার সাথে”?
হৈমবতীদেবী জবাবে বললেন, “আমরা তিনজন যাব মা। আমরা স্বামী-স্ত্রী, আর আমাদের বড়বৌমা। আর আজই যাব ভাবছিলুম”।
সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “পিসি, আমার কোয়ার্টারে আপনাদের তিনজনের থাকবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের খুব বেশী অসুবিধে হবে না। দু’জন পুরুষ মানুষ হলে অবশ্য অসুবিধে হত। তবে আপনাদের হয়ত সামান্য কিছুটা অসুবিধে হতেই পারে। আসলে আপনার বৌমার জন্য আলাদা কোন বিছানা হয়ত হবে না। তাকে হয়ত আমাদের কারো সাথে এক বিছানায় থাকবার প্রয়োজন হতে পারে। এতে তার কোন অসুবিধে হবে না তো”?
হৈমবতীদেবী সাথে সাথে বললেন, “না না মা, আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। তাহলে আমরা আর ঘন্টাখানেক বাদেই রওনা হচ্ছি এখান থেকে”।
______________________________
সীমন্তিনী তার কথা শুনে বলল, “ও আচ্ছা। তবে মেসো, এখন আমি রাখছি। তোমরা আর কোনও খবরাখবর জানতে পারলে আমাকে জানিও। তবে আমার কথাটা মাথায় রেখো কিন্তু। কাল আলিপুরদুয়ার গিয়ে ও বাড়িতে পরি আর অর্চুর বিয়ে নিয়ে একটা কথাও কিন্তু তোমরা বোল না। আবার একেবারে হতাশ হয়েও পোরো না। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। হাওয়া কোন দিকে বয় সেটা আগে দেখে নেওয়া দরকার। তারপর সিদ্ধান্ত নেব আমরা। ঠিক আছে”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা ঠিক আছে, তাই হবে। আমি খোকাকে আর ওর মাকেও সেটা বুঝিয়ে দেব”।
সীমন্তিনী তারপর কথা শেষ করে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে লাগল।
****************
এর পরের সাত আট দিনের মধ্যে অনেক কিছু হল। পরিতোষ সেদিন রাতে সীমন্তিনীকে ফোন করে পিসির সাথে দেখা হবার সব ঘটণা সীমন্তিনীকে জানিয়েছিল। আর হৈমবতীদেবীও সেদিন রাতে রচনার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। তাদের গোটা আলোচনাটাই সেদিন সীমন্তিনী আর নবনীতাকে ঘিরে ছিল। নবনীতা আর পরিতোষের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলেও, সীমন্তিনী কেন পরিতোষের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল সেটা হৈমবতীদেবী জানতে পারলেন না।
কলকাতায় মহিমার প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মহিমা প্রায় রোজই সীমন্তিনীর সাথে রাতে ফোন করে কাজের অগ্রগতীর খবর জানায়।
পরিতোষকে আরও তিনদিন আলিপুরদুয়ারে পিসির বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। পরিতোষের সাথে তার পিসির যেদিন দেখা হল তার পরের দিনই হৈমবতীদেবীর অনুরোধে কালচিনি থেকে বিধুবাবুরা সকলেই আলিপুরদুয়ারে তাদের বাড়ি এসেছিলেন। নিজের ভাইপোকে ফিরে পাবার জন্য বিধুবাবুকে হৈমবতীদেবী প্রাণভরা আশীর্বাদ আর ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পরিতোষের মাধ্যমে বাবার আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর সেদিন রাত থেকেই হৈমবতীদেবী অশৌচ পালন করতে শুরু করেছিলেন। বিধুবাবুর সাথে শলা পরামর্শ করে তিনদিন পর তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাবার শ্রাদ্ধকৃত্য সম্পন্ন করেছিলেন। তাই শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত পিসির অনুরোধে পরিতোষকে বাধ্য হয়েই আলিপুরদুয়ারে থাকতে হয়েছিল।
চতুর্থ দিন সকালে সে পিসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কালচিনিতে একবেলা কাটিয়ে বিকেলের ট্রেনে মালবাজার চলে গিয়েছিল। সেখানে এক রাত তার পূর্ব পরিচিত দেবাশীষ বক্সীর সাথে কাটিয়ে পরদিনই সে কলকাতা ফিরে এসেছিল। আর কলকাতায় ফিরে এসেই সেদিন রাতেই পরিতোষ ডক্টর বড়ুয়ার বাড়ি গিয়ে নাগরাকাটা থেকে কিনে আনা উপহার সামগ্রী গুলো তাদের সবাইকে দিয়েছিল। উপহার পেয়ে সবাই খুশী তো হয়েই ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশী খুশী হয়েছিল দীপা বড়ুয়া, যখন শুনলেন যে পরিতোষ কালচিনি গিয়ে তার বড়দার সাথে দেখা করে এসেছে আর পরিতোষ এতদিনে নিজের রক্তের সম্পর্কের পিসি আর তার বিশাল পরিবারকে খুঁজে পেয়েছে।
বিমল আগরওয়ালার অপারেশনে আর রতীশ ও রচনার ওপর নজর রাখবার জন্যে যতজনকে কাজে লাগানো হয়েছিল। তাদের সমস্ত পাওনাগন্ডা চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর রতীশ ও রচনার ওপর কেউ নজর রাখছে না। তবে পরিতোষ স্বয়ং রোজ সকালে রচনাকে আর বিকেলে রতীশকে ফোন করে তাদের সমস্ত সুবিধে অসুবিধের খবর নেয়। এ ছাড়াও তার টিমের প্রণবকেও বলে রেখেছে সে যেন রতীশদের ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখে। প্রণবের বাড়ি রতীশদের ফ্ল্যাট থেকে খুবই কাছে। বাড়ি থেকে যেতে আসতে তাকে রতীশদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। তাছাড়া রতীশদের ফ্ল্যাটের কাছেই যে পানের দোকানটা আছে তার মালিকের সাথেও প্রণবের খুব ঘণিষ্ঠতা আছে। প্রণব সেই দোকানীকেও রতীশদের ফ্ল্যাটের ওপর সর্বদা নজর রাখতে বলেছে। ওদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এলাকায় কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে বা সন্দেহজনক কিছু দেখলেই প্রণব সেটা জানতে পারবে।
কিন্তু পরিতোষ আর অর্চুর বিয়ে নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকা কলকাতা, নাগরাকাটা আর কালচিনির তিনটে পরিবারের লোকদের দুর্ভাবনা এখনও কাটেনি। পরিতোষের সাথে সীমন্তিনী আর নীতার প্রায় রোজই কথা হয়। পরিতোষ নানা বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলে, আগের মতই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে। তবে সীমন্তিনীর সাথে কথা বলবার সময় সে প্রায় রোজই সীমন্তিনীকে সব সময় সতর্ক আর সাবধান থাকতে বলে। রোজ পরিতোষ তাকে এমনভাবে সতর্ক করছে কেন তা জিজ্ঞেস করেও কোনও সদুত্তর পায়নি সীমন্তিনী। কিন্তু পরিতোষ তাকে বিশেষভাবে বারবার করে ফোনে তাকে বলেছে যে, ব্যক্তিগত কাজেই হোক বা অফিসের কাজেই হোক, সীমন্তিনী নাগরাকাটা থেকে বাইরে কোথাও গেলে যেন পরিতোষকে অবশ্যই সে’কথা জানিয়ে দেয় আগে থেকেই। আর রাতের বেলায় ডিউটি ছাড়া অন্য কোন কাজেই যেন সে কোয়ার্টার ছেড়ে না বেরোয়। আর রাতের বেলা কোথাও ডিউটিতে গেলেও যেন অতিরিক্ত সিকিউরিটি নিয়ে যায়। তবে পরিতোষ সীমন্তিনীর প্রশ্নের পরিস্কার জবাব না দিলেও সীমন্তিনীর ধারণা পরিতোষ হয়ত কোনভাবে জানতে পেরেছে যে সীমন্তিনীর ওপর কোনও আচমকা হামলা হতে পারে। এ ব্যাপারে অবশ্য সীমন্তিনী নিজেও অবহিত আছে মোটামুটি। কয়েকটা উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্যরা যে তার ওপর ক্ষেপে আছে তা সীমন্তিনী নিজেও জানে। জুলাই মাসে দার্জিলিং বর্ডারে অনুসন্ধানের সময়েই সে নিজেও সেটা বুঝতে পেরেছিল। দার্জিলিং বর্ডারে অনুসন্ধানে যাবার পর থেকেই সে উগ্রপন্থীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। আর পরিতোষের বন্ধু দেবাশীস বক্সীও তখনই সীমন্তিনীকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সীমন্তিনী নিজেও সেটা উপলব্ধি করেছে। আর নিজেও সর্বদা চোখ কান খোলা রেখে চলে। তাই সে ভেবেছে যে পরিতোষ যখন মালবাজার গিয়েছিল তখন নিশ্চয়ই দেবাশীস বক্সী পরিতোষকে সে’সব কথা বলেছেন। আর তার পর থেকেই পরিতোষও তাকে রোজ সতর্ক করে যাচ্ছে। আর এই কারনেই অনেক ইচ্ছে থাকা সত্বেও, কোনও অফিসিয়াল কাজ না পরার দরুন সীমন্তিনীর আর আলিপুরদুয়ারে যাওয়া হয়নি। ব্যক্তিগত কাজের অজুহাতে গেলে তার সঙ্গে সিকিউরিটি থাকবে না। তাই সে মনে মনে ভেবে রেখেছিল যে আবার আলিপুরদুয়ারে কোন একটা অফিসিয়াল মিটিং বা অন্য কোনও ধরণের অফিসিয়াল ডিউটি পড়লে সে পরিতোষের পিসি আর পিসেমশাইয়ের সাথে দেখা করবে। অবশ্য প্রথম দেখাতেই সে পরিতোষের বিয়ের প্রসঙ্গটা ওঠাতে পারবে না। তবে আন্তরিক ভাবে পরিচিত হতে পারলে, তাদের মন জয় করতে পারলে, নিশ্চয়ই তাদের ফোন নাম্বার চেয়ে আনা যাবে। আর পরে ফোনেও আসল কথাটা নিয়ে সময় বুঝে আলোচনা করা যাবে।
ওদিকে পরিতোষের জীবনটা কালচিনি আর আলিপুরদুয়ার যাবার পর থেকেই অনেকটাই পালটে গেছে। পিসির বাড়িতে তাকে চারটে দিন থাকতে হয়েছিল। সেখানে পিসি, পিসেমশাই, তিন দাদা, তিন বৌদি, আর পাঁচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝির সাথে কাটানো দিনগুলো যেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। সেখানে তিন দিনের দিন হৈমবতীদেবী আর নিরঞ্জনবাবুর আদেশে তাদের দুই মেয়েও তাদের স্বামী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলিপুরদুয়ারে এসেছিল। পিসি-পিসোর বড়মেয়ে নিহারিকা আর ছোটমেয়ে সুতনুকা। তারা দু’জনেই বয়সে পরির চেয়ে ন’ এবং সাত বছরের বড়। নিহারিকার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলেটির বয়স চৌদ্দ আর মেয়েটির সাত। সুতনুকারও একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। তার ছেলের বয়স বারো আর মেয়ের নয়। এতসব আত্মীয় স্বজনকে কাছে পেয়ে পরিতোষ সত্যিই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। তার পিসির সংসারে সেই কটা দিনের স্মৃতি যেন পরিতোষের মনের ভেতরের সমস্ত দুঃখ সমস্ত গ্লানি দুর করে দিয়েছে। এখনকার পরিতোষ আর সাতদিনের আগের পরিতোষ যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুটো লোক। কালচিনি আর আলিপুরদুয়ারে গিয়ে তার যেন এক নবজন্ম লাভ হয়েছে। কলকাতা ফিরে আসবার পর তার পিসতুতো তিন দাদা আর দু’ দিদি প্রায় রোজই ফোন করে তাকে। তার পিসি রোজ রাত ন’টার দিকে ফোন করেন। পরিতোষের জীবনের সব কথা শুনতে শুনতে তিনি যেন পরিতোষের বন্ধু হয়ে উঠেছেন। আর তার তিন বৌদি। তারাও রোজ পরিতোষকে ফোন করেন। ইয়ার্কি ফাজলামো করেন। তবে বড়বৌদি সুলোচনার আন্তরিকতা বা স্নেহে একফোঁটা খামতি না থাকলেও, তিনি নিজে পরিতোষের সাথে অতটা খোলামেলা কথা বলেন না। পরিতোষের আর তার সম্পর্কটা যেন সত্যিকার দিদি আর ভাইয়ের সম্পর্ক। পরিতোষের স্নান খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা। তার শরীর আর মন ভাল আছে কি না, কাজের ব্যস্ততা কেমন, মূলতঃ এ’সব বিষয়েই তিনি পরিতোষের সাথে কথা বলেন। কিন্তু মেজবৌদি রুমা আর ছোটবৌদি দেবিকার মুখের আগল যেন দিনে দিনে আলগা হচ্ছে। তাদের ভাইদার সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের মত আচরণ করতে শুরু করেছেন তারা। পরিতোষের অবশ্য এটাও মন্দ লাগে না। দিনের শেষে, অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ওই দু’জনের সাথে ঠাট্টা ইয়ার্কি আর খুনুসুটি করতে করতে সে যেন তার শরীরের ভেতরের জীবনীশক্তি ফিরে পায় আবার। নতুন করে তার মনে প্রাণে যেন উদ্যমের জোয়ার ফিরে আসে। আর ওই দু’জনের সাথে যত প্রসঙ্গেই কথা হোক না কেন, ঘুরে ফিরে বারবার পরিতোষের বিয়ের প্রসঙ্গই আসে। এই দুই বৌদি, আর পিসির সাথে বন্ধুত্বসুলভ কথাবার্তায় পরিতোষ তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার কথাও খুলে বলতে বাধ্য হয়েছে এই ক’দিনেই। হৈমবতীদেবী, রুমা আর দেবিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সীমন্তিনী আর নবনীতার সাথে পরিতোষের সম্পর্কের প্রায় সমস্ত খুঁটিনাটিই এ’ ক’দিনে জেনে ফেলেছেন। জীবনে প্রথমবার এতজন আত্মীয় পরিজনের সাথে কথা বলতে বলতে পরিতোষ নিজেও যেন বদলে গেছে। নিজের জীবনের সমস্ত ব্যক্তিগত কথাও সে অনায়াসে প্রকাশ করে ফেলেছে তাদের সাথে। তবে সীমন্তিনীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সে ভুলে যায়নি। তাই কবে কোনদিন সে নবনীতা আর সীমন্তিনীকে কিভাবে ভালবেসে ছিল, আর তার ওই ভালবাসার পরিণতি কিভাবে হয়েছিল, এ’সব কথা জানতে পারলেও তার পিসি এবং বৌদিরা সীমন্তিনীর ভালবাসার পাত্রটি আসলে কে, এ প্রশ্নের জবাব হাজার চেষ্টা করেও পরিতোষের কাছ থেকে জানতে পারেন নি।
সীমন্তিনী, নবনীতা, রচনা মাঝে মাঝে পরিতোষকে ফোন করে তার ফোন ব্যস্ত দেখে। পরে অবশ্য পরিতোষই নিজেই তাদের ফোন করে জানায় যে সে আলিপুরদুয়ারের কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল। পরিতোষ যে তার নিজের আত্মীয় পরিজনদের কাছে পেয়ে আগের চেয়ে অনেক ভাল আছে, আনন্দে আছে, এ’কথা বুঝতে পেরে তারা সবাই খুশী হলেও অর্চুর সাথে পরিতোষের বিয়েটা আদৌ আর সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে তাদের তিনজনেরই দুশ্চিন্তা বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে পরিতোষকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করতে পারছিল না। তিন জনের মনের মধ্যেই কেমন একটা দ্বিধাবোধ যেন জেগে উঠেছিল। কিন্তু তারা সকলেই সীমন্তিনীর নির্দেশ মেনে পরিস্থিতির গড়ান বোঝবার চেষ্টা করছে।
আর অর্চনা তো পরিতোষের আলিপুরদুয়ার যাবার পরের দিন থেকেই নিজে সীমন্তিনী, রচনা বা নবনীতার কাছে পরিতোষের সম্পর্কে কোন কথাই বলে না। তার দিদিভাইয়ের কথাকেই বেদবাক্য ধরে নিয়ে সে মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে যাচ্ছে। তবু যেন পুরোপুরি সফল হতে পারছে না সে। যখন সে বাড়িতে একা থাকে তখন বারবারই ঘুরে ফিরে পরিতোষের মুখটা তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। তার মনটা তখন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। পরক্ষণেই সীমন্তিনীর বলা কথাগুলো সে মনে করবার চেষ্টা করে। তখন বেশীরভাগ সময়েই সে রচনাকে ফোন করে নানা কথায় নিজের মন থেকে পরিতোষের ছবিটাকে সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা করে। তাতে সাময়িক ভাবে কিছুটা সফল হলেও, পরিতোষের ছবিটাকে নিজের মন থেকে যেন সে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছে না পুরোপুরি ভাবে। তার দিদিভাই আর নীতাদি যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন তারা সব সময় তাকে তাদের কাছে কাছে রেখে নানা রকম কথাবার্তায় ভুলিয়ে রাখেন। তার দিদিভাই তাকে এমন কথাও বলেছেন যে পরিতোষ যদি তার পিসির পছন্দমতই কাউকে বিয়ে করে তাহলে অর্চুর জন্যে তিনি ভাল আরেকটা ছেলে খুঁজে বের করবেনই। অর্চুকে তিনি সব সময় স্বচ্ছন্দ আর হাসিখুশী থাকতে নির্দেশ দেন। অর্চনাও তার দিদিভাইয়ের কথা সর্বতোভাবে পালন করবার চেষ্টা করে। সে নিজেই বুঝতে পেরেছে তার দিদিভাই তাকে সঠিক উপদেশই দিয়েছেন।
ক’দিন পর দুপুরবেলায় অফিস ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ করতে করতে সীমন্তিনী প্রথমে অর্চনা আর তারপর রচনার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল। খাওয়া শেষে টিফিন ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিয়ে নিজের চেম্বারে ফিরে আসতেই তার পার্সোনাল মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। এ’সময় তার এ মোবাইলে কে ফোন করতে পারে ভাবতে ভাবতে সে ফোনটা বের করে দেখে একটা আননোন ল্যান্ডলাইন নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। নাম্বারটা কয়েকবার দেখেও তার পরিচিত বলে মনে হল না। শুধু এটুকুই বোঝা গেল যে এটা আলিপুরদুয়ারের নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করবে কি করবে না, ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল। নিজের চেয়ারে বসে ফোনটা হাতে নিয়েই সে ভাবতে লাগল, সে কি কলব্যাক করবে ওই নাম্বারটায়? আবার ভাবল, না থাক, দরকার নেই। পরিচিত কেউ নতুন কোন নাম্বার থেকে ফোন করে থাকলে পরে অবশ্যই জানা যাবে। তখন না হয় অফিসের কাজের ছুতো দেখিয়ে সরি বলে দেবে। এই ভেবে ফোনটা আবার ব্যাগে রাখতে যেতেই সেটা আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে আবার সেই একই নাম্বার থেকে ফোন। কিন্তু এবারে আর বেশী ইতঃস্তত না করে সে কলটা রিসিভ করে ফোন কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যালো। কে বলছেন”?
ও’পাশ থেকে এক বয়স্কা মহিলাকন্ঠে জবাব এল, “আমি হৈমবতী মন্ডল বলছি আলিপুরদুয়ার থেকে। তুমি না না, আপনি হয়ত আমাকে চিনবেন না। আমি ......”
কে ফোন করেছে বুঝতে পেরেই সীমন্তিনী চমকে উঠে বলল, “আপনি করে বলতে হবে না। আপনি নিশ্চয়ই পরির পিসি, তাই তো”?
ও’পাশ থেকে হৈমবতীদেবী বললেন, “হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই চিনেছ। আমি পরির পিসিই বলছি। তবে মা, আমি আগেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এমন অসময়ে তোমাকে ফোন করছি বলে। পরি আমাকে আগেই বলেছিল যে আমি দিনের বেলায় তোমার সাথে কথা বলতে চাইলে যেন ঠিক দুপুর আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে ফোন করি। তোমার নাম্বারটা একটু আগে আমি ওর কাছ থেকেই নিয়েছি। তোমাকে আড়াইটে থেকেই আমি ফোন করে যাচ্ছিলুম। কিন্তু বারবার তোমার ফোন ব্যস্ত পাচ্ছিলুম। তাই .......”
সীমন্তিনী হৈমবতীর কথার মাঝেই তাকে থামিয়ে দিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, “না না পিসি, এতে এভাবে ক্ষমা চাইবার কী আছে? আসলে আমি এই সময়ে লাঞ্চ করতে করতেই আমার কাছের মানুষগুলোর সাথে একটু কথা বলি। বাকি সময়ে অফিসের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে কারো ফোন ধরতেও পারিনা। তবে আপনি যখন ফোন করেছিলেন তখন বোধহয় আমি অর্চু কিংবা রচুর সাথে কথা বলছিলুম। আমি রোজ নিয়ম করে ওই সময় ওদের সাথে কথা বলি তো। তাই আমার ফোন ব্যস্ত পেয়েছেন আপনি। তবে আপনি ভাববেন না। আপনার কথা শোনবার পর থেকেই আমারও মনটা চাইছিল আপনার সাথে একটু দেখা করতে। কিন্তু কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত আছি যে এখান থেকে বেরোবার ফুরসতই পাচ্ছি না। আপনার ফোন পেয়ে খুব ভাল লাগল। বলুন কি বলবেন”?
এমন সময় সীমন্তিনীর অফিসিয়াল মোবাইলটা বেজে উঠল। সেটা হাতে নিয়ে দেখে পরিতোষের ফোন। কলটা সে রিজেক্ট করে দিল।
হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি যে কতটা ব্যস্ত থাকো তা আমি পরির মুখে শুনেছি গো মা। আর আমার ছেলেদের মুখেও তোমার অনেক কথা শুনেছি। সবাই বলে আমি নাকি একটু বেশী কথা বলি। তাই বেশী কথা না বলে যেজন্য তোমাকে ফোন করেছি সেটাই সরাসরি বলছি। শোনো মা, তুমি আর নবনীতাই নাকি পরির সবচেয়ে ভাল বন্ধু। আর তোমরা দু’জনই নাকি ওর সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী। সেটা জেনেই বলছি মা, তোমাদের দু’জনের সাথেই আমি দেখা করতে চাই। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় আমাদের পক্ষে ততই মঙ্গল। কিন্তু আমি জানি তুমি নাগরাকাটায় অফিসের কোয়ার্টারে থাকো। আর নবনীতা আর অর্চুও এখন তোমার সাথে তোমার কোয়ার্টারেই আছে। আমি আসলে তোমাদের তিনজনকেই দেখতে চাইছি। হয়ত তুমি ইতিমধ্যে শুনে থাকবে যে অর্চুর বাবা বিধু, আমার ভাই মানে পরির বাবার ছোটবেলার বন্ধু। আমি বিধুকে ছোটবেলা থেকেই আমার আরেকটা ভাইয়ের মতই ভালবাসতুম। তাই ওর বড়মেয়ে অর্চুকে দেখবার বাসনাও আমার মনে আছে। কিন্তু পরির মুখেই শুনলুম তুমি নাকি নিজের ইচ্ছেমত যেখানে সেখানে যে কোন সময় যেতে পারো না। তাই হয়ত, আমি চাইলেও তুমি এখানে আসতে পারবে না চট করে। সেজন্যই আমি ভাবছিলুম আমি নিজেই তোমার ওখানে যাবো। কিন্তু আমার তো বয়স হয়েছে মা। আর বাড়ি থেকে আমাকে একা কোথাও যেতেও দেবে না কেউ। আর এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে তোমার কোয়ার্টারে এখনই তোমরা তিনজন আছ। হয়ত দু’একজন কাজের লোকও আছে। এরমধ্যে আমার সাথে যদি আরও দু’একজনকে নিয়ে যেতে হয়, তবে তো তোমার কোয়ার্টারে স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা হতে পারে। তাই জিজ্ঞেস করছি মা, নাগরাকাটায় তোমার কোয়ার্টারের কাছাকাছি কোথাও কোন থাকবার হোটেল আছে কি মা”?
সীমন্তিনী হৈমবতীর কথা শুনতে শুনতে মনে মনে অনেক কিছু ভেবে যাচ্ছিল। এবার তিনি থামতেই সে বলল, “পরি আমার সবচাইতে ভাল বন্ধু। আর আপনি তার নিজের পিসি। আপনি আমাকে দেখতে এসে যদি হোটেলে রাত কাটান, তাহলে পরির কাছে আমি কি আর মুখ দেখাতে পারবো পিসি? তবু আপনার কথার জবাবে বলছি, নাগরাকাটা আপনাদের আলিপুরদুয়ারের মত বড় জায়গা নয়। প্রায় গ্রামই বলা যায়। এখানে খাবার হোটেল মোটামুটি থাকলেও থাকবার মত ভাল হোটেল আমার কোয়ার্টারের কাছাকাছি তো দুর, গোটা নাগরাকাটাতেও নেই। নামমাত্র দু’একটা হোটেল অবশ্যই আছে। তবে ও’গুলোতে আপনাদের মত ভদ্রলোকেদের পক্ষে থাকা একেবারেই সম্ভব নয়”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে হৈমবতীদেবী খানিকটা হতাশ সুরে বললেন, “ওমা, তাই নাকি? তবে তো ভারী মুস্কিল হল। তুমি তো সারাটা দিনই অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকো। দিনের বেলায় আর কতটুকুই বা সময় তুমি আমাকে দিতে পারবে! আমার যে তোমাকে অনেক কথা বলার আছে মা”।
একজন কনস্টেবল সীমন্তিনীর কেবিনে ঢুকতেই সীমন্তিনী তাকে হাতের ঈশারা করতে সে সাথে সাথে বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী ফোনে বলল, “আচ্ছা পিসি, আপনারা কবে আসতে চাইছেন? আর কতজন আসবেন? পুরুষ মানুষ ক’জন থাকবে আপনার সাথে”?
হৈমবতীদেবী জবাবে বললেন, “আমরা তিনজন যাব মা। আমরা স্বামী-স্ত্রী, আর আমাদের বড়বৌমা। আর আজই যাব ভাবছিলুম”।
সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “পিসি, আমার কোয়ার্টারে আপনাদের তিনজনের থাকবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের খুব বেশী অসুবিধে হবে না। দু’জন পুরুষ মানুষ হলে অবশ্য অসুবিধে হত। তবে আপনাদের হয়ত সামান্য কিছুটা অসুবিধে হতেই পারে। আসলে আপনার বৌমার জন্য আলাদা কোন বিছানা হয়ত হবে না। তাকে হয়ত আমাদের কারো সাথে এক বিছানায় থাকবার প্রয়োজন হতে পারে। এতে তার কোন অসুবিধে হবে না তো”?
হৈমবতীদেবী সাথে সাথে বললেন, “না না মা, আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। তাহলে আমরা আর ঘন্টাখানেক বাদেই রওনা হচ্ছি এখান থেকে”।
______________________________