29-03-2020, 11:27 AM
(Update No. 237)
অর্চনা সীমন্তিনীর কথায় এবার বেশ কিছুটা শান্ত হল। একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তুমি তো বললে যে সন্ধ্যের আগেই পরিতোষবাবু তার পিসির সাথে দেখা করবার জন্য বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলেন। এখন তো রাত প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। এতক্ষণেও তিনি রচুকে আর ফোন করেন নি”?
বলতে বলতেই কলিং বেলের শব্দ হল। আর খানিক বাদেই নবনীতা প্রায় ছুটে এসে সীমন্তিনীর ঘরে ঢুকে বলল, “ও দিদি, পরির ব্যাপারটা কী গো? সেই কোন সকালে এখান থেকে বেরিয়ে গেছে। তারপর থেকে আমি ওর কোনও খবর পাচ্ছি না। দুপুরের পর থেকে কয়েকবার ওকে ফোন করেছি। ওর ফোন সুইচড অফ শোনাচ্ছে। তোমার সাথে কি ওর কোনও কথা ............”
ওর কথা শেষ হবার আগেই সীমন্তিনীর মোবাইলটা বেজে উঠল। অর্চনা ফোনের দিকে তাকিয়েই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “দিদিভাই, রচুর ফোন”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে ফোনটা তুলে কল রিসিভ করতেই ও’পাশ থেকে রচনার উচ্ছ্বসিত গলা শুনতে পেল, “ও দিদিভাই। কী ভাল খবর পেলুম গো। পরিদা তার নিজের পিসির সাথে দেখা করেছেন। আর পিসিও পরিদাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন গো”।
রচনার উচ্ছ্বসিত গলা শুনে সীমন্তিনী সাথে সাথে ফোনটা স্পীকার মোডে দিয়ে দিয়েছিল। তাই এবারকার কথা অর্চনা আর নবনীতাও শুনতে পাচ্ছিল। কথাটা শুনেই অর্চনা সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরল খুশীতে। কিন্তু নবনীতা রচনার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
সীমন্তিনী বলল, “তোকে ফোন করেছিল পরি”?
রচনা আগের মতই উচ্ছ্বসিত গলায় জবাব দিল, “হ্যাঁ গো দিদিভাই। এইমাত্র পরিদা আমাকে ফোন করেছিলেন। তোমার দাদাভাইই ফোনটা ধরেছিলেন। কারন আমি তো তখন ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছিলুম”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল, “তাই নাকি? আচ্ছা কি কি হয়েছে সেখানে খুলে বল তো? ওর পিসি সুস্থ আছেন তো”?
রচনা একই রকম উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। পিসি একদম সুস্থ আছেন। তিনি তো এক মূহুর্তের জন্যেও পরিদাকে নিজের কাছছাড়া করতে চাইছেন না। তিনি নিজে পরিদার হাত ধরে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন। পিসি তো আমার সাথেও ফোনে কথা বললেন। আর তোমার সাথে আমাদের পরিচয়ের সূত্র ধরেই যে পরিদা বাবার কাছে আর তার কাছে গিয়ে পৌঁছেছেন এ’কথা শোনবার পর তিনি আমাকে, তোমার দাদাভাইকে আর তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এখন তো পরিদা ও বাড়িতে পিসি, তিন তিনটে বৌদি, পাচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝিদের সাথে এমন ব্যস্ত আছেন যে কাউকে একটা ফোনও করতে পারছেন না। আমি যে তার ফোন না পাওয়া অব্দি ঠাকুরের প্রার্থনাতেই বসে থাকব, এ’কথা জানলেও তিনি পিসির সাথে দেখা হবার একঘন্টার মধ্যেও আমাকে ফোন করবার সুযোগ পাননি। পিসি নাকি কিছুতেই তাকে নিজের কাছ থেকে দুরে যেতে দিতে চাইছিলেন না। বাধ্য হয়ে তার পাশে বসেই পরিদা আমাকে ফোন করেছিলেন। তখন সব কিছু জানতে পারলুম। পিসিও পরিদার সাথে আমি যখন কথা বলছিলুম তখনই বুঝে গিয়েছিলেন যে আমি বিধুভূষন চক্রবর্তীর মেয়ে। তাই তিনিও তখন আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। আমিও যেন খুশীতে পাগল হয়ে গিয়েছিলুম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে পরিদার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিয়েই তোমাকে ফোন করছি। পরিদা বলেছেন, সে রাতে তোমাদের সাথে কথা বলবেন। কিন্তু দিদিভাই, পরিদা বললেন, পিসি বাবাকে আদেশ দিয়েছেন কাল বাড়ির সবাইকে নিয়ে তাদের ওখানে যেতে”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁরে, সে খবর আমিও পেয়েছি। কিন্তু পরির সাথে তোর আর কি কি কথা হয়েছে সে’সব আগে খুলে বল তো”।
রচনা অনেকটা সময় ধরে সবকিছু গুছিয়ে বলবার পর জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, পিসি যে আগামীকাল সকালেই মা বাবা আর ভাইকে ডেকে পাঠালেন, এর পেছনে কী কারন থাকতে পারে বলো তো”?
সীমন্তিনী এবার অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বলল, “ব্যাপারটা নিয়ে আমিও ভেবেছি রে রচু। আর এটা নিয়েই আমি অর্চুর সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলুম। আমার মন বলছে এর পেছনে দুটো কারন থাকতে পারে। আর তার একটা যে সত্যি সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই আমার। তবে দ্বিতীয় কারনটা যেটা আমি ভাবছি, সেটা সত্যি না-ও হতে পারে। তবে সেটাও যদি সত্যিই হয় তবে আমাদের পক্ষে সেটা ভাল না-ও হতে পারে”।
নবনীতা আর অর্চনা সীমন্তিনীর কথার মানে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। কিন্তু রচনা বলল, “কী আশ্চর্য দিদিভাই! আমার মনেও কিন্তু দুটো সম্ভাবনার কথাই মাথায় এসেছে। জানিনা তুমিও ঠিক সেটাই ভাবছ কি না। তবে আমার মনে হয় তুমি প্রথম যে সম্ভাবনাটার কথা বলছ সেটা নিজের ভাইপোকে ফিরে পেয়ে বাবাকে পিসি তার কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাতে চান। তুমিও কি এমনটাই ভেবেছ দিদিভাই”?
সীমন্তিনী রচনার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, “আমিও ঠিক এটাই ভেবেছি রে রচু। তবে তুই দ্বিতীয় সম্ভাবনা হিসেবে কী ভাবছিস সেটা বল তো। দেখি এটাও আমার ধারণার সাথে মিলে যায় কিনা”?
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। অর্চনাও যে এই মূহুর্তে সীমন্তিনীর পাশে বসে তাদের সব কথা শুনছে সেটা সে আগেই বুঝতে পেরেছে। তাই একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “দিদিভাই, আমার মনে হয় সেটা এ মূহুর্তে না বলাই ভাল। অন্য কোন সময় বলব’খন”।
সীমন্তিনী একহাতে অর্চনাকে তার আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, “তুই ভাবিস না সোনা। আমি আছি তো তোর আর অর্চুর পাশে। আর তোকে বললুম না আগেই? এ ব্যাপারেই আমি এতক্ষণ অর্চুর সাথে কথা বলছিলুম। আর শোন, এতদিন আমরা সবাই অর্চুর কাছে যে’সব কথা গোপন রেখেছিলুম তার সব কিছু আজ ওকে খুলে বলতে বাধ্য হয়েছি। আর কেন বাধ্য হয়েছি জানিস? তোর দিদি যে একদিনের দেখাতেই পরির প্রেমে পড়ে গেছে রে। ও যে আজ সারাটা দিন তোর আমার চেয়েও অনেক বেশী উদ্বেগে কাটিয়েছে। সেটা জানবার পরেই ওকে আমি এতদিন গোপন রাখা সব কিছু খুলে বলেছি”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রায় আঁতকে উঠে বলল, “অ্যা! কী বলছ তুমি দিদিভাই? দিদি পরিদাকে ভাল বেসে ফেলেছে? সত্যি বলছ তুমি”?
নবনীতাও এ’কথা শুনে অবাক। কিন্তু এতক্ষণে অবাক হবার মত আরও অনেক কিছুই সে শুনেছে। তার মনেও হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করে আছে। কিন্তু রচনার সাথে ফোন বার্তালাপ শেষ না হওয়া অব্দি সে তো আর সীমন্তিনীর কাছে কোন প্রশ্ন তুলে ধরতে পারছে না। তাই চুপ করেই রইল। কিন্তু লজ্জায় নুয়ে পড়া অর্চনার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কিগো অর্চু? সত্যি”?
অর্চনা কোন কিছু না বলে লজ্জায় যেন আরও নুয়ে পড়ল। ওদিকে রচনা তখন ফোনে বলছে, “দিদিভাই আমি বুঝতে পাচ্ছিনা তোমার কথা শুনে আমার খুশী হওয়া উচিৎ? না চিন্তিত হওয়া উচিৎ। আমরা সকলেই তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় ফাইনাল করে এনেছিলুম। এখন পরিদার পিসিই যদি পরিদার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে অন্য কোন মেয়ের সাথে পরিদার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন? তাহলে কী হবে গো”?
সীমন্তিনী শান্ত গলায় বলল, “সে সম্ভাবনা মাথায় রেখেই অর্চুকে আমি বোঝাচ্ছিলুম এতক্ষণ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অর্চুর উদ্বেগ দেখেই যখন আমি ওর মনের ব্যাপারটা আঁচ করেছি, তখনই মনে হল, আগে থেকেই ওকে সাবধান করে দেওয়া উচিৎ। তাই এতদিন আমরা সকলে মিলে ওকে আর পরিকে নিয়ে যা যা ভেবেছি, আর সেজন্যে যাকিছু করেছি তার সবকিছুই খুলে বললুম ওকে। এখন পরির পিসি যদি আমাদের আশঙ্কাটাকেই সত্যি প্রমাণ করে অন্য কোন মেয়ের সাথে পরির বিয়ে দিতে চান, তাহলে আমরা তো আর সেটা আটকাতে পারব না। আর আগে পরি আমাদের যে প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকুক না কেন, জীবনে প্রথমবার খুঁজে পাওয়া ওর একমাত্র রক্তের সম্পর্কের পিসির অনুরোধ বা আদেশ সে ফেলতে পারবে না। হয়ত তার প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার জন্য আমাদের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করবে। আর পরি আমাদের যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন, আমাদের তো পরির ওপর বিরূপ চাপ সৃষ্টি করার কোনও অধিকার নেই। মন না চাইলেও কঠিন সেই বাস্তবকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। তাই তো এ’সবই এতক্ষণ অর্চুকে আমি বোঝাচ্ছিলুম। ওকে বলছিলুম, আগে থেকেই মনে কোন রঙ্গিন স্বপ্ন যেন ও দেখতে শুরু না করে”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে বলল, “তুমি ঠিকই করেছ দিদিভাই। দিদি জীবনে কম কষ্ট তো পায় নি। আবার জীবনে প্রথম একজনকে মনে মনে ভালবেসে তাকে নিজের করে না পেলে ও যে আরও একটা বড় আঘাত পাবে। আবার কষ্ট পাবে”।
সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ঠিক সেটা ভেবেই আজ আমি ওকে সব কিছু খুলে বললুম। আসলে যখনই জানতে পেরেছি যে পরি তার পিসির খোঁজ পেয়েছে, তখন থেকেই আমার মনে এ চিন্তাটা এসেছে। এতদিন গোটা ব্যাপারটাই আমার আর নীতার হাতে ছিল। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছিলুম। কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা হঠাৎ করেই বদলে গেল। পরি ওর রক্তের সম্পর্কের পিসিকে খুঁজে পেয়েছে জেনে তুই আমি, মাসি মেসোরা, সবাই তো খুশী হয়েছি। কিন্তু তার সাথে সাথে আমার মনের কোনে একটা ঘণ কালো মেঘের ছায়াও যেন ফুটে উঠছে। পরির পিসির মতের বিরূদ্ধে গিয়ে আমরা তো জোর করে ওদের বিয়ে দিতে পারব না। তবে আমার মনে হয় এখনই হতাশ হবার মত কিছু হয়নি। ক’টা দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু অর্চু যদি এরই মধ্যে নিজেকে মানসিক ভাবে পুরোপুরি পরির কাছে সমর্পন করে দেয় তাহলেই বিপদ হয়ে যাবে। এ’সব কথাই ওকে বোঝাচ্ছিলুম আমি। তুইও এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করিস নে বোন। আমাদের এখন পরির পিসির মনের ইচ্ছেটা বোঝবার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। যদি সম্ভব হত আমি আজই তার সাথে দেখা করে এ ব্যাপারে আলোচনা করতুম। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাছাড়া অজানা অচেনা এক মহিলার কাছে অনাহুত ভাবে গিয়ে তার ভাইপোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলাটাও তো উচিৎ না। তাই একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখতে হবে গোটা ব্যাপারটা। ততদিন অর্চুকেও নিজের মনটাকে শাসনে রাখতে হবে। সেটা করতে পারলেই ওর পক্ষে মঙ্গল। এ ছাড়া আমাদের সামনে এই মূহুর্তে আর করণীয় কিছু নেই। তুইও আর আজে বাজে কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করিস নে। দেখা যাক কী হয়। পরি হয়ত রাতে ফোন করবে আমাকে বা নীতাকে। ওর সাথে কথা বলেও কিছুটা আঁচ পেতে পারি। যখন যা হয় তুই জানতে পারবি। আর তুইও যদি কোনখান থেকে কিছু জানতে পারিস, তাহলে আমাদের জানাস, কেমন”।
রচনা সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে দিদিভাই। রাখছি তাহলে”।
রচনার সাথে ফোনে কথা শেষ করেই সীমন্তিনী নবনীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিরে একের পর এক এতসব অপ্রত্যাশিত খবর শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিস নিশ্চয়ই। জানি তোর মনের মধ্যে এখন অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে। এক কাজ কর, হাত মুখ ধুয়ে অর্চুকে নিয়ে তোদের ঘরে বসে ওর কাছ থেকে সব কিছু জেনে নে। আমি এই মূহুর্তে তোকে সে’সব শোনাতে পারছি না। আমার এখনই কালচিনিতে ফোন করতে হবে। সেটা পরে শুনে নিস”।
নবনীতা কোন কথা না বলে “এসো অর্চু” বলে অর্চনার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর সীমন্তিনী সাথে সাথে কিংশুকের নাম্বার ডায়াল করল। ও’পাশ থেকে কিংশুকের সাড়া পেতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “ভাই, মেসো দোকান বন্ধ করে বাড়ি এসেছেন”?
কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, বাবা একটু আগেই বাড়িতে এলেন। বাবার সাথে কথা বলবে তুমি? এক মিনিট ধরো তাহলে, আমি ও’ঘরে যাচ্ছি”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “হ্যাঁ ভাই আমি আছি লাইনে। আচ্ছা ভাই, এর মধ্যে পরির বা আলিপুরদুয়ারের আর কেউ ফোন করেছিল”?
কিংশুক বলল, “না দিদিভাই, ওই তোমাকে যে আগের বার বললুম, পরিদার পিসি বাবার সাথে কথা বললেন, তারপর আর কেউ ফোন করেনি। আচ্ছা দিদিভাই, এই নাও বাবাকে দিচ্ছি”।
একটু পরেই ফোনে বিধুবাবুর গলা শোনা গেল, “কে মন্তি মা? হ্যাঁ মা বলো”?
সীমন্তিনী বলল, “মেসো শুনলুম কাল নাকি তোমরা সবাই আলিপুরদুয়ার যাচ্ছ পরির পিসির বাড়িতে”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁগো মা। আসলে হিমুদি এমনভাবে বললেন যে না গেলে ভাল দেখাবে না। আর আমাদের সকলের মনেও একটু কৌতূহল আছেই। পরিকে ও বাড়ির লোকেরা ঠিক কেমন ভাবে নিয়েছে সেটা তো এখনও বুঝতেই পারিনি আমরা। খোকাকে দিয়ে পরির নাম্বারে দু’বার ফোনও করিয়েছি সন্ধ্যের পর থেকে। কিন্তু ও ফোন ধরছে না। ও নিজেও ফোন করে আমাদের কিছু জানাল না। তাই ভাবলুম হিমুদি যখন এত করে বললেন, তাহলে একটা দিন না হয় দোকান বন্ধ রেখে গিয়ে ঘুরেই আসি। তবে বিকেল বা সন্ধ্যের দিকেই সেখান থেকে ফিরে আসব”।
সীমন্তিনী স্বাভাবিক গলায় বলল, “ঠিক আছে মেসো, আমারও মনে হচ্ছিল তোমাদের যাওয়া উচিৎ। তবে মেসো আমরা যে অর্চুর সাথে পরির বিয়ে দেবার কথা ভাবছি, এ’ কথাটা ওখানে তোমরা কেউ এখনই প্রকাশ করে দিও না। তাতে একটু অসুবিধে হতে পারে”।
বিধুবাবু বললেন, “তোমার কথার তাৎপর্য আমি বুঝতে পেরেছি মা। আমি নিজেও সে ব্যাপারে একটু চিন্তিত আছি। কিন্তু মা, পরি তো গতকাল পুরোটা দিনই তোমাদের ওখানেই কাটিয়েছে। পরির সাথে তোমরা কি এখনও ও ব্যাপারে কোন কিছু আলোচনা করোনি”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “ইচ্ছে থাকলেও সেটা করবার সুযোগ পাইনি গো মেসো। পরি যে এভাবে হুট করে আমার এখানে আসবে সেটাই তো আমি জানতুম না। আমি যখন অফিসে যাব বলে ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলুম তখনই ও এসে হাজির। তবু ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে একটু দেরীতেই আমি অফিসে গিয়েছিলুম। আবার অফিস থেকে ফিরে অধিকারীবাবুর সাথে আমি আর পরি মিলে একটা মিটিঙে বসেছিলুম। ভেবেছিলুম ও আরও দু’ একটা দিন নিশ্চয়ই এখানে থাকবে। কিন্তু রাতেই ও জানিয়ে দিল যে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও তোমাদের সাথে দেখা করতে যাবে। আর ঠিক সেভাবেই আজ সকালেই তো ও বেরিয়ে গেল। তাই ওর সাথে ওই ব্যাপার নিয়ে কোন কথাই বলতে পারিনি। ওর সাথে তো একা বসে গল্প করবার জন্য সুযোগই পেলুম না। আর সকলের সামনে কি আর এ’সব কথা বলা যায়, বলো”?
বিধুবাবু সীমিন্তিনীর কথা শুনে বললেন, “হ্যাঁ, সে তুমি ঠিকই বলেছ মা। হাতে একটু সময় নিয়ে দু’পক্ষ একসাথে বসবার সুযোগ না পেলে তো আর সে’সব আলোচনা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু জানো মন্তি মা। আজ দুপুরের পর থেকে মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে। ছোটবেলার বন্ধুর ছেলেকে খুঁজে পেয়ে মনটা খুশীতে ভরে উঠেছিল। পরি নিজের পিসির কাছে যাচ্ছে, এটা ভেবেও খুব আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু হিমুদির যে প্রেসার বেড়েছে, এ’কথা আমার জানা ছিল না। বিকেলে রচু আর নিরুদার বড় ছেলে শ্যামলেন্দু ফোন করে জানাল যে নিরুদা আর তার ছেলেরা পরিকে খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেও হিমুদির প্রেসার বেড়েছে বলে তারা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া পরিকে হিমুদির সাথে দেখা করতে দিতে চাইছেন না। হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী হিমুদি এই বয়সে তার মা বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে সহ্য করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে মনটা খুব শঙ্কিত হচ্ছিল। সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ হিমুদি নিজেই ফোনে আমার সাথে কথা বললেন। উনি পরিকে দেখেছেন কিনা, ওনার শরীর ঠিক আছে কিনা, এ’সব জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেলাম না। হিমুদি শুধু বাড়ির সবাইকে নিয়ে কাল সকালেই তার বাড়িতে যাবার আদেশ শুনিয়ে ফোনটা কেটে দিলেন। ওখানে পরির সাথে কে কেমন ব্যবহার করছে, কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। খানিকক্ষণ আগে রচু ফোন করে সব কিছু জানাল। রচুর কাছ থেকে সবকিছু শুনে আগের দুশ্চিন্তাগুলো মন থেকে কেটে গেলেও নতুন করে আরেক দুশ্চিন্তা মনে এসে ঢুকল। হ্যাঁগো মা, আমরা সবাই মিলে যা ভাবছিলুম সেটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেবে তো? তোমার কি মনে হয় মা”?
সীমন্তিনী শান্ত কন্ঠে বলল, “মেসো, এই মূহুর্তে আমাদের সকলের মনেই সেই একই প্রশ্ন। এতদিন তো পরি সবকিছুই আমার আর নীতার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ ও ওর আপন অভিভাবক খুঁজে পেয়েছে। তাই পরিস্থিতি তো অনেকটাই পাল্টে গেল। এখন পরির পিসি পিসেমশাইরাই তো ওর বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর নীতিগত ভাবে তেমনটাই তো হওয়া উচিৎ মেসো। তবে তারা যদি তেমন দায়িত্ব নিতে না চান তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু রচুর মুখে যা শুনলুম তাতে তো মনে হল ও বাড়ির সকলেই পরিকে আপন করে নিয়েছে। তাই ওর বিয়ের ব্যাপারটা তাদের ওপরেই বোধহয় বর্তাবে। আর সেজন্যেই তোমাকে ও’ কথা বললুম। আমরা এতদিন ধরে পরি আর অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে যা কিছু ভেবেছি সে’সব কথা তুমি কালই তাদের জানিও না। কারন, একদিকে আমাদের অর্চু অল্পশিক্ষিতা। অন্যদিকে ও বিবাহিতা এবং বিধবা। পাঁচ পাঁচটা বছর এক মোদো মাতাল স্বামীর সাথে সংসার করেছে। সে মেয়ে যতই রূপবতী আর গুণবতী হোক না কেন, কোনও ছেলের অভিভাবকেরাই এমন মেয়ের সাথে এক কথায় ছেলের বিয়ে দিতে রাজী হবেন না। তবে যে মহিলা আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে নিজের মা বাবার মতের বিরূদ্ধে গিয়ে নিচুজাতের একটা ছেলের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তার সাথে সংসার করতে পারেন, তার ভেতর ধর্মের বা সংস্কারের গোড়ামি কিছুটা হলেও কম হবার কথা। আর অন্য দিক দিয়ে এটাও ভাবা যায় যে পরিকে তো ওনারা আজই পেলেন। তাই এখনই যে ওনারা পরির বিয়ের জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠবেন তা মনে হয় হবে না। তাই আমাদের একটু অপেক্ষা করতেই হবে মেসো। আজই তো আর পরির পিসির কাছে অর্চুর সম্মন্ধ নিয়ে যাওয়া যায় না। আর তাছাড়া সবচেয়ে বড় ব্যাপার অর্চুকে তারা পরির জন্য পছন্দ করবেন কি না। আর কথায় কথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আমার মনে এল। আচ্ছা মেসো, অর্চুর ব্যাপারে পরির পিসো পিসিরা কি কিছু জানেন”?
বিধুবাবু জবাবে বললেন, “অর্চুর ব্যাপারে তারা অনেক কিছুই জানেন রে মা। তোমাকে বোধহয় সে’কথা আগে বলিনি আমি। আসলে এমন একটা দিন যে আমাদের জীবনে আসতে পারে সেটা তো ভাবিনি আগে। তাই সেদিন ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর দিদিকে দেখার কথাটা তোমাকে বলিনি। তবে যেদিন আমি প্রথম দোকানের জন্য থোকে মাল কিনব বলে আলিপুরদুয়ার গিয়েছিলুম সেদিনই তো নিরুদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আর নিরুদা অ', আর একটু কড়া ধাচের মানুষ হলেও মানুষ হিসেবে খুবই ভাল। উনি তো আমাকে দেখার সাথে সাথেই আমাকে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বাদে হিমুদিকে দেখতে পেয়ে আমারও খুব ভাল লেগেছিল। হিমুদিও সেদিন সাংঘাতিক খুশী হয়েছিলেন আমাকে পেয়ে। আমাকে নিয়ে যে তিনি কি করবেন না করবেন তা যেন বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। আমার সেই মূহুর্তে মনে হয়েছিল আমিই বুঝি হিমুদির মায়ের পেটের ছোট ভাই। কিছুক্ষণ মা বাবা ভাইদের কথা উঠিয়ে কান্নাকাটি করে অনেক আদর যত্ন করেছিলেন আমাকে। আমাদের সব খবরাখবর নিচ্ছিলেন। তখন আমাদের সকলের কথাই তাকে বলেছি। তোমার কথাও সেদিন তাকে বলেছিলুম। অর্চুর বিয়ের পর সাতটা বছর শ্বশুর বাড়িতে কত কষ্টে ছিল, আর শেষে ওকে আমরা ফিরে পেলাম কিভাবে, এসব প্রায় সবই বলেছি হিমুদিকে”।
অর্চনা সীমন্তিনীর কথায় এবার বেশ কিছুটা শান্ত হল। একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তুমি তো বললে যে সন্ধ্যের আগেই পরিতোষবাবু তার পিসির সাথে দেখা করবার জন্য বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলেন। এখন তো রাত প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। এতক্ষণেও তিনি রচুকে আর ফোন করেন নি”?
বলতে বলতেই কলিং বেলের শব্দ হল। আর খানিক বাদেই নবনীতা প্রায় ছুটে এসে সীমন্তিনীর ঘরে ঢুকে বলল, “ও দিদি, পরির ব্যাপারটা কী গো? সেই কোন সকালে এখান থেকে বেরিয়ে গেছে। তারপর থেকে আমি ওর কোনও খবর পাচ্ছি না। দুপুরের পর থেকে কয়েকবার ওকে ফোন করেছি। ওর ফোন সুইচড অফ শোনাচ্ছে। তোমার সাথে কি ওর কোনও কথা ............”
ওর কথা শেষ হবার আগেই সীমন্তিনীর মোবাইলটা বেজে উঠল। অর্চনা ফোনের দিকে তাকিয়েই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “দিদিভাই, রচুর ফোন”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে ফোনটা তুলে কল রিসিভ করতেই ও’পাশ থেকে রচনার উচ্ছ্বসিত গলা শুনতে পেল, “ও দিদিভাই। কী ভাল খবর পেলুম গো। পরিদা তার নিজের পিসির সাথে দেখা করেছেন। আর পিসিও পরিদাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন গো”।
রচনার উচ্ছ্বসিত গলা শুনে সীমন্তিনী সাথে সাথে ফোনটা স্পীকার মোডে দিয়ে দিয়েছিল। তাই এবারকার কথা অর্চনা আর নবনীতাও শুনতে পাচ্ছিল। কথাটা শুনেই অর্চনা সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরল খুশীতে। কিন্তু নবনীতা রচনার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
সীমন্তিনী বলল, “তোকে ফোন করেছিল পরি”?
রচনা আগের মতই উচ্ছ্বসিত গলায় জবাব দিল, “হ্যাঁ গো দিদিভাই। এইমাত্র পরিদা আমাকে ফোন করেছিলেন। তোমার দাদাভাইই ফোনটা ধরেছিলেন। কারন আমি তো তখন ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছিলুম”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল, “তাই নাকি? আচ্ছা কি কি হয়েছে সেখানে খুলে বল তো? ওর পিসি সুস্থ আছেন তো”?
রচনা একই রকম উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। পিসি একদম সুস্থ আছেন। তিনি তো এক মূহুর্তের জন্যেও পরিদাকে নিজের কাছছাড়া করতে চাইছেন না। তিনি নিজে পরিদার হাত ধরে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন। পিসি তো আমার সাথেও ফোনে কথা বললেন। আর তোমার সাথে আমাদের পরিচয়ের সূত্র ধরেই যে পরিদা বাবার কাছে আর তার কাছে গিয়ে পৌঁছেছেন এ’কথা শোনবার পর তিনি আমাকে, তোমার দাদাভাইকে আর তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এখন তো পরিদা ও বাড়িতে পিসি, তিন তিনটে বৌদি, পাচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝিদের সাথে এমন ব্যস্ত আছেন যে কাউকে একটা ফোনও করতে পারছেন না। আমি যে তার ফোন না পাওয়া অব্দি ঠাকুরের প্রার্থনাতেই বসে থাকব, এ’কথা জানলেও তিনি পিসির সাথে দেখা হবার একঘন্টার মধ্যেও আমাকে ফোন করবার সুযোগ পাননি। পিসি নাকি কিছুতেই তাকে নিজের কাছ থেকে দুরে যেতে দিতে চাইছিলেন না। বাধ্য হয়ে তার পাশে বসেই পরিদা আমাকে ফোন করেছিলেন। তখন সব কিছু জানতে পারলুম। পিসিও পরিদার সাথে আমি যখন কথা বলছিলুম তখনই বুঝে গিয়েছিলেন যে আমি বিধুভূষন চক্রবর্তীর মেয়ে। তাই তিনিও তখন আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। আমিও যেন খুশীতে পাগল হয়ে গিয়েছিলুম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে পরিদার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিয়েই তোমাকে ফোন করছি। পরিদা বলেছেন, সে রাতে তোমাদের সাথে কথা বলবেন। কিন্তু দিদিভাই, পরিদা বললেন, পিসি বাবাকে আদেশ দিয়েছেন কাল বাড়ির সবাইকে নিয়ে তাদের ওখানে যেতে”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁরে, সে খবর আমিও পেয়েছি। কিন্তু পরির সাথে তোর আর কি কি কথা হয়েছে সে’সব আগে খুলে বল তো”।
রচনা অনেকটা সময় ধরে সবকিছু গুছিয়ে বলবার পর জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, পিসি যে আগামীকাল সকালেই মা বাবা আর ভাইকে ডেকে পাঠালেন, এর পেছনে কী কারন থাকতে পারে বলো তো”?
সীমন্তিনী এবার অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বলল, “ব্যাপারটা নিয়ে আমিও ভেবেছি রে রচু। আর এটা নিয়েই আমি অর্চুর সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলুম। আমার মন বলছে এর পেছনে দুটো কারন থাকতে পারে। আর তার একটা যে সত্যি সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই আমার। তবে দ্বিতীয় কারনটা যেটা আমি ভাবছি, সেটা সত্যি না-ও হতে পারে। তবে সেটাও যদি সত্যিই হয় তবে আমাদের পক্ষে সেটা ভাল না-ও হতে পারে”।
নবনীতা আর অর্চনা সীমন্তিনীর কথার মানে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। কিন্তু রচনা বলল, “কী আশ্চর্য দিদিভাই! আমার মনেও কিন্তু দুটো সম্ভাবনার কথাই মাথায় এসেছে। জানিনা তুমিও ঠিক সেটাই ভাবছ কি না। তবে আমার মনে হয় তুমি প্রথম যে সম্ভাবনাটার কথা বলছ সেটা নিজের ভাইপোকে ফিরে পেয়ে বাবাকে পিসি তার কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাতে চান। তুমিও কি এমনটাই ভেবেছ দিদিভাই”?
সীমন্তিনী রচনার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, “আমিও ঠিক এটাই ভেবেছি রে রচু। তবে তুই দ্বিতীয় সম্ভাবনা হিসেবে কী ভাবছিস সেটা বল তো। দেখি এটাও আমার ধারণার সাথে মিলে যায় কিনা”?
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। অর্চনাও যে এই মূহুর্তে সীমন্তিনীর পাশে বসে তাদের সব কথা শুনছে সেটা সে আগেই বুঝতে পেরেছে। তাই একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “দিদিভাই, আমার মনে হয় সেটা এ মূহুর্তে না বলাই ভাল। অন্য কোন সময় বলব’খন”।
সীমন্তিনী একহাতে অর্চনাকে তার আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, “তুই ভাবিস না সোনা। আমি আছি তো তোর আর অর্চুর পাশে। আর তোকে বললুম না আগেই? এ ব্যাপারেই আমি এতক্ষণ অর্চুর সাথে কথা বলছিলুম। আর শোন, এতদিন আমরা সবাই অর্চুর কাছে যে’সব কথা গোপন রেখেছিলুম তার সব কিছু আজ ওকে খুলে বলতে বাধ্য হয়েছি। আর কেন বাধ্য হয়েছি জানিস? তোর দিদি যে একদিনের দেখাতেই পরির প্রেমে পড়ে গেছে রে। ও যে আজ সারাটা দিন তোর আমার চেয়েও অনেক বেশী উদ্বেগে কাটিয়েছে। সেটা জানবার পরেই ওকে আমি এতদিন গোপন রাখা সব কিছু খুলে বলেছি”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রায় আঁতকে উঠে বলল, “অ্যা! কী বলছ তুমি দিদিভাই? দিদি পরিদাকে ভাল বেসে ফেলেছে? সত্যি বলছ তুমি”?
নবনীতাও এ’কথা শুনে অবাক। কিন্তু এতক্ষণে অবাক হবার মত আরও অনেক কিছুই সে শুনেছে। তার মনেও হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করে আছে। কিন্তু রচনার সাথে ফোন বার্তালাপ শেষ না হওয়া অব্দি সে তো আর সীমন্তিনীর কাছে কোন প্রশ্ন তুলে ধরতে পারছে না। তাই চুপ করেই রইল। কিন্তু লজ্জায় নুয়ে পড়া অর্চনার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কিগো অর্চু? সত্যি”?
অর্চনা কোন কিছু না বলে লজ্জায় যেন আরও নুয়ে পড়ল। ওদিকে রচনা তখন ফোনে বলছে, “দিদিভাই আমি বুঝতে পাচ্ছিনা তোমার কথা শুনে আমার খুশী হওয়া উচিৎ? না চিন্তিত হওয়া উচিৎ। আমরা সকলেই তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় ফাইনাল করে এনেছিলুম। এখন পরিদার পিসিই যদি পরিদার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে অন্য কোন মেয়ের সাথে পরিদার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন? তাহলে কী হবে গো”?
সীমন্তিনী শান্ত গলায় বলল, “সে সম্ভাবনা মাথায় রেখেই অর্চুকে আমি বোঝাচ্ছিলুম এতক্ষণ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অর্চুর উদ্বেগ দেখেই যখন আমি ওর মনের ব্যাপারটা আঁচ করেছি, তখনই মনে হল, আগে থেকেই ওকে সাবধান করে দেওয়া উচিৎ। তাই এতদিন আমরা সকলে মিলে ওকে আর পরিকে নিয়ে যা যা ভেবেছি, আর সেজন্যে যাকিছু করেছি তার সবকিছুই খুলে বললুম ওকে। এখন পরির পিসি যদি আমাদের আশঙ্কাটাকেই সত্যি প্রমাণ করে অন্য কোন মেয়ের সাথে পরির বিয়ে দিতে চান, তাহলে আমরা তো আর সেটা আটকাতে পারব না। আর আগে পরি আমাদের যে প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকুক না কেন, জীবনে প্রথমবার খুঁজে পাওয়া ওর একমাত্র রক্তের সম্পর্কের পিসির অনুরোধ বা আদেশ সে ফেলতে পারবে না। হয়ত তার প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার জন্য আমাদের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করবে। আর পরি আমাদের যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন, আমাদের তো পরির ওপর বিরূপ চাপ সৃষ্টি করার কোনও অধিকার নেই। মন না চাইলেও কঠিন সেই বাস্তবকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। তাই তো এ’সবই এতক্ষণ অর্চুকে আমি বোঝাচ্ছিলুম। ওকে বলছিলুম, আগে থেকেই মনে কোন রঙ্গিন স্বপ্ন যেন ও দেখতে শুরু না করে”।
রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে বলল, “তুমি ঠিকই করেছ দিদিভাই। দিদি জীবনে কম কষ্ট তো পায় নি। আবার জীবনে প্রথম একজনকে মনে মনে ভালবেসে তাকে নিজের করে না পেলে ও যে আরও একটা বড় আঘাত পাবে। আবার কষ্ট পাবে”।
সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ঠিক সেটা ভেবেই আজ আমি ওকে সব কিছু খুলে বললুম। আসলে যখনই জানতে পেরেছি যে পরি তার পিসির খোঁজ পেয়েছে, তখন থেকেই আমার মনে এ চিন্তাটা এসেছে। এতদিন গোটা ব্যাপারটাই আমার আর নীতার হাতে ছিল। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছিলুম। কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা হঠাৎ করেই বদলে গেল। পরি ওর রক্তের সম্পর্কের পিসিকে খুঁজে পেয়েছে জেনে তুই আমি, মাসি মেসোরা, সবাই তো খুশী হয়েছি। কিন্তু তার সাথে সাথে আমার মনের কোনে একটা ঘণ কালো মেঘের ছায়াও যেন ফুটে উঠছে। পরির পিসির মতের বিরূদ্ধে গিয়ে আমরা তো জোর করে ওদের বিয়ে দিতে পারব না। তবে আমার মনে হয় এখনই হতাশ হবার মত কিছু হয়নি। ক’টা দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু অর্চু যদি এরই মধ্যে নিজেকে মানসিক ভাবে পুরোপুরি পরির কাছে সমর্পন করে দেয় তাহলেই বিপদ হয়ে যাবে। এ’সব কথাই ওকে বোঝাচ্ছিলুম আমি। তুইও এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করিস নে বোন। আমাদের এখন পরির পিসির মনের ইচ্ছেটা বোঝবার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। যদি সম্ভব হত আমি আজই তার সাথে দেখা করে এ ব্যাপারে আলোচনা করতুম। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাছাড়া অজানা অচেনা এক মহিলার কাছে অনাহুত ভাবে গিয়ে তার ভাইপোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলাটাও তো উচিৎ না। তাই একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখতে হবে গোটা ব্যাপারটা। ততদিন অর্চুকেও নিজের মনটাকে শাসনে রাখতে হবে। সেটা করতে পারলেই ওর পক্ষে মঙ্গল। এ ছাড়া আমাদের সামনে এই মূহুর্তে আর করণীয় কিছু নেই। তুইও আর আজে বাজে কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করিস নে। দেখা যাক কী হয়। পরি হয়ত রাতে ফোন করবে আমাকে বা নীতাকে। ওর সাথে কথা বলেও কিছুটা আঁচ পেতে পারি। যখন যা হয় তুই জানতে পারবি। আর তুইও যদি কোনখান থেকে কিছু জানতে পারিস, তাহলে আমাদের জানাস, কেমন”।
রচনা সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে দিদিভাই। রাখছি তাহলে”।
রচনার সাথে ফোনে কথা শেষ করেই সীমন্তিনী নবনীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিরে একের পর এক এতসব অপ্রত্যাশিত খবর শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিস নিশ্চয়ই। জানি তোর মনের মধ্যে এখন অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে। এক কাজ কর, হাত মুখ ধুয়ে অর্চুকে নিয়ে তোদের ঘরে বসে ওর কাছ থেকে সব কিছু জেনে নে। আমি এই মূহুর্তে তোকে সে’সব শোনাতে পারছি না। আমার এখনই কালচিনিতে ফোন করতে হবে। সেটা পরে শুনে নিস”।
নবনীতা কোন কথা না বলে “এসো অর্চু” বলে অর্চনার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর সীমন্তিনী সাথে সাথে কিংশুকের নাম্বার ডায়াল করল। ও’পাশ থেকে কিংশুকের সাড়া পেতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “ভাই, মেসো দোকান বন্ধ করে বাড়ি এসেছেন”?
কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, বাবা একটু আগেই বাড়িতে এলেন। বাবার সাথে কথা বলবে তুমি? এক মিনিট ধরো তাহলে, আমি ও’ঘরে যাচ্ছি”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “হ্যাঁ ভাই আমি আছি লাইনে। আচ্ছা ভাই, এর মধ্যে পরির বা আলিপুরদুয়ারের আর কেউ ফোন করেছিল”?
কিংশুক বলল, “না দিদিভাই, ওই তোমাকে যে আগের বার বললুম, পরিদার পিসি বাবার সাথে কথা বললেন, তারপর আর কেউ ফোন করেনি। আচ্ছা দিদিভাই, এই নাও বাবাকে দিচ্ছি”।
একটু পরেই ফোনে বিধুবাবুর গলা শোনা গেল, “কে মন্তি মা? হ্যাঁ মা বলো”?
সীমন্তিনী বলল, “মেসো শুনলুম কাল নাকি তোমরা সবাই আলিপুরদুয়ার যাচ্ছ পরির পিসির বাড়িতে”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁগো মা। আসলে হিমুদি এমনভাবে বললেন যে না গেলে ভাল দেখাবে না। আর আমাদের সকলের মনেও একটু কৌতূহল আছেই। পরিকে ও বাড়ির লোকেরা ঠিক কেমন ভাবে নিয়েছে সেটা তো এখনও বুঝতেই পারিনি আমরা। খোকাকে দিয়ে পরির নাম্বারে দু’বার ফোনও করিয়েছি সন্ধ্যের পর থেকে। কিন্তু ও ফোন ধরছে না। ও নিজেও ফোন করে আমাদের কিছু জানাল না। তাই ভাবলুম হিমুদি যখন এত করে বললেন, তাহলে একটা দিন না হয় দোকান বন্ধ রেখে গিয়ে ঘুরেই আসি। তবে বিকেল বা সন্ধ্যের দিকেই সেখান থেকে ফিরে আসব”।
সীমন্তিনী স্বাভাবিক গলায় বলল, “ঠিক আছে মেসো, আমারও মনে হচ্ছিল তোমাদের যাওয়া উচিৎ। তবে মেসো আমরা যে অর্চুর সাথে পরির বিয়ে দেবার কথা ভাবছি, এ’ কথাটা ওখানে তোমরা কেউ এখনই প্রকাশ করে দিও না। তাতে একটু অসুবিধে হতে পারে”।
বিধুবাবু বললেন, “তোমার কথার তাৎপর্য আমি বুঝতে পেরেছি মা। আমি নিজেও সে ব্যাপারে একটু চিন্তিত আছি। কিন্তু মা, পরি তো গতকাল পুরোটা দিনই তোমাদের ওখানেই কাটিয়েছে। পরির সাথে তোমরা কি এখনও ও ব্যাপারে কোন কিছু আলোচনা করোনি”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “ইচ্ছে থাকলেও সেটা করবার সুযোগ পাইনি গো মেসো। পরি যে এভাবে হুট করে আমার এখানে আসবে সেটাই তো আমি জানতুম না। আমি যখন অফিসে যাব বলে ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলুম তখনই ও এসে হাজির। তবু ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে একটু দেরীতেই আমি অফিসে গিয়েছিলুম। আবার অফিস থেকে ফিরে অধিকারীবাবুর সাথে আমি আর পরি মিলে একটা মিটিঙে বসেছিলুম। ভেবেছিলুম ও আরও দু’ একটা দিন নিশ্চয়ই এখানে থাকবে। কিন্তু রাতেই ও জানিয়ে দিল যে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও তোমাদের সাথে দেখা করতে যাবে। আর ঠিক সেভাবেই আজ সকালেই তো ও বেরিয়ে গেল। তাই ওর সাথে ওই ব্যাপার নিয়ে কোন কথাই বলতে পারিনি। ওর সাথে তো একা বসে গল্প করবার জন্য সুযোগই পেলুম না। আর সকলের সামনে কি আর এ’সব কথা বলা যায়, বলো”?
বিধুবাবু সীমিন্তিনীর কথা শুনে বললেন, “হ্যাঁ, সে তুমি ঠিকই বলেছ মা। হাতে একটু সময় নিয়ে দু’পক্ষ একসাথে বসবার সুযোগ না পেলে তো আর সে’সব আলোচনা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু জানো মন্তি মা। আজ দুপুরের পর থেকে মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে। ছোটবেলার বন্ধুর ছেলেকে খুঁজে পেয়ে মনটা খুশীতে ভরে উঠেছিল। পরি নিজের পিসির কাছে যাচ্ছে, এটা ভেবেও খুব আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু হিমুদির যে প্রেসার বেড়েছে, এ’কথা আমার জানা ছিল না। বিকেলে রচু আর নিরুদার বড় ছেলে শ্যামলেন্দু ফোন করে জানাল যে নিরুদা আর তার ছেলেরা পরিকে খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেও হিমুদির প্রেসার বেড়েছে বলে তারা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া পরিকে হিমুদির সাথে দেখা করতে দিতে চাইছেন না। হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী হিমুদি এই বয়সে তার মা বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে সহ্য করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে মনটা খুব শঙ্কিত হচ্ছিল। সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ হিমুদি নিজেই ফোনে আমার সাথে কথা বললেন। উনি পরিকে দেখেছেন কিনা, ওনার শরীর ঠিক আছে কিনা, এ’সব জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেলাম না। হিমুদি শুধু বাড়ির সবাইকে নিয়ে কাল সকালেই তার বাড়িতে যাবার আদেশ শুনিয়ে ফোনটা কেটে দিলেন। ওখানে পরির সাথে কে কেমন ব্যবহার করছে, কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। খানিকক্ষণ আগে রচু ফোন করে সব কিছু জানাল। রচুর কাছ থেকে সবকিছু শুনে আগের দুশ্চিন্তাগুলো মন থেকে কেটে গেলেও নতুন করে আরেক দুশ্চিন্তা মনে এসে ঢুকল। হ্যাঁগো মা, আমরা সবাই মিলে যা ভাবছিলুম সেটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেবে তো? তোমার কি মনে হয় মা”?
সীমন্তিনী শান্ত কন্ঠে বলল, “মেসো, এই মূহুর্তে আমাদের সকলের মনেই সেই একই প্রশ্ন। এতদিন তো পরি সবকিছুই আমার আর নীতার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ ও ওর আপন অভিভাবক খুঁজে পেয়েছে। তাই পরিস্থিতি তো অনেকটাই পাল্টে গেল। এখন পরির পিসি পিসেমশাইরাই তো ওর বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর নীতিগত ভাবে তেমনটাই তো হওয়া উচিৎ মেসো। তবে তারা যদি তেমন দায়িত্ব নিতে না চান তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু রচুর মুখে যা শুনলুম তাতে তো মনে হল ও বাড়ির সকলেই পরিকে আপন করে নিয়েছে। তাই ওর বিয়ের ব্যাপারটা তাদের ওপরেই বোধহয় বর্তাবে। আর সেজন্যেই তোমাকে ও’ কথা বললুম। আমরা এতদিন ধরে পরি আর অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে যা কিছু ভেবেছি সে’সব কথা তুমি কালই তাদের জানিও না। কারন, একদিকে আমাদের অর্চু অল্পশিক্ষিতা। অন্যদিকে ও বিবাহিতা এবং বিধবা। পাঁচ পাঁচটা বছর এক মোদো মাতাল স্বামীর সাথে সংসার করেছে। সে মেয়ে যতই রূপবতী আর গুণবতী হোক না কেন, কোনও ছেলের অভিভাবকেরাই এমন মেয়ের সাথে এক কথায় ছেলের বিয়ে দিতে রাজী হবেন না। তবে যে মহিলা আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে নিজের মা বাবার মতের বিরূদ্ধে গিয়ে নিচুজাতের একটা ছেলের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তার সাথে সংসার করতে পারেন, তার ভেতর ধর্মের বা সংস্কারের গোড়ামি কিছুটা হলেও কম হবার কথা। আর অন্য দিক দিয়ে এটাও ভাবা যায় যে পরিকে তো ওনারা আজই পেলেন। তাই এখনই যে ওনারা পরির বিয়ের জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠবেন তা মনে হয় হবে না। তাই আমাদের একটু অপেক্ষা করতেই হবে মেসো। আজই তো আর পরির পিসির কাছে অর্চুর সম্মন্ধ নিয়ে যাওয়া যায় না। আর তাছাড়া সবচেয়ে বড় ব্যাপার অর্চুকে তারা পরির জন্য পছন্দ করবেন কি না। আর কথায় কথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আমার মনে এল। আচ্ছা মেসো, অর্চুর ব্যাপারে পরির পিসো পিসিরা কি কিছু জানেন”?
বিধুবাবু জবাবে বললেন, “অর্চুর ব্যাপারে তারা অনেক কিছুই জানেন রে মা। তোমাকে বোধহয় সে’কথা আগে বলিনি আমি। আসলে এমন একটা দিন যে আমাদের জীবনে আসতে পারে সেটা তো ভাবিনি আগে। তাই সেদিন ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর দিদিকে দেখার কথাটা তোমাকে বলিনি। তবে যেদিন আমি প্রথম দোকানের জন্য থোকে মাল কিনব বলে আলিপুরদুয়ার গিয়েছিলুম সেদিনই তো নিরুদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আর নিরুদা অ', আর একটু কড়া ধাচের মানুষ হলেও মানুষ হিসেবে খুবই ভাল। উনি তো আমাকে দেখার সাথে সাথেই আমাকে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বাদে হিমুদিকে দেখতে পেয়ে আমারও খুব ভাল লেগেছিল। হিমুদিও সেদিন সাংঘাতিক খুশী হয়েছিলেন আমাকে পেয়ে। আমাকে নিয়ে যে তিনি কি করবেন না করবেন তা যেন বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। আমার সেই মূহুর্তে মনে হয়েছিল আমিই বুঝি হিমুদির মায়ের পেটের ছোট ভাই। কিছুক্ষণ মা বাবা ভাইদের কথা উঠিয়ে কান্নাকাটি করে অনেক আদর যত্ন করেছিলেন আমাকে। আমাদের সব খবরাখবর নিচ্ছিলেন। তখন আমাদের সকলের কথাই তাকে বলেছি। তোমার কথাও সেদিন তাকে বলেছিলুম। অর্চুর বিয়ের পর সাতটা বছর শ্বশুর বাড়িতে কত কষ্টে ছিল, আর শেষে ওকে আমরা ফিরে পেলাম কিভাবে, এসব প্রায় সবই বলেছি হিমুদিকে”।