Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 236)

অর্চনা অবাক চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ দিদিভাই? ভাই তোমাকে ফোন করে এ কথা বলল? তার মানে পরিতোষবাবুর পিসি সুস্থ আছেন? তার সাথে তাহলে তো এতক্ষণে নিশ্চয়ই তার দেখা হয়েছে, তাই না দিদিভাই? কিন্তু ভাই তোমাকে পরিতোষবাবুর ব্যাপারে কিছু বলেনি? তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন ......” বলেই হঠাৎ লজ্জা পেয়ে থেমে গেল।
 

ঠিক তখনই লক্ষ্মী দু’হাতে দু’কাপ চা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকে বলল, “দিদিমণি, তুমি তো শুধু চা আনতে বললে। জল খাবার কিছু খাবে না নাকি”?

সীমন্তিনী লক্ষ্মীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল, “আজ অফিস থেকে বেরোবার ঠিক আগেই একটা মিটিং হয়েছে। সেখানে এটা সেটা খেয়েছি গো। তাই এখন আর কিছু খাব না। কিন্তু তোমরা তোমাদের জন্যে কিছু একটা বানিয়ে নাও”।

লক্ষ্মী অর্চনার হাতে চায়ের কাপ দিতে দিতে বলল, “যাক বাবা, এতক্ষণে আমার সোনাদির মুখ গোমড়া ভাবটা দুর হয়েছে। তা সোনাদি, বলো তো তোমার জন্যে কী বানাব? চাউমিন খাবে? না অন্য কিছু”?

অর্চনা লক্ষ্মীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল, “অল্প করে চাউমিনই বানাওগে লক্ষ্মীদি। অন্য কিছু আর খেতে ইচ্ছে করছে না আজ”।

লক্ষ্মী চলে যেতে সীমন্তিনী নিজের কাঁপে একটা চুমুক দিয়ে খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব অর্চু সোনা? সত্যি জবাব দিবি”?

অর্চনা অবাক চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এ কি বলছ দিদিভাই? আমি তোমাকে মিথ্যে বলব, এ কথা তুমি ভাবতে পারলে কী করে গো”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “একদমই ভাবি না। তবু জিজ্ঞেস করলাম। আসলে এমন প্রশ্নও তো তোকে আগে করিনি কখনও”।

অর্চনা এক চুমুক চা খেয়ে সীমন্তিনীর হাতের ওপর একটা হাত রেখে বলল, “এমন কী জিজ্ঞেস করবে তুমি দিদিভাই”?

সীমন্তিনী কিছুক্ষণ অর্চনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবার পর জিজ্ঞেস করল, “পরিকে দেখে তোর কেমন লাগল রে? ভাল লেগেছে”?

অর্চনা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। কিন্তু কিছু বলল না। সীমন্তিনী আবার বলল, “লজ্জা পাস নে বোন। দ্যাখ, আমার আর নীতার কথায় তুই এ বিয়ের ব্যাপারে রাজী হওয়া সত্বেও আমি এখন অব্দি পরির সাথে কিন্তু কোন আলোচনা করিনি। পরি এখনও জানেনা যে তোর সাথেই আমরা ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। আমি অপেক্ষা করছিলুম তুই মন থেকে পরিকে কবে মেনে নিতে পারবি। পরি যে এখানে এভাবে হঠাৎ এসে পড়বে সেটাও আমি জানতুম না। কিন্তু ও আসবার পরে ভেবেছিলুম যে ওর সাথে এবার তোদের বিয়ের ব্যাপারে কথাটা বলব। কিন্তু ও যেমন হুট করে এল, তেমনই হুট করে চলেও গেল। ওর সাথে আলোচনায় বসবার সুযোগটাই হল না। আর তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার ছিল। তুই বারবার বলিস তুই, তোরা সবাই আমার ওপর কৃতজ্ঞ। তাই আমার মনেও একটা ধারণা হয়েছিল যে আমার ওপর সেই কৃতজ্ঞতাবোধ বশতই তুই হয়তো আমার কথার বিরোধিতা করতে না পেরেই এ বিয়েতে মত দিয়ে থাকবি। তাই আমি একটু অপেক্ষা করছিলাম। আমি ভেবেছিলুম তুই একবার আগে পরিকে নিজের চোখে দেখে নে। তারপর আমি তোর মনের ইচ্ছেটা জেনে নিয়ে তবে এ ব্যাপারে এগোব। কিন্তু তোর আর পরির দেখা করাবার সুযোগটাই পাচ্ছিলুম না। পরি তো থাকে কলকাতায়। আর আমরা সবাই ওর কাছ থেকে পাঁচশ কিলোমিটার দুরে। তোদের দেখা করাতে হলে তোকে নিয়ে কলকাতায় যেতে হত। নইলে পরিকে এখানে আনতে হত। কিন্তু কোনটারই সুযোগ খুঁজে পাচ্ছিলুম না। কিন্তু পরি হঠাৎ করে এখানে চলে আসতে আমি মনে মনে খুব খুশী হয়েছিলুম। ভেবেছিলুম ও দুটো দিন থাকলে তুই ওর সাথে কথা বলে ওকে একটু ভাল করে বুঝতে পারবি। ওকে ভাল করে দেখার বা জানার সুযোগ পাবি তুই। তারপর তোর যদি ওকে ভাল লাগে তবেই ওর কাছে কথাটা পাড়বো। কিন্তু ও যে শুধু রাতটুকু কাটিয়েই আজ সকালেই এখান থেকে চলে যাবে, সেটা তো আমি ভাবতেই পারিনি। তাই মনে মনে যেমনটা ভেবেছিলুম তার কিছুই হল না। তা সে যাই হোক, পরি যে তোকে ওই দৃষ্টিতে দেখেনি, তা আমি জানি। কিন্তু তুই তো একটা দিন ওকে দেখলি। কাল তোদের ভেতর কিছু কথাবার্তাও হয়েছে। তাই জিজ্ঞেস করছি, কেমন লাগল ওকে? ভাল লেগেছে”?

অর্চনা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে খুব শান্ত গলায় জবাব দিল, “তোমার প্রশ্নের জবাবে কী বলব তা জানিনে গো দিদিভাই। ঠাকুর কী চাইছেন, তা সত্যিই আমি জানিনে। তবে তোমার ওই বন্ধুকে কি কোন মেয়ের অপছন্দ হতে পারে? সে তো যে কোন মেয়ের কাছে স্বপ্নের রাজপূত্র হতে পারে। আর সত্যি বলছি দিদিভাই, আমি কিন্তু আজ এ’সব নিয়ে একদম ভাবিনি। যখন শুনলুম উনি বাবার ছোটবেলার অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর ছেলে, আর এতদিন নিজেকে অনাথ বলে ভাববার পর আজ সে নিজের রক্তের সম্পর্কের একজনকে খুঁজে পেয়েছে, তখন থেকেই মনে নানা ধরণের চিন্তা হচ্ছে। ওনার বাবার ছোটবেলায় তার ঠাকুর্দা ঠাকুমা আর বাবা যার সাথে নিজেদের রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করেছিলেন, নিজের পছন্দের নিচু জাতের একটা ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই যে মেয়েটাকে তার মা বাবা ভাই চিরতরে পরিত্যাগ করেছিলেন, সেই মহিলা কি সত্যিই ওনাকে নিজের ভাইপো বলে কাছে টেনে নেবেন? আর যদি উনি সেটা না করেন, যদি তারা তাকে অপমান করে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন, তাহলে পরিতোষবাবু কত বড় একটা আঘাতই না পাবেন। যতটা আশা নিয়ে উনি সেখানে গেছেন, বিফল হলে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী আঘাত পাবেন উনি। সে আঘাতটা তিনি সইতে পারবেন দিদিভাই? তার পাশে যে আর কেউ নেই। তার কাঁধে স্নেহের হাত রাখবার মত কেউ তো নেই। দুপুরের পর থেকে তো শুধু এই চিন্তাই হচ্ছে আমার। কেউ আমাকে ফোন করেনি দিদিভাই। আমিই বিকেলে ভাইকে ফোন করে এ’সব জেনেছি। ভাইই বলল যে উনি আমাদের বাবার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে। আমি চোখে না দেখলেও বাবার মুখে তার বন্ধু দুর্গাদাস কাকুর কথা কিছু কিছু শুনেছি। কিন্তু তোমার এই বন্ধুই যে আমাদের ওই দুর্গাকাকুর ছেলে এ তো আর আমি জানতুম না। তোমার বন্ধুও হয়ত এতদিন এ ব্যাপারটা জানতেন না। রচু, রতুদা আর তোমার সাথে তার পরিচয় থাকলেও তোমাদের কারো মুখেই বোধহয় বাবার নামটা তিনি শোনেন নি এতদিন। গতকাল আমরা যখন কথা বলছিলুম তখন কথায় বাবার নামটা উঠেছিল। তখন তার চোখ মুখ দেখে মনে হয়েছিল তিনি বুঝি তার স্মৃতিতে কিছু একটা খুঁজছিলেন। তখন উনি সেটা আমার কাছে সেভাবে প্রকাশ না করলেও আমার কাছ থেকে বাবার সম্বন্ধে জেনে নিয়ে আনমনেই ‘কালচিনি.. বিধুভূষন.. বিধু .. পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন বছর’ এ শব্দগুলো আউড়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমিও তেমন কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু দিদিভাই, এখন আমার মনে হচ্ছে বাবার নাম শোনবার পরেই তিনি কালচিনি যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন মনে মনে। অবশ্য আমার ফোনেই রচুও তাকে কালচিনি গিয়ে মা-বাবার সাথে দেখা করবার অনুরোধ করেছিল। দুপুরে বাবার সাথে গল্প করবার সময়েই বাবা বুঝতে পারেন যে পরিতোষবাবুই তার ছোটবেলার প্রিয়বন্ধু দুর্গাদাস সান্যালের ছেলে। তোমার বন্ধুও উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে আমাদের বাবাই তার বাবার ছোটবেলার বন্ধু। তখনই কথায় কথায় বাবার কাছ থেকেই উনি জানতে পেরেছেন যে আলিপুরদুয়ারে তার পিসি আছেন। আর সেটা শুনেই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেন নি। বাবা তাকে বলেছিলেন যে কাল সকালে তিনি নিজে তাকে নিয়ে তার পিসির বাড়িতে যাবেন। কিন্তু তার তর সয়নি। বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার কাছ থেকে তাদের ঠিকানা জেনে নিয়ে একাই চলে গেছেন তার পিসিকে খুঁজতে। তাহলে তার মানসিক অবস্থাটা তখন ওই মূহুর্তে ঠিক কেমন ছিল, তা তো আন্দাজ করতেই পারছ দিদিভাই। বানভাসি একটা পিঁপড়ে যেমন সামান্য একটা খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, পরিতোষবাবুর অবস্থাটা তো প্রায় তাইই ছিল ওই সময়ে। যে নিজেকে একেবারে অনাথ ভেবে ভেবে অভ্যস্ত সে যদি জানতে পারে তার রক্তের সম্পর্কের এক পিসি এখনও বেঁচে আছেন, তাহলে মনে মনে সে কতটা উতলা হয়ে উঠতে পারে সেই পিসিকে দেখবার জন্য সেটা অন্য যে কারো চাইতে আমি খুব ভালভাবে জানি দিদিভাই। আমিও তো সাত সাতটা বছর মা বাবা ভাই বোনকে ছেড়ে দুরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলুম। প্রায় একটা অনাথের মতই। তাই জানি, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে চোখে দেখবার আশা কতটা প্রবল হতে পারে। কিন্তু সেই পিসিই যদি তার পরিচয় জানবার পর তাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দেন, তাহলে তিনি সইতে পারবেন দিদিভাই”?

সীমন্তিনী অর্চনার হাতের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে খুব মোলায়েম গলায় বলল, “আমি যে জিনিসটার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম, সেটা পেয়ে গেলুম তাহলে। মনে মনে তোর তাহলে পরিকে ভাল লেগেছে। কিরে? ঠিক বলছি তো”?

অর্চনা কিছু না বলে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত লজ্জায় নুয়ে পড়া অর্চনার দিকে তাকিয়ে থাকবার পর তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “এতে এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন বোন। আমি তো চাই সারাটা জীবন তুই যেন সুখে কাটাতে পারিস। আমরা তো তোকে আগেও বলেছি, আমি আর নীতা দু’জনেই পরিকে খুব ভালভাবে জানি। ও যে কতটা ভাল সেটা যারা ওকে জানে চেনে, তারা সকলেই জানে। আর তুই নিজেও এটুকু জীবনে এত কষ্ট পেয়েছিস, যেটা তোর কোন ভাবেই প্রাপ্য ছিল না। তাই যেদিন আমি প্রথম তোকে কালচিনি হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় বেডে শুয়ে থাকতে দেখেছিলুম, তখনই মনে মনে ভেবেছিলুম তোর জীবনটাকে সুন্দর করে তোলবার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব”।
 

বলে একটু থেমে দম নিয়ে আবার বলল, “তোদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমরা সকলে মিলে কিভাবে প্ল্যান বা চিন্তা ভাবনা করেছিলুম, তুই তো তার কিছুই জানিস না। আসলে আমরা সবাই আগে থেকেই অমন ভাবেই প্ল্যান করেছিলুম যে আগেই তোকে পরির ব্যাপারে কিছু জানাব না। আর সবচেয়ে প্রথমে তোকে আর মাসি মেসোকে রাজী করাতে হবে এ বিয়ের ব্যাপারে। আমি যখন কলকাতায় গিয়ে নীতার সাথে পরিচিত হলাম, নীতার সব কথা শুনলুম, তখনই আমার মনে হয়েছিল তুই, মাসি মেসো আর রচু রাজী হলে পরির সাথেই তোর বিয়ে দেব। ওর মত ছেলে লাখেও একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওর সাথে তোর বিয়ে হলে তুই যে সুখী হবিই, এ ব্যাপারে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও নেই। আর সেদিন রচুর কথায় পরি নিজেও আমার আর নীতার ওপরেই তার জন্যে মেয়ে পছন্দ করবার দায়িত্ব দিয়েছিল। তারপর তোকে এখানে নিয়ে আসবার পর নীতাও পরির জন্য তোকেই পছন্দ করল। তারপরে যেটা করেছিলুম সেটা তুই জানিস। তুইও যে এক কথাতেই আবার বিয়ে করতে রাজী হবি না, এটা আমি জানতুমই। তোকে কিভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোর মত নিয়েছিলুম আমরা সে তুই জানিসই। তবে তারপরের কথাগুলো তোকে জানাইনি আমরা। আমি প্রথমে রচু আর দাদাভাইয়ের সাথে, আর পরে কালচিনি গিয়ে মাসি মেসো আর ভাইয়ের সাথে আলোচনা করেছি তোদের বিয়ের ব্যাপারে। রচু তো আমার কথা শুনেই নাচতে শুরু করে দিয়েছিল। দাদাভাইও এক কথায় রাজী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাসি আর মেসো প্রথমে একটু দোনামনা করছিলেন। বলছিলেন ', ঘরের বিধবা মেয়ের দ্বিতীয়বার বিয়ে দিলে সমাজের চোখে তারা ছোট হয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই কিন্তু আমায় প্রথম থেকেই সাপোর্ট করেছিল। মাসি মেসোকে রাজী করাতে আমার খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। তারপর তোর নামের উল্লেখ না করে পরির কাছে জানতে চাইলাম যে স্বামীর সাথে পাঁচ বছর সংসার করা একটা মাধ্যমিক পাশ বিধবা ', মেয়েকে আমি আর নীতা তার জন্যে পছন্দ করেছি। সে বিয়ে করতে রাজী আছে কি না। পরিতোষ শুধু তার আগের কথার পুনরাবৃত্তি করেই জানিয়ে দিয়েছিল যে আমার আর নীতার পছন্দই শেষ কথা। আমাদের পছন্দ হলে সে নিশ্চিন্তে সে মেয়েকে বিয়ে করবে। তাই তার পর থেকেই আমরা সকলেই নিশ্চিন্ত আছি যে পরির সাথেই তোর বিয়েটা হচ্ছে। এদিকে আবার কালচিনিতে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হল। আবার ভাইয়ের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। এ’সব বিচার করে পাঁজি দেখে বিয়ের দিনও মোটামুটিভাবে একটা স্থির করা হয়ে গেছে। কিন্তু ভেবে দেখলুম যে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি বানানো হলেও ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখের আগে বাড়িতে গৃহপ্রবেশ করা যাবে না। কিন্তু বিয়ের জন্য আমরা যে দিনটা ভেবেছি সেটা নভেম্বর মাসে পড়ছে। তাই কালচিনি বাড়িতে ওই সময়ে বিয়ের আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই সেদিন যখন রাজগঞ্জ গিয়েছিলুম, তখন জেঠু, বাবা কাকুদের সাথে আলোচনা করেছিলুম আমি। ও বাড়ির সকলেই রাজগঞ্জের বাড়িতে তোর বিয়ের আয়োজন করতে খুব আগ্রহী। আর তারাও সবাই তোর এ বিয়েতে খুব খুশী হয়েছেন। জেঠু নিজেই তোর বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিতে রাজী আছেন। রচু এ’সব ঘটণা জানে। তবে ওকে আর তোদের কালচিনির বাড়ির সবাইকেও আমি বলে রেখেছিলুম যে আগেই যেন তোর কাছে এ’সব কথা তারা কেউ প্রকাশ না করেন। কিন্তু বিয়ের দিনক্ষণ আর আয়োজনের ব্যাপারে এখনও মাসি মেসোর সাথে সেভাবে কথা বলার সুযোগ পাইনি আমি। তবে ওই যে বললুম, একটা জিনিসের অপেক্ষা করছিলুম আমি মনে মনে। সেটা হচ্ছে পরিকে দেখে তুই মন থেকে ওকে মেনে নিতে পারিস কি না। আজ যখন ঘটণাচক্রে পরি এভাবে হঠাৎ করে এখানে এল, আর এই মূহুর্তে যখন তোর মনের ইচ্ছেটা আমি বুঝতে পারলুম, তখন আর কোন বাধা রইল না। কিন্তু আজ কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে একটা বাধা আসতে পারে। আমার মনে হচ্ছে ......”

সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “কিসের বাধা দিদিভাই”?

সীমন্তিনী আগের মতই অর্চনার হাতের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আমার মন বলছে পরির পিসিই বোধহয় এখন ওর বিয়ে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবেন। তাই বলছি বোন, পরিকে তোর ভাল লেগেছে সে তো খুবই ভাল কথা। আমাদের আত্মীয় স্বজন সকলেই এ বিয়েতে রাজী। এমনকি তুই আর পরিও। তাই আজ সকাল অব্দি আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলুম। কিন্তু আজ সারাটা দিনে অপ্রত্যাশিত ভাবে যা কিছু ঘটে চলছে, সে সব ব্যাপার আমাকে একটু ভাবিয়েই তুলছে। তাই তোকে এখন একটা কথা বলছি। সম্ভব হলে কথাটা রাখিস বোন”।

অর্চনা অভিমানী কন্ঠে সীমন্তিনীর একটা হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আবার তুমি ও’সব কথাই শুরু করলে দিদিভাই? তোমার কথা যে আমার কাছে ঈশ্বরের আদেশের চেয়েও ওপরে”।

সীমন্তিনী ম্লান হেসে অর্চনার চিবুক ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কথাটা বলতে আমারও একদম ভাল লাগছে নারে সোনা। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারন তুই আর রচু, তোদের দু’বোনের যত গুণই থাকুক না কেন, তোরা দু’জনেই খুব ভাবপ্রবণ। সময়ে সময়েই তোরা দু’জনেই মনের আবেগে ভেসে যাস। মনের লাগাম টেনে ধরতে জানিস না তোরা। বাস্তব অনেক সময়ই বড্ড নির্মম, বড় কঠিন হয়ে থাকে। তাই কখনো কখনো মনের বিরূদ্ধে গিয়েও তাকে স্বীকার করে নিতেই হয়। অনেক নির্মমতার বিরূদ্ধে সব সময় বিরোধিতা করা যায় না। বিবেক, মন না চাইলেও মাথা নিচু করে মুখ বুজে সেই কঠিন বাস্তবকে স্বীকার করে নিতে হয়। রচু তবু গত কয়েকটা মাসে অনেকটা পরিণত হয়েছে এ ব্যাপারে। কিন্তু তুই কিন্ত রচুর থেকে বয়সে বড় হলেও সে জিনিসটা এখনও রপ্ত করতে শিখিস নি। তাই আমাকেই মুখ ফুটে এ’কথা বলতে হচ্ছে আজ। তুই আমাকে কিন্তু ভুল বুঝিস না বোন। তবে এখনই পরিকে নিয়ে মনে মনে কোন স্বপ্ন সাজাতে শুরু করিস না সোনা। স্বপ্ন ভেঙে গেলে খুব কষ্ট হয় রে। আর তুই তো জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছিস। নতুন করে দেখা এই স্বপ্নটা ভেঙে গেলে আরেকটা বড় আঘাত পাবি মনে। অবশ্য আলিপুরদুয়ারে ঠিক কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সম্বন্ধে এখনও তো কিছুই জানিনা। তবে ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন, সব কিছুর জন্যেই আমাদের তৈরী থাকতে হবে। তাই বলছি বোন, পরিকে নিয়ে মনে মনে কোনও স্বপ্ন সাজাবার আগে আলিপুরদুয়ারের ব্যাপারটা পরিস্কার হতে দে। আমার মনে হয় কয়েকটা দিনের ভেতরেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। তবে এই একটু আগে পরিকে নিয়ে তুই যে’সব কথা ভাবছিলিস, আমার মনে হয় সেখানে এমন কিছু হবে না যাতে পরি কষ্ট পায়। পরির পিসেমশাই আর তিন পিসতুতো দাদা পরিকে খুব আদর আপ্যায়ন করেছে, এ’ খবর আমি আগেই পেয়েছি। তবে ওর পিসির সাথে ওর দেখা হয়েছে কিনা সেটা এখনও বুঝতে পারিনি। ওর পিসির হাই ব্লাড প্রেসার বলে সবাই একটু চিন্তায় ছিল। সে হয়ত তার মা, বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ সহ্য করতে পারবে না। তাই আগে থেকেই ডাক্তার ডেকে আনা হয়েছিল। এ খবর পেয়েছি বিকেল প্রায় সাড়ে চারটেয়। কিন্তু তারপর থেকে কয়েকবার পরিকে ফোন করেও পাইনি। ও কেন জানিনা ওর দুটো ফোনই সুইচড অফ করে রেখেছে। তাই বিকেলের পর থেকে আমার উদ্বেগ আরও বাড়ছিল। কিন্তু অফিস থেকে ফেরবার সময়েই ভাইয়ের একটা ফোন পেলাম। সে জানালো সন্ধ্যের কিছু পড়েই নাকি পরির পিসি ভাইয়ের ফোনে ফোন করে মেসোর সাথে কথা বলেছেন। আর তিনি মেসোকে আগামীকাল সকালেই মাসি আর ভাইকে সাথে নিয়ে আপিলুরদুয়ারে তাদের বাড়িতে যেতে হুকুম করেছেন। ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে পরির পিসির সাথে পরির দেখা হয়েছে কি না, বা পরির সম্বন্ধে কোন কথা বলেছেন কিনা। ভাই জানাল যে তিনি অন্য কোন ব্যাপারেই আর কিছু বলেননি মেসোকে। বারবার শুধু মেসোদের সবাইকে তাদের বাড়ি যাবার কথাই বলেছেন। আর শুনলুম মেসোও সেখানে যাবে বলেই ভেবেছেন। ভাইয়ের ফোন পাবার পর একটা ব্যাপারে তো নিশ্চিত হলাম যে পরির পিসি সুস্থই আছেন। আর ডাক্তার যখন ও বাড়িতে বিকেল বেলায় এসেছিলেন, তাতে মনে হয় এতক্ষণে পরি নিশ্চয়ই তার পিসিকে দেখেছে। রচুর সাথে যখন সন্ধ্যার আগে আমার কথা হল, তখন রচু বলেছিল যে আমাকে ফোন করবার একটু আগেই পরির সাথে ওর কথা হয়েছিল। আর তখনই পরি পিসির সাথে দেখা করবার জন্য বাড়ির ভেতর যাচ্ছিল। তাই এটা ধরেই নেওয়া যায় যে এতক্ষণে তাদের পিসি ভাইপোর মিলন নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। আর ভদ্রমহিলা যে সুস্থ আছেন সেটা ভাইয়ের ফোনে পেয়েই জানলুম। তবে পরি নিজে কেন যে একটাও ফোন করছে না সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অনেক সম্ভাবনাই মনে আসছে। তবে সেগুলো নিছকই আমার অনুমান। তবে তারপর থেকে রচুর সাথেও আমার কথা হয়নি। দাদাভাইয়ের সাথে একবার কথা হয়েছে তারপর। তার মুখেই শুনলুম আমার সাথে কথা বলবার পরেই রচু নাকি ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছে। পরির পিসির যেন কোন বিপদ না হয়, পিসি যেন পরিকে আপন ভেবে কাছে টেনে নেন। আমার মনে হয় রচু ঠাকুরের কাছে এ’সব প্রার্থনাই করছে। আর দাদাভাই এটাও বলল যে পিসির সাথে দেখা হবার পর পরি প্রথম ফোন করবে রচুকেই। ও রচুকে সে কথা দিয়েছে। আর আমি নিশ্চিত পরির ফোন পেয়েই রচু আমাকে ফোন করবেই করবে। তাই, তুই যেমনটা ভাবছিলিস তেমন ভয়ের কিছু নেই। আমি নিশ্চিত, পরির পিসি পরিকে দেখবার পরে তাকে নিশ্চয়ই কাছে টেনে নিয়েছেন, আর তিনি এখনও সুস্থই আছেন। ও নিয়ে তুই আর ভাবিস নে বোন। আমি তো শুধু এখন রচুর ফোনের অপেক্ষায় আছি। ওর ফোন পেলেই এখন সবকিছু জানতে পারব”।

অর্চনা কিছুটা শান্ত হলেও তখনও খানিকটা উদ্বেগ মাখা স্বরে বলল, “তুমি সত্যি বলছ দিদিভাই। ভাই আর রচুর কাছ থেকে তুমি এ’সব জানতে পেরেছ? কিন্তু তোমাদের বন্ধু তোমাকে বা নীতাদিকে একটাও ফোন করে কিছু জানাতে পারলেন না কেন? এর পেছনে কী কারন থাকতে পারে গো”?
 

সীমন্তিনী এবার অনেকটা সহজ ভাবে বলল, “আরে বাবা, এটা নিয়ে তুই এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেনরে বোকা মেয়ে। আরে ওখানে গিয়ে বাড়িতে ঢোকবার আগেই ও প্রথমে ওর পিসেমশাইকে পেয়েছে। তারপর তিন তিনটে দাদাকে পেয়েছে। আর এনারা সকলেই পরিতোষকে ভীষণভাবে কাছে টেনে নিয়েছে। তারপর বাড়ির ভেতর ঢুকে নিশ্চয়ই তিন তিনটে বৌদিও পেয়েছে। কারন ওর দাদারা সকলেই ওর থেকে বয়সে অনেক বড়। তারা সকলেই নিশ্চয়ই বিয়ে থা করেছেন। তাদের সকলেরই হয়ত একটা বা দু’ তিনটে বাচ্চা কাচ্চাও আছে। পরি হয়ত পাঁচ ছ’টা ভাইপো ভাইঝিও পেয়েছে বাড়িতে ঢোকবার পর। পরি যতই শক্ত নার্ভের হোক না কেন যতই প্র্যাক্টিকাল হোক না কেন, আজ সকাল অব্দি যে জানত যে তার এ পৃথিবীতে নিজের রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই, সে যদি হঠাৎ করে এত আত্মীয় স্বজনের মাঝে গিয়ে পড়ে, তাহলে কতক্ষণ নিজের নার্ভ শক্ত রাখতে পারবে বল তো। পরির চোখে আমরা কখনও সুখ বা দুঃখ কোনরকম আবেগের অশ্রু দেখিনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমি যেমনটা ভাবছি, আলিপুরদুয়ারের সকলে যদি সেভাবেই পরিকে আদর আপ্যায়ন করে থাকে, তাহলে ও আজ কিছুতেই না কেঁদে থাকতে পারবে না। তবে যদি শুনি ও সত্যিই কেঁদেছে বা এখনও কাঁদছে, তাতে আমি কিন্তু দুঃখ পাব না। বরং আমার আনন্দই হবে। ওর বুকের ভেতর এতগুলো বছরের যে নিঃসঙ্গতার কান্না জমে ছিল তার সবটা আজ চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসবে। ওর বুকের ভেতরের পাষানের বোঝাটা আজ হাল্কা হয়ে যাবে। কিছু সময়ের জন্য ও হয়ত নিজেকেও ভুলে যাবে। আমার মনে হয় সেটাই হয়েছে। ওকে ফোনে পাচ্ছিলুম না বলে আমারও বেশ রাগ হচ্ছিল। কিন্তু রচু আর ভাইয়ের সাথে কথা বলবার পর আমি নিজেকে এভাবেই বুঝিয়েছি। আর মনে হয়, সেটাই সত্যি। তাই তুই নিজের মন থেকে ওই দুর্ভাবনাটাকে এবার বিদায় দে বোন। পরি আর ওর পিসি দু’জনেই নিশ্চয়ই ভাল আছেন। আর দেখিস ওই ভিড়ভাট্টা ডামাডোলের ভেতর ও হয়ত ফোন করে উঠতে পাচ্ছে না। তবে রাতে শোবার আগে হলেও ও নিশ্চয়ই আমাদের ফোন করবে। তুই একদম ভাবিস নে”।


(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 29-03-2020, 11:25 AM



Users browsing this thread: 7 Guest(s)