29-03-2020, 12:23 AM
(Update No. 235)
রচনা বিস্মিত গলায় জবাব দিল, “এ কী বলছ পিসি তুমি? তুমি ফোন করলে আমি বিরক্ত হব কেন? তুমি তো জানোনা পিসি, আমার শ্বশুরবাড়িতে বাড়ি ভর্তি লোকজন। তাদের সবাইকে ছেড়ে স্বামীর সাথে এখানে চলে আসতে হয়েছে। এখানে আসবার পর বাড়ির সকলকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিনা বলে মনটা খুব ছটফট করে। তাই তো যখন তখন এর ওর সাথে ফোনে কথা বলি। আর তুমি তো আমার নতুন পিসি। এতদিন পিসি বলে ডাকবার মত কেউ আমাদের জীবনে ছিল না। আজ থেকে তোমায় পেলাম। তুমি ফোন করলে আমি তো খুশীই হব। কিন্তু পিসি ইশ, আমি তো তোমার অনুমতি না নিয়েই প্রথম থেকেই তোমাকে ‘তুমি তুমি’ করে বলছি। এতে তুমি রাগ করোনি তো”?
হৈমবতীদেবী হেসে বললেন, “শোনো পাগলী মেয়ের কথা। যে মেয়েটা আমাকে জীবনে চোখেই দেখেনি, যে আমার সুস্থতা কামনা করে এক দেড় ঘন্টা ধরে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে পারে, সে আমাকে তুমি করে বলছে বলে আমি রাগ করব? তোকে আমি বলে বোঝাতে পারবনা রে মা যে আজ আমি কত খুশী। আজ শুধু আমার ভাইপো নয় তার সাথে সাথে তোর মত এমন একটা মিষ্টি মেয়েও তো পেলুম। আবার আমার একটা ভাই যাকে ‘মা অন্নপূর্ণা’ বলে ডাকে তার কথাও জানতে পারলুম। তবে এই মূহুর্তে এত খুশীর মধ্যেও মনে একটা দুঃখও হচ্ছে। ভগবান আমাকে দুটো ডানা কেন দিলেন না। তাহলে এই মূহুর্তে আমি উড়ে গিয়ে তোর সাথে আর তোর সেই দিদিভাইয়ের সাথে দেখা করতুম। তবে তুই হয়ত নিশ্চয়ই ভাবছিস যে বুড়ীটা তো খুব বকবক করতে পারে। তুই তো আবার কাকে কাকে যেন ফোন করে তোর পরিদার কথা বলবি বললি। তাই এখন রাখছিরে মা। রাতে আমার ফোন থেকে তোকে ফোন করব, তখন আরও কথা হবে। অবশ্য তুই যদি বিরক্ত না হোস। তবে এখন আর তোকে জ্বালাচ্ছি না। তোর বরের নাম তো শুনলুম রতু। রতু আর রচু। বাঃ বেশ মানিয়েছে। তোদের দু’জনের জন্য আমার অনেক অনেক ভালবাসা আর শুভেচ্ছা রইল। ভাল থাকিস মা”।
রচনা এবার বলল, “আচ্ছা পিসি, পরিদার সাথে আরেকটু কথা বলব আমি। ফোনটা একটু ওনাকে দাও না”।
“হ্যাঁ মা দিচ্ছি” বলে হৈমবতীদেবী পরিতোষের হাতে ফোন দিলেন।
প্রায় আধঘণ্টা ধরে রচনার প্রশ্নের জবাবে পরিতোষকে সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে হল। তারপর কথা শেষ করে ফোন পকেটে রাখতে না রাখতেই হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁরে পরিতোষ, মন্তি কি তোর শুধুই বন্ধু? না ওর সাথে তোর অন্য কোনও সম্পর্ক আছে? আর নীতা নামের মেয়েটা কে রে? সে-ও কি তোর বন্ধু? না আর কিছু”?
পরিতোষ পিসিকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তার পায়ের কাছে বসে তার কোলে মাথা চেপে ধরে বলল, “মন্তি আর নীতার সম্বন্ধে সব কিছু তোমাদের বলতে গেলে আজকের পুরো রাতেও সে’সব কথা শেষ হবে না পিসি। ওদের দু’জনকে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে দুটো ফিল্ম বানিয়ে ফেলা যায়। আজ এতদিন বাদে তোমাকে যখন পেয়েছি, তখন ধীরে ধীরে সব কিছুই তোমাদের বলব পিসি। তবে এখন তোমার প্রশ্নের জবাবে শুধু এটুকুই বলছি, ওরা দু’জন দু’রকম ভাবে দু’জন পুরুষকে ভালবাসে। কিন্তু ওরা ওদের ভালবাসার পাত্রের সাথে কোনদিন ঘর করবে না বা বলতে পারো করা সম্ভবই নয়। ওদের ভালবাসার কথা, ওদের জীবনের সব কথা আমি জানি। ওরা দু’জনেই কোনদিনই তাদের ভালবাসার পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না জেনেও নিজেদের ভালবাসার পাত্রদেরই নিজেদের স্বামী বলে ভাবে। আজীবন সমাজের চোখে ওরা অবিবাহিতাই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য ওদের জীবনের সেইসব কথা শুনলে অনেকেই হয়ত ছিঃ ছিঃ করবে। কিন্তু পিসি আমি কিন্তু ওদের ভালবাসাকে শ্রদ্ধাই করি। আর আমি তো তোমাকে আগেও বলেছি পিসি, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসতে পারে তাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি। ওই মেয়েদুটোও তাই। তবে তোমার মত নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে যাবার সাধ্য বা সুযোগ কোনটাই ওদের ছিল না। আর এই শ্রদ্ধার বশেই ওদেরকে আমি বন্ধু বলে ভাবি। আপাততঃ এর বেশী কিছু আমি বলছি না। ওরা দু’জনেই আমার খুব ভাল বন্ধু। তবে আজ যে আমি তোমাকে পেলাম, সেটা ওই মন্তির জন্যেই সম্ভব হল। মন্তির কাছে না এলে তোমার হদিশই পেতাম না আমি। তাই একা তুমি শুধু নও, আমিও মন্তির কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব পিসি। ও আমার যা উপকার করল আজ, সে উপকারের বিনিময়ে কোন কিছুই যথেষ্ট নয়। ওকে ধন্যবাদ দিয়েও আমি ছোট করতে পারব না। শুধু ভগবানের কাছে ওর জন্য প্রার্থনাই করে যাব, ভগবান যেন ওকে শান্তিতে রাখেন” বলে একটু থেমে হৈমবতীদেবীর কোল থেকে মাথা তুলে আবার বলল, “কিন্তু পিসি, আমাকে একটু সময়ের জন্য বাইরে যেতে দাও না গো। মন্তিকে, নীতাকে আর বিধুকাকুকে তো রচুই ফোন করে সবকিছু জানিয়ে দেবে। কিন্তু মালবাজারে আর কলকাতায় দুটো জরুরী ফোন করতে হবে আমার অফিসিয়াল ব্যাপারে। আমার তো কালই মালবাজার যাবার কথা ছিল। আর কলকাতা অফিসেও পরশুই আমার কাজে যোগ দেবার কথা ছিল। কিন্তু তুমি তো আমাকে আটকে দিলে। তাই ওদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানিয়ে দেওয়াটা খুব দরকার। আর বুঝতেই তো পারছ, এ’সব পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। সকলের সামনে এ’সব অফিসিয়াল ব্যাপার নিয়ে কথা বলা যায় না। তোমরা কেউ ব্যাপারটাকে অন্যভাবে নিও না প্লীজ। আমি দুরে কোথাও যাব না। দোকানের পাশে দাঁড়িয়েই তাদের সাথে কথা বলব। প্লীজ পিসি”।
হৈমবতীদেবী পরিতোষের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আচ্ছা বেশ, যা। তবে দোকান থেকে বেশী দুরে কোথাও যাসনে বাবা। তোকে যে সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে পেতে ইচ্ছে করছে আজ। যা। ফোন সেরে আয়। তবে তাড়াতাড়ি ঘুরে আসিস বাবা”।
পরিতোষ হৈমবতীর একটা হাত নিজের দু’হাতে ধরে বলল, “ঠিক আছে পিসি। আমি পনের মিনিটের মধ্যেই তোমার কাছে ফিরে আসছি” বলে অন্যান্য সোফায় বসে থাকা তিন বৌদির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে চোখের ঈশারায় সম্মতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
******************
দুপুরের পর থেকেই সীমন্তিনীর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। সকালে অফিসে আসবার পথে পরিতোষের কালচিনি পৌঁছে যাবার কথা শুনে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল। আজ লাঞ্চ করতে তার একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ লাঞ্চ খেতে খেতে সে রচনাকে ফোন করেছিল। তখনই জানতে পারল যে পরিতোষ বিধুবাবুর ছোট বেলার বন্ধুর ছেলে। বিধুবাবুর কাছে তার নিজের পিসি বেঁচে আছেন, আর আলিপুরদুয়ারে আছেন, এ’কথা শুনেই নাকি পরিতোষ দুপুর আড়াইটের ট্রেনে কালচিনি থেকে আলিপুরদুয়ার চলে গেছে। আর ঠিক তখন থেকেই সীমন্তিনীর মনের উদ্বেগ বেড়ে চলছিল। তার কয়েক মিনিট বাদেই পরিতোষের পাঠানো এসএমএসটাও পেয়েছিল। কিন্তু ভেতরের উদ্বেগটা তাতেও কাটেনি। নিজের উদ্বেগ সামলাতে না পেরে বিকেলের দিকে নিজের কেবিনে বসেই সে পরিতোষকে ফোন করেছিল। কিন্তু মনে হল পরিতোষ কলটা রিজেক্ট করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়বার ফোন করেও একই ফল হয়েছিল। তখন সে ভেবেছিল যে কোন কারণেই হোক পরিতোষ এই মূহুর্তে তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। তারপর একে একে কালচিনিতে, রচনার কাছে আর নবনীতার কাছে বারে বারে ফোন করেও কোনও খবর না পেয়ে তার উদ্বেগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করেছিল। অবশেষে বেলা চারটে নাগাদ রচনা ফোন করে তাকে জানাল যে পরিতোষ তার পিসির বাড়িতে পৌঁছে গেছে ঠিকই। কিন্তু তার পিসির শারীরিক অসুস্থতার জন্যেই তখনও সে পিসির কাছে যায়নি। তবে পিসির বাড়ির লোকজনেরা পরিতোষকে পেয়ে খুব খুশী হলেও সকলেই আশঙ্কায় আছেন যে পরিতোষের মা বাবা দাদু ঠাকুমার মৃত্যু সংবাদ শুনে হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী তার পিসির হয়তো কোন বিপদ আপদ হতে পারে। তাই তারা আগে থেকেই তাদের পারিবারিক ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন। আর ওই ডাক্তার ভদ্রলোক নাকি সব কিছু সামলে নেবেন বলে তাদের সকলকে আশ্বস্ত করে ওপরের তলায় পরিতোষের পিসির কাছে চলে গেছেন। আর সেই সময়েই নাকি রচনা পরিতোষকে ফোন করেছিল। তখন পরিতোষই নাকি এ’সব কথা তাকে বলেছে। রচনার কাছ থেকে এ খবর শোনবার পর এক দিক থেকে তার মনের উদ্বেগ কিছুটা কমেছিল। পরিতোষকে যে তার পিসেমশাই আর পিসতুতো দাদারা ভাল ভাবে গ্রহণ করেছে এটা জেনে। কিন্তু পরিতোষের পিসির শারীরিক অবস্থার কথা শুনে আরেকটা নতুন উদ্বেগ তাকে ঘিরে ধরেছিল। তখন থেকেই মনে মনে সে ঠাকুরকে ডাকছিল বারবার। এত বছর বাদে জীবনে প্রথমবার নিজের পিসির কাছে গিয়েও তার সাথে দেখা না করেই পরিতোষকে যেন ফিরে আসতে না হয়। ভগবানের কাছে এ প্রার্থনাই করছিল সে। কিন্তু যত সময় কাটছিল, মনের উদ্বেগও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। সন্ধ্যের দিকে থাকতে না পেরে সে আবার পরিতোষকে ফোন করল। কিন্তু ফোন সুইচড অফ। রচনাকে ফোন করতে ফোন ধরল রতীশ। রতীশ জানাল যে রচনা বিকেলে পরিতোষ আর তার সাথে কথা বলবার পরেই ঠাকুর ঘরে গিয়ে পরিতোষের মনস্কামনা পূর্ণ করবার জন্যে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। এ’কথা শুনে এত উদ্বেগের মাঝেও রচনার প্রতি তার মন কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। কিন্তু তার মনের দুশ্চিন্তা যেন আর কিছুতেই কমছিল না।
অফিসের কাজ সেরে বেরোতেও একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল তার। বাড়ি ফেরবার পথে রতীশকে আরেকবার ফোন করে জানতে পারল যে এখনও কোন খবর পায়নি ওরা। রচনা তখনও ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেই যাচ্ছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সীমন্তিনীর হাতের মোবাইল বেজে উঠল। কিংশুকের ফোন দেখে সাথে সাথে কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ ভাই, বলো কি খবর”?
কিংশুক সাথে সাথে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “দিদিভাই, এইমাত্র আলিপুরদুয়ার থেকে পরিদার পিসিমা বাবাকে ফোন করেছিলেন। আর তিনি আমাদের সকলকেই কাল সকালে তাদের ওখানে যেতে বলেছেন”।
সীমন্তিনী মনে মনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তিনি তোমাদের সবাইকে আলিপুরদুয়ারে ডেকে পাঠিয়েছেন”?
কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই। আমার কাল কলেজ আছে, বড়দি তোমার ওখানে, এ’সব শুনে বললেন যে বড়দি যখন বাড়িতে নেই তাহলে তাকে বাদ দিয়েই আমি একদিনের জন্য কলেজ কামাই করেও যেন মা বাবার সাথে তাদের ওখানে যাই। কিন্তু অবশ্যই যেতে হবে সেখানে”।
সীমন্তিনী মনে মনে ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে বলল, “কিন্তু তোমাদের সবাইকে এভাবে কেন ডাকলেন উনি? আর পরিতোষের সাথে তার পিসির দেখা হয়েছে কি না, এ’সব ব্যাপারে কিছু বললেন উনি”?
কিংশুক জবাবে বলল, “না দিদিভাই, আর অন্য কোন কথাই তিনি বলেননি। শুধু বাবাকে আমাদের সবাইকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার যাবার নির্দেশ দিয়েই ফোন কেটে দিলেন”।
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “পরিতোষকে তার পিসির সাথে দেখা করতে দিয়েছে কিনা তারা, এ ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছ তোমরা”?
কিংশুক একটু আমতা আমতা করে বলল, “না মানে দিদিভাই, পরিদার পিসি তো এ’সব ব্যাপারে কোন কথাই বললেন না। আমরাও যে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করব, সে সুযোগটুকুও তিনি দিলেন না। শুধু নিজের আদেশটুকু শুনিয়েই ফোন কেটে দিলেন। কী করব দিদিভাই”?
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ভাই, ফোনটা কে করেছিল? পরির পিসি নিজেই না বাড়ির অন্য কেউ ফোনটা করেছিলেন”?
কিংশুক বলল, “ফোনটা তো প্রথমে আমিই ধরেছিলাম দিদিভাই। পরিদার পিসি নিজেই একটা ল্যান্ড লাইন নাম্বার থেকে ফোনটা করেছিলেন। আর উনি নিজেই বললেন যে উনি পরিদার পিসি আর বাবার হিমুদি। আর বাবাকেও নাম ধরে বিধু বলে সম্বোধন করছিলেন। আর তার গলা শুনে হল তিনি পুরোপুরি সুস্থ”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “তাহলে তো ঠিকই আছে। মেসো তো তাদের সবাইকেই আগে থেকেই চিনতেন। তা ভাই, উনি কখন ফোন করেছিলেন মানে ঠিক ক’টার সময়”?
কিংশুক বলল, “এই তো দিদিভাই, মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই। উনি বাবার সাথে কথা শেষ করতেই আমি তোমাকে ফোন করলুম”।
সীমন্তিনী মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা মেসো কি বলছেন? কাল যাবেন তোমাদের নিয়ে”?
কিংশুক বলল, “বাবা তো যেতে রাজী আছেন। কিন্তু আমার কলেজ কামাই করতে হবে ভেবেই আমি নিজে যাব কিনা সেটা স্থির করতে পারছি না। আর আমি না গেলে তো মা-ও যাবেন না”।
কোয়ার্টারের কম্পাউন্ডের ভেতর গাড়ি ঢুকতে দেখে সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ভাই, আমি তো এখন বাড়ি ফিরছি। আমি কিছু বাদে তোমাকে ফোন করব। একটু ভেবে নিই ব্যাপারটা। তা মাসি মেসো সবাই ঠিক আছেন তো”?
কিংশুক বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, আমরা সবাই ভাল আছি। কিন্তু পরিদা শেষ পর্যন্ত তার পিসির সাথে দেখা করতে পারলেন কি না সেটা বুঝতে না পেরেই সবাই একটু চিন্তায় আছি”।
সীমন্তিনীর গাড়ি তখন ঘরের সিঁড়ির কাছে এসে থেমে গেছে। নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “আচ্ছা ভাই, আমি ঘন্টা খানেক বাদে তোমাকে ফোন করছি। আর দুশ্চিন্তা করো না। ভগবান যা করবেন, ভালই করবেন। ছাড়ছি এখন, কেমন”?
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সীমন্তিনী ভাবল এখনই সে এ ব্যাপারে অর্চনাকে কিছু বলবে না। কিন্তু শুকনো মুখে অর্চনা ঘরের দড়জা খুলে দিতেই সীমন্তিনী বুঝে গেল যে অর্চনার কাছে আর সব কিছু গোপন রাখা যাবে না। ও নিশ্চয়ই এতক্ষণে খবর পেয়ে গেছে।
সীমন্তিনী ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “কিরে অর্চু সোনা? তোর মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন রে? কী হয়েছে? দুপুরে খাসনি নাকি”?
অর্চনা সীমন্তিনীর কথার জবাবে কিছু বলবার আগেই রান্নাঘর থেকে লক্ষ্মী বলল, “তোমার সোনা বোন সেই বিকেল থেকে এভাবে মুখ শুকনো করে বসে আছে দিদিমণি। একশ’ বার জিজ্ঞেস করেও তার মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারলুম না আমি। এবার তুমি এসে গেছ। তুমি সামলাও ওনাকে”।
সীমন্তিনী অর্চনার দু’কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘোরাতেই দেখল অর্চনার চোখে জল ছলছল করছে। সীমন্তিনী নিজের মনের ভাব গোপন রেখে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওমা, তুই কাঁদছিস কেন অর্চু? কী হয়েছে রে বোন”?
অর্চনা নিজের ভেতর থেকে উথলে আসা কান্নাকে আর চেপে রাখতে না পেরে সীমন্তিনীর বুকে মুখ চেপে ধরে জোরে কেঁদে ফেলল। সীমন্তিনী নিজের কাঁধের ব্যাগটা একদিকে ফেলে দিয়ে অর্চনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আঃ, বলবি তো কী হয়েছে। আর তোর যখন এত মন খারাপ তাহলে আমাকে ফোন করিস নি কেন? বল না অর্চু, লক্ষ্মী বোন আমার। বল না কী হয়েছে? কেন কাঁদছিস? কেউ কিছু বলেছে তোকে? কিন্তু আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি কোনও ব্যাপারে। বল না কী হয়েছে”?
অর্চনা কোন কথা না বলে ডুকরে ডুকরে কেঁদেই যাচ্ছিল। কোনভাবেই তাকে শান্ত করতে না পেরে লক্ষ্মীকে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঘরে রাখতে বলে সে অর্চনাকে ধরে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার ওপর অর্চনাকে বসিয়ে তার পাশে বসে অর্চনার চিবুক ধরে তার মুখটা তুলে বলল, “লক্ষ্মী সোনা বোন আমার। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে রে? বল না আমায় সবটা খুলে সোনা”।
অর্চনা এবার ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “তোমার বন্ধু কোথায় দিদিভাই? তার কথা কিছু শুনেছ”?
অর্চনার মুখে এ’কথা শুনে সীমন্তিনী প্রথমে অবাক হল। তারপর অর্চনার কাঁদার কারনটা বুঝতে পেরেই মনে মনে পুলকিত হল। অর্চনা যে মনে মনে পরিতোষকে ভালবাসতে শুরু করেছে, এ’কথা বুঝতে পেরে এই উদ্বেগের মাঝেও সে বেশ খুশী হল। তবু মুখে সে ভাব ফুটিয়ে না তুলে কিছু বলতে যেতেই লক্ষ্মী ঘরে ঢুকে বলল, “ওমা দিদিমণি! সোনাদি এভাবে কাঁদছে কেন গো”!
সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “কিছু হয়নি লক্ষ্মীদি। ও একা একা বসে বোধহয় কিছু ভাবছিল। তোমাকে বলতে পারছিল না। নীতাও নেই বাড়িতে। তাই বোধ হয়। আচ্ছা তুমি আমাদের জন্য চা নিয়ে এস। আমি ওকে শান্ত করছি”।
লক্ষ্মী সীমন্তিনীর ব্যাগটা রেখে চলে যেতেই সীমন্তিনী অর্চনার চিবুক ধরে বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি তুই কী ভাবছিলিস এতক্ষণ একা একা। আচ্ছা, এবার চুপটি করে একটু বোস তো এখানে সোনা। আমি হাতমুখটা ধুয়ে আসছি, কেমন”?
অর্চনা নিজের মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিতেই সীমন্তিনী বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। বাথরুম থেকে ফিরে এসে অর্চনার কাছে বসে ওর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাড়িতে ফোন করেছিলি? ভাই কি তোকে পরিতোষের ব্যাপারে কিছু বলেছে”?
অর্চনা লাজুক ভাবে মাথা নিচু করে বলল, “সন্ধ্যের আগে করেছিলাম। কিন্তু বাড়িতেও কেউ কোন খবর পায়নি”।
সীমন্তিনী আবার বলল, “ভাবিস নে। কিচ্ছু হবে না। আমার মন বলছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় আমরা ভাল খবর পাব”।
অর্চনা নিজের জলে ভরা দুটো চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “যে লোকটা গত সাতটা বছর ধরে নিজেকে একেবারে অনাথ বলে ভেবে এসেছেন, তিনি যখন আজ জানতে পারলেন যে তার রক্তের সম্পর্কের আপন পিসি বেঁচে আছেন, আর তাকে দেখতে গিয়েও যদি তিনি বিফল হয়, তবে কত বড় একটা দুঃখই না পাবেন তিনি”।
সীমন্তিনী মনে মনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “হু ঠিক বলেছিস। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস অর্চু? এখানেও সেই সাত! তোর জীবনে সাতটা বছর অন্ধকারময় ছিল, নীতারও তাই। পরিও সাত বছর অনাথ থাকবার পর আজ তার বাবার রক্তের সম্পর্কের নিজের দিদিকে খুঁজে পেয়েছে। আজ আর অন্যরকম কিছু হতেই পারে না। ওদিকে রচু সন্ধ্যের আগে থেকেই পরি আর তার পিসির জন্যে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। পরিতোষের সাথে তার ঠিক আগেই রচুর কথা হয়েছে। আর পরি ওকে কথা দিয়েছে যে পিসির সাথে দেখা হবার পর পরি সবার আগে রচুকেই ফোন করবে, কারন পরির ফোন না পাওয়া অব্দি ও প্রার্থনা শেষ করবে না। আর আমার মন বলছে, রচুর প্রার্থনা ঠাকুর ঠিক শুনবেন। আমিও তো সেই দুপুর থেকেই চিন্তায় আছি। তোকে ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা জানাইনি। নীতা বাড়িতে থাকলে তোদের অবশ্যই জানাতুম। জানি লক্ষ্মীদির সাথে তুই এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করবি না। বাড়িতে একা একা বসেই আবোল তাবোল ভাববি। আর দ্যাখ ঠিক সেটাই হল। আমারই ভুল হয়েছে। আমার উচিৎ ছিল রচু আর ভাইকে আগে থেকে সাবধান করে দেওয়া, যাতে তোকে আগে কিছু জানতে না দেয়। কিন্তু আমিও আজ অফিসে এত ব্যস্ত ছিলুম যে এতটা তলিয়ে ভাববার সময়ই পাইনি। কিন্তু সোনা, এইমাত্র ভাই ফোন করেছিল আমাকে। বলল যে পরির পিসি নাকি কাল সকালে মাসি মেসো আর ভাইকে তাদের বাড়ি যেতে বলেছেন। তোর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তুই আমার এখানে আছিস শুনে আর কিছু বলেন নি”।
______________________________
রচনা বিস্মিত গলায় জবাব দিল, “এ কী বলছ পিসি তুমি? তুমি ফোন করলে আমি বিরক্ত হব কেন? তুমি তো জানোনা পিসি, আমার শ্বশুরবাড়িতে বাড়ি ভর্তি লোকজন। তাদের সবাইকে ছেড়ে স্বামীর সাথে এখানে চলে আসতে হয়েছে। এখানে আসবার পর বাড়ির সকলকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিনা বলে মনটা খুব ছটফট করে। তাই তো যখন তখন এর ওর সাথে ফোনে কথা বলি। আর তুমি তো আমার নতুন পিসি। এতদিন পিসি বলে ডাকবার মত কেউ আমাদের জীবনে ছিল না। আজ থেকে তোমায় পেলাম। তুমি ফোন করলে আমি তো খুশীই হব। কিন্তু পিসি ইশ, আমি তো তোমার অনুমতি না নিয়েই প্রথম থেকেই তোমাকে ‘তুমি তুমি’ করে বলছি। এতে তুমি রাগ করোনি তো”?
হৈমবতীদেবী হেসে বললেন, “শোনো পাগলী মেয়ের কথা। যে মেয়েটা আমাকে জীবনে চোখেই দেখেনি, যে আমার সুস্থতা কামনা করে এক দেড় ঘন্টা ধরে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে পারে, সে আমাকে তুমি করে বলছে বলে আমি রাগ করব? তোকে আমি বলে বোঝাতে পারবনা রে মা যে আজ আমি কত খুশী। আজ শুধু আমার ভাইপো নয় তার সাথে সাথে তোর মত এমন একটা মিষ্টি মেয়েও তো পেলুম। আবার আমার একটা ভাই যাকে ‘মা অন্নপূর্ণা’ বলে ডাকে তার কথাও জানতে পারলুম। তবে এই মূহুর্তে এত খুশীর মধ্যেও মনে একটা দুঃখও হচ্ছে। ভগবান আমাকে দুটো ডানা কেন দিলেন না। তাহলে এই মূহুর্তে আমি উড়ে গিয়ে তোর সাথে আর তোর সেই দিদিভাইয়ের সাথে দেখা করতুম। তবে তুই হয়ত নিশ্চয়ই ভাবছিস যে বুড়ীটা তো খুব বকবক করতে পারে। তুই তো আবার কাকে কাকে যেন ফোন করে তোর পরিদার কথা বলবি বললি। তাই এখন রাখছিরে মা। রাতে আমার ফোন থেকে তোকে ফোন করব, তখন আরও কথা হবে। অবশ্য তুই যদি বিরক্ত না হোস। তবে এখন আর তোকে জ্বালাচ্ছি না। তোর বরের নাম তো শুনলুম রতু। রতু আর রচু। বাঃ বেশ মানিয়েছে। তোদের দু’জনের জন্য আমার অনেক অনেক ভালবাসা আর শুভেচ্ছা রইল। ভাল থাকিস মা”।
রচনা এবার বলল, “আচ্ছা পিসি, পরিদার সাথে আরেকটু কথা বলব আমি। ফোনটা একটু ওনাকে দাও না”।
“হ্যাঁ মা দিচ্ছি” বলে হৈমবতীদেবী পরিতোষের হাতে ফোন দিলেন।
প্রায় আধঘণ্টা ধরে রচনার প্রশ্নের জবাবে পরিতোষকে সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে হল। তারপর কথা শেষ করে ফোন পকেটে রাখতে না রাখতেই হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁরে পরিতোষ, মন্তি কি তোর শুধুই বন্ধু? না ওর সাথে তোর অন্য কোনও সম্পর্ক আছে? আর নীতা নামের মেয়েটা কে রে? সে-ও কি তোর বন্ধু? না আর কিছু”?
পরিতোষ পিসিকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তার পায়ের কাছে বসে তার কোলে মাথা চেপে ধরে বলল, “মন্তি আর নীতার সম্বন্ধে সব কিছু তোমাদের বলতে গেলে আজকের পুরো রাতেও সে’সব কথা শেষ হবে না পিসি। ওদের দু’জনকে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে দুটো ফিল্ম বানিয়ে ফেলা যায়। আজ এতদিন বাদে তোমাকে যখন পেয়েছি, তখন ধীরে ধীরে সব কিছুই তোমাদের বলব পিসি। তবে এখন তোমার প্রশ্নের জবাবে শুধু এটুকুই বলছি, ওরা দু’জন দু’রকম ভাবে দু’জন পুরুষকে ভালবাসে। কিন্তু ওরা ওদের ভালবাসার পাত্রের সাথে কোনদিন ঘর করবে না বা বলতে পারো করা সম্ভবই নয়। ওদের ভালবাসার কথা, ওদের জীবনের সব কথা আমি জানি। ওরা দু’জনেই কোনদিনই তাদের ভালবাসার পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না জেনেও নিজেদের ভালবাসার পাত্রদেরই নিজেদের স্বামী বলে ভাবে। আজীবন সমাজের চোখে ওরা অবিবাহিতাই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য ওদের জীবনের সেইসব কথা শুনলে অনেকেই হয়ত ছিঃ ছিঃ করবে। কিন্তু পিসি আমি কিন্তু ওদের ভালবাসাকে শ্রদ্ধাই করি। আর আমি তো তোমাকে আগেও বলেছি পিসি, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসতে পারে তাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি। ওই মেয়েদুটোও তাই। তবে তোমার মত নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে যাবার সাধ্য বা সুযোগ কোনটাই ওদের ছিল না। আর এই শ্রদ্ধার বশেই ওদেরকে আমি বন্ধু বলে ভাবি। আপাততঃ এর বেশী কিছু আমি বলছি না। ওরা দু’জনেই আমার খুব ভাল বন্ধু। তবে আজ যে আমি তোমাকে পেলাম, সেটা ওই মন্তির জন্যেই সম্ভব হল। মন্তির কাছে না এলে তোমার হদিশই পেতাম না আমি। তাই একা তুমি শুধু নও, আমিও মন্তির কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব পিসি। ও আমার যা উপকার করল আজ, সে উপকারের বিনিময়ে কোন কিছুই যথেষ্ট নয়। ওকে ধন্যবাদ দিয়েও আমি ছোট করতে পারব না। শুধু ভগবানের কাছে ওর জন্য প্রার্থনাই করে যাব, ভগবান যেন ওকে শান্তিতে রাখেন” বলে একটু থেমে হৈমবতীদেবীর কোল থেকে মাথা তুলে আবার বলল, “কিন্তু পিসি, আমাকে একটু সময়ের জন্য বাইরে যেতে দাও না গো। মন্তিকে, নীতাকে আর বিধুকাকুকে তো রচুই ফোন করে সবকিছু জানিয়ে দেবে। কিন্তু মালবাজারে আর কলকাতায় দুটো জরুরী ফোন করতে হবে আমার অফিসিয়াল ব্যাপারে। আমার তো কালই মালবাজার যাবার কথা ছিল। আর কলকাতা অফিসেও পরশুই আমার কাজে যোগ দেবার কথা ছিল। কিন্তু তুমি তো আমাকে আটকে দিলে। তাই ওদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানিয়ে দেওয়াটা খুব দরকার। আর বুঝতেই তো পারছ, এ’সব পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। সকলের সামনে এ’সব অফিসিয়াল ব্যাপার নিয়ে কথা বলা যায় না। তোমরা কেউ ব্যাপারটাকে অন্যভাবে নিও না প্লীজ। আমি দুরে কোথাও যাব না। দোকানের পাশে দাঁড়িয়েই তাদের সাথে কথা বলব। প্লীজ পিসি”।
হৈমবতীদেবী পরিতোষের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আচ্ছা বেশ, যা। তবে দোকান থেকে বেশী দুরে কোথাও যাসনে বাবা। তোকে যে সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে পেতে ইচ্ছে করছে আজ। যা। ফোন সেরে আয়। তবে তাড়াতাড়ি ঘুরে আসিস বাবা”।
পরিতোষ হৈমবতীর একটা হাত নিজের দু’হাতে ধরে বলল, “ঠিক আছে পিসি। আমি পনের মিনিটের মধ্যেই তোমার কাছে ফিরে আসছি” বলে অন্যান্য সোফায় বসে থাকা তিন বৌদির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে চোখের ঈশারায় সম্মতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
******************
দুপুরের পর থেকেই সীমন্তিনীর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। সকালে অফিসে আসবার পথে পরিতোষের কালচিনি পৌঁছে যাবার কথা শুনে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল। আজ লাঞ্চ করতে তার একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ লাঞ্চ খেতে খেতে সে রচনাকে ফোন করেছিল। তখনই জানতে পারল যে পরিতোষ বিধুবাবুর ছোট বেলার বন্ধুর ছেলে। বিধুবাবুর কাছে তার নিজের পিসি বেঁচে আছেন, আর আলিপুরদুয়ারে আছেন, এ’কথা শুনেই নাকি পরিতোষ দুপুর আড়াইটের ট্রেনে কালচিনি থেকে আলিপুরদুয়ার চলে গেছে। আর ঠিক তখন থেকেই সীমন্তিনীর মনের উদ্বেগ বেড়ে চলছিল। তার কয়েক মিনিট বাদেই পরিতোষের পাঠানো এসএমএসটাও পেয়েছিল। কিন্তু ভেতরের উদ্বেগটা তাতেও কাটেনি। নিজের উদ্বেগ সামলাতে না পেরে বিকেলের দিকে নিজের কেবিনে বসেই সে পরিতোষকে ফোন করেছিল। কিন্তু মনে হল পরিতোষ কলটা রিজেক্ট করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়বার ফোন করেও একই ফল হয়েছিল। তখন সে ভেবেছিল যে কোন কারণেই হোক পরিতোষ এই মূহুর্তে তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। তারপর একে একে কালচিনিতে, রচনার কাছে আর নবনীতার কাছে বারে বারে ফোন করেও কোনও খবর না পেয়ে তার উদ্বেগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করেছিল। অবশেষে বেলা চারটে নাগাদ রচনা ফোন করে তাকে জানাল যে পরিতোষ তার পিসির বাড়িতে পৌঁছে গেছে ঠিকই। কিন্তু তার পিসির শারীরিক অসুস্থতার জন্যেই তখনও সে পিসির কাছে যায়নি। তবে পিসির বাড়ির লোকজনেরা পরিতোষকে পেয়ে খুব খুশী হলেও সকলেই আশঙ্কায় আছেন যে পরিতোষের মা বাবা দাদু ঠাকুমার মৃত্যু সংবাদ শুনে হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী তার পিসির হয়তো কোন বিপদ আপদ হতে পারে। তাই তারা আগে থেকেই তাদের পারিবারিক ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন। আর ওই ডাক্তার ভদ্রলোক নাকি সব কিছু সামলে নেবেন বলে তাদের সকলকে আশ্বস্ত করে ওপরের তলায় পরিতোষের পিসির কাছে চলে গেছেন। আর সেই সময়েই নাকি রচনা পরিতোষকে ফোন করেছিল। তখন পরিতোষই নাকি এ’সব কথা তাকে বলেছে। রচনার কাছ থেকে এ খবর শোনবার পর এক দিক থেকে তার মনের উদ্বেগ কিছুটা কমেছিল। পরিতোষকে যে তার পিসেমশাই আর পিসতুতো দাদারা ভাল ভাবে গ্রহণ করেছে এটা জেনে। কিন্তু পরিতোষের পিসির শারীরিক অবস্থার কথা শুনে আরেকটা নতুন উদ্বেগ তাকে ঘিরে ধরেছিল। তখন থেকেই মনে মনে সে ঠাকুরকে ডাকছিল বারবার। এত বছর বাদে জীবনে প্রথমবার নিজের পিসির কাছে গিয়েও তার সাথে দেখা না করেই পরিতোষকে যেন ফিরে আসতে না হয়। ভগবানের কাছে এ প্রার্থনাই করছিল সে। কিন্তু যত সময় কাটছিল, মনের উদ্বেগও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। সন্ধ্যের দিকে থাকতে না পেরে সে আবার পরিতোষকে ফোন করল। কিন্তু ফোন সুইচড অফ। রচনাকে ফোন করতে ফোন ধরল রতীশ। রতীশ জানাল যে রচনা বিকেলে পরিতোষ আর তার সাথে কথা বলবার পরেই ঠাকুর ঘরে গিয়ে পরিতোষের মনস্কামনা পূর্ণ করবার জন্যে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। এ’কথা শুনে এত উদ্বেগের মাঝেও রচনার প্রতি তার মন কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। কিন্তু তার মনের দুশ্চিন্তা যেন আর কিছুতেই কমছিল না।
অফিসের কাজ সেরে বেরোতেও একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল তার। বাড়ি ফেরবার পথে রতীশকে আরেকবার ফোন করে জানতে পারল যে এখনও কোন খবর পায়নি ওরা। রচনা তখনও ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেই যাচ্ছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সীমন্তিনীর হাতের মোবাইল বেজে উঠল। কিংশুকের ফোন দেখে সাথে সাথে কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ ভাই, বলো কি খবর”?
কিংশুক সাথে সাথে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “দিদিভাই, এইমাত্র আলিপুরদুয়ার থেকে পরিদার পিসিমা বাবাকে ফোন করেছিলেন। আর তিনি আমাদের সকলকেই কাল সকালে তাদের ওখানে যেতে বলেছেন”।
সীমন্তিনী মনে মনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তিনি তোমাদের সবাইকে আলিপুরদুয়ারে ডেকে পাঠিয়েছেন”?
কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই। আমার কাল কলেজ আছে, বড়দি তোমার ওখানে, এ’সব শুনে বললেন যে বড়দি যখন বাড়িতে নেই তাহলে তাকে বাদ দিয়েই আমি একদিনের জন্য কলেজ কামাই করেও যেন মা বাবার সাথে তাদের ওখানে যাই। কিন্তু অবশ্যই যেতে হবে সেখানে”।
সীমন্তিনী মনে মনে ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে বলল, “কিন্তু তোমাদের সবাইকে এভাবে কেন ডাকলেন উনি? আর পরিতোষের সাথে তার পিসির দেখা হয়েছে কি না, এ’সব ব্যাপারে কিছু বললেন উনি”?
কিংশুক জবাবে বলল, “না দিদিভাই, আর অন্য কোন কথাই তিনি বলেননি। শুধু বাবাকে আমাদের সবাইকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার যাবার নির্দেশ দিয়েই ফোন কেটে দিলেন”।
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “পরিতোষকে তার পিসির সাথে দেখা করতে দিয়েছে কিনা তারা, এ ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছ তোমরা”?
কিংশুক একটু আমতা আমতা করে বলল, “না মানে দিদিভাই, পরিদার পিসি তো এ’সব ব্যাপারে কোন কথাই বললেন না। আমরাও যে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করব, সে সুযোগটুকুও তিনি দিলেন না। শুধু নিজের আদেশটুকু শুনিয়েই ফোন কেটে দিলেন। কী করব দিদিভাই”?
সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ভাই, ফোনটা কে করেছিল? পরির পিসি নিজেই না বাড়ির অন্য কেউ ফোনটা করেছিলেন”?
কিংশুক বলল, “ফোনটা তো প্রথমে আমিই ধরেছিলাম দিদিভাই। পরিদার পিসি নিজেই একটা ল্যান্ড লাইন নাম্বার থেকে ফোনটা করেছিলেন। আর উনি নিজেই বললেন যে উনি পরিদার পিসি আর বাবার হিমুদি। আর বাবাকেও নাম ধরে বিধু বলে সম্বোধন করছিলেন। আর তার গলা শুনে হল তিনি পুরোপুরি সুস্থ”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “তাহলে তো ঠিকই আছে। মেসো তো তাদের সবাইকেই আগে থেকেই চিনতেন। তা ভাই, উনি কখন ফোন করেছিলেন মানে ঠিক ক’টার সময়”?
কিংশুক বলল, “এই তো দিদিভাই, মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই। উনি বাবার সাথে কথা শেষ করতেই আমি তোমাকে ফোন করলুম”।
সীমন্তিনী মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা মেসো কি বলছেন? কাল যাবেন তোমাদের নিয়ে”?
কিংশুক বলল, “বাবা তো যেতে রাজী আছেন। কিন্তু আমার কলেজ কামাই করতে হবে ভেবেই আমি নিজে যাব কিনা সেটা স্থির করতে পারছি না। আর আমি না গেলে তো মা-ও যাবেন না”।
কোয়ার্টারের কম্পাউন্ডের ভেতর গাড়ি ঢুকতে দেখে সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ভাই, আমি তো এখন বাড়ি ফিরছি। আমি কিছু বাদে তোমাকে ফোন করব। একটু ভেবে নিই ব্যাপারটা। তা মাসি মেসো সবাই ঠিক আছেন তো”?
কিংশুক বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, আমরা সবাই ভাল আছি। কিন্তু পরিদা শেষ পর্যন্ত তার পিসির সাথে দেখা করতে পারলেন কি না সেটা বুঝতে না পেরেই সবাই একটু চিন্তায় আছি”।
সীমন্তিনীর গাড়ি তখন ঘরের সিঁড়ির কাছে এসে থেমে গেছে। নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “আচ্ছা ভাই, আমি ঘন্টা খানেক বাদে তোমাকে ফোন করছি। আর দুশ্চিন্তা করো না। ভগবান যা করবেন, ভালই করবেন। ছাড়ছি এখন, কেমন”?
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সীমন্তিনী ভাবল এখনই সে এ ব্যাপারে অর্চনাকে কিছু বলবে না। কিন্তু শুকনো মুখে অর্চনা ঘরের দড়জা খুলে দিতেই সীমন্তিনী বুঝে গেল যে অর্চনার কাছে আর সব কিছু গোপন রাখা যাবে না। ও নিশ্চয়ই এতক্ষণে খবর পেয়ে গেছে।
সীমন্তিনী ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “কিরে অর্চু সোনা? তোর মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন রে? কী হয়েছে? দুপুরে খাসনি নাকি”?
অর্চনা সীমন্তিনীর কথার জবাবে কিছু বলবার আগেই রান্নাঘর থেকে লক্ষ্মী বলল, “তোমার সোনা বোন সেই বিকেল থেকে এভাবে মুখ শুকনো করে বসে আছে দিদিমণি। একশ’ বার জিজ্ঞেস করেও তার মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারলুম না আমি। এবার তুমি এসে গেছ। তুমি সামলাও ওনাকে”।
সীমন্তিনী অর্চনার দু’কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘোরাতেই দেখল অর্চনার চোখে জল ছলছল করছে। সীমন্তিনী নিজের মনের ভাব গোপন রেখে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওমা, তুই কাঁদছিস কেন অর্চু? কী হয়েছে রে বোন”?
অর্চনা নিজের ভেতর থেকে উথলে আসা কান্নাকে আর চেপে রাখতে না পেরে সীমন্তিনীর বুকে মুখ চেপে ধরে জোরে কেঁদে ফেলল। সীমন্তিনী নিজের কাঁধের ব্যাগটা একদিকে ফেলে দিয়ে অর্চনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আঃ, বলবি তো কী হয়েছে। আর তোর যখন এত মন খারাপ তাহলে আমাকে ফোন করিস নি কেন? বল না অর্চু, লক্ষ্মী বোন আমার। বল না কী হয়েছে? কেন কাঁদছিস? কেউ কিছু বলেছে তোকে? কিন্তু আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি কোনও ব্যাপারে। বল না কী হয়েছে”?
অর্চনা কোন কথা না বলে ডুকরে ডুকরে কেঁদেই যাচ্ছিল। কোনভাবেই তাকে শান্ত করতে না পেরে লক্ষ্মীকে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঘরে রাখতে বলে সে অর্চনাকে ধরে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার ওপর অর্চনাকে বসিয়ে তার পাশে বসে অর্চনার চিবুক ধরে তার মুখটা তুলে বলল, “লক্ষ্মী সোনা বোন আমার। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে রে? বল না আমায় সবটা খুলে সোনা”।
অর্চনা এবার ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “তোমার বন্ধু কোথায় দিদিভাই? তার কথা কিছু শুনেছ”?
অর্চনার মুখে এ’কথা শুনে সীমন্তিনী প্রথমে অবাক হল। তারপর অর্চনার কাঁদার কারনটা বুঝতে পেরেই মনে মনে পুলকিত হল। অর্চনা যে মনে মনে পরিতোষকে ভালবাসতে শুরু করেছে, এ’কথা বুঝতে পেরে এই উদ্বেগের মাঝেও সে বেশ খুশী হল। তবু মুখে সে ভাব ফুটিয়ে না তুলে কিছু বলতে যেতেই লক্ষ্মী ঘরে ঢুকে বলল, “ওমা দিদিমণি! সোনাদি এভাবে কাঁদছে কেন গো”!
সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “কিছু হয়নি লক্ষ্মীদি। ও একা একা বসে বোধহয় কিছু ভাবছিল। তোমাকে বলতে পারছিল না। নীতাও নেই বাড়িতে। তাই বোধ হয়। আচ্ছা তুমি আমাদের জন্য চা নিয়ে এস। আমি ওকে শান্ত করছি”।
লক্ষ্মী সীমন্তিনীর ব্যাগটা রেখে চলে যেতেই সীমন্তিনী অর্চনার চিবুক ধরে বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি তুই কী ভাবছিলিস এতক্ষণ একা একা। আচ্ছা, এবার চুপটি করে একটু বোস তো এখানে সোনা। আমি হাতমুখটা ধুয়ে আসছি, কেমন”?
অর্চনা নিজের মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিতেই সীমন্তিনী বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। বাথরুম থেকে ফিরে এসে অর্চনার কাছে বসে ওর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাড়িতে ফোন করেছিলি? ভাই কি তোকে পরিতোষের ব্যাপারে কিছু বলেছে”?
অর্চনা লাজুক ভাবে মাথা নিচু করে বলল, “সন্ধ্যের আগে করেছিলাম। কিন্তু বাড়িতেও কেউ কোন খবর পায়নি”।
সীমন্তিনী আবার বলল, “ভাবিস নে। কিচ্ছু হবে না। আমার মন বলছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় আমরা ভাল খবর পাব”।
অর্চনা নিজের জলে ভরা দুটো চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “যে লোকটা গত সাতটা বছর ধরে নিজেকে একেবারে অনাথ বলে ভেবে এসেছেন, তিনি যখন আজ জানতে পারলেন যে তার রক্তের সম্পর্কের আপন পিসি বেঁচে আছেন, আর তাকে দেখতে গিয়েও যদি তিনি বিফল হয়, তবে কত বড় একটা দুঃখই না পাবেন তিনি”।
সীমন্তিনী মনে মনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “হু ঠিক বলেছিস। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস অর্চু? এখানেও সেই সাত! তোর জীবনে সাতটা বছর অন্ধকারময় ছিল, নীতারও তাই। পরিও সাত বছর অনাথ থাকবার পর আজ তার বাবার রক্তের সম্পর্কের নিজের দিদিকে খুঁজে পেয়েছে। আজ আর অন্যরকম কিছু হতেই পারে না। ওদিকে রচু সন্ধ্যের আগে থেকেই পরি আর তার পিসির জন্যে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। পরিতোষের সাথে তার ঠিক আগেই রচুর কথা হয়েছে। আর পরি ওকে কথা দিয়েছে যে পিসির সাথে দেখা হবার পর পরি সবার আগে রচুকেই ফোন করবে, কারন পরির ফোন না পাওয়া অব্দি ও প্রার্থনা শেষ করবে না। আর আমার মন বলছে, রচুর প্রার্থনা ঠাকুর ঠিক শুনবেন। আমিও তো সেই দুপুর থেকেই চিন্তায় আছি। তোকে ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা জানাইনি। নীতা বাড়িতে থাকলে তোদের অবশ্যই জানাতুম। জানি লক্ষ্মীদির সাথে তুই এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করবি না। বাড়িতে একা একা বসেই আবোল তাবোল ভাববি। আর দ্যাখ ঠিক সেটাই হল। আমারই ভুল হয়েছে। আমার উচিৎ ছিল রচু আর ভাইকে আগে থেকে সাবধান করে দেওয়া, যাতে তোকে আগে কিছু জানতে না দেয়। কিন্তু আমিও আজ অফিসে এত ব্যস্ত ছিলুম যে এতটা তলিয়ে ভাববার সময়ই পাইনি। কিন্তু সোনা, এইমাত্র ভাই ফোন করেছিল আমাকে। বলল যে পরির পিসি নাকি কাল সকালে মাসি মেসো আর ভাইকে তাদের বাড়ি যেতে বলেছেন। তোর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তুই আমার এখানে আছিস শুনে আর কিছু বলেন নি”।
______________________________