29-03-2020, 12:18 AM
(Update No. 233)
পরিতোষ পিসির কথার জবাবে কি বলবে ভেবে পেল না। হৈমবতীদেবীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলবার মত কিছুই যেন সে খুঁজে পেল না। পিসির দুটো হাত ধরে সে কাতরকন্ঠে বলল, “অমন করে বোল না পিসি। মাকে তো আমি শুধু ছবিতেই দেখেছি। মায়ের আদর কাকে বলে সেটাও কোনদিন বুঝতে পারিনি। বাবার মুখে ছোটবেলায় শুধু শুনেই ছিলাম যে আমার এক পিসি ছিল, উত্তরবঙ্গে কোথাও। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন না আমার মায়ের মতই স্বর্গে চলে গেছেন, জানতে পারিনি। বাবা চলে যাবার পর গত সাতটা বছর ধরে আমি ভাবতাম আমি একটা অনাথ ছেলে। এতবড় পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে একটা লোকও নেই। আজ ভগবানের আশীর্বাদে এই মূহুর্তে আমি যে কত খুশী, তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। পিসি মাসি এরা তো মায়েরই সমকক্ষ। তোমার হাত ধরে এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি আমার মায়ের হাত ধরেই হাঁটছি। এমন সুখ যে আমার কাছে এতদিন অধরাই ছিল পিসি। আজ দুপুরেই প্রথমে কালচিনিতে কাকু আর বিকেলে গদিতে পিসেমশাইয়ের মুখেই তোমার কথা শুনলাম। যা এতদিন আমার কাছে পুরোপুরি অজানা ছিল। শুনলাম বাবা তোমাকে খুব ভালবাসতেন। বাবা কোনদিন আমার সাথে তোমার ব্যাপারে বেশী কিছু কথা বলতেন না। হয়ত তিনি তার বাবার আদেশ মেনেই সেটা করেছিলেন। আর ঠাকুমা আর দাদু কেন তোমার ওপর অভিমান করেছিলেন সে’কথা আমার চাইতে তোমরাই বেশী ভাল জানো। আমি তো সে’সবের কিচ্ছু জানিনা। হয়তো ওই বয়সে বাবাও সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারেন নি। কিংবা নিজের মনের ইচ্ছে মুখে প্রকাশ করে মা-বাবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবার সাহসও হয়তো পাননি তিনি। এই মূহুর্তে আমি শুধু এটুকুই জানি তুমি আমার পিসিমা। আমার মায়ের সমতূল্যা। যাকে আমি আজ জীবনে প্রথমবার দেখতে পেলাম তার ওপর কি আমি অভিমান করে থাকতে পারি, বলো? আর বিগত কয়েকটা ঘন্টায় দাদু ঠাকুমাদের সাথে তোমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপারে যা কিছু শুনেছি তাতে শুধু দুঃখই পেয়েছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভালোবাসাকে খুব শ্রদ্ধা করি পিসি। যারা নিঃস্বার্থ হয়ে নিখাদ ভাল বাসতে পারে তাদের সব্বাইকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। তাই তুমি যে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেও নিজের ভালবাসাকে যেভাবে সম্মান জানিয়েছ তাতে তোমার ওপর আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেছে। দাদু ছিলেন সে যুগের মানুষ। তার মানসিকতা নিশ্চয়ই অন্যরকমই ছিল। তাই হয়ত তিনি সেদিন সেটা মেনে নিতে পারেননি। আজ যদি তারা বেঁচে থাকতেন, তাহলে যুগের ধারার সাথে তাল রেখে তারাও হয়ত অনেক আগেই তোমাকে আবার কাছে টেনে নিতেন। আজ যে ঘটণাচক্রে আমি এখানে এসে পড়েছি, তোমার হাতের আদর আমার কপালে জুটল, এর পেছনে নিশ্চয়ই দাদু ঠাকুমার আত্মার প্রেরণা আছে। নইলে একটু ভেবে দেখো তো, চব্বিশ ঘন্টা আগেও আমি জানতাম না যে আমার আপন পিসি এখানে আছে। কাল বিকেলে নাগরাকাটায় আমার কলীগ বন্ধুর বাড়িতে বিধুকাকুর বড় মেয়ের মুখে তার বাবার নামটা শোনামাত্রই যেন আমার ভেতরে কী একটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেখো, বিধুকাকুর ছোট মেয়ে রচনাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। ওদের সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আমি ওকে নিজের ছোটবোনের মত স্নেহ করি। কিন্তু ওর মুখে কখনও আমি ওর বাবার নাম, মানে বিধুকাকুর নামটা শুনিনি। বিধুকাকুর কাছে কোন এক অদৃশ্য শক্তিই যেন আমাকে আজ টেনে এনেছিল। নইলে তোমার বেঁচে থাকবার কথা শোনা, এখানে এসে তোমাদের সকলের সাথে দেখা করা, কিছুই তো হত না। আমি তো জানতেও পারতাম না যে আমার পিসি আছে, পিসেমশাই আছে, তিন তিনটে দাদা, বৌদি, দু’দুটো দিদি আর এতসব ছোট ছোট ভাই ভাইপো ভাইঝি আছে। আর তুমি বলছ আমি এখনও ভাবছি যে তোমার প্রায়শ্চিত্ত এখনও সম্পূর্ণ হয়নি”?
হৈমবতীদেবী পরিতোষকে আবার দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেতে খেতে বলল, “তুই ঠিক বলছিস বাবা। আমারও মন বলছে এর পেছনে বাবার আত্মার নির্দেশ নিশ্চয়ই আছে। নইলে চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমি যে তপস্যা করে যাচ্ছিলুম, তা এক পলকেই এভাবে পূর্ণ কিছুতেই হত না। তবে বিধু আমাকে ওর কাছে চিরঋণী করে ফেলল। ওর এ উপকারের প্রতিদান আমি সারা জীবনেও শোধ করতে পারব না। দাঁড়া, বড়বৌমা, তোমার মোবাইলটা এনে বিধুর সাথে যোগাযোগ করো তো। আমি এখনই ওর সাথে কথা বলব”।
বড়বৌ সুলোচনা এতক্ষণ পিসি ভাইপোর পাশে দাঁড়িয়েই এমন সুন্দর দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখছিলেন। এবার শ্বাশুড়ি মা-র কথা শুনে তিনি বললেন, “মা চলো, বসবার ঘরে গিয়েই আমি বিধুমামুর সাথে তোমার কথা বলিয়ে দিচ্ছি”।
ঠিক এমন সময় একটু দুরের একটা দড়জা দিয়ে উঁকি মেরে মেজবৌ রুমা বললেন, “বড়দি, মা, ঠাকুরপোকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এস তোমরা। ওখানে চা জলখাবারের আয়োজন করে ফেলেছে ছোটো”।
বসবার ঘরে সুলোচনা হৈমবতীদেবী আর পরিতোষকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর আগে থেকে বসে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই তোরা সবাই ছোটকাকুর ঘরে গিয়ে বোস তো। তোদের খাবার সেখানেই দেওয়া হবে। এখানে বড়রা জরুরী ব্যাপারে কথা বলবে”।
বাচ্চারা সকলেই যেন একটু হতাশ হল। তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে মুখ কাচুমাচু করে বলল, “ওমা, আমাদের এই নতুন কাকুটার সাথে তো আমরা কথাই বলতে পারলাম না এখন অব্দি। এখনও আমাদের সবাইকে চলে যেতে বলছ? আর খাবার খেয়ে সাথে সাথে পড়তে না বসলে আবার গালমন্দ করবে। আমরা তাহলে কাকুর সাথে কখন কথা বলব”?
সুলোচনাদেবী নিজের ছেলের কথার কিছু একটা কড়া জবাব দেবার আগেই পরিতোষ বাচ্চাদের কাছে গিয়ে দু’তিন জনকে দু’হাতের বেষ্টনীতে নিয়ে বলল, “একদম মন খারাপ কোর না তোমরা কেউ। আজ কেউ তোমাদের কোনরকম গালমন্দ করবে না। তোমরা খাবার খেয়ে যে যার পড়া নিয়ে বোসো। আমি ঘন্টাখানেক তোমাদের মা আর ঠাকুমার সাথে কথা বলেই তোমাদের কাছে চলে আসব। তোমরা এর ভেতরেই নিজের নিজের কলেজের হোমটাস্ক গুলো শেষ করে ফেলো কিন্তু। নইলে আমি চলে আসলে তো সে’সব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তাই না”?
পাঁচজন বাচ্চাই পরিতোষকে জাপটে ধরে বলল, “ঠিক আছে কাকু। আমরা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের হোমটাস্ক কমপ্লিট করে ফেলছি। তুমি কিন্তু এক ঘন্টা বাদে ঠিক চলে আসবে ওখানে” বলে সকলে মিলে পরিতোষের গালে চুমু খেয়ে হৈ হৈ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এমন অভিজ্ঞতাও পরিতোষের জীবনে এই প্রথম। পাঁচ পাঁচটা শিশু কিশোর একসাথে তাকে চুমো খেতে পারে, এ ভাবনা জীবনেও কখনো তার মনে আসেনি। বাচ্চাদের চলে যাওয়া দড়জার দিকে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দু’চোখ জলে ভরে গেল।
ছোটবৌ দেবিকা টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম আনতেই বড়বৌ সুলোচনা পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে স্নেহমাখা গলায় বললেন, “ছিঃ ঠাকুরপো, আজ আমাদের সকলের জীবনে কত বড় একটা খুশীর দিন। এমন দিনে চোখের জল ফেলতে নেই ভাই। এসো, ওঠো। চলো, সবাই মিলে চা খাই”।
ওদিকে হৈমবতীদেবী তখন ফোনে বলছেন, “আমি আলিপুরদুয়ার থেকে তোমার বাবার হিমুদি বলছি বাবা। একটু তোমার বাবাকে ফোনটা দেবে? ...... ও সে এখন দোকানে ..... আচ্ছা আচ্ছা বাবা, আমি লাইনে থাকছি। তা তোমরা বাড়ির সকলে ভাল আছ তো বাবা? তোমার মা ভাল আছেন তো? ... হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, তোমার পরিদাও ভাল আছেন। এই তো আমরা সবাই মিলে একসাথে বসে চা খাচ্ছি এখন .... হ্যাঁ, কে বিধু? খুব ব্যস্ত আছিস নাকি রে ভাই? ....... আচ্ছা বেশ, তবে শোন। তুই আমার যা উপকার করলি আজ তার বিনিময় তো আমি সারা জীবনেও দিতে পারবনারে ভাই। কিন্তু শোন, কাল সকালেই তুই তোর বৌ আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে চলে আসবি। তোদের সাথে খুব জরুরী কথা আছে আমার ....... না না, ও’সব কথা আমি শুনছি নে। যত কাজই থাকুক, তোদের আসতেই হবে। দোকান বন্ধ রেখে চলে আসবি ...... অ্যা? কি বলছিস? তোর ছেলের কলেজ খোলা? থাকুক কলেজ খোলা। কাল একটা দিন না’হয় ও কলেজ কামাইই করল, তাতে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আমি কোন অজুহাতই শুনছি না। কাল সকালে তুই বিভা, অর্চু, কিংশুক সবাইকে নিয়ে এখানে চলে আসবি .... কি? অর্চু নাগরাকাটায়? সেখানে কে আছে? ..... ও-ও তোর ছোট মেয়ে রচুর বড় ননদ?....... আচ্ছা ঠিক আছে, ও বাড়িতে নেই যখন তখন তো আর করবার কিছু নেই। তবে তোরা তিনজন কিন্তু অবশ্যই চলে আসবি। রাতে যদি থাকতে না চাস তাহলে সন্ধ্যের ট্রেন ধরে না হয় ফিরেই যাস তোরা, তখন আটকাব না। কিন্তু কাল সকালে কিন্তু অবশ্যই আসবি ভাই। আর কোন কথা নয়। বাকি কথা কাল সাক্ষাতে আলোচনা করা যাবে। রাখলুম” বলে ফোন নামিয়ে রাখলেন।
ছোটবৌ দেবিকা আর মেজবৌ রুমা হৈমবতীদেবী, পরিতোষ আর সুলোচনাদেবীর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেরাও নিজেদেরটা নিয়ে আলাদা আলাদা সোফায় বসল। নিরঞ্জনবাবু আর তার তিন ছেলেই হৈমবতীদেবী সুস্থ হয়ে ওঠবার কিছু পরেই যার যার কর্মস্থলে চলে গেছেন। তবে সকলেই যাবার সময় পরিতোষকে বলে গেছেন যে তারা আজ রাতে একটু তাড়াতাড়িই ফেরবার চেষ্টা করবেন।
পরিতোষ বুঝে গেছে যে পিসির আদেশে আগামীকাল সকালেই বিধুবাবু আর বিভাদেবী এখানে আসছেন। হয়তো কিংশুকও আসবে। এমতাবস্থায় আগামীকাল যে তার মালবাজার যাবার কথা ছিল তা বোধহয় ভেস্তেই যাবে। হাতের ছুটিও শেষ। কে জানত যে নাগরাকাটায় সীমন্তিনীর কাছে এসেই সে তার নিজের পিসি আর তার পরিবারকে খুঁজে পাবে। মনে হচ্ছে ছুটি বাড়াতেই হবে। কারন মালবাজার যাওয়াটা খুবই প্রয়োজনীয়। সেখানে না গিয়ে কলকাতা ফেরা যাবে না।
তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেজবৌ রুমা পরিতোষকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ঠাকুরপো? এত কি ভাবছ? এখানে এসে আমাদের দেখে বুঝি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছ? নিশ্চয়ই ভাবছ, এ কোন চিড়িয়াখানায় এসে পড়লুম রে বাবা”?
পরিতোষ হেসে বলল, “না মেজবৌদি তা নয় গো। আজ কালচিনি ফিরে গিয়ে কাল সকালে মালবাজার যাবার কথা ছিল আমার। সে’কথাই ভাবছিলাম। আর তুমি চিড়িয়াখানার কথা বলছ? গত সাতটা বছর ধরে বিশাল এক চিড়িয়াখানাতেই তো জীবন কাটাচ্ছি মেজবৌদি। ওই বিশাল খাঁচার মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণীর ছায়া পর্যন্ত পড়ে না। তোমাদের এ চিড়িয়াখানায় এসে আশেপাশে এতজনকে পেয়ে মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে এমন স্বপ্ন আমি চব্বিশ ঘন্টা আগেও দেখবার কল্পনাও করতে পারিনি। আমার সম্পর্কের এত লোকের সাহচর্য যে আমার কপালে আছে, এ’কথা তো সারা জীবনেও ভাবতে পারিনি আমি। আমার মত একজন অনাথকে আমার নিজের সম্পর্কের কচি কচি পাঁচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝি এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরবে এ তো ...........”
রুদ্ধ কান্নায় নিজের কথা শেষ করতে পারল না। পাশে বসে থাকা হৈমবতীদেবী পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ছোটবৌ দেবিকা জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি সত্যিই মা-বাবার ব্যাপারে, আমাদের সকলের ব্যাপারে কিছুই জানতে না এতদিন”?
পরিতোষ একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “না ছোটবৌদি, তোমাদের সকলের কথা তো দুর, আমি পিসেমশাই বা পিসির নামটা পর্যন্ত আজ বিকেলের আগে শুনিনি। জন্মের পর খুব ছোট থাকতেই, আমার বয়স যখন মাত্র দু’বছর, তখন মাকে হারিয়েছি। তারপর ছোটবেলাতেই ঠাকুমা আর ঠাকুর্দা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর একমাত্র বাবাকেই দেখেছি। বাবা পুলিশে ছোটখাট একটা চাকরী করতেন। খুব সৎ মানুষ ছিলেন। বাবার স্বপ্ন ছিল তার ছেলেকে আইপিএস অফিসার বানাবার। ২০০৫ সালে আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করে আমি যখন হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং নিতে চলে গেলাম তার মাস দু’য়েক বাদেই বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। বাবাকে হারালাম। আমাদের বাড়িতে দু’ তিনটে ছবি আছে। তাতে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, বাবা আর মা থাকলেও পিসির কোন ছবি ছিল না। বাবার ছোটবেলাকার একটা ছবি আছে। তাতে কিশোর বয়সের বাবার সাথে তার এক বন্ধুর ছবি আছে। গতকাল জানতে পারলাম বাবার সেই বন্ধুটিই হচ্ছেন কালচিনির বিধুকাকু। পিসির কোন ছবি আমি কোথাও দেখিনি। তবে ছোটবেলায় কথায় কথায় বাবা মাঝে মধ্যে বলতেন যে গ্রামে থাকতে তার এক বড়দিদি ছিল, যাকে উনি খুব ভালবাসতেন। সেই পিসি নাকি ভূটান আর আসাম সীমান্তের কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে থাকেন। সেখানেই নাকি নিজে পছন্দ করে অ', এক ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই দাদু ঠাকুমারা তাদের মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। পিসির সম্বন্ধে শুধু এটুকুই আমি শুনেছি। তবে কোনভাবে পিসির প্রসঙ্গ উঠলেই বাবা যেন কেমন হয়ে যেতেন। আমি পিসির ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলেই আমাকে বলতেন, আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবি না। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে আড়ালে গিয়ে কাঁদতেন। সেটা দেখেই আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে বাবা পিসিকে সত্যি খুব ভালবাসতেন। বাবা কাঁদতেন বলে আমিও আর পিসির কথা ওঠাতাম না কখনো। এভাবেই কেটেছে। তারপর তো বাবাও আমাকে একা ফেলে চলে গেলেন। বাবার চেনা পরিচিত কারো মুখে পিসির কথা শুনতাম না। তাই পিসির সম্বন্ধে এতদিন আমি কিচ্ছুটি জানতাম না”।
হৈমবতীদেবী নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “হ্যাঁরে, ঠিক বলেছিস তুই, বাবা। ভাই আমাকে সত্যিই খুব ভালবাসত। ছোটবেলায় তার সমস্ত আবদার ছিল আমার কাছেই। আমাদের বিয়ের তিনদিন পর যখন মা-বাবার সাথে দেখা করে তাদের আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলুম, সেদিন বাবা আমাদের মুখের ওপর দড়জা বন্ধ করে বলেছিলেন যে তার মেয়ে তিনদিন আগে অপঘাতে মারা গেছে। এ পৃথিবীতে মেয়ে বলতে তাদের আর কেউ নেই। আমিও যেন ভাবি যে আমার মা বাবা ভাই সবাই মরে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে যখন সে বাড়ি থেকে তোর পিসোর সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলুম, তখন রাস্তায় এক জায়গায় তোর বাবার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। ভাই আমাকে দেখে আগের মতই ছুটে কাছে এসে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও থমকে গিয়েছিল। আমার মত ওরও দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা বইছিল। ওঃ সেদিনের সেই দৃশ্যটা সারা জীবন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও একলাফে দু’পা পেছনে সরে গিয়েছিল। তারপর কোন কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে হাত ছুঁইয়ে একটা প্রণাম করেই ছুটে একদিকে চলে গিয়েছিল। সেটাই আমার ভাইয়ের তার দিদিকে জীবনের প্রথম আর শেষ প্রণাম করা”।
বলতে বলতে হৈমবতীদেবী আবার কেঁদে ফেললেন। বড়বৌ সুলোচনা ছুটে গিয়ে শাশুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এ কী করছ মা? এভাবে কাঁদলে তো তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। শান্ত হও। ভগবান এতদিনে আমাদের দিকে মুখে তুলে তাকিয়েছেন। তুমি তোমার ভাইপোকে খুঁজে পেয়েছ। আজ আর কান্না নয় মা”।
ছোটবৌ দেবিকা এবার শাশুড়িকে বলল, “মা সব কিছু দেখে শুনে আমার মনে হচ্ছে তোমার এ ভাইপো আমার সমবয়সীই হবে। আমাদের ভেতর বৌদি ঠাকুরপোর সম্পর্ক তো থাকবেই, কিন্তু” বলেই হঠাৎ পরিতোষের দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি বিয়ে করেছ”?
পরিতোষ এমন হঠাৎ প্রসঙ্গে একটু চমকে উঠল। আমতা আমতা করে লাজুক স্বরে বলল, “না ছোটবৌদি, সেটা আর হয়ে ওঠেনি”।
বড়বৌ সুলোচনা বললেন, “আহ, ছোটো, কী হচ্ছে এ’সব? আজই তো ওর সাথে আমাদের পরিচয় হল। এতদিন তো বেচারার অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। এবার আমরাই দেখে শুনে ওর বিয়ে দেব”।
ছোটবৌ দেবিকা একটা কিশোরীর মত আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, “উঃ, কি মজা হবে। আমার খুব শখ ছিল এক দেবরের বিয়েতে খুব আনন্দ স্ফুর্তি করব। কিন্তু এ পরিবারের ছোটবৌ হবার ফলে সে শখ আর পূর্ণ হয়নি। এতদিনে একটা ঠাকুরপো পেলাম। এবার আমি আমার মনের সে সাধটা মেটাতে পারব”।
এবার মেজবৌ রুমা তার বড়জাকে বলল, “আচ্ছা বড়দি, তোমার কি মনে হয় অভিভাবক নেই বলেই এমন কন্দর্পকান্তি একটা ছেলের বিয়ে হবে না? নিজেরা পছন্দ করেই তো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বিয়ে করছে। তবে দেবরের জন্য ঘটকালি করবার আগে ভাল করে খবর নিয়ে নিও। তার ভালবাসার কোন পাত্রী টাত্রী আছে কি না। নইলে কিন্তু নিজেই ফ্যাসাদে পড়তে পার”।
ছোটবৌ দেবিকা বলল, “একদম ঠিক বলেছ মেজদি। এমন হ্যান্ডসাম ছেলের প্রেমিকা থাকবে না, তাও আবার কলকাতার মত একটা শহরে, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার খবর তো নিতেই হবে। কিন্তু তোমাদের কথায় আমি মাকে যে কথাটা বলতে যাচ্ছিলুম সেটা তো বলাই হল না, আচ্ছা মা..” বলে হৈমবতীদেবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বলছিলাম, ঠাকুরপো আমার থেকে বড় ছোট যাই হোক না কেন, আমার তো দাদা বা ভাই বলতে কেউ নেই। আমি যদি চিরাচরিত দেবর বৌদির সম্পর্ক মেনেও ওকে ভাই বলে ডাকি, তাতে তুমি অনুমতি দেবে”?
হৈমবতীদেবী হেসে বললেন, “ওমা পাগলী মেয়ের কথা শোনো। দেবর বৌদির ভেতরে বয়সের ফারাক খুব বেশী না হলে তারা তো ভাই বোনের মত সম্পর্ক রাখতেই পারে। আগেকার দিনে তো দেবরেরা ছেলের বয়সীও হত। তখন বৌদি দেবরের মধ্যে মা-ছেলের মত সম্পর্ক হত। অনেকে তো বৌদিকে মা বলেও ডাকতো। তা হ্যাঁরে পরিতোষ, তোর বয়স কত হল, বল তো”? বলেই স্বগতোক্তির মত করে বললেন, “কপাল আমার, নিজের ভাইপোকে জিজ্ঞেস করছি, তার বয়স কত হল”?
পরিতোষ পিসির হাত ধরে বলল, “আমরা সবাই তো ভাগ্যবিধাতার হাতের খেলার পুতুল পিসি। তুমি যেমন আমার বয়স জানো না তেমনি আমি তো এটাও জানতুম না যে আমার পিসি আছে, দাদারা আছে, বৌদিরা আছে। তাই সেটা তোমার আমার দু’জনেরই দুর্ভাগ্য। তবে যে’কথা হচ্ছিল সেটাই বলি। আমার বয়স এখন তিরিশ। বিএসসি পাশ করবার পর আইপিএস পাশ করেছি। বাবার মৃত্যুর সময় আমি হায়দ্রাবাদে ছিলুম। তারপর কিছুদিন ভাইজ্যাগে ছিলুম। এখন কলকাতাতেই আছি দু’বছরের মত হল”।
এবার ছোটবৌ দেবিকা সাথে সাথে বলল, “দেখেছ মা! আমি বলেছিলুম না যে ও আমার সমবয়সীই হবে। আমি কিন্তু তাহলে এখন থেকেই ওকে ‘ভাইদা’ বলে ডাকব”।
মেজবৌদি রুমা দেবিকার কথা শুনে বলল, “বাহ, দারুণ একটা সম্বোধন খুঁজে বের করেছিস তো ছোটো। ‘ভাইদা’ আহ, সত্যি খুব মিষ্টি লাগছে ডাকটা শুনতে। তাই না বড়দি”? বলে বড়বৌ সুলোচনার দিকে তাকাল।
সুলোচনাও মিষ্টি হেসে বললেন, “হ্যাঁরে মেজো। ডাকটা খুব মিষ্টি লাগবে শুনতে। আমরা তিনজনেই ওকে এখন থেকে ‘ভাইদা’ বলেই ডাকব। মা তুমি কি বলো”?
হৈমবতীদেবী হেসে একহাতে পরিতোষকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোমরা ওকে যদি ওই নামে ডেকে খুশী হও, তাতে আমি কেন বারণ করব। কিন্তু বড়বৌমা, ছোটবৌমা ওর সমবয়সী হলেও ও তো তোমার আর মেজবৌমার থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে, তবু ওকে ভাই না বলে ভাইদা বলে ডাকবে তোমরা”?
বড়বৌ বললেন, “শুধু বয়সটাই কি সবকিছুর মাপকাঠি হয় মা? আমি তো বিশ্বাস করি আত্মীয়দের মধ্যে অন্তরঙ্গতাকেই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বলে গণ্য করতে হয় আর সবচেয়ে ওপরে রাখতে হয়। ষোল বছর আগে এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিলুম। তখন থেকেই তো দেখে আসছি, দাদু দিদিমা আর মামাকে এ বাড়ির সকলে মিলে কত খোঁজা খুঁজি করছে। আমাদের ভাগ্যে ছিল না তাদের কাউকে চাক্ষুষ দেখবার। তাই আজ যখন জানতে পারলুম যে যাদের আমরা এতবছর ধরে খুঁজে চলেছি, তারা সবাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, তাতে তো আমরা দুঃখ পেয়েছিই। কিন্তু তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী আজ আমাদের সাথে আমাদের সামনে বসে আছে, সে কি আর কোন অংশে কম আনন্দের ব্যাপার মা? ও যে আমাদের কাছে কোহিনূর হীরের চাইতেও দামী গো”।
______________________________
পরিতোষ পিসির কথার জবাবে কি বলবে ভেবে পেল না। হৈমবতীদেবীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলবার মত কিছুই যেন সে খুঁজে পেল না। পিসির দুটো হাত ধরে সে কাতরকন্ঠে বলল, “অমন করে বোল না পিসি। মাকে তো আমি শুধু ছবিতেই দেখেছি। মায়ের আদর কাকে বলে সেটাও কোনদিন বুঝতে পারিনি। বাবার মুখে ছোটবেলায় শুধু শুনেই ছিলাম যে আমার এক পিসি ছিল, উত্তরবঙ্গে কোথাও। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন না আমার মায়ের মতই স্বর্গে চলে গেছেন, জানতে পারিনি। বাবা চলে যাবার পর গত সাতটা বছর ধরে আমি ভাবতাম আমি একটা অনাথ ছেলে। এতবড় পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে একটা লোকও নেই। আজ ভগবানের আশীর্বাদে এই মূহুর্তে আমি যে কত খুশী, তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। পিসি মাসি এরা তো মায়েরই সমকক্ষ। তোমার হাত ধরে এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি আমার মায়ের হাত ধরেই হাঁটছি। এমন সুখ যে আমার কাছে এতদিন অধরাই ছিল পিসি। আজ দুপুরেই প্রথমে কালচিনিতে কাকু আর বিকেলে গদিতে পিসেমশাইয়ের মুখেই তোমার কথা শুনলাম। যা এতদিন আমার কাছে পুরোপুরি অজানা ছিল। শুনলাম বাবা তোমাকে খুব ভালবাসতেন। বাবা কোনদিন আমার সাথে তোমার ব্যাপারে বেশী কিছু কথা বলতেন না। হয়ত তিনি তার বাবার আদেশ মেনেই সেটা করেছিলেন। আর ঠাকুমা আর দাদু কেন তোমার ওপর অভিমান করেছিলেন সে’কথা আমার চাইতে তোমরাই বেশী ভাল জানো। আমি তো সে’সবের কিচ্ছু জানিনা। হয়তো ওই বয়সে বাবাও সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারেন নি। কিংবা নিজের মনের ইচ্ছে মুখে প্রকাশ করে মা-বাবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবার সাহসও হয়তো পাননি তিনি। এই মূহুর্তে আমি শুধু এটুকুই জানি তুমি আমার পিসিমা। আমার মায়ের সমতূল্যা। যাকে আমি আজ জীবনে প্রথমবার দেখতে পেলাম তার ওপর কি আমি অভিমান করে থাকতে পারি, বলো? আর বিগত কয়েকটা ঘন্টায় দাদু ঠাকুমাদের সাথে তোমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপারে যা কিছু শুনেছি তাতে শুধু দুঃখই পেয়েছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভালোবাসাকে খুব শ্রদ্ধা করি পিসি। যারা নিঃস্বার্থ হয়ে নিখাদ ভাল বাসতে পারে তাদের সব্বাইকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। তাই তুমি যে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেও নিজের ভালবাসাকে যেভাবে সম্মান জানিয়েছ তাতে তোমার ওপর আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেছে। দাদু ছিলেন সে যুগের মানুষ। তার মানসিকতা নিশ্চয়ই অন্যরকমই ছিল। তাই হয়ত তিনি সেদিন সেটা মেনে নিতে পারেননি। আজ যদি তারা বেঁচে থাকতেন, তাহলে যুগের ধারার সাথে তাল রেখে তারাও হয়ত অনেক আগেই তোমাকে আবার কাছে টেনে নিতেন। আজ যে ঘটণাচক্রে আমি এখানে এসে পড়েছি, তোমার হাতের আদর আমার কপালে জুটল, এর পেছনে নিশ্চয়ই দাদু ঠাকুমার আত্মার প্রেরণা আছে। নইলে একটু ভেবে দেখো তো, চব্বিশ ঘন্টা আগেও আমি জানতাম না যে আমার আপন পিসি এখানে আছে। কাল বিকেলে নাগরাকাটায় আমার কলীগ বন্ধুর বাড়িতে বিধুকাকুর বড় মেয়ের মুখে তার বাবার নামটা শোনামাত্রই যেন আমার ভেতরে কী একটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেখো, বিধুকাকুর ছোট মেয়ে রচনাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। ওদের সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আমি ওকে নিজের ছোটবোনের মত স্নেহ করি। কিন্তু ওর মুখে কখনও আমি ওর বাবার নাম, মানে বিধুকাকুর নামটা শুনিনি। বিধুকাকুর কাছে কোন এক অদৃশ্য শক্তিই যেন আমাকে আজ টেনে এনেছিল। নইলে তোমার বেঁচে থাকবার কথা শোনা, এখানে এসে তোমাদের সকলের সাথে দেখা করা, কিছুই তো হত না। আমি তো জানতেও পারতাম না যে আমার পিসি আছে, পিসেমশাই আছে, তিন তিনটে দাদা, বৌদি, দু’দুটো দিদি আর এতসব ছোট ছোট ভাই ভাইপো ভাইঝি আছে। আর তুমি বলছ আমি এখনও ভাবছি যে তোমার প্রায়শ্চিত্ত এখনও সম্পূর্ণ হয়নি”?
হৈমবতীদেবী পরিতোষকে আবার দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেতে খেতে বলল, “তুই ঠিক বলছিস বাবা। আমারও মন বলছে এর পেছনে বাবার আত্মার নির্দেশ নিশ্চয়ই আছে। নইলে চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমি যে তপস্যা করে যাচ্ছিলুম, তা এক পলকেই এভাবে পূর্ণ কিছুতেই হত না। তবে বিধু আমাকে ওর কাছে চিরঋণী করে ফেলল। ওর এ উপকারের প্রতিদান আমি সারা জীবনেও শোধ করতে পারব না। দাঁড়া, বড়বৌমা, তোমার মোবাইলটা এনে বিধুর সাথে যোগাযোগ করো তো। আমি এখনই ওর সাথে কথা বলব”।
বড়বৌ সুলোচনা এতক্ষণ পিসি ভাইপোর পাশে দাঁড়িয়েই এমন সুন্দর দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখছিলেন। এবার শ্বাশুড়ি মা-র কথা শুনে তিনি বললেন, “মা চলো, বসবার ঘরে গিয়েই আমি বিধুমামুর সাথে তোমার কথা বলিয়ে দিচ্ছি”।
ঠিক এমন সময় একটু দুরের একটা দড়জা দিয়ে উঁকি মেরে মেজবৌ রুমা বললেন, “বড়দি, মা, ঠাকুরপোকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এস তোমরা। ওখানে চা জলখাবারের আয়োজন করে ফেলেছে ছোটো”।
বসবার ঘরে সুলোচনা হৈমবতীদেবী আর পরিতোষকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর আগে থেকে বসে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই তোরা সবাই ছোটকাকুর ঘরে গিয়ে বোস তো। তোদের খাবার সেখানেই দেওয়া হবে। এখানে বড়রা জরুরী ব্যাপারে কথা বলবে”।
বাচ্চারা সকলেই যেন একটু হতাশ হল। তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে মুখ কাচুমাচু করে বলল, “ওমা, আমাদের এই নতুন কাকুটার সাথে তো আমরা কথাই বলতে পারলাম না এখন অব্দি। এখনও আমাদের সবাইকে চলে যেতে বলছ? আর খাবার খেয়ে সাথে সাথে পড়তে না বসলে আবার গালমন্দ করবে। আমরা তাহলে কাকুর সাথে কখন কথা বলব”?
সুলোচনাদেবী নিজের ছেলের কথার কিছু একটা কড়া জবাব দেবার আগেই পরিতোষ বাচ্চাদের কাছে গিয়ে দু’তিন জনকে দু’হাতের বেষ্টনীতে নিয়ে বলল, “একদম মন খারাপ কোর না তোমরা কেউ। আজ কেউ তোমাদের কোনরকম গালমন্দ করবে না। তোমরা খাবার খেয়ে যে যার পড়া নিয়ে বোসো। আমি ঘন্টাখানেক তোমাদের মা আর ঠাকুমার সাথে কথা বলেই তোমাদের কাছে চলে আসব। তোমরা এর ভেতরেই নিজের নিজের কলেজের হোমটাস্ক গুলো শেষ করে ফেলো কিন্তু। নইলে আমি চলে আসলে তো সে’সব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তাই না”?
পাঁচজন বাচ্চাই পরিতোষকে জাপটে ধরে বলল, “ঠিক আছে কাকু। আমরা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের হোমটাস্ক কমপ্লিট করে ফেলছি। তুমি কিন্তু এক ঘন্টা বাদে ঠিক চলে আসবে ওখানে” বলে সকলে মিলে পরিতোষের গালে চুমু খেয়ে হৈ হৈ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এমন অভিজ্ঞতাও পরিতোষের জীবনে এই প্রথম। পাঁচ পাঁচটা শিশু কিশোর একসাথে তাকে চুমো খেতে পারে, এ ভাবনা জীবনেও কখনো তার মনে আসেনি। বাচ্চাদের চলে যাওয়া দড়জার দিকে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দু’চোখ জলে ভরে গেল।
ছোটবৌ দেবিকা টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম আনতেই বড়বৌ সুলোচনা পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে স্নেহমাখা গলায় বললেন, “ছিঃ ঠাকুরপো, আজ আমাদের সকলের জীবনে কত বড় একটা খুশীর দিন। এমন দিনে চোখের জল ফেলতে নেই ভাই। এসো, ওঠো। চলো, সবাই মিলে চা খাই”।
ওদিকে হৈমবতীদেবী তখন ফোনে বলছেন, “আমি আলিপুরদুয়ার থেকে তোমার বাবার হিমুদি বলছি বাবা। একটু তোমার বাবাকে ফোনটা দেবে? ...... ও সে এখন দোকানে ..... আচ্ছা আচ্ছা বাবা, আমি লাইনে থাকছি। তা তোমরা বাড়ির সকলে ভাল আছ তো বাবা? তোমার মা ভাল আছেন তো? ... হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, তোমার পরিদাও ভাল আছেন। এই তো আমরা সবাই মিলে একসাথে বসে চা খাচ্ছি এখন .... হ্যাঁ, কে বিধু? খুব ব্যস্ত আছিস নাকি রে ভাই? ....... আচ্ছা বেশ, তবে শোন। তুই আমার যা উপকার করলি আজ তার বিনিময় তো আমি সারা জীবনেও দিতে পারবনারে ভাই। কিন্তু শোন, কাল সকালেই তুই তোর বৌ আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে চলে আসবি। তোদের সাথে খুব জরুরী কথা আছে আমার ....... না না, ও’সব কথা আমি শুনছি নে। যত কাজই থাকুক, তোদের আসতেই হবে। দোকান বন্ধ রেখে চলে আসবি ...... অ্যা? কি বলছিস? তোর ছেলের কলেজ খোলা? থাকুক কলেজ খোলা। কাল একটা দিন না’হয় ও কলেজ কামাইই করল, তাতে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আমি কোন অজুহাতই শুনছি না। কাল সকালে তুই বিভা, অর্চু, কিংশুক সবাইকে নিয়ে এখানে চলে আসবি .... কি? অর্চু নাগরাকাটায়? সেখানে কে আছে? ..... ও-ও তোর ছোট মেয়ে রচুর বড় ননদ?....... আচ্ছা ঠিক আছে, ও বাড়িতে নেই যখন তখন তো আর করবার কিছু নেই। তবে তোরা তিনজন কিন্তু অবশ্যই চলে আসবি। রাতে যদি থাকতে না চাস তাহলে সন্ধ্যের ট্রেন ধরে না হয় ফিরেই যাস তোরা, তখন আটকাব না। কিন্তু কাল সকালে কিন্তু অবশ্যই আসবি ভাই। আর কোন কথা নয়। বাকি কথা কাল সাক্ষাতে আলোচনা করা যাবে। রাখলুম” বলে ফোন নামিয়ে রাখলেন।
ছোটবৌ দেবিকা আর মেজবৌ রুমা হৈমবতীদেবী, পরিতোষ আর সুলোচনাদেবীর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেরাও নিজেদেরটা নিয়ে আলাদা আলাদা সোফায় বসল। নিরঞ্জনবাবু আর তার তিন ছেলেই হৈমবতীদেবী সুস্থ হয়ে ওঠবার কিছু পরেই যার যার কর্মস্থলে চলে গেছেন। তবে সকলেই যাবার সময় পরিতোষকে বলে গেছেন যে তারা আজ রাতে একটু তাড়াতাড়িই ফেরবার চেষ্টা করবেন।
পরিতোষ বুঝে গেছে যে পিসির আদেশে আগামীকাল সকালেই বিধুবাবু আর বিভাদেবী এখানে আসছেন। হয়তো কিংশুকও আসবে। এমতাবস্থায় আগামীকাল যে তার মালবাজার যাবার কথা ছিল তা বোধহয় ভেস্তেই যাবে। হাতের ছুটিও শেষ। কে জানত যে নাগরাকাটায় সীমন্তিনীর কাছে এসেই সে তার নিজের পিসি আর তার পরিবারকে খুঁজে পাবে। মনে হচ্ছে ছুটি বাড়াতেই হবে। কারন মালবাজার যাওয়াটা খুবই প্রয়োজনীয়। সেখানে না গিয়ে কলকাতা ফেরা যাবে না।
তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেজবৌ রুমা পরিতোষকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ঠাকুরপো? এত কি ভাবছ? এখানে এসে আমাদের দেখে বুঝি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছ? নিশ্চয়ই ভাবছ, এ কোন চিড়িয়াখানায় এসে পড়লুম রে বাবা”?
পরিতোষ হেসে বলল, “না মেজবৌদি তা নয় গো। আজ কালচিনি ফিরে গিয়ে কাল সকালে মালবাজার যাবার কথা ছিল আমার। সে’কথাই ভাবছিলাম। আর তুমি চিড়িয়াখানার কথা বলছ? গত সাতটা বছর ধরে বিশাল এক চিড়িয়াখানাতেই তো জীবন কাটাচ্ছি মেজবৌদি। ওই বিশাল খাঁচার মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণীর ছায়া পর্যন্ত পড়ে না। তোমাদের এ চিড়িয়াখানায় এসে আশেপাশে এতজনকে পেয়ে মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে এমন স্বপ্ন আমি চব্বিশ ঘন্টা আগেও দেখবার কল্পনাও করতে পারিনি। আমার সম্পর্কের এত লোকের সাহচর্য যে আমার কপালে আছে, এ’কথা তো সারা জীবনেও ভাবতে পারিনি আমি। আমার মত একজন অনাথকে আমার নিজের সম্পর্কের কচি কচি পাঁচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝি এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরবে এ তো ...........”
রুদ্ধ কান্নায় নিজের কথা শেষ করতে পারল না। পাশে বসে থাকা হৈমবতীদেবী পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ছোটবৌ দেবিকা জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি সত্যিই মা-বাবার ব্যাপারে, আমাদের সকলের ব্যাপারে কিছুই জানতে না এতদিন”?
পরিতোষ একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “না ছোটবৌদি, তোমাদের সকলের কথা তো দুর, আমি পিসেমশাই বা পিসির নামটা পর্যন্ত আজ বিকেলের আগে শুনিনি। জন্মের পর খুব ছোট থাকতেই, আমার বয়স যখন মাত্র দু’বছর, তখন মাকে হারিয়েছি। তারপর ছোটবেলাতেই ঠাকুমা আর ঠাকুর্দা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর একমাত্র বাবাকেই দেখেছি। বাবা পুলিশে ছোটখাট একটা চাকরী করতেন। খুব সৎ মানুষ ছিলেন। বাবার স্বপ্ন ছিল তার ছেলেকে আইপিএস অফিসার বানাবার। ২০০৫ সালে আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করে আমি যখন হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং নিতে চলে গেলাম তার মাস দু’য়েক বাদেই বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। বাবাকে হারালাম। আমাদের বাড়িতে দু’ তিনটে ছবি আছে। তাতে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, বাবা আর মা থাকলেও পিসির কোন ছবি ছিল না। বাবার ছোটবেলাকার একটা ছবি আছে। তাতে কিশোর বয়সের বাবার সাথে তার এক বন্ধুর ছবি আছে। গতকাল জানতে পারলাম বাবার সেই বন্ধুটিই হচ্ছেন কালচিনির বিধুকাকু। পিসির কোন ছবি আমি কোথাও দেখিনি। তবে ছোটবেলায় কথায় কথায় বাবা মাঝে মধ্যে বলতেন যে গ্রামে থাকতে তার এক বড়দিদি ছিল, যাকে উনি খুব ভালবাসতেন। সেই পিসি নাকি ভূটান আর আসাম সীমান্তের কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে থাকেন। সেখানেই নাকি নিজে পছন্দ করে অ', এক ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই দাদু ঠাকুমারা তাদের মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। পিসির সম্বন্ধে শুধু এটুকুই আমি শুনেছি। তবে কোনভাবে পিসির প্রসঙ্গ উঠলেই বাবা যেন কেমন হয়ে যেতেন। আমি পিসির ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলেই আমাকে বলতেন, আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবি না। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে আড়ালে গিয়ে কাঁদতেন। সেটা দেখেই আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে বাবা পিসিকে সত্যি খুব ভালবাসতেন। বাবা কাঁদতেন বলে আমিও আর পিসির কথা ওঠাতাম না কখনো। এভাবেই কেটেছে। তারপর তো বাবাও আমাকে একা ফেলে চলে গেলেন। বাবার চেনা পরিচিত কারো মুখে পিসির কথা শুনতাম না। তাই পিসির সম্বন্ধে এতদিন আমি কিচ্ছুটি জানতাম না”।
হৈমবতীদেবী নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “হ্যাঁরে, ঠিক বলেছিস তুই, বাবা। ভাই আমাকে সত্যিই খুব ভালবাসত। ছোটবেলায় তার সমস্ত আবদার ছিল আমার কাছেই। আমাদের বিয়ের তিনদিন পর যখন মা-বাবার সাথে দেখা করে তাদের আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলুম, সেদিন বাবা আমাদের মুখের ওপর দড়জা বন্ধ করে বলেছিলেন যে তার মেয়ে তিনদিন আগে অপঘাতে মারা গেছে। এ পৃথিবীতে মেয়ে বলতে তাদের আর কেউ নেই। আমিও যেন ভাবি যে আমার মা বাবা ভাই সবাই মরে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে যখন সে বাড়ি থেকে তোর পিসোর সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলুম, তখন রাস্তায় এক জায়গায় তোর বাবার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। ভাই আমাকে দেখে আগের মতই ছুটে কাছে এসে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও থমকে গিয়েছিল। আমার মত ওরও দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা বইছিল। ওঃ সেদিনের সেই দৃশ্যটা সারা জীবন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও একলাফে দু’পা পেছনে সরে গিয়েছিল। তারপর কোন কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে হাত ছুঁইয়ে একটা প্রণাম করেই ছুটে একদিকে চলে গিয়েছিল। সেটাই আমার ভাইয়ের তার দিদিকে জীবনের প্রথম আর শেষ প্রণাম করা”।
বলতে বলতে হৈমবতীদেবী আবার কেঁদে ফেললেন। বড়বৌ সুলোচনা ছুটে গিয়ে শাশুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এ কী করছ মা? এভাবে কাঁদলে তো তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। শান্ত হও। ভগবান এতদিনে আমাদের দিকে মুখে তুলে তাকিয়েছেন। তুমি তোমার ভাইপোকে খুঁজে পেয়েছ। আজ আর কান্না নয় মা”।
ছোটবৌ দেবিকা এবার শাশুড়িকে বলল, “মা সব কিছু দেখে শুনে আমার মনে হচ্ছে তোমার এ ভাইপো আমার সমবয়সীই হবে। আমাদের ভেতর বৌদি ঠাকুরপোর সম্পর্ক তো থাকবেই, কিন্তু” বলেই হঠাৎ পরিতোষের দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি বিয়ে করেছ”?
পরিতোষ এমন হঠাৎ প্রসঙ্গে একটু চমকে উঠল। আমতা আমতা করে লাজুক স্বরে বলল, “না ছোটবৌদি, সেটা আর হয়ে ওঠেনি”।
বড়বৌ সুলোচনা বললেন, “আহ, ছোটো, কী হচ্ছে এ’সব? আজই তো ওর সাথে আমাদের পরিচয় হল। এতদিন তো বেচারার অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। এবার আমরাই দেখে শুনে ওর বিয়ে দেব”।
ছোটবৌ দেবিকা একটা কিশোরীর মত আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, “উঃ, কি মজা হবে। আমার খুব শখ ছিল এক দেবরের বিয়েতে খুব আনন্দ স্ফুর্তি করব। কিন্তু এ পরিবারের ছোটবৌ হবার ফলে সে শখ আর পূর্ণ হয়নি। এতদিনে একটা ঠাকুরপো পেলাম। এবার আমি আমার মনের সে সাধটা মেটাতে পারব”।
এবার মেজবৌ রুমা তার বড়জাকে বলল, “আচ্ছা বড়দি, তোমার কি মনে হয় অভিভাবক নেই বলেই এমন কন্দর্পকান্তি একটা ছেলের বিয়ে হবে না? নিজেরা পছন্দ করেই তো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বিয়ে করছে। তবে দেবরের জন্য ঘটকালি করবার আগে ভাল করে খবর নিয়ে নিও। তার ভালবাসার কোন পাত্রী টাত্রী আছে কি না। নইলে কিন্তু নিজেই ফ্যাসাদে পড়তে পার”।
ছোটবৌ দেবিকা বলল, “একদম ঠিক বলেছ মেজদি। এমন হ্যান্ডসাম ছেলের প্রেমিকা থাকবে না, তাও আবার কলকাতার মত একটা শহরে, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার খবর তো নিতেই হবে। কিন্তু তোমাদের কথায় আমি মাকে যে কথাটা বলতে যাচ্ছিলুম সেটা তো বলাই হল না, আচ্ছা মা..” বলে হৈমবতীদেবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বলছিলাম, ঠাকুরপো আমার থেকে বড় ছোট যাই হোক না কেন, আমার তো দাদা বা ভাই বলতে কেউ নেই। আমি যদি চিরাচরিত দেবর বৌদির সম্পর্ক মেনেও ওকে ভাই বলে ডাকি, তাতে তুমি অনুমতি দেবে”?
হৈমবতীদেবী হেসে বললেন, “ওমা পাগলী মেয়ের কথা শোনো। দেবর বৌদির ভেতরে বয়সের ফারাক খুব বেশী না হলে তারা তো ভাই বোনের মত সম্পর্ক রাখতেই পারে। আগেকার দিনে তো দেবরেরা ছেলের বয়সীও হত। তখন বৌদি দেবরের মধ্যে মা-ছেলের মত সম্পর্ক হত। অনেকে তো বৌদিকে মা বলেও ডাকতো। তা হ্যাঁরে পরিতোষ, তোর বয়স কত হল, বল তো”? বলেই স্বগতোক্তির মত করে বললেন, “কপাল আমার, নিজের ভাইপোকে জিজ্ঞেস করছি, তার বয়স কত হল”?
পরিতোষ পিসির হাত ধরে বলল, “আমরা সবাই তো ভাগ্যবিধাতার হাতের খেলার পুতুল পিসি। তুমি যেমন আমার বয়স জানো না তেমনি আমি তো এটাও জানতুম না যে আমার পিসি আছে, দাদারা আছে, বৌদিরা আছে। তাই সেটা তোমার আমার দু’জনেরই দুর্ভাগ্য। তবে যে’কথা হচ্ছিল সেটাই বলি। আমার বয়স এখন তিরিশ। বিএসসি পাশ করবার পর আইপিএস পাশ করেছি। বাবার মৃত্যুর সময় আমি হায়দ্রাবাদে ছিলুম। তারপর কিছুদিন ভাইজ্যাগে ছিলুম। এখন কলকাতাতেই আছি দু’বছরের মত হল”।
এবার ছোটবৌ দেবিকা সাথে সাথে বলল, “দেখেছ মা! আমি বলেছিলুম না যে ও আমার সমবয়সীই হবে। আমি কিন্তু তাহলে এখন থেকেই ওকে ‘ভাইদা’ বলে ডাকব”।
মেজবৌদি রুমা দেবিকার কথা শুনে বলল, “বাহ, দারুণ একটা সম্বোধন খুঁজে বের করেছিস তো ছোটো। ‘ভাইদা’ আহ, সত্যি খুব মিষ্টি লাগছে ডাকটা শুনতে। তাই না বড়দি”? বলে বড়বৌ সুলোচনার দিকে তাকাল।
সুলোচনাও মিষ্টি হেসে বললেন, “হ্যাঁরে মেজো। ডাকটা খুব মিষ্টি লাগবে শুনতে। আমরা তিনজনেই ওকে এখন থেকে ‘ভাইদা’ বলেই ডাকব। মা তুমি কি বলো”?
হৈমবতীদেবী হেসে একহাতে পরিতোষকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোমরা ওকে যদি ওই নামে ডেকে খুশী হও, তাতে আমি কেন বারণ করব। কিন্তু বড়বৌমা, ছোটবৌমা ওর সমবয়সী হলেও ও তো তোমার আর মেজবৌমার থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে, তবু ওকে ভাই না বলে ভাইদা বলে ডাকবে তোমরা”?
বড়বৌ বললেন, “শুধু বয়সটাই কি সবকিছুর মাপকাঠি হয় মা? আমি তো বিশ্বাস করি আত্মীয়দের মধ্যে অন্তরঙ্গতাকেই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বলে গণ্য করতে হয় আর সবচেয়ে ওপরে রাখতে হয়। ষোল বছর আগে এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিলুম। তখন থেকেই তো দেখে আসছি, দাদু দিদিমা আর মামাকে এ বাড়ির সকলে মিলে কত খোঁজা খুঁজি করছে। আমাদের ভাগ্যে ছিল না তাদের কাউকে চাক্ষুষ দেখবার। তাই আজ যখন জানতে পারলুম যে যাদের আমরা এতবছর ধরে খুঁজে চলেছি, তারা সবাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, তাতে তো আমরা দুঃখ পেয়েছিই। কিন্তু তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী আজ আমাদের সাথে আমাদের সামনে বসে আছে, সে কি আর কোন অংশে কম আনন্দের ব্যাপার মা? ও যে আমাদের কাছে কোহিনূর হীরের চাইতেও দামী গো”।
______________________________