Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 232)

মেজবৌ রুমার হাতে একটা বরণডালা। আর ছোটবৌ দেবিকার হাতে মিষ্টির প্লেট আর জল। মেজবৌ রুমা এগিয়ে এসে পরিতোষের কপালে একটা চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে দিয়ে বরণডালাটা পরিতোষের কপালে আর বুকে ছোঁয়াল। তারপর ছোটবৌ দেবিকা পরিতোষের মুখে চামচে করে মিষ্টির টুকরো তুলে দিয়ে বলল, “আমার কোন দেবর ছিল না বলে এতদিন দুঃখ করছিলাম। ভগবান আজ আমার সে দুঃখ দুর করলেন” বলে নিরঞ্জনবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, বরণটা কিন্তু সম্পূর্ণ হল না। বড়দির বারণ আছে বলেই উলু দেওয়া হল না। ওপরে নিয়ে যাবার পর বড়দি নিজে শাঁখে ফুঁ দেবেন বলে সেটাও বাকি রইল”।

নিরঞ্জনবাবু হেসে বললেন, “ডাক্তার যখন অনুমতি দিয়েছে, তখন আচারের বাকি অংশটুকুও বড়বৌমা ঠিক পূর্ণ করবে। তোমরা বরং এবার ওকে নিয়ে ওপরে যাও। আমরাও আসছি তোমাদের পেছনে পেছনে”।

মেজবৌ রুমা বলল, “বাবা, বড়দি কিন্তু সবার আগে আপনাকে মা-র ঘরে যেতে বলেছেন”।
 

ছোটছেলে অমলেন্দু বলল, “হ্যাঁ বাবা, ডাক্তারবাবুও তাই বলেছেন। তুমি সবার আগে যাও। তুমি গিয়ে মা-র পাশে থাকো। বৌদিরা তার পর পরিতোষকে নিয়ে গিয়ে ঢুকবে। আর বড়দা মেজদা, তোরাও এদের সাথেই ওপরে চলে যা। আমি বলাইদাকে দুটো কথা বলেই আসছি” বলে দোকানের দিকে চলে গেল।

পরিতোষ এবার নিজের মনের সংশয় আর চেপে রাখতে না পেরে নিরঞ্জনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু পিসেমশাই, পিসিমা .......”

নিরঞ্জনবাবু মিষ্টি হেসে পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ডাক্তার বলেছে, ভয়ের কিছু নেই। তোমার পিসির প্রেসার এখন পুরোপুরি নর্ম্যাল আছে। আর তাছাড়া ডাক্তারও তো এখন তার কাছেই আছে। কিছু হলে সে সামলে নিতে পারবে। তুমি আর দেরী না করে ওপরে যাও বাবা। অনেকক্ষণ তোমাকে এমন অন্যায়ভাবে আমরা এখানেই আটকে রেখেছি। এবার যাও, গিয়ে তোমার পিসিকে দ্যাখো” বলে বৌদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা ওকে নিয়ে লিফটের সামনে এস। তবে তোমাদের আগে আমি ওপরে উঠে যাচ্ছি”।

নিরঞ্জনবাবু বেরিয়ে যেতেই দেবিকা আর রুমা পরিতোষকে নিয়ে লিফটের দড়জার কাছে এসে দাঁড়াল। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দুও সিঁড়ি বেয়েই ওপরে চলে গেলে দেবিকা পরিতোষকে বলল, “জানো ঠাকুরপো, আমাদের এ বাড়ির সকলের মনেই এতদিন দুঃখ ছিল। বাবার তরফের অনেক আত্মীয় পরিজনদের সাথেই আমাদের যোগাযোগ আছে। কিন্তু মা-র তরফ থেকে আমাদের আত্মীয় বলতে এতদিন কাউকে পাইনি। শুনেছি দাদু-দিদারা কেউই মা-বাবার বিয়েটা মেনে নিতে পারেন নি বলে মা-বাবার সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখেন নি। মা-বাবার বিয়ের পর পরই নাকি তারা নিজেদের ভিটেবাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। মা-বাবা আর তাদের ছেলে মেয়েরাও অনবরতঃ তোমাদের হদিশ পাবার চেষ্টা করে গেছেন। আজ এতদিন এত বছর বাদে তোমাকে পেয়ে আমাদের যে কত ভাল লাগছে, তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না”।
 

পিসির শারীরিক অবস্থার চিন্তা পরিতোষের মন থেকে যেন কিছুতেই সরছিল না। তাই ছোটবৌদির কথার কোন জবাব না দিয়ে সে বলল, “কিন্তু ছোটবৌদি, পিসির তো শুনেছি হাই প্রেসার। দাদু-ঠাকুমা, বাবা মা-র কথা গুলো শুনে .........”

ও’পাশ থেকে মেজবৌদি রুমা বলল, “ও’সব ব্যাপার নিয়ে আর চিন্তা নেই ঠাকুরপো। ডাক্তারবাবু সব কিছু সামলে নিয়েছেন। মা ইতিমধ্যেই সবকিছু জেনে গেছেন। দাদু-দিদা আর মামাবাবুর মৃত্যু সংবাদ শুনে একটু সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দু’মিনিট বাদেই ডাক্তারবাবু মা-কে স্বাভাবিক করে তুলেছেন। এখন তিনি ভাল আছেন। আর তার ভাইপো-কে চোখের দেখা দেখবার জন্য উতলা হয়ে আছেন। চলো, আর দেরী করা ঠিক হবে না। কি বলিস ছোটো”?

দেবিকাও তার কথায় সায় দিতে পরিতোষকে নিয়ে দুই জা লিফটের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। চারতলায় লিফটের দড়জা খুলতেই সামনে অনেক লোকের ভিড় দেখা গেল। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দুর পাশে বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ে, একজন বছর চল্লিশের ভদ্রমহিলা আর তার পেছনে আরও দু’জন মহিলাকে দেখা গেল। এই দু’জনের মধ্যে একজনকে সে গদির ঘরে তার জন্য খাবার নিয়ে যেতে দেখেছিল। সামনের ভদ্রমহিলাকে দেখে পরিতোষ মনে মনে ভাবল, ইনিই বোধহয় শ্যামলেন্দুর স্ত্রী, এ বাড়ির বড় পুত্রবধূ। রুমা আর দেবিকা প্রথমে লিফটের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর রুমা সেই ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ঠাকুরপো, ইনি আমাদের বড়দি। তোমার বড় বৌদি। আর এরা সকলেই এ বাড়ির ছেলে মেয়ে, তোমার ভাইপো ভাইঝি। ওদের সাথে পরে আলাপ করতে পারবে” বলেই তার বড়-জাকে বলল, “নাও বড়দি, এবার শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে আমাদের ঠাকুরপোকে ঘরে বরণ করে নাও”।

পরিতোষ নিচু হয়ে শ্যামলেন্দুর স্ত্রীকে প্রণাম করতে যেতেই ভদ্রমহিলা তার হাত ধরে বললেন, “না না, ভাই, এ কী করছ? প্রণাম করতে হবে না ভাই। তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াও” বলে মেজো-জা রুমার হাতে ধরা বরণডালার চন্দনের বাটি থেকে আঙুলের ডগায় একটু চন্দন নিয়ে পরিতোষের কপালে ফোঁটা এঁকে দিয়ে তার হাতে ধরা শাঁখে ফুঁ দিলেন। সাথে সাথে পেছনে দাঁড়ানো মহিলারা একযোগে উলুধ্বনি দিয়ে উঠল।
 

উলুদ্ধ্বনি আর শাঁখের ফুঁয়ের জোয়ার শুরু হতেই পরিতোষের চোখের আড়ালের কোনও এক জায়গা থেকে এক বৃদ্ধার গলা শোনা গেল, “আঃ, কেন আমাকে আটকাচ্ছ বল তো? আমি বলছি তো আমি ঠিক আছি। তোমরা বুঝতে পাচ্ছ না। কিন্তু আমি জানি, যে এসেছে সে শুধু আমার ভাইপো নয়। ওর চেহারাটা হয়ত আলাদা হবে। কিন্তু আজ এ মূহুর্তে ওর ভেতর আমার বাবার আত্মা অধিষ্ঠিত আছে। আমার বাবাই এত বছর বাদে আমায় ক্ষমা করবেন বলে এসেছেন। তাই, আমাকে যেতে দাও ওর কাছে, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে আর বাধা দিওনা দয়া করে। আমাকে ওর কাছে যেতে দাও”।
 

নিজেকে সামলে রাখবার অনেক চেষ্টা করেও পরিতোষ সফল হল না। নিজের চোখের জল লুকোতে চোখ বুজে মাথা নুইয়ে নিল। পরপর তিনবার উলুধ্বনি শেষ হবার পর সামনের সবাই পেছনে সরে যেতেই বড়বৌ সুলোচনা পরিতোষের একটা হাত ধরে বললেন, “এসো ঠাকুরপো”।
 

পরিতোষ এক পা এগোতেই একদিক থেকে নারীকন্ঠ ভেসে এল, “কৈ কোথায় সে? আমার দুর্গার ছেলে কোথায়”?

নতুন শোনা কন্ঠ যেদিক থেকে ভেসে এল সেদিকে চাইতেই দেখে এক বৃদ্ধা করিডোর দিয়ে এলোমেলো পায়ে লিফটের দিকে এগিয়ে আসছেন। তার একটি হাত নিরঞ্জনবাবু নিজে ধরে আছেন। আর অন্য হাতটি ধরে আছেন নিরঞ্জনবাবুর ছোট ছেলে অমলেন্দু। বৃদ্ধার ঠিক পেছনেই ডাক্তার বিশ্বাসকেও দেখা গেল।

পরিতোষের বুঝতে এক মূহুর্তও সময় লাগল না। এক অজানা শক্তি যেন তাকে সেই বৃদ্ধার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। পরিতোষ ছুটে বৃদ্ধার কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার শ্বাস প্রশ্বাস অসম্ভব রকমের দ্রুত হয়ে উঠল। বৃদ্ধা হৈমবতীদেবী নিজের একহাতে ধরে থাকা চশমাটা নিজের চোখে পড়তে পড়তে বললেন, “তুমি? তুমি বাবা? তুমিই আমার দুর্গার ছেলে”?

পরিতোষ বৃদ্ধার পায়ের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে তাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াবার আগেই হৈমবতীদেবী পরিতোষের মুখটাকে দু’হাতে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আয় বাবা, আমার বুকে আয়। চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমার বুকের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। তোকে বুকে চেপে ধরে আগে আমার বুকের সেই আগুনটাকে নিভিয়ে নিই”।

পরিতোষের মুখ দিয়ে কোন কথা সরছে না। কিন্তু দু’চোখ থেকে জলের ধারা বইতে শুরু করেছে। সে উঠে হৈমবতীদেবীর সামনে দাঁড়াতেই তিনি তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের বুকে চেপে ধরলেন। পরিতোষের হাত দুটোও যেন তার অজান্তেই হৈমবতীদেবীকে সাপটে ধরল। পরিতোষের শরীরের ভেতরে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। নিজের মাকে তো জন্মের পরেই হারিয়েছে। ঠাকুমার কথা অল্প অল্প মনে পড়ে। কিন্তু সেই ঠাকুমাকেও এভাবে জড়িয়ে ধরবার সুযোগ সে সত্যি কোনদিন পেয়েছে কিনা তা মনে করতে পারছিল না। তাই জ্ঞানতঃ নিজের রক্তের সম্পর্ক থাকা কোনও মহিলাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবার অভিজ্ঞতা তার জীবনে এইই প্রথম। তার মনে হচ্ছিল তার সারাটা শরীর জুড়ে যেন একটা শান্ত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। আর তার অনুভূতি যে ঠিক কেমন তা সে যেন বুঝতেই পারছিল না। কিন্তু তার মনটা যেন সারা জীবন ধরে এমন অনুভূতি পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল। তার মনে হল এ স্নিগ্ধতার তুলনা যেন কোন কিছুর সাথেই করা যায় না।
 

হৈমবতীদেবী পাগলের মত পরিতোষের গালে কপালে চুমু খাচ্ছিলেন। পরিতোষের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। আর মুখে বলছিলেন, “এতদিনে? এত বছর বাদে আমার ওপর তোমার অভিমান কমলো বাবা? কিন্তু আমি এতই অভাগী যে তুমি বেঁচে থাকতে আমাদের ক্ষমা করতে পারলে না। আর ক’টা দিনই বা আছে আমার পরমায়ু! তারপর তো পরলোকে তোমাদের সকলের সাথেই আবার আমার দেখা হত। আর ক’টা বছর আগে যদি ক্ষমা করতে, তাহলে আমার আদরের ভাইটা বড় হয়ে কেমন দেখতে হয়েছিল সেটা অন্ততঃ দেখতে পারতুম বাবা”।

পরিতোষের হাতের বাঁধনে হৈমবতীদেবীর শরীরটা শুরু থেকেই থরথর করে কাঁপছিল। তাই পরিতোষ চেয়েও নিজেকে তার পিসির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল, সে হাত সরিয়ে নিলেই তার পিসির দেহটা ঢলে পড়বে। সে পিসিকে আঁকড়ে ধরেই ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “হ্যাঁ, পিসি। আমি তোমার দুর্গার ছেলে পরিতোষ”।

পরিতোষ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তার পিঠের ওপর এতক্ষণ ঘুরতে থাকা হাত দুটো নিচের দিকে ঝুলে পড়ল। পিসির শরীরটাও যেন নিথর হয়ে গেল। তার শরীরটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। পরিতোষ শক্ত হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ডাক্তার বিশ্বাসের দিকে চেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “পিসি অজ্ঞান হয়ে গেছেন ডক্টর”।

ডক্টর বিশ্বাস তাড়াতাড়ি বললেন, “হ্যাঁ, বুঝেছি। তবে ঘাবড়াবেন না। ওনাকে ঘরে নিয়ে আসুন। এখনই একটা ইঞ্জেকশন পুশ করতে হবে” বলে পেছন ফিরে একটা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। পরিতোষ আর দেরী না করে হৈমবতীদেবীর শরীরটাকে পাঁজাকোলা করে ডাক্তারের পেছন পেছন সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল। তার পেছন পেছন বাড়ির প্রায় সকলেই ঘরের ভেতর এসে ঢুকল।

ডক্টর বিশ্বাস নিজের ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ বের করে তাতে ওষুধ ভরতে ভরতে বললেন, “ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিন। আর অন্যরা ঘরের সবগুলো জানালা খুলে দিন। দড়জার দিকে কেউ ভিড় করবেন না প্লীজ”।

পরিতোষ সযত্নে পিসির শরীরটাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু ঘরের জানালা গুলো খুলে দিলেন। ডাক্তার স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে হৈমবতীদেবীর বুকের স্পন্দন বুঝে নিয়ে তার হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করে তার পালস দেখতে দেখতে বললেন, “একটা গ্লাসে হাল্কা গরম জল, আর এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসুন, তাড়াতাড়ি” বলতে বলতে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ট্যাবলেট বের করলেন।

নিরঞ্জনবাবু হৈমবতীদেবীর বিছানার মাথার দিক থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বুঝছ ডাক্তার? কোন বিপদ হবে না তো”?

ডক্টর বিশ্বাস বললেন, “ভয় পাবেন না। কিচ্ছু হবে না। সাময়িক উত্তেজনাটা সইতে পারেননি বলেই এভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়েছেন। আশা করছি পাঁচ মিনিটের ভেতরেই সেন্স ফিরে আসবে”।
 

পরিতোষ তার পিসির শিয়রের কাছেই বসেছিল। মাথা ঘুড়িয়ে নিরঞ্জনবাবুর একটা হাত দু’হাতে নিজের হাতে ধরে বলল, “কি দরকার ছিল পিসেমশাই? আমি তো বলেই ছিলাম, আমি দুর থেকে পিসিকে একটা প্রণাম করেই চলে যাব। এভাবে তাকে বিপদে ফেলা কি ......”

তার কথার মাঝেই ডক্টর বিশ্বাস পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে মোলায়েম স্বরে বললেন, “মিস্টার সান্যাল, অত চিন্তা করবেন না। আমি বলছি তো, কোনও বিপদ হবে না। উনি আর একটু বাদেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমি দায়িত্ব নিয়ে এ’কথা দিচ্ছি আপনাকে। শি ইস পারফেক্টলি অলরাইট। এবার সেন্স ফিরে এলেই এই ট্যাবলেটটা খাইয়ে দিলেই এভরিথিং উইল বি ওকে। রিল্যাক্স প্লীজ”।
 

এমন সময় ছোটবৌ দু’হাতে দুটো গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বড়বৌ সুলোচনা একটা ছোট টেবিল খাটের পাশে রাখতে রাখতে পরিতোষের উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি শান্ত হও ঠাকুরপো। ডাক্তারবাবু মা-র নাড়ী নক্ষত্র সব কিছু চেনেন। উনি যখন অভয় দিচ্ছেন তাহলে আমাদের ভাববার কিছু নেই। তুমি বরং ততক্ষণ আমার সাথে এসো একটু”।

ছোটবৌ দেবিকা টেবিলের ওপর একটা জলের আরেকটা দুধের গ্লাস রাখতে পরিতোষ সুলোচনাকে বলল, “না বড়বৌদি, প্লীজ। পিসি সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত আমি এখান থেকে সরব না”।

ঠিক এমন সময়েই হৈমবতীদেবীর শরীরটা যেন একটু নড়ে উঠল। আর প্রায় সাথে সাথেই খুব দুর্বল গলায় তিনি বলে উঠলেন, “পরিতোষ, আমার দুর্গার ছেলে কোথায়? আমার ভাই দুর্গার ছেলে কি আবার আমাকে ছেড়ে চলে গেল”?

পরিতোষ সাথে সাথে হৈমবতীদেবীর হাতখানা ধরে বলল, “এই তো পিসি, এই তো আমি। তোমার পাশেই আছি, কোত্থাও যাইনি তো”।
 

ঘরের সকলের মুখেই স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। হৈমবতীদেবী পরিতোষের একটা হাত চেপে ধরে বলল, “তুই তোর হাতটা একটু আমার মাথায় রাখ না বাবা। তাহলে আমি বুঝব, বাবা আমাকে, তোর পিসেমশাইকে আর আমাদের ছেলেমেয়েদের সবাইকে মেনে নিয়েছেন”।

পরিতোষের দু’চোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রুধারা নেমে এল। হৈমবতীদেবী নিজেই পরিতোষের হাতটা নিজের মাথার ওপর চেপে ধরলেন। পরিতোষও নিজের হাতটা হৈমবতীদেবীর মাথায় চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি যে তোমাদের কারো নাম ঠিকানা কিচ্ছুটি জানতাম না পিসি। ছোটবেলায় বাবার মুখেই শুধু দু’একবার শুনেছি যে তার এক দিদি ছিল। আমি তো আর কিচ্ছুটি জানতাম না”।

এবার ডক্টর বিশ্বাস হৈমবতীদেবীকে বললেন, “আচ্ছা ভাইপোর সঙ্গে কথা তো রাতভর বলতে পারবেন বৌদি। আমি তো আর রাতভর এখানে বসে থাকতে পারব না। বেশী দেরী হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে যে বৌয়ের ঠ্যাঙ্গানি খেতে হবে। তাই এ ওষুধটা খেয়ে নিন তো দেখি”।

হৈমবতীদেবীকে ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে ডক্টর পরিতোষকে বলল, “মিঃ সান্যাল, এবার আপনি দুধটুকু আস্তে আস্তে আপনার পিসিকে খাইয়ে দিন। তাহলেই দশ মিনিট বাদে দেখবেন উনি বাড়িময় ছুটোছুটি শুরু করে দেবেন” বলে আরেকবার হৈমবতীদেবীর পালস দেখে সন্তুষ্ট মুখে উঠে পড়লেন।
 

যাবার আগে বড়বৌকে কিছু নির্দেশ দিয়ে পরিতোষের সাথে হ্যান্ডশেক করে ডক্টর বিশ্বাস বেরিয়ে গেলেন।


******************

ডাক্তারের কথাকে সত্যি প্রমাণিত করে হৈমবতীদেবী সত্যিই মিনিট দশেক বাদেই বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেই সারা বাড়িতে যেন উৎসবের ঢেউ বইতে শুরু করল। তিনি নিজেই পরিতোষের হাত ধরে গোটা বাড়িটা ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখাতে শুরু করলেন। পরিতোষও খুশী মনেই পিসির হাত ধরে ঘুরে ঘুরে সব দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, পিসি নন, হৈমবতীদেবী যেন তার নিজের মা। মায়েরা যেমন ছোট ছেলেকে হাত ধরে হাঁটা শেখান, হৈমবতীদেবীও যেন ঠিক তেমনটাই করছিলেন।
 

পরিতোষেরও যেন খুব ভাল লাগছিল। এমন ভাল লাগা তার জীবনে এর আগে আর কখনও সে পায়নি। কিন্তু কোন একদিকে শাঁখ আর কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠতেই তার মনে হল এ কি! এরই মধ্যে সন্ধ্যে হয়ে গেল! তার তো কালচিনি ফিরে যাবার কথা ছিল। আর সাথে সাথেই মনে পড়ল রচনার কথা। রচনাকে সে কথা দিয়েছিল যে পিসির সাথে দেখা হবার পর সে প্রথম খবরটা তাকেই জানাবে। অবশ্য খবর এখনও কাউকেই দেওয়া হয়নি। কিন্তু রচনা তো তখনই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছিল। আর বলেছিল, যতক্ষণ না পরিতোষের ফোন পায়, ততক্ষণ অব্দি সে প্রার্থনা করেই যাবে। ইশ, একেবারেই মনে ছিলনা কথাটা। পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে সুইচ অন করল। গদিঘর থেকে বৌদিদের সাথে লিফটে চেপে ওপরে আসবার সময়েই সে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিল।
 

কিন্তু ফোন করতে যাবার আগেই হৈমবতীদেবী তার হাত ধরে আরেকদিকে টানতে টানতে বললেন, “চল বাবা, আজ আমরা মায়ে পোয়ে একসাথে ঠাকুর প্রণাম করি গিয়ে”।

পরিতোষ মায়ের বাধ্য ছেলের মতই মোবাইল পকেটে রেখে পিসির হাত ধরে ঠাকুরঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দু’জনে ঠাকুর প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই বড়বৌ সারা বাড়িতে ধূপ আর প্রদীপ দেখিয়ে ঠাকুরঘরে এসে বললেন, “ও-ও তোমরা এখানে? আর আমি সারা বাড়িময় তোমাদের খুঁজে এলুম”।
 

হৈমবতীদেবী প্রদীপ আর ধূপের ওম পরিতোষের আর নিজের মাথায় মেখে নিতেই সুলোচনা বললেন, “মা, তুমি ঠাকুরপোকে নিয়ে এখন আর নিজের ঘরে না গিয়ে বরং বসবার ঘরে গিয়ে বসো। ছোটো আর মেজো চা জল খাবার বানিয়ে ওখানেই নিয়ে আসবে। সবাই একসাথে বসে ঠাকুরপোর গল্প শুনতে শুনতে খাব”।

পরিতোষ একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “কিন্তু পিসি, আমাকে যে এখন বেরোতে হবে। আমি কাকুকে কথা দিয়ে এসেছিলাম যে তোমাকে দেখে আমি আজই কালতচিনি ফিরে যাব”।

হৈমবতীদেবী পরিতোষের হাতটা নিজের হাতে ধরে রেখেই বললেন, “তুই তো বিধুর সাথে দেখা করতেই যাচ্ছিস, তাইনা বাবা? ভাবিস নে। আমি বিধুকে এখনই ফোন করে দিচ্ছি। ও কাল সকালেই এখানে এসে পড়বে দেখিস”।
 

পরিতোষ একটু চিন্তিতভাবে বলল, “কিন্তু পিসি, আজ রাতে কালচিনিতে কাটিয়ে কাল সকালেই আমাকে সেখান থেকে মালবাজার যেতে হবে একটা বিশেষ কাজে। মালবাজারের কাজ শেষ করেই আমি সেখান থেকে বাগডোগরা গিয়ে ফ্লাইটে কলকাতা চলে যাব। কালই আমার ছুটির শেষ দিন”।
 

পরিতোষের কথা শুনে বড়বৌ ঠাকুরের আসনের সামনে টুকিটাকি কাজ করতে করতেই পরিতোষের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। হৈমবতীদেবী পরিতোষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “চুয়াল্লিশটা বছর ধরে রোজ রাধামাধবের কাছে প্রার্থনা করতুম, আমি যেন আমার মা বাবা আর ভাইকে ফিরে পাই। এতগুলো বছরের ভেতর পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে গেছে। আমার মা, বাবা, ভাই, ভাইবৌ এক এক করে সকলকেই ভগবান তার কাছে টেনে নিয়েছেন। তবু তিনি আমার প্রার্থনায় সারা দেন নি। আজ যখন রাধামাধবের অসীম কৃপায় তোকে কাছে পেয়েছি, তখন একটা দিনও আমার কাছে থাকবি না বাবা? আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কি এখনও সম্পূর্ণ হল না”?

______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 29-03-2020, 12:14 AM



Users browsing this thread: 5 Guest(s)