29-03-2020, 12:13 AM
(Update No. 231)
নিরঞ্জনবাবু শান্ত কন্ঠেই বললেন, “কোনও অঘটণ যাতে না ঘটে সে জন্যেই তো ডাক্তারের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আগে আলোচনা করতে হচ্ছে। তারপর ডাক্তার যা পরামর্শ দেয় সে হিসেবেই আমাদের এগোতে হবে। আর সে’জন্যেই বাড়িতে আমরা এখনও পরিতোষের আসার খবরটা জানাই নি। আর এ ছেলেটাকে দ্যাখ, পিসির প্রেসার বেড়েছে শুনেই বলছে যে ও আর ওর পিসির মুখোমুখি হয়ে তাকে বিপদে ফেলতে চায় না। বলছে, দুর থেকে একবার ওর পিসিকে দেখেই এখানে থেকে নাকি চলে যাবে”।
শ্যামলেন্দু সে’কথা শুনে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “সে কি ভাই? এতগুলো বছর ধরে তোমাদের সবাইকে আমরা খুঁজে চলেছি। আজ তোমাকে পেয়েও আমরা আমাদের মায়ের কাছে তার ভাইপোকে নিয়ে যাব না? পরে যেদিন আমাদের মা এ’কথা জানতে পারবেন সেদিন কি আমরা তার সামনে আর মুখ উঁচু করে দাঁড়াতে পারব বলো? তুমি কিচ্ছু ভেব না। বাবা আর অমু তোমাকে এখানে রেখে সঠিক কাজটাই করেছে। ডাক্তারবাবু এলে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয়ই মাকে সুস্থ রাখবার উপায় বের করে আমাদের উচিৎ পরামর্শ দেবেন”।
বিমলেন্দু বললেন, “আর তাছাড়া, আমাদের ভাগ্যেই হয়ত ছিল যে দাদু, দিদিমা, মামা, মামী, কাউকেই আমরা চাক্ষুষ দেখতে পারব না। কিন্তু তুমিও তো আমাদের পর নও ভাই। আমাদের মায়ের সাথে তো তোমার রক্তের সম্পর্ক। আর সেটা খুব দুরের কোন সম্পর্কও নয়, খুবই কাছের। তোমার বাবার শরীরে যে রক্ত বইতো, সেই একই রক্ত তো আমাদের মায়ের শরীরেও বইছে। অবশ্য দাদু দিদিমা যে মা বাবার ওপর প্রচণ্ড অভিমান করেই আমাদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন, সে কথা তো আমরা সবাই জানি। তাদের মনে আমাদের মা-বাবার প্রতি তিক্ততা আর ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তোমার মনেও যদি তেমন তিক্ততা বা ঘৃণা থেকে থাকে, তাহলে ....”
ছেলের কথার মাঝপথেই নিরঞ্জনবাবু তাকে বাধে দিয়ে বলে উঠলেন, “ছিঃ বিমু, এ’সব কি বলছিস তুই? ও একটা ', সন্তান হয়েও না একটু আগেই তোদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিল! সেটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি? আরে ও বেচারা তো ছোটবেলাতেই নিজের মা, ঠাকুর্দা আর ঠাকুমাকে হারিয়ে বসেছে। ওর বাবাও ওকে ছেড়ে চলে গেছে প্রায় সাত বছর আগে। এই সাতটা বছর ধরে ছেলেটা নিজেকে অনাথ ভেবে আসছে। ও তো ওর পিসির নামটাও শোনেনি সারা জীবনে। ওর পিসির নাম যে হৈমবতী আর সে যে কুমারগ্রামের এক মণ্ডল পরিবারের নিরঞ্জন মণ্ডলকে বিয়ে করেছিল, সেটা তো ও কেবলমাত্র আজ দুপুরেই জানতে পেরেছে তোদের বিধুমামুর কাছ থেকে। আর আমাদের নাম পরিচয় ঠিকানা জানবার পর একটা মূহুর্তও ও আর নষ্ট করেনি। সোজা এখানে চলে এসেছে। আর তুই বলছিস, ওর মনে আমাদের প্রতি তিক্ততা বা ঘৃণা জমে আছে”?
পরিতোষ ততক্ষণে তার সাধ্যমত কিছুটা খাবার খেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বিমলেন্দুর কথাগুলো শুনেই তার হাত থেমে গিয়েছিল। বাথরুমে ঢুকে বেসিনে হাত ধুয়ে ঘরে ফিরে আসতেই বিমলেন্দু তার কাছে ছুটে এসে তার হাত ধরে অনুতপ্ত সুরে বললেন, “ভাই, আমি সবকিছু না জেনে না বুঝেই তোমার সম্পর্কে অনেক উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি। আমাকে সে’জন্যে ক্ষমা করো ভাই। আর শোনো, এতদিন নিজের সম্বন্ধে যা ভেবেছ তা ভেবেছ। কিন্তু আজকের পর থেকে নিজেকে কখনও আর অনাথ বলে ভাববে না। মনে রেখ, আজকের পর থেকে এ পৃথিবীতে তুমি আর একা নও। তোমার পিসি আছেন, পিসেমশাই আছেন। তোমার ওপর তিন তিনটে দাদা আছে। দু’ দু’টো দিদি আছে তোমার। কে বলেছে এ পৃথিবীতে তোমার আর কেউ নেই”?
পরিতোষ তার কথার কোন জবাব দেবার আগেই বিমলেন্দুর পকেটের মোবাইল বেজে উঠল। বিমলেন্দু মোবাইল বের করে তার দিকে তাকিয়েই নিরঞ্জনবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ বলো .... আরে না না সে’সব কিছু নয়। ব্যাবসা সংক্রান্ত ব্যাপারেই বাবা আমাকে আর বড়দাকে ডেকে পাঠিয়েছেন একটা ব্যাপারে একটু পরামর্শ করবার জন্য ..... সত্যি বলছি রে বাবা .... কিচ্ছু হয়নি ..... হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা ঠিক আছেন। আমরা সবাই মিলে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে বসেছি .... কি বললে?.... ও ও তাই বলো, আরে একজন অনেক দুর থেকে বাবার কাছে এসেছেন। তার দুপুরে খাওয়া হয়নি শুনেই বাবা তার জন্য বাড়ি থেকে খাবার পাঠাতে বলেছিলেন। এই তো উনি এইমাত্র খেয়ে উঠলেন, এখানেই আছেন এখনও ... আরে নারে বাবা, কিচ্ছু হয়নি .... হ্যাঁ? কী বললে? ডাক্তারের গাড়ি? আমাদের দোকানের সামনে? কিজানি, ডাক্তার বিশ্বাস তো এখানে আসেননি। হতে পারে আশে পাশে অন্য কোথাও এসেছেন কোনও কাজে। আচ্ছা এখন ফোনটা রাখো তো। এবার আমরা আলোচনায় বসব। বাকি কথা পরে শুনো, রাখছি”।
বিমলেন্দু ফোন বন্ধ করতে না করতেই অমলেন্দুর সাথে একজন বয়স্ক ডাক্তার ঘরে এসে ঢুকলেন। সবাই মিলে ডাক্তারকে গোটা ব্যাপারটা ভাল করে বিস্তারিত ভাবে বলবার পর তার পরামর্শ চাইল। ডাক্তার বিশ্বাস কয়েক মূহুর্ত খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভেবে বললেন, “ঠিক আছে মণ্ডলবাবু। আমি এখন আপনার ছোট ছেলেকে নিয়ে ওপরে যাচ্ছি। আগে আপনার মিসেসকে একটু চেকআপ করে দেখি। সবকিছু ভাল করে পরীক্ষা করবার পর প্রয়োজনীয় যা যা করবার করে নিচ্ছি। তারপর আমি খবর পাঠালে আপনারা মিঃ সান্যালকে নিয়ে ওপরে আসবেন। আর এরমধ্যে কোনও কারনে যদি আপনাদের কাউকে ওপরে যেতেই হয়, তাহলে এমন ভাব দেখাবেন যে আমি রেগুলার চেকআপ করতেই এখানে এসেছি। বাড়ির আর কেউ যেন এখনই মিঃ সান্যালের ব্যাপারে কিছু জানতে বা বুঝতে না পারেন”।
ডাক্তার বিশ্বাস উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ তার একটা হাত ধরে উদ্বিঘ্ন ভাবে বলল, “ডক্টর শুনুন, আমি কলকাতায় থাকি। পেশাগত ভাবে আমি একজন একজন পুলিস অফিসার। কলকাতার সমস্ত বড় বড় হাসপাতাল, নার্সিংহোম আর ডাক্তারদের সাথে আমার খুব ভাল পরিচয় আছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আপনি পরামর্শ দিলে আর এনারা সকলে চাইলে পিসিকে আমি কলকাতা নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু ডক্টর সবার আগে আমি আপনার ওপরেই ভরসা করছি। আপনিও যদি তেমনটা সাজেস্ট করেন, তাহলে সেটা আমি করতেই পারি। তবে ডক্টর যাকে আমি সারাজীবনে এর আগে কখনও দেখতে পাইনি, তাকে দেখব বলেই তার জীবনটাকে বিপন্ন করে তুলতে আমি কিন্তু একেবারেই চাইছি না। আমি চাই না, পিসি কোন বিপদের মুখোমুখি হোন। পিসি এতদিন মনে মনে যে ধারণা নিয়ে বেঁচে আছেন, সেভাবেই থাকুন। তার মা বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ তাকে নাহয় আমরা না-ই বা জানালাম। তাতে তো নতুন করে আর কোন ক্ষতি হবে না। আপনি যদি তেমন বোঝেন তাহলে নিচে এখানে একটা খবর পাঠিয়ে দেবেন প্লীজ। আমি পিসির সাথে দেখা না করেই এখান থেকে চলে যাব। তাহলে অন্ততঃ এ সান্ত্বনাটুকু তো আমি নিয়ে যেতে পারব, যে এখানে আমার পিসি আছেন, পিসেমশাই আছেন, দাদারা আছেন। আমি পৃথিবীতে এখনও পুরোপুরি অনাথ হয়ে যাইনি। ভগবান চাইলে নিশ্চয়ই আমি একদিন না একদিন আমার পিসিকে একটা প্রণাম করতে ঠিক পারব। প্লীজ ডক্টর, আপনি আমার এ অনুরোধটুকু রাখবেন প্লীজ” বলতে বলতে পরিতোষের গলা ধরে এল। তার চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল।
ডক্টর বিশ্বাস পরিতোষের একটা হাত নিজের দু’হাতে ধরে খুব ধীর স্থির ভাবে বললেন, “এত উতলা হবেন না মিঃ সান্যাল। আমি এনাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। আপনার পিসি আমার অনেকদিনের পুরোন পেশেন্ট। তাই তার ফিজিকাল কন্ডিশন সম্বন্ধে আমি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। আমি প্রতি সপ্তাহেই তাকে রুটিন মাফিক চেক করতে আসি। এতদিন উনি মোটামুটি ঠিকই ছিলেন। শুধু গত সপ্তাহেই তার প্রেসারটা সামান্য বেড়ে ছিল। আর আমি তার যথাযথ ওষুধও দিয়েছি। আশা করি তার প্রেসার হয়ত এ’ ক’দিনে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবু আজকের এমন পরিস্থিতিতে ওনারা আগে থাকতেই আমার সাথে কন্টাক্ট করে খুব ভাল করেছেন। আমি আশা করছি, সব দিক সামলে নিতে পারব। আর অমুর মুখে ফোনে ডিটেইলটা শুনে আমি সব রকম ভাবে প্রস্তুত হয়েই এসেছি” বলে একটু থামলেন। তারপর আবার পরিতোষের মুখের দিকে চেয়ে খুব নরম গলায় বললেন, “তবে, আপনার কথায় আমি সত্যি খুব অবাক হলাম মিঃ সান্যাল। আমার পঁয়ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারে আমি নানান অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আমি কোনদিন পড়িনি। আমার সামনেও আজ একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে আমার নিজের ওপর যতটুকু ভরসা আছে, তার ওপর ভিত্তি করেই বলছি, আমি এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পারব। আপনি নিজেকে শান্ত রাখবার চেষ্টা করুন। কেমন”?
ডক্টর বিশ্বাস নিজের ব্যাগটা নিয়ে অমলেন্দুর সাথে পেছনের দড়জার দিকে এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ পেছন ফিরে বিমলেন্দুকে বললেন, “ওহ, বিমলেন্দু, একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। আমার গাড়ির চাবিটা তোমার হাতে রাখ। পেছনের ডিকিতে একটা অক্সিজেন সিলিণ্ডার আছে। সঙ্গে একটা প্যাকেটে এক্সেসরি গুলোও রাখা আছে। ভগবান না করুন, আমি যদি সিলিণ্ডার চেয়ে পাঠাঁই তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই সিলিণ্ডার আর প্যাকেটটা ওপরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করবে, কেমন”? বলে বিমলেন্দুর হাতে চাবি দিয়ে আবারও পরিতোষের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “রিল্যাক্স মিঃ সান্যাল। প্রে টু গড ফর দা বেস্ট”।
পরিতোষ নিজের চোখ মুছতে মুছতেই মাথা ঝাঁকাল। আর ঠিক তখনই তার পকেটের একটা মোবাইল বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে সীমন্তিনীর ফোন। ফোনটা সাথে সাথে কেটে দিল। এই মূহুর্তে কারো সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তার। বিমলেন্দু আর শ্যামলেন্দু দু’জনেই পরিতোষের দুটো হাত ধরে আবার গদিতে বসতে বসতে বললেন, “এত চিন্তা কোর না ভাই। ডাক্তার বিশ্বাস মা-র সমস্ত নারী নক্ষত্র জানেন। উনি ঠিক সামলে নেবেন সবটা দেখো”।
পরিতোষ এই মূহুর্তে নিজের মনের পরিস্থিতি কাউকে খুলে বলতে পারবে না। দুই দাদার কথা শুনে মুখে জোর করেই একটুখানি হাসি ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করতেই পকেটের মোবাইল আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে এবারেও সীমন্তিনীর ফোন। আবার কল রিজেক্ট করে দিতেই নিরঞ্জনবাবু তার কাঁধে হাত রেখে মোলায়েম স্বরে বললেন, “বাবা পরিতোষ, এতোটা অস্থির হয়ো না বাবা। একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করো। টেনশনে তো আমরা সকলেই আছি। তবে আমার মন বলছে, তুমি নিশ্চয়ই খানিক বাদেই তোমার পিসিকে দেখতে পারবে। এতগুলো বছর বাদে আজকের এই দিনটা আমাদের সকলের জীবনে ভগবান যখন এনেই দিয়েছেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, আজ খারাপ কিছু হবে না। তবে আমার মনে হয় তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে এস। আর কে তোমাকে বারবার ফোন করছে, তার সাথে একটু কথা বলে নাও। তাহলে একটু হলেও তোমার টেনশনটা কমবে”।
নিরঞ্জনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই পরিতোষের পকেটের মোবাইল আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে এবার কিংশুকের ফোন। আবার কল রিজেক্ট করে দিল সে। নিরঞ্জনবাবু তখন তার বড়ছেলেকে বললেন, “শামু, তুই ওকে নিয়ে একটু বাইরে যা। আর পরিতোষ, ওঠো বাবা তুমি। যারা ফোন করছে তোমায় বারবার, বাইরে গিয়ে একটু হাওয়ায় দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলে এসো। যাও বাবা”।
পরিতোষ নিজের অনিচ্ছা সত্বেও নিরঞ্জনবাবুর কথা মেনে নিজের ব্যাগটা গদির ওপর রেখেই শ্যামলেন্দুর সাথে বাইরের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে এসেই শ্যামলেন্দু জিজ্ঞেস করলেন, “আমি হয়ত চিনব না ভাই। তবু জিজ্ঞেস করছি, কে বারবার তোমাকে ফোন করছে”?
পরিতোষ মোবাইলটা হাতে রেখেই একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, “কাল নাগরাকাটায় আমি যে বন্ধুর ওখানে ছিলাম সে, আর কালচিনি থেকে কাকুর ছেলে। আমি কালচিনি থেকে চলে আসবার পর তাদের কাউকে কোনও খবর দিই নি। তাই হয়ত তারা সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তায় আছেন”।
শ্যামলেন্দু সে’কথা শুনে বললেন, “তুমি ভাই, তোমার বন্ধুকে ফোন করে বলে দাও, যে তুমি আমাদের এখানে পৌঁছে গেছ। আর ঠিক আছ। তাহলে তারা নিশ্চিন্ত হবেন। আর বিধুমামুর ছেলের নাম্বার আমার কাছে আছে। আমি তাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি” বলে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে পরিতোষের কাছ থেকে কয়েক ফুট দুরে চলে গেলেন।
পরিতোষ একটু ম্লান হেসে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করবার আগেই আবার সেটা বেজে উঠল। এবার রচনার ফোন দেখে কলটা রিসিভ করে কানে ফোন লাগাতেই ও’পাশ থেকে রচনা উদ্বিঘ্ন কন্ঠে বলে উঠল, “পরিদা, কোথায় আছ গো তুমি? কেউ তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না কেন? তুমি কেন আলিপুরদুয়ার গিয়েছ, মা-বাবার মুখে সে’সব কথাই আমি শুনেছি। কিন্তু ও’খানে গিয়ে তুমি কাউকে কিচ্ছু জানাওনি এখনও পর্যন্ত। সবাই যে দুশ্চিন্তা করছেন। তুমি ঠিক আছ তো পরিদা? ওখানে গিয়ে কোনও ঝামেলায় পড়নি তো”?
পরিতোষ নিজের গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে জবাবে বলল, “রচু, সোনা বোন আমার। আমি একদম ঠিক আছি। আসলে এখানে এসে প্রথমবার নিজের অনেক আত্মীয় স্বজন দেখতে পেয়ে কাউকে ফোন করবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মানে যখন থেকে বোধবুদ্ধি হয়েছে তখন থেকে তো বাবা ছাড়া আর কাউকে চোখেই দেখিনি। এখন পিসি, পিসেমশাই আর তিন তিনটে দাদা পেয়ে নিজেই যেন কেমন হকচকিয়ে গিয়েছি আমি। তাই কাউকে ফোন করবার কথা মনেও আসেনি। আর সবার সাথে কথাবার্তায় এমনভাবে ব্যস্ত আছি যে মন্তি আর কিংশুকের ফোন কলও রিজেক্ট করে দিতে বাধ্য হয়েছি। সরি”।
রচনা পরিতোষের কথা শুনে বলল, “তোমার গলাটা কেমন যেন লাগছে পরিদা। তুমি ঠিক আছ তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? তোমার পিসি পিসেমশাই কি তোমার সাথে ভাল ব্যবহার করেন নি? তেমন হলে তুমি এখনও কেন আলিপুরদুয়ারে বসে আছ? কালচিনি বা নাগরাকাটায় ফিরে যাচ্ছ না কেন”?
পরিতোষ নিজের গলার স্বর স্বাভাবিক রাখবার চেষ্টা করতে করতে জবাব দিল, “না রে বোন, একেবারেই তা নয়। পিসেমশাই আর দাদারা সকলেই আমাকে খুব আদর আপ্যায়ন করেছেন। সব কথা তো এখনই তোমাকে ফোনে খুলে বলা সম্ভব নয় বোন। তবে পিসিকে এখনও দেখতে পাই নি। আসলে পিসির তো বয়স হয়েছে। ইদানীং তার নাকি প্রেসার বেড়েছে। তাই আমাকে দেখবার সাথে সাথেই পিসি যখন জানতে পারবেন যে তার বাবা, মা, ভাই, ভাইয়ের বৌ এরা কেউ আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই তখন তো তিনি বিরাট একটা দুঃখ পাবেন। সেই ধাক্কাটা তিনি সামলে নিতে পারবেন কি না, এটা ভেবেই পিসেমশাই আর দাদাদের সাথে যুক্তি পরামর্শ করছি। আর পিসিকে যে ডাক্তার নিয়মিত দেখেন, তাকেও ডেকে আনা হয়েছে। এখন ওই ডাক্তারবাবু পিসিকে পরীক্ষা করে দেখছেন। খানিকবাদে উনি যেমন সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা তেমনই করব। তাই এই মূহুর্তে আমি মন্তি আর কিংশুকের কলটা রিজেক্ট করে দিয়েছি”।
রচনা পরিতোষের কথা শুনে বলল, “ও-ও, বুঝেছি। তুমি নিজেও এ মূহুর্তে বেশ টেনশনে আছ। তা তোমার পিসির বয়স কত হয়েছে গো পরিদা”?
পরিতোষ জবাবে বলল, “কালচিনিতেই কাকু বলেছিলেন, পিসির বর্তমান বয়স প্রায় বাষট্টি। কিন্তু পিসির যে প্রেসার বেড়েছে, এ খবরটা বোধহয় কাকুও জানতেন না। আর এই মূহুর্তে কারো সাথে ফোনে কথা বলতেও আমার ইচ্ছে করছে না। তাই মন্তি আর কিংশুকের কলগুলো আমি রিজেক্ট করে দিয়েছি। তারপর পিসেমশাই বারবার করে ফোন কলের জবাব দিতে বলাতেই এই মূহুর্তে আমি বাড়ির বাইরে আসবার সাথে সাথেই তোমার কল পেলাম। তাই তোমাকে একটা অনুরোধ করছি বোন। তুমি প্লীজ মন্তি আর ....”
তার কথার মাঝেই রচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি কিচ্ছু ভেবো না পরিদা। তোমার পিসির কিচ্ছু হবে না। আমি বলছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখো তুমি জীবনে প্রথমবার তোমার পিসির আদর পাবে। আর আমি এখনই কালচিনি আর নাগরাকাটায় ফোন করে বলে দিচ্ছি। তারাও কেউ তোমাকে ফোন করে এখন আর ডিস্টার্ব করবেন না। তুমিও নিজের মনটাকে শান্ত করো। তবে পিসির সাথে দেখা হবার পর তোমার ফুরসৎ মত তুমি কিন্তু আমায় একটি বার ফোন করবে। কথা দাও আমাকে, প্লীজ”।
পরিতোষ আবেগে বুজে আসা গলায় কোন রকমে বলল, “ঠিক আছে সোনা বোন। কথা দিলাম”।
রচনা আবার বলল, “আর হ্যাঁ, শোনো পরিদা। আমি দিদিভাই আর ভাইকে তোমার খবর জানিয়েই এখনই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসব। তোমার আর তোমার পিসির জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব। তোমার ফোন না পাওয়া অব্দি আমি কিন্তু প্রার্থনা করতেই থাকব। তাই পিসির সাথে দেখা হবার পর একটা ফোন কিন্তু অবশ্যই করবে। বুঝেছ”?
পরিতোষ আবার রূদ্ধ গলায় বলল, “হ্যাঁ বোন। করব”।
রচনা এবার বলল, “এবার মনটাকে শান্ত করো। আর ভেতরে গিয়ে দেখো, নিশ্চয়ই এতক্ষণে ডাক্তার তোমার জন্যে সুখবর পাঠিয়েছেন। আমিও ঠাকুরঘরে চলে এসেছি। তুমি ভেতরে ঢোকো” বলে ফোন কেটে দিল।
পরিতোষ ফোন নামাতেই শ্যামলেন্দু কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কে ফোন করেছিল? তোমার কোনও বন্ধু”?
পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “ভেতরে থাকতে প্রথম ফোনটা করেছিল আমার এক কলীগ বন্ধু, নাগরাকাটা থানার ওএসডি। আর পরের বার ফোন করেছিল কালচিনির বিধুকাকুর ছেলে। কিন্তু এবারে যার সাথে কথা হল সে বিধুকাকুর ছোট মেয়ে রচনা। ওরা কলকাতাতেই থাকে। কয়েক মাস আগে থেকেই আমি ওদেরকে চিনি। আমাকে দাদার মত শ্রদ্ধা করে মেয়েটা। খুব ভালবাসে আমাকে”।
শ্যামলেন্দু ভুরু কুঁচকে বললেন, “নাগরাকাটা থানার ওএসডি তো এক মহিলা। সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি। বড্ড জাদরেল এবং সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে তার খুব সুনাম আছে এ তল্লাটে। তিনিই কি তোমাকে ফোন করেছিলেন”?
পরিতোষ একটু অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ দাদা, ওকে সংক্ষেপে আমরা মন্তি বলে ডাকি। এখন আমি যার সাথে কথা বললাম, মানে বিধুকাকুর ছোটমেয়ে রচনা, এই রচনা হল সীমন্তিনীর বৌদি। সীমন্তিনীর সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই রচনা আর বিধুকাকুর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে” বলে একটু থেমে শ্যামলেন্দু আবার কিছু বলবার আগেই পরিতোষ বলল, “বড়দা, আমার মনে হয়, এবার আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিৎ। ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই এতক্ষণে কোনও খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন”।
শ্যামলেন্দুও পরিতোষের কথায় সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। চলো। আমিও কিংশুককে ফোনে তোমার এখানে এসে পৌঁছনোর কথা জানিয়ে দিয়েছি। ওরাও তোমার জন্যে চিন্তায় ছিল। তবে তোমাকে আরেকটা কথা আমার বলবার আছে ভাই। অবশ্য সেটা পরে বললেও চলবে। যদি আমি ভুলে যাই তাহলে একটু মনে করিয়ে দিও ভাই। চল এবার ভেতরে যাই”।
শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ভেতরে গদীর ঘরে ঢুকতেই দেখল সেখানে নিরঞ্জনবাবু, অমলেন্দু, বিমলেন্দু ছাড়াও আরও দু’জন বিবাহিতা ভদ্রমহিলা হাতে বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর সকলেরই মুখ চোখ খুশীতে উদ্ভাসিত। পরিতোষ আর শ্যামলেন্দু গদি ঘরে ঢুকতেই নিরঞ্জনবাবু গদি থেকে নেমে পরিতোষের হাত ধরে বললেন, “এসো পরিতোষ এসো বাবা” বলে বিবাহিতা মহিলা দু’জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেজ বৌমা, ছোট বৌমা, এই হল তোমাদের দেবর, পরিতোষ। আর পরিতোষ এরা তোমার দুই বৌদি। এ রুমা, তোমার মেজদা বিমলেন্দুর স্ত্রী, আর ও হচ্ছে তোমার ছোটবৌদি, অমুর স্ত্রী দেবিকা”।
পরিতোষের মনে হল তার মেজ বৌদি তার চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড় হলেও ছোটবৌদি দেবিকা বোধহয় তার সমবয়সীই হবে। দুই বৌদির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই দু’জনেই ছিটকে পেছনে সরে গেলেন। মেজবৌদি মিষ্টি হেসে বললেন, “তোমার প্রণাম নিলে তো তোমাকে আশীর্বাদও করতে হবে ভাই। কিন্তু দেখছ তো আমাদের দু’জনেরই হাত জোড়া। তাই আশীর্বাদ তো করতে পারব না এখন। এখন আমাদের যা করণীয় সেটাই বরং করতে দাও”।
ss_sexy
নিরঞ্জনবাবু শান্ত কন্ঠেই বললেন, “কোনও অঘটণ যাতে না ঘটে সে জন্যেই তো ডাক্তারের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আগে আলোচনা করতে হচ্ছে। তারপর ডাক্তার যা পরামর্শ দেয় সে হিসেবেই আমাদের এগোতে হবে। আর সে’জন্যেই বাড়িতে আমরা এখনও পরিতোষের আসার খবরটা জানাই নি। আর এ ছেলেটাকে দ্যাখ, পিসির প্রেসার বেড়েছে শুনেই বলছে যে ও আর ওর পিসির মুখোমুখি হয়ে তাকে বিপদে ফেলতে চায় না। বলছে, দুর থেকে একবার ওর পিসিকে দেখেই এখানে থেকে নাকি চলে যাবে”।
শ্যামলেন্দু সে’কথা শুনে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “সে কি ভাই? এতগুলো বছর ধরে তোমাদের সবাইকে আমরা খুঁজে চলেছি। আজ তোমাকে পেয়েও আমরা আমাদের মায়ের কাছে তার ভাইপোকে নিয়ে যাব না? পরে যেদিন আমাদের মা এ’কথা জানতে পারবেন সেদিন কি আমরা তার সামনে আর মুখ উঁচু করে দাঁড়াতে পারব বলো? তুমি কিচ্ছু ভেব না। বাবা আর অমু তোমাকে এখানে রেখে সঠিক কাজটাই করেছে। ডাক্তারবাবু এলে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয়ই মাকে সুস্থ রাখবার উপায় বের করে আমাদের উচিৎ পরামর্শ দেবেন”।
বিমলেন্দু বললেন, “আর তাছাড়া, আমাদের ভাগ্যেই হয়ত ছিল যে দাদু, দিদিমা, মামা, মামী, কাউকেই আমরা চাক্ষুষ দেখতে পারব না। কিন্তু তুমিও তো আমাদের পর নও ভাই। আমাদের মায়ের সাথে তো তোমার রক্তের সম্পর্ক। আর সেটা খুব দুরের কোন সম্পর্কও নয়, খুবই কাছের। তোমার বাবার শরীরে যে রক্ত বইতো, সেই একই রক্ত তো আমাদের মায়ের শরীরেও বইছে। অবশ্য দাদু দিদিমা যে মা বাবার ওপর প্রচণ্ড অভিমান করেই আমাদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন, সে কথা তো আমরা সবাই জানি। তাদের মনে আমাদের মা-বাবার প্রতি তিক্ততা আর ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তোমার মনেও যদি তেমন তিক্ততা বা ঘৃণা থেকে থাকে, তাহলে ....”
ছেলের কথার মাঝপথেই নিরঞ্জনবাবু তাকে বাধে দিয়ে বলে উঠলেন, “ছিঃ বিমু, এ’সব কি বলছিস তুই? ও একটা ', সন্তান হয়েও না একটু আগেই তোদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিল! সেটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি? আরে ও বেচারা তো ছোটবেলাতেই নিজের মা, ঠাকুর্দা আর ঠাকুমাকে হারিয়ে বসেছে। ওর বাবাও ওকে ছেড়ে চলে গেছে প্রায় সাত বছর আগে। এই সাতটা বছর ধরে ছেলেটা নিজেকে অনাথ ভেবে আসছে। ও তো ওর পিসির নামটাও শোনেনি সারা জীবনে। ওর পিসির নাম যে হৈমবতী আর সে যে কুমারগ্রামের এক মণ্ডল পরিবারের নিরঞ্জন মণ্ডলকে বিয়ে করেছিল, সেটা তো ও কেবলমাত্র আজ দুপুরেই জানতে পেরেছে তোদের বিধুমামুর কাছ থেকে। আর আমাদের নাম পরিচয় ঠিকানা জানবার পর একটা মূহুর্তও ও আর নষ্ট করেনি। সোজা এখানে চলে এসেছে। আর তুই বলছিস, ওর মনে আমাদের প্রতি তিক্ততা বা ঘৃণা জমে আছে”?
পরিতোষ ততক্ষণে তার সাধ্যমত কিছুটা খাবার খেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বিমলেন্দুর কথাগুলো শুনেই তার হাত থেমে গিয়েছিল। বাথরুমে ঢুকে বেসিনে হাত ধুয়ে ঘরে ফিরে আসতেই বিমলেন্দু তার কাছে ছুটে এসে তার হাত ধরে অনুতপ্ত সুরে বললেন, “ভাই, আমি সবকিছু না জেনে না বুঝেই তোমার সম্পর্কে অনেক উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি। আমাকে সে’জন্যে ক্ষমা করো ভাই। আর শোনো, এতদিন নিজের সম্বন্ধে যা ভেবেছ তা ভেবেছ। কিন্তু আজকের পর থেকে নিজেকে কখনও আর অনাথ বলে ভাববে না। মনে রেখ, আজকের পর থেকে এ পৃথিবীতে তুমি আর একা নও। তোমার পিসি আছেন, পিসেমশাই আছেন। তোমার ওপর তিন তিনটে দাদা আছে। দু’ দু’টো দিদি আছে তোমার। কে বলেছে এ পৃথিবীতে তোমার আর কেউ নেই”?
পরিতোষ তার কথার কোন জবাব দেবার আগেই বিমলেন্দুর পকেটের মোবাইল বেজে উঠল। বিমলেন্দু মোবাইল বের করে তার দিকে তাকিয়েই নিরঞ্জনবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ বলো .... আরে না না সে’সব কিছু নয়। ব্যাবসা সংক্রান্ত ব্যাপারেই বাবা আমাকে আর বড়দাকে ডেকে পাঠিয়েছেন একটা ব্যাপারে একটু পরামর্শ করবার জন্য ..... সত্যি বলছি রে বাবা .... কিচ্ছু হয়নি ..... হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা ঠিক আছেন। আমরা সবাই মিলে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে বসেছি .... কি বললে?.... ও ও তাই বলো, আরে একজন অনেক দুর থেকে বাবার কাছে এসেছেন। তার দুপুরে খাওয়া হয়নি শুনেই বাবা তার জন্য বাড়ি থেকে খাবার পাঠাতে বলেছিলেন। এই তো উনি এইমাত্র খেয়ে উঠলেন, এখানেই আছেন এখনও ... আরে নারে বাবা, কিচ্ছু হয়নি .... হ্যাঁ? কী বললে? ডাক্তারের গাড়ি? আমাদের দোকানের সামনে? কিজানি, ডাক্তার বিশ্বাস তো এখানে আসেননি। হতে পারে আশে পাশে অন্য কোথাও এসেছেন কোনও কাজে। আচ্ছা এখন ফোনটা রাখো তো। এবার আমরা আলোচনায় বসব। বাকি কথা পরে শুনো, রাখছি”।
বিমলেন্দু ফোন বন্ধ করতে না করতেই অমলেন্দুর সাথে একজন বয়স্ক ডাক্তার ঘরে এসে ঢুকলেন। সবাই মিলে ডাক্তারকে গোটা ব্যাপারটা ভাল করে বিস্তারিত ভাবে বলবার পর তার পরামর্শ চাইল। ডাক্তার বিশ্বাস কয়েক মূহুর্ত খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভেবে বললেন, “ঠিক আছে মণ্ডলবাবু। আমি এখন আপনার ছোট ছেলেকে নিয়ে ওপরে যাচ্ছি। আগে আপনার মিসেসকে একটু চেকআপ করে দেখি। সবকিছু ভাল করে পরীক্ষা করবার পর প্রয়োজনীয় যা যা করবার করে নিচ্ছি। তারপর আমি খবর পাঠালে আপনারা মিঃ সান্যালকে নিয়ে ওপরে আসবেন। আর এরমধ্যে কোনও কারনে যদি আপনাদের কাউকে ওপরে যেতেই হয়, তাহলে এমন ভাব দেখাবেন যে আমি রেগুলার চেকআপ করতেই এখানে এসেছি। বাড়ির আর কেউ যেন এখনই মিঃ সান্যালের ব্যাপারে কিছু জানতে বা বুঝতে না পারেন”।
ডাক্তার বিশ্বাস উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ তার একটা হাত ধরে উদ্বিঘ্ন ভাবে বলল, “ডক্টর শুনুন, আমি কলকাতায় থাকি। পেশাগত ভাবে আমি একজন একজন পুলিস অফিসার। কলকাতার সমস্ত বড় বড় হাসপাতাল, নার্সিংহোম আর ডাক্তারদের সাথে আমার খুব ভাল পরিচয় আছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আপনি পরামর্শ দিলে আর এনারা সকলে চাইলে পিসিকে আমি কলকাতা নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু ডক্টর সবার আগে আমি আপনার ওপরেই ভরসা করছি। আপনিও যদি তেমনটা সাজেস্ট করেন, তাহলে সেটা আমি করতেই পারি। তবে ডক্টর যাকে আমি সারাজীবনে এর আগে কখনও দেখতে পাইনি, তাকে দেখব বলেই তার জীবনটাকে বিপন্ন করে তুলতে আমি কিন্তু একেবারেই চাইছি না। আমি চাই না, পিসি কোন বিপদের মুখোমুখি হোন। পিসি এতদিন মনে মনে যে ধারণা নিয়ে বেঁচে আছেন, সেভাবেই থাকুন। তার মা বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ তাকে নাহয় আমরা না-ই বা জানালাম। তাতে তো নতুন করে আর কোন ক্ষতি হবে না। আপনি যদি তেমন বোঝেন তাহলে নিচে এখানে একটা খবর পাঠিয়ে দেবেন প্লীজ। আমি পিসির সাথে দেখা না করেই এখান থেকে চলে যাব। তাহলে অন্ততঃ এ সান্ত্বনাটুকু তো আমি নিয়ে যেতে পারব, যে এখানে আমার পিসি আছেন, পিসেমশাই আছেন, দাদারা আছেন। আমি পৃথিবীতে এখনও পুরোপুরি অনাথ হয়ে যাইনি। ভগবান চাইলে নিশ্চয়ই আমি একদিন না একদিন আমার পিসিকে একটা প্রণাম করতে ঠিক পারব। প্লীজ ডক্টর, আপনি আমার এ অনুরোধটুকু রাখবেন প্লীজ” বলতে বলতে পরিতোষের গলা ধরে এল। তার চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল।
ডক্টর বিশ্বাস পরিতোষের একটা হাত নিজের দু’হাতে ধরে খুব ধীর স্থির ভাবে বললেন, “এত উতলা হবেন না মিঃ সান্যাল। আমি এনাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। আপনার পিসি আমার অনেকদিনের পুরোন পেশেন্ট। তাই তার ফিজিকাল কন্ডিশন সম্বন্ধে আমি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। আমি প্রতি সপ্তাহেই তাকে রুটিন মাফিক চেক করতে আসি। এতদিন উনি মোটামুটি ঠিকই ছিলেন। শুধু গত সপ্তাহেই তার প্রেসারটা সামান্য বেড়ে ছিল। আর আমি তার যথাযথ ওষুধও দিয়েছি। আশা করি তার প্রেসার হয়ত এ’ ক’দিনে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবু আজকের এমন পরিস্থিতিতে ওনারা আগে থাকতেই আমার সাথে কন্টাক্ট করে খুব ভাল করেছেন। আমি আশা করছি, সব দিক সামলে নিতে পারব। আর অমুর মুখে ফোনে ডিটেইলটা শুনে আমি সব রকম ভাবে প্রস্তুত হয়েই এসেছি” বলে একটু থামলেন। তারপর আবার পরিতোষের মুখের দিকে চেয়ে খুব নরম গলায় বললেন, “তবে, আপনার কথায় আমি সত্যি খুব অবাক হলাম মিঃ সান্যাল। আমার পঁয়ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারে আমি নানান অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আমি কোনদিন পড়িনি। আমার সামনেও আজ একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে আমার নিজের ওপর যতটুকু ভরসা আছে, তার ওপর ভিত্তি করেই বলছি, আমি এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পারব। আপনি নিজেকে শান্ত রাখবার চেষ্টা করুন। কেমন”?
ডক্টর বিশ্বাস নিজের ব্যাগটা নিয়ে অমলেন্দুর সাথে পেছনের দড়জার দিকে এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ পেছন ফিরে বিমলেন্দুকে বললেন, “ওহ, বিমলেন্দু, একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। আমার গাড়ির চাবিটা তোমার হাতে রাখ। পেছনের ডিকিতে একটা অক্সিজেন সিলিণ্ডার আছে। সঙ্গে একটা প্যাকেটে এক্সেসরি গুলোও রাখা আছে। ভগবান না করুন, আমি যদি সিলিণ্ডার চেয়ে পাঠাঁই তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই সিলিণ্ডার আর প্যাকেটটা ওপরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করবে, কেমন”? বলে বিমলেন্দুর হাতে চাবি দিয়ে আবারও পরিতোষের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “রিল্যাক্স মিঃ সান্যাল। প্রে টু গড ফর দা বেস্ট”।
পরিতোষ নিজের চোখ মুছতে মুছতেই মাথা ঝাঁকাল। আর ঠিক তখনই তার পকেটের একটা মোবাইল বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে সীমন্তিনীর ফোন। ফোনটা সাথে সাথে কেটে দিল। এই মূহুর্তে কারো সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তার। বিমলেন্দু আর শ্যামলেন্দু দু’জনেই পরিতোষের দুটো হাত ধরে আবার গদিতে বসতে বসতে বললেন, “এত চিন্তা কোর না ভাই। ডাক্তার বিশ্বাস মা-র সমস্ত নারী নক্ষত্র জানেন। উনি ঠিক সামলে নেবেন সবটা দেখো”।
পরিতোষ এই মূহুর্তে নিজের মনের পরিস্থিতি কাউকে খুলে বলতে পারবে না। দুই দাদার কথা শুনে মুখে জোর করেই একটুখানি হাসি ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করতেই পকেটের মোবাইল আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে এবারেও সীমন্তিনীর ফোন। আবার কল রিজেক্ট করে দিতেই নিরঞ্জনবাবু তার কাঁধে হাত রেখে মোলায়েম স্বরে বললেন, “বাবা পরিতোষ, এতোটা অস্থির হয়ো না বাবা। একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করো। টেনশনে তো আমরা সকলেই আছি। তবে আমার মন বলছে, তুমি নিশ্চয়ই খানিক বাদেই তোমার পিসিকে দেখতে পারবে। এতগুলো বছর বাদে আজকের এই দিনটা আমাদের সকলের জীবনে ভগবান যখন এনেই দিয়েছেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, আজ খারাপ কিছু হবে না। তবে আমার মনে হয় তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে এস। আর কে তোমাকে বারবার ফোন করছে, তার সাথে একটু কথা বলে নাও। তাহলে একটু হলেও তোমার টেনশনটা কমবে”।
নিরঞ্জনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই পরিতোষের পকেটের মোবাইল আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে এবার কিংশুকের ফোন। আবার কল রিজেক্ট করে দিল সে। নিরঞ্জনবাবু তখন তার বড়ছেলেকে বললেন, “শামু, তুই ওকে নিয়ে একটু বাইরে যা। আর পরিতোষ, ওঠো বাবা তুমি। যারা ফোন করছে তোমায় বারবার, বাইরে গিয়ে একটু হাওয়ায় দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলে এসো। যাও বাবা”।
পরিতোষ নিজের অনিচ্ছা সত্বেও নিরঞ্জনবাবুর কথা মেনে নিজের ব্যাগটা গদির ওপর রেখেই শ্যামলেন্দুর সাথে বাইরের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে এসেই শ্যামলেন্দু জিজ্ঞেস করলেন, “আমি হয়ত চিনব না ভাই। তবু জিজ্ঞেস করছি, কে বারবার তোমাকে ফোন করছে”?
পরিতোষ মোবাইলটা হাতে রেখেই একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, “কাল নাগরাকাটায় আমি যে বন্ধুর ওখানে ছিলাম সে, আর কালচিনি থেকে কাকুর ছেলে। আমি কালচিনি থেকে চলে আসবার পর তাদের কাউকে কোনও খবর দিই নি। তাই হয়ত তারা সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তায় আছেন”।
শ্যামলেন্দু সে’কথা শুনে বললেন, “তুমি ভাই, তোমার বন্ধুকে ফোন করে বলে দাও, যে তুমি আমাদের এখানে পৌঁছে গেছ। আর ঠিক আছ। তাহলে তারা নিশ্চিন্ত হবেন। আর বিধুমামুর ছেলের নাম্বার আমার কাছে আছে। আমি তাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি” বলে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে পরিতোষের কাছ থেকে কয়েক ফুট দুরে চলে গেলেন।
পরিতোষ একটু ম্লান হেসে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করবার আগেই আবার সেটা বেজে উঠল। এবার রচনার ফোন দেখে কলটা রিসিভ করে কানে ফোন লাগাতেই ও’পাশ থেকে রচনা উদ্বিঘ্ন কন্ঠে বলে উঠল, “পরিদা, কোথায় আছ গো তুমি? কেউ তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না কেন? তুমি কেন আলিপুরদুয়ার গিয়েছ, মা-বাবার মুখে সে’সব কথাই আমি শুনেছি। কিন্তু ও’খানে গিয়ে তুমি কাউকে কিচ্ছু জানাওনি এখনও পর্যন্ত। সবাই যে দুশ্চিন্তা করছেন। তুমি ঠিক আছ তো পরিদা? ওখানে গিয়ে কোনও ঝামেলায় পড়নি তো”?
পরিতোষ নিজের গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে জবাবে বলল, “রচু, সোনা বোন আমার। আমি একদম ঠিক আছি। আসলে এখানে এসে প্রথমবার নিজের অনেক আত্মীয় স্বজন দেখতে পেয়ে কাউকে ফোন করবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মানে যখন থেকে বোধবুদ্ধি হয়েছে তখন থেকে তো বাবা ছাড়া আর কাউকে চোখেই দেখিনি। এখন পিসি, পিসেমশাই আর তিন তিনটে দাদা পেয়ে নিজেই যেন কেমন হকচকিয়ে গিয়েছি আমি। তাই কাউকে ফোন করবার কথা মনেও আসেনি। আর সবার সাথে কথাবার্তায় এমনভাবে ব্যস্ত আছি যে মন্তি আর কিংশুকের ফোন কলও রিজেক্ট করে দিতে বাধ্য হয়েছি। সরি”।
রচনা পরিতোষের কথা শুনে বলল, “তোমার গলাটা কেমন যেন লাগছে পরিদা। তুমি ঠিক আছ তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? তোমার পিসি পিসেমশাই কি তোমার সাথে ভাল ব্যবহার করেন নি? তেমন হলে তুমি এখনও কেন আলিপুরদুয়ারে বসে আছ? কালচিনি বা নাগরাকাটায় ফিরে যাচ্ছ না কেন”?
পরিতোষ নিজের গলার স্বর স্বাভাবিক রাখবার চেষ্টা করতে করতে জবাব দিল, “না রে বোন, একেবারেই তা নয়। পিসেমশাই আর দাদারা সকলেই আমাকে খুব আদর আপ্যায়ন করেছেন। সব কথা তো এখনই তোমাকে ফোনে খুলে বলা সম্ভব নয় বোন। তবে পিসিকে এখনও দেখতে পাই নি। আসলে পিসির তো বয়স হয়েছে। ইদানীং তার নাকি প্রেসার বেড়েছে। তাই আমাকে দেখবার সাথে সাথেই পিসি যখন জানতে পারবেন যে তার বাবা, মা, ভাই, ভাইয়ের বৌ এরা কেউ আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই তখন তো তিনি বিরাট একটা দুঃখ পাবেন। সেই ধাক্কাটা তিনি সামলে নিতে পারবেন কি না, এটা ভেবেই পিসেমশাই আর দাদাদের সাথে যুক্তি পরামর্শ করছি। আর পিসিকে যে ডাক্তার নিয়মিত দেখেন, তাকেও ডেকে আনা হয়েছে। এখন ওই ডাক্তারবাবু পিসিকে পরীক্ষা করে দেখছেন। খানিকবাদে উনি যেমন সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা তেমনই করব। তাই এই মূহুর্তে আমি মন্তি আর কিংশুকের কলটা রিজেক্ট করে দিয়েছি”।
রচনা পরিতোষের কথা শুনে বলল, “ও-ও, বুঝেছি। তুমি নিজেও এ মূহুর্তে বেশ টেনশনে আছ। তা তোমার পিসির বয়স কত হয়েছে গো পরিদা”?
পরিতোষ জবাবে বলল, “কালচিনিতেই কাকু বলেছিলেন, পিসির বর্তমান বয়স প্রায় বাষট্টি। কিন্তু পিসির যে প্রেসার বেড়েছে, এ খবরটা বোধহয় কাকুও জানতেন না। আর এই মূহুর্তে কারো সাথে ফোনে কথা বলতেও আমার ইচ্ছে করছে না। তাই মন্তি আর কিংশুকের কলগুলো আমি রিজেক্ট করে দিয়েছি। তারপর পিসেমশাই বারবার করে ফোন কলের জবাব দিতে বলাতেই এই মূহুর্তে আমি বাড়ির বাইরে আসবার সাথে সাথেই তোমার কল পেলাম। তাই তোমাকে একটা অনুরোধ করছি বোন। তুমি প্লীজ মন্তি আর ....”
তার কথার মাঝেই রচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি কিচ্ছু ভেবো না পরিদা। তোমার পিসির কিচ্ছু হবে না। আমি বলছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখো তুমি জীবনে প্রথমবার তোমার পিসির আদর পাবে। আর আমি এখনই কালচিনি আর নাগরাকাটায় ফোন করে বলে দিচ্ছি। তারাও কেউ তোমাকে ফোন করে এখন আর ডিস্টার্ব করবেন না। তুমিও নিজের মনটাকে শান্ত করো। তবে পিসির সাথে দেখা হবার পর তোমার ফুরসৎ মত তুমি কিন্তু আমায় একটি বার ফোন করবে। কথা দাও আমাকে, প্লীজ”।
পরিতোষ আবেগে বুজে আসা গলায় কোন রকমে বলল, “ঠিক আছে সোনা বোন। কথা দিলাম”।
রচনা আবার বলল, “আর হ্যাঁ, শোনো পরিদা। আমি দিদিভাই আর ভাইকে তোমার খবর জানিয়েই এখনই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসব। তোমার আর তোমার পিসির জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব। তোমার ফোন না পাওয়া অব্দি আমি কিন্তু প্রার্থনা করতেই থাকব। তাই পিসির সাথে দেখা হবার পর একটা ফোন কিন্তু অবশ্যই করবে। বুঝেছ”?
পরিতোষ আবার রূদ্ধ গলায় বলল, “হ্যাঁ বোন। করব”।
রচনা এবার বলল, “এবার মনটাকে শান্ত করো। আর ভেতরে গিয়ে দেখো, নিশ্চয়ই এতক্ষণে ডাক্তার তোমার জন্যে সুখবর পাঠিয়েছেন। আমিও ঠাকুরঘরে চলে এসেছি। তুমি ভেতরে ঢোকো” বলে ফোন কেটে দিল।
পরিতোষ ফোন নামাতেই শ্যামলেন্দু কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কে ফোন করেছিল? তোমার কোনও বন্ধু”?
পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “ভেতরে থাকতে প্রথম ফোনটা করেছিল আমার এক কলীগ বন্ধু, নাগরাকাটা থানার ওএসডি। আর পরের বার ফোন করেছিল কালচিনির বিধুকাকুর ছেলে। কিন্তু এবারে যার সাথে কথা হল সে বিধুকাকুর ছোট মেয়ে রচনা। ওরা কলকাতাতেই থাকে। কয়েক মাস আগে থেকেই আমি ওদেরকে চিনি। আমাকে দাদার মত শ্রদ্ধা করে মেয়েটা। খুব ভালবাসে আমাকে”।
শ্যামলেন্দু ভুরু কুঁচকে বললেন, “নাগরাকাটা থানার ওএসডি তো এক মহিলা। সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি। বড্ড জাদরেল এবং সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে তার খুব সুনাম আছে এ তল্লাটে। তিনিই কি তোমাকে ফোন করেছিলেন”?
পরিতোষ একটু অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ দাদা, ওকে সংক্ষেপে আমরা মন্তি বলে ডাকি। এখন আমি যার সাথে কথা বললাম, মানে বিধুকাকুর ছোটমেয়ে রচনা, এই রচনা হল সীমন্তিনীর বৌদি। সীমন্তিনীর সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই রচনা আর বিধুকাকুর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে” বলে একটু থেমে শ্যামলেন্দু আবার কিছু বলবার আগেই পরিতোষ বলল, “বড়দা, আমার মনে হয়, এবার আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিৎ। ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই এতক্ষণে কোনও খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন”।
শ্যামলেন্দুও পরিতোষের কথায় সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। চলো। আমিও কিংশুককে ফোনে তোমার এখানে এসে পৌঁছনোর কথা জানিয়ে দিয়েছি। ওরাও তোমার জন্যে চিন্তায় ছিল। তবে তোমাকে আরেকটা কথা আমার বলবার আছে ভাই। অবশ্য সেটা পরে বললেও চলবে। যদি আমি ভুলে যাই তাহলে একটু মনে করিয়ে দিও ভাই। চল এবার ভেতরে যাই”।
শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ভেতরে গদীর ঘরে ঢুকতেই দেখল সেখানে নিরঞ্জনবাবু, অমলেন্দু, বিমলেন্দু ছাড়াও আরও দু’জন বিবাহিতা ভদ্রমহিলা হাতে বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর সকলেরই মুখ চোখ খুশীতে উদ্ভাসিত। পরিতোষ আর শ্যামলেন্দু গদি ঘরে ঢুকতেই নিরঞ্জনবাবু গদি থেকে নেমে পরিতোষের হাত ধরে বললেন, “এসো পরিতোষ এসো বাবা” বলে বিবাহিতা মহিলা দু’জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেজ বৌমা, ছোট বৌমা, এই হল তোমাদের দেবর, পরিতোষ। আর পরিতোষ এরা তোমার দুই বৌদি। এ রুমা, তোমার মেজদা বিমলেন্দুর স্ত্রী, আর ও হচ্ছে তোমার ছোটবৌদি, অমুর স্ত্রী দেবিকা”।
পরিতোষের মনে হল তার মেজ বৌদি তার চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড় হলেও ছোটবৌদি দেবিকা বোধহয় তার সমবয়সীই হবে। দুই বৌদির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই দু’জনেই ছিটকে পেছনে সরে গেলেন। মেজবৌদি মিষ্টি হেসে বললেন, “তোমার প্রণাম নিলে তো তোমাকে আশীর্বাদও করতে হবে ভাই। কিন্তু দেখছ তো আমাদের দু’জনেরই হাত জোড়া। তাই আশীর্বাদ তো করতে পারব না এখন। এখন আমাদের যা করণীয় সেটাই বরং করতে দাও”।
(To be cont'd ......)
______________________________ss_sexy