29-03-2020, 12:11 AM
(Update No. 230)
পরিতোষ মাথা নিচু করে বলল, “দাদা, তারা কেউই আর এ পৃথিবীতে বেঁচে নেই। সবার আগে আমার মা, মানে আপনাদের মামী, আর তারপর ঠাকুমা, ঠাকুর্দা আমার ছোটবেলাতেই আমাদের ছেড়ে একে একে স্বর্গে চলে গেছেন। আর বাবা গেলেন সাত বছর আগে, ২০০৫এ। তখন থেকেই আমি পুরোপুরি অনাথ হয়ে গেছি”।
অমলেন্দু আর নিরঞ্জনবাবু দু’জনেই হায় হায় করে উঠলেন এ কথা শুনে। নিরঞ্জনবাবু তার শ্বশুরের ছবির নিচেই হাঁটু মুড়ে বসে গদিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে কাঁদতে লাগলেন। আর অমলেন্দুও নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “এতদিন কোন খোঁজ না পেলেও, দাদু যে এতদিনে এ সংসারের মায়া ছেড়ে চলেই গেছেন, এটা আমরা ধরেই নিয়েছিলুম ভাই। তবে মনের কোনায় একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে দিদিমা হয়ত এখনও বেঁচে আছেন। আর মামা মামী তো এত তাড়াতাড়ি চলে যাবার কথাই নয়। কিন্তু এমনই ভাগ্য আমাদের, কাউকেই আর আমরা দেখতে পেলুম না”!
পরিতোষ কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। নিরঞ্জনবাবু এবার নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করতে করতে বললেন, “হে ভগবান। এ দিনটা দেখার ছিল বলেই কি এখনও আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছ”?
অমলেন্দুকে ডাকতে দোকানের ওদিক থেকে আরও একজন আসতেই অমলেন্দু তাকে বলল, “এই শোন, তোরা নিজেরাই ওদিকে সামাল দে এখন। আমি আর বাবা এখন খুব জরুরী একটা কাজে ব্যস্ত আছি। তোরা কেউ আমাদের ডিসটার্ব করিস না। আমরা না ডাকলে তোরা কেউ এখানে আসিস না। আর শোন, কাউন্টার থেকে এক্ষুনি আমার মোবাইলটা এনে দিয়ে যা”।
পরিতোষ কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না যেন। নিরঞ্জনবাবু দেয়ালে হেলান দিয়ে গদীতে বসেই পরিতোষের হাত ধরে তার কাছে টেনে নিল। পরিতোষও কোন কথা না বলে নিরঞ্জনবাবুর পাশে বসে পড়ল। আর অমলেন্দু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে থাকল। খানিক বাদে দোকানের একজন কর্মচারী এসে অমলেন্দুর হাতে তার মোবাইলটা দিয়ে যেতেই অমলেন্দু একজনকে ফোন করল। ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই অমলেন্দু বলল, “বড়দা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি চলে আয়। আমি আর বাবা নিচে গদিতে আছি। সেখানেই আসিস” তারপর আরেকটু সময় চুপ করে ও’দিকের কথা শুনে বলল, “নারে বড়দা, একদম দেরী করিস না। আমি মেজদাকেও ফোন করে তাকে আসতে বলছি। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয় প্লীজ। নইলে একটা বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে”।
তারপর ফোন কেটে আরও একজনকে ফোন করে একই কথা বলল। তার কথাতেই পরিতোষ বুঝতে পারল যে অমলেন্দু তার মেজদা আর বড়দার সাথেই কথা বলল। কিন্তু ‘সমস্যা দেখা দিতে পারে’ কথাটা শুনেই সে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। সে ভাবতে লাগল, সে এভাবে এদের কাছে এসে পড়াতেই কি কোনও সমস্যার উৎপত্তি হল? কিন্তু সে তো কোনও সমস্যা সৃষ্টি করবার জন্যে এখানে আসেনি। সে তো শুধু তার পিসিকে একটু চোখের দেখা দেখতেই এসেছে।
অমলেন্দুর ফোনে কথা বলা শেষ হতেই পরিতোষ দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলল, “দাদা, আমি এভাবে হুট করে এসে পড়ায় আপনারা যদি কোনও ভাবে বিব্রত হয়ে থাকেন, বা আমি যদি এসে আপনাদের কোনও সমস্যার সৃষ্টি করে ফেলি, তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাদের কাউকেই কোনও সমস্যায় ফেলবার উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি। আমি শুধু আমার পিসিকে একটিবার চোখে দেখব বলেই কিন্তু এসেছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্যই আমার নেই”।
নিরঞ্জনবাবু পরিতোষের হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে বললেন, “এ তুমি কি বলছ বাবা পরিতোষ। আজ তোমাকে পেয়ে আমরা যে কী পরিমাণ খুশী হয়েছি, সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না আমরা। কিন্তু বাবা, অমু যেমনটা ভাবছে তেমন সমস্যা একটা আছে অবশ্যই। তবে সেটা সমস্যা না বলে আপাততঃ সেটাকে আমাদের একটা দুশ্চিন্তা বলেই ধরে নিতে পার। তবে সে দুশ্চিন্তার কারন তুমি নও বাবা”।
এবার অমলেন্দুও পরিতোষের পাশে বসেই তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “ভাই, আমি প্রথমেই তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি। নিজের দাদাকে কেউ আপনি আজ্ঞে করে কথা বললে সেটা খুব খারাপ শোনায়। তাই তুমি আমাকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ করে বোলো। আমাদের তিন ভাই আর দু’বোনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ছোট। তাই আমাকে দাদা বা ছোড়দা বলে ডাকবার মত কেউ এতদিন ছিল না। এবার আমিও একটা ভাই পেয়ে গেলুম। তুমি আমাকে কিন্তু ছোড়দা বলে ডাকবে ভাই” বলে একটু থেমে বলল, “আর ফোনে আমি বড়দা আর মেজদাকে খুব তাড়াতাড়ি এখানে আসতে বলেছি, সেটা তো তুমি বুঝতেই পেরেছ। দাদারা দু’জনেও ব্যবসাই করেন। বড়দা রোডওয়েজের ব্যবসা করেন আর মেজদার মেডিক্যাল স্টোর। তারা মনে হয় পনের কুড়ি মিনিটের ভেতরেই এখানে এসে পৌঁছে যাবেন। আমি চাইছি ততক্ষণ আমরা এখানেই থাকব। দাদারা এলেই আমরা বাড়ির ভেতরে যাব। কিন্তু যে সমস্যার কথা বলেছি, সে সমস্যা কিন্তু তুমি একেবারেই নও ভাই। সে সমস্যাটা আমাদের মাকে নিয়ে, মানে তোমার পিসিকে নিয়ে। আচ্ছা ভাই, আমাদের মাকে তো তুমি এই প্রথম দেখবে। মা বাবার মুখে যতটুকু শুনেছি, তাতে মনে হয় তুমি তোমার পিসির কোনও ছবিও হয়ত কোনদিন দেখনি। কিন্তু তোমার পিসির সম্বন্ধে তোমার মনে কিছু একটা ধারণা তো আছেই। হতে পারে তার সম্বন্ধে তুমি মনে মনে কিছু একটা ভেবেছ। তাকে দেখতে কেমন হবে বা তার শরীর স্বাস্থ্য কেমন হবে, এইসব”।
পরিতোষ মাথা নিচু করে বলল, “ছোড়দা, ছোটবেলা থেকে আমি শুধু এ’টুকুই জানতাম যে আসাম আর ভূটান সীমান্তের কাছাকাছি কোনও একটা গ্রামে আমার এক পিসি আছেন, যিনি আমার বাবার চাইতে বয়সে বড়। তিনি তার পছন্দের একজন কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই ঠাকুর্দা ঠাকুমা তাকে চিরতরে পরিত্যাগ করে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। শুনেছি বাবাও তখন খুব ছোট ছিলেন। কলেজে ক্লাস সিক্সে পড়তেন। তাই পিসির বিয়ে মেনে নেওয়া বা না নেওয়ার ব্যাপারে বাবার মতামতের নিশ্চয়ই তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু ঠাকুর্দা মারা যাবার সময় বাবাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে বাবা যেন কোনদিন তার দিদির নাম মুখে না আনেন। তাই বাবার মুখে শুধু ওইটুকুই শুনেছি। এর বেশী কিছু আমি আজ সকাল অব্দিও জানতুম না। তবে বাবা যে তার দিদিকে খুব ভালবাসতেন সেটা তার কথা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ঘটণাচক্রে আজ সকালে আমি কালচিনি গিয়েছিলাম কাকুর বাড়িতে। তখন আমি এটাও জানতাম না যে তিনিই আমার বাবার বন্ধু। কিন্তু গতকাল নাগরাকাটায় আমার এক বন্ধুর বাড়িতে তার নামটা শোনবার পর থেকেই আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল বিধু নামটা আমি বোধহয় বাবার মুখেই কখনও কখনও শুনেছি। আর তাছাড়া বিধুকাকুর ছোট মেয়ে তার স্বামীর সাথে কলকাতাতেই থাকে। আর তাদের সাথে আমার ভাল পরিচয়ও আছে। ওই মেয়েটাকে আমি আমার বোনের মত স্নেহ করি। সে-ও বারবার করে বলেছিল, কলকাতা ফেরবার আগে আমি যেন কালচিনি গিয়ে তার মা বাবার সাথে অবশ্যই দেখা করে যাই। তাই আমি আজ সকালেই কালচিনি গিয়েছিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে কাকু কাকিমার সাথে গল্প করবার সময় হঠাতই কথায় কথায় জানতে পারলাম যে উনি আর বাবা তাদের ছোটবেলায় অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন। আর তখনই তার কাছেই জানতে পারলাম যে আমার পিসি এখানে আছেন, ভাল আছেন। গত সাতটা বছর ধরে নিজেকে পুরোপুরি অনাথ ভেবে কাটাবার পর যে মূহুর্তে জানতে পারলাম যে আমি অতটা অভাগা নই, আমার রক্তের সম্পর্কের একজন পিসি আছেন, তখন আর একটা মুহুর্তও আমি নষ্ট করিনি। কাকু বলছিলেন উনি কাল সকালে নিজেই আমাকে নিয়ে এখানে আসবেন। কিন্তু আমার মনটা ছটফট করছিল এখানে আসবার জন্যে। আমার আর তর সইছিল না দেখে উনি তড়িঘড়ি ওই চিঠিটা লিখে দিয়েছিলেন পিসেমশাইয়ের নামে। আমিও দেরী না করে আড়াইটের ট্রেন ধরে এখানে চলে এসেছি”।
পরিতোষের সব কথা শুনে নিরঞ্জনবাবু বললেন, “দেখেছিস অমু! একেই বলে প্রদীপের তলায় অন্ধকার। নইলে মাস খানেক আগেই তো বিধুর সাথে আবার আমাদের দেখা হয়েছিল। তখন কি আর জানতুম যে গত চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমরা হন্যে হয়ে যাদের খুঁজছি তাদের হদিশ আছে বিধুর ছোটমেয়ের কাছে! বিধুর ছোটমেয়ে তোর মামাতো ভাইকে দাদা বলে ডাকে? বিধুও জানতনা যে তার ছোট মেয়ে তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর ছেলেকে আগেই খুঁজে পেয়েছে”।
অমলেন্দুও তার বাবার কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু বাবা, মাকে এখন সামলাবে কি করে বলো তো? দাদু, দিদিমা, মামা কেউ বেঁচে নেই শুনে আমরাই তো আমাদের কান্না সামলাতে পারছি না। তার কী অবস্থা হতে পারে”?
নিরঞ্জনবাবুও চিন্তিত মুখে বললেন, “আমিও তো সেটাই ভাবছি রে অমু। গত সপ্তাহেই তো ডাক্তার চেকআপ করে বলল যে প্রেসারটা নাকি একটু বেড়েছে। আজ নিজের ভাইপোকে দেখে সে যতটা খুশী হবে, ঠিক ততটাই দুঃখ পাবে চার চারজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে। এ ধাক্কাটা সে সইতে পারবে কিনা বুঝতে পারছি না। তুই এক কাজ কর তো। ডাক্তার বিশ্বাসকে ফোন করে দেখ তো সে এখন আসতে পারবে কি না”।
অমলেন্দু বলল, “হ্যাঁ বাবা, দেখছি” বলে ভেতরের দিকে কোথাও চলে গেল।
পরিতোষ পিসির প্রেসারের খবর শুনে চিন্তিত স্বরে নিরঞ্জনবাবুকে বলল, “পিসেমশাই, পিসির প্রেসার বেড়েছে? না না, এ অবস্থায় তাকে তার বাবা মা ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ জানানো একেবারেই ঠিক হবে না। আমার বাবাও তো স্ট্রোকেই মারা গেছেন। তবে সেটা কিভাবে হয়েছিল জানিনা। তাকে শেষ দেখাটুকু দেখবার সৌভাগ্যও হয়নি আমার। আমি তখন সবে আইপিএস পাশ করে হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ ছিলাম। না না, পিসেমশাই, পিসিকে এখন কিছু জানাবার দরকার নেই। আর আমি যে এখানে এসেছিলাম, এ কথাও তাকে জানাবার দরকার নেই এখন। আপনারা দয়া করে আমাকে শুধু একটু সুযোগ করে দিন। আমি যেন দুর থেকে পিসিকে একটুখানি দেখতে পারি। তাহলেই আমার মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবে। আমি তাকে একটু সময় দেখেই, দুর থেকে তাকে প্রণাম করেই এখান থেকে চলে যাব”।
নিরঞ্জনবাবু ম্লান হেসে বললেন, “তাই কি হয় বাবা? এতদিন বাদে যে আমরা তোমাকে পেয়েছি, এটাই কি কম সৌভাগ্যের কথা আমাদের কাছে? কিন্তু স্বার্থপরের মত আমরাই সে সৌভাগ্য উপভোগ করব, আর যার সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক সেই মহিলাই এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন, এটা তো আমরা কেউই মেনে নিতে পারব না বাবা। তুমি একটু ধৈর্য ধরে বোসো। একটা না একটা উপায় ঠিকই বের হয়ে আসবে। তোমার অন্য দুই দাদা আসুক, ডাক্তার আসুক, তারপর সবাই মিলে ভাবলে একটা রাস্তা ঠিক পেয়ে যাব আমরা। কিন্তু বাবা, তুমি অন্য কিছু ভেবো না। ততক্ষণ তোমাকে কিন্তু এখানেই আমাদের সাথে থাকতে হবে। তা তুমি তো সেই দুপুর বেলায় কালচিনি থেকে বেরিয়েছ। সন্ধ্যে হতে চলল, তোমার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে। দাঁড়াও তোমার জন্যে আমি কিছু খাবার ব্যবস্থা করি আগে”।
পরিতোষ অনেক বারণ করা সত্বেও নিরঞ্জনবাবু শুনলেন না। নিজের গদীর ওপরে একটা কাঠের ক্যাশ বাক্সের পাশ থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে ফোন করে কাউকে বললেন, “বড়বৌমা, একজনের জন্য কিছু জলখাবার পাঠিয়ে দিও তো গদীতে” বলে চুপ করে ও’পাশের কথা শুনে আবার বললেন, “সে’সব তুমি পরে জানতে পারবে মা। আপাততঃ ধরে নাও, বিশেষ এক অতিথি এসেছে আমার এখানে। সেটা ভেবেই ভাল করে গুছিয়ে দিও সব কিছু। কেমন? আর তোমার মা কেমন আছেন”? বলে আরও কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে “ঠিক আছে” বলে ফোন বন্ধ করে নামিয়ে রাখলেন।
এমন সময় অমলেন্দু পেছনের দড়জা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “বাবা ডাক্তার বিশ্বাস আসছেন। বললেন দশ পনেরো মিনিটের ভেতর এসে পড়বেন”।
তার কথা শেষ না হতেই হন্তদন্ত হয়ে আরও দু’জন দোকানের দিক থেকে গদির ঘরে এসে ঢুকলেন। তার মধ্যে বড়জন অমলেন্দুর কথা ধরেই জিজ্ঞেস করলেন, “ডাক্তার আসছে মানে? কার কী হয়েছে বাবা”?
আরেকজন অমলেন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁরে অমু, মা ঠিক আছেন তো”?
অমলেন্দু কিছু বলবার আগেই নিরঞ্জনবাবু হাত তুলে তার দুই বড়ছেলেকে শান্ত হবার ঈশারা করে বললেন, “তোরা শান্ত হ শামু বিমু। তেমন কিছু হয়নি। তবে তোদেরকে এভাবে ডেকে এনেছি, তার একটা বিশেষ কারন আছে। একে দ্যাখ। আন্দাজ কর তো দেখি এ ছেলেটা কে হতে পারে”? বলে পরিতোষের দিকে ঈশারা করল।
অমলেন্দু তার বাবাকে বললেন, “বাবা আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। ডাক্তারবাবু চলে আসতে পারেন। আগে তো তাকে এখানে এনেই গোটা পরিস্থিতিটা বোঝাতে হবে, তাই না”?
নিরঞ্জনবাবু অনুমতি দিতে অমলেন্দু বাইরে চলে গেলেন। নতুন আসা অন্য দু’জন পরিতোষকে দেখে কিছু আন্দাজ করতে না পেরে বললেন, “বাবা আমরা তো কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। কে উনি”?
নিরঞ্জনবাবু পরিতোষকে একহাতে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে আনন্দিত স্বরে বললেন, “এ হচ্ছে পরিতোষ। তোদের আরেকটা ভাই। তোদের মামার ছেলে রে। আর পরিতোষ এরা তোমার পিসির দুই বড় ছেলে। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু”।
দুই ছেলেই বিস্ময়ে আর আনন্দে প্রায় একসাথেই বলে উঠলেন, “সত্যি বলছ বাবা? এ আমাদের ভাই? আমাদের একমাত্র মামার ছেলে”?
পরিতোষ গদি থেকে নেমে দুই বড়ভাইকে প্রণাম করবার জন্য ঝুঁকতেই তারা দু’জনেই পরিতোষের হাত ধরে বলল, “থাক থাক ভাই। আমাদের প্রণাম করতে হবে না। ওহ, আজ কত বড় খুশীর দিন আমাদের সকলের। এতগুলো বছর ধরে যাদের আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাদের একজনকে আজ পেয়েছি আমরা। তাহলে তো মামা, মামী, দিদা দাদু সবাইকেই এবার আমরা দেখতে পারব বাবা”।
অপেক্ষাকৃত কম বয়স যার তিনি পরিতোষের একটা হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু বাবা, ও এসেছে কখন? আর ওকে এখনও বাড়িতে নিয়ে যাওনি কেন? এখানেই বসিয়ে রেখেছ”?
নিরঞ্জনবাবু একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বসিয়ে রেখেছি কি আর সাধে রে। ও হচ্ছে সদ্য গাছে ফোটা একটা গোলাপ ফুল। গোলাপ ফুলের রূপ আর সুগন্ধের সাথে সাথে বোঁটার দিকে যে কাঁটাও থাকে রে। সে কাঁটার খোঁচা লাগবে বুঝতে পেরেই তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। তাই তো তোদের ডেকে আনলুম। ডাক্তার বিশ্বাসও আসছে। উনি এলে সবাই মিলে বসে পরামর্শ করব, যাতে কাঁটার খোঁচা খেতে না হয়”।
শ্যামলেন্দু তার বাবার কথার অর্থ কিছু বুঝতে না পেরে জজ্ঞেস করলেন, “তুমি কী বলছ বাবা? আমরা তো কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না”।
এমন সময়েই পেছন দিকের দড়জার ওপার থেকে নারীকন্ঠে কেউ বলে উঠল, “কাকাবাবু, খাবার এনেছি। ভেতরে আসব”?
নিরঞ্জনবাবু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দুই ছেলে চুপ থাকতে বলে বললেন, “হ্যাঁ তাপসী, ভেতরে নিয়ে আয়”।
বছর তিরিশের এক বিবাহিতা মহিলা খাবারের থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরটার এক কোনায় যে একটা ছোট টেবিল চেয়ার আছে সেটা পরিতোষের এতক্ষণে নজরে পড়ল। মহিলা ওই টেবিলের ওপর খাবারের থালা আর গ্লাস রেখে শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দুকে গদির ঘরে দেখে মনে মনে একটু অবাকই হল। এ সময়ে এই দু’জনের তো এখানে থাকবার কথা নয়। ফিরে যাবার আগে পরিতোষের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে বেরিয়ে গেল।
নিরঞ্জনবাবু তখন বললেন, “ছেলেটা অনেকক্ষণ হল এসেছে। দুপুরে খাবার খেয়েই কালচিনি থেকে ট্রেনে উঠেছিল। বাড়ির ভেতর নিতে পারছিলুম না। তাই বড়বৌমাকে বলে ওর জন্য কিছু খাবার আনিয়ে নিলাম” বলে পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, “বাবা পরিতোষ, তুমি তো আশা করি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছ। আমার মনটা খুব চাইছে তোমার মুখে প্রথম গ্রাসটা তোমার পিসি নিজেই তুলে দিক। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করেই সেটা আর করতে পারছি না। তুমি আমাদের অসহায়তাটুকু বুঝে আমাদের ক্ষমা করে দিও বাবা। ওই ওদিকে ছোট একটা বাথরুম আছে। সেখানে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এ খাবারটুকু খেয়ে নাও বাবা। নইলে এগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে”।
পরিতোষ একটু লাজুক মুখে বলল, “আমার কিন্তু একেবারেই ক্ষিদে পায়নি পিশেমশাই। আর পিসির কথা ভেবে তো আরও চিন্তা হচ্ছে আমার। এতসব তো খেতেই পারব না আমি”।
নিরঞ্জনবাবু স্নেহমাখা সুরে বললেন, “ঠিক আছে বাবা, যেটুকু পার, খেয়ে নাও। ডাক্তার এলে তার সাথে পরামর্শ করেই তোমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাব আমরা। অবশ্য তোমার পিসি যখন শুনবেন যে আমাদের বাড়ি এসেও তুমি প্রথম খাবার খেয়েছ এ গদিতে বসে, তখন আমাদের সকলের ওপরেই তিনি কিছু চোটপাট করবেনই”।
পরিতোষ উঠে বাথরুমের দিকে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে টেবিলে খেতে বসবার আগেই দেখল তার দুই দাদা বিধুবাবুর লেখা চিঠিটা পড়ছেন। চিঠি পড়া শেষ হলে মেজছেলে বিমলেন্দু বললেন, “তাহলে শেষ মেষ বিধুমামুই আমাদের এত বড় উপকারটা করলেন”।
বড়ছেলে শ্যামলেন্দু বললেন, “হ্যাঁ বাবা, বিধুমামুই যখন ওকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাহলে তো ওকে সন্দেহ করবার মত কিছু নেই। বিধুমামুর মত লোক কিছুতেই কাউকে ঠকাতে পারেন না। তাই পরিতোষই যে আমাদের ভাই, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। কিন্তু ওকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওনি কেন তোমরা, সেটাই তো বুঝতে পাচ্ছি না”।
নিরঞ্জনবাবু শান্ত গলায় বললেন, “ভগবানের অসীম কৃপা যে পরিতোষ আমাদের কাছে এসে পড়েছে। এ দিনটার জন্যেই তো আমরা চুয়াল্লিশটা বছর ভগবানের কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করে যাচ্ছিলুম। কিন্ত এ সুখের সাথে সাথে অনেকগুলো দুঃসংবাদও যে আমাদের কাছে চলে আসবে, সেটা তো আমরা কেউই আশাই করিনি। তোদের দাদু, দিদিমা, মামা এমনকি তোদের মামীও, এরা কেউই আর বেঁচে নেই রে। এনারা সকলেই এ পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে চলে গেছেন”।
শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু দু’জনেই চমকে উঠে চাপা চিৎকার করে উঠল, “কী বলছ বাবা? এরা সকলেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন”!
নিরঞ্জনবাবু আগের মতই শান্ত স্বরে বললেন, “হ্যাঁরে, পরিতোষের মুখেই খানিকক্ষণ আগে এ দুঃসংবাদটা শুনলুম আমরা। আসলে সময়ের ব্যবধানটাও তো কম নয়। চুয়াল্লিশটা বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের বিয়ের পর। এতোটা দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীর কত কিছু বদলে গেছে। আমরাও সবাই কে কোথায় ছিলুম, কে কোথায় ভেসে এসেছি, কে কোথায় স্রোতের টানে বয়ে গেছে। কিন্তু একসাথেই যে চার চারজনের মৃত্যু সংবাদ আমরা পাবো, এ তো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। এবার বুঝতে পারছিস? ওকে এতক্ষণ ধরে এখানেই বসিয়ে রেখেছি কেন”?
বিমলেন্দু ভীত কন্ঠে বললেন, “মা তো এ দুঃসংবাদ গুলো শুনে সইতেই পারবেন না। কী হবে বাবা”?
______________________________
পরিতোষ মাথা নিচু করে বলল, “দাদা, তারা কেউই আর এ পৃথিবীতে বেঁচে নেই। সবার আগে আমার মা, মানে আপনাদের মামী, আর তারপর ঠাকুমা, ঠাকুর্দা আমার ছোটবেলাতেই আমাদের ছেড়ে একে একে স্বর্গে চলে গেছেন। আর বাবা গেলেন সাত বছর আগে, ২০০৫এ। তখন থেকেই আমি পুরোপুরি অনাথ হয়ে গেছি”।
অমলেন্দু আর নিরঞ্জনবাবু দু’জনেই হায় হায় করে উঠলেন এ কথা শুনে। নিরঞ্জনবাবু তার শ্বশুরের ছবির নিচেই হাঁটু মুড়ে বসে গদিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে কাঁদতে লাগলেন। আর অমলেন্দুও নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “এতদিন কোন খোঁজ না পেলেও, দাদু যে এতদিনে এ সংসারের মায়া ছেড়ে চলেই গেছেন, এটা আমরা ধরেই নিয়েছিলুম ভাই। তবে মনের কোনায় একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে দিদিমা হয়ত এখনও বেঁচে আছেন। আর মামা মামী তো এত তাড়াতাড়ি চলে যাবার কথাই নয়। কিন্তু এমনই ভাগ্য আমাদের, কাউকেই আর আমরা দেখতে পেলুম না”!
পরিতোষ কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। নিরঞ্জনবাবু এবার নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করতে করতে বললেন, “হে ভগবান। এ দিনটা দেখার ছিল বলেই কি এখনও আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছ”?
অমলেন্দুকে ডাকতে দোকানের ওদিক থেকে আরও একজন আসতেই অমলেন্দু তাকে বলল, “এই শোন, তোরা নিজেরাই ওদিকে সামাল দে এখন। আমি আর বাবা এখন খুব জরুরী একটা কাজে ব্যস্ত আছি। তোরা কেউ আমাদের ডিসটার্ব করিস না। আমরা না ডাকলে তোরা কেউ এখানে আসিস না। আর শোন, কাউন্টার থেকে এক্ষুনি আমার মোবাইলটা এনে দিয়ে যা”।
পরিতোষ কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না যেন। নিরঞ্জনবাবু দেয়ালে হেলান দিয়ে গদীতে বসেই পরিতোষের হাত ধরে তার কাছে টেনে নিল। পরিতোষও কোন কথা না বলে নিরঞ্জনবাবুর পাশে বসে পড়ল। আর অমলেন্দু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে থাকল। খানিক বাদে দোকানের একজন কর্মচারী এসে অমলেন্দুর হাতে তার মোবাইলটা দিয়ে যেতেই অমলেন্দু একজনকে ফোন করল। ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই অমলেন্দু বলল, “বড়দা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি চলে আয়। আমি আর বাবা নিচে গদিতে আছি। সেখানেই আসিস” তারপর আরেকটু সময় চুপ করে ও’দিকের কথা শুনে বলল, “নারে বড়দা, একদম দেরী করিস না। আমি মেজদাকেও ফোন করে তাকে আসতে বলছি। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয় প্লীজ। নইলে একটা বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে”।
তারপর ফোন কেটে আরও একজনকে ফোন করে একই কথা বলল। তার কথাতেই পরিতোষ বুঝতে পারল যে অমলেন্দু তার মেজদা আর বড়দার সাথেই কথা বলল। কিন্তু ‘সমস্যা দেখা দিতে পারে’ কথাটা শুনেই সে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। সে ভাবতে লাগল, সে এভাবে এদের কাছে এসে পড়াতেই কি কোনও সমস্যার উৎপত্তি হল? কিন্তু সে তো কোনও সমস্যা সৃষ্টি করবার জন্যে এখানে আসেনি। সে তো শুধু তার পিসিকে একটু চোখের দেখা দেখতেই এসেছে।
অমলেন্দুর ফোনে কথা বলা শেষ হতেই পরিতোষ দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলল, “দাদা, আমি এভাবে হুট করে এসে পড়ায় আপনারা যদি কোনও ভাবে বিব্রত হয়ে থাকেন, বা আমি যদি এসে আপনাদের কোনও সমস্যার সৃষ্টি করে ফেলি, তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাদের কাউকেই কোনও সমস্যায় ফেলবার উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি। আমি শুধু আমার পিসিকে একটিবার চোখে দেখব বলেই কিন্তু এসেছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্যই আমার নেই”।
নিরঞ্জনবাবু পরিতোষের হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে বললেন, “এ তুমি কি বলছ বাবা পরিতোষ। আজ তোমাকে পেয়ে আমরা যে কী পরিমাণ খুশী হয়েছি, সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না আমরা। কিন্তু বাবা, অমু যেমনটা ভাবছে তেমন সমস্যা একটা আছে অবশ্যই। তবে সেটা সমস্যা না বলে আপাততঃ সেটাকে আমাদের একটা দুশ্চিন্তা বলেই ধরে নিতে পার। তবে সে দুশ্চিন্তার কারন তুমি নও বাবা”।
এবার অমলেন্দুও পরিতোষের পাশে বসেই তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “ভাই, আমি প্রথমেই তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি। নিজের দাদাকে কেউ আপনি আজ্ঞে করে কথা বললে সেটা খুব খারাপ শোনায়। তাই তুমি আমাকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ করে বোলো। আমাদের তিন ভাই আর দু’বোনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ছোট। তাই আমাকে দাদা বা ছোড়দা বলে ডাকবার মত কেউ এতদিন ছিল না। এবার আমিও একটা ভাই পেয়ে গেলুম। তুমি আমাকে কিন্তু ছোড়দা বলে ডাকবে ভাই” বলে একটু থেমে বলল, “আর ফোনে আমি বড়দা আর মেজদাকে খুব তাড়াতাড়ি এখানে আসতে বলেছি, সেটা তো তুমি বুঝতেই পেরেছ। দাদারা দু’জনেও ব্যবসাই করেন। বড়দা রোডওয়েজের ব্যবসা করেন আর মেজদার মেডিক্যাল স্টোর। তারা মনে হয় পনের কুড়ি মিনিটের ভেতরেই এখানে এসে পৌঁছে যাবেন। আমি চাইছি ততক্ষণ আমরা এখানেই থাকব। দাদারা এলেই আমরা বাড়ির ভেতরে যাব। কিন্তু যে সমস্যার কথা বলেছি, সে সমস্যা কিন্তু তুমি একেবারেই নও ভাই। সে সমস্যাটা আমাদের মাকে নিয়ে, মানে তোমার পিসিকে নিয়ে। আচ্ছা ভাই, আমাদের মাকে তো তুমি এই প্রথম দেখবে। মা বাবার মুখে যতটুকু শুনেছি, তাতে মনে হয় তুমি তোমার পিসির কোনও ছবিও হয়ত কোনদিন দেখনি। কিন্তু তোমার পিসির সম্বন্ধে তোমার মনে কিছু একটা ধারণা তো আছেই। হতে পারে তার সম্বন্ধে তুমি মনে মনে কিছু একটা ভেবেছ। তাকে দেখতে কেমন হবে বা তার শরীর স্বাস্থ্য কেমন হবে, এইসব”।
পরিতোষ মাথা নিচু করে বলল, “ছোড়দা, ছোটবেলা থেকে আমি শুধু এ’টুকুই জানতাম যে আসাম আর ভূটান সীমান্তের কাছাকাছি কোনও একটা গ্রামে আমার এক পিসি আছেন, যিনি আমার বাবার চাইতে বয়সে বড়। তিনি তার পছন্দের একজন কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই ঠাকুর্দা ঠাকুমা তাকে চিরতরে পরিত্যাগ করে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। শুনেছি বাবাও তখন খুব ছোট ছিলেন। কলেজে ক্লাস সিক্সে পড়তেন। তাই পিসির বিয়ে মেনে নেওয়া বা না নেওয়ার ব্যাপারে বাবার মতামতের নিশ্চয়ই তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু ঠাকুর্দা মারা যাবার সময় বাবাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে বাবা যেন কোনদিন তার দিদির নাম মুখে না আনেন। তাই বাবার মুখে শুধু ওইটুকুই শুনেছি। এর বেশী কিছু আমি আজ সকাল অব্দিও জানতুম না। তবে বাবা যে তার দিদিকে খুব ভালবাসতেন সেটা তার কথা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ঘটণাচক্রে আজ সকালে আমি কালচিনি গিয়েছিলাম কাকুর বাড়িতে। তখন আমি এটাও জানতাম না যে তিনিই আমার বাবার বন্ধু। কিন্তু গতকাল নাগরাকাটায় আমার এক বন্ধুর বাড়িতে তার নামটা শোনবার পর থেকেই আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল বিধু নামটা আমি বোধহয় বাবার মুখেই কখনও কখনও শুনেছি। আর তাছাড়া বিধুকাকুর ছোট মেয়ে তার স্বামীর সাথে কলকাতাতেই থাকে। আর তাদের সাথে আমার ভাল পরিচয়ও আছে। ওই মেয়েটাকে আমি আমার বোনের মত স্নেহ করি। সে-ও বারবার করে বলেছিল, কলকাতা ফেরবার আগে আমি যেন কালচিনি গিয়ে তার মা বাবার সাথে অবশ্যই দেখা করে যাই। তাই আমি আজ সকালেই কালচিনি গিয়েছিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে কাকু কাকিমার সাথে গল্প করবার সময় হঠাতই কথায় কথায় জানতে পারলাম যে উনি আর বাবা তাদের ছোটবেলায় অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন। আর তখনই তার কাছেই জানতে পারলাম যে আমার পিসি এখানে আছেন, ভাল আছেন। গত সাতটা বছর ধরে নিজেকে পুরোপুরি অনাথ ভেবে কাটাবার পর যে মূহুর্তে জানতে পারলাম যে আমি অতটা অভাগা নই, আমার রক্তের সম্পর্কের একজন পিসি আছেন, তখন আর একটা মুহুর্তও আমি নষ্ট করিনি। কাকু বলছিলেন উনি কাল সকালে নিজেই আমাকে নিয়ে এখানে আসবেন। কিন্তু আমার মনটা ছটফট করছিল এখানে আসবার জন্যে। আমার আর তর সইছিল না দেখে উনি তড়িঘড়ি ওই চিঠিটা লিখে দিয়েছিলেন পিসেমশাইয়ের নামে। আমিও দেরী না করে আড়াইটের ট্রেন ধরে এখানে চলে এসেছি”।
পরিতোষের সব কথা শুনে নিরঞ্জনবাবু বললেন, “দেখেছিস অমু! একেই বলে প্রদীপের তলায় অন্ধকার। নইলে মাস খানেক আগেই তো বিধুর সাথে আবার আমাদের দেখা হয়েছিল। তখন কি আর জানতুম যে গত চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমরা হন্যে হয়ে যাদের খুঁজছি তাদের হদিশ আছে বিধুর ছোটমেয়ের কাছে! বিধুর ছোটমেয়ে তোর মামাতো ভাইকে দাদা বলে ডাকে? বিধুও জানতনা যে তার ছোট মেয়ে তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর ছেলেকে আগেই খুঁজে পেয়েছে”।
অমলেন্দুও তার বাবার কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু বাবা, মাকে এখন সামলাবে কি করে বলো তো? দাদু, দিদিমা, মামা কেউ বেঁচে নেই শুনে আমরাই তো আমাদের কান্না সামলাতে পারছি না। তার কী অবস্থা হতে পারে”?
নিরঞ্জনবাবুও চিন্তিত মুখে বললেন, “আমিও তো সেটাই ভাবছি রে অমু। গত সপ্তাহেই তো ডাক্তার চেকআপ করে বলল যে প্রেসারটা নাকি একটু বেড়েছে। আজ নিজের ভাইপোকে দেখে সে যতটা খুশী হবে, ঠিক ততটাই দুঃখ পাবে চার চারজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে। এ ধাক্কাটা সে সইতে পারবে কিনা বুঝতে পারছি না। তুই এক কাজ কর তো। ডাক্তার বিশ্বাসকে ফোন করে দেখ তো সে এখন আসতে পারবে কি না”।
অমলেন্দু বলল, “হ্যাঁ বাবা, দেখছি” বলে ভেতরের দিকে কোথাও চলে গেল।
পরিতোষ পিসির প্রেসারের খবর শুনে চিন্তিত স্বরে নিরঞ্জনবাবুকে বলল, “পিসেমশাই, পিসির প্রেসার বেড়েছে? না না, এ অবস্থায় তাকে তার বাবা মা ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ জানানো একেবারেই ঠিক হবে না। আমার বাবাও তো স্ট্রোকেই মারা গেছেন। তবে সেটা কিভাবে হয়েছিল জানিনা। তাকে শেষ দেখাটুকু দেখবার সৌভাগ্যও হয়নি আমার। আমি তখন সবে আইপিএস পাশ করে হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ ছিলাম। না না, পিসেমশাই, পিসিকে এখন কিছু জানাবার দরকার নেই। আর আমি যে এখানে এসেছিলাম, এ কথাও তাকে জানাবার দরকার নেই এখন। আপনারা দয়া করে আমাকে শুধু একটু সুযোগ করে দিন। আমি যেন দুর থেকে পিসিকে একটুখানি দেখতে পারি। তাহলেই আমার মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবে। আমি তাকে একটু সময় দেখেই, দুর থেকে তাকে প্রণাম করেই এখান থেকে চলে যাব”।
নিরঞ্জনবাবু ম্লান হেসে বললেন, “তাই কি হয় বাবা? এতদিন বাদে যে আমরা তোমাকে পেয়েছি, এটাই কি কম সৌভাগ্যের কথা আমাদের কাছে? কিন্তু স্বার্থপরের মত আমরাই সে সৌভাগ্য উপভোগ করব, আর যার সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক সেই মহিলাই এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন, এটা তো আমরা কেউই মেনে নিতে পারব না বাবা। তুমি একটু ধৈর্য ধরে বোসো। একটা না একটা উপায় ঠিকই বের হয়ে আসবে। তোমার অন্য দুই দাদা আসুক, ডাক্তার আসুক, তারপর সবাই মিলে ভাবলে একটা রাস্তা ঠিক পেয়ে যাব আমরা। কিন্তু বাবা, তুমি অন্য কিছু ভেবো না। ততক্ষণ তোমাকে কিন্তু এখানেই আমাদের সাথে থাকতে হবে। তা তুমি তো সেই দুপুর বেলায় কালচিনি থেকে বেরিয়েছ। সন্ধ্যে হতে চলল, তোমার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে। দাঁড়াও তোমার জন্যে আমি কিছু খাবার ব্যবস্থা করি আগে”।
পরিতোষ অনেক বারণ করা সত্বেও নিরঞ্জনবাবু শুনলেন না। নিজের গদীর ওপরে একটা কাঠের ক্যাশ বাক্সের পাশ থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে ফোন করে কাউকে বললেন, “বড়বৌমা, একজনের জন্য কিছু জলখাবার পাঠিয়ে দিও তো গদীতে” বলে চুপ করে ও’পাশের কথা শুনে আবার বললেন, “সে’সব তুমি পরে জানতে পারবে মা। আপাততঃ ধরে নাও, বিশেষ এক অতিথি এসেছে আমার এখানে। সেটা ভেবেই ভাল করে গুছিয়ে দিও সব কিছু। কেমন? আর তোমার মা কেমন আছেন”? বলে আরও কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে “ঠিক আছে” বলে ফোন বন্ধ করে নামিয়ে রাখলেন।
এমন সময় অমলেন্দু পেছনের দড়জা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “বাবা ডাক্তার বিশ্বাস আসছেন। বললেন দশ পনেরো মিনিটের ভেতর এসে পড়বেন”।
তার কথা শেষ না হতেই হন্তদন্ত হয়ে আরও দু’জন দোকানের দিক থেকে গদির ঘরে এসে ঢুকলেন। তার মধ্যে বড়জন অমলেন্দুর কথা ধরেই জিজ্ঞেস করলেন, “ডাক্তার আসছে মানে? কার কী হয়েছে বাবা”?
আরেকজন অমলেন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁরে অমু, মা ঠিক আছেন তো”?
অমলেন্দু কিছু বলবার আগেই নিরঞ্জনবাবু হাত তুলে তার দুই বড়ছেলেকে শান্ত হবার ঈশারা করে বললেন, “তোরা শান্ত হ শামু বিমু। তেমন কিছু হয়নি। তবে তোদেরকে এভাবে ডেকে এনেছি, তার একটা বিশেষ কারন আছে। একে দ্যাখ। আন্দাজ কর তো দেখি এ ছেলেটা কে হতে পারে”? বলে পরিতোষের দিকে ঈশারা করল।
অমলেন্দু তার বাবাকে বললেন, “বাবা আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। ডাক্তারবাবু চলে আসতে পারেন। আগে তো তাকে এখানে এনেই গোটা পরিস্থিতিটা বোঝাতে হবে, তাই না”?
নিরঞ্জনবাবু অনুমতি দিতে অমলেন্দু বাইরে চলে গেলেন। নতুন আসা অন্য দু’জন পরিতোষকে দেখে কিছু আন্দাজ করতে না পেরে বললেন, “বাবা আমরা তো কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। কে উনি”?
নিরঞ্জনবাবু পরিতোষকে একহাতে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে আনন্দিত স্বরে বললেন, “এ হচ্ছে পরিতোষ। তোদের আরেকটা ভাই। তোদের মামার ছেলে রে। আর পরিতোষ এরা তোমার পিসির দুই বড় ছেলে। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু”।
দুই ছেলেই বিস্ময়ে আর আনন্দে প্রায় একসাথেই বলে উঠলেন, “সত্যি বলছ বাবা? এ আমাদের ভাই? আমাদের একমাত্র মামার ছেলে”?
পরিতোষ গদি থেকে নেমে দুই বড়ভাইকে প্রণাম করবার জন্য ঝুঁকতেই তারা দু’জনেই পরিতোষের হাত ধরে বলল, “থাক থাক ভাই। আমাদের প্রণাম করতে হবে না। ওহ, আজ কত বড় খুশীর দিন আমাদের সকলের। এতগুলো বছর ধরে যাদের আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাদের একজনকে আজ পেয়েছি আমরা। তাহলে তো মামা, মামী, দিদা দাদু সবাইকেই এবার আমরা দেখতে পারব বাবা”।
অপেক্ষাকৃত কম বয়স যার তিনি পরিতোষের একটা হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু বাবা, ও এসেছে কখন? আর ওকে এখনও বাড়িতে নিয়ে যাওনি কেন? এখানেই বসিয়ে রেখেছ”?
নিরঞ্জনবাবু একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বসিয়ে রেখেছি কি আর সাধে রে। ও হচ্ছে সদ্য গাছে ফোটা একটা গোলাপ ফুল। গোলাপ ফুলের রূপ আর সুগন্ধের সাথে সাথে বোঁটার দিকে যে কাঁটাও থাকে রে। সে কাঁটার খোঁচা লাগবে বুঝতে পেরেই তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। তাই তো তোদের ডেকে আনলুম। ডাক্তার বিশ্বাসও আসছে। উনি এলে সবাই মিলে বসে পরামর্শ করব, যাতে কাঁটার খোঁচা খেতে না হয়”।
শ্যামলেন্দু তার বাবার কথার অর্থ কিছু বুঝতে না পেরে জজ্ঞেস করলেন, “তুমি কী বলছ বাবা? আমরা তো কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না”।
এমন সময়েই পেছন দিকের দড়জার ওপার থেকে নারীকন্ঠে কেউ বলে উঠল, “কাকাবাবু, খাবার এনেছি। ভেতরে আসব”?
নিরঞ্জনবাবু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দুই ছেলে চুপ থাকতে বলে বললেন, “হ্যাঁ তাপসী, ভেতরে নিয়ে আয়”।
বছর তিরিশের এক বিবাহিতা মহিলা খাবারের থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরটার এক কোনায় যে একটা ছোট টেবিল চেয়ার আছে সেটা পরিতোষের এতক্ষণে নজরে পড়ল। মহিলা ওই টেবিলের ওপর খাবারের থালা আর গ্লাস রেখে শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দুকে গদির ঘরে দেখে মনে মনে একটু অবাকই হল। এ সময়ে এই দু’জনের তো এখানে থাকবার কথা নয়। ফিরে যাবার আগে পরিতোষের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে বেরিয়ে গেল।
নিরঞ্জনবাবু তখন বললেন, “ছেলেটা অনেকক্ষণ হল এসেছে। দুপুরে খাবার খেয়েই কালচিনি থেকে ট্রেনে উঠেছিল। বাড়ির ভেতর নিতে পারছিলুম না। তাই বড়বৌমাকে বলে ওর জন্য কিছু খাবার আনিয়ে নিলাম” বলে পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, “বাবা পরিতোষ, তুমি তো আশা করি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছ। আমার মনটা খুব চাইছে তোমার মুখে প্রথম গ্রাসটা তোমার পিসি নিজেই তুলে দিক। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করেই সেটা আর করতে পারছি না। তুমি আমাদের অসহায়তাটুকু বুঝে আমাদের ক্ষমা করে দিও বাবা। ওই ওদিকে ছোট একটা বাথরুম আছে। সেখানে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এ খাবারটুকু খেয়ে নাও বাবা। নইলে এগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে”।
পরিতোষ একটু লাজুক মুখে বলল, “আমার কিন্তু একেবারেই ক্ষিদে পায়নি পিশেমশাই। আর পিসির কথা ভেবে তো আরও চিন্তা হচ্ছে আমার। এতসব তো খেতেই পারব না আমি”।
নিরঞ্জনবাবু স্নেহমাখা সুরে বললেন, “ঠিক আছে বাবা, যেটুকু পার, খেয়ে নাও। ডাক্তার এলে তার সাথে পরামর্শ করেই তোমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাব আমরা। অবশ্য তোমার পিসি যখন শুনবেন যে আমাদের বাড়ি এসেও তুমি প্রথম খাবার খেয়েছ এ গদিতে বসে, তখন আমাদের সকলের ওপরেই তিনি কিছু চোটপাট করবেনই”।
পরিতোষ উঠে বাথরুমের দিকে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে টেবিলে খেতে বসবার আগেই দেখল তার দুই দাদা বিধুবাবুর লেখা চিঠিটা পড়ছেন। চিঠি পড়া শেষ হলে মেজছেলে বিমলেন্দু বললেন, “তাহলে শেষ মেষ বিধুমামুই আমাদের এত বড় উপকারটা করলেন”।
বড়ছেলে শ্যামলেন্দু বললেন, “হ্যাঁ বাবা, বিধুমামুই যখন ওকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাহলে তো ওকে সন্দেহ করবার মত কিছু নেই। বিধুমামুর মত লোক কিছুতেই কাউকে ঠকাতে পারেন না। তাই পরিতোষই যে আমাদের ভাই, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। কিন্তু ওকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওনি কেন তোমরা, সেটাই তো বুঝতে পাচ্ছি না”।
নিরঞ্জনবাবু শান্ত গলায় বললেন, “ভগবানের অসীম কৃপা যে পরিতোষ আমাদের কাছে এসে পড়েছে। এ দিনটার জন্যেই তো আমরা চুয়াল্লিশটা বছর ভগবানের কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করে যাচ্ছিলুম। কিন্ত এ সুখের সাথে সাথে অনেকগুলো দুঃসংবাদও যে আমাদের কাছে চলে আসবে, সেটা তো আমরা কেউই আশাই করিনি। তোদের দাদু, দিদিমা, মামা এমনকি তোদের মামীও, এরা কেউই আর বেঁচে নেই রে। এনারা সকলেই এ পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে চলে গেছেন”।
শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু দু’জনেই চমকে উঠে চাপা চিৎকার করে উঠল, “কী বলছ বাবা? এরা সকলেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন”!
নিরঞ্জনবাবু আগের মতই শান্ত স্বরে বললেন, “হ্যাঁরে, পরিতোষের মুখেই খানিকক্ষণ আগে এ দুঃসংবাদটা শুনলুম আমরা। আসলে সময়ের ব্যবধানটাও তো কম নয়। চুয়াল্লিশটা বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের বিয়ের পর। এতোটা দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীর কত কিছু বদলে গেছে। আমরাও সবাই কে কোথায় ছিলুম, কে কোথায় ভেসে এসেছি, কে কোথায় স্রোতের টানে বয়ে গেছে। কিন্তু একসাথেই যে চার চারজনের মৃত্যু সংবাদ আমরা পাবো, এ তো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। এবার বুঝতে পারছিস? ওকে এতক্ষণ ধরে এখানেই বসিয়ে রেখেছি কেন”?
বিমলেন্দু ভীত কন্ঠে বললেন, “মা তো এ দুঃসংবাদ গুলো শুনে সইতেই পারবেন না। কী হবে বাবা”?
______________________________