Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 229)

বিধুবাবুর কথা শুনে পরিতোষের চোখ দুটোয় খুশীর ঝিলিক ফুটে উঠল। সে চোখ বড়বড় করে উত্তেজিত ভাবে বলল, “আমার পিসি এখনও বেঁচে আছেন আর সুস্থ আছেন? সত্যি বলছেন কাকু”?

বিধুবাবুও খুশী ভরা গলায় জবাব দিলেন, “হ্যাঁ বাবা, তোমার পিসি, এখনও সুস্থ আছেন। তার শরীর স্বাস্থ্য এখনও ঠিক আছে”।

পরিতোষ হঠাৎ করে বিধুবাবুর দুটো হাত ধরে কাতর গলায় বলে উঠল, “কাকু, আপনি আমাকে তাদের নাম ঠিকানাটুকু দিতে পারবেন? অন্ততঃ একটি বার তাকে চাক্ষুষ দেখতে চাই আমি। উনি যদি আমার পরিচয় পেয়ে আমাকে ঘৃণাও করেন, তবু আমি তাতে কিছু মনে করব না। আমার মনে অন্ততঃ এ শান্তিটুকু থাকবে যে এ পৃথিবীতে আমার আপন বলতে এখনও একজন আছেন” বলতে বলতে তার গলা ধরে এল। তার দু’চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা নেমে এল।
 

বিভাদেবীও পরিতোষের আকুলতা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছেন। বিধুবাবু পরিতোষের হাত ধরে বললেন, “কিচ্ছু ভেবনা বাবা। তুমি যখন চাইছ, তখন তুমি আজ রাতটা এই গরীব কাকুর বাড়িতে থেকে যাও। আগামীকাল সকালে আমি নিজে তোমাকে তোমার পিসির কাছে নিয়ে যাব”।

পরিতোষ ব্যগ্রভাবে বলল, “কাকু, এতদিন জানতাম যে আমার আপন বলতে এ পৃথিবীতে আর কেউ বেঁচে নেই। তাই নিজেকে একেবারে অনাথ বলে ধরে নিয়েই নিশ্চিন্ত ছিলাম। এখন আমার পিসি আছেন শুনতে পেয়ে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। তবে আমি আপনাকে এখনই সেখানে যেতে বাধ্য করতে চাই না। আপনি আমার পিসি আর পিসেমশাইয়ের নাম আর ঠিকানাটা আমাকে একটু বলে দিন। আমি আজই আলিপুরদুয়ার গিয়ে তার সাথে দেখা করতে চাই। আমার মনে হয় এখান থেকে সেখানে যেতে খুব বেশী সময় লাগবে না। যদি আমি ফিরে আসবার জন্য কোনও বাস, ট্রেন কিংবা ট্যাক্সি পেয়ে যাই, তাহলে রাতেই এখানে ফিরে আসব”।

বিধুবাবু পরিতোষের কথা শুনে মিষ্টি করে হেসে বললেন, “বুঝতে পারছি বাবা। তুমি আর তর সইতে পারছ না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। রক্তের টান বুঝি একেই বলে। কিন্তু আজ তো আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বাবা। তবে তুমি যদি আজই যেতে চাও, তাহলে তোমায় নাহয় তাদের নাম ঠিকানা লিখে দিচ্ছি” বলে কিংশুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোকা আমাকে একটা কাগজ কলম দে তো”।

পরিতোষ সাথে সাথে নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল, “কাকু আপনি বলুন। আমি আমার মোবাইলে লিখে নিচ্ছি”।

বিধুবাবু বললেন, “আচ্ছা, লিখে নাও তাহলে। তোমার পিসির নাম হচ্ছে শ্রীমতী হৈমবতী মন্ডল। আর তোমার পিসেমশাইয়ের নাম হচ্ছে শ্রীযুক্ত নিরঞ্জন মন্ডল। আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় মাইল খানেক যাবার পরেই একটা বড় তেপথী দেখতে পাবে। সেখানে পৌঁছে যে কাউকে নিরুবাবুর দোকানের কথা শুধোলেই তারা তোমাকে তোমার পিসেমশাইয়ের দোকান দেখিয়ে দেবে। দোকানের ঠিক পেছনেই তাদের পাঁচতলা উঁচু বাড়ি। দোকানটার নাম মণ্ডল হোলসেলার্স। আশা করি তোমার খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হবে না। তবে বাবা, এর মধ্যে একটা কথা আছে। তারা কিন্তু অচেনা অজানা লোকদের চট করেই বিশ্বাস করেন না। অবশ্য তার যথাযথ কারনও আছে” বলে একটু থেমে কিছু একটা ভেবে বললেন, “আচ্ছা দাঁড়াও। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি চট করে। তুমি বরং সেটা সঙ্গে নিয়ে যাও। যদি তারা তোমার মুখের কথায় আশ্বস্ত না হন তাহলে দোকানের গদিতে যে বসে থাকবে তার হাতেই এ চিঠিটা দিও। আর বোলো আমিই তোমায় সেখানে পাঠিয়েছি। আমার মনে হয় আমার চিঠিটা পেলে তারা নিশ্চয়ই তোমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যাবেন। আর তোমার মনের ইচ্ছেও পূর্ণ হবে” বলে আবার কিংশুককে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কইরে খোকা, যা একটা কাগজ কলম এনে দে আমাকে। তাড়াতাড়ি চিঠিটা লিখে দিলে ও যদি এখনই বেরিয়ে পরে তাহলে আড়াইটের ট্রেনটা হয়ত ধরতে পারবে”।

কিংশুক কাগজ কলম আনতেই বিধুবাবু নিরঞ্জন মণ্ডলের নামে একটা চিঠি লিখে দিলেন। এ চিঠি নিয়ে কে তার কাছে যাচ্ছে, তা-ও বিশদে বর্ণনা করে লিখলেন। তার তোষকের তলা থেকে একটা খাম বের করে চিঠিটা তাতে পুড়ে দিতে দিতে পরিতোষকে বললেন, “আমি জানি, হিমুদি তোমাকে খুব আদর যত্ন করবেন। তাই আমার মনে হয়না তুমি আজ ফিরতে পারবে। কিন্তু বাবা, আজ হোক বা কাল হোক, তুমি কিন্তু সেখান থেকেই সরাসরি কলকাতা চলে যেও না। আসলে আজ সকালে যখন রচু তোমার এখানে আসবার খবরটা দিয়েছিল, তার পর আমি আর বাজারে যেতে পারিনি। তাই তোমার কাকিমাও তোমার জন্য খুব একটা আয়োজন করতে পারেন নি। তোমার পিসির ওখান থেকে বেরিয়ে তুমি কিন্তু অবশ্যই আবার এখানে আসবে। তোমাকে একটু ভালমন্দ খাওয়াতে না পারলে যে আমি খুব দুঃখ পাব বাবা। আর পরলোকে দুর্গাও আমাকে নিন্দেমন্দ করবে। তাই আমার এ অনুরোধটুকু তুমি রেখ বাবা”।
 

বিধুবাবু চিঠি লিখতে লিখতেই পরিতোষ নিজের পোশাক পরিবর্তন করে বেরোবার জন্য তৈরী হয়ে গিয়েছিল। বিধুবাবুর হাত থেকে চিঠিটা নিতে নিতে বলল, “আমি কথা দিচ্ছি, অবশ্যই আসব কাকু। আজ আমার কত সৌভাগ্যের দিন। বাবার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর খোঁজ পেলাম। আর ঘন্টা খানেক বাদেই হয়ত এমন আরেকজনের দেখা পেতে চলেছি যে কিনা আমার বাবার রক্তের সম্পর্কের আপন দিদি। আর এখানে না এলে, এ’সব কি আমার কপালে জুটত বলুন। তাই আলিপুরদুয়ার থেকে আমি অবশ্যই এখানে আসব” বলে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে প্রণাম করল।


*****************

বিধুবাবু কিংশুককে পরিতোষের সাথে ষ্টেশন অব্দি পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু পরিতোষই তাতে বারণ করে একাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বিকেল তিনটে বাজবার পাঁচ মিনিট আগেই ট্রেন আলিপুরদুয়ার জংশনে পৌঁছে গেল। ষ্টেশন চত্ত্বর থেকে বেরিয়েই সামনের একটা হোটেলে জিজ্ঞেস করে অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। অটোতে যেতে যেতেই সে সীমন্তিনীকে ফোন করবে ভেবেও করল না। তার মনে পড়ল এ সময়ে সীমন্তিনী আর নবনীতা দুজনেই তাদের কাজে ব্যস্ত থাকবে। তাই সে শুধু সীমন্তিনীর ফোনে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল যে ব্যক্তিগত জরুরী একটা কাজে সে আলিপুরদুয়ার এসেছে। আজ কালচিনি ফেরা সম্ভব হবে কিনা সে জানে না।

দশ মিনিট বাদেই তেপথীর মোড়ে সে অটো থেকে নামল। তারপর রাস্তার ধারে একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই দোকানী তাকে রাস্তা চিনিয়ে দিল। মণ্ডল হোলসেলার্সের বিশাল দোকানটার সামনে এসে দেখল পেছনেই পাঁচতলা উঁচু একটা সুন্দর বিল্ডিং। দুরু দুরু বুকে সে দোকানটার ভেতর গিয়ে ঢুকল। প্রথমেই একটা কাউন্টার দেখতে পেল, যেখানে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সী একজন লোক বসে খদ্দেরদের সাথে লেনদেনের হিসাব করছিল। পরিতোষ তার কাছে গিয়ে বলল, “আচ্ছা, বলছি নিরঞ্জনবাবু কি এখানে আছেন? আমি কালচিনি থেকে আসছি। বিধুভূষণ চক্রবর্তী আমায় পাঠিয়েছেন”।

লোকটা তার ব্যস্ততার মাঝেও মুখ তুলে তার দিকে চেয়ে বলল, “ও কালচিনির বিধুমামু আপনাকে পাঠিয়েছেন? কিন্তু তার মাল তো আমরা গতকালই পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি কি পাননি”?

পরিতোষ একটু হেসে বলল, “না আমাকে উনি সে জন্যে পাঠান নি। একটা অন্য কাজে পাঠিয়েছেন। আসলে উনি নিরঞ্জন বাবুর নামে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন। আর চিঠিটা নিরঞ্জন বাবুর হাতেই দিতে বলেছেন”।

লোকটা এবার আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও আচ্ছা” বলে দোকানের ভেতর দিকে মুখ করে কাউকে ডাকল, “এই বলাইদা, একটু এদিকে এসো তো”।

বলাই নামের মাঝ বয়সী একটা লোক কাউন্টারের পেছনে এসে দাঁড়াতেই কাউন্টারের লোকটা তাকে বলল, “এ বাবুকে ভেতরের গদিতে বাবার কাছে নিয়ে যাও তো”।

‘বাবা’ শব্দটা শুনেই পরিতোষ একটু চমকে গেল, এ লোকটা তাহলে তার পিসতুতো ভাই!? কিন্তু সে কিছু বলে ওঠবার আগেই বলাই তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনি ওদিক দিয়ে ঘুরে আসুন বাবু” বলে দোকানের একপাশ দিয়ে একটা সরু করিডোরের মত জায়গা দেখিয়ে দিল।

বলাইয়ের পেছন পেছন কয়েক সেকেণ্ড যাবার পর একটা ঘরের দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে বলাই জিজ্ঞেস করল, “আপনার নামটা বলুন বাবু। বাবুকে সেটা বলতে হবে”।

পরিতোষ বলল, “আমার নাম বললে উনি আমাকে চিনবেন না। আপনি গিয়ে বলুন যে কালচিনির বিধূ ভূষণ চক্রবর্তী তার লেখা একটা চিঠি আমার হাতে পাঠিয়েছেন। আমি সেটা দিতেই এখানে এসেছি”।

লোকটা একবার পরিতোষের আপাদমস্তক ভাল করে দেখে ভেতরে ঢুকে গেল। আর মিনিট খানেক বাদেই আবার দড়জা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আসুন আপনি”।

পরিতোষ নিজের ব্যাগটা কাঁধের সাথে ভাল করে চেপে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকল। ভেতরে বেশ বড়সড় একটা সাদা কাপড়ে মোড়া গদিতে ধুতী গেঞ্জী পড়া বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারার এক বৃদ্ধ আধা শোয়া হয়ে বসে আছেন। বয়স নির্ঘাত সত্তরের ওপরেই হবে বলে মনে হল পরিতোষের। গদিতে তার উল্টোদিকে দু’জন মাঝ বয়সী লোক ব্যবসায়িক কথাবার্তায় ব্যস্ত। পরিতোষকে ভেতরে ঢুকতে দেখে বয়স্ক ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “বিধুর চিঠি নিয়ে তুমিই এসেছ? তা সে কেমন আছে? সুস্থ আছে তো”?

পরিতোষ নিজের বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করতে করতে বলল, “হ্যাঁ, উনি ভাল আছেন। বিশেষ একটা ব্যাপারেই তিনি আমাকে এ চিঠিটা দিয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি তো আপনাকে ঠিক চিনি না। আপনিই নিরঞ্জন মণ্ডল তো? আসলে কাকু বলে দিয়েছেন যে এ চিঠিটা আমি যেন নিরঞ্জন বাবু ছাড়া আর কারো হাতে না দিই”।

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই নিরঞ্জন মণ্ডল। তোমাকে ‘তুমি’ করে বললাম বলে কিছু মনে কোর না। আসলে তুমি তো আমার ছেলেদের বয়সীই”।

পরিতোষ হেসে বলল, “না না, এতে মনে করবার কি আছে? এই নিন” বলে দুরুদুরু বুকে চিঠিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। নিরঞ্জনবাবু চিঠিটা হাতে নিয়ে ওপরে তার নাম ঠিকানা লেখাটা দেখে খামটা খুলতে খুলতেও থেমে গিয়ে পরিতোষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বলাইকে বলল, “এই হারামজাদা, এ বাবু যে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন দেখতে পাচ্ছিস না? একটা চেয়ার দে তাকে বসবার। এমন স্যুট বুট পড়া লোক কি গদিতে পা ভাঁজ করে বসতে পারে কখনও? তোদের আক্কেল পছন্দ আর কবে হবে বল দেখি”।

পরিতোষ ‘না না লাগবে না’ বললেও বলাই তড়িঘড়ি তার জন্যে চেয়ার পেতে দিল। পরিতোষের বুকটা এক অজানা আশঙ্কায় যেন কাঁপতে শুরু করল। চেয়ারে বসে বসে ভাবতে লাগল, এ চিঠি পড়ে তার এই পিসেমশাই নাজানি কিভাবে রিয়েক্ট করেন। দেখে তো মনে হচ্ছে, বেশ মেজাজী মানুষ। কিন্তু নিরঞ্জনবাবু চিঠিটা খুলে কয়েক সেকেণ্ড বাদেই আধ শোয়া অবস্থা থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে অবাক দৃষ্টিতে অনেক ক্ষণ পরিতোষের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর আবার চিঠির বাকি অংশ পড়তে লাগলেন। এক সময় তার চিঠি পড়া শেষ হলে তিনি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তারপর মুখ তুলে তার সামনে বসা ওই লোক দুটোকে ভারী গলায় বললেন, “যাদব, সুকুমার, তোমাদের সঙ্গে আজ আর কথা বলতে পারছি না আমি। একটা ভীষণ জরুরী কাজ এসে পড়েছে আমার হাতে। তোমরা বরং কাল বা পরশু যখন খুশী এসো”।

লোকদুটো চলে যেতে নিরঞ্জন বাবু এবার বলাইকে বললেন, “তুইও গিয়ে ছোটবাবুকে বল আমি তাকে ডাকছি একটা বিশেষ কাজে। এক্ষুনি যেন এখানে চলে আসে” বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন। পেছনে হ্যাঙ্গারে টানানো একটা পাঞ্জাবী পড়তে পড়তে অবিশ্বাস্য নরম গলায় পরিতোষকে বলেলন, “পরিতোষ, বাড়ির ভেতরে যাবার আগে, তোমার পা থেকে জুতোটা খুলে একটু এখানে এই গদীর ওপরে উঠে আসবে বাবা”?

একটু আগে যে ভদ্রলোককে পরিতোষের খুব মেজাজী বলে মনে হচ্ছিল হঠাতই তার গলায় এমন স্নেহমাখা সুর শুনে পরিতোষ মনে মনে অবাক হল। তার কথার অর্থ বুঝতে না পারলেও নিজের পা থেকে জুতো দুটো খুলে ফেলল। তারপর গদির ওপর উঠে দাঁড়াতেই নিরঞ্জনবাবু তার হাত ধরে তার গদির একটা কোনার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে ঈশারা করে নিরঞ্জনবাবু বললেন, “এনাকে তুমি চেনো নিশ্চয়ই”?

পরিতোষ অবাক হয়ে দেখল দেয়ালে তার ঠাকুর্দার ছবি টাঙানো। সুন্দর ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিটা। সুন্দর টাটকা জুই ফুলের মালা ঝুলছে ছবিটায়। পরিতোষ প্রায় ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “এ তো আমার ঠাকুর্দা কালীচরন সান্যালের ছবি”!

নিরঞ্জনবাবু হাতজোড় করে ছবিটাকে প্রণাম করে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক চিনেছ বাবা তুমি। ইনি তোমার ঠাকুর্দাই। আর আমার শ্বশুরমশাই। তোমার পিসি খুব ছোট থাকতেই আমি তাকে ভালবেসে ফেলেছিলুম। বেশ কয়েকবছর বাদে সে আমার ভালবাসা স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু আমি নিচু জাতের কায়স্থের ছেলে বলেই তোমার ঠাকুর্দা আমাকে নিজের জামাই হিসেবে স্বীকার করতে রাজি হননি। কিন্তু আমরা দু’জন তো দু’জনকে পরস্পরের জীবন মরণের সঙ্গী করে ফেলেছি ততদিনে। তাই নিরূপায় হয়ে তোমার পিসি ম্যাট্রিক পাশ করবার পরেই আমি তাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। তখন আমরা কুমারগ্রামে থাকতাম। এই আলিপুরদুয়ারে এসেই ছিন্নমস্তা কালী মন্দিরে আমরা বিয়ে করেছিলুম। তিনদিন বাদে কুমারগ্রাম ফিরে গিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠেছিলুম। আর সেদিনই তোমার পিসিকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলুম। কিন্তু তিনি আমাদের তার বাড়িতে ঢুকতেও দেননি। বলেছিলেন যে তার মেয়ে তিনদিন আগেই মারা গেছে। তার আর কোনও মেয়েও নেই আর মেয়ে জামাইও নেই। হিমু, মানে তোমার পিসি, সেদিন খুব কেঁদেছিল। তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষাও আমি খুঁজে পাচ্ছিলুম না। তোমার পিসিকে নিয়ে যখন আবার নিজেদের বাড়ির দিকে ফিরছিলুম তখন পথে তোমার বাবা দুর্গার সাথে দেখা হয়েছিল। ও তখন খুব ছোট। দশ এগার বছরের বাচ্চা একটা ছেলে। দিদিকে ভীষণ ভালবাসতো। তিনদিন বাদে দিদিকে দেখে সে আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল। কিন্তু কাছে এসে তার দিদিকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েই সে থমকে গিয়েছিল। হয়ত বাবার নিষেধাজ্ঞা মনে পড়ে গিয়েছিল তার। সেদিনকার ওই মূহুর্তের দৃশ্যটা আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে পরিতোষ। দুর্গা তার দিদির খুব কাছে এসেও দু’পা পিছিয়ে গিয়ে মাটি ছুঁয়ে তার দিদিকে প্রণাম করে এক ছুটে বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিল। একটা কথাও মুখ ফুটে বলেনি। তখন তোমার পিসি স্থান কাল ভুলে রাস্তার মাঝেই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল। অনেক কষ্টে তাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম। আমাদের বিয়ের দু’মাস বাদেই নিজেদের ভিটে জমি বিক্রী করে শ্বশুরমশাই তোমার ঠাকুমা আর বাবাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে তোমার পিসিকে শুধু কাঁদতেই দেখেছি। ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রায় পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করেছিল। তারপর প্রায় ছ’মাস ডাক্তারের চিকিৎসা আর আমাদের বাড়ির লোকজনদের পরিচর্যায় ও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। তারপর নিজের ভবিতব্যকেই মেনে নিয়েছিল। তবে আমি বা তোমার পিসি কেউই কিন্তু তোমার ঠাকুর্দা, ঠাকুমা বা বাবাকে কোনও রকম দোষারোপ করিনি কোনদিন। বরং তাদের মনে দুঃখ দেবার জন্য আমরা আজও নিজেদের অপরাধী বলেই ভাবি। এখনও রোজ সকালে গদিতে এসে আমি শ্বশুর মশাইয়ের এ ছবিটায় নিজের হাতে মালা পড়াই। হাতজোড় করে তার কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের দু’জনকে ক্ষমা করে দিতে”।

পরিতোষও হাতজোড় করে তার ঠাকুর্দার ছবিকে প্রণাম করে নিরঞ্জনবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই নিরঞ্জনবাবু হা হা করে উঠে বললেন, “এ কী করলে বাবা? তোমরা ',। আমি কায়স্থ। আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাটা তোমার উচিৎ হয়নি বাবা”।

পরিতোষ শান্ত গলায় জবাব দিল, “আমি ও’সব জাতপাতে আর ধর্মের গোড়ামিতে বিশ্বাস করিনা পিসেমশাই। আমি বিশ্বাস করি শুধু মানুষে। আপনি আমার গুরুজন। আমার নমস্য। তাই আপনাকে আমি প্রণাম করতেই পারি”।

নিরঞ্জনবাবু আবার তার শ্বশুরের ছবিকে প্রণাম করে বললেন, “এতোদিনে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল বাবা। এতদিনে আপনার জামাই হবার স্বীকৃতি পেলাম আমি” বলে পরিতোষের দিকে তাকিয়ে বলল, “জানো পরিতোষ, প্রায় দেড় দু’মাস আগে বিধু যখন আমাদের এখানে প্রথম খরিদ্দারী করতে এসেছিল, তখন আমি তাকে তোমার পিসির কাছে নিয়ে গিয়েছিলুম। তোমার পিসি তখন ভেবেছিল যে বিধু নয় তার নিজের ছোটভাই দুর্গাই বুঝি তার কাছে ফিরে এসেছে। বিধুর হাতদুটো ধরে সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তার কাছে আমরা তোমার বাবা, ঠাকুমা আর ঠাকুর্দার ব্যাপারে জানতে চাইছিলুম। কিন্তু সে-ও তখন বলেছিল যে সে কিছু জানে না। আজ এতদিন পর মনে হচ্ছে বাবা আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। হয়ত এ আমার আর তোমার পিসির রোজকার প্রার্থনারই ফল। বাবা নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এতদিনে। নইলে এতগুলো বছর পর তুমি এভাবে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে না কিছুতেই” বলতে বলতে তার গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে গেল।
 

পরিতোষকে দু’হাতে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে নিরঞ্জনবাবু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। পরিতোষের ভেতর থেকেও প্রচণ্ড একটা কান্নার আবেগ ধেয়ে আসতে চাইছিল যেন। বৃদ্ধ নিরঞ্জনবাবুকে সে-ও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নিজের কান্না প্রশমিত করবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। আর ঠিক অমন সময়েই তাদের পেছন থেকে কেউ একজন ‘বাবা’ বলে ডেকে উঠতেই তারা একে অপরের হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হল। নিরঞ্জনবাবু নিজের ধুতির খুট দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলেন। আর পরিতোষ পেছনে তাকিয়ে দেখে খানিক আগে দোকানের সামনের কাউন্টারে যে ভদ্রলোক বসে ছিলেন তিনি এই গদিঘরে এসে পৌঁছেছেন। নিজের বাবাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে লোকটা উদ্বিঘ্ন ভাবে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন তুমি? ইনি কে”?
 

নিরঞ্জনবাবু চোখে জল থাকা অবস্থাতেও মুখে হাসি এনে তার ছেলের কথার জবাবে বললেন, “অমু, এ তোর ভাই রে। তোর মামাতো ভাই। তোর নিজের মামার ছেলে, পরিতোষ। কলকাতায় থাকে রে। পুলিশের মস্ত বড় অফিসার একজন” বলে পরিতোষকে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই দোকানে ঢোকবার সময়ই ওকে দেখেছ। ও অমলেন্দু, তোমার পিসির ছোট ছেলে”।

পরিতোষ গদি থেকে নেমে অমলেন্দুর পায়ে হাত দিতে যেতেই অমলেন্দু তার দুটো হাত ধরে বলল, “আরে এ কী করছেন আপনি? না না প্রণাম করতে হবে না”।

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “জীবনে আজ প্রথম আমি এক দাদাকে দেখবার সুযোগ পেলাম। ছোট ভাই হয়ে দাদাকে কি একটা প্রণাম করতে পারিনা আমি”?
 

অমলেন্দু পরিতোষের হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাদের জন্মের আগেই দাদু, দিদিমা আর মামা মা-বাবার সাথে তাদের সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ভাইবোনেরা ছোটবেলা থেকে শুধু ছবিতেই তাদের দেখেছি। বড় হয়ে ওঠার পর যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই আমরা তিনভাই দু’বোন নানাভাবে নানাদিকে দাদু, দিদিমা আর মামাকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও তাদের হদিশ পাই নি। মাকে সেই ছোট্টবেলা থেকে রোজ কাঁদতে দেখেছি আমরা। ভগবান আজ আমাদের দিকে তার সদয় দৃষ্টি দিয়েছেন। তা ভাই, আমাদের দাদু, দিদিমা আর মামা এরা সবাই কে কেমন আছেন? কোথায় আছেন তারা সবাই”?

______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 29-03-2020, 12:10 AM



Users browsing this thread: 6 Guest(s)