Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 228)

রান্নাঘরের পেছনেই কলের পাড়ে কিংশুকের গলা পেয়ে বিভাদেবী নিজের চিন্তার জাল ছিঁড়ে ফেলে চায়ের জল চাপালেন উনোনে। রান্নাঘর থেকেই গলা তুলে বিভাদেবী ছেলেকে বললেন, “খোকা, চট করে তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে আয় তো উনি এখন চা খাবেন কিনা”।

পরিতোষকে কলের পাড় আর বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে কিংশুক বাইরে চলে গেল। আর খানিক বাদে ফিরে এসে রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, “মা, বাবার জন্যেও বানিও চা। উনি আসছেন”।

পরিতোষ হাতমুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে একটা পাজামা আর পাঞ্জাবী পড়ে ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময়েই সীমন্তিনীর ফোন এল। পরিতোষ বিধুবাবুর বাড়ি পৌঁছে গেছে শুনে সীমন্তিনীও আশ্বস্ত হল। কিংশুকের ডাকে পরিতোষ ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল বিভাদেবী তার জন্যে চা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।

পরিতোষ বিভাদেবীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল, “কাকুও তো চা খাবেন বলছিলেন। উনি আসবেন না”?

বিভাদেবী হাতের অন্য কাপটা কিংশুককে দিতে দিতে বলল, “দোকানে বোধহয় খদ্দের আছে। তাই বোধহয় উনি আসতে পারছেন না। খোকা দিয়ে আসবে তার চা-টা। তুমি খাও বাবা”।
 

পরিতোষ চায়ের কাঁপে চুমুক দিতেই বিভাদেবী বললেন, “মন্তিমার মুখে শুনেছি, তুমি নাকি ওর খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু এই তো তুমি প্রথম এসেছ ওর ওখানে। কিন্তু দুটো দিনও সেখানে না থেকেই চলে যাচ্ছ বাবা”?

পরিতোষ একটু হেসে জবাব দিল, “কাকিমা, একটা খুব জরুরী কাজ ছিল বলেই আমাকে এভাবে হঠাৎ করে দিন তিনেকের ছুটি নিয়ে চলে আসতে হয়েছে। মন্তির ওখানে যে কাজে এসেছিলাম সেটা তো হয়ে গেছে। আর আমার বাকি আরেকটা কাজ আছে মালবাজারে। কিন্তু এদিকে এসেছি শুনেই রচনা এমন করে বলল যে এখানে না এসে পারলাম না। তাই ভাবলাম আজ একটা বেলা এখানে আপনাদের সাথে কাটিয়ে আজ বিকেলের দিকেই আমি মালবাজার চলে যাব। আর মালবাজারের কাজটা সেরে কাল বিকেলের দিকে আমি শিলিগুড়ি হয়ে বাগডোগরা চলে যাব। তারপর কলকাতা”।
 

বিভাদেবী পরিতোষের কথা শুনে বললেন, “ওমা সে কী কথা? তুমি আজই চলে যাবে? না না, ওটি হবে না বাবা। তোমাকে আজকের রাতটা আমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে। কাল সকালে যেখানে যেতে চাও, চলে যেও। অবশ্য আমাদের বাড়ির যা জরাজীর্ন অবস্থা, তাতে তোমার বেশ অসুবিধেই হবে, জানি। তবু বলছি একটু কষ্ট স্বীকার করেই থেকে যাও বাবা। নইলে রচু আর মন্তি দু’জনেই কিন্তু মন খারাপ করবে”।

পরিতোষ হেসে জবাব দিল, “ওই মেয়েদুটোকে কষ্ট দিতে আমিও চাইনা কাকিমা। আপনি হয়তো জানেন না কাকিমা, আপনার ছোটমেয়ে কিন্তু আমাকে দাদা বলে ডাকে। আমিও ওকে আমার বোন বলেই ভাবি। আসলে আমার তো এ পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ নেই। তাই রচনার মত একটা বোন পেয়ে আমিও খুব খুব খুশী। আর সে সম্পর্কের সূত্র ধরেই তো মুখ ফসকে আপনাকে মা বলে ফেলেছিলাম। যে মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, তিনি তো আমার বোধবুদ্ধি হবার আগেই স্বর্গে চলে গেছেন। শুধু ছবিতেই তাকে দেখেছি আমি। কিন্তু আজ আপনাকে দেখে মনে হল আমি যেন সত্যি এক মায়ের সান্নিধ্যে এসেছি। জীবনে প্রথমবার আজ মনে হচ্ছে .......” বলতে বলতে তার গলা ধরে এল। মুখ নামিয়ে চুপ করে নিজের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসা অশ্রু সংবরণ করবার চেষ্টা করতে লাগল।

বিভাদেবী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “মন খারাপ কোর না বাবা। ভগবান যার কপালে যা লিখেছেন, তা থেকে কারো কি আর মুক্তি আছে? তুমি রচুকে নিজের বোন বলে ভাবো। তাই আমিও তো তোমার মায়ের মতই। তোমার যখন ইচ্ছে তুমি আমার কাছে চলে আসতে পার”।

এমন সময় কিংশুক মোবাইলে কথা বলতে বলতে ছুটে এসে পরিতোষের হাতে ফোনটা দিয়ে বলল, “পরিদা, ছোড়দি আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে”।

পরিতোষ ফোনটা নিয়ে কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যাঁ রচু সোনা, বলো”।

রচনার আদুরে বায়নায় পরিতোষ কালচিনিতে থেকে যেতে মত দিতে বাধ্য হল।

বিধুবাবু দুপুর প্রায় একটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে বাড়ির ভেতর এলেন। আর আগে এসে পরিতোষের সাথে কথা বলতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবার পর পরিতোষ সকলের জন্যে নিয়ে আসা পোশাকগুলো সকলের হাতে দিয়ে বলল, “মাকে তো আমি জ্ঞান হবার আগেই হারিয়েছি। আর বাবাকে যখন কিছু দেবার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম, ঠিক তখনই উনিও আমাকে অনাথ করে দিয়ে চলে গেলেন। আজ আপনাদের হাতে এ সামান্য উপহারটুকু দিতে পেরে আমার মনে যে কেমন অনুভূতি হচ্ছে, সেটা আপনাদের কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। এর আগে আর আমার এদিকে আসা হয়নি কখনও। ভবিষ্যতেও আর কখনও আসা হবে কিনা, সেটাও জানি না। সামনের মাসেই তো পূজো। তখন আপনারা সবাই এগুলো পড়ে আমাকে আশীর্বাদ করবেন”।

দুপুরে বিধুবাবু দু’ঘন্টার মত দোকান বন্ধ রেখে ঘরে একটু বিশ্রাম নেন। প্রায় ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নেন। তারপর বিকেল তিনটে নাগাদ আবার দোকানে চলে যান। কিন্তু আজ আর তিনি ঘুমোবার কথা মনেও আনলেন না। তিনি ভাবলেন, এই ছেলেটির সাথেই তো মন্তি অর্চুর বিয়ে দিতে চাইছে। প্রথম দেখাতেই ছেলেটাকে তার ভাল লেগেছে। তবু যে কোনও কারনেই হোক ছেলেটা যখন তাদের বাড়ি এসেই পড়েছে, তখন তার সাথে একটু কথা বলে তাকে বোঝবার কিছুটা চেষ্টা তো করাই উচিৎ। তবে তার মন্তি-মার ওপর তিনি চোখ বুজে ভরসা করতে পারেন। তার মন্তি-মা যখনই বলেছে যে ছেলেটা খুব ভাল, তখন থেকেই এই ছেলেটার ব্যাপারে তার মনে আর কোন সংশয় নেই। তবু অন্ততঃ সৌজন্য রক্ষার খাতিরেও তার সাথে কিছু কথা বলা নিতান্তই আবশ্যক। তাই তিনি পরিতোষের উপহার গ্রহণ করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা বাবা পরিতোষ, একটু আগেই তুমি বললে যে তোমার বাবা-মা দু’জনেই তোমাকে অনাথ করে দিয়ে চলে গেছেন। নিজেকে কখনও অনাথ বলে ভেবনা বাবা। আমি দরিদ্র ',। জীবনে অনেকবার অসহায় অবস্থায় পড়েছি। জীবনের কটু অভিজ্ঞতাও কম সঞ্চয় করিনি। সেই অভিজ্ঞতার জোরেই বলছি বাবা, একটা কথা সব সময় মাথায় রেখ। যাদের আপনজন বলতে পৃথিবীতে কেউ থাকে না, তাদের জন্য ঈশ্বর থাকেন। কথাটা হয়ত তুমিও শুনে থাকবে। কিন্তু আমরা সবাই এটা আমাদের জীবনে উপলব্ধি করেছি। এক ফোঁটাও মিথ্যে নয় কথাটা। তুমি জানো কিনা জানিনা, আমাদের বড়মেয়ে অর্চু, সাত সাতটা বছর ওর নিজের মা, বাবা, ভাই, বোন বেঁচে থাকা সত্বেও একেবারে অনাথের মতই জীবন কাটিয়েছে। সে আমারই দোষে। কিন্তু আমরা ওর কাছে যেতে না পারলেও ভগবান ঠিকই ওর ওপর নজর রাখছিলেন। তাই তো ও যখন মৃত্যুর মুখে পড়েছিল, তখনই ঠিক সময়ে ভগবান নিজের দূত পাঠিয়ে ওকে রক্ষা করেছেন” বলে একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, “তা যাক সে সব কথা। ও’সব দুঃস্বপ্নের স্মৃতিচারণা করাও বড্ড বেদনাদায়ক। তা বাবা, তোমার মা বাবার কী হয়েছিল? কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতেই কি তারা চলে গেছেন”?

পরিতোষ শূণ্যে দৃষ্টি রেখে বলল, “কাকু, আমি যখন মাকে হারিয়েছি তখন আমি মোটে একটা দু’বছরের শিশু। মা-র কোন কথাই আমার মনে নেই। তবে বড় হবার পর বাবার মুখেই শুনেছি যে আমার জন্মের পর থেকেই নাকি উনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। কী হয়েছিল, তা আমি আজও জানিনা। বাবা ছিলেন পুলিশের সাধারণ একজন কনস্টেবল। উপার্জনও সীমিত ছিল। তবু তার সাধ্যমত চিকিৎসা তিনি করিয়েছিলেন। কিন্তু মাকে আর সারিয়ে তুলতে পারেননি। মা-র ব্যাপারে আমি শুধু এটুকুই জানি। বাবা একাই আমার ছোটবেলা থেকে আমাকে পেলে পুষে বড় করে তুলেছিলেন। কোনদিন কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করতেন না তিনি। তাই চাকুরী জীবনেও তার প্রাপ্য মর্য্যাদা তিনি পাননি। জানেনই তো সৎ ভাবে বেঁচে থাকতে সবাইকে হাজারো ঝুঁট ঝামেলা পোয়াতে হয়। তার উপার্জনের বেশীর ভাগ অংশটাই তিনি আমার ভরণ পোষণ আর লেখাপড়ার দিকে ব্যয় করতেন। কিন্তু তিনিও যে হাই ব্লাড প্রেসারের রুগী ছিলেন এ’কথা আমি তার মৃত্যুর আগে পর্যন্তও জানতে পারিনি। আমি আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করবার পর যখন হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং নিতে চলে গিয়েছিলাম, তার প্রায় দু’মাস বাদেই বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম। শুনলাম তার স্ট্রোক হয়েছিল। কিন্তু ট্রেনিং পেরিয়ডে ছুটি পাইনি। তাই বাবার দাহ সৎকারও আমি নিজে হাতে করতে পারিনি। আমার বন্ধুরাই সে দায়িত্ব পালন করেছিল। তবে অনেক কাকুতি মিনতি করে দিন সাতেকের ছুটি পেয়ে শ্রাদ্ধের তিনদিন আগে বাড়ি এসেছিলাম। তখন বাবার শ্রাদ্ধটা করতে পেরেছিলাম”।

এতোটা বলে পরিতোষ থামতেই বিভাদেবী বলে উঠলেন, “আহারে, বেচারা মরে গিয়েও নিজের সন্তানের হাতের আগুনটুকুও তার কপালে জুটল না”!

বিধুবাবুও পরিতোষের কথা শুনে খুব আফসোস করলেন। কিন্তু বিভাদেবীর কথা শুনে বললেন, “বিধাতা যার কপালে যা লিখে দিয়েছেন, সেটা আর কে কবে খন্ডাতে পেরেছে বলো। তা বাবা, তোমার বাবার কি খুব বয়স হয়েছিল”?

পরিতোষ নিজের ঝাপসা হয়ে আসা চোখদুটো মুছে নিয়ে বলল, “না কাকু, বাবা মারা গেছেন ২০০৫ এর জুন মাসে। তখন তার বয়স ছিল মোটে আটচল্লিশ। অনেক দিন সার্ভিস বাকি ছিল তার”।

বিধুবাবু ভারাক্রান্ত মনে বলল, “তার মানে, এখন যদি উনি বেঁচে থাকতেন তাহলে তার বয়স হত পঞ্চান্ন। এ তো আমারই বয়সী! আমারও তো এখন পঞ্চান্নই চলছে। ইশ, এ জন্যেই বলে জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। নইলে ওটা কি চলে যাবার বয়স ছিল? তা বাবা, তোমার আর কোনও আত্মীয় স্বজন নেই কোথাও”?

পরিতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি তো জীবনে কাউকে দেখিনি কাকু। তবে বাবার মুখেই শুনেছিলাম তার নাকি এক দিদি ছিল। বাবার চেয়ে উনি নাকি প্রায় ছ’ সাত বছরের বড় ছিলেন। বাবা যখন ক্লাস সিক্সে পড়তেন তখনই নাকি তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আসাম আর ভূটান বর্ডারের কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে। তখন আমার বাবা ঠাকুর্দারাও ওখানেই কোথাও থাকতেন। কিন্তু অ', একটা ছেলেকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন বলে দাদু, ঠাকুমা তাদের সেই মেয়ের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে ভিটে মাটি বিক্রি করে দিয়ে সেখান থেকে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। সে আমার জন্মের বহু আগের ঘটণা। আমার বাবাও তখন নাকি মাত্র দশ এগার বছরের। পিসির কোন ছবিও কোথাও দেখিনি। তার নাম ধাম ঠিকানা কিছুই জানিনা আমি। আর তিনি এখনও বেঁচে আছেন কিনা তাও জানিনা”।

বিধুবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, “সে কি বাবা। নিজের পিসির সম্মন্ধে তুমি কিচ্ছুটি জানো না”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “সে সুযোগই তো কখনও পাইনি কাকু। সে’সব তো আমার জন্মের অনেক আগেকার কথা। আর বাবা বলেছিলেন যে পিসি নিজের পছন্দের এক কায়স্থ নিচু জাতের ছেলের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে আমার ঠাকুর্দা নাকি তখন থেকেই তাকে চিরতরে পরিত্যাগ করেছিলেন। আর নিজেদের গ্রামেই তার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি বলে ঠাকুর্দা তার মেয়ের বিয়ের দু’তিন মাস বাদেই ওই গ্রাম ছেড়ে ঠাকুমা আর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে চিরতরে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। সেটা খুব সম্ভবতঃ ঊণিশশ’ সাতষট্টি আটষট্টি সালের কথা হবে। বাবা বিয়ে করেছিলেন কলকাতা যাবার প্রায় তের বছর পর ১৯৮১ সালে। আমার জন্ম হয়েছে ১৯৮২ সালে। তখনও ঠাকুর্দা ঠাকুমা বেঁচে ছিলেন। ৮৪ সালে মা মারা গেলেন। তার দু’তিন বছরের মধ্যেই ঠাকুমা আর দাদু মারা গিয়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর থেকে শুধু বাবাকেই কাছে পেয়েছি আমি। তার মুখেই পিসির সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হবার কথা আমি শুনেছি। বাবাও যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পিসির কোনও খোঁজ খবর করেননি। ঠাকুর্দা নাকি মৃত্যু শয্যায় শুয়ে বাবাকে এ ব্যাপারে শপথ নিতে বাধ্য করেছিলেন। তাই আমার পক্ষেও এর চেয়ে বেশী কিছু জানা সম্ভব হয়নি” বলে একটু দম নিয়ে আবার বলল, “কিন্তু বাড়িতে অলস সময়ে যখন একা বসে থাকি তখন মাঝে মাঝে সেই পিসির কথা মনে আসে আমার। মনে হয়, তার সাথে যদি যোগাযোগ থাকত তবুও বোধহয় রক্তের সম্পর্ক থাকা আমার আপন একজনের পরিচয় আমি দিতে পারতাম। কিন্তু পিসির নামও তো আমি জানিনা। আসাম-ভূটান বর্ডারের কাছাকাছি যে গ্রামে ঠাকুর্দারা থাকতেন, যে গ্রামে পিসির বিয়ে হয়েছিল সে গ্রামের নামটাও আমি জানিনা। আর এত বছর বাদে পিসি এখনও জীবিত আছেন কিনা, বা এখনও ওই গ্রামেই আছেন কিনা, এ’সব তো কিছুই জানিনা আমি। কী করে আর তাকে খুঁজব আমি বলুন”।

পরিতোষের কথা শুনতে শুনতে বিধুবাবু যেন মনে মনে তার স্মৃতির তলানিতে কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছিলেন একনাগাড়ে। পরিতোষ থামতেই তিনি বললেন, “তোমার কথা শুনে মনটা খুব ভারী হয়ে গেল বাবা। এত একাও কি কেউ হতে পারে এ পৃথিবীতে? তবে জানো বাবা, তোমার ঠাকুর্দার পরিবারের যেমন কথা তুমি শোনালে, ঠিক তেমনই একটা পরিবারকে আমি চিনতুম আমার ছোটবেলায়। কাকতালীয়ও হতে পারে। কিন্তু আমার মনের ভেতর থেকে কেউ যেন আমাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে কথাটা তোমাকে বলবার জন্য। তখন আমরা কুমারগ্রাম বলে একটা ছোট্ট জায়গায় থাকতুম। সে জায়গাটাও আসাম আর ভূটান বর্ডারের খুব কাছাকাছিই ছিল। ১৯৭০ সালে আমাদের বাড়িটা আগুনে পুড়ে একেবারে ভস্মীভূত হয়ে যাবার পর আমরা সেখান থেকে চলে এসে এখানে বাড়ি করে থাকতে শুরু করেছিলাম। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। কিন্তু কুমারগ্রামে ছোটবেলায় আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। কলেজে আমরা একসাথে পড়তাম। ওরা থাকত কুমারগ্রামের দক্ষিণ দিকের একেবারে শেষ প্রান্তে। আমার ওই ', বন্ধুর দিদিও বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে একটা কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করেছিল। আর মেয়েটা তাদের পাড়ারই ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে তারা বাড়ি ঘর বিক্রী করে দিয়ে কুমারগ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেটাও ১৯৬৮ সালের কথা। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। তখন অবশ্য আমরা জানতুম না যে তারা কোথায় গেছেন। আমরা এখানে চলে আসবার প্রায় বছর তিনেক পর বাবা কি একটা কাজে যেন কুমারগ্রাম গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে উনি আমার নামের একটা চিঠি এনে আমার হাতে দিয়েছিলেন। সে চিঠিটা আমার ওই বন্ধুর লেখা ছিল। ম্যাট্রিক পাশ করবার খবর জানিয়েছিল আমাকে। আমাদের কুমারগ্রাম বাড়ির ঠিকানায় চিঠিটা এসেছিল। আমাদের পাশের বাড়ির মালিক সেটা নাকি রেখে দিয়েছিলেন তার কাছে। তারপর বাবার হাতে দিয়েছিলেন সেটা। সে চিঠিটা কলকাতা থেকে এসেছিল, কিন্তু তাতে আমার বন্ধুর ঠিকানা লেখা ছিল না। তবে এ’টুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে দুর্গারা কুমারগ্রাম ছেড়ে যাবার পর কলকাতাতেই কোথাও আছে”।

বিধুবাবুর মুখে নিজের বাবার নাম শুনে পরিতোষ চমকে উঠে বলল, “কাকু, কী নাম বললেন আপনি? দুর্গা”?

এবার বিধুবাবু চমকে উঠলেন, “হ্যাঁ বাবা, দুর্গা। আমার ওই ছেলেবেলার বন্ধুর নাম। পুরো নাম ছিল দুর্গাদাস সান্যাল। আমরা বন্ধুরা সবাই ছোট্ট করে ওকে ‘দুর্গা’ বলে ডাকতুম”।

পরিতোষ এবার প্রায় রুদ্ধ গলায় বলল, “আমার বাবার নামও তো দুর্গাদাস সান্যালই”।

এবার বিধুবাবু অবাক হয়ে বিছানা থেকে প্রায় লাফ মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কী বলছ তুমি বাবা? আচ্ছা, তোমার ঠাকুর্দার নাম কি কালীচরন সান্যাল ছিল”?

পরিতোষও নিজের উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “হ্যাঁ কাকু, ঠিক বলছেন আপনি। আমার ঠাকুর্দার নাম কালীচরণ সান্যালই ছিল। তাহলে আপনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন”?

বিধুবাবু এবার নিজের মনের জড়তা কাটিয়ে উঠে পরিতোষকে বুকে চেপে ধরে বললেন, “হ্যাঁ বাবা। আমি আর তোমার বাবা ছোটবেলায় অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলুম। কিন্তু কালচক্রের ফেরে আমরা একে অপরের কাছ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলুম। আমার সেই বন্ধু যে আজ আর এ পৃথিবীতে নেই, এ’কথা আজ এত বছর বাদে তার ছেলের মুখেই আমাকে শুনতে হল.... হা ভগবান” বলতে বলতে তার চোখ থেকে জলের ধারা নেমে এল।
 

বিধুবাবুর শরীরটা উত্তেজনায় কাঁপছে বুঝতে পেরে পরিতোষ তাকে দু’হাতে জাপটে ধরে বলল, “কাকু, আপনি শান্ত হোন। আপনি বিছানায় বসে কথা বলুন। আপনার শরীরটা কাঁপছে কিন্তু” বলে বিভাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কাকিমা, কাকুকে একটু জল খেতে দিন” বলে বিধুবাবুকে আগলে ধরে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দিল। বিধুবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে পরিতোষের গালে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগলেন, “পরিতোষ, তুমি সত্যি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু দুর্গার ছেলে”?

কিংশুক এতক্ষণ চুপচাপ বিছানার এক কোনায় বসে তার বাবা আর পরিদার কথা শুনে যাচ্ছিল। এতক্ষণ সে একটা কথাও বলেনি। এবার পরিতোষের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, “পরিদা, তুমি কিন্তু তাহলে আমার ডাবল দাদা হয়ে গেলে এখন থেকে। আগে ছোড়দির দাদা ছিলে, আর এখন আমাদের বাবার বন্ধুর ছেলে হয়ে গেলে”।

পরিতোষ কিংশুকের দিকে চেয়ে কিছু না বলে শুধু একটু হাসল। এমন সময় বিভাদেবী জলের গ্লাস এনে বিধুবাবুর মুখের সামনে ধরে বললেন, “নাও তো, এ জলটুকু খেয়ে নাও। আর দু’মিনিট শান্ত হয়ে চুপটি করে বোস। তারপর কথা বোল”।

বিধুবাবু গ্লাসের প্রায় অর্ধেকটা জল খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিতেই বিভাদেবী একটু হেসে পরিতোষের দিকে চেয়ে বললেন, “আমি তোমার কাকুর মুখে তার ছোটবেলার বন্ধু দুর্গাবাবুর নাম শুনেছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু তাকে কখনও চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমাদের বিয়ের অনেক আগেই তারা নিজেদের পৈতৃক গ্রাম ছেড়ে এখানে চলে এসেছিলেন। এখানে আসবার প্রায় চৌদ্দ পনের বছর বাদে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বাবা তুমি তোমার সেই পিসির নামটাও জানো না”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “না কাকিমা, বাবা কোনদিন তার নাম মুখে আনেন নি। যে দু’একবার তার কথা বলেছেন তখন ‘তোর পিসি, তোর পিসি’ বলেই উল্লেখ করেছেন। আমার মনে আছে একদিন আমি তার কাছে পিসির নামটা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বলেছিলেন যে ঠাকুর্দাকে তিনি কথা দিয়েছেন কখনও নিজের দিদির নাম মুখে আনবেন না। তাই আমার পক্ষেও জানা সম্ভব হয়নি। আর কলকাতায় বাবার যারা বন্ধুবান্ধব আছেন, তারাও কেউ জানেননা যে আমার একজন পিসি ছিল”।

বিধুবাবু জল খেয়ে খানিকক্ষণ চোখ বুজে তার ছোট্টবেলার বন্ধুর মুখটা মনে করছিলেন। এবার পরিতোষের কথা শুনে তিনি চোখ খুলে বললেন, “ছিল নয় বাবা, আছেন। তোমার পিসি আমাদের হিমুদি, এখনও বেঁচে আছেন। বয়স বাষট্টির মত হলেও এখনও ঈশ্বরের আশীর্বাদে তিনি বেশ সুস্থ সবল আছেন। মাস খানেক আগেই তার স্বামী নিরুদার সাথে আমার দেখা হয়েছে আলিপুরদুয়ারে। হ্যাঁ তারাও অনেক বছর আগেই কুমারগ্রাম ছেড়ে আলিপুরদুয়ারে চলে গিয়েছিলেন। বিরাট ব্যবসা তাদের সেখানে। পাইকারী মনিহারী আর গালামালের ব্যবসা। আমার দোকানের সব জিনিস তো আমি নিরুদার দোকান থেকেই আনি এখন। অবশ্য এখন আর আমাকে সেখানে গিয়ে মাল কিনতে হয় না। চেনাজানা লোকের হাতে একটা খামে টাকা আর মালপত্রের তালিকা পাঠিয়ে দিলেই তারা সবকিছু এখানে পাঠিয়ে দেন। দোকান শুরু করবার পর মাসখানেক আগে প্রথম যখন আলিপুরদুয়ার গিয়েছিলুম মাল কিনতে তখনই নিরুদাকে সেখানে দেখতে পাই। নিরুদা তো আগে থেকেই জানেন যে আমি হিমুদির ভাইয়ের বন্ধু। তাই শালাবাবু বলে খুব খাতিরদারি করে জোর করে আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। বিশাল বাড়ি তাদের। পাঁচতলা বাড়ি। সেদিন আমি প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বাদে হিমুদিকে দেখলুম। হিমুদিও এত বছর বাদে আমাকে দেখে খুব খুশী হয়েছিলেন। দুর্গার কথাও জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু তখন আমিই তো কিছু জানতুম না। তাকে আর কী বলব”।


______________________________
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 29-03-2020, 12:08 AM



Users browsing this thread: 24 Guest(s)