28-03-2020, 11:59 PM
(Update No. 225)
পরিতোষ মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “অনেক কথাই তো বলবার আছে। সবকিছু খুলে বলতে গেলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে। তবে যে’কথাগুলো তোমাদের না শুনলেই চলবে না সে’গুলোই আগে বলছি। শোন মন্তি, গত পরশু দিন মানে সতেরো তারিখ সন্ধ্যায় বিমল আগরওয়ালার গাড়িতে একটা বম্ব ব্লাস্ট হয়েছে। তবে বিমল তাতে মারা যায়নি। আমি অবশ্য আগের দিনই অফিসের কাজে তমলুক চলে গিয়েছিলাম। তাই সঙ্গে সঙ্গেই খবরটা জানতে পারিনি। আসলে আমাদের পুলিশের কাছে খবর ছিল যে বিমলের বিদেশী গাড়িটা যে রঙের ছিল, ওইরকম অ্যাশ কালারের একটা বিদেশী গাড়িতে বম্ব প্লান্ট করা হয়েছে। বারুইপুর থানার পুলিশের একটা টিম বারুইপুর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার পশ্চিমে প্রায় ফাঁকা একটা জায়গায় বিমলের গাড়িটাকে কলকাতার দিকে আসতে দেখে। তারা গাড়িটা থামিয়ে গাড়িটা চেক করতে গিয়েই বুঝতে পারে যে ওই গাড়িতেই বম্ব প্লান্ট করা হয়েছে। কিন্তু হাতে সময় কম ছিল। তাই বিমলকে গাড়ি থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে নেবার আগেই বম্বটা বার্স্ট করে ফেলেছিল। পুলিশের লোকেরা বিমলকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে তার প্রাণ বাঁচাতে পারলেও বিমলের শরীরের পেছন দিকে বেশ কয়েকটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। আর সামনের দিকেও ওর কোমড়ের নিচের অংশে বেশ ভাল রকম ইনজুরি হয়েছিল। তড়িঘড়ি সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স করে বিমলকে একটা বেসরকারী নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানা গেল যে বিমলের একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাকও হয়েছ একই সময়। তবে ঘন্টা দুয়েকের চিকিৎসার পর সেখানকার ডাক্তাররা জানায় যে বিমলের অবস্থা মোটামুটি বিপদমুক্ত। শরীরের বেশ কয়েকটা জায়গায় ছোট ছোট অপারেশনও করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাবার চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেই লোকাল পুলিশের আরেকটা টিমের সাথে কয়েকটা সেন্ট্রাল এজেন্সীর গোয়েন্দা আর অফিসারেরা এসে বিমলকে সেখানেই তাদের কাস্টডিতে নিয়ে নিয়েছেন। পরে শুনলাম, যে ওই দিন সন্ধ্যেয় বিমল আগরওয়ালার বাড়ি, অফিস আর ফার্ম হাউসে একই সাথে সত্তর বাহাত্তর জন সেন্ট্রাল এজেন্সীর গোয়েন্দা আর অফিসারেরা রেইড করেছিল। আর তাদের সঙ্গে প্রচুর পরিমানে কলকাতা পুলিশের লোকও ছিল। সে’সব জায়গায় রেইড করে নাকি এক হাজার কোটিরও ওপরের ব্ল্যাকমানি আর প্রচুর বেনামী সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে। আর নৌসেনা সম্পর্কিত কিছু আপত্তিজনক দস্তাবেজও তারা উদ্ধার করেছে। তাই বিমলকে ওই হাসপাতালের বেডে থাকা অবস্থাতেই তারা অ্যারেস্ট করেছে। দেশদ্রোহিতা ছাড়াও আরও কয়েকটা রেপ, মার্ডার এবং আরও অনেকগুলো চার্জ তার বিরূদ্ধে নথীভুক্ত হয়েছে। বিকেলে ফোনে জানলাম আজও বিমল ওই হাসপাতালেই আছে। তবে গতকাল সেন্স ফিরবার পরেই সে যখন জানতে পেরেছিল যে তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, তখনই নাকি আবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আজ বিকেলে অবশ্য শুনলাম যে আজ সকালে সেন্স ফিরে আসবার পর থেকে সে আর জ্ঞান হারায়নি। তবে ডাক্তাররা তার অবস্থার আরও কিছুটা উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত নাকি তাকে রিলিজ করবেন না। তাই এখনও সে ওই হাসপাতালেই সশস্ত্র পুলিশ পাহারায় আছে। আর যে সমস্ত চার্জ তার বিরূদ্ধে আনা হয়েছে, তাতে জেলের বাইরে বেরনো তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না এ জীবনে। আমার তো মনে হয় বিচারে তার মৃত্যুদণ্ডই হবে। আর তাই আমাদের রচু সোনার ওপর যে বিপদটা নেমে এসেছিল, সেটা ধরে নাও চিরদিনের জন্যেই ভ্যানিস হয়ে গেল। কারন বিমল যেভাবে এবার জালে ফেঁসেছে তাতে তার জামিনও হবে না, আর ফাঁসি হবার আগেও সে আর কোনদিন জেল থেকে বেরোতেও পারবে না”।
পরিতোষের কথাগুলো শুনতে শুনতে তিনজনেরই চোখ মুখ খুশীতে জ্বলজ্বল করছিল। আর তার কথা শেষ হতেই অর্চনা বিছানা থেকে নেমে ‘দিদিভাই, আমি একটু আসছি’ বলেই ঠাকুর ঘরের দিকে ছুটে গেল। আর অর্চনা বেরিয়ে যাবার পরেই পরিতোষ একটু চাপা গলায় বলল, “বিমল যে শেষ পর্যন্ত এভাবে ফেঁসে যাবে, এতোটা আমি আশা করিনি মন্তি। আমি তো রচুকে বাঁচাবার জন্য অন্য ভাবে আরেকটা কাজ করে ফেলেছি। যাতে বিমল বেঁচে থাকলেও রচুর দিকে আর তাকাতে পারত না। আর সেটা এই ফাঁকে তোমাদের দু’জনকে বলে দিই, অর্চনার সামনে সেটা বলতে পারব না। সেটা হল, বিমল সারা জীবনের মত সম্ভোগ ক্ষমতা হারিয়েছে। রচু তো দুরের কথা ও এখন নিজের বিয়ে করা স্ত্রীর সাথেও আর কোনদিন সম্ভোগ করতে পারবে না”।
সীমন্তিনী চমকে উঠে বললো, “কী বলছ পরি? হাউ কুড ইউ ডু দিস”?
পরিতোষ শান্তভাবেই জবাব দিল, “সহজ ছিল না। ডক্টর বড়ুয়া আমাকে সাহায্য না করলে এমনটা কিছুতেই করতে পারতাম না আমি”।
নবনীতা আর সীমন্তিনী দু’জনেই পরিতোষের কথা শুনে বিস্ময়ে হা করে রইল। অনেকক্ষণ পর সীমন্তিনী বলল, “সেদিন রাতেই আমি এই অ্যাক্সিডেন্টের ঘটণাটা শুনেছি। আর তখনই বুঝেছি আমার রচুর ওপর থেকে বিপদটা কেটে গেছে। কিন্তু কিভাবে কি হল, সেটা ঠিক মেলাতে পারছিলুম না। আচ্ছা পরি, আমি জানি কোন পদ্ধতিতে কিভাবে তুমি এ’সব করেছ তা আমাকে খুলে বলবে না। তাই সে ব্যাপারে আমি কিছু জিজ্ঞেসও করছি না। কিন্তু ঠিক কী কী তুমি করেছ তা তো একটু খুলে বলো, প্লীজ”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর প্রশ্ন শুনে ঠোঁট টিপে হেসে কিছু বলতে যেতেই অর্চনা ঘরে এসে ঢুকল। আর ঘরে ঢুকেই সে সীমন্তিনীর পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। সীমন্তিনী অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কাঁদিস নে সোনা। আজ তো আমাদের কতবড় একটা খুশীর দিন”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে অর্চনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “এই শুভদিনটা এলো শুধু তোমাদের দু’জনের জন্যে গো দিদিভাই। আজ খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের দু’জনকে একটি বার প্রণাম করতে”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে অর্চনাকে আগের থেকেও জোরে বুকে চেপে ধরে বলল, “এমন পাগলামি করিসনে বোন। আমি তো তোর প্রণাম নেবই না সে তো তুই জানিসই। আর পরিও যে তোর প্রণাম নেবে না এ ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। তবু তুই নিজেই জিজ্ঞেস করে দ্যাখ তাকে”।
নবনীতা এবার বলল, “এ সমস্ত কথা বলে সময় নষ্ট কোরনা তো অর্চু। গোটা ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নিতে দাও আগে আমাদের” বলে পরিতোষের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ পরি, তুমি বলো”।
পরিতোষ একটু সময় ভেবে নিয়ে বলল, “এ ব্যাপারে সব কিছুই যে আমি করেছি বলে তোমরা ভাবছ, তা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আর আমার কথা তো ছেড়েই দাও। বিমলের ফার্ম হাউসে যে গোপন কোন চেম্বার বা সেফ আছে, অনেকগুলো কেন্দ্রীয় সরকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থা দশ বছর আগে থেকে এ’কথা জানতে পারলেও আলাদা আলাদা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিমলের অফিসে আর ফার্ম হাউসে রেইড করেও তারা কিচ্ছু খুঁজে পায়নি। উল্টে বিমলই নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাঁটিয়ে তাদের অনেককে নানাভাবে বিব্রত করে তুলেছিল। কয়েকজনকে তো খুনও করে ফেলেছিল। কিন্তু বিমলের টিকিটাও কেউ ছুঁতে পারে নি। এবার বিমলের বিরূদ্ধে আমার অপারেশনটা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। সব মিলিয়ে ধরো প্রায় লাখ চল্লিশেকের প্রয়োজন ছিল। এই খরচের টাকাটা বিমলের কাছ থেকেই আমাকে আদায় করতে হত। আর সেটা করার কথা ভেবেই তার কিছু কিছু কূকার্যের প্রমাণ যোগাড় করবার সময় হঠাৎ করেই কয়েকটা চাবি পেয়ে যাই আমি। চাবি গুলোর বেশ কয়েকটা ছিল বিমলের অফিসের কয়েকটা আলমারি, লকার, ড্রয়ার আর কেবিনেটের। কয়েকটা চাবি ছিল ওর বাড়ির কয়েকটা আলমারি ও কেবিনেটের। কিন্তু দুটো চাবি যে কিসের বা কোন তালার চাবি ছিল, তার হদিশ করে উঠতে পারিনি সঠিক ভাবে। ঠিক অমন সময়েই পাঁচশ’ মাইল দুরে থেকেও সবচেয়ে বড় সাহায্যটা আমাকে করেছে কিন্তু মন্তিই। মন্তি বিমলের ওই দক্ষিণেশ্বরের ফার্ম হাউসের সিক্রেট চেম্বার আর সেফ খোলার পদ্ধতির কথা আমাকে না জানালে আমি কিছুই খুঁজে বের করতে পারতাম না বোধহয়। আর চিরদিনের জন্য বদমাশটাকে জেলেও ঢোকাতে পারতাম না আমি। মন্তির কাছ থেকে সেটা জানবার পরই আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। আর সাথে সাথেই দিল্লীতে আইবিতে কর্মরত আমার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি। আর সাথে সাথেই বিভিন্ন মহলে ব্যাপারটা নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। তবে তাদের কাজের সাথে আমি তেমনভাবে জড়িত ছিলাম না। কিন্তু একদিন তাদের গোপন বৈঠকে তারা আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। এবারে এই অপারেশনটা যে লীড করছিল, তাকে বিমলের ফার্ম হাউসের চেম্বার আর সেফ খোলার পুরো পদ্ধতিটা আমাকে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল, যা আমি মন্তির কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। সে’জন্যে মন্তিকে একটা বিশেষ ধন্যবাদ আমার জানানোই উচিৎ। কারন ওই ফিডব্যাকটা না পেলে এবারেও তারা বিমলকে কিছু করতে পারত না” বলে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মন্তি সেজন্যে”।
নবনীতা অবাক হয়ে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “সে’সব কথা তুমি কি করে জানতে পারলে দিদি”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “সে’সব মহিমা বৌদিই আমাকে জানিয়েছিলেন রে। বিমল মহিমা বৌদিকেও ওই ফার্ম হাউসে নিয়ে যেত তো। তাই অনেক আগে থেকেই মহিমা বৌদি সে ব্যাপারগুলো জানতেন। আর তার কাছ থেকে ক’দিন আগে ব্যাপারটা জানতে পেরেই আমি সাথে সাথে পরিকে জানিয়ে দিয়েছিলুম”।
পরিতোষ আবার বলল, “ফার্মহাউসের সিক্রেট চেম্বার আর সেফের চাবি আমি যোগাড় করতে পারলেও সে সিক্রেট চেম্বার বা ওই সেফটা কিছুতেই খোলা যেত না তোমার কাছ থেকে ওই ফিডব্যাক গুলো না পেলে। বিমলের অফিসের লকার থেকে লোক লাগিয়ে আমি ফার্ম হাউসের চাবিগুলো পেয়েছিলাম। ওই চেম্বারে ব্ল্যাকমানি পাওয়া যাবেই এ ধারণা আমার মনে আগে থেকেই ছিল। আর আমি এটাও জানতে পেরেছিলাম যে গত কয়েক বছরের ভেতর ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট, অ্যান্টিকরাপশন ব্যুরো, সিবিআই ছাড়াও সেন্ট্রালের বেশ কয়েকটা গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন সময়ে বিমলের অফিসে এবং ফার্মহাউসে রেড করেছিল। কিন্তু তারা কোনবারই বিমলের বিপক্ষে কোন কিছুই খুঁজে পায়নি। উল্টে এদের ভেতরেই বেশ কয়েকজনকে বিমল নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাঁটিয়ে ট্র্যান্সফার করিয়ে দিয়েছে, বা নিজের পোষা গুণ্ডাদের দিয়ে হুমকি দিয়েছে। দু’ একজনকে খুনও করেছে। আমি সেইসব এজেন্সীর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তাদের কাছ থেকে জানলাম যে বিমলের বাড়ি বা তার ফার্মহাউসে গোপন কোন চেম্বার বা সেফ আছে এ’কথা জানলেও সে’গুলোর হদিশ তারা অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারে নি। আমি যখন বিমলের অফিস থেকে চাবিগুলো হাতে পেলাম তখন আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। এদিকে আমি আমার প্ল্যানমাফিক রচুকে বিমলের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য অন্য প্ল্যানে কাজ করছিলাম। আসলে যেদিনই মন্তি আমাকে জানিয়েছিল যে বিমল আগরওয়ালা রচুর ওপর কূ-নজর ফেলেছে সেদিনই ওকে আমি মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। তাতে সময়ও কম লাগত আর পয়সাও কম খরচ হত। আর ওকে এমনভাবে মারতাম যে ওর শরীরের একটা টুকরো পাওয়া যেত কন্যাকুমারীতে তো আরেকটা টুকরো পাওয়া যেত লাদ্দাখে। আর বাকি টুকরো গুলোকে সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলতাম। পুলিশ গোয়েন্দা সিআইডি সিবিআই হাজার চেষ্টা করেও খুনিকে ধরতে পারত না। কিন্তু মন্তি আমাকে শুরুতেই বারণ করে দিয়েছিল, আমি যেন কোনরকম খুনোখুনির ভেতরে না যাই। তাই আমি অন্যভাবে প্ল্যান করলাম। আর তাতে করে আট ন’টা টিমকে নানাভাবে বদমাশটার পেছনে লাগালাম। বিমলের বাড়ি, অফিস আর ফার্মহাউসে আলাদা আলাদা টিম লাগিয়ে বিমলের অনেক দুষ্কর্মের প্রমাণ আর ভিডিও যোগাড় করতে পেরেছিলাম। আর ফাইনালি বিমলকে কোনভাবে হসপিটালাইজড করে তার একটা অপারেশন করবার ব্যবস্থা করছিলাম”।
একটু থেমে তিনজনের মুখের দিকে একবার করে দেখে নিয়ে বলল, “এখানে তোমাদের একটা ব্যাপার কিছুটা খুলে বলতেই হবে। নইলে সেদিন আমি রচু আর রতুকে নিয়ে দমদম বেড়াতে গিয়েছিলাম কেন, সে কারনটা তোমাদের কাছে অজানা থেকে যাবে। কিন্তু সেটা তোমাদের জানা উচিৎ। আমি জানি ওই ব্যাপারটা নিয়ে তোমাদের মনেও একটা প্রশ্ন থেকে গেছে। আসলে এভাবে যেসব অপারেশন করি সেগুলো পুরোপুরি বেআইনি ভাবেই করতে হয়। কিন্তু ডক্টর বড়ুয়া একজন খুব সজ্জন মানুষ এবং সেই সাথে খুবই নিষ্ঠাবান। বিমলের শরীরে আমি যে অপারেশনটা করাতে চাইছিলাম সেটা করতে যে তিনি মন থেকে সায় পাচ্ছিলেন না, সেটা আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম। কিন্তু আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে ডক্টর বড়ুয়া যখন তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে হায়দ্রাবাদ বেড়াতে গিয়েছিলেন, তখন একদল দুষ্কৃতীর খপ্পড়ে পড়েছিলেন। ঘটণাটা এখন বর্ণনা করছি না। কিন্তু তাদের তিনজনেরই প্রাণ সংশয় হয়েছিল সেদিন। আমি তখন ভাইজ্যাগে থাকতাম। কিন্তু ঘটণাচক্রে আমিও সেদিন হায়দ্রাবাদে ছিলাম, আর ওই মূহুর্তে ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। আমার সাথে ওই আব্দুলও ছিল। আব্দুল তখন আমার সঙ্গেই ছিল। এক পলকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে ওই পরিবারটা কেমন ভয়ঙ্কর এক বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। তাই ওই পরিবারকে বাঁচাতে আমি আর আব্দুল একসাথে ওই দুষ্কৃতীগুলোর সাথে মোকাবেলায় নেমেছিলাম। কিন্তু আগে থেকে কোন প্ল্যানিং ছিল না বলে আব্দুলের হাতে সেদিন ওই দুষ্কৃতী দলের দু’জন ওই স্পটেই মারা গিয়েছিল। বাকিরা ওই মূহুর্তে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ঘটণার গম্ভীরতা বুঝে আমি সঙ্গে সঙ্গেই আব্দুল আর ডক্টর বরুয়াদের সবাইকে নিয়ে সেই মূহুর্তেই হায়দ্রাবাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ফ্লাইটে দমদমে নেমেই প্রথমে তাদেরকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলাম। আব্দুলও তখন থেকেই কলকাতায় রয়ে গেছে। ও আমার অনেক দিনের সঙ্গী। পরে আরেকটা অপারেশনে প্রীতিদিকে বাঁচাতে পারলেও, তার একমাত্র আপনজন ভাইটাকে বাঁচাতে পারিনি। প্রীতিদির নিজের বলতে আর কেউ ছিল না। আব্দুল নিজেই সেদিন প্রীতিদিকে বিয়ে করে নিজের স্ত্রীর মর্য্যাদা দিয়ে তাকে তার ঘরে নিতে চেয়েছিল। প্রীতিদিও নিরূপায় হয়ে হয়তো খানিকটা বাধ্য হয়েই তার চেয়ে বয়সে ছোট আব্দুলের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। ওদের বিয়ের দিন থেকেই প্রীতিদি আমাকে তার ভাই বানিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতি বছর তিনি আমাকে ভাই ফোঁটা দেন, রাখী পড়ান। আজ ওরা একটা ছেলে নিয়ে খুব সুখে সংসার করছে। আব্দুলও প্রীতিদিকে খুব ভালোবাসে”।
একটু দম নিয়ে পরিতোষ আবার বলল, “হায়দ্রাবাদে সেই ঘটণার পর বেশ জল ঘোলা হয়েছিল। ডক্টর বড়ুয়া আর তার পরিবারের সবাইকে সেদিনই যদি সেখান থেকে সরিয়ে না আনতে পারতাম তাহলে তাদের কাউকে বাঁচানো যেত না। ওই দুষ্কৃতীদের গোটা দলটাকে ধরতে সেখানকার পুলিশের প্রায় তেরো মাসের মত সময় লেগেছিল। রচনাকে এই ব্যাপারে বিমলের হাত থেকে বাঁচাতে যে প্ল্যান আমি করেছিলাম, তাতে আমার নীতিতে চলা একজন বিশ্বস্ত সার্জেনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ডক্টর বড়ুয়া ছাড়া আমার হাতে অমন আর কেউ ছিল না। আগেই বলেছি, ডক্টর বড়ুয়া একজন খুব সৎ মানুষ। তার কাছে যখন এ ব্যাপারে আমি প্রথম সাহায্য চেয়েছিলাম, তখন আড়াই বছর আগে আমি তাদের যে উপকার করেছিলাম, সে’কথা ভেবেই তিনি সরাসরি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি নীতির বিরূদ্ধে গিয়ে তেমন কিছু করতে তার বিবেকের সাথে লড়াই করছিলেন। তাই নিরূপায় হয়েই সেদিন রতু আর রচুকে নিয়ে তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, রচুর মিষ্টি মুখ আর মিষ্টি ব্যাবহারে ডক্টর বড়ুয়া নিজের মনের দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে উঠতে পারবেন। আর ঠিক সেটাই হয়েছিল। রচনাকে দেখা মাত্রই ডক্টর বড়ুয়ার স্ত্রী দীপা বৌদি আর তাদের মেয়ে আকাঙ্ক্ষা তাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিল। আমিও যখন আলাদাভাবে ডক্টর বড়ুয়াকে বোঝালাম যে এই রচনাকে বাঁচাতেই আমাকে এ’সব করতে হচ্ছে, তখন ডাক্তার প্রথমে রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক পরমূহুর্তেই তিনি বিনাশর্তে আমার কাজে সব রকম সাহায্য করতে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন। আমি যেভাবে বিমলের একটা অপারেশন করাতে চেয়েছিলাম, তিনি ঠিক সেভাবেই সেটা করেছেন। এখন বিমল তো দেশদ্রোহিতা ছাড়াও অন্য অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পড়েছে। ওর বিরূদ্ধে সব রকম প্রমাণ সেন্ট্রাল গোয়েন্দাদের হাতে আছে। তাই ও আর কোনদিন জেল থেকে বেরোতেই পারবে না। তা সত্বেও যদি ধরে নিই যে সে কোনভাবে জেলের বাইরে চলেই আসবে, তবুও রচনাকে আর কোনভাবেই বিপদে ফেলতে পারবে না। এটা আশা করি তোমরাও এখন বুঝতে পারছ”।
_____________________________
পরিতোষ মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “অনেক কথাই তো বলবার আছে। সবকিছু খুলে বলতে গেলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে। তবে যে’কথাগুলো তোমাদের না শুনলেই চলবে না সে’গুলোই আগে বলছি। শোন মন্তি, গত পরশু দিন মানে সতেরো তারিখ সন্ধ্যায় বিমল আগরওয়ালার গাড়িতে একটা বম্ব ব্লাস্ট হয়েছে। তবে বিমল তাতে মারা যায়নি। আমি অবশ্য আগের দিনই অফিসের কাজে তমলুক চলে গিয়েছিলাম। তাই সঙ্গে সঙ্গেই খবরটা জানতে পারিনি। আসলে আমাদের পুলিশের কাছে খবর ছিল যে বিমলের বিদেশী গাড়িটা যে রঙের ছিল, ওইরকম অ্যাশ কালারের একটা বিদেশী গাড়িতে বম্ব প্লান্ট করা হয়েছে। বারুইপুর থানার পুলিশের একটা টিম বারুইপুর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার পশ্চিমে প্রায় ফাঁকা একটা জায়গায় বিমলের গাড়িটাকে কলকাতার দিকে আসতে দেখে। তারা গাড়িটা থামিয়ে গাড়িটা চেক করতে গিয়েই বুঝতে পারে যে ওই গাড়িতেই বম্ব প্লান্ট করা হয়েছে। কিন্তু হাতে সময় কম ছিল। তাই বিমলকে গাড়ি থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে নেবার আগেই বম্বটা বার্স্ট করে ফেলেছিল। পুলিশের লোকেরা বিমলকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে তার প্রাণ বাঁচাতে পারলেও বিমলের শরীরের পেছন দিকে বেশ কয়েকটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। আর সামনের দিকেও ওর কোমড়ের নিচের অংশে বেশ ভাল রকম ইনজুরি হয়েছিল। তড়িঘড়ি সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স করে বিমলকে একটা বেসরকারী নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানা গেল যে বিমলের একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাকও হয়েছ একই সময়। তবে ঘন্টা দুয়েকের চিকিৎসার পর সেখানকার ডাক্তাররা জানায় যে বিমলের অবস্থা মোটামুটি বিপদমুক্ত। শরীরের বেশ কয়েকটা জায়গায় ছোট ছোট অপারেশনও করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাবার চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেই লোকাল পুলিশের আরেকটা টিমের সাথে কয়েকটা সেন্ট্রাল এজেন্সীর গোয়েন্দা আর অফিসারেরা এসে বিমলকে সেখানেই তাদের কাস্টডিতে নিয়ে নিয়েছেন। পরে শুনলাম, যে ওই দিন সন্ধ্যেয় বিমল আগরওয়ালার বাড়ি, অফিস আর ফার্ম হাউসে একই সাথে সত্তর বাহাত্তর জন সেন্ট্রাল এজেন্সীর গোয়েন্দা আর অফিসারেরা রেইড করেছিল। আর তাদের সঙ্গে প্রচুর পরিমানে কলকাতা পুলিশের লোকও ছিল। সে’সব জায়গায় রেইড করে নাকি এক হাজার কোটিরও ওপরের ব্ল্যাকমানি আর প্রচুর বেনামী সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে। আর নৌসেনা সম্পর্কিত কিছু আপত্তিজনক দস্তাবেজও তারা উদ্ধার করেছে। তাই বিমলকে ওই হাসপাতালের বেডে থাকা অবস্থাতেই তারা অ্যারেস্ট করেছে। দেশদ্রোহিতা ছাড়াও আরও কয়েকটা রেপ, মার্ডার এবং আরও অনেকগুলো চার্জ তার বিরূদ্ধে নথীভুক্ত হয়েছে। বিকেলে ফোনে জানলাম আজও বিমল ওই হাসপাতালেই আছে। তবে গতকাল সেন্স ফিরবার পরেই সে যখন জানতে পেরেছিল যে তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, তখনই নাকি আবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আজ বিকেলে অবশ্য শুনলাম যে আজ সকালে সেন্স ফিরে আসবার পর থেকে সে আর জ্ঞান হারায়নি। তবে ডাক্তাররা তার অবস্থার আরও কিছুটা উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত নাকি তাকে রিলিজ করবেন না। তাই এখনও সে ওই হাসপাতালেই সশস্ত্র পুলিশ পাহারায় আছে। আর যে সমস্ত চার্জ তার বিরূদ্ধে আনা হয়েছে, তাতে জেলের বাইরে বেরনো তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না এ জীবনে। আমার তো মনে হয় বিচারে তার মৃত্যুদণ্ডই হবে। আর তাই আমাদের রচু সোনার ওপর যে বিপদটা নেমে এসেছিল, সেটা ধরে নাও চিরদিনের জন্যেই ভ্যানিস হয়ে গেল। কারন বিমল যেভাবে এবার জালে ফেঁসেছে তাতে তার জামিনও হবে না, আর ফাঁসি হবার আগেও সে আর কোনদিন জেল থেকে বেরোতেও পারবে না”।
পরিতোষের কথাগুলো শুনতে শুনতে তিনজনেরই চোখ মুখ খুশীতে জ্বলজ্বল করছিল। আর তার কথা শেষ হতেই অর্চনা বিছানা থেকে নেমে ‘দিদিভাই, আমি একটু আসছি’ বলেই ঠাকুর ঘরের দিকে ছুটে গেল। আর অর্চনা বেরিয়ে যাবার পরেই পরিতোষ একটু চাপা গলায় বলল, “বিমল যে শেষ পর্যন্ত এভাবে ফেঁসে যাবে, এতোটা আমি আশা করিনি মন্তি। আমি তো রচুকে বাঁচাবার জন্য অন্য ভাবে আরেকটা কাজ করে ফেলেছি। যাতে বিমল বেঁচে থাকলেও রচুর দিকে আর তাকাতে পারত না। আর সেটা এই ফাঁকে তোমাদের দু’জনকে বলে দিই, অর্চনার সামনে সেটা বলতে পারব না। সেটা হল, বিমল সারা জীবনের মত সম্ভোগ ক্ষমতা হারিয়েছে। রচু তো দুরের কথা ও এখন নিজের বিয়ে করা স্ত্রীর সাথেও আর কোনদিন সম্ভোগ করতে পারবে না”।
সীমন্তিনী চমকে উঠে বললো, “কী বলছ পরি? হাউ কুড ইউ ডু দিস”?
পরিতোষ শান্তভাবেই জবাব দিল, “সহজ ছিল না। ডক্টর বড়ুয়া আমাকে সাহায্য না করলে এমনটা কিছুতেই করতে পারতাম না আমি”।
নবনীতা আর সীমন্তিনী দু’জনেই পরিতোষের কথা শুনে বিস্ময়ে হা করে রইল। অনেকক্ষণ পর সীমন্তিনী বলল, “সেদিন রাতেই আমি এই অ্যাক্সিডেন্টের ঘটণাটা শুনেছি। আর তখনই বুঝেছি আমার রচুর ওপর থেকে বিপদটা কেটে গেছে। কিন্তু কিভাবে কি হল, সেটা ঠিক মেলাতে পারছিলুম না। আচ্ছা পরি, আমি জানি কোন পদ্ধতিতে কিভাবে তুমি এ’সব করেছ তা আমাকে খুলে বলবে না। তাই সে ব্যাপারে আমি কিছু জিজ্ঞেসও করছি না। কিন্তু ঠিক কী কী তুমি করেছ তা তো একটু খুলে বলো, প্লীজ”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর প্রশ্ন শুনে ঠোঁট টিপে হেসে কিছু বলতে যেতেই অর্চনা ঘরে এসে ঢুকল। আর ঘরে ঢুকেই সে সীমন্তিনীর পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। সীমন্তিনী অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কাঁদিস নে সোনা। আজ তো আমাদের কতবড় একটা খুশীর দিন”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে অর্চনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “এই শুভদিনটা এলো শুধু তোমাদের দু’জনের জন্যে গো দিদিভাই। আজ খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের দু’জনকে একটি বার প্রণাম করতে”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে অর্চনাকে আগের থেকেও জোরে বুকে চেপে ধরে বলল, “এমন পাগলামি করিসনে বোন। আমি তো তোর প্রণাম নেবই না সে তো তুই জানিসই। আর পরিও যে তোর প্রণাম নেবে না এ ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। তবু তুই নিজেই জিজ্ঞেস করে দ্যাখ তাকে”।
নবনীতা এবার বলল, “এ সমস্ত কথা বলে সময় নষ্ট কোরনা তো অর্চু। গোটা ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নিতে দাও আগে আমাদের” বলে পরিতোষের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ পরি, তুমি বলো”।
পরিতোষ একটু সময় ভেবে নিয়ে বলল, “এ ব্যাপারে সব কিছুই যে আমি করেছি বলে তোমরা ভাবছ, তা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আর আমার কথা তো ছেড়েই দাও। বিমলের ফার্ম হাউসে যে গোপন কোন চেম্বার বা সেফ আছে, অনেকগুলো কেন্দ্রীয় সরকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থা দশ বছর আগে থেকে এ’কথা জানতে পারলেও আলাদা আলাদা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিমলের অফিসে আর ফার্ম হাউসে রেইড করেও তারা কিচ্ছু খুঁজে পায়নি। উল্টে বিমলই নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাঁটিয়ে তাদের অনেককে নানাভাবে বিব্রত করে তুলেছিল। কয়েকজনকে তো খুনও করে ফেলেছিল। কিন্তু বিমলের টিকিটাও কেউ ছুঁতে পারে নি। এবার বিমলের বিরূদ্ধে আমার অপারেশনটা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। সব মিলিয়ে ধরো প্রায় লাখ চল্লিশেকের প্রয়োজন ছিল। এই খরচের টাকাটা বিমলের কাছ থেকেই আমাকে আদায় করতে হত। আর সেটা করার কথা ভেবেই তার কিছু কিছু কূকার্যের প্রমাণ যোগাড় করবার সময় হঠাৎ করেই কয়েকটা চাবি পেয়ে যাই আমি। চাবি গুলোর বেশ কয়েকটা ছিল বিমলের অফিসের কয়েকটা আলমারি, লকার, ড্রয়ার আর কেবিনেটের। কয়েকটা চাবি ছিল ওর বাড়ির কয়েকটা আলমারি ও কেবিনেটের। কিন্তু দুটো চাবি যে কিসের বা কোন তালার চাবি ছিল, তার হদিশ করে উঠতে পারিনি সঠিক ভাবে। ঠিক অমন সময়েই পাঁচশ’ মাইল দুরে থেকেও সবচেয়ে বড় সাহায্যটা আমাকে করেছে কিন্তু মন্তিই। মন্তি বিমলের ওই দক্ষিণেশ্বরের ফার্ম হাউসের সিক্রেট চেম্বার আর সেফ খোলার পদ্ধতির কথা আমাকে না জানালে আমি কিছুই খুঁজে বের করতে পারতাম না বোধহয়। আর চিরদিনের জন্য বদমাশটাকে জেলেও ঢোকাতে পারতাম না আমি। মন্তির কাছ থেকে সেটা জানবার পরই আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। আর সাথে সাথেই দিল্লীতে আইবিতে কর্মরত আমার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি। আর সাথে সাথেই বিভিন্ন মহলে ব্যাপারটা নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। তবে তাদের কাজের সাথে আমি তেমনভাবে জড়িত ছিলাম না। কিন্তু একদিন তাদের গোপন বৈঠকে তারা আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। এবারে এই অপারেশনটা যে লীড করছিল, তাকে বিমলের ফার্ম হাউসের চেম্বার আর সেফ খোলার পুরো পদ্ধতিটা আমাকে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল, যা আমি মন্তির কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। সে’জন্যে মন্তিকে একটা বিশেষ ধন্যবাদ আমার জানানোই উচিৎ। কারন ওই ফিডব্যাকটা না পেলে এবারেও তারা বিমলকে কিছু করতে পারত না” বলে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মন্তি সেজন্যে”।
নবনীতা অবাক হয়ে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “সে’সব কথা তুমি কি করে জানতে পারলে দিদি”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “সে’সব মহিমা বৌদিই আমাকে জানিয়েছিলেন রে। বিমল মহিমা বৌদিকেও ওই ফার্ম হাউসে নিয়ে যেত তো। তাই অনেক আগে থেকেই মহিমা বৌদি সে ব্যাপারগুলো জানতেন। আর তার কাছ থেকে ক’দিন আগে ব্যাপারটা জানতে পেরেই আমি সাথে সাথে পরিকে জানিয়ে দিয়েছিলুম”।
পরিতোষ আবার বলল, “ফার্মহাউসের সিক্রেট চেম্বার আর সেফের চাবি আমি যোগাড় করতে পারলেও সে সিক্রেট চেম্বার বা ওই সেফটা কিছুতেই খোলা যেত না তোমার কাছ থেকে ওই ফিডব্যাক গুলো না পেলে। বিমলের অফিসের লকার থেকে লোক লাগিয়ে আমি ফার্ম হাউসের চাবিগুলো পেয়েছিলাম। ওই চেম্বারে ব্ল্যাকমানি পাওয়া যাবেই এ ধারণা আমার মনে আগে থেকেই ছিল। আর আমি এটাও জানতে পেরেছিলাম যে গত কয়েক বছরের ভেতর ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট, অ্যান্টিকরাপশন ব্যুরো, সিবিআই ছাড়াও সেন্ট্রালের বেশ কয়েকটা গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন সময়ে বিমলের অফিসে এবং ফার্মহাউসে রেড করেছিল। কিন্তু তারা কোনবারই বিমলের বিপক্ষে কোন কিছুই খুঁজে পায়নি। উল্টে এদের ভেতরেই বেশ কয়েকজনকে বিমল নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাঁটিয়ে ট্র্যান্সফার করিয়ে দিয়েছে, বা নিজের পোষা গুণ্ডাদের দিয়ে হুমকি দিয়েছে। দু’ একজনকে খুনও করেছে। আমি সেইসব এজেন্সীর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তাদের কাছ থেকে জানলাম যে বিমলের বাড়ি বা তার ফার্মহাউসে গোপন কোন চেম্বার বা সেফ আছে এ’কথা জানলেও সে’গুলোর হদিশ তারা অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারে নি। আমি যখন বিমলের অফিস থেকে চাবিগুলো হাতে পেলাম তখন আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। এদিকে আমি আমার প্ল্যানমাফিক রচুকে বিমলের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য অন্য প্ল্যানে কাজ করছিলাম। আসলে যেদিনই মন্তি আমাকে জানিয়েছিল যে বিমল আগরওয়ালা রচুর ওপর কূ-নজর ফেলেছে সেদিনই ওকে আমি মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। তাতে সময়ও কম লাগত আর পয়সাও কম খরচ হত। আর ওকে এমনভাবে মারতাম যে ওর শরীরের একটা টুকরো পাওয়া যেত কন্যাকুমারীতে তো আরেকটা টুকরো পাওয়া যেত লাদ্দাখে। আর বাকি টুকরো গুলোকে সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলতাম। পুলিশ গোয়েন্দা সিআইডি সিবিআই হাজার চেষ্টা করেও খুনিকে ধরতে পারত না। কিন্তু মন্তি আমাকে শুরুতেই বারণ করে দিয়েছিল, আমি যেন কোনরকম খুনোখুনির ভেতরে না যাই। তাই আমি অন্যভাবে প্ল্যান করলাম। আর তাতে করে আট ন’টা টিমকে নানাভাবে বদমাশটার পেছনে লাগালাম। বিমলের বাড়ি, অফিস আর ফার্মহাউসে আলাদা আলাদা টিম লাগিয়ে বিমলের অনেক দুষ্কর্মের প্রমাণ আর ভিডিও যোগাড় করতে পেরেছিলাম। আর ফাইনালি বিমলকে কোনভাবে হসপিটালাইজড করে তার একটা অপারেশন করবার ব্যবস্থা করছিলাম”।
একটু থেমে তিনজনের মুখের দিকে একবার করে দেখে নিয়ে বলল, “এখানে তোমাদের একটা ব্যাপার কিছুটা খুলে বলতেই হবে। নইলে সেদিন আমি রচু আর রতুকে নিয়ে দমদম বেড়াতে গিয়েছিলাম কেন, সে কারনটা তোমাদের কাছে অজানা থেকে যাবে। কিন্তু সেটা তোমাদের জানা উচিৎ। আমি জানি ওই ব্যাপারটা নিয়ে তোমাদের মনেও একটা প্রশ্ন থেকে গেছে। আসলে এভাবে যেসব অপারেশন করি সেগুলো পুরোপুরি বেআইনি ভাবেই করতে হয়। কিন্তু ডক্টর বড়ুয়া একজন খুব সজ্জন মানুষ এবং সেই সাথে খুবই নিষ্ঠাবান। বিমলের শরীরে আমি যে অপারেশনটা করাতে চাইছিলাম সেটা করতে যে তিনি মন থেকে সায় পাচ্ছিলেন না, সেটা আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম। কিন্তু আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে ডক্টর বড়ুয়া যখন তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে হায়দ্রাবাদ বেড়াতে গিয়েছিলেন, তখন একদল দুষ্কৃতীর খপ্পড়ে পড়েছিলেন। ঘটণাটা এখন বর্ণনা করছি না। কিন্তু তাদের তিনজনেরই প্রাণ সংশয় হয়েছিল সেদিন। আমি তখন ভাইজ্যাগে থাকতাম। কিন্তু ঘটণাচক্রে আমিও সেদিন হায়দ্রাবাদে ছিলাম, আর ওই মূহুর্তে ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। আমার সাথে ওই আব্দুলও ছিল। আব্দুল তখন আমার সঙ্গেই ছিল। এক পলকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে ওই পরিবারটা কেমন ভয়ঙ্কর এক বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। তাই ওই পরিবারকে বাঁচাতে আমি আর আব্দুল একসাথে ওই দুষ্কৃতীগুলোর সাথে মোকাবেলায় নেমেছিলাম। কিন্তু আগে থেকে কোন প্ল্যানিং ছিল না বলে আব্দুলের হাতে সেদিন ওই দুষ্কৃতী দলের দু’জন ওই স্পটেই মারা গিয়েছিল। বাকিরা ওই মূহুর্তে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ঘটণার গম্ভীরতা বুঝে আমি সঙ্গে সঙ্গেই আব্দুল আর ডক্টর বরুয়াদের সবাইকে নিয়ে সেই মূহুর্তেই হায়দ্রাবাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ফ্লাইটে দমদমে নেমেই প্রথমে তাদেরকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলাম। আব্দুলও তখন থেকেই কলকাতায় রয়ে গেছে। ও আমার অনেক দিনের সঙ্গী। পরে আরেকটা অপারেশনে প্রীতিদিকে বাঁচাতে পারলেও, তার একমাত্র আপনজন ভাইটাকে বাঁচাতে পারিনি। প্রীতিদির নিজের বলতে আর কেউ ছিল না। আব্দুল নিজেই সেদিন প্রীতিদিকে বিয়ে করে নিজের স্ত্রীর মর্য্যাদা দিয়ে তাকে তার ঘরে নিতে চেয়েছিল। প্রীতিদিও নিরূপায় হয়ে হয়তো খানিকটা বাধ্য হয়েই তার চেয়ে বয়সে ছোট আব্দুলের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। ওদের বিয়ের দিন থেকেই প্রীতিদি আমাকে তার ভাই বানিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতি বছর তিনি আমাকে ভাই ফোঁটা দেন, রাখী পড়ান। আজ ওরা একটা ছেলে নিয়ে খুব সুখে সংসার করছে। আব্দুলও প্রীতিদিকে খুব ভালোবাসে”।
একটু দম নিয়ে পরিতোষ আবার বলল, “হায়দ্রাবাদে সেই ঘটণার পর বেশ জল ঘোলা হয়েছিল। ডক্টর বড়ুয়া আর তার পরিবারের সবাইকে সেদিনই যদি সেখান থেকে সরিয়ে না আনতে পারতাম তাহলে তাদের কাউকে বাঁচানো যেত না। ওই দুষ্কৃতীদের গোটা দলটাকে ধরতে সেখানকার পুলিশের প্রায় তেরো মাসের মত সময় লেগেছিল। রচনাকে এই ব্যাপারে বিমলের হাত থেকে বাঁচাতে যে প্ল্যান আমি করেছিলাম, তাতে আমার নীতিতে চলা একজন বিশ্বস্ত সার্জেনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ডক্টর বড়ুয়া ছাড়া আমার হাতে অমন আর কেউ ছিল না। আগেই বলেছি, ডক্টর বড়ুয়া একজন খুব সৎ মানুষ। তার কাছে যখন এ ব্যাপারে আমি প্রথম সাহায্য চেয়েছিলাম, তখন আড়াই বছর আগে আমি তাদের যে উপকার করেছিলাম, সে’কথা ভেবেই তিনি সরাসরি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি নীতির বিরূদ্ধে গিয়ে তেমন কিছু করতে তার বিবেকের সাথে লড়াই করছিলেন। তাই নিরূপায় হয়েই সেদিন রতু আর রচুকে নিয়ে তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, রচুর মিষ্টি মুখ আর মিষ্টি ব্যাবহারে ডক্টর বড়ুয়া নিজের মনের দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে উঠতে পারবেন। আর ঠিক সেটাই হয়েছিল। রচনাকে দেখা মাত্রই ডক্টর বড়ুয়ার স্ত্রী দীপা বৌদি আর তাদের মেয়ে আকাঙ্ক্ষা তাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিল। আমিও যখন আলাদাভাবে ডক্টর বড়ুয়াকে বোঝালাম যে এই রচনাকে বাঁচাতেই আমাকে এ’সব করতে হচ্ছে, তখন ডাক্তার প্রথমে রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক পরমূহুর্তেই তিনি বিনাশর্তে আমার কাজে সব রকম সাহায্য করতে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন। আমি যেভাবে বিমলের একটা অপারেশন করাতে চেয়েছিলাম, তিনি ঠিক সেভাবেই সেটা করেছেন। এখন বিমল তো দেশদ্রোহিতা ছাড়াও অন্য অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পড়েছে। ওর বিরূদ্ধে সব রকম প্রমাণ সেন্ট্রাল গোয়েন্দাদের হাতে আছে। তাই ও আর কোনদিন জেল থেকে বেরোতেই পারবে না। তা সত্বেও যদি ধরে নিই যে সে কোনভাবে জেলের বাইরে চলেই আসবে, তবুও রচনাকে আর কোনভাবেই বিপদে ফেলতে পারবে না। এটা আশা করি তোমরাও এখন বুঝতে পারছ”।
_____________________________