28-03-2020, 11:51 PM
(Update No. 224)
পরিতোষ খেতে খেতেই বলল, “হ্যাঁ মিঃ অধিকারী, যা বলছিলাম। মানে একজন পুলিশ অফিসারের
একাউন্টের মাধ্যমে এত টাকার লেনদেন করাটা একেবারেই অনুচিত। আর কালচিনির বাড়ির কারোরও ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই” বলেই সীমন্তিনীর দিকে চোখ টিপে ঈশারা করে দিয়ে আবার বলল, “তাই ওর পক্ষে নিজের একাউন্ট থেকে এই ট্রানজাকশন গুলো করা সম্ভবপর নয়। আর সে কথা ভেবেই কলকাতা থেকে টাকাটা আমি ক্যাশই নিয়ে এসেছি। তাই বলছি, যদি আপনাদের পক্ষে ক্যাশে পেমেন্ট নিতে তেমন কোন অসুবিধে না হয়, তাহলে আমরা আপনাকে ক্যাশেই দিতে চাই টাকাটা। আর হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আপনাদের কাছ থেকে কোনও পাকা রসিদও আমরা চাই না। শুধু একটা সাদা কাগজে আপনারা টাকাটা আমাদের কাছ থেকে নিচ্ছেন, এটা লিখে দিলেই চলবে। আমরা আপনাদের বিশ্বাস করি। আর এ ভরসাও আছে যে আপনারা আমাদের এ বিশ্বাস কখনও ভাঙবেন না”।
সুরজিত অধিকারী পরিতোষের কথা শুনে বলল, “স্যার, ম্যাডাম যে আমাদের কত বড় উপকার করেছেন, সেটা শুধু আমরাই জানি। তার সাহায্যেই আমরা সাউথ কলকাতায় পাঁচ কোটি টাকার বড়সড় একটা কন্ট্রাক্ট পেয়েছি। যার ফলে শুধু আর্থিক লাভই নয়। কলকাতায় আমরা নিজেদের ব্যবসা ছড়িয়ে দেবার একটা সুযোগ পেয়েছি। এ যে আমাদের কাছে কত বড় একটা পাওনা, সেটা আপনাদের বুঝিয়ে বলাও সম্ভব নয়। তাই ম্যাডামকে আমাদের ফার্ম থেকে একটা ভালো কিছু উপহার দিতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ম্যাডাম নিজেই তাতে আপত্তি করেছেন। আর একটা কথাও আমি এখানে বলতে চাই স্যার। ম্যাডাম এখানে এসেছেন মাত্র মাস নয়েক হল। এই ন’মাসের মধ্যেই আমাদের এখানকার সার্বিক পরিস্থিতির এতটাই উন্নতি হয়েছে যে এই ছোট্ট শহরের প্রায় সব মানুষ তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে। তাই তার সাথে কোনও রকম অভদ্র আচরণ করা বা তাকে কোনওভাবে বোকা বানানোর বা ঠকানোর কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারব না। আর ব্যক্তিগত ভাবে ম্যাডাম যে কতবড় একটা উপকার করেছেন সে’কথা তো আগেই বললাম। তাই বলছি স্যার, কোনও ভাবেই আমরা ম্যাডামের কোন ক্ষতি করব না। আপনারা চাইলে যখন খুশী যেভাবে খুশী আমাদের পেমেন্ট করতে পারেন। আমরা নিশ্চিত জানি যে আমরা কোনও গর্হিত কিছু করে না ফেললে ম্যাডামও আমাদের কোনভাবে বিপাকে ফেলবেন না। তাই বলছি, আমরা অন্য কারো কাছ থেকে যেভাবেই পেমেন্ট নিই না কেন, ম্যাডামের কাছ থেকে ক্যাশ টাকা নিতেও আমাদের কোনও অসুবিধে নেই”।
পরিতোষ মনে মনে একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “আপনার কথা শুনে খুব খুশী হলাম মিঃ অধিকারী। এবার খাবারটা খেয়ে নিন”।
খাবার শেষ হবার আগেই অর্চনা কফি এনে সবাইকে দিল। কফির কাপ হাতে নেবার আগেই পরিতোষ সীমন্তিনীকে বলল, “তুমি তোমার ঘর থেকে ওই প্যাকেটটা নিয়ে এস”।
সীমন্তিনী বেরিয়ে গেল। আবার মিনিট পাঁচেক বাদেই আব্দুলের দেওয়া প্যাকেটটা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। পরিতোষের ঈশারায় সীমন্তিনী কফির কাপ হাতে তুলে নিতেই পরিতোষ সুরজিতকে বলল, “সুরজিত বাবু, এই প্যাকেটটায় চল্লিশ লাখ টাকা আছে। কফিটা খেয়ে একটু দেখে নিন। তারপর একটা কাগজে সিম্পল একটা রিসিপ্ট লিখে দিন”।
সুরজিতবাবু বললেন, “হ্যাঁ রিসিপ্ট না হয় লিখে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু স্যার, চল্লিশ লাখ কেন দিচ্ছেন? আমাদের বাজেট তো ছত্রিশ লাখ পচাত্তর হাজারের”?
পরিতোষ বলল, “আপাততঃ এর পুরোটাই রেখে দিন। পরে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে। কনস্ট্রাকশন শেষ হবার পর যখন ফাইনাল হিসেব করা হবে তখনই না হয় এটা অ্যাডজাস্ট করা যাবে। ও নিয়ে এত ভাববেন না”।
********************
মিঃ অধিকারী রিসিপ্ট লিখে দিয়ে টাকার প্যাকেটটা নিয়ে চলে যাবার পর পরিতোষ সীমন্তিনীকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে লক্ষ্মীদিকে ডেকে বলল, “ও লক্ষ্মীদি, এবার তোমার দিদিমণিকে খেতে দাও। আর তোমরাও তো খাবে, তাই না? তোমাদের সকলের খাবার নিয়ে এস এখানে”।
লক্ষ্মী রান্নাঘরের ভেতর থেকেই জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, আনছি”।
লক্ষ্মীর কথা শুনে পরিতোষ বিরক্তভাবে বলল, “আরে দুর, সেই আসবার পর থেকে তুমি আমাকে স্যার স্যার বলে যাচ্ছ কেন বলো তো? আমি তোমার স্যার হলাম কিভাবে? আমার কি কোনও নাম ধাম নেই নাকি”?
সীমন্তিনী পরিতোষের কথা হেসে ফেলে বলল, “হ্যাঁগো লক্ষ্মীদি। ও তো তোমার থেকে বয়সে ছোটই। ওকে স্যার বললে ভাল দেখায় নাগো। আমি যেমন রচু আর অর্চুকে রচুসোনা অর্চুসোনা বলে ডাকি তুমি বরং ওকে পরিসোনা বলে ডেকো। শুনতে খুব ভাল লাগবে” বলে নিজেই হেসে উঠল।
সীমন্তিনীর কথা শুনে পরিতোষও হেসে ফেলল। অর্চনা আর লক্ষ্মী মিলে তিনজনের খাবার টেবিলে এনে লক্ষ্মী বলল, “আমরা হলাম গরীব মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। আমরা কি আর তোমাদের মত ওভাবে ডাকতে পারি দিদিমণি”?
সীমন্তিনী খাবার প্লেট নিজের দিকে টেনে বলল, “কিন্তু ও তো তোমার মুখ থেকে স্যার ডাকটা শুনতে পছন্দ করছে না। তাহলে কী বলে ডাকবে? দাদাভাই? না দাদাবাবু”?
অর্চনা সীমন্তিনীর পাশে বসে পড়েছে। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে থেকেই একটা প্লেট নিজের সামনে নিয়ে বলল, “তোমার দাদাভাইকেই তো আমি দাদাভাই বলে ডাকি দিদিমণি। উনি যদি পছন্দ করেন তাহলে আমি তাকে বড়দা বলে ডাকতে পারি। উনি তো দাদাভাইয়ের চেয়ে বড়ই হবেন”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আচ্ছা তাই ডেকো”।
পরিতোষও সীমন্তিনীর আরেকপাশে আরেকটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “ঠিক আছে চলবে, কিন্তু ওই ‘উনি ইনি তিনি আপনি আজ্ঞে’ চলবে না কিন্তু। সোজা তুমি করে বলবে। চাইলে তুই করেও বলতে পার”।
সীমন্তিনী খেতে খেতে পরিতোষের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, “সত্যি পরিতোষ ওই চল্লিশ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে তো অনেক ঝুকির ব্যাপার হয়ে যেত, আর কথা নেই বার্তা নেই তুমি হুট করেই এতগুলো টাকা একবারে পাঠিয়ে দিলে। তুমি না এলে তো আমি ব্যাঙ্কেই নিয়ে যেতুম ও’গুলো। এতগুলো টাকা ঘরে কতদিন ফেলে রাখা সম্ভব হত”?
পরিতোষ বলল, “সে’জন্যেই তো আমাকে এমন বিনা নোটিশে আসতে হল ম্যাডাম। সে যাই হোক, মিঃ অধিকারী যে ক্যাশ নিতে রাজী হয়েছেন তাতে আমাদের অনেক সুবিধে হল। নইলে অনেক ঝামেলা হত। তবে তুমি কিন্তু তাদের সাথে সব সময় ক্লোজ কন্টাক্ট রেখে চলবে। আর তারা সাধারণত যেভাবে অন্যান্য কনস্ট্রাকশন গুলো করেন, এটা যেন তার থেকেও একটু বেশী স্ট্রং করে বানায়। বাজেটের চেয়েও তো প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা তাদের বেশী দেওয়া হল। আচ্ছা আর একটা কথা বলো তো সুইটহার্ট। উনি কলকাতার কোন একটা প্রজেক্টের কথা বলছিলেন যেন। কোন পাঁচ কোটি টাকার প্রজেক্ট তুমি তাদের পাইয়ে দিয়েছ”?
সীমন্তিনী বলল, “সে’কথা তো তোমাকে বলবার সুযোগই পাইনি আমি। তুমিই তো ব্যস্ত ছিলে বলে আমাকে ফোন করতেও বারণ করেছিলে। গত সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই এই ব্যাপারটা ঘটে গেছে। আর তাই তোমাকে সে ব্যাপারে কিছু জানাবার সুযোগ পাইনি”।
পরিতোষ বলল, “বেশ তো, এখন তাহলে খুলে বলো ব্যাপারটা”।
সীমন্তিনী এক গ্রাস খাবার গিলে বলল, “আজ ঊণিশ তারিখ। আজকের দিনটাই আগে থেকে ঠিক করা ছিল। শোনো পরি, মহিমা মালহোত্রা সেন আজ থেকেই তার এসকর্ট ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। বিকেলে সে আমাকে ফোন করে এ’কথা বলেছে”।
পরিতোষ অবাক হয়ে বলল, “কি বলছ মুন ডার্লিং! মহিমা মালহোত্রা সেন এরই মধ্যে ......”
সীমন্তিনী পরিতোষকে মাঝপথেই বাঁধা দিয়ে বলে উঠল, “আঃ পরি, কী তখন থেকে ডার্লিং, মুনডার্লিং, সুইটহার্ট এসব বলে যাচ্ছ বলো তো? অর্চু কি ভাববে তা একটুও ভাবছ না তুমি”?
পরিতোষ হেসে বলল, “সে তুমি আমাকে যতই বকো না কেন মুন ডার্লিং, আমি সারা জীবন ওইভাবেই তোমাকে ডাকব। তুমি পরে তোমার অর্চু সোনাকে বুঝিয়ে দিও। এখন মহিমা মালহোত্রা সেনের কথা কি বলছিলে সেটা বলো তো”।
অর্চনা মুচকি হেসে বলল, “দিদিভাই তুমি যেদিন রচুদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে, সেদিনই তো রচু জানতে পেরেছিল উনি তোমাকে কোন কোন নামে সম্বোধন করেন। আর রচুর মুখে আমিও সে’সব কথা শুনেছি। তাই আমাকে নিয়ে আর ভেব না। তুমি বরং যে কথা বলছিলে, সেটাই বলো”।
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “সব ক’টা পাগল এসে জুটেছে আমার কপালেই। হুহ। আচ্ছা শোনো। মহিমা বৌদি, মানে মহিমা মালহোত্রা সেন আজ থেকেই তার বেআইনি ব্যবসাটা বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি ...”
পরিতোষ হঠাৎ মাঝখানে বলে উঠল, “এক মিনিট ডার্লিং। তুমি কী বললে? মহিমা বৌদি? মানে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যাঁ পরিতোষ, তাকে আমি কিছুদিন যাবত বৌদি বলেই ডাকি। বয়সে তো তিনি আমার থেকে অনেক বড়। এখন বোধহয় তার সাতচল্লিশ বছর চলছে। দাদাভাইকে তিনি আগে থেকেই নিজের দেবর ভেবে তাকে ভাইয়ের মত স্নেহ করেন। নিজে অমন একটা খারাপ কাজে ছ’সাত বছর ধরে লিপ্ত থেকেও দাদাভাই বা রচুর কোন ক্ষতি তিনি করেননি। রচুর এ বিপদের কথা তো তিনিই আমায় প্রথম জানিয়েছিলেন। নইলে আজ এভাবে আমরা রচুকে বিপদমুক্ত করতে পারতুম না বোধহয়। আর এটাও আমি খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি যে, প্রথমদিকে আর্থিক চাপে পড়েই তিনি বিপথে গিয়েছিলেন। আর পরবর্তী কালে একটা নেশা বা ঘোরের বশেই তিনি তার এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আজ সে তার সমস্ত অতীত কাজের জন্য অনুতপ্ত। আর তিনি যে সমস্ত মেয়েগুলোকে তার ব্যবসায় টেনে এনেছিল তারাও সকলেই অভাবের তাড়নাতেই তার কাজে যোগ দিয়েছিল। নইলে আমার এক কথায় মহিমা বৌদিও যেমন তার এ ব্যবসা ছেড়ে দিতেন না, তেমনি ওই মেয়েগুলোও তার কথা এভাবে মেনে নিত না। আর এ’সমস্ত ব্যাপারটা যেদিন বুঝেছি সেদিন থেকেই আমি বুঝে গেছি যে উনি একজন বোর্ন ক্রিমিনাল নন। আর এমন একজন অপরাধীকে মেইন স্ট্রীমে ফিরিয়ে আনতে আমাকে খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। আর সেদিন থেকেই তাকে আমি বৌদি বলে ডাকতে শুরু করেছি। তবে তার মুখেই আমি শুনেছি, তার ভেতরে এ পরিবর্তনটা এসেছে রচুর সাথে পরিচিত হবার পর থেকেই। আচ্ছা সে’কথা যাক। তাকে নিয়ে আমি কী প্ল্যান করেছি সেটাই বরং শোনো”।
বলে নিজের খাবারের শেষটুকু খেয়ে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে বলল, “শোনো পরি, মহিমা বৌদি যে সত্যিই একজন খুব ভাল মনের মহিলা, এ’কথা সবার আগে রচু আমাকে বললেও, কথাটা আমি বিশ্বাস করেছিলুম যখন নীতাও আমাকে সে’কথা বলল। হ্যাঁ, চমকে যেও না। তুমি তো জানতেই, নীতার সাথে তোমার যখন আবার দেখা হল তখন নীতাও এমনই একটা চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। এই মহিমা মালহোত্রা সেনের এজেন্সীতেই নীতা কাজ করত। তার আগে দাদাভাই আর রচুর মুখেও তার অনেক প্রশংসা শুনেছি। দাদাভাই খুবই সহজ সরল। ও সবাইকেই সরল মনে বিশ্বাস করে ফেলে। কেউই তার কাছে খারাপ নয়। কিন্তু আমাদের রচুসোনা কিন্তু তেমন নয়। ওর ভেতরে মানুষ চেনবার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। বিমল আগরওয়ালা লোকটা যে সুবিধের নয়, এটা কিন্তু সবার আগে রচুই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। কিন্তু তখন আমরা কেউই ব্যাপারটাকে অতটা আমল দিই নি। কিন্তু রচুও সবসময় মহিমা বৌদির প্রশংসাই করত। তারপর রচুকে পাবার জন্য বিমল মহিমা বৌদিকে কন্ট্রাক্ট করতেই উনি এমন বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন যে নিজের সর্বস্য দিয়েও তিনি রচুকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার একার পক্ষে বিমল আগরওয়ালার মোকাবেলা করা সম্ভবপর নয় বলে উনি রচু আর দাদাভাইয়ের হিতৈষী এমন কাউকে খুঁজছিলেন যার সহায়তায় তিনি রচুকে বাঁচাতে পারবেন। তখনই তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়। তিনি তখনই আমার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন। আর ঠিক তখনই নীতা আমাকে বলেছিল যে মহিমা বৌদি কাউকে তার নিজের ইচ্ছের বিরূদ্ধে তার ব্যবসায় টানেন না। নীতার কাছে মহিমা বৌদি সম্পর্কে যত কিছু জানা সম্ভব জেনে নিয়ে আমি তার সাথে কথা বলি। প্রথম দিনেই তিনি তার সমস্ত অপরাধের কথা আমার কাছে অকপটে স্বীকার করেছিলেন। যদিও তিনি তখনও জানতে পারেননি যে আমি পুলিশে কাজ করি। অবশ্য তিনি এখনও আমার আসল পরিচয় জানেন না। তবে প্রথম দিনেই উনি আমাকে যা কিছু বললেন তাতেই আমার মনে হয়েছিল, ওই বেআইনি ব্যবসা তিনি একটা ঝোঁকের মাথায় শুরু করলেও তিনি সেটা থেকে মুক্তি পেতে চান। পরে আরও কয়েকদিন কথা বলার পর আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হই। তখনই তোমাকে বলেছিলাম যে তুমি তাকে কোনভাবে হ্যারাস কোর না। আমি তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনবার প্ল্যান করছি। আমি যখন জানতে পারলাম যে তার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা পড়ে আছে। আর তিনি সে টাকা গুলোকে নিজের পরিবারের জন্যও ব্যবহার করতে পারছেন না তখনই আমি তাকে আমার প্ল্যান জানালাম। উনি এককথায় আমার প্ল্যানটা মেনেও নিলেন। তার সাথে আটচল্লিশজন মেয়ে এ কাজে জড়িয়েছিল। তারাও সৎভাবে বেঁচে থাকবার একটা রাস্তা পেয়ে খুব খুশী হয়েছে। এখন তার হাতে এত টাকা আছে, যার কথা তার স্বামী বা ছেলেমেয়েও জানে না। আমার পরামর্শেই মহিমা বৌদি একটা সাড়ে তিনহাজার স্কয়ার ফুটের জমি কিনেছেন প্রায় দু’কোটি টাকা দিয়ে। আর এ জমি কেনার ব্যাপারেই এই সুরজিত অধিকারীর ছোটভাই দেবজিত অধিকারী আমার কথায় তাকে সাহায্য করেছেন। সেখানে মহিমা বৌদি প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বাজেটের একটা মার্কেট কমপ্লেক্স বানাচ্ছেন। তাতে পঞ্চাশটার মত স্টল থাকবে। আর এ কাজের পুরো দায়িত্বটাই মহিমা বৌদি দেবজিত অধিকারীকেই দিয়েছেন। তাই অধিকারীরাই সে প্রজেক্টটা হাতে নিয়েছেন। সেখানে প্রত্যেকটা মেয়েকে সে একটা একটা করে স্টল দিচ্ছেন। তাতে সকলেরই আলাদা আলাদা মালিকানা স্বত্ত থাকছে। তাই মাসে মাসে কোনও ভাড়াও তাদের দিতে হবে না। প্রত্যেককে যার যার পছন্দ অনুযায়ী ব্যবসা শুরু করবার মূলধনও তিনিই দেবেন। আর যতদিন পর্যন্ত মার্কেট কমপ্লেক্স উদ্বোধন না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মেয়েগুলো যেন কোন আর্থিক কষ্টে না পড়ে তার জন্যেও সে প্রতিমাসে মাসে তাদের সংসার চালাবার খরচ দিয়ে যাবেন। মোটামুটি এমনভাবে প্ল্যান করেই এগোচ্ছি আমরা”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর কথা শুনতে শুনতে একের পর এক অবাক হচ্ছিল। সীমন্তিনী থামতেই সে বলে উঠল, “বাপরে বাপ! এতো সাংঘাতিক কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছ ডার্লিং তুমি! দু’কোটি টাকার প্লট, পাঁচ কোটি টাকার কমপ্লেক্স, আটচল্লিশ জনকে ব্যবসার মূলধন, আবার প্রত্যেককে মাসে মাসে সংসার খরচ দিয়ে যাওয়া, এতো বিশাল ব্যাপার! কত টাকা আছে তার হাতে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “শুনলে হয়ত তুমিও চমকে যাবে পরি। মহিমা বৌদির হাতে আজ প্রায় কুড়ি কোটি টাকা আছে। আর তিনি এর সবটাই এ’ভাবে খরচ করতে প্রস্তুত আছেন”।
পরিতোষ নিজে মাথায় হাত দিয়ে বলল, “মাই গড, আই কান্ট বিলিভ। সিমপ্লি আই কান্ট বিলিভ ইট। এভাবে নিজের উপার্জিত টাকা কেউ উড়িয়ে দিতে পারে”?
সীমন্তিনী আবার হেসে বলল, “এ’জন্যেই বোধহয় এখনও সে’কথাটা সত্যি আছে। ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। আসলেই সেটা হতে যাচ্ছে পরি। আর তার প্রসেস অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। ওহ হ্যাঁ, এর মধ্যে আরও একটা কথা আছে পরি। যদিও এটা এ প্রজেক্টের সাথে রিলেটেড নয়। মহিমা বৌদি ছ’সাত বছর আগে যখন সেই আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন ওই সময় এই বিমল আগরওয়ালা তাকে তিরিশ না পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিল। আর তার বিনিময়ে বিমলের কাছে তিনি নিজেকে বাঁধা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন সারা জীবনের জন্য। সেই থেকেই তার এ ব্যবসার শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিমলের আর্থিক শক্তি আর প্রভাব প্রতিপত্তি এতোটাই ছিল যে মহিমা বৌদি রচুকে তার হাত থেকে বাঁচাতে পারতেন না। আর তিনি নিজেও নিজেকে বিমলের হাত থেকে বাঁচাতে পারছিলেন না। যখন তুমি বিমলকে শায়েস্ত করবার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলে, তখনই মহিমা বৌদিকে আমি বলেছিলুম যে উনি যদি আমার কথা মত নিজের পাপ ব্যবসা বন্ধ করে দেন, আর ভবিষ্যতে সৎপথে চলবার চেষ্টা করেন, তাহলে আমিও তাকে বিমলের কবল থেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করব। তাই পরশুদিন রাতে মহিমা বৌদির মুখেই আমি প্রথম জানতে পারি যে বিমলের অমন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বৌদি তো ভেবেছিলেন যে সবকিছু বোধহয় আমিই করেছি”।
সীমন্তিনী থামতে পরিতোষ অনেকক্ষণ থম ধরে বসে রইল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে মেঝেতে পা ঠুকে সীমন্তিনীকে স্যালিউট করে বলল, “স্যালিউট ম্যাম। সেই সঙ্গে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদও জানাচ্ছি। আশা করি তোমার এই সুবিশাল প্রজেক্ট সর্বতোভাবে সফল হোক। আজ তোমার ওপর নয়, আমার নিজের ওপরেই নিজের খুব খুব অহঙ্কার হচ্ছে”।
সীমন্তিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে পরিতোষের হাত ধরে টেনে নামাতে নামাতে বলল, “কী হচ্ছে পরি এ’সব। তুমি আমার থেকে কত সিনিয়ার একজন অফিসার। এভাবে জুনিয়ারকে কেউ স্যালিউট করে? আমার লজ্জা করে না বুঝি”?
বলতে না বলতেই ঘরের কলিংবেল বেজে উঠল। অর্চনা গিয়ে দড়জা খুলতেই নবনীতা ভেতরে ঢুকল। সীমন্তিনী সবাইকে থামতে বলে নবনীতাকে হাতমুখ ধুয়ে আগে খেয়ে নিতে বলল। অর্চনা নবনীতার জন্য খাবার আয়োজন করতে গেল।
*****************
নবনীতার খাওয়া শেষ হবার পর সে পরিতোষকে বলল, “আচ্ছা পরি, তোমার সাথে তো কোন কথাই হয়নি। এবার তুমি কিছু বলবে”?
সীমন্তিনীও নবনীতার কথায় সায় জানাতেই পরিতোষ বলল, “অবশ্যই বলব মন্তি ডার্লিং। কিন্তু এখানে বসেই সেটা শুনবে? না অন্য কোথাও গিয়ে বসবে”?
সীমন্তিনী নবনীতা, অর্চনা আর পরিতোষকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বলল, “পরিতোষ কোনওরকম হেজিটেট না করে তুমি আমার বিছানায় বসে পড়ো। আর আসল কথাগুলো বলো” বলে নবনীতা আর অর্চনাকে নিয়ে নিজেও বিছানার ওপর উঠে বসল।
______________________________
পরিতোষ খেতে খেতেই বলল, “হ্যাঁ মিঃ অধিকারী, যা বলছিলাম। মানে একজন পুলিশ অফিসারের
একাউন্টের মাধ্যমে এত টাকার লেনদেন করাটা একেবারেই অনুচিত। আর কালচিনির বাড়ির কারোরও ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই” বলেই সীমন্তিনীর দিকে চোখ টিপে ঈশারা করে দিয়ে আবার বলল, “তাই ওর পক্ষে নিজের একাউন্ট থেকে এই ট্রানজাকশন গুলো করা সম্ভবপর নয়। আর সে কথা ভেবেই কলকাতা থেকে টাকাটা আমি ক্যাশই নিয়ে এসেছি। তাই বলছি, যদি আপনাদের পক্ষে ক্যাশে পেমেন্ট নিতে তেমন কোন অসুবিধে না হয়, তাহলে আমরা আপনাকে ক্যাশেই দিতে চাই টাকাটা। আর হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আপনাদের কাছ থেকে কোনও পাকা রসিদও আমরা চাই না। শুধু একটা সাদা কাগজে আপনারা টাকাটা আমাদের কাছ থেকে নিচ্ছেন, এটা লিখে দিলেই চলবে। আমরা আপনাদের বিশ্বাস করি। আর এ ভরসাও আছে যে আপনারা আমাদের এ বিশ্বাস কখনও ভাঙবেন না”।
সুরজিত অধিকারী পরিতোষের কথা শুনে বলল, “স্যার, ম্যাডাম যে আমাদের কত বড় উপকার করেছেন, সেটা শুধু আমরাই জানি। তার সাহায্যেই আমরা সাউথ কলকাতায় পাঁচ কোটি টাকার বড়সড় একটা কন্ট্রাক্ট পেয়েছি। যার ফলে শুধু আর্থিক লাভই নয়। কলকাতায় আমরা নিজেদের ব্যবসা ছড়িয়ে দেবার একটা সুযোগ পেয়েছি। এ যে আমাদের কাছে কত বড় একটা পাওনা, সেটা আপনাদের বুঝিয়ে বলাও সম্ভব নয়। তাই ম্যাডামকে আমাদের ফার্ম থেকে একটা ভালো কিছু উপহার দিতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ম্যাডাম নিজেই তাতে আপত্তি করেছেন। আর একটা কথাও আমি এখানে বলতে চাই স্যার। ম্যাডাম এখানে এসেছেন মাত্র মাস নয়েক হল। এই ন’মাসের মধ্যেই আমাদের এখানকার সার্বিক পরিস্থিতির এতটাই উন্নতি হয়েছে যে এই ছোট্ট শহরের প্রায় সব মানুষ তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে। তাই তার সাথে কোনও রকম অভদ্র আচরণ করা বা তাকে কোনওভাবে বোকা বানানোর বা ঠকানোর কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারব না। আর ব্যক্তিগত ভাবে ম্যাডাম যে কতবড় একটা উপকার করেছেন সে’কথা তো আগেই বললাম। তাই বলছি স্যার, কোনও ভাবেই আমরা ম্যাডামের কোন ক্ষতি করব না। আপনারা চাইলে যখন খুশী যেভাবে খুশী আমাদের পেমেন্ট করতে পারেন। আমরা নিশ্চিত জানি যে আমরা কোনও গর্হিত কিছু করে না ফেললে ম্যাডামও আমাদের কোনভাবে বিপাকে ফেলবেন না। তাই বলছি, আমরা অন্য কারো কাছ থেকে যেভাবেই পেমেন্ট নিই না কেন, ম্যাডামের কাছ থেকে ক্যাশ টাকা নিতেও আমাদের কোনও অসুবিধে নেই”।
পরিতোষ মনে মনে একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “আপনার কথা শুনে খুব খুশী হলাম মিঃ অধিকারী। এবার খাবারটা খেয়ে নিন”।
খাবার শেষ হবার আগেই অর্চনা কফি এনে সবাইকে দিল। কফির কাপ হাতে নেবার আগেই পরিতোষ সীমন্তিনীকে বলল, “তুমি তোমার ঘর থেকে ওই প্যাকেটটা নিয়ে এস”।
সীমন্তিনী বেরিয়ে গেল। আবার মিনিট পাঁচেক বাদেই আব্দুলের দেওয়া প্যাকেটটা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। পরিতোষের ঈশারায় সীমন্তিনী কফির কাপ হাতে তুলে নিতেই পরিতোষ সুরজিতকে বলল, “সুরজিত বাবু, এই প্যাকেটটায় চল্লিশ লাখ টাকা আছে। কফিটা খেয়ে একটু দেখে নিন। তারপর একটা কাগজে সিম্পল একটা রিসিপ্ট লিখে দিন”।
সুরজিতবাবু বললেন, “হ্যাঁ রিসিপ্ট না হয় লিখে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু স্যার, চল্লিশ লাখ কেন দিচ্ছেন? আমাদের বাজেট তো ছত্রিশ লাখ পচাত্তর হাজারের”?
পরিতোষ বলল, “আপাততঃ এর পুরোটাই রেখে দিন। পরে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে। কনস্ট্রাকশন শেষ হবার পর যখন ফাইনাল হিসেব করা হবে তখনই না হয় এটা অ্যাডজাস্ট করা যাবে। ও নিয়ে এত ভাববেন না”।
********************
মিঃ অধিকারী রিসিপ্ট লিখে দিয়ে টাকার প্যাকেটটা নিয়ে চলে যাবার পর পরিতোষ সীমন্তিনীকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে লক্ষ্মীদিকে ডেকে বলল, “ও লক্ষ্মীদি, এবার তোমার দিদিমণিকে খেতে দাও। আর তোমরাও তো খাবে, তাই না? তোমাদের সকলের খাবার নিয়ে এস এখানে”।
লক্ষ্মী রান্নাঘরের ভেতর থেকেই জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, আনছি”।
লক্ষ্মীর কথা শুনে পরিতোষ বিরক্তভাবে বলল, “আরে দুর, সেই আসবার পর থেকে তুমি আমাকে স্যার স্যার বলে যাচ্ছ কেন বলো তো? আমি তোমার স্যার হলাম কিভাবে? আমার কি কোনও নাম ধাম নেই নাকি”?
সীমন্তিনী পরিতোষের কথা হেসে ফেলে বলল, “হ্যাঁগো লক্ষ্মীদি। ও তো তোমার থেকে বয়সে ছোটই। ওকে স্যার বললে ভাল দেখায় নাগো। আমি যেমন রচু আর অর্চুকে রচুসোনা অর্চুসোনা বলে ডাকি তুমি বরং ওকে পরিসোনা বলে ডেকো। শুনতে খুব ভাল লাগবে” বলে নিজেই হেসে উঠল।
সীমন্তিনীর কথা শুনে পরিতোষও হেসে ফেলল। অর্চনা আর লক্ষ্মী মিলে তিনজনের খাবার টেবিলে এনে লক্ষ্মী বলল, “আমরা হলাম গরীব মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। আমরা কি আর তোমাদের মত ওভাবে ডাকতে পারি দিদিমণি”?
সীমন্তিনী খাবার প্লেট নিজের দিকে টেনে বলল, “কিন্তু ও তো তোমার মুখ থেকে স্যার ডাকটা শুনতে পছন্দ করছে না। তাহলে কী বলে ডাকবে? দাদাভাই? না দাদাবাবু”?
অর্চনা সীমন্তিনীর পাশে বসে পড়েছে। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে থেকেই একটা প্লেট নিজের সামনে নিয়ে বলল, “তোমার দাদাভাইকেই তো আমি দাদাভাই বলে ডাকি দিদিমণি। উনি যদি পছন্দ করেন তাহলে আমি তাকে বড়দা বলে ডাকতে পারি। উনি তো দাদাভাইয়ের চেয়ে বড়ই হবেন”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আচ্ছা তাই ডেকো”।
পরিতোষও সীমন্তিনীর আরেকপাশে আরেকটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “ঠিক আছে চলবে, কিন্তু ওই ‘উনি ইনি তিনি আপনি আজ্ঞে’ চলবে না কিন্তু। সোজা তুমি করে বলবে। চাইলে তুই করেও বলতে পার”।
সীমন্তিনী খেতে খেতে পরিতোষের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, “সত্যি পরিতোষ ওই চল্লিশ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে তো অনেক ঝুকির ব্যাপার হয়ে যেত, আর কথা নেই বার্তা নেই তুমি হুট করেই এতগুলো টাকা একবারে পাঠিয়ে দিলে। তুমি না এলে তো আমি ব্যাঙ্কেই নিয়ে যেতুম ও’গুলো। এতগুলো টাকা ঘরে কতদিন ফেলে রাখা সম্ভব হত”?
পরিতোষ বলল, “সে’জন্যেই তো আমাকে এমন বিনা নোটিশে আসতে হল ম্যাডাম। সে যাই হোক, মিঃ অধিকারী যে ক্যাশ নিতে রাজী হয়েছেন তাতে আমাদের অনেক সুবিধে হল। নইলে অনেক ঝামেলা হত। তবে তুমি কিন্তু তাদের সাথে সব সময় ক্লোজ কন্টাক্ট রেখে চলবে। আর তারা সাধারণত যেভাবে অন্যান্য কনস্ট্রাকশন গুলো করেন, এটা যেন তার থেকেও একটু বেশী স্ট্রং করে বানায়। বাজেটের চেয়েও তো প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা তাদের বেশী দেওয়া হল। আচ্ছা আর একটা কথা বলো তো সুইটহার্ট। উনি কলকাতার কোন একটা প্রজেক্টের কথা বলছিলেন যেন। কোন পাঁচ কোটি টাকার প্রজেক্ট তুমি তাদের পাইয়ে দিয়েছ”?
সীমন্তিনী বলল, “সে’কথা তো তোমাকে বলবার সুযোগই পাইনি আমি। তুমিই তো ব্যস্ত ছিলে বলে আমাকে ফোন করতেও বারণ করেছিলে। গত সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই এই ব্যাপারটা ঘটে গেছে। আর তাই তোমাকে সে ব্যাপারে কিছু জানাবার সুযোগ পাইনি”।
পরিতোষ বলল, “বেশ তো, এখন তাহলে খুলে বলো ব্যাপারটা”।
সীমন্তিনী এক গ্রাস খাবার গিলে বলল, “আজ ঊণিশ তারিখ। আজকের দিনটাই আগে থেকে ঠিক করা ছিল। শোনো পরি, মহিমা মালহোত্রা সেন আজ থেকেই তার এসকর্ট ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। বিকেলে সে আমাকে ফোন করে এ’কথা বলেছে”।
পরিতোষ অবাক হয়ে বলল, “কি বলছ মুন ডার্লিং! মহিমা মালহোত্রা সেন এরই মধ্যে ......”
সীমন্তিনী পরিতোষকে মাঝপথেই বাঁধা দিয়ে বলে উঠল, “আঃ পরি, কী তখন থেকে ডার্লিং, মুনডার্লিং, সুইটহার্ট এসব বলে যাচ্ছ বলো তো? অর্চু কি ভাববে তা একটুও ভাবছ না তুমি”?
পরিতোষ হেসে বলল, “সে তুমি আমাকে যতই বকো না কেন মুন ডার্লিং, আমি সারা জীবন ওইভাবেই তোমাকে ডাকব। তুমি পরে তোমার অর্চু সোনাকে বুঝিয়ে দিও। এখন মহিমা মালহোত্রা সেনের কথা কি বলছিলে সেটা বলো তো”।
অর্চনা মুচকি হেসে বলল, “দিদিভাই তুমি যেদিন রচুদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে, সেদিনই তো রচু জানতে পেরেছিল উনি তোমাকে কোন কোন নামে সম্বোধন করেন। আর রচুর মুখে আমিও সে’সব কথা শুনেছি। তাই আমাকে নিয়ে আর ভেব না। তুমি বরং যে কথা বলছিলে, সেটাই বলো”।
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “সব ক’টা পাগল এসে জুটেছে আমার কপালেই। হুহ। আচ্ছা শোনো। মহিমা বৌদি, মানে মহিমা মালহোত্রা সেন আজ থেকেই তার বেআইনি ব্যবসাটা বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি ...”
পরিতোষ হঠাৎ মাঝখানে বলে উঠল, “এক মিনিট ডার্লিং। তুমি কী বললে? মহিমা বৌদি? মানে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যাঁ পরিতোষ, তাকে আমি কিছুদিন যাবত বৌদি বলেই ডাকি। বয়সে তো তিনি আমার থেকে অনেক বড়। এখন বোধহয় তার সাতচল্লিশ বছর চলছে। দাদাভাইকে তিনি আগে থেকেই নিজের দেবর ভেবে তাকে ভাইয়ের মত স্নেহ করেন। নিজে অমন একটা খারাপ কাজে ছ’সাত বছর ধরে লিপ্ত থেকেও দাদাভাই বা রচুর কোন ক্ষতি তিনি করেননি। রচুর এ বিপদের কথা তো তিনিই আমায় প্রথম জানিয়েছিলেন। নইলে আজ এভাবে আমরা রচুকে বিপদমুক্ত করতে পারতুম না বোধহয়। আর এটাও আমি খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি যে, প্রথমদিকে আর্থিক চাপে পড়েই তিনি বিপথে গিয়েছিলেন। আর পরবর্তী কালে একটা নেশা বা ঘোরের বশেই তিনি তার এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আজ সে তার সমস্ত অতীত কাজের জন্য অনুতপ্ত। আর তিনি যে সমস্ত মেয়েগুলোকে তার ব্যবসায় টেনে এনেছিল তারাও সকলেই অভাবের তাড়নাতেই তার কাজে যোগ দিয়েছিল। নইলে আমার এক কথায় মহিমা বৌদিও যেমন তার এ ব্যবসা ছেড়ে দিতেন না, তেমনি ওই মেয়েগুলোও তার কথা এভাবে মেনে নিত না। আর এ’সমস্ত ব্যাপারটা যেদিন বুঝেছি সেদিন থেকেই আমি বুঝে গেছি যে উনি একজন বোর্ন ক্রিমিনাল নন। আর এমন একজন অপরাধীকে মেইন স্ট্রীমে ফিরিয়ে আনতে আমাকে খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। আর সেদিন থেকেই তাকে আমি বৌদি বলে ডাকতে শুরু করেছি। তবে তার মুখেই আমি শুনেছি, তার ভেতরে এ পরিবর্তনটা এসেছে রচুর সাথে পরিচিত হবার পর থেকেই। আচ্ছা সে’কথা যাক। তাকে নিয়ে আমি কী প্ল্যান করেছি সেটাই বরং শোনো”।
বলে নিজের খাবারের শেষটুকু খেয়ে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে বলল, “শোনো পরি, মহিমা বৌদি যে সত্যিই একজন খুব ভাল মনের মহিলা, এ’কথা সবার আগে রচু আমাকে বললেও, কথাটা আমি বিশ্বাস করেছিলুম যখন নীতাও আমাকে সে’কথা বলল। হ্যাঁ, চমকে যেও না। তুমি তো জানতেই, নীতার সাথে তোমার যখন আবার দেখা হল তখন নীতাও এমনই একটা চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। এই মহিমা মালহোত্রা সেনের এজেন্সীতেই নীতা কাজ করত। তার আগে দাদাভাই আর রচুর মুখেও তার অনেক প্রশংসা শুনেছি। দাদাভাই খুবই সহজ সরল। ও সবাইকেই সরল মনে বিশ্বাস করে ফেলে। কেউই তার কাছে খারাপ নয়। কিন্তু আমাদের রচুসোনা কিন্তু তেমন নয়। ওর ভেতরে মানুষ চেনবার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। বিমল আগরওয়ালা লোকটা যে সুবিধের নয়, এটা কিন্তু সবার আগে রচুই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। কিন্তু তখন আমরা কেউই ব্যাপারটাকে অতটা আমল দিই নি। কিন্তু রচুও সবসময় মহিমা বৌদির প্রশংসাই করত। তারপর রচুকে পাবার জন্য বিমল মহিমা বৌদিকে কন্ট্রাক্ট করতেই উনি এমন বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন যে নিজের সর্বস্য দিয়েও তিনি রচুকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার একার পক্ষে বিমল আগরওয়ালার মোকাবেলা করা সম্ভবপর নয় বলে উনি রচু আর দাদাভাইয়ের হিতৈষী এমন কাউকে খুঁজছিলেন যার সহায়তায় তিনি রচুকে বাঁচাতে পারবেন। তখনই তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়। তিনি তখনই আমার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন। আর ঠিক তখনই নীতা আমাকে বলেছিল যে মহিমা বৌদি কাউকে তার নিজের ইচ্ছের বিরূদ্ধে তার ব্যবসায় টানেন না। নীতার কাছে মহিমা বৌদি সম্পর্কে যত কিছু জানা সম্ভব জেনে নিয়ে আমি তার সাথে কথা বলি। প্রথম দিনেই তিনি তার সমস্ত অপরাধের কথা আমার কাছে অকপটে স্বীকার করেছিলেন। যদিও তিনি তখনও জানতে পারেননি যে আমি পুলিশে কাজ করি। অবশ্য তিনি এখনও আমার আসল পরিচয় জানেন না। তবে প্রথম দিনেই উনি আমাকে যা কিছু বললেন তাতেই আমার মনে হয়েছিল, ওই বেআইনি ব্যবসা তিনি একটা ঝোঁকের মাথায় শুরু করলেও তিনি সেটা থেকে মুক্তি পেতে চান। পরে আরও কয়েকদিন কথা বলার পর আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হই। তখনই তোমাকে বলেছিলাম যে তুমি তাকে কোনভাবে হ্যারাস কোর না। আমি তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনবার প্ল্যান করছি। আমি যখন জানতে পারলাম যে তার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা পড়ে আছে। আর তিনি সে টাকা গুলোকে নিজের পরিবারের জন্যও ব্যবহার করতে পারছেন না তখনই আমি তাকে আমার প্ল্যান জানালাম। উনি এককথায় আমার প্ল্যানটা মেনেও নিলেন। তার সাথে আটচল্লিশজন মেয়ে এ কাজে জড়িয়েছিল। তারাও সৎভাবে বেঁচে থাকবার একটা রাস্তা পেয়ে খুব খুশী হয়েছে। এখন তার হাতে এত টাকা আছে, যার কথা তার স্বামী বা ছেলেমেয়েও জানে না। আমার পরামর্শেই মহিমা বৌদি একটা সাড়ে তিনহাজার স্কয়ার ফুটের জমি কিনেছেন প্রায় দু’কোটি টাকা দিয়ে। আর এ জমি কেনার ব্যাপারেই এই সুরজিত অধিকারীর ছোটভাই দেবজিত অধিকারী আমার কথায় তাকে সাহায্য করেছেন। সেখানে মহিমা বৌদি প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বাজেটের একটা মার্কেট কমপ্লেক্স বানাচ্ছেন। তাতে পঞ্চাশটার মত স্টল থাকবে। আর এ কাজের পুরো দায়িত্বটাই মহিমা বৌদি দেবজিত অধিকারীকেই দিয়েছেন। তাই অধিকারীরাই সে প্রজেক্টটা হাতে নিয়েছেন। সেখানে প্রত্যেকটা মেয়েকে সে একটা একটা করে স্টল দিচ্ছেন। তাতে সকলেরই আলাদা আলাদা মালিকানা স্বত্ত থাকছে। তাই মাসে মাসে কোনও ভাড়াও তাদের দিতে হবে না। প্রত্যেককে যার যার পছন্দ অনুযায়ী ব্যবসা শুরু করবার মূলধনও তিনিই দেবেন। আর যতদিন পর্যন্ত মার্কেট কমপ্লেক্স উদ্বোধন না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মেয়েগুলো যেন কোন আর্থিক কষ্টে না পড়ে তার জন্যেও সে প্রতিমাসে মাসে তাদের সংসার চালাবার খরচ দিয়ে যাবেন। মোটামুটি এমনভাবে প্ল্যান করেই এগোচ্ছি আমরা”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর কথা শুনতে শুনতে একের পর এক অবাক হচ্ছিল। সীমন্তিনী থামতেই সে বলে উঠল, “বাপরে বাপ! এতো সাংঘাতিক কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছ ডার্লিং তুমি! দু’কোটি টাকার প্লট, পাঁচ কোটি টাকার কমপ্লেক্স, আটচল্লিশ জনকে ব্যবসার মূলধন, আবার প্রত্যেককে মাসে মাসে সংসার খরচ দিয়ে যাওয়া, এতো বিশাল ব্যাপার! কত টাকা আছে তার হাতে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “শুনলে হয়ত তুমিও চমকে যাবে পরি। মহিমা বৌদির হাতে আজ প্রায় কুড়ি কোটি টাকা আছে। আর তিনি এর সবটাই এ’ভাবে খরচ করতে প্রস্তুত আছেন”।
পরিতোষ নিজে মাথায় হাত দিয়ে বলল, “মাই গড, আই কান্ট বিলিভ। সিমপ্লি আই কান্ট বিলিভ ইট। এভাবে নিজের উপার্জিত টাকা কেউ উড়িয়ে দিতে পারে”?
সীমন্তিনী আবার হেসে বলল, “এ’জন্যেই বোধহয় এখনও সে’কথাটা সত্যি আছে। ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। আসলেই সেটা হতে যাচ্ছে পরি। আর তার প্রসেস অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। ওহ হ্যাঁ, এর মধ্যে আরও একটা কথা আছে পরি। যদিও এটা এ প্রজেক্টের সাথে রিলেটেড নয়। মহিমা বৌদি ছ’সাত বছর আগে যখন সেই আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন ওই সময় এই বিমল আগরওয়ালা তাকে তিরিশ না পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিল। আর তার বিনিময়ে বিমলের কাছে তিনি নিজেকে বাঁধা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন সারা জীবনের জন্য। সেই থেকেই তার এ ব্যবসার শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিমলের আর্থিক শক্তি আর প্রভাব প্রতিপত্তি এতোটাই ছিল যে মহিমা বৌদি রচুকে তার হাত থেকে বাঁচাতে পারতেন না। আর তিনি নিজেও নিজেকে বিমলের হাত থেকে বাঁচাতে পারছিলেন না। যখন তুমি বিমলকে শায়েস্ত করবার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলে, তখনই মহিমা বৌদিকে আমি বলেছিলুম যে উনি যদি আমার কথা মত নিজের পাপ ব্যবসা বন্ধ করে দেন, আর ভবিষ্যতে সৎপথে চলবার চেষ্টা করেন, তাহলে আমিও তাকে বিমলের কবল থেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করব। তাই পরশুদিন রাতে মহিমা বৌদির মুখেই আমি প্রথম জানতে পারি যে বিমলের অমন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বৌদি তো ভেবেছিলেন যে সবকিছু বোধহয় আমিই করেছি”।
সীমন্তিনী থামতে পরিতোষ অনেকক্ষণ থম ধরে বসে রইল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে মেঝেতে পা ঠুকে সীমন্তিনীকে স্যালিউট করে বলল, “স্যালিউট ম্যাম। সেই সঙ্গে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদও জানাচ্ছি। আশা করি তোমার এই সুবিশাল প্রজেক্ট সর্বতোভাবে সফল হোক। আজ তোমার ওপর নয়, আমার নিজের ওপরেই নিজের খুব খুব অহঙ্কার হচ্ছে”।
সীমন্তিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে পরিতোষের হাত ধরে টেনে নামাতে নামাতে বলল, “কী হচ্ছে পরি এ’সব। তুমি আমার থেকে কত সিনিয়ার একজন অফিসার। এভাবে জুনিয়ারকে কেউ স্যালিউট করে? আমার লজ্জা করে না বুঝি”?
বলতে না বলতেই ঘরের কলিংবেল বেজে উঠল। অর্চনা গিয়ে দড়জা খুলতেই নবনীতা ভেতরে ঢুকল। সীমন্তিনী সবাইকে থামতে বলে নবনীতাকে হাতমুখ ধুয়ে আগে খেয়ে নিতে বলল। অর্চনা নবনীতার জন্য খাবার আয়োজন করতে গেল।
*****************
নবনীতার খাওয়া শেষ হবার পর সে পরিতোষকে বলল, “আচ্ছা পরি, তোমার সাথে তো কোন কথাই হয়নি। এবার তুমি কিছু বলবে”?
সীমন্তিনীও নবনীতার কথায় সায় জানাতেই পরিতোষ বলল, “অবশ্যই বলব মন্তি ডার্লিং। কিন্তু এখানে বসেই সেটা শুনবে? না অন্য কোথাও গিয়ে বসবে”?
সীমন্তিনী নবনীতা, অর্চনা আর পরিতোষকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বলল, “পরিতোষ কোনওরকম হেজিটেট না করে তুমি আমার বিছানায় বসে পড়ো। আর আসল কথাগুলো বলো” বলে নবনীতা আর অর্চনাকে নিয়ে নিজেও বিছানার ওপর উঠে বসল।
______________________________