28-03-2020, 11:35 PM
(Update No. 222)
সীমন্তিনী সংক্ষেপে সেটা পরিতোষকে বলল। পরিতোষ শুনে খুব খুশী হয়ে বলল, “বাঃ সত্যিই খুব ভাল খবর। তবে মন্তি, ওই ডক্টর সোম আর কালচিনির ওসি মিঃ রায়, এই দু’জন কিন্তু সত্যিই খুব ভাল কাজ করেছেন। ডক্টর বড়ুয়ার মুখে শুনেছি, ওনার যা কন্ডিশন ছিল তাতে কালচিনির মত অমন ছোট একটা হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট করে এত তাড়াতাড়ি তাকে সুস্থ করে তোলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কিন্তু ডক্টর সোম সে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। আর কোর্টে যে এত তাড়াতাড়ি কেসটার ফয়সলা হয়ে গেল, এ কৃতিত্ব মিঃ রায়ের। উনি নিশ্চয়ই এমনভাবে সাক্ষী সাবুদ কোর্টে প্রোডিউস করেছিলেন যে ডিফেন্স ল’ইয়ারের করবার মত বোধহয় বেশী কিছু ছিলই না। নইলে এত তাড়াতাড়ি এ কেসের রায় বেরতো না” বলে একটু থেমেই আবার বলল, “অবশ্য তোমার রচুসোনা তো বলে, তুমি ছিলে বলেই নাকি মিঃ রায় তার দিদির ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখতেন” বলেই হেসে ফেলল।
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “ছাড়ো তো ওই পাগলীর কথা”।
পরিতোষও হেসে বলল, “আচ্ছা বেশ, তার কথা না হয় আপাততঃ ছেড়েই দিচ্ছি। কিন্তু তোমাদের দু’ম্যাডামের আজকের প্রোগ্রাম কি শুনি? অফিসে কি আজও ছুটি মারতে চাইছ নাকি”?
নবনীতা সাথে সাথে বলল, “না বাবা, আমি কামাই করতে পারব না। পরশুদিনই রাজগঞ্জ থেকে আলিপুর দুয়ার হয়ে আসতে গিয়ে একদিন আমাকে কামাই করতে হয়েছে। আজ আবার কামাই করলে আমি জয়া ম্যাডামের সামনে দাঁড়াতেই পারব না”।
পরিতোষ তখন মন্তিকে বলল, “তাহলে এক কাজ করো মন্তি। আমি কোন ঘরে থাকব, সেটা আমাকে দেখিয়ে দাও। গত বেশ কয়েকটা রাত ভাল করে ঘুমোতে পারিনি আমি। একটা লম্বা টানা ঘুম দেওয়া খুবই প্রয়োজন আমার। তুমি আর বনি ... সরি তুমি আর নীতা যার যার কাজে চলে যাও। তোমরা ফিরে এলে তোমাদের সাথে আমার অনেক কথা আলোচনা করবার আছে। আর হ্যাঁ, তুমি তো বলেছিলে যে কালচিনি বাড়ি তৈরীর কাজটা তুমি এখানকারই কোন এক ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়েছ। তার সঙ্গে আজই একটু কথা বলা যাবে কি? তুমি তার সাথে একটু কথা বলে দেখো। আর তুমি অফিস থেকে ফেরার পথে তাকে যদি সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসতে পার, তাহলে তো আরও ভাল হয়”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে, আমি তাদের সাথে কথা বলে দেখব। আর তুমি, এদিকে এস। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি”।
পরিতোষকে সঙ্গে করে সীমন্তিনী তার গেস্টরুমে এসে বলল, “আগে থেকে আমি যদি জানতে পারতুম যে তুমি আসছ, তাহলে আগে থেকেই সবকিছু পরিপাটি করে রাখতে পারতুম। আসলে সচরাচর এ ঘরটায় তো আর কেউ থাকে না। তাই সব সময় ঝাড়পোঁছও করা হয় না। ঘরটা একটু ঝাট দিয়ে বিছানাটা ভাল করে পেতে দিলেই হবে। তবে দশ মিনিটেই লক্ষ্মীদি সেটা করে দেবে। তুমি এ’ ঘরেই থাকবে। যতক্ষণ খুশী ঘুমিয়ে নিতে পার। কিন্তু আমার মনে হয় আরেকটু অপেক্ষা করে, লাঞ্চের পর ঘুমোলেই ভাল হবে। নইলে লাঞ্চের সময়েই তো আবার তোমাকে ডেকে তুলতে হবে”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর কথায় সায় জানাল।
*********************
বেলা এগারোটার দিকে নবনীতা আর সীমন্তিনী দু’জন একই সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী যাবার আগে লক্ষ্মীকে গেস্টরুমটা পরিস্কার করবার কথা বলে গেছে। তারা বেরিয়ে যেতেই অর্চনা লক্ষ্মীকে রান্না করতে বলে নিজেই গেস্টরুম পরিস্কার করতে চলে গেল। পরিতোষ তখন কোয়ার্টারের চারপাশটা ঘুরে ফিরে দেখছিল। আর মাঝে মাঝে একে ওকে ফোন করছিল।
প্রায় আধঘণ্টা বাদে পরিতোষ ঘরের ভেতর এসে ঢুকতেই অর্চনা বলল, “আপনার ঘরটা পরিস্কার করে দিয়েছি স্যার। কিন্তু লক্ষ্মীদির রান্নাও মোটামুটি হয়ে গেছে। উনি বলছিলেন আপনি চাইলে খেয়ে দেয়েই ঘুমোতে পারেন”।
পরিতোষ কয়েক মূহুর্ত অর্চনার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “মন্তি, নীতা কেউ কিন্তু আমাকে স্যার বলে না, আর আমাকে আপনি আজ্ঞে করেও কথা বলে না। রচু আর রতুও আমাকে স্যার না বলে পরিদা বলে ডাকে, আমিও ওদের দু’জনকে নাম ধরেই ডাকি। আজই আমাদের প্রথম পরিচয়। প্রথম পরিচয়ে কোন মহিলাকে তুমি করে বলাটা ভদ্রোচিত নয়। কিন্তু তবু বলছি, আমি কিন্তু আপনি আজ্ঞে করে কথা বলতে পারব না। নাম ধরে তুমি করেই বলব। তাতে কিছু মনে করবে না তো”?
অর্চনা লাজুক হেসে বলল, “আপনি আমাদের দিদিভাইয়ের বন্ধু। আমাকে নাম ধরে ডাকতেই পারেন। আর তুমি করেই বলবেন। তবে আমি কিন্তু তুমি করে বা আপনার নাম ধরে ডাকতে পারব না। অমন অনুরোধ করবেন না প্লীজ”।
পরিতোষ ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে বলল, “আচ্ছা সে ঠিক আছে। কিন্তু স্যার বলা চলবে না একেবারেই। এবারে এখানে একটু বোস তো। আমার তো আর এখন করবার কিছু নেই। তোমার সাথে বসে একটু কথা বলেই কিছুটা সময় কাটাই”।
অর্চনা উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বসতেই পরিতোষ বলল, “তুমি হয়ত জানো না অর্চনা, রতু আর রচু কলকাতা যাবার দু’তিন দিন পরেই ওদের দু’জনকে আমি দেখেছি। কিন্তু কখনও আমাদের মুখোমুখি দেখা হয়নি। মাসখানেক আগে মন্তি যখন কলকাতা গিয়েছিল, তখনই ওদের সাথে আমার সামনা সামনি দেখা হয়েছিল। তারপর এই কয়েকদিন আগে যখন ওদের দু’জনকে নিয়ে .....”
অর্চনা পরিতোষের কথার মাঝপথেই বলে উঠল, “কিন্তু রচু আর দিদিভাইয়ের মুখে তো শুনেছি যে তিনি কলকাতা যাবার আগেও আপনার সাথে রতুদা আর রচুর একবার মুখোমুখি দেখা হয়েছিল”।
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “ওহ, ওই শাড়ি ছিনতাইয়ের কথাটা বলছ? ও বাবা, সে’কথাও তুমি জেনে ফেলেছ”?
অর্চনা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল। পরিতোষ আবার বলল, “সেদিন মুখোমুখি দেখা হলেও ওরা তো তখন আমার পরিচয় জানত না। তাই ওই দেখাটাকে আমি ধর্তব্যের ভেতর আনছি না। ওদের দু’জনকে ভালভাবে জানলাম সেদিন যখন ওদের দু’জনকে নিয়ে আমি দমদমে ডক্টর বড়ুয়ার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেদিন থেকেই বলতে গেলে ওদের সাথে আমার হৃদ্যতা হয়েছে”।
অর্চনা নরম গলায় বলল, “হ্যাঁ রচু সেদিনের কথাও আমাকে বলেছে। কিন্তু ওরা তো এটা জানে না যে আপনি ......” বলেই হঠাৎ থেমে গেল। সে ভাবল যে’ ব্যাপারটা রতীশ আর রচুর কাছে এখনও গোপন আছে, সেটা এভাবে প্রকাশ না করাই ভাল।
পরিতোষ অর্চনাকে থামতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ কি বলছিলে? ওরা কী জানে না”?
অর্চনা তাড়াতাড়ি বলল, “না না। কিছু না। কিন্তু রচু আমাকে বলেছে যে আপনাকে ও নিজের দাদার মতই ভক্তি শ্রদ্ধা করে”।
পরিতোষ বলল, “রচু সত্যিই খুব ভাল মেয়ে। কিন্তু ওর বা তোমাদের সম্পর্কে বেশী কিছু জানবার সুযোগ আমি পাই নি। আচ্ছা তোমাদের বাড়ি যে কালচিনিতে, সেটা তো আমি শুনেছি। তোমরা ক’ ভাইবোন? আর তোমাদের মা বাবা”?
অর্চনা সহজ ভাবেই জবাব দিল, “আমরা দু’বোন এক ভাই। ভাই সকলের ছোট এবার হায়ার সেকেন্ডারী দেবে। মা বাবা দু’জনেই বাড়িতেই থাকেন। আমার মা-র নাম বিভা আর বাবার নাম বিধুভূষণ চক্রবর্তী। তিনি কিছুদিন আগে অব্দি যজমানিই করতেন। কিছুদিন হল বাড়ির সামনেই একটা দোকান খুলেছেন”।
পরিতোষ মনে মনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “বিধুভূষণ চক্রবর্তী...... বিধুভূষণ ...... বিধু..... বিধু....। কালচিনি.... কালচিনি....। আচ্ছা তোমার বাবাকে কেউ কি বিধু বা বিধুবাবু বলে ডাকে”?
অর্চনা পরিতোষের প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হয়ে জবাব দিল, “এমনিতে বাবাকে তো ওখানে কেউ নাম ধরে ডাকে না। সকলেই তো তাকে চক্রবর্তী মশাই, চক্রবর্তী খুড়ো বলে ডাকে। তবে হ্যাঁ, বাবার সমবয়সী কয়েকজন বাবাকে নাম ধরে ‘বিধু’ বলে ডাকেন। কিন্তু আপনি এ’কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন”?
পরিতোষ মনে মনে আবার কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোমার বাবার বয়স কত হয়েছে”?
অর্চনা আবার কৌতূহলী হয়ে বলল, “বাবার তো এখন বোধহয় ছাপ্পান্ন বছর। কিন্তু আপনি এ’সব জিজ্ঞেস করছেন কেন”?
পরিতোষ যেন নিজের মনের অতলে তলিয়ে গেছে। এভাবে চিন্তামগ্ন ভাবে বলল, “কালচিনি ... বিধু ... ছাপ্পান্ন ... ছাপ্পান্ন ....”
অর্চনা কিছু বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল, “পরিতোষবাবু, কি হল? কি ভাবছেন এত”?
পরিতোষ নিজের মনের চিন্তা দুরে সরিয়ে রেখে একটু হেসে বলল, “না, না, তেমন কিছু নয়। আসলে আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না। রতু ওরা কলকাতা যাবার পর থেকেই মন্তির মুখে কালচিনির নাম আমি শুনেছি। কিন্তু এতদিন আমার এমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এখন এই মূহুর্তে তোমাদের বাবার নামটা শোনবার পর থেকেই আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথায় যেন কালচিনি আর বিধু নামটা একসাথে শুনেছি আমি। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না”। একটু থেমেই আবার বলল, “তবে আমার শোনা বিধুই যে তোমাদের বাবা বিধুভূষণ চক্রবর্তী হবেন, এটা ভাববারও কোন কারন নেই। আচ্ছা সে’কথা বরং থাক। কিন্তু এই যে আমি যে গায়ে পড়ে তোমার সাথে এত কথা বলছি, তাতে তোমার কোনরকম অস্বস্তি হচ্ছে না তো”?
অর্চনার যে একেবারেই অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়। তবু মুখে সে বলল, “না না। ছিঃ ছিঃ এ কী বলছেন আপনি? নীতাদি আর দিদিভাইয়ের সাথে আপনার এত ভাল বন্ধুত্ব, রচুকে আপনি ছোটবোনের মত স্নেহ করেন, এমন লোকের সাথে কথা বলতে আমার অস্বস্তি কেন হবে”?
পরিতোষ মিষ্টি করে হেসে বলল, “না মানে, তখন থেকে আমি একাই তো বেশী বকবক করে চলেছি। তাই বলছিলাম আর কি। আচ্ছা, মন্তিকে, মানে তোমাদের দিদিভাইকে তোমরা খুব ভালবাস তাই না”?
মন্তির প্রসঙ্গ উঠতেই অর্চনা এবার অনেকটা সাবলীল ভাবে জবাব দিল, “যার জন্য আমি বলতে গেলে পূনর্জন্ম লাভ করেছি, তাকে ভালবাসব না? আমাদের পরিবারের মধ্যে আমিই তাকে সবচেয়ে পরে পেয়েছি। দিদিভাই তার অনেক আগে থেকেই আমার মা বাবা, ভাই আর রচুর জন্যে কত কী করেছেন। এখনও সমানে করে যাচ্ছেন। দিদিভাই তো রচু আর ভাইয়ের কাছে ভগবান। মা দিদিভাইকে বলেন মা দুর্গা, আর বাবা তাকে বলেন মা অন্নপূর্ণা। আমি তো তাকে আমার সবকিছু বলে ভাবি”।
পরিতোষ আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “আমি অবশ্য অতশত জানিনা। তবে মন্তি তার দাদাভাই আর রচুকে যতটা ভালবাসে, এমনভাবে ভাল আমি কাউকে বাসতে দেখিনি। আর সেটা দেখেই আমিও ওকে খুব শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রমের চোখে দেখি। আমি তো গত সাত বছর ধরেই অনাথ। তার আগেও শুধু বাবা ছাড়া আমাদের পরিবারে আর কাউকে দেখতে পাইনি আমি। তাই পারিবারিক সম্পর্কগুলো যে কতখানি ভালবাসা, আন্তরিকতা আর শ্রদ্ধায় ভরা হতে পারে এ সম্বন্ধে আমার কোন ধারনাই প্রায় ছিল না। মন্তির সাথে পরিচিত হবার পরই আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। ভালবাসা কাকে বলে, আশেপাশের মানুষগুলোকে কিকরে আপন করে তুলতে হয়, এ’সব আমি ওকে দেখেই বুঝেছি”।
অর্চনা বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই বলল, “আপনার কথা নীতাদি, দিদিভাই আর রচুর মুখে অনেক শুনেছি। কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব আমি কিছুতেই খুঁজে পাইনি”।
পরিতোষ অর্চনার কথা শুনেই তীক্ষ্ণ চোখে অর্চনার দিকে দেখতে দেখতে বলল, “তুমি কি মন্তির সাথে আমার পরিচয় বা বন্ধুত্ব কি করে হয়েছে, তা শুনেছ”?
অর্চনা এবার মাথা নিচু করে ঝাঁকিয়ে বলল, “হু, কিছু কিছু”।
পরিতোষ বলল, “তাহলে তোমার মনে ঠিক কোন প্রশ্ন আছে, সেটা হয়ত আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার মনে হয়ত এ প্রশ্নটাই উঠেছে যে আমি যখন মন্তিকে এত সম্ভ্রম করি, ওর সাথে এখনও যখন আমার এত বন্ধুত্ব, আর মন্তিও যখন আমাকে এখনও তার বন্ধু বলে ভাবে, তাহলে আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে মন্তি আমার প্রস্তাবটা মেনে নেয়নি কেন, তাই তো? কিন্তু আমাকে সে প্রশ্ন করেও আমার কাছ থেকে তার জবাব পাবেনা তুমি অর্চনা। তাই সেটা আর জিজ্ঞেস কোর না প্লীজ”।
অর্চনা কিছুটা হতাশ হয়ে মুখ নামিয়ে নিতেই পরিতোষ আবার বলল, “তুমি হয়ত আমার কথায় দুঃখ পেলে। কিন্তু বিশ্বাস করো, সে প্রশ্নের জবাবটা শুধু তোমাকেই যে জানাতে পারব না, তা নয়। কাউকেই আমি সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। আমি মন্তির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি এ ব্যাপারে। তাই সেটা ছাড়া আর যে কোনও প্রশ্ন তুমি করতে পার”।
অর্চনা এবার সে প্রসঙ্গ ছেড়ে বলল, “আপনি আসবার পরে তো দিদিভাই আর নীতাদি তাদের কাজে চলে গেলেন। আসল কথাটা নিয়ে কোন কথাই বলা হয়নি। কিন্তু শুনলুম যে আপনি নাকি আজ তিনদিন হল কলকাতা ছেড়েছেন। রচুর ওপর এর মধ্যে কোনও বিপদ নেমে আসবেনা তো”?
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “সেটা তোমাদের সবাইকে একসাথেই বলব, ওরা সবাই বাড়ি ফেরবার পর। তবে তুমি যখন রচুকে নিয়ে এতটাই চিন্তায় আছ, তাই আপাততঃ এটুকু জেনে রাখো, তোমার বোন এখন সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ। আর তুমি তো আগেই জেনেছ যে রচুকেও আমি আমার বোন বলেই ভাবি। আমি এ পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, রচুর ওপরে কোনও বিপদের আঁচ লাগতে দেবনা আমি”।
পরিতোষের কথা শুনে অর্চনার চোখ মুখ খুশীতে ঝলমল করে উঠল। সে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলল, “আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব বুঝতে ........” তার কথা শেষ না হতেই অর্চনার হাতে ধরা ফোনটা বেজে উঠল। অর্চনা তাকিয়ে রচনার কল দেখেই হেসে বলল, “দেখুন, ওর কথা বলতে না বলতেই ওর ফোন এসে হাজির”।
পরিতোষ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ফোনটা আমাকে দাও প্লীজ। ওকে একটু চমকে দিই”।
অর্চনাও মজা পেয়ে কোন কথা না বলে ফোনটা পরিতোষের হাতে দিল। পরিতোষ ফোন স্পীকারে দিয়ে কল রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যালো, কে বলছেন”?
অর্চনার গলার বদলে ভারিক্কি পুরুষ কন্ঠ শুনে রচনা একটু থতমত খেয়ে বলল, “ওহ সরি। আমার মনে হয় কোন কারনে কলটা আপনার কাছে চলে গেছে। সরি, কিছু মনে করবেন না প্লীজ”।
রচনা ফোন কেটে দেবার আগেই পরিতোষ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “মানে কী? উল্টোপাল্টা নম্বরে ফোন করবেন, আর বলবেন সরি। এ কি মামার বাড়ির আবদার পেয়েছেন নাকি” বলে অর্চনার দিকে চেয়ে কৌতুক পূর্ণ হাসি দিল।
রচনা ও’পাশ থেকে বলল, “না না, আপনি বিশ্বাস করুন। আমি কোন উল্টোপাল্টা নাম্বার ডায়াল করিনি। আমার মোবাইলে আমার দিদির নাম্বারটা আগে থেকেই সেভ করে রাখা আছে। আর কন্টাক্ট লিস্ট থেকেই আমি ডায়াল করেছি। তাই আমার তরফ থেকে কোন ভুল হয়নি। হয়তো নেট ওয়ার্কের কোন সমস্যার জন্যেই কলটা ভুল নাম্বারে ঢুকে গেছে। তবু আমি আবার সরি বলছি”।
পরিতোষ আবারও অর্চনার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাড়াতাড়ি করে ফোনে বলল, “শুনুন ম্যাডাম, এ’সব ফালতু কথা বলে আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না আপনার। আপনার গলা শুনে তো আপনাকে বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনি কি জানেন, এভাবে অচেনা অজানা পুরুষদের কাছে ফোন করা মেয়েদের পক্ষে একেবারেই ভাল নয়। আমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। তাই আপনাকে বোঝাচ্ছি। এ’সব করবেন না। এতে অনেক রকম বিপদ হতে পারে, বুঝেছেন”?
রচনা তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। সরি। আর আপনাকে ডিসটার্ব করব না” বলেই ফোন কেটে দিল।
অর্চনা অবাক হয়ে বলল, “একি? ফোনটা কেটে দিল”?
পরিতোষ হেসে বলল, “ভেবো না। এখনই আবার কল আসবে দেখো”।
কিন্তু মিনিট পাঁচেক কেটে যাবার পরেও ফোন এল না দেখে পরিতোষ অর্চনাকে বলল, “ও বোধহয় ভাবছে যে আবার রঙ নাম্বার লেগে যাবে। তাই আর করছে না। নাও, এবার তুমিই ওকে ফোন করো”।
অর্চনা ফোন হাতে নিয়ে রচনাকে কল করবার সাথে সাথেই রচনা কল রিসিভ করে বলল, “ইশ দিদিরে। কী কান্ডটাই না হল। একটু আগেই তোকে আমি ফোন করছিলুম। কিন্তু জানিনা কিভাবে কলটা কোথাকার একটা পুলিশের কাছে চলে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরে সরি বললেও লোকটা কিভাবে শাঁসালো আমাকে বাব্বা। শেষ ভয় পেয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলুম। কিন্তু পরে আবার তোকে ফোন করব ভাবলেও ঠিক সাহসে কুলোল না। কিজানি, আবার যদি কলটা ওই নাম্বারেই ঢুকে যায়”।
পরিতোষ অর্চনাকে ঈশারা করতে অর্চনা ফোনের স্পীকার অন করে দিল। তারপর পরিতোষের ঈশারাতেই ফোনটা ডাইনিং টেবিলের ওপরে রেখে ফোনের দিকে একটু ঝুঁকে বলল, “ওমা! তাই নাকিরে? লোকটা কি তোকে গালিগালাজ করেছে নাকি”?
রচনা বলল, “না, তা ঠিক নয়। গালিগালাজ কিছু করেনি। যা বলেছে তা বেশ ভদ্র ভাষাতেই বলেছে। কিন্তু খুব শাসিয়েছে রে। বাব্বা, আমার বুকটা এখনও ধড়ফড় করছে যেন”।
এবার অর্চনা কিছু জবাব দেবার আগেই পরিতোষ ফোনের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বলল, “লোকটা তোমাকে ওভাবে শাঁসালো আর তুমি অমনি ভয় পেয়ে ফোনটা কেটে দিলে? তুমি বলতে পারলে না যে আমার দিদি আর দাদাও আইপিএস অফিসার”?
সীমন্তিনী সংক্ষেপে সেটা পরিতোষকে বলল। পরিতোষ শুনে খুব খুশী হয়ে বলল, “বাঃ সত্যিই খুব ভাল খবর। তবে মন্তি, ওই ডক্টর সোম আর কালচিনির ওসি মিঃ রায়, এই দু’জন কিন্তু সত্যিই খুব ভাল কাজ করেছেন। ডক্টর বড়ুয়ার মুখে শুনেছি, ওনার যা কন্ডিশন ছিল তাতে কালচিনির মত অমন ছোট একটা হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট করে এত তাড়াতাড়ি তাকে সুস্থ করে তোলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কিন্তু ডক্টর সোম সে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। আর কোর্টে যে এত তাড়াতাড়ি কেসটার ফয়সলা হয়ে গেল, এ কৃতিত্ব মিঃ রায়ের। উনি নিশ্চয়ই এমনভাবে সাক্ষী সাবুদ কোর্টে প্রোডিউস করেছিলেন যে ডিফেন্স ল’ইয়ারের করবার মত বোধহয় বেশী কিছু ছিলই না। নইলে এত তাড়াতাড়ি এ কেসের রায় বেরতো না” বলে একটু থেমেই আবার বলল, “অবশ্য তোমার রচুসোনা তো বলে, তুমি ছিলে বলেই নাকি মিঃ রায় তার দিদির ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখতেন” বলেই হেসে ফেলল।
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “ছাড়ো তো ওই পাগলীর কথা”।
পরিতোষও হেসে বলল, “আচ্ছা বেশ, তার কথা না হয় আপাততঃ ছেড়েই দিচ্ছি। কিন্তু তোমাদের দু’ম্যাডামের আজকের প্রোগ্রাম কি শুনি? অফিসে কি আজও ছুটি মারতে চাইছ নাকি”?
নবনীতা সাথে সাথে বলল, “না বাবা, আমি কামাই করতে পারব না। পরশুদিনই রাজগঞ্জ থেকে আলিপুর দুয়ার হয়ে আসতে গিয়ে একদিন আমাকে কামাই করতে হয়েছে। আজ আবার কামাই করলে আমি জয়া ম্যাডামের সামনে দাঁড়াতেই পারব না”।
পরিতোষ তখন মন্তিকে বলল, “তাহলে এক কাজ করো মন্তি। আমি কোন ঘরে থাকব, সেটা আমাকে দেখিয়ে দাও। গত বেশ কয়েকটা রাত ভাল করে ঘুমোতে পারিনি আমি। একটা লম্বা টানা ঘুম দেওয়া খুবই প্রয়োজন আমার। তুমি আর বনি ... সরি তুমি আর নীতা যার যার কাজে চলে যাও। তোমরা ফিরে এলে তোমাদের সাথে আমার অনেক কথা আলোচনা করবার আছে। আর হ্যাঁ, তুমি তো বলেছিলে যে কালচিনি বাড়ি তৈরীর কাজটা তুমি এখানকারই কোন এক ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়েছ। তার সঙ্গে আজই একটু কথা বলা যাবে কি? তুমি তার সাথে একটু কথা বলে দেখো। আর তুমি অফিস থেকে ফেরার পথে তাকে যদি সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসতে পার, তাহলে তো আরও ভাল হয়”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে, আমি তাদের সাথে কথা বলে দেখব। আর তুমি, এদিকে এস। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি”।
পরিতোষকে সঙ্গে করে সীমন্তিনী তার গেস্টরুমে এসে বলল, “আগে থেকে আমি যদি জানতে পারতুম যে তুমি আসছ, তাহলে আগে থেকেই সবকিছু পরিপাটি করে রাখতে পারতুম। আসলে সচরাচর এ ঘরটায় তো আর কেউ থাকে না। তাই সব সময় ঝাড়পোঁছও করা হয় না। ঘরটা একটু ঝাট দিয়ে বিছানাটা ভাল করে পেতে দিলেই হবে। তবে দশ মিনিটেই লক্ষ্মীদি সেটা করে দেবে। তুমি এ’ ঘরেই থাকবে। যতক্ষণ খুশী ঘুমিয়ে নিতে পার। কিন্তু আমার মনে হয় আরেকটু অপেক্ষা করে, লাঞ্চের পর ঘুমোলেই ভাল হবে। নইলে লাঞ্চের সময়েই তো আবার তোমাকে ডেকে তুলতে হবে”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর কথায় সায় জানাল।
*********************
বেলা এগারোটার দিকে নবনীতা আর সীমন্তিনী দু’জন একই সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী যাবার আগে লক্ষ্মীকে গেস্টরুমটা পরিস্কার করবার কথা বলে গেছে। তারা বেরিয়ে যেতেই অর্চনা লক্ষ্মীকে রান্না করতে বলে নিজেই গেস্টরুম পরিস্কার করতে চলে গেল। পরিতোষ তখন কোয়ার্টারের চারপাশটা ঘুরে ফিরে দেখছিল। আর মাঝে মাঝে একে ওকে ফোন করছিল।
প্রায় আধঘণ্টা বাদে পরিতোষ ঘরের ভেতর এসে ঢুকতেই অর্চনা বলল, “আপনার ঘরটা পরিস্কার করে দিয়েছি স্যার। কিন্তু লক্ষ্মীদির রান্নাও মোটামুটি হয়ে গেছে। উনি বলছিলেন আপনি চাইলে খেয়ে দেয়েই ঘুমোতে পারেন”।
পরিতোষ কয়েক মূহুর্ত অর্চনার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “মন্তি, নীতা কেউ কিন্তু আমাকে স্যার বলে না, আর আমাকে আপনি আজ্ঞে করেও কথা বলে না। রচু আর রতুও আমাকে স্যার না বলে পরিদা বলে ডাকে, আমিও ওদের দু’জনকে নাম ধরেই ডাকি। আজই আমাদের প্রথম পরিচয়। প্রথম পরিচয়ে কোন মহিলাকে তুমি করে বলাটা ভদ্রোচিত নয়। কিন্তু তবু বলছি, আমি কিন্তু আপনি আজ্ঞে করে কথা বলতে পারব না। নাম ধরে তুমি করেই বলব। তাতে কিছু মনে করবে না তো”?
অর্চনা লাজুক হেসে বলল, “আপনি আমাদের দিদিভাইয়ের বন্ধু। আমাকে নাম ধরে ডাকতেই পারেন। আর তুমি করেই বলবেন। তবে আমি কিন্তু তুমি করে বা আপনার নাম ধরে ডাকতে পারব না। অমন অনুরোধ করবেন না প্লীজ”।
পরিতোষ ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে বলল, “আচ্ছা সে ঠিক আছে। কিন্তু স্যার বলা চলবে না একেবারেই। এবারে এখানে একটু বোস তো। আমার তো আর এখন করবার কিছু নেই। তোমার সাথে বসে একটু কথা বলেই কিছুটা সময় কাটাই”।
অর্চনা উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বসতেই পরিতোষ বলল, “তুমি হয়ত জানো না অর্চনা, রতু আর রচু কলকাতা যাবার দু’তিন দিন পরেই ওদের দু’জনকে আমি দেখেছি। কিন্তু কখনও আমাদের মুখোমুখি দেখা হয়নি। মাসখানেক আগে মন্তি যখন কলকাতা গিয়েছিল, তখনই ওদের সাথে আমার সামনা সামনি দেখা হয়েছিল। তারপর এই কয়েকদিন আগে যখন ওদের দু’জনকে নিয়ে .....”
অর্চনা পরিতোষের কথার মাঝপথেই বলে উঠল, “কিন্তু রচু আর দিদিভাইয়ের মুখে তো শুনেছি যে তিনি কলকাতা যাবার আগেও আপনার সাথে রতুদা আর রচুর একবার মুখোমুখি দেখা হয়েছিল”।
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “ওহ, ওই শাড়ি ছিনতাইয়ের কথাটা বলছ? ও বাবা, সে’কথাও তুমি জেনে ফেলেছ”?
অর্চনা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল। পরিতোষ আবার বলল, “সেদিন মুখোমুখি দেখা হলেও ওরা তো তখন আমার পরিচয় জানত না। তাই ওই দেখাটাকে আমি ধর্তব্যের ভেতর আনছি না। ওদের দু’জনকে ভালভাবে জানলাম সেদিন যখন ওদের দু’জনকে নিয়ে আমি দমদমে ডক্টর বড়ুয়ার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেদিন থেকেই বলতে গেলে ওদের সাথে আমার হৃদ্যতা হয়েছে”।
অর্চনা নরম গলায় বলল, “হ্যাঁ রচু সেদিনের কথাও আমাকে বলেছে। কিন্তু ওরা তো এটা জানে না যে আপনি ......” বলেই হঠাৎ থেমে গেল। সে ভাবল যে’ ব্যাপারটা রতীশ আর রচুর কাছে এখনও গোপন আছে, সেটা এভাবে প্রকাশ না করাই ভাল।
পরিতোষ অর্চনাকে থামতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ কি বলছিলে? ওরা কী জানে না”?
অর্চনা তাড়াতাড়ি বলল, “না না। কিছু না। কিন্তু রচু আমাকে বলেছে যে আপনাকে ও নিজের দাদার মতই ভক্তি শ্রদ্ধা করে”।
পরিতোষ বলল, “রচু সত্যিই খুব ভাল মেয়ে। কিন্তু ওর বা তোমাদের সম্পর্কে বেশী কিছু জানবার সুযোগ আমি পাই নি। আচ্ছা তোমাদের বাড়ি যে কালচিনিতে, সেটা তো আমি শুনেছি। তোমরা ক’ ভাইবোন? আর তোমাদের মা বাবা”?
অর্চনা সহজ ভাবেই জবাব দিল, “আমরা দু’বোন এক ভাই। ভাই সকলের ছোট এবার হায়ার সেকেন্ডারী দেবে। মা বাবা দু’জনেই বাড়িতেই থাকেন। আমার মা-র নাম বিভা আর বাবার নাম বিধুভূষণ চক্রবর্তী। তিনি কিছুদিন আগে অব্দি যজমানিই করতেন। কিছুদিন হল বাড়ির সামনেই একটা দোকান খুলেছেন”।
পরিতোষ মনে মনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “বিধুভূষণ চক্রবর্তী...... বিধুভূষণ ...... বিধু..... বিধু....। কালচিনি.... কালচিনি....। আচ্ছা তোমার বাবাকে কেউ কি বিধু বা বিধুবাবু বলে ডাকে”?
অর্চনা পরিতোষের প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হয়ে জবাব দিল, “এমনিতে বাবাকে তো ওখানে কেউ নাম ধরে ডাকে না। সকলেই তো তাকে চক্রবর্তী মশাই, চক্রবর্তী খুড়ো বলে ডাকে। তবে হ্যাঁ, বাবার সমবয়সী কয়েকজন বাবাকে নাম ধরে ‘বিধু’ বলে ডাকেন। কিন্তু আপনি এ’কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন”?
পরিতোষ মনে মনে আবার কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোমার বাবার বয়স কত হয়েছে”?
অর্চনা আবার কৌতূহলী হয়ে বলল, “বাবার তো এখন বোধহয় ছাপ্পান্ন বছর। কিন্তু আপনি এ’সব জিজ্ঞেস করছেন কেন”?
পরিতোষ যেন নিজের মনের অতলে তলিয়ে গেছে। এভাবে চিন্তামগ্ন ভাবে বলল, “কালচিনি ... বিধু ... ছাপ্পান্ন ... ছাপ্পান্ন ....”
অর্চনা কিছু বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল, “পরিতোষবাবু, কি হল? কি ভাবছেন এত”?
পরিতোষ নিজের মনের চিন্তা দুরে সরিয়ে রেখে একটু হেসে বলল, “না, না, তেমন কিছু নয়। আসলে আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না। রতু ওরা কলকাতা যাবার পর থেকেই মন্তির মুখে কালচিনির নাম আমি শুনেছি। কিন্তু এতদিন আমার এমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এখন এই মূহুর্তে তোমাদের বাবার নামটা শোনবার পর থেকেই আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথায় যেন কালচিনি আর বিধু নামটা একসাথে শুনেছি আমি। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না”। একটু থেমেই আবার বলল, “তবে আমার শোনা বিধুই যে তোমাদের বাবা বিধুভূষণ চক্রবর্তী হবেন, এটা ভাববারও কোন কারন নেই। আচ্ছা সে’কথা বরং থাক। কিন্তু এই যে আমি যে গায়ে পড়ে তোমার সাথে এত কথা বলছি, তাতে তোমার কোনরকম অস্বস্তি হচ্ছে না তো”?
অর্চনার যে একেবারেই অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়। তবু মুখে সে বলল, “না না। ছিঃ ছিঃ এ কী বলছেন আপনি? নীতাদি আর দিদিভাইয়ের সাথে আপনার এত ভাল বন্ধুত্ব, রচুকে আপনি ছোটবোনের মত স্নেহ করেন, এমন লোকের সাথে কথা বলতে আমার অস্বস্তি কেন হবে”?
পরিতোষ মিষ্টি করে হেসে বলল, “না মানে, তখন থেকে আমি একাই তো বেশী বকবক করে চলেছি। তাই বলছিলাম আর কি। আচ্ছা, মন্তিকে, মানে তোমাদের দিদিভাইকে তোমরা খুব ভালবাস তাই না”?
মন্তির প্রসঙ্গ উঠতেই অর্চনা এবার অনেকটা সাবলীল ভাবে জবাব দিল, “যার জন্য আমি বলতে গেলে পূনর্জন্ম লাভ করেছি, তাকে ভালবাসব না? আমাদের পরিবারের মধ্যে আমিই তাকে সবচেয়ে পরে পেয়েছি। দিদিভাই তার অনেক আগে থেকেই আমার মা বাবা, ভাই আর রচুর জন্যে কত কী করেছেন। এখনও সমানে করে যাচ্ছেন। দিদিভাই তো রচু আর ভাইয়ের কাছে ভগবান। মা দিদিভাইকে বলেন মা দুর্গা, আর বাবা তাকে বলেন মা অন্নপূর্ণা। আমি তো তাকে আমার সবকিছু বলে ভাবি”।
পরিতোষ আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “আমি অবশ্য অতশত জানিনা। তবে মন্তি তার দাদাভাই আর রচুকে যতটা ভালবাসে, এমনভাবে ভাল আমি কাউকে বাসতে দেখিনি। আর সেটা দেখেই আমিও ওকে খুব শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রমের চোখে দেখি। আমি তো গত সাত বছর ধরেই অনাথ। তার আগেও শুধু বাবা ছাড়া আমাদের পরিবারে আর কাউকে দেখতে পাইনি আমি। তাই পারিবারিক সম্পর্কগুলো যে কতখানি ভালবাসা, আন্তরিকতা আর শ্রদ্ধায় ভরা হতে পারে এ সম্বন্ধে আমার কোন ধারনাই প্রায় ছিল না। মন্তির সাথে পরিচিত হবার পরই আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। ভালবাসা কাকে বলে, আশেপাশের মানুষগুলোকে কিকরে আপন করে তুলতে হয়, এ’সব আমি ওকে দেখেই বুঝেছি”।
অর্চনা বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই বলল, “আপনার কথা নীতাদি, দিদিভাই আর রচুর মুখে অনেক শুনেছি। কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব আমি কিছুতেই খুঁজে পাইনি”।
পরিতোষ অর্চনার কথা শুনেই তীক্ষ্ণ চোখে অর্চনার দিকে দেখতে দেখতে বলল, “তুমি কি মন্তির সাথে আমার পরিচয় বা বন্ধুত্ব কি করে হয়েছে, তা শুনেছ”?
অর্চনা এবার মাথা নিচু করে ঝাঁকিয়ে বলল, “হু, কিছু কিছু”।
পরিতোষ বলল, “তাহলে তোমার মনে ঠিক কোন প্রশ্ন আছে, সেটা হয়ত আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার মনে হয়ত এ প্রশ্নটাই উঠেছে যে আমি যখন মন্তিকে এত সম্ভ্রম করি, ওর সাথে এখনও যখন আমার এত বন্ধুত্ব, আর মন্তিও যখন আমাকে এখনও তার বন্ধু বলে ভাবে, তাহলে আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে মন্তি আমার প্রস্তাবটা মেনে নেয়নি কেন, তাই তো? কিন্তু আমাকে সে প্রশ্ন করেও আমার কাছ থেকে তার জবাব পাবেনা তুমি অর্চনা। তাই সেটা আর জিজ্ঞেস কোর না প্লীজ”।
অর্চনা কিছুটা হতাশ হয়ে মুখ নামিয়ে নিতেই পরিতোষ আবার বলল, “তুমি হয়ত আমার কথায় দুঃখ পেলে। কিন্তু বিশ্বাস করো, সে প্রশ্নের জবাবটা শুধু তোমাকেই যে জানাতে পারব না, তা নয়। কাউকেই আমি সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। আমি মন্তির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি এ ব্যাপারে। তাই সেটা ছাড়া আর যে কোনও প্রশ্ন তুমি করতে পার”।
অর্চনা এবার সে প্রসঙ্গ ছেড়ে বলল, “আপনি আসবার পরে তো দিদিভাই আর নীতাদি তাদের কাজে চলে গেলেন। আসল কথাটা নিয়ে কোন কথাই বলা হয়নি। কিন্তু শুনলুম যে আপনি নাকি আজ তিনদিন হল কলকাতা ছেড়েছেন। রচুর ওপর এর মধ্যে কোনও বিপদ নেমে আসবেনা তো”?
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “সেটা তোমাদের সবাইকে একসাথেই বলব, ওরা সবাই বাড়ি ফেরবার পর। তবে তুমি যখন রচুকে নিয়ে এতটাই চিন্তায় আছ, তাই আপাততঃ এটুকু জেনে রাখো, তোমার বোন এখন সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ। আর তুমি তো আগেই জেনেছ যে রচুকেও আমি আমার বোন বলেই ভাবি। আমি এ পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, রচুর ওপরে কোনও বিপদের আঁচ লাগতে দেবনা আমি”।
পরিতোষের কথা শুনে অর্চনার চোখ মুখ খুশীতে ঝলমল করে উঠল। সে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলল, “আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব বুঝতে ........” তার কথা শেষ না হতেই অর্চনার হাতে ধরা ফোনটা বেজে উঠল। অর্চনা তাকিয়ে রচনার কল দেখেই হেসে বলল, “দেখুন, ওর কথা বলতে না বলতেই ওর ফোন এসে হাজির”।
পরিতোষ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ফোনটা আমাকে দাও প্লীজ। ওকে একটু চমকে দিই”।
অর্চনাও মজা পেয়ে কোন কথা না বলে ফোনটা পরিতোষের হাতে দিল। পরিতোষ ফোন স্পীকারে দিয়ে কল রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যালো, কে বলছেন”?
অর্চনার গলার বদলে ভারিক্কি পুরুষ কন্ঠ শুনে রচনা একটু থতমত খেয়ে বলল, “ওহ সরি। আমার মনে হয় কোন কারনে কলটা আপনার কাছে চলে গেছে। সরি, কিছু মনে করবেন না প্লীজ”।
রচনা ফোন কেটে দেবার আগেই পরিতোষ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “মানে কী? উল্টোপাল্টা নম্বরে ফোন করবেন, আর বলবেন সরি। এ কি মামার বাড়ির আবদার পেয়েছেন নাকি” বলে অর্চনার দিকে চেয়ে কৌতুক পূর্ণ হাসি দিল।
রচনা ও’পাশ থেকে বলল, “না না, আপনি বিশ্বাস করুন। আমি কোন উল্টোপাল্টা নাম্বার ডায়াল করিনি। আমার মোবাইলে আমার দিদির নাম্বারটা আগে থেকেই সেভ করে রাখা আছে। আর কন্টাক্ট লিস্ট থেকেই আমি ডায়াল করেছি। তাই আমার তরফ থেকে কোন ভুল হয়নি। হয়তো নেট ওয়ার্কের কোন সমস্যার জন্যেই কলটা ভুল নাম্বারে ঢুকে গেছে। তবু আমি আবার সরি বলছি”।
পরিতোষ আবারও অর্চনার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাড়াতাড়ি করে ফোনে বলল, “শুনুন ম্যাডাম, এ’সব ফালতু কথা বলে আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না আপনার। আপনার গলা শুনে তো আপনাকে বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনি কি জানেন, এভাবে অচেনা অজানা পুরুষদের কাছে ফোন করা মেয়েদের পক্ষে একেবারেই ভাল নয়। আমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। তাই আপনাকে বোঝাচ্ছি। এ’সব করবেন না। এতে অনেক রকম বিপদ হতে পারে, বুঝেছেন”?
রচনা তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। সরি। আর আপনাকে ডিসটার্ব করব না” বলেই ফোন কেটে দিল।
অর্চনা অবাক হয়ে বলল, “একি? ফোনটা কেটে দিল”?
পরিতোষ হেসে বলল, “ভেবো না। এখনই আবার কল আসবে দেখো”।
কিন্তু মিনিট পাঁচেক কেটে যাবার পরেও ফোন এল না দেখে পরিতোষ অর্চনাকে বলল, “ও বোধহয় ভাবছে যে আবার রঙ নাম্বার লেগে যাবে। তাই আর করছে না। নাও, এবার তুমিই ওকে ফোন করো”।
অর্চনা ফোন হাতে নিয়ে রচনাকে কল করবার সাথে সাথেই রচনা কল রিসিভ করে বলল, “ইশ দিদিরে। কী কান্ডটাই না হল। একটু আগেই তোকে আমি ফোন করছিলুম। কিন্তু জানিনা কিভাবে কলটা কোথাকার একটা পুলিশের কাছে চলে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরে সরি বললেও লোকটা কিভাবে শাঁসালো আমাকে বাব্বা। শেষ ভয় পেয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলুম। কিন্তু পরে আবার তোকে ফোন করব ভাবলেও ঠিক সাহসে কুলোল না। কিজানি, আবার যদি কলটা ওই নাম্বারেই ঢুকে যায়”।
পরিতোষ অর্চনাকে ঈশারা করতে অর্চনা ফোনের স্পীকার অন করে দিল। তারপর পরিতোষের ঈশারাতেই ফোনটা ডাইনিং টেবিলের ওপরে রেখে ফোনের দিকে একটু ঝুঁকে বলল, “ওমা! তাই নাকিরে? লোকটা কি তোকে গালিগালাজ করেছে নাকি”?
রচনা বলল, “না, তা ঠিক নয়। গালিগালাজ কিছু করেনি। যা বলেছে তা বেশ ভদ্র ভাষাতেই বলেছে। কিন্তু খুব শাসিয়েছে রে। বাব্বা, আমার বুকটা এখনও ধড়ফড় করছে যেন”।
এবার অর্চনা কিছু জবাব দেবার আগেই পরিতোষ ফোনের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বলল, “লোকটা তোমাকে ওভাবে শাঁসালো আর তুমি অমনি ভয় পেয়ে ফোনটা কেটে দিলে? তুমি বলতে পারলে না যে আমার দিদি আর দাদাও আইপিএস অফিসার”?
(To be cont'd ......)
______________________________