28-03-2020, 11:30 PM
(Update No. 221)
অর্চনা আর লক্ষ্মীদি সীমন্তিনীর কথা শুনে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকল। অর্চনা তখনও জানেনা যে এইমাত্র ঘরে এসে ঢোকা এ আগন্তুকই পরিতোষ। সীমন্তিনী আর নবনীতাও বুঝি আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভুলেই গিয়েছিল যে পরিতোষের সঙ্গে এভাবে হঠাৎ করে সামনা সামনি পরিচয় হলে অর্চনা লজ্জা পাবে। সীমন্তিনী লক্ষ্মী আর অর্চনার সাথে পরিতোষের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য কিছু একটা বলতে যেতেই পরিতোষ বাঁধা দিয়ে বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও মন্তি, লেট মি গেস” বলে লক্ষ্মীর দিকে হাত দেখিয়ে বলল, “ইনিইতো তোমার লক্ষ্মীদি, আর” বলে অর্চনার দিকে ভাল করে দেখতে দেখতে বলল, “এনাকে দেখে তো আমাদের রচু সোনার দিদি বলে মনে হচ্ছে। ঠিক বলেছি না”?
বলে সীমন্তিনীর দিকে চাইতেই সীমন্তিনী বলল, “একদম ঠিক বলেছ। আমাদের রচু সোনার দিদি অর্চু, মানে অর্চনা” আর লক্ষ্মীদি ইনি হলেন আমার আর নীতার পরি, পরিতোষ সান্যাল”।
পরিতোষ হাতজোড় করে দু’জনকে নমস্কার করবার আগেই অর্চনা ছুটে তাদের ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। সীমন্তিনী অর্চনার অবস্থা কল্পনা করেই নবনীতাকে ঈশারা করতে নবনীতাও ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি শিগগীর ওর জন্যে চা জল খাবার রেডি কর। আর পরি তুমি আমার সাথে এস। আমার ঘরে গিয়ে বসি”।
নিজের ঘরে ঢুকে সীমন্তিনী পরিতোষকে বলল, “পরি, এতোটা জার্নি করে এসেছ। হয়ত টায়ার্ড হয়েছ। কিন্তু এখনই তোমাকে গেস্টরুমে ঢোকাতে পারছি না। গেস্টরুমটাকে একটু ঝাড়পোঁছ করতে হবে। তুমি আপাততঃ আমার বাথরুমটাই ব্যবহার করো। হাত মুখ ধুয়ে একেবারে স্নান সেরে বেরিয়ে এস। গিজারে গরম জলও আছে। আমি ততক্ষণে অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিই যে আমি ঘন্টাখানেক পর অফিস যাচ্ছি”।
পরিতোষ সোফায় বসে নিজের ব্যাগটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, “প্যাকেটটা ভাল মত রেখেছ তো? খুলেছ”?
সীমন্তিনী বলল, “না খুলিনি, তবে ভাল মতই রেখেছি। অফিসে বেরোচ্ছিলুম বলেই সাথে সাথে খুলিনি। ভেবেছিলুম অফিস থেকে এসেই সেটা খুলব। কিন্তু ওটা তো বেশ ভারী দেখলুম। কি আছে ওতে”?
পরিতোষ হেসে বলল, “এসেই যখন পড়েছি, তখন আর ভেবো না। সময় মত জানতে পারবে” বলে নিজের ব্যাগ থেকে টাওয়েল সাবান টুথব্রাশ বের করে সীমন্তিনীর কথামতই পরিতোষ সীমন্তিনীর বাথরুমে ঢুকে গেল।
সীমন্তিনী নিজের অফিসে ফোন না করে তখনই অর্চনাদের ঘরে গিয়ে নবনীতাকে বলল, “পরিটা এভাবে হুট করে এসে পড়াতে অর্চু বেশ লজ্জা পেয়ে গেছে তাই না রে নীতা? তবে একটা কথা শোন তোরা দু’জনেই। আয় এদিকে আয়” বলে অর্চনা আর নবনীতার হাত ধরে বিছানায় বসতেই নবনীতা বলল, “পরি কি তোমাকে আগে জানিয়েছিল দিদি, যে ও আজ আসছে এখানে”?
সীমন্তিনী চাপা গলায় জবাব দিল, “আরে নারে। ওর সাথে আমার তো এ ব্যাপারে কোন কথাই হয়নি। তোরা তো দেখেছিস গত দু’দিন ধরে ওর সাথে কথা বলতে না পেরে আমি কতটা চিন্তিত ছিলুম। একটু আগেও যখন ফোন করে আমাকে বলল যে একজন লোকের হাতে ও ওই প্যাকেটটা পাঠাচ্ছে, তখনও ও বলেনি যে ও এখানে এসে গেছে। তবে কি ব্যাপারে কেন এসেছে তা আমরা ঠিকই এবার জানতে পারব। কিন্তু শোন নীতা, পরিকে এখনই অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে ও’সব নিয়ে কোন কথাই বলবি না একদম”।
নবনীতা ব্যাপারটা আন্দাজ করে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই সীমন্তিনী অর্চনাকে বলল, “অর্চু সোনা। তুই ভাবিসনে যে আমরা জেনে বুঝে কোনও প্ল্যান করে পরিকে এভাবে ডেকে এনেছি। তোকে সত্যি বলছি, পরি যে এভাবে হুট করে আমার এখানে চলে আসতে পারে, এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে ওর সাথে কথা না বলে তো বোঝা যাবে না যে ও ঠিক কী জন্যে এখানে এসেছে। তবে ও এভাবে এসে পড়াতে তুই যে খুব লজ্জা পাচ্ছিস, সেটা বুঝতেই পারছি বোন। আর সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু আমার একটা কথা ভাল করে শোন বোন। পরিকে কিন্তু আমরা এখনও তোর ব্যাপারে, মানে তোদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলিনি। আমি তো তোদের আগেই বলেছি যে পরি কটা দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছে। আমি ভেবেছিলুম ওর ব্যস্ততাটা কেটে যাবার পরেই আমরা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলব। তাই তুই যেমন জানিস যে আমরা ওর সাথে তোর বিয়ে দেবার চেষ্টা করছি, ও কিন্তু সেটা জানে না এখনও। তাই তুই এখনই ওর সামনে এত লজ্জা পেতে যাস নে। স্বাভাবিক ভাবে ওর সাথে কথাটথা বলবি। ও কেন এখানে এসেছে, আর কতক্ষণ থাকবে, এ’সব ব্যাপারে তো এখনও কিছু জানতে পারিনি। তবে যতক্ষণই থাক, তুই ওকে শুধু আমার আর মন্তির বন্ধু বলেই ভাববি। ওকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিবি না যে আমরা তোর আর ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছি। ও যতক্ষণ এখানে থাকবে, ততক্ষণ বিয়ের ব্যাপারে, মানে তোর আর ওর বিয়ের ব্যাপারে আমরা কেউ কোন কথা বলব না। অন্ততঃ আজকের দিনটা এভাবে কাটুক। পরে নাহয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব, বুঝেছিস তো? আর নীতা, আমি তো পরির সাথেই থাকব। তুই এখনই রচুকে একটা ফোন করে বলে দে যে পরি এখানে এসেছে হঠাৎ করে। তাই এখন আমাদের কারো সাথে কথা বলার সময়ে ও যেন পরি আর অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা না বলে, বুঝেছিস”?
নবনীতা মাথা নেড়ে সায় জানাতেই সীমন্তিনী উঠে পড়ে অর্চনার গালে হাত বুলিয়ে বলল, “একদম টেনশন নিস না সোনা। ওর সামনে স্বাভাবিক থাকবি, কেমন? আমি এখন ওকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসব। তোরাও আসিস। আর একদম স্বাভাবিক থাকবি সবাই”।
অর্চনাও মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়তেই সীমন্তিনী বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী সোজা রান্নাঘরে গিয়ে পরিতোষের খাবার প্রস্তুত হচ্ছে কিনা দেখে নিয়ে নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই তার অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিল যে তার অফিসে যেতে কিছুটা দেরী হবে।
খানিক বাদেই পরিতোষ পাজামা আর পাঞ্জাবী পড়ে সীমন্তিনীর ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “আমি হঠাৎ করে এসে পড়ে তোমাদের সবাইকে খুব বিব্রত করে ফেলেছি বুঝতে পারছি মন্তি ডার্লিং। কিন্তু তা সত্বেও না এসে পারলাম না। তবে ও’সব কথা পরে বলছি। তুমি অফিস যাচ্ছ তো না কি”?
পরিকে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসতে বলে সীমন্তিনী বলল, “আমি অফিসে জানিয়ে দিয়েছি যে আজ আমার অফিসে যেতে একটু দেরী হবে। আর তুমি এভাবে এসে পড়াতে আমরা কতটুকু অপ্রস্তুত হয়েছি না হয়েছি সে কথা ছেড়ে আগে বলো তো, এভাবে হুট করে চলে আসবার দরকার কি ছিল? হ্যাঁ মানছি, খুব ভাল একটা সারপ্রাইজ তুমি আমাদের দিয়েছ। কিন্তু তার কি সত্যিই কোন দরকার ছিল”?
ততক্ষণে অর্চনা আর নবনীতাও ডাইনিং টেবিলে এসে দুটো চেয়ারে বসে পড়ল। নবনীতা বেশ খুশী খুশী মুখে পরিতোষকে বলল, “হ্যাঁ পরি, বলো তো? এভাবে আমাদের সারপ্রাইজ দেবার পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা কী”?
পরিতোষকে একবার সকলের মুখের দিকে দেখে অর্চনার মুখের ওপর বেশ কয়েক মূহুর্ত চেয়ে থাকতে দেখে সীমন্তিনী বলল, “অর্চুকে দেখে হেজিটেট করছ বলতে? আমার এই অর্চু সোনাও আমাদের রচু সোনার মতই আমাদের পরম প্রিয়জন এবং আপন। ওর সামনে তুমি যে কোন কথা অনায়াসে বলতে পারো পরি। নাও খেতে খেতে কথা বলো”।
লক্ষ্মী একটা প্লেটে কয়েকটা লুচি আর তরকারির বাটি এনে পরিতোষের সামনে রেখে বলল, “নিন, স্যার। এটুকু খেয়ে নিন”?
পরিতোষ অবাক চোখে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এসব কী? লুচি তরকারি! এসব বানিয়েছেন আপনি আমার জন্যে”?
সীমন্তিনী নবনীতা আর অর্চনার সাথে লক্ষ্মীও অবাক হল পরিতোষের কথা শুনে। লক্ষ্মী আমতা আমতা করে ভয়ে ভয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, আমি তো এটাই বানালুম। তা আপনি কি এ’সব খান না”?
পরিতোষ কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে মাথা নিচু করে ফেলল। তার খুব ছোট্টবেলাকার একটা ধোঁয়াটে ছবি যেন তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। কত কত বছর পরে সে দৃশ্যটা আজ তার মনে পড়ল। তখন বোধহয় তার পাঁচ ছ’ বছর বয়স।
সীমন্তিনী পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে আস্তে করে বলল, “কি হল পরি? তুমি কি সত্যি লুচি তরকারি খাও না? আচ্ছা বেশ, লক্ষ্মীদি তুমি না হয় চট করে একটু নুডলসই বানিয়ে আন ওর জন্যে। আর এ’গুলো বরং নিয়েই যাও। আমরা সকলে তো সকালের খাওয়া তো খেয়ে নিয়েছি”।
লক্ষ্মী হতভম্বের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েও ইতস্তত করে বলল, “দিদিমণি, কারো সামনে থেকে এভাবে খাবারের থালা সরিয়ে নেওয়া যে ঠিক নয় গো”।
পরিতোষ সাথে সাথে লুচির থালাটার ওপর দুটো হাত এমন আড়াআড়ি ভাবে রাখল যে দেখে মনে হল কেউ যেন তার সামনে থেকে থালাটা ছিনিয়ে নিতে চাইছে, আর সে থালাটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। পরিতোষকে এমন করতে দেখে ঘরের বাকি সবাই একে অপরের মুখের দিকে দেখতে লাগল। সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “ঠিক আছে লক্ষ্মীদি, এটা থাক। তুমি বরং গিয়ে ওর জন্যে ভাল করে এক কাপ কফি বানিয়ে আনো”।
লক্ষ্মী তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে চলে গিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে থাকবার পর পরিতোষ নিজের পাঞ্জাবীর কোনা দিয়ে চোখ মোছবার চেষ্টা করতেই অর্চনা নবনীতা আর সীমন্তিনী সকলেই বুঝতে পারল পরিতোষ কাঁদছে। নবনীতা আর সীমন্তিনী দু’জন দু’পাশ থেকে পরিতোষের পিঠে হাত রেখে তার নাম ধরে ডাকল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে পরিতোষ নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে সকলের দিকে দেখতে দেখতে ম্লান হেসে বলল, “সরি মন্তি। আমি একটু ..... প্লীজ কিছু মনে কোর না তোমরা”।
সীমন্তিনী পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল, “এ’গুলো খেতে যদি ইচ্ছে না করে তবে থাক। তোমাকে একটু নুডলস বানিয়ে দিচ্ছি”।
পরিতোষ এবার বেশ তাড়াতাড়িই জবাব দিল, “না না। ইটস ওকে। কোন সমস্যা নেই। তা আমি একা একাই খাব নাকি? তোমরা কেউ কিছু খাবে না আমার সাথে”?
সীমন্তিনী বলল, “আমরা কিছুক্ষণ আগেই সকালের খাবার খেয়েছি পরি। তবে তোমার সাথে আমরাও সবাই একটু একটু কফি খাব। তুমি শুরু করো” বলে অর্চনার দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্চু, লক্ষ্মীদিকে বল, আমাদের সবার জন্য কফি বানাতে”।
অর্চনা রান্নাঘরে যাবার সুযোগ পেয়ে আর এক মূহুর্তও দাঁড়াল না। রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি বানাতে বানাতেও তার কান সজাগ রইল।
পরিতোষ লুচি তরকারির প্রথম গ্রাসটা মুখে দিয়েই তৃপ্তিতে চোখ বুজে ফেলল। ভাল করে চিবিয়ে আয়েশ করে গ্রাসটা গিলে নেবার পর চোখ খুলে হেসে বলল, “জানো মন্তি, আজ প্রায় চব্বিশ বছর পর কেউ আমার সামনে এভাবে লুচি তরকারির প্লেট এগিয়ে দিল। আমি তখন খুব ছোট্ট। ছোটবেলার অনেক কথাই মন থেকে হারিয়ে গেছে। মা-র স্মৃতি বলতে তো কিছুই নেই আমার। আজ এই মূহুর্তে হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার একটা কথা। তখন বোধ হয় আমি ছ’ সাত বছরের। আমার ঠাকুমা ঠিক এভাবে লুচির থালা সাজিয়ে আমার সামনে রেখেছিলেন। কথাটা গত তেইশ চব্বিশ বছরের মধ্যে আর আমার মনে আসেনি, কারনটা আমিও জানিনা। তবে সেদিনের পর এতগুলো বছরের মধ্যে আজই প্রথম কেউ আমাকে এভাবে খেতে দিল। তাই হয়ত কথাটা আমার মনে পড়ে গেল”।
অর্চনা রান্নাঘর থেকে পরিতোষের এ’কথা শুনতেই তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তার মনটা যেন বলে উঠল ‘আহারে বেচারা’। আর সীমন্তিনী পরিবেশটা হাল্কা করবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “আচ্ছা, এবার খেতে খেতে হঠাৎ তোমার এমন আগমনের কারনটা কী বলো তো” বলেই রান্নাঘরের দিকে মুখ তুলে বলল, “লক্ষ্মীদি আর লুচি আছে? থাকলে আরও দুটো নিয়ে এস”।
লক্ষ্মী রান্নাঘর থেকেই সাড়া দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি আছে, আনছি”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর কথার জবাবে বলল, “প্লীজ মন্তি ডার্লিং। এভাবে আমার মনের সুখটা নষ্ট করে ফেলো না প্লীজ। আগে তৃপ্তি করে খেতে দাও। লুচিগুলো খেয়ে নিই। তারপর কফি খেতে খেতেই না হয় সেটা বলি”।
কেউ আর কোনও কথা বলল না। লক্ষ্মী আরও দু’খানা লুচি পরিতোষের থালায় দিল। পরিতোষ সে’দুটোও খেয়ে নিল। অর্চনা ট্রেতে করে চার কাপ কফি এনে সবাইকে দিয়ে নিজেও একটা কাপ নিয়ে একটা চেয়ারে বসল। পরিতোষ কফির কাপে প্রথম চুমুক দিয়েই সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি অফিসে যাচ্ছ তো”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “হ্যাঁ যেতে তো হবেই। কিন্তু একটু আগেই যে ওই আব্দুর রহমান নামে লোকটা এসে ওই প্যাকেটটা দিয়ে গেল, সেটা কি তার হাত দিয়ে তুমিই পাঠিয়েছিলে? প্যাকেটটা তো বেশ ভারী। কী আছে ওতে? আর তুমি নিজেই যখন এলে তবে তার হাত দিয়ে সেটা পাঠাবার কি দরকার ছিল”?
পরিতোষ খেতে খেতেই বলল, “আব্দুর রহমান ওর আসল নাম নয় মন্তি। ওর আসল নাম হচ্ছে আব্দুল। আব্দুল করিম শেখ। ক’দিন আগে একদিন রাতে তোমাকে বলেছিলাম না? প্রীতিদির বাড়িতে ডিনার করেছি। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘প্রীতিদি কে’। আমি বলেছিলাম ‘পরে বলব’। মনে আছে? ওই প্রীতিদি এই আব্দুলের স্ত্রী। আমাকে নিজের ভাইয়ের মত স্নেহ করেন। আমাকে ভাই ফোঁটা দেন। আব্দুলও আমার খুব বিশ্বস্ত। ওর ওপর যে কোন কাজের ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। কলকাতাতেই থাকে। আমি তিনদিন যাবৎ কলকাতার বাইরে ছিলাম, তমলুকে। কিন্তু এই জিনিসটা পরশুদিনই আব্দুলের কাছে এসে পড়েছিল। তাই কলকাতা থেকে আব্দুলকেই পাঠাতে বাধ্য হয়েছি প্যাকেটটা তোমার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। আমি আজ ভোরে তমলুক থেকে কলকাতা এসে সোজা দমদম চলে গিয়েছিলাম। তারপর সকালের প্রথম ফ্লাইট ধরেই বাগডোগরা চলে এসেছি। তাই আমার পক্ষে প্যাকেটটা আনা সম্ভব হয়নি। আর.... ওই প্যাকেটটার ভেতর চল্লিশ লক্ষ টাকা আছে। তুমি বলেছিলে না যে রচুর বাপের বাড়িতে ঘর বানাতে তোমার টাকা লাগবে। এটাই সেই টাকা”।
পরিতোষের কথা শুনে তিনজনেই চোখ বড়বড় করে চাপা চিৎকার করে উঠল। সীমন্তিনী বলল, “এভাবে এতগুলো টাকা এখানে পাঠাবার কী দরকার ছিল পরি? রাস্তা ঘাটে কত কিছুই তো হয়ে যেতে পারত। তুমি তো ব্যাঙ্ক ড্রাফট করেই পাঠিয়ে দিতে পারতে”।
পরিতোষ বলল, “তা হয়ত পারতাম। কিন্তু তাতে কিছু রিস্ক থেকে যেত। কেউ না কেউ জেনে ফেলত। তাছাড়া ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলাও আছে এতে। তাই আগে থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম যে আমি নিজেই টাকাটা নিয়ে আসব। কিন্তু অফিসের কাজে আমাকে ষোল তারিখে ইস্ট মেদিনীপুর যেতে হয়েছিল। সতের তারিখ বিকেলে টাকাটা আমাদের হাতে এলেও আমি তখন তমলুকে। তাই আব্দুলকে দিয়েই এ টাকাটা পাঠাতে হল। আব্দুল আমার খুব বিশ্বস্ত। ওকে নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না আমার। কিন্তু এ টাকাটা তুমি হাতে পেলে কী করবে না করবে, সেটা ভেবেই আমি নিজেও চলে এসেছি। তুমি হয়ত অতটা তলিয়ে না ভেবেই টাকাটা নিয়ে ব্যাঙ্কে চলে যেতে কোনও একাউন্টে জমা দিতে। আর তাতেও একই ধরণের কিছুটা ঝামেলা হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই আব্দুলকে কালকের ট্রেনে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আজ ভোরের ফ্লাইট ধরেই বাগডোগরা হয়ে এখানে এলাম”।
সীমন্তিনী তার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “শুধু আমার জন্যে তুমি এত কষ্ট করে এখানে এলে”?
পরিতোষ দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “তোমার জন্যে তো আমার এ জানটাও দিয়ে দিতে পারি ডার্লিং। আর তাছাড়া, এ’ খবরটা তুমি অলরেডি পেয়ে গেছ কিনা জানিনা। তবে তোমার রচুসোনা কিন্তু এখন আর তোমার একার রচুসোনা নয়। সে আমারও রচু সোনা হয়ে উঠেছে। যেদিন ওদের আমি ডক্টর বড়ুয়ার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন থেকে রচুও আমাকে দাদা বলে ডাকছে। আর আমাকে সে নিজেই এ অধিকার দিয়েছে যে আমার ইচ্ছে হলে আমিও তাকে তোমার মত করেই রচুসোনা বলেও ডাকতে পারি। তাই যেটুকু কষ্ট আমি আজ করলাম সেটা যে শুধু তোমার একার জন্যেই করেছি, এটা ভাবলে ভুল করবে। আমি কিন্তু তোমার সাথে সাথে রচুর কথা ভেবেও এখানে এসেছি” বলেই একটু থেমে বলল, “আচ্ছা বাই দি বাই, রচুর কি অন্য আরও কোন দিদি আছে? না ইনিই” বলে অর্চনার দিকে ঈশারা করল।
সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে বলল, “রচুরা তো দু’বোনই। এই অর্চু আর ও। রচু কি তোমাকে ওর কথা আগে বলেছে নাকি”?
পরিতোষ অনেকক্ষণ অর্চনার দিকে দেখে মুখ সরিয়ে এক চুমুক কফি খেয়ে বলল, “না আগে তো আর রচুর সাথে আমার তেমনভাবে গল্প করবার সুযোগ হয়নি। সেদিন ডক্টর বড়ুয়ার বাড়িতেই কথায় কথায় এনার প্রসঙ্গ উঠেছিল। কালচিনি হাসপাতালের ডক্টর সোম তো দীপা বৌদির দাদা। কথায় কথায় এমন পরিচয় বেরিয়ে আসবার পরেই তো ডক্টর দিব্যেন্দুর ফ্যামিলির সাথে রতু আর রচুর খুব ভাব হয়ে গেছে। ডক্টর বড়ুয়ার মেয়েটা, আকাঙ্ক্ষা, বড্ড মিষ্টি মেয়ে একটা। সে তো তখন থেকেই রতু আর রচুকে নিজের মামা মামী বানিয়ে নিয়েছে”।
অর্চনার বুঝতে বাকি রইল না যে তার কালচিনি হাসপাতালে থাকবার সময়কার কথাগুলো পরিতোষের আর জানতে বাকি নেই। এ’কথা ভেবেই তার লজ্জা লাগতে লাগল। সে তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দিদিভাই, আমি একটু আসছি”।
কিন্তু সে এক পা এগিয়েই পরিতোষের কথা শুনে থেমে গেল। পরিতোষ তাকেই উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি যদি আপনাকে কোন দুঃখ দিয়ে ফেলে থাকি, তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, এতে কিন্তু আপনার দুঃখ বা লজ্জা পাবার মতো কিছু নেই। সেটা তো জাস্ট একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর সে দুর্ঘটনার জন্যেও আপনি নিজে তো দায়ী ছিলেন না। তাহলে আপনি কেন লজ্জা পাবেন” বলেই সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “ওহ, কথায় কথায় আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন আমি এত ঝামেলায় ছিলাম যে আর খবর নিতেই পারিনি। তা সেদিন কোর্ট রায় দিয়েছিল”?
____________________________
অর্চনা আর লক্ষ্মীদি সীমন্তিনীর কথা শুনে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকল। অর্চনা তখনও জানেনা যে এইমাত্র ঘরে এসে ঢোকা এ আগন্তুকই পরিতোষ। সীমন্তিনী আর নবনীতাও বুঝি আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভুলেই গিয়েছিল যে পরিতোষের সঙ্গে এভাবে হঠাৎ করে সামনা সামনি পরিচয় হলে অর্চনা লজ্জা পাবে। সীমন্তিনী লক্ষ্মী আর অর্চনার সাথে পরিতোষের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য কিছু একটা বলতে যেতেই পরিতোষ বাঁধা দিয়ে বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও মন্তি, লেট মি গেস” বলে লক্ষ্মীর দিকে হাত দেখিয়ে বলল, “ইনিইতো তোমার লক্ষ্মীদি, আর” বলে অর্চনার দিকে ভাল করে দেখতে দেখতে বলল, “এনাকে দেখে তো আমাদের রচু সোনার দিদি বলে মনে হচ্ছে। ঠিক বলেছি না”?
বলে সীমন্তিনীর দিকে চাইতেই সীমন্তিনী বলল, “একদম ঠিক বলেছ। আমাদের রচু সোনার দিদি অর্চু, মানে অর্চনা” আর লক্ষ্মীদি ইনি হলেন আমার আর নীতার পরি, পরিতোষ সান্যাল”।
পরিতোষ হাতজোড় করে দু’জনকে নমস্কার করবার আগেই অর্চনা ছুটে তাদের ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। সীমন্তিনী অর্চনার অবস্থা কল্পনা করেই নবনীতাকে ঈশারা করতে নবনীতাও ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি শিগগীর ওর জন্যে চা জল খাবার রেডি কর। আর পরি তুমি আমার সাথে এস। আমার ঘরে গিয়ে বসি”।
নিজের ঘরে ঢুকে সীমন্তিনী পরিতোষকে বলল, “পরি, এতোটা জার্নি করে এসেছ। হয়ত টায়ার্ড হয়েছ। কিন্তু এখনই তোমাকে গেস্টরুমে ঢোকাতে পারছি না। গেস্টরুমটাকে একটু ঝাড়পোঁছ করতে হবে। তুমি আপাততঃ আমার বাথরুমটাই ব্যবহার করো। হাত মুখ ধুয়ে একেবারে স্নান সেরে বেরিয়ে এস। গিজারে গরম জলও আছে। আমি ততক্ষণে অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিই যে আমি ঘন্টাখানেক পর অফিস যাচ্ছি”।
পরিতোষ সোফায় বসে নিজের ব্যাগটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, “প্যাকেটটা ভাল মত রেখেছ তো? খুলেছ”?
সীমন্তিনী বলল, “না খুলিনি, তবে ভাল মতই রেখেছি। অফিসে বেরোচ্ছিলুম বলেই সাথে সাথে খুলিনি। ভেবেছিলুম অফিস থেকে এসেই সেটা খুলব। কিন্তু ওটা তো বেশ ভারী দেখলুম। কি আছে ওতে”?
পরিতোষ হেসে বলল, “এসেই যখন পড়েছি, তখন আর ভেবো না। সময় মত জানতে পারবে” বলে নিজের ব্যাগ থেকে টাওয়েল সাবান টুথব্রাশ বের করে সীমন্তিনীর কথামতই পরিতোষ সীমন্তিনীর বাথরুমে ঢুকে গেল।
সীমন্তিনী নিজের অফিসে ফোন না করে তখনই অর্চনাদের ঘরে গিয়ে নবনীতাকে বলল, “পরিটা এভাবে হুট করে এসে পড়াতে অর্চু বেশ লজ্জা পেয়ে গেছে তাই না রে নীতা? তবে একটা কথা শোন তোরা দু’জনেই। আয় এদিকে আয়” বলে অর্চনা আর নবনীতার হাত ধরে বিছানায় বসতেই নবনীতা বলল, “পরি কি তোমাকে আগে জানিয়েছিল দিদি, যে ও আজ আসছে এখানে”?
সীমন্তিনী চাপা গলায় জবাব দিল, “আরে নারে। ওর সাথে আমার তো এ ব্যাপারে কোন কথাই হয়নি। তোরা তো দেখেছিস গত দু’দিন ধরে ওর সাথে কথা বলতে না পেরে আমি কতটা চিন্তিত ছিলুম। একটু আগেও যখন ফোন করে আমাকে বলল যে একজন লোকের হাতে ও ওই প্যাকেটটা পাঠাচ্ছে, তখনও ও বলেনি যে ও এখানে এসে গেছে। তবে কি ব্যাপারে কেন এসেছে তা আমরা ঠিকই এবার জানতে পারব। কিন্তু শোন নীতা, পরিকে এখনই অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে ও’সব নিয়ে কোন কথাই বলবি না একদম”।
নবনীতা ব্যাপারটা আন্দাজ করে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই সীমন্তিনী অর্চনাকে বলল, “অর্চু সোনা। তুই ভাবিসনে যে আমরা জেনে বুঝে কোনও প্ল্যান করে পরিকে এভাবে ডেকে এনেছি। তোকে সত্যি বলছি, পরি যে এভাবে হুট করে আমার এখানে চলে আসতে পারে, এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে ওর সাথে কথা না বলে তো বোঝা যাবে না যে ও ঠিক কী জন্যে এখানে এসেছে। তবে ও এভাবে এসে পড়াতে তুই যে খুব লজ্জা পাচ্ছিস, সেটা বুঝতেই পারছি বোন। আর সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু আমার একটা কথা ভাল করে শোন বোন। পরিকে কিন্তু আমরা এখনও তোর ব্যাপারে, মানে তোদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলিনি। আমি তো তোদের আগেই বলেছি যে পরি কটা দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছে। আমি ভেবেছিলুম ওর ব্যস্ততাটা কেটে যাবার পরেই আমরা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলব। তাই তুই যেমন জানিস যে আমরা ওর সাথে তোর বিয়ে দেবার চেষ্টা করছি, ও কিন্তু সেটা জানে না এখনও। তাই তুই এখনই ওর সামনে এত লজ্জা পেতে যাস নে। স্বাভাবিক ভাবে ওর সাথে কথাটথা বলবি। ও কেন এখানে এসেছে, আর কতক্ষণ থাকবে, এ’সব ব্যাপারে তো এখনও কিছু জানতে পারিনি। তবে যতক্ষণই থাক, তুই ওকে শুধু আমার আর মন্তির বন্ধু বলেই ভাববি। ওকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিবি না যে আমরা তোর আর ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছি। ও যতক্ষণ এখানে থাকবে, ততক্ষণ বিয়ের ব্যাপারে, মানে তোর আর ওর বিয়ের ব্যাপারে আমরা কেউ কোন কথা বলব না। অন্ততঃ আজকের দিনটা এভাবে কাটুক। পরে নাহয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব, বুঝেছিস তো? আর নীতা, আমি তো পরির সাথেই থাকব। তুই এখনই রচুকে একটা ফোন করে বলে দে যে পরি এখানে এসেছে হঠাৎ করে। তাই এখন আমাদের কারো সাথে কথা বলার সময়ে ও যেন পরি আর অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা না বলে, বুঝেছিস”?
নবনীতা মাথা নেড়ে সায় জানাতেই সীমন্তিনী উঠে পড়ে অর্চনার গালে হাত বুলিয়ে বলল, “একদম টেনশন নিস না সোনা। ওর সামনে স্বাভাবিক থাকবি, কেমন? আমি এখন ওকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসব। তোরাও আসিস। আর একদম স্বাভাবিক থাকবি সবাই”।
অর্চনাও মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়তেই সীমন্তিনী বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী সোজা রান্নাঘরে গিয়ে পরিতোষের খাবার প্রস্তুত হচ্ছে কিনা দেখে নিয়ে নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই তার অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিল যে তার অফিসে যেতে কিছুটা দেরী হবে।
খানিক বাদেই পরিতোষ পাজামা আর পাঞ্জাবী পড়ে সীমন্তিনীর ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “আমি হঠাৎ করে এসে পড়ে তোমাদের সবাইকে খুব বিব্রত করে ফেলেছি বুঝতে পারছি মন্তি ডার্লিং। কিন্তু তা সত্বেও না এসে পারলাম না। তবে ও’সব কথা পরে বলছি। তুমি অফিস যাচ্ছ তো না কি”?
পরিকে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসতে বলে সীমন্তিনী বলল, “আমি অফিসে জানিয়ে দিয়েছি যে আজ আমার অফিসে যেতে একটু দেরী হবে। আর তুমি এভাবে এসে পড়াতে আমরা কতটুকু অপ্রস্তুত হয়েছি না হয়েছি সে কথা ছেড়ে আগে বলো তো, এভাবে হুট করে চলে আসবার দরকার কি ছিল? হ্যাঁ মানছি, খুব ভাল একটা সারপ্রাইজ তুমি আমাদের দিয়েছ। কিন্তু তার কি সত্যিই কোন দরকার ছিল”?
ততক্ষণে অর্চনা আর নবনীতাও ডাইনিং টেবিলে এসে দুটো চেয়ারে বসে পড়ল। নবনীতা বেশ খুশী খুশী মুখে পরিতোষকে বলল, “হ্যাঁ পরি, বলো তো? এভাবে আমাদের সারপ্রাইজ দেবার পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা কী”?
পরিতোষকে একবার সকলের মুখের দিকে দেখে অর্চনার মুখের ওপর বেশ কয়েক মূহুর্ত চেয়ে থাকতে দেখে সীমন্তিনী বলল, “অর্চুকে দেখে হেজিটেট করছ বলতে? আমার এই অর্চু সোনাও আমাদের রচু সোনার মতই আমাদের পরম প্রিয়জন এবং আপন। ওর সামনে তুমি যে কোন কথা অনায়াসে বলতে পারো পরি। নাও খেতে খেতে কথা বলো”।
লক্ষ্মী একটা প্লেটে কয়েকটা লুচি আর তরকারির বাটি এনে পরিতোষের সামনে রেখে বলল, “নিন, স্যার। এটুকু খেয়ে নিন”?
পরিতোষ অবাক চোখে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এসব কী? লুচি তরকারি! এসব বানিয়েছেন আপনি আমার জন্যে”?
সীমন্তিনী নবনীতা আর অর্চনার সাথে লক্ষ্মীও অবাক হল পরিতোষের কথা শুনে। লক্ষ্মী আমতা আমতা করে ভয়ে ভয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, আমি তো এটাই বানালুম। তা আপনি কি এ’সব খান না”?
পরিতোষ কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে মাথা নিচু করে ফেলল। তার খুব ছোট্টবেলাকার একটা ধোঁয়াটে ছবি যেন তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। কত কত বছর পরে সে দৃশ্যটা আজ তার মনে পড়ল। তখন বোধহয় তার পাঁচ ছ’ বছর বয়স।
সীমন্তিনী পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে আস্তে করে বলল, “কি হল পরি? তুমি কি সত্যি লুচি তরকারি খাও না? আচ্ছা বেশ, লক্ষ্মীদি তুমি না হয় চট করে একটু নুডলসই বানিয়ে আন ওর জন্যে। আর এ’গুলো বরং নিয়েই যাও। আমরা সকলে তো সকালের খাওয়া তো খেয়ে নিয়েছি”।
লক্ষ্মী হতভম্বের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েও ইতস্তত করে বলল, “দিদিমণি, কারো সামনে থেকে এভাবে খাবারের থালা সরিয়ে নেওয়া যে ঠিক নয় গো”।
পরিতোষ সাথে সাথে লুচির থালাটার ওপর দুটো হাত এমন আড়াআড়ি ভাবে রাখল যে দেখে মনে হল কেউ যেন তার সামনে থেকে থালাটা ছিনিয়ে নিতে চাইছে, আর সে থালাটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। পরিতোষকে এমন করতে দেখে ঘরের বাকি সবাই একে অপরের মুখের দিকে দেখতে লাগল। সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “ঠিক আছে লক্ষ্মীদি, এটা থাক। তুমি বরং গিয়ে ওর জন্যে ভাল করে এক কাপ কফি বানিয়ে আনো”।
লক্ষ্মী তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে চলে গিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে থাকবার পর পরিতোষ নিজের পাঞ্জাবীর কোনা দিয়ে চোখ মোছবার চেষ্টা করতেই অর্চনা নবনীতা আর সীমন্তিনী সকলেই বুঝতে পারল পরিতোষ কাঁদছে। নবনীতা আর সীমন্তিনী দু’জন দু’পাশ থেকে পরিতোষের পিঠে হাত রেখে তার নাম ধরে ডাকল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে পরিতোষ নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে সকলের দিকে দেখতে দেখতে ম্লান হেসে বলল, “সরি মন্তি। আমি একটু ..... প্লীজ কিছু মনে কোর না তোমরা”।
সীমন্তিনী পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল, “এ’গুলো খেতে যদি ইচ্ছে না করে তবে থাক। তোমাকে একটু নুডলস বানিয়ে দিচ্ছি”।
পরিতোষ এবার বেশ তাড়াতাড়িই জবাব দিল, “না না। ইটস ওকে। কোন সমস্যা নেই। তা আমি একা একাই খাব নাকি? তোমরা কেউ কিছু খাবে না আমার সাথে”?
সীমন্তিনী বলল, “আমরা কিছুক্ষণ আগেই সকালের খাবার খেয়েছি পরি। তবে তোমার সাথে আমরাও সবাই একটু একটু কফি খাব। তুমি শুরু করো” বলে অর্চনার দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্চু, লক্ষ্মীদিকে বল, আমাদের সবার জন্য কফি বানাতে”।
অর্চনা রান্নাঘরে যাবার সুযোগ পেয়ে আর এক মূহুর্তও দাঁড়াল না। রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি বানাতে বানাতেও তার কান সজাগ রইল।
পরিতোষ লুচি তরকারির প্রথম গ্রাসটা মুখে দিয়েই তৃপ্তিতে চোখ বুজে ফেলল। ভাল করে চিবিয়ে আয়েশ করে গ্রাসটা গিলে নেবার পর চোখ খুলে হেসে বলল, “জানো মন্তি, আজ প্রায় চব্বিশ বছর পর কেউ আমার সামনে এভাবে লুচি তরকারির প্লেট এগিয়ে দিল। আমি তখন খুব ছোট্ট। ছোটবেলার অনেক কথাই মন থেকে হারিয়ে গেছে। মা-র স্মৃতি বলতে তো কিছুই নেই আমার। আজ এই মূহুর্তে হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার একটা কথা। তখন বোধ হয় আমি ছ’ সাত বছরের। আমার ঠাকুমা ঠিক এভাবে লুচির থালা সাজিয়ে আমার সামনে রেখেছিলেন। কথাটা গত তেইশ চব্বিশ বছরের মধ্যে আর আমার মনে আসেনি, কারনটা আমিও জানিনা। তবে সেদিনের পর এতগুলো বছরের মধ্যে আজই প্রথম কেউ আমাকে এভাবে খেতে দিল। তাই হয়ত কথাটা আমার মনে পড়ে গেল”।
অর্চনা রান্নাঘর থেকে পরিতোষের এ’কথা শুনতেই তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তার মনটা যেন বলে উঠল ‘আহারে বেচারা’। আর সীমন্তিনী পরিবেশটা হাল্কা করবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “আচ্ছা, এবার খেতে খেতে হঠাৎ তোমার এমন আগমনের কারনটা কী বলো তো” বলেই রান্নাঘরের দিকে মুখ তুলে বলল, “লক্ষ্মীদি আর লুচি আছে? থাকলে আরও দুটো নিয়ে এস”।
লক্ষ্মী রান্নাঘর থেকেই সাড়া দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি আছে, আনছি”।
পরিতোষ সীমন্তিনীর কথার জবাবে বলল, “প্লীজ মন্তি ডার্লিং। এভাবে আমার মনের সুখটা নষ্ট করে ফেলো না প্লীজ। আগে তৃপ্তি করে খেতে দাও। লুচিগুলো খেয়ে নিই। তারপর কফি খেতে খেতেই না হয় সেটা বলি”।
কেউ আর কোনও কথা বলল না। লক্ষ্মী আরও দু’খানা লুচি পরিতোষের থালায় দিল। পরিতোষ সে’দুটোও খেয়ে নিল। অর্চনা ট্রেতে করে চার কাপ কফি এনে সবাইকে দিয়ে নিজেও একটা কাপ নিয়ে একটা চেয়ারে বসল। পরিতোষ কফির কাপে প্রথম চুমুক দিয়েই সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি অফিসে যাচ্ছ তো”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “হ্যাঁ যেতে তো হবেই। কিন্তু একটু আগেই যে ওই আব্দুর রহমান নামে লোকটা এসে ওই প্যাকেটটা দিয়ে গেল, সেটা কি তার হাত দিয়ে তুমিই পাঠিয়েছিলে? প্যাকেটটা তো বেশ ভারী। কী আছে ওতে? আর তুমি নিজেই যখন এলে তবে তার হাত দিয়ে সেটা পাঠাবার কি দরকার ছিল”?
পরিতোষ খেতে খেতেই বলল, “আব্দুর রহমান ওর আসল নাম নয় মন্তি। ওর আসল নাম হচ্ছে আব্দুল। আব্দুল করিম শেখ। ক’দিন আগে একদিন রাতে তোমাকে বলেছিলাম না? প্রীতিদির বাড়িতে ডিনার করেছি। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘প্রীতিদি কে’। আমি বলেছিলাম ‘পরে বলব’। মনে আছে? ওই প্রীতিদি এই আব্দুলের স্ত্রী। আমাকে নিজের ভাইয়ের মত স্নেহ করেন। আমাকে ভাই ফোঁটা দেন। আব্দুলও আমার খুব বিশ্বস্ত। ওর ওপর যে কোন কাজের ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। কলকাতাতেই থাকে। আমি তিনদিন যাবৎ কলকাতার বাইরে ছিলাম, তমলুকে। কিন্তু এই জিনিসটা পরশুদিনই আব্দুলের কাছে এসে পড়েছিল। তাই কলকাতা থেকে আব্দুলকেই পাঠাতে বাধ্য হয়েছি প্যাকেটটা তোমার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। আমি আজ ভোরে তমলুক থেকে কলকাতা এসে সোজা দমদম চলে গিয়েছিলাম। তারপর সকালের প্রথম ফ্লাইট ধরেই বাগডোগরা চলে এসেছি। তাই আমার পক্ষে প্যাকেটটা আনা সম্ভব হয়নি। আর.... ওই প্যাকেটটার ভেতর চল্লিশ লক্ষ টাকা আছে। তুমি বলেছিলে না যে রচুর বাপের বাড়িতে ঘর বানাতে তোমার টাকা লাগবে। এটাই সেই টাকা”।
পরিতোষের কথা শুনে তিনজনেই চোখ বড়বড় করে চাপা চিৎকার করে উঠল। সীমন্তিনী বলল, “এভাবে এতগুলো টাকা এখানে পাঠাবার কী দরকার ছিল পরি? রাস্তা ঘাটে কত কিছুই তো হয়ে যেতে পারত। তুমি তো ব্যাঙ্ক ড্রাফট করেই পাঠিয়ে দিতে পারতে”।
পরিতোষ বলল, “তা হয়ত পারতাম। কিন্তু তাতে কিছু রিস্ক থেকে যেত। কেউ না কেউ জেনে ফেলত। তাছাড়া ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলাও আছে এতে। তাই আগে থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম যে আমি নিজেই টাকাটা নিয়ে আসব। কিন্তু অফিসের কাজে আমাকে ষোল তারিখে ইস্ট মেদিনীপুর যেতে হয়েছিল। সতের তারিখ বিকেলে টাকাটা আমাদের হাতে এলেও আমি তখন তমলুকে। তাই আব্দুলকে দিয়েই এ টাকাটা পাঠাতে হল। আব্দুল আমার খুব বিশ্বস্ত। ওকে নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না আমার। কিন্তু এ টাকাটা তুমি হাতে পেলে কী করবে না করবে, সেটা ভেবেই আমি নিজেও চলে এসেছি। তুমি হয়ত অতটা তলিয়ে না ভেবেই টাকাটা নিয়ে ব্যাঙ্কে চলে যেতে কোনও একাউন্টে জমা দিতে। আর তাতেও একই ধরণের কিছুটা ঝামেলা হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই আব্দুলকে কালকের ট্রেনে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আজ ভোরের ফ্লাইট ধরেই বাগডোগরা হয়ে এখানে এলাম”।
সীমন্তিনী তার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “শুধু আমার জন্যে তুমি এত কষ্ট করে এখানে এলে”?
পরিতোষ দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “তোমার জন্যে তো আমার এ জানটাও দিয়ে দিতে পারি ডার্লিং। আর তাছাড়া, এ’ খবরটা তুমি অলরেডি পেয়ে গেছ কিনা জানিনা। তবে তোমার রচুসোনা কিন্তু এখন আর তোমার একার রচুসোনা নয়। সে আমারও রচু সোনা হয়ে উঠেছে। যেদিন ওদের আমি ডক্টর বড়ুয়ার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন থেকে রচুও আমাকে দাদা বলে ডাকছে। আর আমাকে সে নিজেই এ অধিকার দিয়েছে যে আমার ইচ্ছে হলে আমিও তাকে তোমার মত করেই রচুসোনা বলেও ডাকতে পারি। তাই যেটুকু কষ্ট আমি আজ করলাম সেটা যে শুধু তোমার একার জন্যেই করেছি, এটা ভাবলে ভুল করবে। আমি কিন্তু তোমার সাথে সাথে রচুর কথা ভেবেও এখানে এসেছি” বলেই একটু থেমে বলল, “আচ্ছা বাই দি বাই, রচুর কি অন্য আরও কোন দিদি আছে? না ইনিই” বলে অর্চনার দিকে ঈশারা করল।
সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে বলল, “রচুরা তো দু’বোনই। এই অর্চু আর ও। রচু কি তোমাকে ওর কথা আগে বলেছে নাকি”?
পরিতোষ অনেকক্ষণ অর্চনার দিকে দেখে মুখ সরিয়ে এক চুমুক কফি খেয়ে বলল, “না আগে তো আর রচুর সাথে আমার তেমনভাবে গল্প করবার সুযোগ হয়নি। সেদিন ডক্টর বড়ুয়ার বাড়িতেই কথায় কথায় এনার প্রসঙ্গ উঠেছিল। কালচিনি হাসপাতালের ডক্টর সোম তো দীপা বৌদির দাদা। কথায় কথায় এমন পরিচয় বেরিয়ে আসবার পরেই তো ডক্টর দিব্যেন্দুর ফ্যামিলির সাথে রতু আর রচুর খুব ভাব হয়ে গেছে। ডক্টর বড়ুয়ার মেয়েটা, আকাঙ্ক্ষা, বড্ড মিষ্টি মেয়ে একটা। সে তো তখন থেকেই রতু আর রচুকে নিজের মামা মামী বানিয়ে নিয়েছে”।
অর্চনার বুঝতে বাকি রইল না যে তার কালচিনি হাসপাতালে থাকবার সময়কার কথাগুলো পরিতোষের আর জানতে বাকি নেই। এ’কথা ভেবেই তার লজ্জা লাগতে লাগল। সে তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দিদিভাই, আমি একটু আসছি”।
কিন্তু সে এক পা এগিয়েই পরিতোষের কথা শুনে থেমে গেল। পরিতোষ তাকেই উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি যদি আপনাকে কোন দুঃখ দিয়ে ফেলে থাকি, তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, এতে কিন্তু আপনার দুঃখ বা লজ্জা পাবার মতো কিছু নেই। সেটা তো জাস্ট একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর সে দুর্ঘটনার জন্যেও আপনি নিজে তো দায়ী ছিলেন না। তাহলে আপনি কেন লজ্জা পাবেন” বলেই সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “ওহ, কথায় কথায় আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন আমি এত ঝামেলায় ছিলাম যে আর খবর নিতেই পারিনি। তা সেদিন কোর্ট রায় দিয়েছিল”?
____________________________