Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 206)

সকাল প্রায় ছ’টা নাগাদ সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতাকে সাথে নিয়ে এনজেপি ষ্টেশনের প্লাটফর্মে নামতেই অবাক হয়ে দেখল সতীশ বেশ কিছুটা দুরে ট্রেনের কামড়া গুলোয় উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছে। নবনীতা আর অর্চনাকে থামিয়ে দিয়ে সে চিৎকার করে ‘সতু, এই যে এদিকে’ বলতেই সতীশ তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে তাদের কাছে এসে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী তার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “অর্চু, নীতা, দ্যাখ। এ হচ্ছে আমার ভাই সতু। আর সতু এ হচ্ছে অর্চনা, আমার অর্চু সোনা, তোর বৌদিভাইয়ের দিদি, আর এ হচ্ছে আমার আরেকটা বোন নীতা, মানে নবনীতা”।

সতীশ নিচু হয়ে সীমন্তিনীকে প্রণাম করে অর্চনার পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই অর্চনা আর নবনীতা দু’জনেই লাফ দিয়ে দু’পা পেছনে সরে গিয়ে না না বলে উঠল। সীমন্তিনী হেসে সতীশের হাত ধরে বলল, “আচ্ছা সতু, থাক। ওদের প্রণাম করে আর অস্বস্তিতে ফেলিস না। তা হ্যাঁরে, বড়মা এখন কেমন আছেন? তার শরীর ঠিক আছে তো”?

সতীশ সীমন্তিনীর হাত থেকে তাদের ব্যাগটা নিয়ে বলল, “হ্যাঁ বড়দি, মা তো কাল তোর ফোন পাবার পর থেকেই একদম স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। আধঘণ্টা আগে আমি যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিলুম তখন তো মাকে দেখলাম তোদের জন্য পায়েস রান্না করছেন” বলেই হেসে ফেলল। তারপর বলল, “আচ্ছা চল চল, আর দেরী না করে আমরা বরং গাড়িতে যেতে যেতেই কথা বলব”।

সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতাকে সাথে নিয়ে সতীশের পেছন পেছন যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, “তুই গাড়ি নিয়ে এসেছিস নাকি”?

সতীশ হেসে বলল, “না এনে আর উপায় ছিল? তুই আসছিস, এ’কথা শুনেই বাড়িতে তো হুলুস্থুল পড়ে গেছে রে। ছোটকাকু তো এ’কথা শুনেই রাতেই ফোন করে গাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিলেন। আর সবচেয়ে কে বেশী লাফালাফি করছে জানিস? অনুমান কর তো? দেখি তোর অনুমান ঠিক হয় কিনা”।
 

সীমন্তিনী কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “কাকু আর বড়মাই নিশ্চয়ই”।

সতীশ বলল, “নারে বড়দি, পারলি না। হ্যাঁ মা আর কাকু তো যথেষ্টই খুশী। তবে তাদের চেয়েও আনন্দে বেশী লাফালাফি করছে আমাদের পুচকিটা”।

সীমন্তিনী হাঁটতে হাঁটতে থেমে গিয়ে অবাক হয়ে বলল, “কী বলছিস তুই সতু? চন্দু”?

সতীশ হেসে বলল, “হ্যাঁরে দিদি চন্দু। ওর খুশী দেখে বাড়ির সব্বাইও তোর মতই অবাক হয়ে গেছে। দাদা আর বৌদিভাই কলকাতা চলে যাবার পর থেকে গত তিন মাসে আমরা কেউ ওকে হাসতে দেখিনি। কাল তুই মা-র সাথে কথা বলবার পর বাড়ির সবাই যখন জানতে পারল যে তুই আসছিস। তখনই ও এসে আমার ফোন থেকে বৌদিভাইকে ফোন করবার জন্য বায়না ধরল। তুই তো জানিসই যে তুই ওকে বৌদিভাইয়ের সাথে কথা বলতে বারণ করবার পর থেকে ওকে কেউ বাড়ির ফোনে হাত দিতে দেয় না। আর ও-ও প্রথমদিকে খুব কান্নাকাটি করলেও পরে নিজেই যেন হাসিমুখে সে নিয়মটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তুই আসছিস শুনেই বুঝি ও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। কিন্তু তাও দ্যাখ, বড়দের কথা অমান্য করে ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করতে যায়নি। আমার কাছে এসে বায়না করেছিল। তখন আমিই বৌদিভাইয়ের নাম্বার ডায়াল করে ওকে কথা বলতে দিয়েছিলুম। বৌদিভাই তো ওর মুখেই তোর এখানে আসবার খবর শুনেছে। আর তার পর থেকেই কাল যতক্ষণ জেগেছিল ততক্ষণ এক নাগাড়ে ছুটোছুটি লাফালাফি করে গেছে। অন্যান্য দিন তো সন্ধ্যের পর থেকে ওকে পড়বার টেবিল থেকে কেউ ডেকেও তুলতে পারে না। কাল বোধহয় মাত্র ঘন্টাখানেকই পড়ার টেবিলে বসেছিল ও। আর আরও আশ্চর্য ব্যাপার কি জানিস? আমি যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিলুম, তখন মা রান্নাঘরে। মাকে বলতে গিয়ে দেখি ও মা-র সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তার পায়েস বানানো দেখছে। ও তো আমার সাথেই আসতে চাইছিল। কিন্তু মা-ই ওকে বোঝালেন যে তোরা তিনজন আসছিস। আমি থাকব, তাই গাড়িতে বসবার জায়গা কম পড়ে যাবে। আর সেটা শুনেই ও বেশ শান্ত ভাবেই মেনে নিল ব্যাপারটা”।
 

সতীশের মুখে চন্দ্রিকার কথা শুনেই সীমন্তিনীর চোখদুটোয় জল এসে গিয়েছিল। কথায় কথায় ষ্টেশনের বাইরে এসে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েই সীমন্তিনী সতীশকে বলল, “সতু, আমার খুব খারাপ লাগছে রে। চন্দু আর চঞ্চুর জন্য কিছু একটা নিয়ে আসতে পারলে ভাল হত। কিন্তু কাল রাতে তো এভাবে আসবার কথাটা প্রায় হুট করেই ঠিক করে ফেলেছি। হাতে সময়ও ছিল না। ভেবেছিলুম শিলিগুড়ি থেকেই কিছু একটা কিনে নিয়ে যাব ওদের জন্যে। কিন্তু এত সকালে কি সত্যি এখানে কোন দোকান পাট খোলা পাবো রে ভাই”?

সতীশ সীমন্তিনীদের ব্যাগটা গাড়ির ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “নারে বড়দি, এত সকালে কোন দোকানই খোলা পাওয়া যাবে নারে। তুই বরং বেলা বাড়লে রাজগঞ্জ থেকেই ওদের কিছু কিনে দিস। এছাড়া তো আর উপায় নেই। আচ্ছা, এবার তোরা গাড়িতে উঠে পর। আপনারাও আসুন প্লীজ” বলে নবনীতা আর অর্চনাকে গাড়িতে ওঠবার ঈশারা করল।

গাড়িতে যেতে যেতে সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতাকে দু’পাশের নানা জিনিষ দেখাতে দেখাতে এটা ওটা বলে যাচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টা বাদে দুর থেকে বাড়ির দিকে ঈশারা করে সতীশ বলল, “ওই দ্যাখ বড়দি”।

সীমন্তিনী সতীশের ঈশারা মত তাকিয়ে দেখে তারা প্রায় তাদের বাড়ি পৌঁছে গেছে। আর বাড়ির মেন গেটের সামনে এগারো বছরের টুকটুকে চন্দ্রিকা দাঁড়িয়ে রাস্তার এদিকেই তাকিয়ে আছে। প্রথমদিকে ও হয়ত গাড়িটাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু বাড়ির গেটের কাছে গাড়ি স্লো হয়ে যেতেই ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বাড়ির ভেতরদিকে মুখ করে চেঁচিয়ে বলল, “এসে গেছে গো বড়মা। বড়দি এসে গেছেন”।
 

সীমন্তিনীই সকলের আগে গাড়ির দড়জা খুলে নেমে পড়ল। কিন্তু এক পা এগিয়ে যাবার আগেই চন্দ্রিকা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনীও চন্দ্রিকাকে দু’হাতে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে চিনতে পেরেছিস তুই সোনা”?

“কেন চিনব না বড়দি। বড়দার বিয়ের সময় তো তোমাকে দেখেছি আমি। আর বড় বৌমণি তো সব সময় তোমার কথা বলেন। তুমিই তাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাস, এ’কথা বড় বৌমণি আমাকে সব সময় বলেন” চন্দ্রিকাও দু’হাতে সীমন্তিনীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেই জবাব দিল।
 

সীমন্তিনী অনেক প্রযত্ন করেও নিজের চোখের জল আটকাতে পারল না। চন্দ্রিকাকে শক্ত করে নিজের বুকে চেপে ধরে ধরে সে ফুঁপিয়ে উঠল। সতীশ ততক্ষণে নবনীতা আর অর্চনাকে অন্য পাশের দড়জা খুলে নামিয়ে এনেছে। আর নিজেও সীমন্তিনীদের ব্যাগটা গাড়ি থেকে বের করে নিয়েছে। নবনীতা আর অর্চনা সীমন্তিনীর কাছে এসে তাকে কাঁদতে দেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে চন্দ্রিকাকে তার হাতের বাঁধন থেকে আলগা করে দিতেই চন্দ্রিকা সীমন্তিনীর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমি কেঁদো না বড়দি। বৌমণি যদি জানতে পারেন যে তুমি এখানে এসে কেঁদেছ, তাহলে আমাকে খুব বকবেন”।

সীমন্তিনী চন্দ্রিকার কথা শুনে আরেকবার তাকে বুকে চেপে ধরে তার দু’গালে চুমু খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমার মিষ্টি ছোট্ট বোন তুই। আচ্ছা চন্দু সোনা, এই দ্যাখ, আমার সাথে আরও দুটো দিদি এসেছে। এ হচ্ছে নবনীতা মানে আমার আরেকটা বোন। তুই ওকে নীতাদি বলে ডাকবি। আর ইনি কে বল তো”?

চন্দ্রিকা মুগ্ধ দৃষ্টিতে অর্চনার দিকে দেখতে দেখতে বলল, “জানি বড়দি। বড়মা আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন যে তোমার সাথে আমার বৌমণির বড়দিদি আর আরও একটা দিদি আসবেন। তাই ইনিই আমাদের বৌমণির দিদি হবেন”।

সীমন্তিনী কিছু বলবার আগেই অর্চনাও চন্দ্রিকাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “ঠিক বলেছ সোনা। আমি তোমার বৌমণির দিদিই। তুমিও আমাকে দিদি বলে ডাকবে কেমন”?
 

চন্দ্রিকা হঠাৎ নিচু হয়ে অর্চনাকে প্রণাম করতে যেতেই অর্চনা তার হাত ধরে বলল, “না বোন, তোমাকে কাউকে প্রণাম করতে হবে না। আমরা এমনিই তোমাকে আশীর্বাদ করছি। তুমি খুব বড় হও, খুব সুখী হও”।

নবনীতাও অর্চনাকে কাছে টেনে বলল, “এই ছোট্ট মিষ্টি সোনাটার কি এই এই দিদিটাকে পছন্দ হল না”?

চন্দ্রিকাও নবনীতাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “এমা এ কী বলছ দিদি? বৌমণি আমাকে বলেছেন, তুমিও তাকে খুব ভালবাস। আর আমার বৌমণিকে যে ভালবাসে, তাকে আমিও ভালবাসি। তাহলে তোমাকে আমি পছন্দ করব না কেন”।

সতীশ এবার হেসে বলল, “বুঝেছিস তো বড়দি? ওর কাছে ওর বৌমণির কথাই শেষ কথা। ওর বৌমণি যদি বলে যে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে, ও-ও সেটাই সত্যি বলে ধরবে”।

চন্দ্রিকা একটু রাগত চোখে সতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, “মেজদা ভাল হবেনা বলছি। বৌমণির নামে একদম আজেবাজে কথা বলবে না কিন্তু। আমার বৌমণি তোমার মত অমন ভুলভাল কথা বলেন না। তিনি যা বলেন, তা একেবারে সত্যি বলেন। সে তোমার মত মিথ্যে কথাও বলেন না আর তোমার মত কারো পেছনেও লাগেন না, বুঝেছ”?

সতীশ হেসে চন্দ্রিকার মাথায় হাল্কা করে চাটি মেরে বলল, “তোর বৌমণি যখন শুনতে পাবে যে তুই তার দিদিকে এতক্ষণ বাড়ির বাইরেই আটকে রেখেছিস, তখন কী হবে ভেবে দেখেছিস”?

চন্দ্রিকা সাথে সাথে অর্চনা আর সীমন্তিনীর দুটো হাত ধরে বলল, “হ্যাঁগো, মেজদা ঠিক বলেছে। চলো চলো তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে চলো তোমরা। নীতাদি তুমিও এসো। আমার তো দুটোই হাত। তাই তোমার হাতটা ধরতে পারলুম না বলে আমার ওপর রাগ কোর না গো। এসো”।
 

সরলাদেবী, সীমাদেবী আর চন্দ্রাদেবী বাড়ির ভেতরে গেটের আড়ালে থেকেই সীমন্তিনীদের তিনজনকে দেখে যাচ্ছিলেন। চন্দু সবাইকে নিয়ে গেটের দিকে হাঁটতেই সীমাদেবী নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে অন্য দুই জায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সরলাদেবী ‘মন্তি মা আমার’ বলেই সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চন্দ্রাদেবী নবনীতার হাত ধরে হাসিমুখে বললেন, “তুমি তো নবনীতা, তাই না? এসো এসো মা”।

আর সীমাদেবী অর্চনার হাত ধরে মিষ্টি হেসে বললেন, “তুমি যে আমাদের বৌমার বোন, সে পরিচয় কেউ না দিলেও আমাদের চিনতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। এসো মা”।

সীমন্তিনী আর সরলাদেবী দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছিল সমানে। তাদের দু’জনকে দেখে সতীশের চোখেও জল চলে আসছিল। সে তাই বসবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “তোমরা উঠোনে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে গিয়ে বোস। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি”।
 

চন্দ্রিকা নবনীতা আর অর্চনার হাত ধরে বসবার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই সামনে চঞ্চলকে দেখতে পেয়ে বলল, “অর্চুদি, নীতাদি, এই যে দ্যাখ, এ আমাদের ছোড়দা”।
 

চঞ্চল এগিয়ে এসে নবনীতার পায়ের দিকে ঝুঁকতেই নবনীতা তার হাত ধরে বলল, “না না ভাই, প্রণাম করতে হবে না”।
 

চঞ্চল অর্চনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেজমা একদম ঠিক কথাই বলেছেন। তুমি যে আমাদের বৌমনির দিদি, সেটা তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। আমি চঞ্চল”।

অর্চনা চঞ্চলের হাত ধরে বলল, “তুমিও আমার মিষ্টি ছোট ভাই। তা ভাই বাড়ির আর সব কোথায়? ভেতরে না কি”?

চঞ্চল বলল, “আমরা তো ছ’ভাই বোন। বড়দা কলকাতায়, বড়দি নাগরাকাটায় আর সেজদা ভুবনেশ্বরে। তাই বাড়িতে এখন শুধু আমরা তিন ভাই বোন। মেজদা, চন্দু আর আমি। আর বাবা বড়জেঠু ছোটজেঠু সবাই এ ঘরে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন, এসো, ভেতরে এসো”।

চঞ্চলের পেছন পেছন চন্দ্রিকার হাত ধরে নবনীতা আর অর্চনা বসবার ঘরের ভেতরে ঢুকতেই বাড়ির তিন কর্তাকে দেখতে পেল। নবনীতাদের দেখে ঘরের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এসো, এসো মা তোমরা। আজ আমাদের সত্যিই বড় খুশীর দিন”।

চন্দ্রিকা সকলের সাথে নবনীতা আর অর্চনার পরিচয় করে দিতে নবনীতা আর অর্চু দু’জনেই তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। কর্তারা তিনজনই তাদের আশীর্বাদ করে সোফায় বসতে বললেন। নবনীতা আর অর্চনা চঞ্চল আর চন্দ্রিকাকে সাথে নিয়ে সোফায় বসল।

রতিকান্তবাবু অর্চনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের বাড়ির সকলে ভাল আছেন তো মা? বেয়াই তো শুনেছি, এখন আর যজমানি করেন না। তার শরীর স্বাস্থ্য ভাল আছে তো”?

অর্চনা বলল, “হ্যাঁ মেসোমশাই, বাবা ভাল আছেন। আর অন্য সবাইও ভাল আছেন। বাবা এখন বাড়ির সামনেই একটা দোকান করেছেন”।

রতিকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা, সে খবর আমরা শুনেছি। ভালই হয়েছে। এ বয়সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে যজমানি করতে কষ্ট তো কম হবে না। দোকানটা শুরু করে ভালই করেছেন তিনি। তোমাদের ভাইটা কী পড়ছে এখন”?

অর্চনা বলল, “ও তো এবার হায়ার সেকেন্ডারি ফাইনাল দেবে মেসো’।

এবার শশীকান্তবাবু নবনীতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মা তুমি তো শুনেছি কলকাতার মেয়ে। আমাদের বৌমা আর রতুর সাথে তোমার পরিচয় আছে নিশ্চয়ই”?

নবনীতা জবাব দিল, “হ্যাঁ কাকু, রতুদা আর বৌদির সাথে আমার পরিচয় আগেই হয়েছে। আর সত্যি কথা বলতে গেলে বৌদির সাথে পরিচয় না হলে হয়ত আজ আর আপনাদের বাড়ি আসা হয়েই উঠত না”।

এমন সময় সরলাদেবী সীমন্তিনীকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাড়ির তিন কর্তার উদ্দেশ্যে বললেন, “শোনো, তোমাদের সকলের খাবার দেওয়া হচ্ছে টেবিলে। তোমরা গিয়ে খেয়ে নাও। আর আজ তো তোমরা দুপুরেই ফিরে আসবে। তখন এদের সকলের সাথে জমিয়ে গল্প করতে পারবে। তবে মন্তি কী বলছে শোনো। ওরা নাকি কাল সকালেই ফিরে যাবে বলছে”।

চন্দ্রকান্তবাবু অবাক হয়ে সীমন্তিনীকে বললেন, “সেকি রে মা? এতদিন বাদে এলি। দুটো দিনও থাকবি না”?

সীমন্তিনী তার জেঠু বাবা ও কাকুকে প্রণাম করে বলল, “না গো কাকু, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমি তো আগে থেকে প্ল্যান করে আসতে পারিনি। কাল রাতেই হুট করে আসবার সিদ্ধান্তটা নিয়েই চলে এসেছি। অফিস থেকে যে দু’একদিনের ছুটি নিয়ে আসব সেটা সম্ভব হল না। আর আগামীকাল আবার অর্চুর কেসের হিয়ারিং আছে। ওকে নিয়ে আমার আলিপুরদুয়ার কোর্টে হাজিরা দিতে হবে সকাল এগারোটায়। তাই আজই বিকেলের দিকে চলে যেতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু একটা রাত না থাকলে তো যে উদ্দেশ্যে এসেছি, সে কাজটাই করতে পারব না, তাই আজ সন্ধ্যেয় তোমাদের সাথে বসে আলোচনাটা সেরে নিয়ে, কাল ভোর ভোরই চলে যেতে হবে গো আমাদের। তাতেও আমাদের সমস্যা হতে পারে। কখন কোয়ার্টারে গিয়ে পৌঁছব কে জানে। হয়ত এমনও হতে পারে যে এখান থেকে সরাসরি আলিপুরদুয়ারই চলে যেতে হবে। কারন এমনও হতে পারে যে নাগরাকাটা হয়ে ঘুরে গেলে দেরী হয়ে যাবে। কোর্টে তো ঠিক সময় পৌঁছতেই হবে। তাই বুঝতেই পারছ, ইচ্ছে থাকলেও আর থাকবার উপায় নেই”।

এবার রতিকান্তবাবু বললেন, “এতদিন পর এলি। দুটো দিন না থেকেই চলে যাবি মা”?

সীমন্তিনী রতিকান্তবাবুর পাশে বসে বলল, “যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি, সেটা যদি সফল হয় তাহলে নভেম্বর মাসেই আবার আমাদের সবাইকে আসতে হবে, আর তার আগেও হয়ত আমাকে কয়েকবার আসতে হবে। তখন তো থাকতেই হবে জেঠু”।

রতিকান্তবাবু বললেন, “সে’সব তো পরের কথা রে মা। আর যে উদ্দেশ্যে এসেছিস সে ব্যাপারে আর বলার বেশী কি আছে? অর্চনা কি আমাদের পর? রাহুর ফেরে ছিল বলেই এতদিন আমরা ওকে দেখতে পাইনি, সে’কথা ঠিক। কিন্তু ও-ও তো আমাদের একটা মেয়েই রে। তাই ও’ ব্যাপারে আর লম্বা আলোচনার কি আছে। বাড়ির মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, বাবা কাকা মেসো হিসেবে আমরা বিয়েটা দেব। এটাই তো মোদ্দা আর একমাত্র কথা। ও বাড়িতে যখন অসুবিধে আছে তাহলে এখান থেকেই বিয়েটা হবে। ও নিয়ে তুই কিচ্ছু ভাবিস নে। তোরা কে কবে এখানে আসবি, মেয়েপক্ষের কতজন এখানে আসবি, বিয়ের সময় বরযাত্রী কতজন আসছে, এ’সব জানিয়ে দিলেই আমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলব। আর বিয়ের কেনাকাটা তো তোরা মেয়েরাই করবি জানি। তবু আমাদের যদি কিছু করতে হয় সেটা সময়ে সময়ে ফোনে জানিয়ে দিলেই হবে। বিয়ের আয়োজন তো বাড়িতেই করব। পেছনে যতটা জায়গা তাতে দুটো বিয়ের প্যান্ডাল হয়ে যাবে। ডেকোরেটার ডেকে ওদের বুঝিয়ে দেব কোথায় কী হবে। বাকি কাজ তো তারাই করবে। এছাড়া আমাদের আর কাজ কি আছে। আমরা তো মেয়ের বাড়ির লোকজন হিসেবেই সমস্ত কাজ করব, অতিথিদের আদর অভ্যর্থনা করব, এই তো? নাকি এর বাইরেও আরও কিছু করবার আছে আমাদের”?

রতিকান্তবাবুর কথা শুনে সীমন্তিনীর মুখের কথা যেন হারিয়ে গেল। সে তো মনে মনে ভেবেছিল যে সবাইকে এ ব্যাপারে রাজী করাতে তাকে অনেক কথা খরচ করতে হবে। কিন্তু তার জেঠু তো এক কথাতেই সবটা সেরে ফেললেন। আনন্দে আর খুশীতে তার চোখের পাতা ভিজে গেল। রতিকান্তবাবুর কথার পরিপ্রেক্ষিতে তার যে ওই মূহুর্তে কী বলা উচিৎ, তা যেন সে বুঝতেই পারছিল না।

রতিকান্তবাবুর কথা ফুরোতেই হঠাৎ সীমাদেবী সে ঘরে এসে ঢুকলেন। তিনি সরাসরি অর্চনার কাছে এসে তার হাত ধরে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বললেন, “একটু ওঠো তো মা”।

অর্চনাও রতিকান্তবাবুর কথা শুনে যার পর নাই অবাক হয়েছিল। তাই সে সীমাদেবীর কথার অর্থ কিছু বুঝতে না পেরেই উঠে দাঁড়াল। সীমাদেবী অর্চনার গলায় একটা সোনার হার পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “আমাদের এই মেয়েটাকে আজ আমরা প্রথম দেখতে পেলুম বলে এটা আমাদের তরফ থেকে তোমার জন্য একটা ছোট্ট উপহার মা”।

অর্চনা চমকে উঠে বলল, “এমা এ কী বলছেন আপনি”?

সীমাদেবী হারটা অর্চনার গলায় পড়িয়ে দিতে দিতেই বললেন, “বারে এতে অবাক হবার কি আছে মা? তুমি তো আমাদের একটা মেয়েই। রচু এ বাড়ির বৌ হওয়া সত্বেও আমাদের সকলের কাছে মেয়ে উঠেছে। তুমি তো সেই রচুরই বোন। তাহলে তুমিও কি আমাদের মেয়েই হলে না? অবশ্য ভাগ্যের পরিহাসে আমরা তোমার এই তিন মা তোমাকে আগে কখনও দেখতে পাইনি। প্রথমবার এমন মিষ্টি মেয়েটাকে দেখে একটা উপহার না দিলে কি চলে, বলো”?


____________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 25-03-2020, 11:36 AM



Users browsing this thread: 10 Guest(s)