25-03-2020, 11:35 AM
(Update No. 205)
ও’দিক থেকে ছোটমা আর সতীশের কথা শোনা গেল। তারা সরলাদেবীকে ফোনে কথা বলবার অনুরোধ করছে। আর একটা কান্নার আওয়াজও যেন শোনা যাচ্ছে। প্রায় মিনিট খানেক কেটে যাবার পর সরলা দেবীর গলা শোনা গেল। তিনি কাউকে বলছেন, ‘কোন মুখে আমি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলব বল? ভর সন্ধ্যেবেলায় মেয়েটার মনে আমি কত আঘাতই না দিয়েছি। এখন ....’। এবার আরেক মহিলার গলা শোনা গেল, “তোমার ওই মেয়েই যে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে গো বড়দি। বৌমা নিশ্চয়ই তাকে ফোন করে জানিয়েছে যে তুমি এদিকে কান্নাকাটি করছ। আর মেয়েটাও সে কথা শুনে নাজানি কত দুশ্চিন্তায় আছে। একটুখানি কথা বলোনা বড়দি। নইলে ওই মেয়েটাও যে আজ সারা রাত না ঘুমিয়ে কেঁদে কেটেই কাটাবে গো। লক্ষ্মী দিদি আমার, একবার শুধু তার সাথে একটু কথা বলো’। সীমন্তিনী তার কাকী চন্দ্রাদেবীর গলা চিনতে পারল। সরলা দেবী কিছুতেই ফোন ধরতে চাইছেন না। আর সতীশ ও চন্দ্রাদেবী দু’জনেই নানা ভাবে সরলাদেবীকে ফোনে কথা বলাবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কাটবার পর সরলাদেবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করে দে মন্তি। আমি তোকে ওভাবে বলে খুব অন্যায় করেছি রে”।
সীমন্তিনী নিজের মনকে শক্ত রেখে বলল, “বড়মা, কেন তুমি এমন কথা বলছ বলো তো? তুমি আমাকে এমন কী বলেছ? আমি তো তোমার কথায় কোন কষ্ট পাইনি। কেন ক্ষমা চাইছ তুমি আমার কাছে”?
সরলাদেবী কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “আমার যে তখন কোন ভীমরতিতে ধরেছিল কে জানে। প্রায় এক যুগ ধরে যে মেয়েটা আমাদের বাড়িছাড়া হয়েও আমার মনের সব ইচ্ছে পূরণ করে যাচ্ছে, তাকে অমন কথা বলতে আমার জিভটা খসে পড়ল না কেন... হা ভগবান। কেন আমাকে দিয়ে এতবড় পাপটা তুমি করালে ঠাকুর”।
সীমন্তিনী এবার দুষ্টুমি ভরা গলায় বলল, “ও’কথা ছাড়ো তো বড়মা। গাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে কি না সেটা বলো তো শুনি”।
সরলাদেবীর কান্নাটা যেন এক মূহুর্তের জন্য থেমে গেল। কিন্তু পরমূহুর্তেই আবার ছোট মেয়ের মত কেঁদে কেঁদে বললেন, “কিসের গাড়ি? কার গাড়ির কথা বলছিস তুই”?
সীমন্তিনী আগের মতই দুষ্টুমি করে বলল, “ওমা সেকি গো? তুমি এখনও জানো না? এখনও এ খবরটা কেউ তোমাকে দেয়নি”?
এবার সরলাদেবীর গলায় আর কান্নার সুর নেই। তিনি বললেন, “কিসের কথা বলছিস তুই? কে কোন গাড়ির খবর দেবে আমাকে”?
সীমন্তিনী বলল, “বারে! কি বলছ তুমি বড়মা! জেঠু যে আজ জলপাইগুড়ি গিয়ে বাড়ির জন্য একটা ইয়া বড় গাড়ি কিনে এনেছেন, সে খবর তুমি এখনও পাও নি”?
সরলাদেবী সীমন্তিনীর কথাগুলোই আউরে বললেন, “তোর জেঠু আজ জলপাইগুড়ি গিয়েছিলেন? গাড়ি কিনে এনেছেন আমাদের বাড়ির জন্য”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ গো বড়মা। তুমি দেখছি আজকাল জেঠুর কোনও খবরই রাখো না। এতদিন তো জানতুম যে আমার বড়মাই হচ্ছে আমাদের বাড়ির খবরের কাগজ। তার কাছে বাড়ির সব খবর জানা যায়। এখন তো দেখছি অবস্থা বদলে গেছে। নাকি কাজে ফাঁকি মারতে শুরু করেছ আজকাল? দাঁড়াও জেঠুকে বলতে হবে, যেন তার বৌটাকে একটু ভাল করে কড়কে দেন”।
এবার সরলাদেবী সীমন্তিনীর চালাকি বুঝতে পেরে চুপ করে গেলেন। সীমন্তিনী যে তার কান্না থামাবার জন্যেই এ’সব কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছে সেটা বুঝতে পেরেই তার মন হাল্কা হতে শুরু করল। অনেকক্ষণ তিনি কি বলবেন না বলবেন সেটাই ভাবতে লাগলেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সীমন্তিনী আবার বলল, “ও এইবার বুঝেছি। জেঠু তো গাড়িটা কিনে রাজগঞ্জে নিয়েই যান নি। গাড়িটা তো এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমার কোয়ার্টারে। আচ্ছা ঠিক আছে, ভেবো না বড়মা। আমি কাল সকালেই ওই গাড়িটাতে চড়েই তোমার কাছে যাচ্ছি। তখন বরং আমাকে না বকে তুমি তোমার পতিদেবতাটিকেই বকে দিও। তোমাকে না জানিয়ে এভাবে গাড়ি কিনে আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়াটা তার একদম উচিৎ হয়নি”।
সীমন্তিনী দেখতে না পেলেও সরলাদেবী এবার ঝট করে উঠে বসে বললেন, “কি বললি? কি বললি তুই মন্তি? তুই কাল আমার কাছে আসছিস? সত্যি বলছিস মা”?
সীমন্তিনী এবার মোলায়েম স্বরে বলল, “হ্যাঁগো বড়মা। সত্যি বলছি। কাল সকালেই তুমি তোমার এই অপদার্থ নষ্টা কলঙ্কিনী মেয়েটার পোড়া মুখটা দেখতে পাবে”।
সরলাদেবী এবার খুশীতে আনন্দে উচ্ছ্বল হয়ে বললেন, “তুই সত্যি বলছিস মন্তি? না আমি কাঁদছি দেখে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বোকা বানাচ্ছিস”?
সীমন্তিনী এবার আগের মতই মোলায়েম স্বরে জবাব দিল, “হু, সান্ত্বনা তো দিচ্ছিই। নইলে আমার ধেড়ে ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা যে শান্ত হবে না। তবে বোকা বানাচ্ছি না। আমি সত্যিই কাল সকালেই রাজগঞ্জে গিয়ে পৌঁছব”।
সরলাদেবী এবার আরও খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি? কথা দিচ্ছিস তো? আর কথার খেলাপ করবি না তো”?
সীমন্তিনী বলল, “তোমাকে দেওয়া কোন কথার খেলাপ আমি সারা জীবনেও কখনও করেছি বড়মা? যে আজ তুমি আমাকে এমন প্রশ্ন করছ”?
সরলাদেবী বললেন, “জানিরে মা জানি। তুই যে ..... আচ্ছা সে’কথা থাক। তা তুই অর্চনা আর ওই মেয়েটাকেও সাথে আনবি তো? নিয়ে আসিস মা। অর্চনাকে একটিবার দেখতে আমার খুব ইচ্ছে রে। ও আমাদের বৌমার দিদি। ওকেই শুধু আমরা কেউ দেখিনি। ও আসতে না চাইলেও জোর করেই নিয়ে আসিস ওকে”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আনব বড়মা। অর্চু আর নীতা দু’জনকেই সাথে নিয়ে যাচ্ছি আমি। তোমার আবদার কি আমি ফেলতে পারি? কিন্তু আমার আবদারও কিন্তু তোমাকে রাখতে হবে”।
সরলাদেবীও খুশী হয়ে বললেন, “তোর আবদার তো আমি মঞ্জুর করেই দিয়েছি মনে মনে। তুই এলে সেটা মুখে প্রকাশ করব”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি সে আবদারের কথা বলছিনা গো বড়মা। আর ও আবদার তো তুমি একা মেটাতে পারবে না। বাড়ির তিন কর্তার মঞ্জুরীও যে চাই। এখন আমি অন্য আবদারের কথা বলছি। আমি জানি সন্ধ্যের পর থেকে তুমি কিচ্ছুটি খাওনি। এবার উঠে লক্ষ্মী মেয়ের মত একটু কিছু খেয়ে নাও তো দেখি”।
সরলাদেবীও এবার হেসে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। তোর এ আবদারও রাখছি আমি। কিন্তু শোন মা, এবার তুই ফোন রেখে সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পর। কাল তো সকাল সকালই রওনা হবি তোরা”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যা বড়মা, আমরা ভোর চারটের ট্রেন ধরে এনজেপি যাব। তারপর সেখান থেকে ট্রেনে বা বাসে রাজগঞ্জ যাব। তুমি কিন্তু আর মন খারাপ করে থেক না। তবে বড়মা তোমাদের সকলের কাছে, বাড়ির সকলের কাছেই আমার একটা অনুরোধ আছে কিন্তু”।
সরলাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের অনুরোধ রে”?
সীমন্তিনী এক মূহুর্ত চুপ থেকে বলল, “অর্চুর ব্যাপারে তো তোমরা সবকিছুই জানো বড়মা। কিন্তু নীতার সম্বন্ধে তো তোমরা বেশী কিছু জানো না। ওই মেয়েটার জীবনের ওপর দিয়েও অনেক ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে। তাই ওর বাড়ির সাথে ওর একেবারেই যোগাযোগ নেই। ওকে ওর বাড়ি বা পরিবারের সম্মন্ধ কেউ যেন ওকে কোনওরকম প্রশ্ন না করেন। ওর ব্যাপারে তোমাদের যদি সত্যিই কিছু জানবার ইচ্ছে থাকে তাহলে আমি ওর আড়ালে তোমাদের আলাদাভাবে সে’সব কথা বলব। কিন্তু সরাসরি ওকে কেউ কোনও প্রশ্ন করলে ও খুব বিব্রত হয়ে পড়বে আর কষ্ট পাবে। আমি চাই না আমাদের বাড়ি গিয়ে ও কোন কষ্ট পাক”।
সরলাদেবী বললেন, “বৌমার মুখে ওর ব্যাপারে কিছু কিছু কথা আমি শুনেছিরে মা। সত্যিই মেয়েটা বড়ই অভাগী রে। তবে ওর ব্যাপার নিয়ে তুই কোন চিন্তা করিসনে। আমি সব্বাইকে এ ব্যাপারে আগে থেকেই বলে রাখছি। কেউ ওকে ও’সব ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করবে না”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “ঠিক আছে বড়মা। এখন আর তাহলে আর কিছু বলছি না। তুমি বরং এখন খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নাও। আর ফোনটা ছোটমাকে একটু দাও না”।
সরলাদেবী বললেন, “হ্যাঁ দিচ্ছিরে মা। আর শোন, তোরা কিন্তু সাবধানে আসিস। এই নে ছোটোর সাথে কথা বল”।
ফোনে চন্দ্রাদেবীর গলা শুনেই সীমন্তিনী বলল, “ছোটমা, আমার প্রণাম নিও”।
চন্দ্রাদেবী বললেন, “হ্যাঁ মন্তি, ভাল থেক। তোমরা তো তাহলে কাল আসছ, তাই তো”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ ছোটমা, আসছি। কালই তোমাদের সাথে কথা হবে। আজ শুধু তুমি বড়মাকে নিয়ে একটু খাইয়ে দিও প্লীজ”।
চন্দ্রাদেবী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ও নিয়ে তুমি ভেবো না মন্তি। বড়দি তো তোমার সাথে কথা বলেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সত্যি তুমি যাদু জান গো। গত তিন সাড়ে তিন ঘন্টায় আমরা দুই জা মিলে যা করতে পারছিলুম না, তুমি এক মিনিটে সেটা করে ফেললে? আমি এখনই বড়দিকে খাবার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো”।
সীমন্তিনী আর কথা না বলে ফোন কেটে দিল।
রাতে খাবার টেবিলে খেতে খেতে সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতাকে বলল, “আমি তো তোদের মতামত না জেনেই বড়মাকে কথা দিয়ে দিলুম যে তোরাও কাল আমার সাথে রাজগঞ্জ যাচ্ছিস। আসলে বড়মা ওখানে ওভাবে কান্নাকাটি করছেন জানতে পেরেই তোদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আগে থেকে আলোচনা করবার ফুরসতই পাই নি। তোদের হয়ত তাতে খারাপ লাগতে পারে। তবে তোদের কারো যদি আপত্তি থাকে তো এখন সেটা আমার জেনে নেওয়া উচিৎ”।
নবনীতা আর অর্চু দু’জনেই এক কথায় জানিয়ে দিল যে তাদের কোন আপত্তি নেই। বরং রতীশের মা আর রচনার শাশুড়িকে দেখবার একটা আগ্রহ তাদের দু’জনের মনেই আছে।
রাতের খাবার খেয়ে সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতাকে ঘুমিয়ে পরতে বলে নিজের পার্সোনাল মোবাইলটা সুইচ অফ করে অফিসিয়াল মোবাইলটাতে রাত তিনটের এলার্ম সেট করে শুয়ে পড়ল। সীমন্তিনী আশা করছিল যে আজ রাতে মহিমা তাকে নিশ্চয়ই ফোন করবে। কিন্তু তার সাথে যে এক দু’মিনিটে কথা শেষ হবে না, সেটা আন্দাজ করেই সে মোবাইলটা সুইচ অফ করে রাখল। মহিমা বৌদি তার ল্যান্ডলাইন অথবা অফিসিয়াল ফোনের নাম্বার জানে না। কিন্তু আজ রাতে সে আর কারো সাথে কথা বলতে চাইছে না। রাত তিনটেয় উঠে পড়তে হবে। তাই এ সময়টুকু ঘুমিয়ে নেওয়া খুব দরকার।
*******************
ও’দিক থেকে ছোটমা আর সতীশের কথা শোনা গেল। তারা সরলাদেবীকে ফোনে কথা বলবার অনুরোধ করছে। আর একটা কান্নার আওয়াজও যেন শোনা যাচ্ছে। প্রায় মিনিট খানেক কেটে যাবার পর সরলা দেবীর গলা শোনা গেল। তিনি কাউকে বলছেন, ‘কোন মুখে আমি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলব বল? ভর সন্ধ্যেবেলায় মেয়েটার মনে আমি কত আঘাতই না দিয়েছি। এখন ....’। এবার আরেক মহিলার গলা শোনা গেল, “তোমার ওই মেয়েই যে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে গো বড়দি। বৌমা নিশ্চয়ই তাকে ফোন করে জানিয়েছে যে তুমি এদিকে কান্নাকাটি করছ। আর মেয়েটাও সে কথা শুনে নাজানি কত দুশ্চিন্তায় আছে। একটুখানি কথা বলোনা বড়দি। নইলে ওই মেয়েটাও যে আজ সারা রাত না ঘুমিয়ে কেঁদে কেটেই কাটাবে গো। লক্ষ্মী দিদি আমার, একবার শুধু তার সাথে একটু কথা বলো’। সীমন্তিনী তার কাকী চন্দ্রাদেবীর গলা চিনতে পারল। সরলা দেবী কিছুতেই ফোন ধরতে চাইছেন না। আর সতীশ ও চন্দ্রাদেবী দু’জনেই নানা ভাবে সরলাদেবীকে ফোনে কথা বলাবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কাটবার পর সরলাদেবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করে দে মন্তি। আমি তোকে ওভাবে বলে খুব অন্যায় করেছি রে”।
সীমন্তিনী নিজের মনকে শক্ত রেখে বলল, “বড়মা, কেন তুমি এমন কথা বলছ বলো তো? তুমি আমাকে এমন কী বলেছ? আমি তো তোমার কথায় কোন কষ্ট পাইনি। কেন ক্ষমা চাইছ তুমি আমার কাছে”?
সরলাদেবী কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “আমার যে তখন কোন ভীমরতিতে ধরেছিল কে জানে। প্রায় এক যুগ ধরে যে মেয়েটা আমাদের বাড়িছাড়া হয়েও আমার মনের সব ইচ্ছে পূরণ করে যাচ্ছে, তাকে অমন কথা বলতে আমার জিভটা খসে পড়ল না কেন... হা ভগবান। কেন আমাকে দিয়ে এতবড় পাপটা তুমি করালে ঠাকুর”।
সীমন্তিনী এবার দুষ্টুমি ভরা গলায় বলল, “ও’কথা ছাড়ো তো বড়মা। গাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে কি না সেটা বলো তো শুনি”।
সরলাদেবীর কান্নাটা যেন এক মূহুর্তের জন্য থেমে গেল। কিন্তু পরমূহুর্তেই আবার ছোট মেয়ের মত কেঁদে কেঁদে বললেন, “কিসের গাড়ি? কার গাড়ির কথা বলছিস তুই”?
সীমন্তিনী আগের মতই দুষ্টুমি করে বলল, “ওমা সেকি গো? তুমি এখনও জানো না? এখনও এ খবরটা কেউ তোমাকে দেয়নি”?
এবার সরলাদেবীর গলায় আর কান্নার সুর নেই। তিনি বললেন, “কিসের কথা বলছিস তুই? কে কোন গাড়ির খবর দেবে আমাকে”?
সীমন্তিনী বলল, “বারে! কি বলছ তুমি বড়মা! জেঠু যে আজ জলপাইগুড়ি গিয়ে বাড়ির জন্য একটা ইয়া বড় গাড়ি কিনে এনেছেন, সে খবর তুমি এখনও পাও নি”?
সরলাদেবী সীমন্তিনীর কথাগুলোই আউরে বললেন, “তোর জেঠু আজ জলপাইগুড়ি গিয়েছিলেন? গাড়ি কিনে এনেছেন আমাদের বাড়ির জন্য”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ গো বড়মা। তুমি দেখছি আজকাল জেঠুর কোনও খবরই রাখো না। এতদিন তো জানতুম যে আমার বড়মাই হচ্ছে আমাদের বাড়ির খবরের কাগজ। তার কাছে বাড়ির সব খবর জানা যায়। এখন তো দেখছি অবস্থা বদলে গেছে। নাকি কাজে ফাঁকি মারতে শুরু করেছ আজকাল? দাঁড়াও জেঠুকে বলতে হবে, যেন তার বৌটাকে একটু ভাল করে কড়কে দেন”।
এবার সরলাদেবী সীমন্তিনীর চালাকি বুঝতে পেরে চুপ করে গেলেন। সীমন্তিনী যে তার কান্না থামাবার জন্যেই এ’সব কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছে সেটা বুঝতে পেরেই তার মন হাল্কা হতে শুরু করল। অনেকক্ষণ তিনি কি বলবেন না বলবেন সেটাই ভাবতে লাগলেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সীমন্তিনী আবার বলল, “ও এইবার বুঝেছি। জেঠু তো গাড়িটা কিনে রাজগঞ্জে নিয়েই যান নি। গাড়িটা তো এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমার কোয়ার্টারে। আচ্ছা ঠিক আছে, ভেবো না বড়মা। আমি কাল সকালেই ওই গাড়িটাতে চড়েই তোমার কাছে যাচ্ছি। তখন বরং আমাকে না বকে তুমি তোমার পতিদেবতাটিকেই বকে দিও। তোমাকে না জানিয়ে এভাবে গাড়ি কিনে আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়াটা তার একদম উচিৎ হয়নি”।
সীমন্তিনী দেখতে না পেলেও সরলাদেবী এবার ঝট করে উঠে বসে বললেন, “কি বললি? কি বললি তুই মন্তি? তুই কাল আমার কাছে আসছিস? সত্যি বলছিস মা”?
সীমন্তিনী এবার মোলায়েম স্বরে বলল, “হ্যাঁগো বড়মা। সত্যি বলছি। কাল সকালেই তুমি তোমার এই অপদার্থ নষ্টা কলঙ্কিনী মেয়েটার পোড়া মুখটা দেখতে পাবে”।
সরলাদেবী এবার খুশীতে আনন্দে উচ্ছ্বল হয়ে বললেন, “তুই সত্যি বলছিস মন্তি? না আমি কাঁদছি দেখে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বোকা বানাচ্ছিস”?
সীমন্তিনী এবার আগের মতই মোলায়েম স্বরে জবাব দিল, “হু, সান্ত্বনা তো দিচ্ছিই। নইলে আমার ধেড়ে ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা যে শান্ত হবে না। তবে বোকা বানাচ্ছি না। আমি সত্যিই কাল সকালেই রাজগঞ্জে গিয়ে পৌঁছব”।
সরলাদেবী এবার আরও খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি? কথা দিচ্ছিস তো? আর কথার খেলাপ করবি না তো”?
সীমন্তিনী বলল, “তোমাকে দেওয়া কোন কথার খেলাপ আমি সারা জীবনেও কখনও করেছি বড়মা? যে আজ তুমি আমাকে এমন প্রশ্ন করছ”?
সরলাদেবী বললেন, “জানিরে মা জানি। তুই যে ..... আচ্ছা সে’কথা থাক। তা তুই অর্চনা আর ওই মেয়েটাকেও সাথে আনবি তো? নিয়ে আসিস মা। অর্চনাকে একটিবার দেখতে আমার খুব ইচ্ছে রে। ও আমাদের বৌমার দিদি। ওকেই শুধু আমরা কেউ দেখিনি। ও আসতে না চাইলেও জোর করেই নিয়ে আসিস ওকে”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “আনব বড়মা। অর্চু আর নীতা দু’জনকেই সাথে নিয়ে যাচ্ছি আমি। তোমার আবদার কি আমি ফেলতে পারি? কিন্তু আমার আবদারও কিন্তু তোমাকে রাখতে হবে”।
সরলাদেবীও খুশী হয়ে বললেন, “তোর আবদার তো আমি মঞ্জুর করেই দিয়েছি মনে মনে। তুই এলে সেটা মুখে প্রকাশ করব”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি সে আবদারের কথা বলছিনা গো বড়মা। আর ও আবদার তো তুমি একা মেটাতে পারবে না। বাড়ির তিন কর্তার মঞ্জুরীও যে চাই। এখন আমি অন্য আবদারের কথা বলছি। আমি জানি সন্ধ্যের পর থেকে তুমি কিচ্ছুটি খাওনি। এবার উঠে লক্ষ্মী মেয়ের মত একটু কিছু খেয়ে নাও তো দেখি”।
সরলাদেবীও এবার হেসে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। তোর এ আবদারও রাখছি আমি। কিন্তু শোন মা, এবার তুই ফোন রেখে সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পর। কাল তো সকাল সকালই রওনা হবি তোরা”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যা বড়মা, আমরা ভোর চারটের ট্রেন ধরে এনজেপি যাব। তারপর সেখান থেকে ট্রেনে বা বাসে রাজগঞ্জ যাব। তুমি কিন্তু আর মন খারাপ করে থেক না। তবে বড়মা তোমাদের সকলের কাছে, বাড়ির সকলের কাছেই আমার একটা অনুরোধ আছে কিন্তু”।
সরলাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের অনুরোধ রে”?
সীমন্তিনী এক মূহুর্ত চুপ থেকে বলল, “অর্চুর ব্যাপারে তো তোমরা সবকিছুই জানো বড়মা। কিন্তু নীতার সম্বন্ধে তো তোমরা বেশী কিছু জানো না। ওই মেয়েটার জীবনের ওপর দিয়েও অনেক ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে। তাই ওর বাড়ির সাথে ওর একেবারেই যোগাযোগ নেই। ওকে ওর বাড়ি বা পরিবারের সম্মন্ধ কেউ যেন ওকে কোনওরকম প্রশ্ন না করেন। ওর ব্যাপারে তোমাদের যদি সত্যিই কিছু জানবার ইচ্ছে থাকে তাহলে আমি ওর আড়ালে তোমাদের আলাদাভাবে সে’সব কথা বলব। কিন্তু সরাসরি ওকে কেউ কোনও প্রশ্ন করলে ও খুব বিব্রত হয়ে পড়বে আর কষ্ট পাবে। আমি চাই না আমাদের বাড়ি গিয়ে ও কোন কষ্ট পাক”।
সরলাদেবী বললেন, “বৌমার মুখে ওর ব্যাপারে কিছু কিছু কথা আমি শুনেছিরে মা। সত্যিই মেয়েটা বড়ই অভাগী রে। তবে ওর ব্যাপার নিয়ে তুই কোন চিন্তা করিসনে। আমি সব্বাইকে এ ব্যাপারে আগে থেকেই বলে রাখছি। কেউ ওকে ও’সব ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করবে না”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “ঠিক আছে বড়মা। এখন আর তাহলে আর কিছু বলছি না। তুমি বরং এখন খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নাও। আর ফোনটা ছোটমাকে একটু দাও না”।
সরলাদেবী বললেন, “হ্যাঁ দিচ্ছিরে মা। আর শোন, তোরা কিন্তু সাবধানে আসিস। এই নে ছোটোর সাথে কথা বল”।
ফোনে চন্দ্রাদেবীর গলা শুনেই সীমন্তিনী বলল, “ছোটমা, আমার প্রণাম নিও”।
চন্দ্রাদেবী বললেন, “হ্যাঁ মন্তি, ভাল থেক। তোমরা তো তাহলে কাল আসছ, তাই তো”?
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ ছোটমা, আসছি। কালই তোমাদের সাথে কথা হবে। আজ শুধু তুমি বড়মাকে নিয়ে একটু খাইয়ে দিও প্লীজ”।
চন্দ্রাদেবী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ও নিয়ে তুমি ভেবো না মন্তি। বড়দি তো তোমার সাথে কথা বলেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সত্যি তুমি যাদু জান গো। গত তিন সাড়ে তিন ঘন্টায় আমরা দুই জা মিলে যা করতে পারছিলুম না, তুমি এক মিনিটে সেটা করে ফেললে? আমি এখনই বড়দিকে খাবার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো”।
সীমন্তিনী আর কথা না বলে ফোন কেটে দিল।
রাতে খাবার টেবিলে খেতে খেতে সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতাকে বলল, “আমি তো তোদের মতামত না জেনেই বড়মাকে কথা দিয়ে দিলুম যে তোরাও কাল আমার সাথে রাজগঞ্জ যাচ্ছিস। আসলে বড়মা ওখানে ওভাবে কান্নাকাটি করছেন জানতে পেরেই তোদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আগে থেকে আলোচনা করবার ফুরসতই পাই নি। তোদের হয়ত তাতে খারাপ লাগতে পারে। তবে তোদের কারো যদি আপত্তি থাকে তো এখন সেটা আমার জেনে নেওয়া উচিৎ”।
নবনীতা আর অর্চু দু’জনেই এক কথায় জানিয়ে দিল যে তাদের কোন আপত্তি নেই। বরং রতীশের মা আর রচনার শাশুড়িকে দেখবার একটা আগ্রহ তাদের দু’জনের মনেই আছে।
রাতের খাবার খেয়ে সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতাকে ঘুমিয়ে পরতে বলে নিজের পার্সোনাল মোবাইলটা সুইচ অফ করে অফিসিয়াল মোবাইলটাতে রাত তিনটের এলার্ম সেট করে শুয়ে পড়ল। সীমন্তিনী আশা করছিল যে আজ রাতে মহিমা তাকে নিশ্চয়ই ফোন করবে। কিন্তু তার সাথে যে এক দু’মিনিটে কথা শেষ হবে না, সেটা আন্দাজ করেই সে মোবাইলটা সুইচ অফ করে রাখল। মহিমা বৌদি তার ল্যান্ডলাইন অথবা অফিসিয়াল ফোনের নাম্বার জানে না। কিন্তু আজ রাতে সে আর কারো সাথে কথা বলতে চাইছে না। রাত তিনটেয় উঠে পড়তে হবে। তাই এ সময়টুকু ঘুমিয়ে নেওয়া খুব দরকার।
*******************