Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 203)

ও’পাশ থেকে সরলাদেবী ধরা গলায় বললেন, “তোকে একটিবার খুব চোখে দেখতে ইচ্ছে করছে রে মা। একটিবার আয় না বাড়িতে। এক যুগ হয়ে গেল তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিস। রতুর বিয়ের সময় শুধু দু’তিনদিন এসেছিলিস বটে, তাও তো তিন সাড়ে তিন বছর হয়ে গেছে। ওদিকে রতু রচু ওরাও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমার বুকের পাঁজর গুলোই মনে হয় ভেঙে গেছে। রচু চলে যাবার পর থেকে আমরা বাড়ির লোকগুলো কেমন যেন হয়ে গেছি। মাঝে মধ্যে যেন বুঝতেই পারিনা, আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি। তোকে ফোন না করার দিব্যি দিয়ে রেখেছিস। সেটাও বুকে পাথর চাপা দিয়ে সহ্য করছি। রতু রচু ওরা না হয় পাঁচশ’ মাইল দুরে থাকে। মন চাইলেও হুট করে চলে আসতে পারবে না। তুই তো আমাদের কাছেই আছিস মা। এত কাছে থেকেও এই মা-টার কাছে একটুও আসতে ইচ্ছে করেনা তোর? কতদিন হয়ে গেল তোকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না। মায়ের এমন কষ্ট তুই কি একটুও বুঝতে পারিস না”?
 

ফোনের স্পীকারে কথা গুলো শুনে অর্চনাও কেঁদে ফেলল। সীমন্তিনীর ভেতর থেকেও আবার কান্না উথলে আসছিল যেন। অনেক কষ্টে কান্না সামলে সে বলল, “বড়মা, ও’সব কথা ছাড়ো না। তোমাদের সকলের কাছ থেকে যে সাহায্যটুকু আমি চেয়েছিলুম সে ব্যাপারে তোমার যা বলার আছে, সেটাই বলো না”।

কয়েকমূহুর্ত নিশ্চুপ থাকবার পর সরলাদেবী বললেন, “অর্চনা তো শুনেছি এখন তোর কাছেই আছে। আর কলকাতা থেকেও নাকি তুই আরেকটা মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিস। ওই দু’জনকে সাথে নিয়ে তুই একবার বাড়ি আয়। তারপর তোর অনুরোধের ব্যাপার নিয়ে কথা বলব আমি। নইলে নয়”।
 

সীমন্তিনী সরলাদেবীর কথা শুনে খুব অবাক হয়ে বলল, “কী ছেলেমানুষি করছ তুমি বড়মা? আমার অফিস আছে। নীতাও এক জায়গায় নতুন কাজে ঢুকেছে। তাই আমাদের দু’জনের পক্ষেই এখন ছুটি নেওয়া সম্ভব নয়। আর অর্চুর কথাও তো জানো তোমরা। ওর এখনও ওষুধ পথ্য চলছে। এ অবস্থায় কি করে আমি তোমার কাছে যাই, বলো তো? কালচিনির বাড়িতে অসুবিধে আছে বলেই বিয়ের আয়োজনটা অন্য কোথাও করতে হচ্ছে। আর দেখো, অর্চু তো আমাদের পর নয়। সে যে তোমারই নয়নের মণি বৌমার বড় দিদি। ওর বিয়েতে এ’টুকু সাহায্য করা কি খুব বড় ব্যাপার? আচ্ছা, একান্তই যদি তোমরা রাজি না-ই হও, তাহলে সেটাই পরিষ্কার করে বলে দাও আমাকে। হাতে সময় থাকতে থাকতেই আমাকে অন্য একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। তাই আমি শুধু তোমার কাছে এটাই জানতে চাইছি যে তোমার আপত্তি করবার পেছনে আসল কারনটা কি”?
 

সরলাদেবী এবার অনেকটা দৃঢ় স্বরে জবাব দিলেন, “তোর কোনও প্রশ্নের জবাবই আমি এখন দেব না। আর কেন আপত্তি করেছি, সেটাও বলব না। তুই যদি সেটা জানতেই চাস, তবে তোকে বাড়ি আসতেই হবে। এটাই আমার সাফ কথা। এবার তুই কি করবি সে সিদ্ধান্ত তোর”।
 

সীমন্তিনী কাতর কন্ঠে বলল, “বড়মা তুমি কেন এমন জেদ করছ বলো তো? আমি তো এমন একটা কাজ করি যে যখন তখন প্রয়োজন পড়লেই আমরা ছুটি নিতে পারি না। একটু বোঝার চেষ্টা করো”।

সরলাদেবী আগের মতই দৃঢ় স্বরে বললেন, “কিচ্ছু বোঝার দরকার নেই আর আমার মন্তি। সারাটা জীবন ধরেই বাড়ির সকলের ইচ্ছে আবদার বুঝতে বুঝতেই বুড়ি হয়ে গেলুম। আমি আমার কথা পরিষ্কার করে তোকে বলে দিয়েছি। তুই যদি বাড়ি আসিস, আর সাথে অর্চনা আর নীতাকেও নিয়ে আসিস, তাহলেই ব্যাপারটা আমি নতুন করে ভেবে দেখব। ভেবে দেখবই শুধু নয়, অর্চুর বিয়ে এ বাড়ি থেকেই দেব আমরা, এ কথাও দিচ্ছি তোকে। কিন্তু পরিষ্কার ভাবে শর্তটাও বলে দিচ্ছি। এক সপ্তাহের ভেতর নীতা আর অর্চুকে সাথে নিয়ে তোকে বাড়ি আসতে হবে। নইলে বিয়ের কথা তো ছেড়েই দে, এই বুড়ি বড়মাকেও আর কক্ষনও ফোন করবি না তুই। আমার মৃত্যু সংবাদ পেলেও এ বাড়ি আসবি না” বলেই ফোন কেটে দিলেন।

তার প্রিয় বড়মা যে তার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন, এমন ধারণাও সীমন্তিনী কখনও করেনি। কয়েকবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করেও ও’পাশ থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে সীমন্তিনী রিসিভার নামিয়ে রেখে থম ধরে বসে রইল। নিজের কানে শোনা কথাগুলোকেও যেন সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার বড়মা তার সাথে এভাবে কথা বলতে পারলেন? কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার।

রচনার মুখে ওর শাশুড়ির কথা অনেক শুনেছে অর্চনা। কিন্তু সীমন্তিনীকে যে সরলাদেবী কতটা ভালবাসেন সেটা সে আজই বুঝতে পারল। সরলাদেবীর মনের কষ্ট বুঝতে পেরে অর্চনাও ভেতরে ভেতরে কাঁদতে শুরু করেছিল। ফোনের কথা শেষ হবার পর সীমন্তিনীকে স্থানুর মত বসে থাকতে দেখে অর্চনা সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ও দিদিভাই, কি হল গো তোমার? কথা বলছ না কেন”?

সীমন্তিনী অর্চনার দু’হাতের মধ্যেই একটুখানি কেঁপে উঠে অর্চনার একটা হাত ধরে বলল, “নারে, কিচ্ছু হয়নি আমার। আমি একদম ঠিক আছি। কিন্তু বড়মা আমাকে এভাবে বলতে পারলেন”?

অর্চনা সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরেই বলল, “মন খারাপ কোর না দিদিভাই। রচুর মুখে ওর শাশুড়ির কথা আমি অনেক শুনেছি। অমন একটা শাশুড়ি পেয়েছে বলে মনে মনে রচুর ওপর আমার কিছুটা ঈর্ষাই হত। কিন্তু তোমার বড়মা যে তোমাকে কতটা ভালবাসেন, সেটা আমি আজ বুঝতে পারলুম গো। এত ভাল যে বাসে তাকে না দেখে তুমি কিকরে থাকতে পারছ, আমি জানিনা। কিন্তু উনি যে তোমার জন্য কত কষ্টে আছেন সেটা তো তুমি আমার থেকে ভাল জানো দিদিভাই। তাহলে একটিবার তার কথা রেখে অন্ততঃ একটা দিনের জন্যেও তো তুমি তার কাছে যেতে পারো”।

সীমন্তিনীও অর্চুকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমারও মনটা মাঝে মাঝে খুব কাঁদে রে। কিন্তু আমি ও বাড়িতে গেলেই বড়মা যতটা খুশী হন, তার চেয়েও অনেক বেশী কষ্ট পান ও বাড়ির অন্য দুটো মানুষ। তাই বুঝতে পারছিস, আমি কত বড় একটা কূ-সন্তান, আর কত বড় অভাগী। তোরা তো ছোট, তোরা হয়ত বুঝবি না সেটা। কিন্তু আমিও মা মাসিদের মত বুড়িয়ে না গেলেও জীবনটাকে গভীরভাবে দেখতে শিখেছি অনেক ছোটবেলা থেকেই। নীলার আংটি তো অনেকেই পড়ে। কিন্তু একটা কথা হয়ত শুনেছিস, নীলা সকলের সহ্য হয় না। পরিবারের ভালবাসা আমার জীবনে অনেকটা নীলার মতই। আমার কপালে সয় না। তাই হয়ত আমি এমন হয়ে উঠেছি”।
 

অর্চনা সীমন্তিনীর কথার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এ মূহুর্তে আর সে সীমন্তিনীকে কিছু বলতে চাইল না। একবার দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত সাতটা পনেরো। নবনীতার ফিরতে এখনও দেরী আছে। অন্যদিন নবনীতা ফিরে আসবার পর সবাই একসাথে বসে চা খায়। কিন্তু আজ এখনই একটু চা খেতে পারলে বোধহয় ভাল হত। তাই অর্চনা সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, “দিদিভাই, একটু চা খাবে”?

সীমন্তিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘড়ির দিকে দেখে বলল, “নীতার আসতে তো এখনও দেরী আছে। কিন্তু একটু চা খেলে বোধহয় ভালই লাগবে এ সময়। যা, লক্ষ্মীদিকে বল আমাদের জন্যে দু’কাপ চা বানিয়ে দিতে। আচ্ছা চল, আমিও যাই। একা একা থাকতে ইচ্ছে করছে না এখন” বলে মোবাইল দুটো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
 

অর্চনা নিজেই তিনকাপ চা বানিয়ে একটা কাপ লক্ষ্মীর জন্য রেখে বাকি দুটো কাপ হাতে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা সীমন্তিনীর কাছে এল।

সরলাদেবীর শেষের দিকের কথাগুলো সীমন্তিনীর মনটাকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। ও বাড়ি থেকে অর্চুর বিয়ে দিতে যে বড়মা একেবারেই অরাজী নন, এ’কথা সীমন্তিনীর বুঝতে একটুও কষ্ট হয়নি। সে খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে তার বড়মার মনের কথা। ইচ্ছে কি তার নিজের মনের ভেতরেও নেই? তার মনটাও যে মাঝে মাঝে খুব ছটফট করে বাড়ির সবাইকে দেখতে। বাড়ির লোকদের মধ্যে তাকে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা যারা করেন, তার সেই নিজের মা বাবাকেও তার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। সে নিজেও খুব ভাল ভাবেই জানে, যে দুঃখ সে তার মা-বাবাকে দিয়েছে, তাতে তার জীবনের শেষ দিনেও তারা হয়ত তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না। তার ছোট ভাই সূর্য্যর মনেও বুঝি তার জন্য কোন ভালবাসা জন্মায়নি। চন্দু আর চঞ্চু তো আরও ছোট। মাধ্যমিক পাশ করবার পর যখন সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল তখন চঞ্চুর বয়স সবে এক বছর। চন্দুর জন্মের খবর তো সে বড়মার মুখেই শুনেছে, ফোনে। এখন চন্দুর বয়স এগারো পেরিয়ে গেছে। আর চঞ্চুর তেরো। দাদাভাইয়ের বিয়ের সময় এক দু’লহমার জন্যে তারা তাদের বড়দিকে দেখেছে। কিন্তু তাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত বলেই হয়ত তারা কেউ প্রথমে তার কাছেই আসতে চায়নি। অনেক ব্যস্ততার মধ্যে সে নিজেই কিছুটা সময় ওদের সাথে কাটিয়েছিল। তারপরেও তো অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। ওরা হয়ত ওদের বড়দিকে ভুলেই গেছে। আজ হয়ত তারা শুধু এটুকুই জানে যে এ পৃথিবীতে তাদের বড়দি বলে কেউ একজন আছে। কিন্তু বছর কয়েক বাদে হয়ত এ স্মৃতিটুকুও তাদের মন থেকে হারিয়ে যাবে। তখন যদি কোনদিন সে তাদের মুখোমুখিও হয়, তারা হয়ত তাদের বড়দিকে চিনতেও পারবে না। তখন হয়ত সীমন্তিনীকে নিজের মুখেই ওই ভাইবোন দুটোর কাছে নিজের পরিচয় খুলে বলতে হবে। কিন্তু ওরা কি তখন সহজ ভাবে তার কাছে আসতে পারবে? মনে হয় না।

সীমন্তিনীর পাশের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে অর্চনা বুঝতে পারছিল যে তার দিদিভাইয়ের মনটা ভাল নেই। নিজের মনেই কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে। তাই সে নিজেও আগ বাড়িয়ে কোন কথার উত্থাপন করতে সঙ্কোচ বোধ করছিল। ঠিক অমন সময়েই ঘরের কলিং বেল বেজে উঠল। সীমন্তিনী বা অর্চু ওঠার আগেই লক্ষ্মী গিয়ে দড়জা খুলে দিতেই নবনীতা দড়জা দিয়ে প্রায় ছুটে ভেতরে এল। ডাইনিং টেবিলে দু’জনকে বসা দেখেই নবনীতা সীমন্তিনীর কাছে এসে উদ্বেগ ভরা গলায় জিজ্ঞেস করল, “দিদি, তোমায় এমন লাগছে কেন গো দেখতে? শরীর খারাপ নাকি”?

সীমন্তিনী নবনীতাকে নির্ধারিত সময়ের আগেই বাড়ি ফিরে আসতে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? কিছু হয়েছে”?

নবনীতা একটা চেয়ার টেনে সীমন্তিনীর পাশে বসতে বসতে বলল, “না না, কিচ্ছু হয়নি দিদি। আমি একদম ঠিক আছি। আর খুব তাড়াতাড়িও তো আসিনি। দেখ, এই তো আটটা বাজতে চলেছে ঘড়িতে”।

সীমন্তিনীও ঘড়ির দিকে দেখে বলল, “হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু তোদের দোকানে তো এখন খদ্দেরের বেশ ভিড়। এতো তাড়াতাড়ি তুই চলে আসতে পারলি কি করে”?
 

নবনীতা প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল, “না দিদি, আজ সাতটার পর থেকে খুব বেশী খদ্দের আসেনি আমাদের দোকানে। আর খগেনদাও আজ কেন জানিনা একটু আগেই এসে গিয়েছিল। আর ম্যাম সেটা বুঝতে পেরেই আমাকে ডেকে ছুটি দিয়ে দিলেন”।

সীমন্তিনী ভুরু কুঁচকে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “বেশ, তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর ফিরতে দেরী হবে, আর আমাদের খুব খেতে ইচ্ছে করছিল বলে আগেই চা খেতে শুরু করেছি” বলে একটু গলা তুলে লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে বলল, “লক্ষ্মীদি নীতার জন্যে চা জল খাবার রেডি করো”।

নবনীতা একবার অর্চনার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে ঈশারা করে বলল, “হ্যাঁ দিদি, এখনই ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি” বলে নিজেদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। অর্চনাও সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই, আমি আমার মোবাইলটা নিয়ে আসছি, একটু বোসো তুমি” বলে নবনীতার পেছন পেছন এগিয়ে গেল।
 

সীমন্তিনীও তার মোবাইলদুটো হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে সোজা লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে জয়া বসাককে ফোন করল। জয়া বসাক ফোন ধরেই উদ্বেগ ভরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম, আপনি? আপনার শরীরটা ভাল নেই শুনেই আমি নীতাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। ও কি এখনও গিয়ে পৌঁছয় নি না কি? আর আপনার শরীর কেমন আছে বলুন তো? ডাক্তার বা ওষুধপত্র এ’সব ব্যাপারে আমি কি কিছু সাহায্য করতে পারি, ম্যাডাম”?
 

সীমন্তিনী মনে মনে হেসে বলল, “না না ম্যাম, আমি এখন বেশ সুস্থ আছি আর নীতাও চলে এসেছে। আমার অসুস্থতার কথা শুনে আপনি ওকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। এটা শুনেই আপনাকে থ্যাংক্স জানাবার জন্যেই ফোনটা করলুম। কিন্তু ম্যাম, আমার কোয়ার্টারে নীতা বাদে সব মিলে আর তিনজনই এখন আছি। আমরা তো কেউ ওকে ফোন করিনি! ও তাহলে জানল কি করে যে আমার শরীর খারাপ করেছে, এটা ভেবেই তো অবাক হচ্ছি”।
 

জয়া বসাক জানালেন, “ম্যাডাম, সেটা তো আমি সঠিক আমি জানিনা। তবে নীতাই তো বলেছিল যে কলকাতা থেকে আপনার বৌদিই নাকি ওকে ফোন করে আপনার অসুস্থতার কথা জানিয়েছেন”।

সীমন্তিনী আশ্বস্ত হবার ভঙ্গীতে বলল, “ও-ও, এইবার বুঝেছি। আচ্ছা ম্যাম, আপনাকে আর ডিস্টার্ব করছি না। আরেকবার ধন্যবাদ আপনাকে” বলে ফোন কেটে দিয়ে বাথরুম থেকে বেরোল। আর তাড়াতাড়ি ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে বলল, “লক্ষ্মীদি, নীতার খাবার রেডি হয়নি এখনও”?
 

লক্ষ্মী কিচেন থেকে সাড়া দিয়ে বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, হয়ে গেছে, আনছি এখনই। এই চা-টা হয়ে এল বলে”।

ও’দিকে নবনীতার পেছন পেছন অর্চনা ঘরে ঢুকতেই নবনীতা দড়জা বন্ধ করে অর্চুকে সীমন্তিনীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই অর্চনা সংক্ষেপে সব কিছু বলে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল।

লক্ষ্মীর কথা শেষ হতেই অর্চনা তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আবার সীমন্তিনীর পাশের ডাইনিং চেয়ারে বসতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “এতক্ষণ লাগল তোর মোবাইল আনতে অর্চু? খুঁজে পাচ্ছিলিস না নাকি”?

অর্চনা একটু থতমত খেয়ে বলল, “না দিদিভাই, মোবাইলটা তো ঠিক জায়গাতেই ছিল। ওই নীতাদিই জিজ্ঞেস করছিল, তোমার মন খারাপ কেন। তাই একটু ....”
 

অর্চনা যে নীতার মত মিথ্যে কথা বলছে না, এটা বুঝতে পেরে সীমন্তিনী মনে মনে খুশী হল। কিন্তু মুখে হাসি না ফুটিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “তোর মোবাইলটা তো ঘরে ছিল। এরমধ্যে রচু তোকে ফোন করেছিল কি না দ্যাখ তো”?

অর্চনা নিজের হাতের মোবাইলের কল লগ দেখে বলল, “হ্যাঁ গো দিদিভাই, রচু ফোন করেছিল তো! এই যে দ্যাখ। সাতটা চব্বিশে ফোন করেছিল”।

সীমন্তিনীও অর্চনার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল সত্যিই তাই। সে বলল, “আমরা এখানে বসেছিলুম বলেই বোধ হয় ফোনের আওয়াজটা শুনতে পাইনি”।

অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “রচুকে ফোন করব একটা”?

সীমন্তিনী বলল, “একটু দাঁড়া। নীতা ওর জল খাবার খেয়ে নিক। তারপর তোদের রুমে গিয়ে ওর সাথে কথা বলব”।
 

অর্চনা আর কোনও কথা বলল না। সীমন্তিনী আবার কিছু একটা বলতে যেতেই সীমন্তিনীর ফোনটা আবার বেজে উঠল। স্ক্রীনে দেখা গেল ‘সিনিয়র অধিকারী কলিং’। সীমন্তিনী সাথে সাথে কলটা রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ সুরজিত বাবু, বলুন কি খবর”?

অপরদিক থেকে ইঞ্জিনিয়ার মিঃ দেবজিত অধিকারীর দাদা সুরজিত অধিকারী বললেন, “ম্যাডাম, আমি আগামীকাল কালচিনি যাচ্ছি। এদিকে কালচিনির প্রজেক্টটা নিয়ে আমাদের এখানকার প্রিপারেটরি কাজ গুলো সারা হয়ে গেছে। এখন কালচিনি, আলিপুরদুয়ার আর জলপাইগুড়ির বিভিন্ন অফিস থেকে কয়েকটা পারমিশন বের করতে হবে। মূলতঃ সে’ কাজের জন্যই আমি যাচ্ছি। কিন্তু ম্যাম, ওই সব অফিসে যাবার আগে আপনাদের বাড়ির দলিল, খাজনার রসিদ আর ইলেক্ট্রিসিটি বিলের কপি টপির মত দু’একটা জিনিসের প্রয়োজন। আপনি যদি কাইন্ডলি আপনাদের বাড়িতে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দেন তাহলে একটু সুবিধে হত। আসলে এর আগে তো আমার ভাই দেবুই সেখানে গিয়েছিল। আমাকে তো তারা কেউ চেনেন না, তাই বলছিলাম আর কি”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “ঠিক আছে সুরজিত বাবু। আমি একটু পরেই মেসোকে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দিচ্ছি। তা ওখানে আমাদের বাড়িটা খুঁজে পেতে আপনার কোনও অসুবিধে হবে না তো”?

সুরজিতবাবু বললেন, “না না ম্যাডাম, কোন অসুবিধে হবে না। লোকেশানের সমস্ত ডেসক্রিপশনই তো আমাদের কাছে আছে। তাই ও ব্যাপারে কোন সমস্যা হবে না। আর ম্যাডাম, আরও একটা কথা ছিল”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ বলুন না”।

সুরজিতবাবু বললেন, “কিছুক্ষণ আগে কলকাতা থেকে দেবু আমাকে ফোন করেছিল। ও বলল যে আপনার বান্ধবীর সাথে তার ডিলটা ফাইনাল হয়ে গেছে। আগামী পরশুই জমিটার রেজিস্ট্রি হচ্ছে। আর আপনার বান্ধবী পুরো মার্কেট কমপ্লেক্স বানাবার কাজটা আমাদের ফার্মকেই কন্ট্রাক্ট দিচ্ছেন। তাই দেবু আপাততঃ বেশ কিছুদিনের মধ্যে কলকাতা ছেড়ে আসতে পারছে না। তবে আপনার সাথে ও কাল বা পরশুর ভেতর ফোনে কথা বলবে”।
 

সীমন্তিনী কথাটা শুনে আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে কোনরকমে সংযত করে বলল, “এ তো সত্যিই খুব ভাল খবর সুরজিতবাবু। এত তাড়াতাড়ি যে এমন একটা সুখবর আপনারা আমাকে দেবেন, সেটা আমি আশাই করিনি। সে যাই হোক, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আর মিঃ অধিকারী মানে আপনার ভাইয়ের ফোনের অপেক্ষায় রইলুম আমি”।

সুরজিতবাবু আবার বললেন, “ম্যাডাম, এটা আমাদের পক্ষেও অনেক গর্বের ব্যাপার। কলকাতায় এতবড় প্রোজেক্ট করবার সুযোগ আগে আমরা পাইনি। তাই এটা সাকসেসফুলি করতে পারলে সেখানে আমাদেরও একটা রেপুটেশন ক্রিয়েট হবে মার্কেটে। আর এর ফলে ভবিষ্যতেও হয়ত এমন ধরণের আরও কিছু কাজ আমরা করবার সুযোগ পাব। তবে ম্যাডাম, আমাদের এমন একটা সুযোগ দেবার জন্য আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আর আমাদের ফার্ম সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আমাদের এত বড় উপকার করবার জন্যে আপনাকে একটা বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে। তবে সেটার ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটা এখনও নেওয়া হয়নি”।

সীমন্তিনী এবার নিজের উচ্ছ্বাস চেপে রেখে অনেকটা শান্ত গলায় বলল, “সুরজিতবাবু, আপনি যে আমাকে পুরস্কৃত করবার কথা বললেন, এটা শুনেই আমি খুব খুশী হলাম। আর সেজন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদও জানাচ্ছি আপনাকে এবং আপনাদের ফার্মকে। কিন্তু আমার সম্বন্ধে আপনারা সত্যিই কতটুকু কী জানেন, তা আমি জানিনে। তাই একটা কথা বলছি, এতে আপনি বা আপনারা কেউ দুঃখ পাবেন না প্লীজ। দেখুন, কারো কাছ থেকে কোন উপহার নেবার অভ্যেস আমার একেবারেই নেই। তাই সেটা নিয়ে আপনারা অযথা মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করবেন না প্লীজ। তবে আরেকটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে দিচ্ছি আপনাকে। আমার বান্ধবী যে প্রজেক্টটা বানাতে চাইছে, সে প্রজেক্টটা কিন্তু শুধুই আমার ওই বান্ধবীরই নয়। ওটা যেমন আপনাদের কাছেও একটা বিরাট প্রজেক্ট, তেমনি আমার কাছেও এটা একটা ড্রিম প্রজেক্ট। ওই প্রজেক্টটা সাকসেসফুল হলে, সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট হবে। তাই আমার খুশী, আমার আনন্দের সীমা থাকবে না। আমাকে সে আনন্দটুকু নিয়েই থাকতে দেবেন প্লীজ”।


______________________________
 
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 25-03-2020, 11:34 AM



Users browsing this thread: 10 Guest(s)