Thread Rating:
  • 43 Vote(s) - 3.26 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram
#55
পরীর আত্মসমর্পণ (#03)

আমি বসার ঘরে ঢুকে আড় চোখে হিমাদ্রির দিকে তাকাই। সেদিন নিলাদ্রি আসেনি। হিমাদ্রি আর তাঁর বাবা মা এসেছিলেন। আমি হিমাদ্রির দিকে দেখে ভদ্রতার জন্য হাত জোর করে প্রনাম করি। হিমাদ্রি দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তরে আমাকে দেখে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়। সেই ক্ষণিকের মধ্যে আমি ওকে দেখে বুঝে নেই যে আমার চেয়ে বেশি লম্বা নয় হিমাদ্রি, ওর পাশে দাঁড়ালে হয়ত আমাকে বেশি লম্বা লাগবে ওর থেকে। বিগত কয়েক মাসে আমি অনেক রোগা হয়ে গেছিলাম। 

হিমাদ্রির গায়ের রঙ একটু বেশি শ্যামবর্ণের, হয়ত কাজের জন্য গায়ের রঙ পুড়ে গেছে। মাথার সামনের দিকে চুল নেই, একটু টাক। নাকের নিচে পুরু গোঁফ, কালো ঠোঁট, থ্যাবড়া নাক। একটু ভুরি আছে, তাও আবার সুটের ভেতর থেকে অল্প বেড়িয়ে গেছে। 

আমি ওর উলটো দিকের সোফার ওপরে বসে যাই। হিমাদ্রির বাবা আমাকে আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, চুপচাপ নিচু স্বরে তাঁর উত্তর দিলাম। এ যেন এক পরীক্ষার মতন মনে হল আমার। 

হিমাদ্রির বাবা ছোটমাকে বললেন, “আমরা এক গৃহবধূ চাইছি।”

আমি একবার হিমাদ্রির দিকে তারপরে ছোটমায়ের দিকে তাকালাম। আমার হারানোর কিছু ছিলনা, আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকনাও। হৃদয়ের অন্তিম সাহসের কনা সঞ্চয় করে বললাম, “আমি কলেজের টিচার হতে চাই।” 

হিমাদ্রি এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসি। বাবু বাকিদের বলেন যে আমাদের দুজনকে একটু একা কথা বলতে দিতে, বাকিদের নিয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন।

আমার বুক খুব জোরে জোরে ধুকপুক করতে শুরু করে দেয়। মনে হল যেন বুকের পাঁজর ভেঙ্গে হৃদপিণ্ডটা এই মাটিতে পরে গড়াগড়ি খাবে। আমার সামনে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যাক্তি বসে, আমি তাঁর সামনে একটা পাথরের পুতুলের মতন বসে থাকি। সবাই বেড়িয়ে যাওয়ার পরে, অনেকক্ষণ আমাদের দুজনের মুখে কোন কথা ছিলান। নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে আমি আমার বুকের ধুকপুক শব্ধ যেন শুনতে পাই। 

হিমাদ্রি কিছু পরে গলা খাকরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এই বছর প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করেছ?”

আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই, হ্যাঁ।

হিমাদ্রি, “বেশ নাম করা কলেজ।”

আমি আবার মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই, হ্যাঁ।

কোলের ওপরে আমার হাত জড় করে রাখা, আমি ছোটো টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই টেবিলের কাঁচের প্রতিফলনে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর দৃষ্টি আমার চেহারার ওপরে নিবদ্ধ। 

হিমাদ্রি, “শুচিস্মিতা অনেক বিশাল নাম। তোমাকে ছোটো করে কি বলে ডাকা যায় বলতো?”

সেই প্রশ্ন শুনে মনে হল, আবার এক নতুন পরিচয়। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে মন করল না আমার। আমি চুপ করে থাকি।

হিমাদ্রির পরের কথা আমাকে হাসিয়ে দিল, “আচ্ছা, চুপচাপ থাকা ছাড়া আর কি কি করা হয় তোমার?”

আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে লজ্জা ঢেকে নেই। হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে চোখ তুলে তাকাই। সেই প্রথম বার আমাদের চার চোখ এক হয়। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে হিমাদ্রি।

হিমাদ্রি বলে, “বাবার কথা অত মাথায় রেখ না। আমি কথা দিচ্ছি যে তুমি চাকরি করতে পারবে, আমি তাতে বাঁধা দেব না। আমি ধানবাদে অনেক কলেজ জানি, যেখানে তুমি খুব সহজে ফিসিক্স টিচারের চাকরি পেয়ে যাবে।”

ওর কথা শুনে আমার বুকে জল আসে, আমার বুক হালকা হয়ে যায়। আমি মাথা ঝুকিয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাই।

হিমাদ্রি আমাকে বলে, “এত চুপচাপ কেন, তোমার সম্বন্ধে কিছু বলো? নিলাদ্রি নিশ্চয় আমার সম্বন্ধে কিছু বলেছে, তাও তোমার যদি কিছু প্রশ্ন থাকে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো।”

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেই, “আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। তোমার যদি কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে তাহলে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে।”

বুক ভরে এক শ্বাস নেই আমি, মাথার ভেতরে কোন প্রশ্ন জাগেনা, বুকের ভেতরে কোন অনুভুতি জাগেনা। চারপাশের ছন্দ আমাকে দুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমি অনড়, নিশ্চল। হিমাদ্রি আমার শান্ত চেহারার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে আবার এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়।

সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি শেষে ওকে বলি, “দুপুরে নিশ্চয় খেয়ে যাবে?”

সামনের দিকে ঝুঁকে আমার মুখের কাছে মুখ এনে হিমাদ্রি আমাকে বলে, “তুমি রান্নাও জানো?”

আমি আলতো মাথা নাড়াই, হ্যাঁ।

হিমাদ্রি হেসে বলে, “তাহলে ত খেয়ে যেতেই হচ্ছে।”

দুপুরে খাওয়ার সময়ে সবাই খেতে বসে আমার রান্নার খুব তারিফ করল। আমি সর্বক্ষণ ঠোঁটে এক মেকি হাসি মাখিয়ে ওদের পরিবেশন করে গেলাম।

ওরা চলে যাওয়ার পরে আমি নিজের ঘরে ঢুকে চুপচাপ বিছানার ওপরে বসে পরি। জানালার বাইরের একভাবে তাকিয়ে থাকি। চোখের সামনে এক তপ্ত বিস্তীর্ণ ফাঁকা মরুভুমি দেখতে পাই। সেই মরুভুমির ওপর দিয়ে এবারে আমাকে হেঁটে যেতে হবে। আমি জানিনা, সেই মরুভুমির মাঝে আমি কোন মরুদ্যান খুঁজে পাবো কি না, আমি শুধু এই টুকু জানি যে সেদিন থেকে আমার বুক এক শূন্য মরুভুমিতে পরিনত হয়ে গেছিল।

ছোটমা আমার ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “হিমাদ্রি কে দেখে কেমন লাগল?”

আমি ছোটমায়ের প্রশ্ন শুনে খুব বিচলিত হয়ে উঠি। ছোটমা আমার মনের কথা জানেন, তাও আমাকে কেন এই প্রশ্ন করা। তিনি ভালো করে জানেন আমার কাকে ভালো লাগে। আমি ছোটমায়ের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে উত্তর দেই, “তোমরা আগে থেকেই আমার জীবনের সবকিছু ঠিক করে ফেলেছ, তারপরে আমার আর কি বলার আছে।”

ছোটমা আমার পাশে বসে আমাকে বললেন, “পরী, হিমাদ্রির বাবা ধানবাদের নামি ব্যাক্তি, ওরা খুব বড়লোক। হিমাদ্রি ইঞ্জিনিয়ার, ভালো ছেলে। তোর জন্য অনেক সম্বন্ধ এসেছিল, আইএএস, আইপিএস, কিন্তু সেসব বাইরের। আমি তোকে বেশি দুরে পাঠাতে চাইনা রে মা। ধানবাদ কোলকাতা থেকে বেশি দুরে নয়, ট্রেনে শুধু মাত্র ছয় ঘন্টা লাগে, তুই আমার সাথে দেখা করতে যেকোনো সময় আসতে পারিস, আমি যেকোনো সময়ে তোর কাছে যেতে পারব।”

আমি মাথা দুলিয়ে বলি, ঠিক আছে।

ছোটমা আমার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে মুখে হাসি ফুটাতে বলেন, আমি অনেক কষ্টে ছোটমার চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি। কথায় কথায় জানতে পারি যে, হিমাদ্রির বাড়ি ধানবাদের হিরাপুর নামে এক জায়গায়। বাবা মায়ের সাথে একত্র পরিবার। ছোটো ভাই নিলাদ্রি, তাঁর বাবার কন্ট্রাক্টারির কাজে সাহায্য করে, হিমাদ্রির বাবা ধানবাদের নাম করা কয়লার কন্ট্রাক্টর। হিমাদ্রির মায়ের নাম রজনী কর্মকার, একজন গৃহবধূ।

সেই বছরের মাঝামাঝি আমার বিবাহের দিন ঠিক করা হয়। ছোটমা মৈথিলী আর মেঘনা বৌদিকে ফোন করে সব জানিয়ে দেন।

একদিন রাতে আমি কল্যাণীকে ফোন করে আমার বিয়ের কথা জানাই। কল্যাণী আমার মুখে সেই সংবাদ শুনে মর্মাহত হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

তারপরে কল্যাণী আহত সুরে বলে, “আমি তোর বেদনাপ্লুত চেহারার সামনে যেতে পারবোনা রে পরী। আমার হয়ে দীপঙ্কর যাবে তোর বিয়েতে।”

আমি কপালে করাঘাত করে ধরা গলায় ওকে বললাম, “মেয়ে হয়ে জন্মেছিরে, ভাগ্যের পরিহাসের সামনে কি করে রুখে দাঁড়াব বল? এই সমাজ আমাদের বলিদান চায় পদেপদে, আমাদের জন্ম শুধু বলিদান দেওয়ার জন্য, রে কল্যাণী।”

কল্যাণী আর কোন কথা না বলে ফোন রেখে দেয়। সেইরাতে আমি আর ঘুমাতে পারি না। নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার চিড়ে আমার কানে বেজে ওঠে আমার বলিদানের সানাইয়ের করুন সুর। সেই কান্নার সুরেও আমার চোখে জল আসেনা, জল শুকিয়ে গেছে।

পরের দিন সকাল বেলা উঠে মৈথিলীকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। অত ভোরে মৈথিলী আমাদের বাড়ি পৌঁছে যায়। বসার ঘরে বসে ছোটমায়ের সাথে কথা বলছিল মৈথিলী। আমাকে দেখতে পেয়ে, বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে আমাকে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ঠেলে।

ভুরু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “একি করছ পরী?”

আমি প্রথমে ওর প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। আমি ওর মনের ভাবাবেগ তখন ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে না পেরে ওকে প্রশ্ন করি, “কেন কি হয়েছে?”

আমার হাত ধরে বিছানার ওপরে বসিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি বিয়ে করছ? কি ব্যাপার, তোমার ভালোবাসার কি হবে?”

আমি ফাঁকা বুক নিয়ে বিছানার ওপরে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলি, “আমি আর কি করতে পারি, চুরনি?”

মৈথিলী আমার ব্যাথিত মুখখানি নিজের দিকে তুলে ধরে। ওর সমবেদনার স্পর্শে আমার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। আমার মাথা নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরে বলে, “কোথায় আছে ও, বলো। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব, তুমি চলে যাও। এখানে যা হবে সব আমি সামলে নেব, আমি তোমাকে এই ভাবে পুড়তে দেখতে পারব না।”

আমি ওর বুকে মাথা গুঁজে কেঁদে ফেলি, “আমার আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই চুরনি। আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমার সাথে একবারও যোগাযোগ করেনি।”

আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আমাকে শান্ত করে বলে, “পরী একদম বলবে না যে তোমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আমি সারা জীবন তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকব। যা কিছু হোক। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে আমিও বড় নিরুপায়। বাড়ির সবাই এই ভাবে যে তোমার ছোটমা তোমার জন্য যা করছে তাই তোমার জন্য ঠিক।”

সেই প্রথম বার আমি ওর চোখে আমার দুখের জন্য জল দেখি। আমার ব্যাথায় ব্যাথিত হয়ে কাঁদে ওর হৃদয়। আমি ওর কোমর জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলি, “আমার মা নেই, ও আর আমার সাথে যোগাযোগ করলনা। আমি জানি না, ও কোথায় আছে, কেমন আছে। আমার আর কোন জায়গা নেই যাওয়ার চুরনি। আমি আমার ভালোবাসা হেরে গেছে চুরনি। ওর ভালোবাসার পরী এই সমাজের নিয়মাবলীর সামনে আত্মসমর্পণ করে দিয়েছে।”
[+] 1 user Likes Nefertiti's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram - by Nefertiti - 23-03-2020, 09:03 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)