Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 197)

সীমন্তিনী এবার অর্চনাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই নারে নীতা। এ বেচারিকে নিয়ে অমন ঠাট্টা করিস নে বোন। তবে আমি সত্যি বলছি তোকে, কথাটা আমি তোদের কাউকে কখনও বলিনি, ইচ্ছে করেই। কারন আমি চাইনি, অর্চু মনে কোন কষ্ট পাক। কিন্তু কথায় কথায় ঠাট্টার ছলেই কথাটা আজ উঠল বলে বলছি। দ্যাখ আমাদের অর্চুর ভেতর ঘাটতি বলতে শুধু একটা জিনিসই আছে। ও কেবল মাধ্যমিক পাশ, এটাই। এ ছাড়া ওর ভেতর অপছন্দ করবার মত আর কিচ্ছু নেই। কিন্তু ওর মত মেয়েকে প্রত্যেকটা ছেলের বাবা মায়েরাই এক কথায় নিজেদের পুত্রবধূ করে নিতে চাইবে। তোরা তো আমার দাদাভাই আর রচুর বিয়ের সব কথা শুনেছিস। রচুকে প্রথমবার জলপাইগুড়িতে দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই ইচ্ছে হয়েছিল ওই মেয়েটাকে আমি আমার দাদাভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে আমাদের পরিবারে আনব। তাই তো অন্য কাজের অজুহাতে কালচিনি গিয়ে এদের বাড়ির সকলের সাথে ভাব করেছিলাম। আর ধীরে ধীরে রচুকে যখন জানতে বুঝতে শুরু করলাম, তখন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলুম যে যেমন করেই হোক আমার দাদাভাইয়ের সাথেই ওর বিয়ে দিতেই হবে। তারপরও কত কি হয়েছে তা তোরা সবই জানিস। আমাদের বাড়ি থেকে যখন বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে কাকু জেঠুরা কালচিনি গেলেন, তখন তো রচুই সে সম্মন্ধ প্রায় নাকচ করেই দিয়েছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমি ঠিক কালচিনির বাড়ির সকলের সাথে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছিলুম। তারপর একদিন রচুও রাজি হল। তাই সে এখন আমাদের বাড়ির সকলের আদরের বড়বৌমা। আমার বিশ্বাস ছিল। রচু আমার দাদাভাই আর আমাদের পরিবারের সবাইকে সুখী করতে পারবে। আমার ধারণা মিথ্যে হয়নি। রচুও যেমন আমাদের পরিবারের ছোট বড় সবাইকে বিয়ের আগে থেকেই নিজের আপন করে নিয়েছে, তেমনি আমাদের বাড়ির সকলেও রচুকে তাদের নয়নের মণি করে তুলেছে। রচু দাদাভাইয়ের সাথে কলকাতা চলে যাবার পর আমাদের বাড়িটাই নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। অর্চুকে দেখবার পর বা বলতে পারিস ওকে ফিরে পাবার পর আমার লোভী মনটায় আগের মতই আরেকটা লালসা জন্ম নিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, রচু আমাদের বাড়িতে যে শূণ্যতা তৈরী করে দাদাভাইয়ের সাথে চলে গেছে, সে শূণ্যতা পূরণ করতে পারবে এই অর্চুই। ওকেও আমি আমার আরেক ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজেদের পরিবারে নিয়ে যেতে চাইছিলুম। কিন্তু ওই যে বলে না? সবার সব ইচ্ছে কখনোই পূর্ণ হয় না। ক’দিন আগেই জানতে পারলুম, আমার ওই ভাই, সতু, একটা মেয়েকে ভালবাসে। তাই আমার সে ইচ্ছে আর পূরণ হবার নয়। সতুর সাথেই ওর বিয়ে দেবার কথা আমি মনে মনে ভেবেছিলুম। কিন্তু জেনে বুঝে আমি অর্চুকে এমন একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে পারি না, যে অন্য কোন মেয়েকে ভালবাসে। হোক সে আমার ভাই, অর্চুও তো আমার পর নয়। ও-ও তো আমার একটা বোন। ওর জীবনটাকে নিয়েও তো আমি জুয়ো খেলতে পারিনা”।
 

নবনীতা এবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ তুমি দিদি”?

সীমন্তিনী অর্চুকে নিজের বুকে চেপে ধরে হতাশ গলায় বলল, “হ্যাঁরে, সত্যিই তাই। আমাদেরই কপাল খারাপ রচুর মত এমনই আরেকটা হীরের টুকরোকে হাতের কাছে পেয়েও নিজের করে নিতে পারলুম না। তবে যাক সে’কথা। তুই পরির কথা বললি তো? সে ব্যাপারেই বলছি, অর্চু যেমন আমার একটা বোন, তেমনি পরিও আমার বন্ধু। খুব ভাল বন্ধু। আমি নিশ্চিত জানি যে পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দিতে পারলে ওরা দু’জনেই খুব সুখী হতে পারত। কিন্তু এতে যে অনেক বাধা আছে রে নীতা। মাসি মেসোর সাথে আমি অর্চুর আবার বিয়ে দেবার ব্যাপারে কথা বলেছি। তারা কিন্তু রাজি হননি। ', ঘরের বিধবা মেয়ের পূনর্বিবাহ দিলে তারা নাকি সমাজে একঘরে হয়ে যাবেন। তাদেরকে অনেক ভাবে বুঝিয়েও আমি রাজি করাতে পারিনি। তবে আমি একটু জেদী ধরণের মেয়ে। তাই এত সহজেই হাল ছেড়ে দিচ্ছি না। হয়ত একটু সময় লাগবে, তবে মাসি মেসো একদিন না একদিন আমার কথা ঠিক মেনে নেবেন, দেখিস। এইটুকু বয়সের এমন সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে, যার সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে, সে আমার চোখের সামনে অমন সন্যাসিনী সেজে জীবনভর ঘুরে বেড়াবে, আর আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখব, এ কিছুতেই হতে পারে না। তার জন্য যদি আমাকে কারুর মতের বিরূদ্ধেও যেতে হয় তাতেও আমি দ্বিধা করব না। আর এ মেয়েটা নিজেও তো তার মনের কথা আমাকে খুলে বলেনি এখনও। না পরির কথাই আমি বলছি না। তবে ও যদি ওর মনের ইচ্ছের কথাটা পরিষ্কার ভাবে আমাকে জানাতো তাহলে আমি যে করেই হোক মাসি মেসোকে রাজি করিয়ে আমি ওর আবার বিয়ে দিতুম”।

অর্চনা “দিদিভাই” বলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নবনীতা বলল, “বারে দিদি, তুমি কেন মিছেমিছি অর্চুর ওপর দায় চাপাচ্ছ বলো তো? অর্চুতো সেদিন আমার সামনেই তোমায় বলল যে তুমি ওকে যা বলবে ও তাই করবে। তোমার কথা ও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। এর চেয়ে আরো কি পরিষ্কার করে বলবে ও তোমাকে”?

সীমন্তিনী এবার একটু ম্লান হেসে বলল, “নারে নীতা, ওই কথাটুকুই সত্যি যথেষ্ট নয় রে আমার কাছে। আসলে ওর মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে বসেছে যে ওই আচার্যি পরিবার থেকে আমিই ওকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে এনেছি। কিন্তু সেটা তো পুরোপুরি সত্যি নয়। হ্যাঁ, আমি মানছি যে, আমার অনুরোধেই কালচিনি থানার ওসি ওর ওপর দুরে থেকেও নজর রাখছিলেন। আমি তো রচুর বিয়ের আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি যে অর্চু ওর শ্বশুর বাড়িতে ভাল নেই। কিন্তু পুলিশ অফিসার হলেও, কোনও লিখিত অভিযোগ বা কোনও উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কারো বাড়িতে গিয়ে আমরা কোনরকম অনুসন্ধান করতে পারি না। আমার হাতে ও’সব কিছুই ছিল না। মাসি মেসো আর রচুর মুখে শোনা কথার ভিত্তিতেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে অর্চু সেখানে ভাল নেই। কিন্তু আমার হাতে তাদের কোন লিখিত অভিযোগ ছিল না, না ছিল কোন সাক্ষ্য প্রমাণ। তাই কালচিনি থানার ওসির পক্ষেও আগ বাড়িয়ে কিছু করা সম্ভব ছিল না। তবে আমি যদি কালচিনি থানায় পোস্টিং পেতুম, তাহলে এমন কিছু নিশ্চয়ই করতে পারতুম। অর্চুকে ওরা ওইভাবে আধ মড়া করে রেল আইনের ওপর ফেলে যাবার সুযোগই পেত না। কিন্তু সে’কথা থাক। যা হয়নি, তা নিয়ে কথা বলে তো লাভ নেই। আসল কথা হল ওর মনের ধারণা এটাই যে আমার জন্যেই ও ওই আচার্যিবাড়ি থেকে ওই বাড়ির লোকজনগুলোর হাতের নাগালের বাইরে চলে আসতে পেরেছে। তাই ওর নরম মনে আমার ওপর একটা কৃতজ্ঞতাবোধের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই ও একবাক্যে বলছে যে আমি যা বলব ও সেটাই করবে, আমার কথার অন্যথা কক্ষনো করবে না। কিন্তু .......”

সীমন্তিনীর কথার মাঝেই অর্চনা বলে উঠল, “দিদিভাই, তুমি এমন করে বলছ কেন? নীতাদির মত তুমিও আমার পেছন লাগতে শুরু করলে”?
 

সীমন্তিনী তখনও অর্চনাকে জড়িয়েই ধরে ছিল। এবার অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “দুর পাগলী, তোর পেছন লাগছি কোথায়? আমি তো আমার বোনটাকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরে আছি রে। আর তুই কি কখনো শুনেছিস কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে আবার তার পেছনে লাগতে পারে”?

অর্চনা আদুরে গলায় বলল, “তোমার সাথে কথায় পাল্লা দিতে তো আমি সাত জনমেও পারব না দিদিভাই। তবে তুমি কিন্তু একটু বাড়িয়ে বাড়িয়েই বলছ”।

কথা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে নবনীতা সীমন্তিনীকে বলল, “আচ্ছা তোমাদের দু’বোনের মান অভিমান ছেড়ে তুমি আমাকে বোঝাও তো দিদি, কেন অর্চুর মুখের কথাই তোমার কাছে সব নয়”?
 

সীমন্তিনী আগের মতই অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “মুখের কথাই সব নয় এ’কথা তুই কেন বুঝতে পারছিস না নীতা। আচ্ছা তুই নিজেকে দিয়েই বিচার করে দ্যাখ না। অর্চুর মত তুইও তো বলিস ‘দিদি তুমি যা বলবে, আমি সেটাই করব’। আমি যদি বলি যে পরি তোকে আগেও যেমন ভালবাসত এখনও তেমনই ভালবাসে, আর বিয়ের পরেও তোকে এমনভাবেই ভালবেসে যাবে। তাহলে তুইই পরিকে বিয়ে কর। তাহলে তুই করবি? জানি করবি না। সেটা করলে তুই আজ আমার এখানে থাকতিস না। এটাই হচ্ছে মুখের কথা আর মনের কথার পার্থক্য। মুখের কথাটা নির্ভর করে পুরোপুরি ভাবে মৌখিক বা পারিপার্শ্বিক বিবেচনা বা যুক্তি তর্কের ওপর। মন কিন্তু কোন বিচার, যুক্তি তর্ক মানে না, কোন পারিপার্শ্বিকতা বোঝেনা। মনের কথা পুরোপুরি ভাবেই মনের আবেগ, ভালবাসা, বিশ্বাস থেকে জন্মায়। তাই আমি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুখের কথার চাইতে মনের কথাকেই বেশী গুরুত্ব দিই। আর বিয়ে-সাদির ব্যাপারে মুখের কথার সাথে সাথে মনের আবেগ মনের ইচ্ছেটাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। কারন বিয়েটা তো আর এক দু’দিনের ব্যাপার নয় যে, ঠিক আছে ভুলটা যখন হয়েই গেছে তাহলে নাহয় দুটো দিন অপেক্ষা করেই দেখি, ঠিক হয়ে যাবে হয়ত। এমন তো নয়। বিয়েটা যে সারা জীবনের জন্য। কাউকে আমি দোষ দিচ্ছিনা, অর্চুর কপালে দুর্ভোগ লেখা ছিল, ওকে তাই সেটা ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু দ্যাখ ওর বিয়ের আগে যদি ছেলের সম্বন্ধে ভাল করে খোঁজ খবর নেওয়া যেত তাহলে হয়ত জানা যেত ওই বাদল আচার্যির স্বভাব চরিত্র কেমন। আর তখন সত্যিটা জানতে পারলে মাসি মেসোরা নিশ্চয়ই তার সাথে অর্চুর বিয়ে দিতেন না। এখন আবার যে আমি ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি, তাতে আমিও যদি আগের বারের মাসি মেসোর মত কোন ভুল করে ফেলি, তাহলে কী সর্বনাশটাই যে হবে সেটা ভাবতে পারিস? তাই যে ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করব, তার ব্যাপারে সব কিছু নির্ভুলভাবে জেনে নেওয়াটা খুবই দরকার। অর্চুর জন্যে আমার প্রথম পছন্দ ছিল আমার ভাই সতু। কিন্তু সে তো আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। পরিও আমার খুব ভাল বন্ধু। তবে ওর সাথে তেমনভাবে মেলামেশা তো আমি কোনদিনই করিনি। কিন্তু ওর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে বলেই ওকে কিছুটা জানতে বুঝতে পেরেছি। তাতে মনে হয়েছে যে ছেলেটাকে সবদিক দিয়ে ভরসা করা যায়। আর গত কয়েকটা মাসে দাদাভাই আর রচুকে যেভাবে আগলে আছে পরি, এ তো প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। যাদেরকে ক’দিন আগে পর্যন্ত ও চিনত না জানত না, আজ তাদের সুরক্ষিত রাখবার জন্য ও রাতভর গোটা কলকাতা শহর চষে বেড়াচ্ছে। পরির স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে আমি যতটুকু জানি তুই তার চেয়ে হাজার গুন বেশী জানিস নীতা। তোর মুখে সবকিছু শুনে আমার মনে হয়েছে যে অমন একটা ছেলের হাতে আমাদের অর্চুকে তুলে দিলে বিপদের তেমন আশঙ্কা থাকবে না। অর্চু সুখী হবে। কিন্তু যেহেতু অর্চু আর পরি দু’জনেই আমাদের খুব কাছের, তাই দু’পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই ব্যাপারটা বিচার করা উচিৎ। এখন দ্যাখ নীতা, আমরা যদি পরির অ্যাঙ্গেল থেকে ব্যাপারটা ভাবি, তবে পরি বিয়ের ব্যাপারে আমাদের দু’জনের পছন্দটাকেই বিনা বাক্যবেয়ে মেনে নেবে বললেও আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ যে, যে মেয়েটা পাঁচ বছর স্বামীর সাথে সংসার করবার পর বিধবা হয়েছে, সাত সাতটা বছর শ্বশুর শাশুড়ি আর সৎ ছেলেদের সাথে সংসার করেছে, সে আমাদের চোখে যতই অতুলনীয়া হোক না কেন, পরি কি নিঃশঙ্ক চিত্তে তাকে নিজের স্ত্রী বলে গ্রহন করতে পারবে? ‘আমাদের পছন্দই ওর পছন্দ’ এ কথা মুখ বললেও ওর মনটা কি সত্যিই তেমনভাবেই মুখের কথাটাকেই সায় দেবে? আর অর্চনার অ্যাঙ্গেল থেকেও ভেবে দেখতে হবে, আমি বা তুই পরির যত প্রশংসাই করি না কেন, ও তো জানে যে পরি আর তোর মধ্যে একটা সময় প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক ছিল। তোকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত পরি। আজও যে ও তোকে বিয়ে করতে রাজি আছে, তার মানে আজও ও তোকে ভালবাসে। আর আমি সেভাবে ওর প্রেমিকা না হলেও পরি তো আমাকেও একটা সময় বিয়ে করতে চেয়েছিল। বলাই বাহুল্য যে আমাকেও ও মনে মনে একতরফা ভাবে ভালবাসত বলেই আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাবটা রেখেছিল। এখনও পরি সব সময় কথায় কথায় আমাকে ডার্লিং, সুইটহার্ট বলে। আর এ’সব কথা তো অর্চুও এতদিনে জেনে গেছে। এখন তুইই বল নীতা, যে ছেলেটা দু’দুটো মেয়েকে ভালবেসে আলাদা আলাদা সময়ে তাদের দু’জনকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল, যে ছেলেটার তিনকুলে আত্মীয় বলতে কেউ নেই, সে যতই ভাল, গুণী, পরোপকারী, সৎ আর সাহসী হোক না কেন, অন্য কোনও মেয়ে কি নিঃশঙ্ক চিত্তে ওই ছেলেটাকে বিয়ে করতে পারে? অর্চনার মনেও সে ব্যাপারে খানিকটা হলেও শঙ্কা থাকবে। তাই তো বলছি, অর্চুর বা পরির মুখের কথাকেই শেষ কথা বলে ধরাটা আমাদের ভুল হবে। ওদের মনের কথাগুলোই আমাদের শুনতে বা বুঝতে হবে। কিন্তু সেটা তো আর সহজ কথা নয়। আমরা কেউ তো আর জ্যোতিষী নই যে সকলের মনের কথা বুঝে ফেলব। সেটা ওদের দু’জনের কাছ থেকেই জানতে হবে। আর সেটাও ওদের দু’জনকে মুখ ফুটেই বলতে হবে যে ওরা একে অপরকে বিয়ে করতে রাজি আছে। তবেই না তেমনটা সম্ভব হবে। আর পরিকে বিয়ে করতে রাজি না হলেও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো অর্চুর ভাবাই উচিৎ। কেউ তো চিরকাল বেঁচে থাকে না। আর বেঁচে থাকলেও অনেকেরই শারীরিক, মানসিক আর আর্থিক দিক দিয়ে প্রভূত পরিবর্তন হতে পারে। আজ মেসো-মাসিরা আছেন। তারা তাদের মেয়েকে বুকে আগলে রাখবেন, জানি। কিন্তু নির্মম হলেও এটা তো সত্যি কথা যে তারা কোন না কোনদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। তখন ওর পাশে শুধু ভাই থাকবে। ভাইও ওকে কিছু কম ভালবাসে না। কিন্তু একদিন ভাইও বড় হবে। তার কর্মজীবন শুরু হবে একদিন। হয়ত তখন সে কালচিনিতে থাকতে পারবে না। হয়ত বাইরে কোথাও চলে যেতে হবে। তখন অর্চুকেও যদি ও নিজের সাথে নিয়ে যেতে না পারে? আর এ ছাড়াও দ্যাখ, ভাই একদিন বিয়ে করবে, তার নিজস্ব একটা সংসার হবে। আর সে সংসারে কর্ত্রী হবে তার স্ত্রী। আজ ভাই যে নজরে তার বড়দিকে দেখছে, সেদিনও কি তা বজায় রাখতে পারবে? যদি সেটাই বজায় থাকে তো ভাল কথা। কিন্তু যদি তা না হয়? ভাই যাকে ঘরে এনে তুলবে সেই মহিলা যদি অর্চুকে সম্মান শ্রদ্ধা না করেন, তখন অর্চুর কী অবস্থা হবে, সেটা ওর সময় থাকতেই ভাবা উচিৎ। এই তুই, আমি, আমরাও তো কেউ আর অমরত্বের বরদান নিয়ে জন্ম নিই নি। মনে প্রাণে চাইলেও, আর মুখেও যতই বলি, চিরদিন কি আর আমরা সত্যি সত্যি ওর পাশে থাকতে পারবো? আমার মনে হয় এখনই অর্চুর এ’সব কথা ভাবা উচিৎ। আজ আমি ওর পাশে আছি। ওর ভালোর জন্য আমার যা করা উচিৎ আমি তাই করব। কিন্তু আমার নিজের ভবিষ্যতও যে আমার অজানা। আমি কতদিন তোদের সকলের পাশে থাকতে পারব তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? তাই আমার মনে হয় সময় থাকতে থাকতে অর্চুর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের ভাবা তো উচিতই। সেটা আমরা করছিও। কিন্তু অর্চুকেও সেটা ভেবে দেখতে হবে। তবে আমি তোকে সত্যি বলছি নীতা, অর্চুর মনে যদি পরিকে নিয়ে কোনও দ্বিধা না থাকে, আর ও যদি সত্যি মন থেকে এ বিয়েতে রাজি থাকে, তাহলে আমি যেকোনও ভাবেই হোক, মাসি মেসো, ভাই আর রচুকে রাজি করাবই করাব”।

সীমন্তিনীর কথা শুনতে শুনতে অর্চনার মনটা এতক্ষণ ভেতরে ভেতরে কাঁদছিল। এবার সীমন্তিনী থামতেই অর্চনা তাকে আঁকড়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, “আমাকে ক্ষমা করো দিদিভাই। আমি সত্যিই অনেক ভুল করে ফেলেছি গো। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে এভাবে ভাবা উচিৎ আমি তো সেটা বুঝতেই পারিনি গো। আমাকে মাফ করে দাও দিদিভাই। ক্ষমা করে দাও আমাকে। আমি ভুল করেছি। কিন্তু দোহাই তোমার দিদিভাই। আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলে আমাকে এভাবে কাঁদিও নাগো” বলতে বলতে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল।

সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’দিক থেকে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। ওদিকে কান্নার আওয়াজ শুনে লক্ষ্মী রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে ঘরের অবস্থা দেখে সেও চেঁচিয়ে উঠল, “ওমা এ কি? কী হয়েছে গো সোনাদির? আবার কি তার শরীর খারাপ করল নাকি? এখানে আসবার পর সে তো ভালই ছিল। হঠাৎ আবার কি হল”?
 

নবনীতাই তার কথার জবাবে বলল, “কিচ্ছু হয়নি গো লক্ষ্মীদি। ওই কথায় কথায় ওর জীবনের কথাগুলো উঠতেই এভাবে.....”।

লক্ষ্মীও এগিয়ে এসে অর্চনার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আহারে, কেঁদোনা গো সোনাদি। কেঁদো না। আমি বলছি একদিন তুমি খুব সুখী হবে। ভগবান নিশ্চয়ই তোমার দিকে মুখ তুলে চাইবেন। বিনাদোষে কম সাজা তো পাওনি তুমি। সেটা ভগবানও নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। এবার তিনিও বুঝতে পারবেন যে তোমার আগের জন্মের কোনও পাপের জন্য যতটুকু শাস্তি তোমার পাওনা ছিল, উনি ভুল করে তার থেকেও অনেক বেশী শাস্তি তোমাকে দিয়ে ফেলেছেন। এবার তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তাকেই করতে হবে। আর তাঁর কাজ তিনিই করবেন। দেখে নিও” বলে নবনীতাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোমাদের সকলকেও বলিহারি যাই বাপু। তোমরা সকলেই তো জানো, পুরনো কথা তুললেই ওই দুঃখের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাবে সোনাদির। তা সত্বেও কেন যে তোমরা ... বুঝিনে বাপু। যাকগে, তোমরা কাঁদিয়েছ, এবার তোমরাই সামলাও। ওদিকে উনুনে কড়াই চাপিয়েই কান্না শুনে ছুটে এসেছি আমি। যাই গিয়ে দেখিগে .....” বলে চলে গেল।
 

নবনীতা আর সীমন্তিনী অনেক কষ্টে অর্চনাকে শান্ত করল। তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবার পর অর্চনা হঠাৎ সীমন্তিনীর পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে আবার কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, “আমার ভুলের জন্য তুমি আমাকে যা শাস্তি দিতে চাও, দাও দিদিভাই। কিন্তু নিজেকে নিয়ে আর মা বাবাকে নিয়ে তুমি যে’সব কথা বললে একটু আগে, অমন কথা কিন্তু আর কক্ষনো বলোনা আমায়। তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমি। এই তোমার পা ছুঁয়ে আমি শপথ করে বলছি দিদিভাই, তোমার সব কথা সব নির্দেশ আমি মন থেকেই মেনে নেব। তুমি ভেবোনা যে ও শুধু আমার মুখের কথা। কিন্তু তুমিও আমাকে কথা দাও, এমন কথা তুমি আর কোনদিন মুখেও আনবে না। বলো দিদিভাই, আমাকে কথা দাও”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে অর্চনাকে নিজের পায়ের ওপর থেকে টেনে তুলে রাগত স্বরে বলল, “এই কী হচ্ছে এটা অর্চু। তোকে না কতদিন বলেছি তোরা কেউ আমার পায়ে হাত দিবি না”।

অর্চনা আবার অভিমানী সুরে বলল, “তাহলে ও’সব কথা বললে কেন তুমি দিদিভাই? তুমি তো গড়গড় করে শুধু বলেই খালাস। কিন্তু কথাগুলো যে আমার বুকে একের পর এক তীরের মত বিঁধছিল, তা কি তুমি বুঝতে পেরেছ”?
 

সীমন্তিনী এবার তাকে আবার বুকে চেপে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কথা দিচ্ছি, অমন কথা আর তোকে কক্ষনো বলব না। কিন্তু তোকেও কিন্তু বলে রাখছি, এরপর কক্ষনো যদি আমার পায়ে হাত দিয়েছিস আবার, তো সেদিন আমি তোকে খুব খুব মারব কিন্তু”।

অর্চনা এবার ভেজা চোখে কৌতুক ভরা গলায় বলল, “ঠিক আছে মেরো। যত খুশী মেরো আমাকে। তোমার মারও আমার কাছে তোমার আশীর্বাদ”।

সীমন্তিনী দু’হাতে অর্চনার মুখটা ধরে হাসিমুখে বলল, “কি দুষ্টু মেয়ে দেখেছিস নীতা”?

নবনীতা অর্চনাকে সীমন্তিনীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “দাঁড়াও দিদি। আপাততঃ আমি ওর দুষ্টুমি নিয়ে ভাবতে চাই নে। আমি ওর একটা কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারিনি। এই অর্চু। সত্যি করে বলো তো। একটু আগে তুমি যা বললে, তা কি সত্যি”?

অর্চনা নবনীতার কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কোন কথার কথা বলছ তুমি”?
 

নবনীতা বলল, “এই যে একটু আগে তুমি বললে যে দিদির সব কথা সব নির্দেশ তুমি মন থেকেই মেনে নেবে? আর এটা শুধু তোমার মুখের কথা নয়। এ’কথা কি সত্যি”?

অর্চনা এবার নবনীতার কথার আসল মানে বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে মুখ নোয়াল। আর সেই সাথে সাথে সীমন্তিনীও অর্চনার একটা হাত ধরে বলল, “তাইতো রে নীতা। কান্নাকাটির হিড়িকে ব্যাপারটা আমি ঠিক ধরতে পারিনি। কিন্তু অর্চু, সত্যি করে বল তো? নীতা যা বলছে সেটাই কি সত্যি? তুই পরিকে বিয়ে করতে সত্যিই ......”

সীমন্তিনীর মুখে হাত চাপা দিয়ে অর্চনা সীমন্তিনীর বুকেই মুখ গুঁজে দিয়ে নিজের লজ্জা ঢাকবার চেষ্টা করতে লাগল।
 

নবনীতা দু’হাতে সীমন্তিনী আর অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে লাফাতে লাফাতে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “ওঃ দিদি গো, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে না, কী বলব তোমাকে। আমি রোজ স্নান করে তোমার ঠাকুরঘরে গিয়ে রোজ তাঁর কাছে প্রার্থনা করতুম। বলতুম ‘ঠাকুর তুমি নটী বিনোদিনী দাসী, মাতাল গিরীশ ঘোষের মত বিপথে চলে যাওয়া লোকগুলোকেও তোমার আশীর্বাদ দিয়ে ধন্য করেছ। আমি কি তাদের চেয়েও বেশী পাপী? আমি তো নিজের জন্য তোমার কাছে কিচ্ছুটি চাই নে ঠাকুর। আমার জন্য তো তুমি দিদিকেই আমার কাছে পাঠিয়েছ। যাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতুম সেই পরির জীবনটাকে আমি যেন সুন্দর করে গুছিয়ে দিতে পারি, শুধু এ আশীর্বাদটুকু তুমি আমাকে করো ঠাকুর’। আজ ঠাকুর আমায় সে আশীর্বাদ দিয়েছেন। ওঃ, অর্চু সোনা বোন আমার। তুমি জানো না আমার কতবড় উপকার তুমি আজ করলে। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি জানি তোমরা দু’জনেই এ বিয়েতে খুব খুব সুখী হবে”।


______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 21-03-2020, 07:26 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)