21-03-2020, 07:13 PM
(Update No. 185)
সীমন্তিনী আগের মতই অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “নারে অর্চু। আসলে রচুই বুঝি আমার কাছে আমার পূর্বজন্মের কোন পূণ্যফল। জানিস অর্চু সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে আমি পাগলের মত আমার দাদাভাইকে ভালবাসতুম। দাদাভাইয়ের গায়ে সামান্য আঁচড়টুকু লাগলেও সকলের সাথে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিতুম। দাদাভাইকে বাড়ির কেউ বকাবকি করলে আমি দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দিতুম। কেউ আমাকে বাগে আনতে পারত না। এতোটাই জেদী ছিলুম আমি। আমার জেদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল বাড়ির সবাই। জলপাইগুড়িতে রচুকে যেদিন প্রথম দেখেছিলুম, সেদিনই আমার মনে হয়েছিল, আমার দাদাভাইয়ের জন্য এই মেয়েটাই একমাত্র উপযুক্ত। আমার ধারণা মিথ্যে হয়নি রে। রচু সত্যি সত্যি নিজেকে দাদাভাইয়ের উপযুক্ত বলে প্রমাণ করছে। দাদাভাইয়ের সাথে সাথে ও বাড়ির প্রত্যেকটা লোককে এমন করে আপন করে নিয়েছে যে সবাই রচুকে নিজেদের নয়নের মণি বলে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। দাদাভাই যখন ঠিক করল কলকাতা যাবে, তখন বাড়িতে কেউই তার কথা মানতে চাইছিল না। রচুও রাজী ছিল না বাড়ির সকলকে ছেড়ে দাদাভাইয়ের সাথে যেতে। আবার দাদাভাইকে ছেড়ে বাড়িতে থাকবার কথাও মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। তখনও ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমিই রাজী করেছি। এর জন্যেও হয়ত বাড়ির লোকেরা আমার ওপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত যে কতটা ঠিক তা এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ির লোকেরা বুঝতে পেরেছিল। দাদাভাইয়ের দু’লাখ টাকা লুট হয়ে যাবার পর ওই সময়ে রচু যদি ওর সাথে না থাকত, তাহলে দাদাভাই কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারত না। তাই রচুকে আমি আমার জীবনের কোহিনুর হীরে বলে মনে করি রে। দাদাভাইয়ের স্ত্রী হয়ে ও আমার যে উপকার করেছে তার বিনিময়ে আমি ওর জন্যে, ভাইয়ের জন্যে, তোদের সকলের জন্যে যতকিছুই করিনা কেন, তা খুবই সামান্য”।
অর্চনা সীমন্তিনীর মুখের দিকে চেয়ে তার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি সত্যি খুব ভাল গো দিদিভাই। তবে দিদিভাই, কাল যখন রচুকে ফোনে পাচ্ছিলুম না, তখন আমার সত্যি খুব দুশ্চিন্তা হয়েছিল গো। তুমি যখন বললে যে রচু ওরা পরিতোষবাবুর সাথে কোথাও বেরিয়েছে, তখনই মনটা শান্ত হয়েছিল। আর রাতে রচুর কথা শুনেই বুঝলুম ও কাল কতটা খুশী হয়েছিল। আসলে অজানা অচেনা একটা বাড়িতে গিয়ে যে পূর্ব পরিচিত একজনের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে, এটা জানতে পেরেই রতুদা আর রচুর খুব ভাল লেগেছে। আর তাদের অমায়িক ব্যবহারে ওদের মন ভরে গেছে। সত্যি দিদিভাই, রচুর মনটা খারাপ বলে এত দুরে থেকেও তুমি কিকরে ওর মনের সব কষ্ট দুর করে দিলে। ভাবতেও অবাক লাগে। মনে হয় যেন ম্যাজিক। অবশ্য তোমার বন্ধু ওই পরিতোষবাবুও এজন্যে একই সমান ধন্যবাদের অংশীদার। রচু তো বলল যে উনি তোমার চেয়েও বড় পুলিশ অফিসার। আর কোলকাতার মত বড় শহরে তিনি কাজ করেন। তাই নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে তার ব্যস্ততাও তোমার চেয়ে অনেক বেশী। তা সত্বেও তিনি এতোটা সময় ধরে ওদের সাথে থাকলেন! এ তো শুধু তোমারই খাতিরে”।
সীমন্তিনী কিছু বলে ওঠার আগে লক্ষ্মী ঘরের কাজ করতে হবে উঠে চলে গেল। লক্ষ্মী চলে যেতে সীমন্তিনী বলল, “সত্যি রে অর্চু। ঠিক বলেছিস তুই। পরি সত্যিই আমাদের ধন্যবাদ পাবার মত কাজ একের পর এক করেই যাচ্ছে। তোকে তো আগেই বলেছি, পরি রচু আর দাদাভাইকে সুরক্ষিত রাখতে কত কী করে যাচ্ছে”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি আর পরিতোষবাবু দু’জনেই তো পুলিশেই কাজ কর। কিন্তু তুমি তো চাকরি পাবার পর এখানেই আছ। পরিতোষবাবুও কি এদিকে ছিলেন কখনও? নইলে তোমাদের পরিচয় আর এমন বন্ধুত্ব হল কি করে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “রচু আর দাদাভাইয়ের বিয়ের তিন চার দিন পরেই আমি আইপিএস পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করেছিলুম। দু’মাস বাদেই পরীক্ষা দিলুম, পাস করলুম। তার মাস দুয়েক পর ট্রেনিংএ যেতে হল হায়দ্রাবাদে। পরি তারও বছর চারেক আগে আইপিএস হয়েছিল। আমাদের ট্রেনিংএর সময় ও গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে আমাদের ক্লাস নিত” এই বলে একটু থেমে অর্চুকে জিজ্ঞেস করল, “এরপর কী হয়ে থাকতে পারে ভাব তো”?
অর্চনা দুষ্টু দুষ্টু ভাব করে হেসে বলল, “এমন সুন্দরী আমার দিদিভাইটাকে দেখে তিনি নিশ্চয়ই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। আর সেই থেকেই তোমাদের বন্ধুত্ব, তাই না”?
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “কিছুটা তা হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়। আমার প্রেমে পড়েছিল, সেটা পুরো না হলেও কিছুটা ঠিক। কিন্তু সেই থেকেই যে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে তা ঠিক নয়। এর পেছনে আরও কিছু কথা আছে”।
অর্চনা বলল, “বলোনা দিদিভাই। এর ভেতরে আর কী কথা আছে, সেটা বলতে যদি তোমার বাধা না থাকে, তাহলে বলো না। কোন ছোট্ট বেলায় মা-র কোলে মাথা রেখে আমরা দু’বোন একসাথে এমন গল্প শুনতুম। আজ কেন জানিনা, অমন করে গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোর কাছে সে’সব কথা বলতে বাধা নেই আমার। কিন্তু এ গল্প শেষ হতে কিন্তু অনেক সময় লাগবে। শুনবি”?
অর্চনা হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাতে সীমন্তিনী আবার বলল, “ঠিক আছে, যতটা ছোট করে বলা যায়, সে চেষ্টা করছি। তবে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে এটা ওটা জানতে চাইলে কিন্তু গল্প আর শেষ হবে না আজ। আচ্ছা শোন, তুই যেমন বললি, পরি আমাকে তেমন করে প্রেম নিবেদন কখনও করেনি। ও সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি তো ছোটবেলা থেকেই বিবাহিতা। তাই ......”
অর্চনা চমকে উঠে বলল, “কী বললে তুমি দিদিভাই? তুমি বিবাহিতা? তাও ছোটবেলা থেকে? মানে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “এ ব্যাপারটা প্লীজ তুই জানতে চাস নে বোন। ও’কথা শুধু আমি ছাড়া আর কেউ জানে না রে অর্চু। এমনকি রচু বা দাদাভাইও সেটা জানে না। শুধু এই কারনেই আমি মাধ্যমিক পাশ করবার পরেই ও বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এসেছি। আমার নিজের মা-বাবাও আর আমার খোঁজ খবর নেন না। অবশ্য তাদের সত্যিই কারো দোষ নেই। আমার জেদ আর আমার একগুয়েমিই এর জন্য দায়ী। তবে রচুকে আমি কথা দিয়েছি যে এ ব্যাপারে যদি কখনও আমাকে কিছু বলতেই হয়, তাহলে শুধু ওকেই বলব। তাই এ ব্যাপারটা নিয়ে আর কখনও কিছু জিজ্ঞেস করিসনে আমায়, প্লীজ” বলে একটু থেমে আবার বলল, “এবার যে কথটা বলতে শুরু করেছি সেটা শোন। ট্রেনিং সেন্টারে আমাকে দেখে পরির নিশ্চয়ই ভাল লেগেছিল। কিন্তু প্রেম করবার কথা না বলে ও সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আমি পরিকে জানিয়েছিলুম যে আমি বিবাহিতা। কিন্তু আমার কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া না দেখে বা আমার হাতে কোন শাঁখা পলা না দেখে ও আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু ভালভাবে ব্যাপারটা বোঝার পর ও আমাকে অনুরোধ করেছিল যে আমি যাতে ওর অন্ততঃ বন্ধু হয়ে থাকি। আমি সে কথাটা মেনে নিয়েছিলুম। কিন্তু তখনও আমি জানতুম না যে পরি আসলেই কতটা দুঃখী। সেটা জানলুম এবার কলকাতা গিয়ে। তখন আমিই শুধু নই, রচুও ব্যাপারটা জেনেছে। তোকে কি বলব অর্চু। ওর অতীতটা যে এমন দুঃখজনক সেটা আমি আগে একেবারেই বুঝতে পারিনি। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার প্রায় দেড় দু’বছর পর আমার ট্রেনিং শেষ হয়। আর তার পরপরই আমার এখানে পোস্টিং হয়। আর পরিতোষও তার আগেই কলকাতা ট্র্যান্সফার হয়ে আসে। আমাদের মাঝে নিয়মিত ফোনে কথা হত। কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ হত না। আমি ওকে বারবার বিয়ে করবার কথা বলতুম। অবশেষে একদিন ও বলল যে ও একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। কিন্তু আমি গিয়ে মেয়েটার সাথে কথা না বললে ও বিয়ে করবে না। তাই আগেরবার কলকাতা গিয়ে পরির পছন্দ করা মেয়েটাকে দেখতে রচুকে সঙ্গে নিয়েই আমি পরির সাথে দেখা করি। সেদিনই নীতার সাথে আমাদের দেখা হয়”।
এ’কথা শুনেই অর্চনা প্রায় চিৎকার করে উঠল, “নীতাদি? তার মানে কি নীতাদিকেই পরিতোষবাবু .....”
সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “সে’সব কথাই বলছি তোকে” বলে নবনীতা আর পরিতোষের ব্যাপারে সব কথা খুলে বলল। বলতে বলতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। সীমন্তিনীর মুখে নবনীতার কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্চনা বার বার কেঁদে ফেলছিল। মোটামুটিভাবে নবনীতার কথা শেষ করে সীমন্তিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কত মানুষের জীবনে যে এমন কত্তো বিষাদের উপাখ্যান জড়িয়ে আছে, সে’সব তো বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায়না রে। নবনীতাকে পরিতোষ আবার ফিরে না পেলে, বা আমি পরিকে বিয়ের ব্যাপারে চাপাচাপি না করলে পরি হয়তো নীতার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেও চাইত না। আর আমিও ওদের ব্যাপারে কিচ্ছুটি জানতে পারতুম না। রচুও আমার সাথে ছিল বলে সবটাই সেদিন জানতে পেরেছে। এই এত বড় পৃথিবীতে পরির আপন বলতে নিজের বলতে আর কেউ নেই। তাই তো সেদিন নীতা আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম যে আমরা যে করেই হোক ওর বিয়ে দেব। আর দ্যাখ, আমার সাথে ওর বন্ধুত্বের মর্য্যাদা দিয়েই ও দাদাভাই আর রচুর ওপর সদা সর্বদা নজর রেখে যাচ্ছে। আমিও দাদাভাই আর রচুর নিরাপত্তার কথা ভেবে স্বার্থপরের মত ওর কাছে একের পর এক বায়না করে যাচ্ছি, আর দিনে দিনে ওর কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছি রে। জানিনে বেঁচে থাকতে ওর ঋণ আমি শোধ করতে পারব কি না”।
এবার থেমে অর্চনার চোখের জল মুছতে মুছতে সীমন্তিনী বলল, “কাঁদিস নে বোন। যার যার কপালের লেখা তাকে সেটা ভোগ করতেই হয়। আমার কপালে যা আছে আমিও সেটাই ভোগ করছি। তোর কপালে যে দুর্ভোগ ছিল তা তুই ভোগ করেছিস। আর নীতারও তাই। ও-ও ওর কপালের দুর্ভোগ ভোগ করেছে। জানিনে বিধাতা আমাদের কার কপালে কী ভবিতব্য লিখে রেখেছেন। কিন্তু আমি মনপ্রাণ দিয়ে শুধু এটুকুর চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমার আশেপাশে জড়িয়ে থাকা এই লোকগুলোর মুখে আমি হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারি। নিজের মা-বাবাকে, নিজের বাড়ির সকলকে যে দুঃখ আমি দিয়েছি, এভাবেই যদি তার প্রায়শ্চিত্ত করে উঠতে পারি। যাক, ওঠ এবার। নীতার ফেরার সময় হয়ে এল। আর তোরও ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে”।
অর্চনা সীমন্তিনীর কোল থেকে উঠে নিজের চোখ ভাল করে মুছতে মুছতে বলল, “পরিতোষবাবু আর নীতাদির কথা শুনে মনটা সত্যি খুব ভারী হয়ে গেল গো দিদিভাই। লোকটা যে দু’দুটো মেয়েকে পছন্দ করেছিল, সেই দু’জনকেই সে হারিয়ে বসেছে। আহা রে। আমি মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব দিদিভাই, যেন তোমার আর নীতাদির চেষ্টা সফল হয়। পরিতোষবাবুর জন্যে সত্যিই তোমরা একটা ভাল মেয়ে যেন খুঁজে পাও। লোকটার নিঃসঙ্গ জীবনে একজন সত্যিকারের সঙ্গিনী যেন তোমরা জুটিয়ে দিতে পার”। বলে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
ওষুধ খেয়ে খানিকক্ষণ পরে আবার সীমন্তিনীর কাছে এসে বসে বলল, “তা দিদিভাই, তুমি বা নীতাদি কোনও মেয়ের খোঁজ করেছ পরিতোষবাবুর জন্যে”?
সীমন্তিনী কাতর চোখে অর্চনার দিকে চেয়ে বলল, “কই আর তেমন করে উঠতে পারছি বল। রচু আর দাদাভাইয়ের চিন্তাতেই তো মরছি আমি, আবার একদিকে ভাইয়ের পড়াশোনার কথা, আরেকদিকে অফিসের কাজের চাপ, আরেকদিকে কালচিনির বাড়ি তৈরীর ব্যাপার, আবার দাদাভাইয়ের ইনস্টিটিউটের মালিক মহিমা বৌদির ব্যাপার, এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তো আমি হিমশিম খাচ্ছি। কিকরে আর পাত্রী খুঁজি আমি বল। আর নীতাই বা কি করবে। ও তো এখানে একেবারে নতুন। ও আর কাকে চেনে কাকে জানে যে পাত্রী খুঁজবে। তবু ক’দিন আগে একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। কিন্তু কাজের ব্যস্ততাতেই তাদের সাথে এখনও কোন যোগাযোগ সেভাবে করে উঠতে পারিনি। কিন্তু একটা ভাল মেয়ে খুঁজে তো বের করতেই হবে পরির জন্যে। হ্যাঁরে তোদের কালচিনিতে তোর জানাশোনা কোনও ভাল পরিবারের ভদ্র সভ্য কোন ', মেয়ে আছে তোর জানাশোনার মধ্যে”?
অর্চনা মুখ কালো করে জবাব দিল, “গত সাতটা বছর ধরে কালচিনির কোনও খবরই তো আমি জানতে পেতুম না দিদিভাই। আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর আমি তো কোথাও বেরোতুমই না। বাড়িতেই শুধু থাকতুম। এই প্রথম আমি বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে তোমার কাছে এসেছি। তাই কোনও মেয়ের খোঁজ তো আমার কাছেও নেই। তবে তুমি বাবার সাথে কথা বলো না। বাবার জানাশোনার মধ্যে কোন মেয়ের খোঁজ থাকতেও পারে”।
সীমন্তিনী চিন্তার ভাব করে বলল, “হু, কথাটা মন্দ বলিস নি। মেসো তো এতদিন বাড়ি বাড়ি যজমানি করেই কাটিয়েছেন। কোন বাড়িতে কোন মেয়ে আছে, তা তিনি নিশ্চয়ই জানেন। মেসোর সাথেই কথা বলে দেখি কাজের কাজ কিছু হয় কি না .....”
সীমন্তিনীর কথা শেষ হবার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। সীমন্তিনী সাথে সাথে উঠে বলল, “ওই নীতা এল বুঝি। চল চল”।
তারা দু’জন মূল দড়জার কাছে যাবার আগেই লক্ষ্মী দড়জা খুলে দিয়েছিল। নীতা ভেতরে ঢুকে অর্চনার সাথে সীমন্তিনীকে দেখেই বলে উঠল, “একি দিদি? তুমি এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে এসেছ”?
সীমন্তিনী নীতার একটা হাত ধরে বলল, “নারে, তোদের ওখান থেকে এসে আর আমি অফিসে যাইনি আজ। আসলে আজ তেমন কাজ ছিল না। তাই ঘরে বসে বসে অর্চুর সাথে গল্প করে কাটালাম এতোক্ষণ”।
নীতা সকলের সাথে ঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে বলল, “বিকেল থেকে এতো রাত অব্দি অর্চুর সাথে গল্প করে কাটালে? তাহলে আমার সাথে আর কোনও গল্প করবে না”?
সীমন্তিনী বলল, “করবো রে পাগলী করবো, ভাবিস নে। যা পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আমার ঘরে আয়”।
নীতা নিজের ঘরের দিকে এক পা এগিয়েও থেমে গিয়ে আবার বলল, “তোমরা যখন গিয়েছিলে, তখন আমার কাউন্টারে ভিড় ছিল সত্যি। কিন্তু তাই বলে আমার সাথে একটা কথাও বললে না তোমরা? আর জয়া ম্যামও তোমাদের দেখেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছ বলে তিনি আমাকেও জিজ্ঞেস করছিলেন, এমন কেন করলে তোমরা”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “রোজ রোজ তোর জয়া ম্যামের চেম্বারে গিয়ে এটা সেটা খেয়ে আসব, সেটা কি ভাল দেখায়, বল? আজ ইচ্ছে করেই আমি তার চেম্বারে যাই নি। তবে উনি যে তার চেম্বারে বসেই সিসি টিভি ক্যামেরায় আমাকে দেখেছেন, সেটা তো জানিই। আর আজও উনি ম্যানেজারবাবুকে স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেবার কথা বলে দিয়েছেন, সেটাও জানি। তুই তাকে বলিস যে, আমি একটু ব্যস্ত ছিলুম বলেই তার সাথে আজ দেখা করিনি। তাহলেই হবে। পরে না হয় আবার কোন একদিন তার কাছে যাব। এবার যা, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আর শোন, আমার ঘরেই আসিস। আমি ততক্ষণ রচুর সাথে একটু কথা বলে নিই। তারপর রাত ন’টার পর আরেকটা জরুরী ফোন করতে হবে” বলে নিজের ঘরে চলে গেল।
*******************
রাত ন’টা বাজবার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পরিতোষ পেছনের রাস্তা দিয়ে বিট্টুদের বাড়িতে ঢুকল। শেখর আর বিপ্লব দু’জনে আরও পাঁচ মিনিট আগেই বিট্টুদের বাড়িতে এসেছে। পরিতোষ পেছনের ঘরে এসে ঢুকতেই শেখর আর বিপ্লব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পরিতোষ চেয়ারে বসে ওদের দু’জনকে চেয়ারে বসতে বলে বিট্টুকে ডাকল। বিট্টু আসতেই পরিতোষ তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোরা সবাই ভাল আছিস তো ভাই? মাসিমা কেমন আছেন”?
বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা, মা আমি দু’জনেই ভাল আছি। মা-র সাথে দেখা করলেন না”?
পরিতোষ বলল, “মাসিমার সাথে তো অবশ্যই দেখা করব। তবে আগে এদের সাথে দরকারী কাজগুলো সেরে নিই” বলে নিজের পকেট থেকে পার্স বের করতে করতে বলল, “ঘরে ফ্লাস্ক আছে রে? পাঁচ ছ’ কাপ চা আনবার মত”?
বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা আছে। কিন্তু চা তো মা-ই বানাবেন বলেছেন”।
পরিতোষ পার্স থেকে একশ’ টাকার একটা নোট বের করে বিট্টুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মাসিমার হাতের চা আমি পরে খাব। এদের সাথে মিটিং শেষ করে নিই তারপর। এখন এরা এসেছে, এরপর আবার আরেকজন আসবে। তুই এক কাজ করনা ভাই, একটু কষ্ট করে সামনের দোকানটা থেকে ফ্লাস্কে করে ছ’কাপ চা আর খাবার কিছু একটা নিয়ে আয়। পকোরা বা চপ টপ যা পাস কিছু একটা নিয়ে আসিস চার পাঁচ জনের মত। আর মাসিমাকে বলে যাস, আমি কাজ শেষ করে তার ঘরে গিয়ে তার হাতের চা খাব”।
বিট্টু টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে “ঠিক আছে দাদা” বলে বেড়িয়ে গেল। পরিতোষ তখন শেখর আর বিপ্লবের দিকে মুখ করে বলল, “হ্যাঁ এবার বল। সবগুলো জিনিস নিয়ে এসেছিস তো”?
শেখর নিজের কোলের ওপর রাখা ব্যাগটার দিকে ঈশারা করে বলল, “হ্যাঁ স্যার, সব রেডি। এ ব্যাগেই আছে। বের করব”?
পরিতোষ বলল, “হু, বের কর”।
____________________________
সীমন্তিনী আগের মতই অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “নারে অর্চু। আসলে রচুই বুঝি আমার কাছে আমার পূর্বজন্মের কোন পূণ্যফল। জানিস অর্চু সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে আমি পাগলের মত আমার দাদাভাইকে ভালবাসতুম। দাদাভাইয়ের গায়ে সামান্য আঁচড়টুকু লাগলেও সকলের সাথে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিতুম। দাদাভাইকে বাড়ির কেউ বকাবকি করলে আমি দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দিতুম। কেউ আমাকে বাগে আনতে পারত না। এতোটাই জেদী ছিলুম আমি। আমার জেদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল বাড়ির সবাই। জলপাইগুড়িতে রচুকে যেদিন প্রথম দেখেছিলুম, সেদিনই আমার মনে হয়েছিল, আমার দাদাভাইয়ের জন্য এই মেয়েটাই একমাত্র উপযুক্ত। আমার ধারণা মিথ্যে হয়নি রে। রচু সত্যি সত্যি নিজেকে দাদাভাইয়ের উপযুক্ত বলে প্রমাণ করছে। দাদাভাইয়ের সাথে সাথে ও বাড়ির প্রত্যেকটা লোককে এমন করে আপন করে নিয়েছে যে সবাই রচুকে নিজেদের নয়নের মণি বলে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। দাদাভাই যখন ঠিক করল কলকাতা যাবে, তখন বাড়িতে কেউই তার কথা মানতে চাইছিল না। রচুও রাজী ছিল না বাড়ির সকলকে ছেড়ে দাদাভাইয়ের সাথে যেতে। আবার দাদাভাইকে ছেড়ে বাড়িতে থাকবার কথাও মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। তখনও ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমিই রাজী করেছি। এর জন্যেও হয়ত বাড়ির লোকেরা আমার ওপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত যে কতটা ঠিক তা এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ির লোকেরা বুঝতে পেরেছিল। দাদাভাইয়ের দু’লাখ টাকা লুট হয়ে যাবার পর ওই সময়ে রচু যদি ওর সাথে না থাকত, তাহলে দাদাভাই কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারত না। তাই রচুকে আমি আমার জীবনের কোহিনুর হীরে বলে মনে করি রে। দাদাভাইয়ের স্ত্রী হয়ে ও আমার যে উপকার করেছে তার বিনিময়ে আমি ওর জন্যে, ভাইয়ের জন্যে, তোদের সকলের জন্যে যতকিছুই করিনা কেন, তা খুবই সামান্য”।
অর্চনা সীমন্তিনীর মুখের দিকে চেয়ে তার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি সত্যি খুব ভাল গো দিদিভাই। তবে দিদিভাই, কাল যখন রচুকে ফোনে পাচ্ছিলুম না, তখন আমার সত্যি খুব দুশ্চিন্তা হয়েছিল গো। তুমি যখন বললে যে রচু ওরা পরিতোষবাবুর সাথে কোথাও বেরিয়েছে, তখনই মনটা শান্ত হয়েছিল। আর রাতে রচুর কথা শুনেই বুঝলুম ও কাল কতটা খুশী হয়েছিল। আসলে অজানা অচেনা একটা বাড়িতে গিয়ে যে পূর্ব পরিচিত একজনের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে, এটা জানতে পেরেই রতুদা আর রচুর খুব ভাল লেগেছে। আর তাদের অমায়িক ব্যবহারে ওদের মন ভরে গেছে। সত্যি দিদিভাই, রচুর মনটা খারাপ বলে এত দুরে থেকেও তুমি কিকরে ওর মনের সব কষ্ট দুর করে দিলে। ভাবতেও অবাক লাগে। মনে হয় যেন ম্যাজিক। অবশ্য তোমার বন্ধু ওই পরিতোষবাবুও এজন্যে একই সমান ধন্যবাদের অংশীদার। রচু তো বলল যে উনি তোমার চেয়েও বড় পুলিশ অফিসার। আর কোলকাতার মত বড় শহরে তিনি কাজ করেন। তাই নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে তার ব্যস্ততাও তোমার চেয়ে অনেক বেশী। তা সত্বেও তিনি এতোটা সময় ধরে ওদের সাথে থাকলেন! এ তো শুধু তোমারই খাতিরে”।
সীমন্তিনী কিছু বলে ওঠার আগে লক্ষ্মী ঘরের কাজ করতে হবে উঠে চলে গেল। লক্ষ্মী চলে যেতে সীমন্তিনী বলল, “সত্যি রে অর্চু। ঠিক বলেছিস তুই। পরি সত্যিই আমাদের ধন্যবাদ পাবার মত কাজ একের পর এক করেই যাচ্ছে। তোকে তো আগেই বলেছি, পরি রচু আর দাদাভাইকে সুরক্ষিত রাখতে কত কী করে যাচ্ছে”।
অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি আর পরিতোষবাবু দু’জনেই তো পুলিশেই কাজ কর। কিন্তু তুমি তো চাকরি পাবার পর এখানেই আছ। পরিতোষবাবুও কি এদিকে ছিলেন কখনও? নইলে তোমাদের পরিচয় আর এমন বন্ধুত্ব হল কি করে”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “রচু আর দাদাভাইয়ের বিয়ের তিন চার দিন পরেই আমি আইপিএস পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করেছিলুম। দু’মাস বাদেই পরীক্ষা দিলুম, পাস করলুম। তার মাস দুয়েক পর ট্রেনিংএ যেতে হল হায়দ্রাবাদে। পরি তারও বছর চারেক আগে আইপিএস হয়েছিল। আমাদের ট্রেনিংএর সময় ও গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে আমাদের ক্লাস নিত” এই বলে একটু থেমে অর্চুকে জিজ্ঞেস করল, “এরপর কী হয়ে থাকতে পারে ভাব তো”?
অর্চনা দুষ্টু দুষ্টু ভাব করে হেসে বলল, “এমন সুন্দরী আমার দিদিভাইটাকে দেখে তিনি নিশ্চয়ই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। আর সেই থেকেই তোমাদের বন্ধুত্ব, তাই না”?
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “কিছুটা তা হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়। আমার প্রেমে পড়েছিল, সেটা পুরো না হলেও কিছুটা ঠিক। কিন্তু সেই থেকেই যে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে তা ঠিক নয়। এর পেছনে আরও কিছু কথা আছে”।
অর্চনা বলল, “বলোনা দিদিভাই। এর ভেতরে আর কী কথা আছে, সেটা বলতে যদি তোমার বাধা না থাকে, তাহলে বলো না। কোন ছোট্ট বেলায় মা-র কোলে মাথা রেখে আমরা দু’বোন একসাথে এমন গল্প শুনতুম। আজ কেন জানিনা, অমন করে গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোর কাছে সে’সব কথা বলতে বাধা নেই আমার। কিন্তু এ গল্প শেষ হতে কিন্তু অনেক সময় লাগবে। শুনবি”?
অর্চনা হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাতে সীমন্তিনী আবার বলল, “ঠিক আছে, যতটা ছোট করে বলা যায়, সে চেষ্টা করছি। তবে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে এটা ওটা জানতে চাইলে কিন্তু গল্প আর শেষ হবে না আজ। আচ্ছা শোন, তুই যেমন বললি, পরি আমাকে তেমন করে প্রেম নিবেদন কখনও করেনি। ও সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি তো ছোটবেলা থেকেই বিবাহিতা। তাই ......”
অর্চনা চমকে উঠে বলল, “কী বললে তুমি দিদিভাই? তুমি বিবাহিতা? তাও ছোটবেলা থেকে? মানে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “এ ব্যাপারটা প্লীজ তুই জানতে চাস নে বোন। ও’কথা শুধু আমি ছাড়া আর কেউ জানে না রে অর্চু। এমনকি রচু বা দাদাভাইও সেটা জানে না। শুধু এই কারনেই আমি মাধ্যমিক পাশ করবার পরেই ও বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এসেছি। আমার নিজের মা-বাবাও আর আমার খোঁজ খবর নেন না। অবশ্য তাদের সত্যিই কারো দোষ নেই। আমার জেদ আর আমার একগুয়েমিই এর জন্য দায়ী। তবে রচুকে আমি কথা দিয়েছি যে এ ব্যাপারে যদি কখনও আমাকে কিছু বলতেই হয়, তাহলে শুধু ওকেই বলব। তাই এ ব্যাপারটা নিয়ে আর কখনও কিছু জিজ্ঞেস করিসনে আমায়, প্লীজ” বলে একটু থেমে আবার বলল, “এবার যে কথটা বলতে শুরু করেছি সেটা শোন। ট্রেনিং সেন্টারে আমাকে দেখে পরির নিশ্চয়ই ভাল লেগেছিল। কিন্তু প্রেম করবার কথা না বলে ও সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আমি পরিকে জানিয়েছিলুম যে আমি বিবাহিতা। কিন্তু আমার কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া না দেখে বা আমার হাতে কোন শাঁখা পলা না দেখে ও আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু ভালভাবে ব্যাপারটা বোঝার পর ও আমাকে অনুরোধ করেছিল যে আমি যাতে ওর অন্ততঃ বন্ধু হয়ে থাকি। আমি সে কথাটা মেনে নিয়েছিলুম। কিন্তু তখনও আমি জানতুম না যে পরি আসলেই কতটা দুঃখী। সেটা জানলুম এবার কলকাতা গিয়ে। তখন আমিই শুধু নই, রচুও ব্যাপারটা জেনেছে। তোকে কি বলব অর্চু। ওর অতীতটা যে এমন দুঃখজনক সেটা আমি আগে একেবারেই বুঝতে পারিনি। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার প্রায় দেড় দু’বছর পর আমার ট্রেনিং শেষ হয়। আর তার পরপরই আমার এখানে পোস্টিং হয়। আর পরিতোষও তার আগেই কলকাতা ট্র্যান্সফার হয়ে আসে। আমাদের মাঝে নিয়মিত ফোনে কথা হত। কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ হত না। আমি ওকে বারবার বিয়ে করবার কথা বলতুম। অবশেষে একদিন ও বলল যে ও একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। কিন্তু আমি গিয়ে মেয়েটার সাথে কথা না বললে ও বিয়ে করবে না। তাই আগেরবার কলকাতা গিয়ে পরির পছন্দ করা মেয়েটাকে দেখতে রচুকে সঙ্গে নিয়েই আমি পরির সাথে দেখা করি। সেদিনই নীতার সাথে আমাদের দেখা হয়”।
এ’কথা শুনেই অর্চনা প্রায় চিৎকার করে উঠল, “নীতাদি? তার মানে কি নীতাদিকেই পরিতোষবাবু .....”
সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “সে’সব কথাই বলছি তোকে” বলে নবনীতা আর পরিতোষের ব্যাপারে সব কথা খুলে বলল। বলতে বলতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। সীমন্তিনীর মুখে নবনীতার কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্চনা বার বার কেঁদে ফেলছিল। মোটামুটিভাবে নবনীতার কথা শেষ করে সীমন্তিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কত মানুষের জীবনে যে এমন কত্তো বিষাদের উপাখ্যান জড়িয়ে আছে, সে’সব তো বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায়না রে। নবনীতাকে পরিতোষ আবার ফিরে না পেলে, বা আমি পরিকে বিয়ের ব্যাপারে চাপাচাপি না করলে পরি হয়তো নীতার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেও চাইত না। আর আমিও ওদের ব্যাপারে কিচ্ছুটি জানতে পারতুম না। রচুও আমার সাথে ছিল বলে সবটাই সেদিন জানতে পেরেছে। এই এত বড় পৃথিবীতে পরির আপন বলতে নিজের বলতে আর কেউ নেই। তাই তো সেদিন নীতা আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম যে আমরা যে করেই হোক ওর বিয়ে দেব। আর দ্যাখ, আমার সাথে ওর বন্ধুত্বের মর্য্যাদা দিয়েই ও দাদাভাই আর রচুর ওপর সদা সর্বদা নজর রেখে যাচ্ছে। আমিও দাদাভাই আর রচুর নিরাপত্তার কথা ভেবে স্বার্থপরের মত ওর কাছে একের পর এক বায়না করে যাচ্ছি, আর দিনে দিনে ওর কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছি রে। জানিনে বেঁচে থাকতে ওর ঋণ আমি শোধ করতে পারব কি না”।
এবার থেমে অর্চনার চোখের জল মুছতে মুছতে সীমন্তিনী বলল, “কাঁদিস নে বোন। যার যার কপালের লেখা তাকে সেটা ভোগ করতেই হয়। আমার কপালে যা আছে আমিও সেটাই ভোগ করছি। তোর কপালে যে দুর্ভোগ ছিল তা তুই ভোগ করেছিস। আর নীতারও তাই। ও-ও ওর কপালের দুর্ভোগ ভোগ করেছে। জানিনে বিধাতা আমাদের কার কপালে কী ভবিতব্য লিখে রেখেছেন। কিন্তু আমি মনপ্রাণ দিয়ে শুধু এটুকুর চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমার আশেপাশে জড়িয়ে থাকা এই লোকগুলোর মুখে আমি হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারি। নিজের মা-বাবাকে, নিজের বাড়ির সকলকে যে দুঃখ আমি দিয়েছি, এভাবেই যদি তার প্রায়শ্চিত্ত করে উঠতে পারি। যাক, ওঠ এবার। নীতার ফেরার সময় হয়ে এল। আর তোরও ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে”।
অর্চনা সীমন্তিনীর কোল থেকে উঠে নিজের চোখ ভাল করে মুছতে মুছতে বলল, “পরিতোষবাবু আর নীতাদির কথা শুনে মনটা সত্যি খুব ভারী হয়ে গেল গো দিদিভাই। লোকটা যে দু’দুটো মেয়েকে পছন্দ করেছিল, সেই দু’জনকেই সে হারিয়ে বসেছে। আহা রে। আমি মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব দিদিভাই, যেন তোমার আর নীতাদির চেষ্টা সফল হয়। পরিতোষবাবুর জন্যে সত্যিই তোমরা একটা ভাল মেয়ে যেন খুঁজে পাও। লোকটার নিঃসঙ্গ জীবনে একজন সত্যিকারের সঙ্গিনী যেন তোমরা জুটিয়ে দিতে পার”। বলে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
ওষুধ খেয়ে খানিকক্ষণ পরে আবার সীমন্তিনীর কাছে এসে বসে বলল, “তা দিদিভাই, তুমি বা নীতাদি কোনও মেয়ের খোঁজ করেছ পরিতোষবাবুর জন্যে”?
সীমন্তিনী কাতর চোখে অর্চনার দিকে চেয়ে বলল, “কই আর তেমন করে উঠতে পারছি বল। রচু আর দাদাভাইয়ের চিন্তাতেই তো মরছি আমি, আবার একদিকে ভাইয়ের পড়াশোনার কথা, আরেকদিকে অফিসের কাজের চাপ, আরেকদিকে কালচিনির বাড়ি তৈরীর ব্যাপার, আবার দাদাভাইয়ের ইনস্টিটিউটের মালিক মহিমা বৌদির ব্যাপার, এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তো আমি হিমশিম খাচ্ছি। কিকরে আর পাত্রী খুঁজি আমি বল। আর নীতাই বা কি করবে। ও তো এখানে একেবারে নতুন। ও আর কাকে চেনে কাকে জানে যে পাত্রী খুঁজবে। তবু ক’দিন আগে একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। কিন্তু কাজের ব্যস্ততাতেই তাদের সাথে এখনও কোন যোগাযোগ সেভাবে করে উঠতে পারিনি। কিন্তু একটা ভাল মেয়ে খুঁজে তো বের করতেই হবে পরির জন্যে। হ্যাঁরে তোদের কালচিনিতে তোর জানাশোনা কোনও ভাল পরিবারের ভদ্র সভ্য কোন ', মেয়ে আছে তোর জানাশোনার মধ্যে”?
অর্চনা মুখ কালো করে জবাব দিল, “গত সাতটা বছর ধরে কালচিনির কোনও খবরই তো আমি জানতে পেতুম না দিদিভাই। আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর আমি তো কোথাও বেরোতুমই না। বাড়িতেই শুধু থাকতুম। এই প্রথম আমি বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে তোমার কাছে এসেছি। তাই কোনও মেয়ের খোঁজ তো আমার কাছেও নেই। তবে তুমি বাবার সাথে কথা বলো না। বাবার জানাশোনার মধ্যে কোন মেয়ের খোঁজ থাকতেও পারে”।
সীমন্তিনী চিন্তার ভাব করে বলল, “হু, কথাটা মন্দ বলিস নি। মেসো তো এতদিন বাড়ি বাড়ি যজমানি করেই কাটিয়েছেন। কোন বাড়িতে কোন মেয়ে আছে, তা তিনি নিশ্চয়ই জানেন। মেসোর সাথেই কথা বলে দেখি কাজের কাজ কিছু হয় কি না .....”
সীমন্তিনীর কথা শেষ হবার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। সীমন্তিনী সাথে সাথে উঠে বলল, “ওই নীতা এল বুঝি। চল চল”।
তারা দু’জন মূল দড়জার কাছে যাবার আগেই লক্ষ্মী দড়জা খুলে দিয়েছিল। নীতা ভেতরে ঢুকে অর্চনার সাথে সীমন্তিনীকে দেখেই বলে উঠল, “একি দিদি? তুমি এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে এসেছ”?
সীমন্তিনী নীতার একটা হাত ধরে বলল, “নারে, তোদের ওখান থেকে এসে আর আমি অফিসে যাইনি আজ। আসলে আজ তেমন কাজ ছিল না। তাই ঘরে বসে বসে অর্চুর সাথে গল্প করে কাটালাম এতোক্ষণ”।
নীতা সকলের সাথে ঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে বলল, “বিকেল থেকে এতো রাত অব্দি অর্চুর সাথে গল্প করে কাটালে? তাহলে আমার সাথে আর কোনও গল্প করবে না”?
সীমন্তিনী বলল, “করবো রে পাগলী করবো, ভাবিস নে। যা পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আমার ঘরে আয়”।
নীতা নিজের ঘরের দিকে এক পা এগিয়েও থেমে গিয়ে আবার বলল, “তোমরা যখন গিয়েছিলে, তখন আমার কাউন্টারে ভিড় ছিল সত্যি। কিন্তু তাই বলে আমার সাথে একটা কথাও বললে না তোমরা? আর জয়া ম্যামও তোমাদের দেখেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছ বলে তিনি আমাকেও জিজ্ঞেস করছিলেন, এমন কেন করলে তোমরা”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “রোজ রোজ তোর জয়া ম্যামের চেম্বারে গিয়ে এটা সেটা খেয়ে আসব, সেটা কি ভাল দেখায়, বল? আজ ইচ্ছে করেই আমি তার চেম্বারে যাই নি। তবে উনি যে তার চেম্বারে বসেই সিসি টিভি ক্যামেরায় আমাকে দেখেছেন, সেটা তো জানিই। আর আজও উনি ম্যানেজারবাবুকে স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেবার কথা বলে দিয়েছেন, সেটাও জানি। তুই তাকে বলিস যে, আমি একটু ব্যস্ত ছিলুম বলেই তার সাথে আজ দেখা করিনি। তাহলেই হবে। পরে না হয় আবার কোন একদিন তার কাছে যাব। এবার যা, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আর শোন, আমার ঘরেই আসিস। আমি ততক্ষণ রচুর সাথে একটু কথা বলে নিই। তারপর রাত ন’টার পর আরেকটা জরুরী ফোন করতে হবে” বলে নিজের ঘরে চলে গেল।
*******************
রাত ন’টা বাজবার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পরিতোষ পেছনের রাস্তা দিয়ে বিট্টুদের বাড়িতে ঢুকল। শেখর আর বিপ্লব দু’জনে আরও পাঁচ মিনিট আগেই বিট্টুদের বাড়িতে এসেছে। পরিতোষ পেছনের ঘরে এসে ঢুকতেই শেখর আর বিপ্লব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পরিতোষ চেয়ারে বসে ওদের দু’জনকে চেয়ারে বসতে বলে বিট্টুকে ডাকল। বিট্টু আসতেই পরিতোষ তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোরা সবাই ভাল আছিস তো ভাই? মাসিমা কেমন আছেন”?
বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা, মা আমি দু’জনেই ভাল আছি। মা-র সাথে দেখা করলেন না”?
পরিতোষ বলল, “মাসিমার সাথে তো অবশ্যই দেখা করব। তবে আগে এদের সাথে দরকারী কাজগুলো সেরে নিই” বলে নিজের পকেট থেকে পার্স বের করতে করতে বলল, “ঘরে ফ্লাস্ক আছে রে? পাঁচ ছ’ কাপ চা আনবার মত”?
বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা আছে। কিন্তু চা তো মা-ই বানাবেন বলেছেন”।
পরিতোষ পার্স থেকে একশ’ টাকার একটা নোট বের করে বিট্টুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মাসিমার হাতের চা আমি পরে খাব। এদের সাথে মিটিং শেষ করে নিই তারপর। এখন এরা এসেছে, এরপর আবার আরেকজন আসবে। তুই এক কাজ করনা ভাই, একটু কষ্ট করে সামনের দোকানটা থেকে ফ্লাস্কে করে ছ’কাপ চা আর খাবার কিছু একটা নিয়ে আয়। পকোরা বা চপ টপ যা পাস কিছু একটা নিয়ে আসিস চার পাঁচ জনের মত। আর মাসিমাকে বলে যাস, আমি কাজ শেষ করে তার ঘরে গিয়ে তার হাতের চা খাব”।
বিট্টু টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে “ঠিক আছে দাদা” বলে বেড়িয়ে গেল। পরিতোষ তখন শেখর আর বিপ্লবের দিকে মুখ করে বলল, “হ্যাঁ এবার বল। সবগুলো জিনিস নিয়ে এসেছিস তো”?
শেখর নিজের কোলের ওপর রাখা ব্যাগটার দিকে ঈশারা করে বলল, “হ্যাঁ স্যার, সব রেডি। এ ব্যাগেই আছে। বের করব”?
পরিতোষ বলল, “হু, বের কর”।
____________________________