21-03-2020, 07:12 PM
(Update No. 184)
সীমন্তিনীও ফোন বন্ধ করে রচনার কান্নার ব্যাপারে ভাবতে লাগল। তার নিজের মনটাও ভারী হয়ে উঠল। রচনাকে যেমন রাজগঞ্জের বাড়ির প্রত্যেকে ভালবাসে, তেমনি রচনাও তো বিয়ের পর থেকেই ও বাড়ির সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। আর চন্দু তো রচনার সবচেয়ে আদরের ছিল ও বাড়িতে। কলকাতা যাবার সময় তো সারাটা পথেই ও চন্দুর কথা ভেবে ভেবে কেঁদেছে। এদিকে চন্দুটারও খুব করুণ অবস্থা হয়েছিল তখন। অনেক কষ্টে বাড়ির লোকেরা ওকে বোঝাতে পারলেও অমন হাসিখুশী মেয়েটা সেই থেকে নাকি খুব চুপচাপ হয়ে গেছে, সীমন্তিনীর নিজেরও খুব ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে চন্দুকে একটু কাছে পেতে। তিন বছর হয়ে গেল, ও বাড়ির কাউকে সে দেখতে পায়নি। চন্দুটা নাজানি কত বড় হয়ে গেছে এতদিনে। ভাবতে ভাবতে সীমন্তিনীর চোখ দিয়েও জল গড়াতে লাগল।
সীমন্তিনীকে কাঁদতে দেখে নবনীতা আর অর্চনা ঘাবড়ে গেল। তারা সীমন্তিনীকে সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সীমন্তিনী একটু ধাতস্থ হয়ে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “ঠিক আছে, ছাড় আমাকে, আমাকে আরেকটা ফোন এখনই করতে হবে” বলে চন্দ্রকান্তবাবুর নাম্বার ডায়াল করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ও’পাশ থেকে চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “কীরে, মন্তি? এতো রাতে ফোন করেছিস কেন? কি হয়েছে রে মা? তুই ঠিক আছিস তো”?
সীমন্তিনী ভারী গলায় বলল, “না কাকু, কিচ্ছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। আসলে বাড়ির সকলের কথা খুব মনে পড়ছে গো আজ। তাই ফোনটা করলুম। আচ্ছা কাকু, চন্দু কেমন আছে গো? ঠিকমত পড়াশোনা করছে তো? আগের মত হাসিখুশী থাকছে তো”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁরে চন্দু তো ভালই আছে। পড়াশোনাতেও আগের চেয়ে অনেক ভাল রেজাল্ট করছে। ওর কলেজের মাষ্টার মশাইরা তো বলছেন যে চন্দুই বোধহয় এবার ওদের ক্লাসে প্রথম হবে। তা তুই কি ওর সাথে কথা বলতে চাইছিস? কিন্তু ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে রে মা”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “না না কাকু, ওকে ডাকতে হবে না। আসলে রচু একটু আগে ফোন করে বলল যে চন্দুকে অনেকদিন ধরে দেখতে পাচ্ছে না বলে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই আমি ফোনটা করলুম চন্দুর খবর নেবার জন্যে। এর আগে তুমি বলেছিলে যে চন্দু আগের মত হাসি খুশী নেই, খেলাধূলোও করে না, হৈ হুল্লোড় করা তো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। এখনও কি অমনই আছে কাকু”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “আমরা তো আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি রে মা। কিন্তু চন্দু কিছুতেই আর আগের মত উচ্ছল প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে নারে। তবে বড়বৌমার কথাতেই ও খাওয়া দাওয়া পড়াশোনা সবকিছুই ঠিকঠাক মত করছে। শরীর স্বাস্থ্যও ঠিক আছে। শুধু আগের সেই উচ্ছলতাটাই হারিয়ে ফেলেছে। ওর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান এখন বড়বৌমার মত ভাল রেজাল্ট করা। আর জানিস মন্তি? রোজ ঘুম থেকে উঠে আর শুতে যাবার আগে ও বড়বৌমার ছবিতে প্রণাম করে। এসব দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানিস, বড়বৌমা বোধহয় ওকে কোনও যাদুতে বন্দী করে রেখেছে”।
সীমন্তিনী খুব ধীর গলায় বলল, “রচু তো আমাদের সবাইকেই যাদুতে বন্দী করে রেখেছে কাকু। আচ্ছা যাক সে কথা। শোনো, আজ এখান থেকে তোমাদের সকলের জন্য কিছু কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। কার জন্যে কোনটা, তা সব লিখে দিয়েছি। তবে প্রায় তিন বছর যাবৎ তোমাদের কাউকে আমি দেখিনি। মাপ আন্দাজ করে কিনেছি। কারো পোশাক যদি মাপে ছোটবড় হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিও দেরী না করে। আর সে জন্যেই হাতে সময় থাকতেই ওগুলো পাঠালাম। যাতে বদলাতে হলেও পূজোর আগেই সেটা করে ফেলা যায়। আর হ্যাঁ কাকু, এবার তো আমার হয়ে প্রণাম করবার কেউ নেই বাড়িতে। তাই তোমরা সবাই আমার প্রণাম নিও” বলে কেঁদে ফেলল।
চন্দ্রকান্তবাবু ওদিক থেকে সীমন্তিনীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মন্তি মা, এমন অভিমান করে এভাবে আর কতদিন থাকবি মা? একবারটি আয় না মা দু’দিনের জন্য। তোকেও তো আমাদের দেখতে ইচ্ছে হয় রে। কিন্তু তুই তো তোর মাথার দিব্যি দিয়ে আমাদের তোর কাছে যাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছিস চিরতরে। আর তুইও যে ভেতরে ভেতরে কেঁদে মরছিস, সেটাও তো আমি খুব ভালই জানিরে মা। একবার আয় না লক্ষ্মী মা আমার ......”
চন্দ্রকান্তবাবুর কথা শেষ না হতেই সীমন্তিনী ফোন কেটে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। অর্চনা আর নবনীতা সীমন্তিনীর হতভম্ব অবস্থা দেখে কী করবে না করবে ভেবে পেল না। তারা দু’জনে দু’দিক থেকে সীমন্তিনীর গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শুধু সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
প্রায় মিনিট দশেক বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবার পর সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে নবনীতা আর অর্চনাকে তাদের ঘরে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিল। আর নিজেও মোবাইলে ভোর পাঁচটার এলার্ম সেট করে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়ল।
*****************
এলার্মের শব্দেই সীমন্তিনী উঠে পড়ল। লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে ঘরের মেঝেতে একটা শতরঞ্চী পেতে প্রাণায়াম আর যোগাচর্চা করল। প্রায় সাতটা নাগাদ নিজের ঘর থেকে বেরোতেই অর্চনাকে ট্রেতে করে চায়ের কাপ হাতে তার ঘরের দিকে আসতে দেখে বলল, “গুড মর্নিং, অর্চু সোনা। এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস তোরা”?
অর্চনাও মিষ্টি করে হেসে বলল, “গুড মর্নিং দিদিভাই। কোথায় বসবে? ডাইনিং টেবিলে না তোমার ঘরে”?
সীমন্তিনী ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “ডাইনিং টেবিলেই বসি চল। তা নীতা লক্ষ্মীদি ওরা সব কোথায়”?
অর্চনাও সীমন্তিনীর পাশে পাশে যেতে যেতে বলল, “ওরা রান্নাঘরে আছে। আসছে এখনই। তুমি বোসো”।
সীমন্তিনী একটা চেয়ারে বসতেই লক্ষ্মী আর নবনীতাও রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। সীমন্তিনীর নির্দেশেই রোজ সকালে তারা চারজনে একসাথে বসে সকালের চা খায়। চা খেতে খেতে সীমন্তিনী বলল, “অর্চু, কাল তো ফিরতে ফিরতে আমাদের বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা কাজ আর করতে পারিনি। কিন্তু আমাকে তো একটু পরেই বেড়িয়ে যেতে হবে। তাই তোকে একটা কাজের ভার দিচ্ছি। নীতা অবশ্য জানে, কাল আমরা কিছু কাপড় চোপড় মার্কেটিং করে এনেছি। কালচিনির সকলের জন্যে। আমি বেড়িয়ে যাবার পর তুই আর নীতা প্যাকেটটা খুলে সেসব বের করে দেখবি। সবগুলো তোর পছন্দ হয় কিনা সেটা নীতাকে বলবি। অপছন্দ হলে সেগুলো পাল্টে আনতে হবে। আর নীতা, একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে রে। আমার ইচ্ছে ছিল কালচিনির ডাক্তার সোমের জন্যেও কিছু একটা নেব। আমাদের জন্যে লোকটা যা করেছে তার বিনিময়ে একটা ছোট উপহার তো তাকে দেওয়াই উচিৎ। কিন্তু কাল কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি। ওদিকে ডাক্তার সোমের বোনের সাথে রচু আর দাদাভাইয়ের পরিচয় হল কাল। ডাক্তার সোমের বোন দীপা নাকি দাদাভাই আর রচুকে নিজের ভাই বোন বানিয়ে নিয়েছেন। তাই কিছু একটা না দিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। তাই আমার হয়ে তোকে দুটো কাজ করতে হবে। আমি বেড়িয়ে যাবার পরে পরেই তুই রচুর সাথে কথা বলে জেনে নিবি, ডাক্তার সোমের ফ্যামিলীতে তার স্ত্রী ছাড়া আর কে কে আছে? মানে ছেলে মেয়ে ক’জন আর তাদের বয়স কেমন, এসব জেনে নিবি। তারপর তোদের শোরুমে গিয়ে ডাক্তার সোমের জন্যে ভালো একসেট পাঞ্জাবী আর পাজামা, তার স্ত্রীর জন্যে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি, আর বাচ্চাদের জন্যে কিছু পোশাক, তোর পছন্দ মত বেছে রাখিস। আমি আজ দুপুরের দিকেই অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ব। তারপর তোদের শোরুম থেকে ওগুলো নিয়ে আসব। আর হ্যাঁ, কাল যেগুলো এনেছি ওগুলোর মধ্যে অর্চুর অপছন্দ হওয়া জিনিসগুলোও নিয়ে যাস। ওগুলোও একসাথে পাল্টে আনব। তোর অসুবিধে হবে না তো”?
নবনীতা বলল, “অসুবিধের কি আছে দিদি? কিন্তু দিদি, তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোরা দুটো আমার দুটো বোন। বোন হয়ে দিদিকে সব রকম কথা বলার অধিকার তোদের আছে। এতে এত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন? তবে তুই কী বলবি তা বোধহয় আমি আন্দাজ করতে পারছি। তুই পরি কিংবা রচু বা দাদাভাইয়ের ব্যাপারেই কিছু বলবি, তাই না”?
নবনীতা একটু লাজুক মুখে জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদি। তবে এত লোকের জন্যে এতকিছু কিনতে তোমার কত টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। সেদিন আমাদের এ বাড়ির সকলের জন্য সবকিছু আনলে। কাল রাজগঞ্জের বাড়ির সকলের জন্য, কালচিনির সকলের জন্য কত খরচ হল। আবার এখন ডাক্তার সোমের ফ্যামিলির জন্যে আবার কত খরচ হবে কে জানে। আমি তো সবে কাজে ঢুকলাম। আমার পক্ষে তো কাউকেই কিছু দেওয়া সম্ভব না এখন। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে ছিল, যদি রতুদা, বৌদি আর পরির জন্যেও কিছু একটা কিনে পাঠাতে পারতুম”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুই কি ভেবেছিস নীতা? দাদাভাই, রচু ওদের কথা ভুলে গিয়ে আমি অন্য সকলের কথা ভাবছি? আরে পাগলী, আমি আগেই রচুর একাউন্টে পঁচিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিরে। তবে সে কথাটা এখনও ওদের বলিনি। পূজোর আগে আগে ওদের বলব যে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলে ওরা যেন নিজেদের পছন্দ মত কিছু পোশাক কিনে নেয়। ওদের জন্য ইচ্ছে করেই এখানে থেকে আর কিছু নিলাম না। ওখানে অনেক দোকানপাট আছে। ওরা অনেক দেখেশুনে পছন্দসই জিনিস কিনে নিতে পারবে। আর পরি আর তোর মহিমা ম্যাডামেকেও কিছু একটা দিতে বলব”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে অর্চনা আর নবনীতা দু’জনেই অবাক চোখে তার দিকে চাইল। সীমন্তিনী চা খাওয়া শেষ করে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি সকালের খাবারটা বানিয়ে ফেলো। আমি চান সেরে আসছি”।
****************
অফিসে যাবার পথে রচনার সাথে সংক্ষেপে কথা হল। অফিসে এসে নানারকম কাজে ঘন্টা তিনেক ডুবে থাকবার পর সীমন্তিনী একটু ব্রেক নিয়ে মহিমাকে ফোন করল। দু’বার রিং হতেই মহিমা সাড়া দিল। সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “বৌদি, তুমি কি খুব ব্যস্ত আছ নাকি এখন”?
মহিমা সীমন্তিনীর ফোন পেয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় জবাব দিল, “না না মন্তি, আমি ফ্রি আছি। ইনস্টিটিউট বন্ধ করে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে খুব ভাল লাগল”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “বৌদি, তোমার ব্যাপারে একটা নতুন প্ল্যান আমার মাথায় এসেছে। তবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে অনেক সময় লাগবে। আমি তো এখন অফিসে আছি। তাই ভাবছি আজ রাতে তোমার সাথে ও ব্যাপারে কথা বলব। তুমি শুধু একটা কথা আমায় বল বৌদি। তুমি কি সত্যিই তোমার ওই ব্যবসাটা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তই নিয়েছ? আর তোমার হাতে যে টাকা গুলো জমেছে, তা কি সত্যি তোমার মেয়েদের ওপর খরচ করতে রাজী আছ”?
মহিমা প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল, “হ্যাঁ মন্তি। এর আগের দিন তোমার সাথে কথা বলার পর আমি ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক ভেবেছি। তারপর মনে হয়েছে, তোমার সাজেশান অনুযায়ী অমন কিছু করতে পারলেই হয়ত আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব। জীবনে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য অনেক পাপ করে ফেলেছি আমি। এখন আমি সত্যিই মানসিক ভাবে খুব ক্লান্ত মন্তি। অনেক ভেবে দেখেছি, আমার এখন শুধু মাত্র তিনটে ইচ্ছে পূরণ হলেই আমি শান্তিতে বাঁচতে বা মরতে পারব। এরমধ্যে প্রথম ইচ্ছেটা হল, আমি এই ব্যবসাটা পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করে দিতে চাই। দ্বিতীয় ইচ্ছে হল, আমার মেয়েগুলোকে সৎপথে বাঁচবার সুযোগ করে দিতে চাই, যাতে ওদের ভবিষ্যতে আর এভাবে নিজেদের শরীর বিক্রী করে বেঁচে থাকার রসদ যোগাড় করতে না হয়। আর তৃতীয় ইচ্ছেটা হচ্ছে, ওই রাহু বিমলের হাত থেকে যেন আমি মুক্তি পাই। এছাড়া আমার আর জীবনে কিছুটি চাইবার নেই গো”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি তোমাকে আগেও বলেছি বৌদি যে তুমি এমনটা চাইলে আমি তোমার পাশে থাকব। আজও আবার একই কথা বলছি। কিন্তু বৌদি, এখন আমার হাতে সময় খুব বেশী নেই। তোমার সাথে আমি রাতে কথা বলব। কিন্তু ইন দা মিন টাইম, তুমি একটা কাজ করে রাখবে প্লীজ”?
মহিমা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো না কী করতে হবে আমার”?
সীমন্তিনী এক মূহুর্ত চুপ থেকে বলল, “তুমি তো বলেছিলে যে নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক একাউন্টে তোমার অনেক টাকা জমে আছে। সব একাউন্ট মিলিয়ে তোমার কাছে এখন কত টাকা আছে, আর এরমধ্যে থেকে কত টাকা তুমি তোমার মেয়েদের পেছনে খরচ করতে পার, সেটার একটা রাফ হিসেব করে রাখবে প্লীজ। তারপর রাতে আমরা এ ব্যাপারে ডিটেইলস আলোচনা করব, কেমন”?
মহিমা জবাব দিল, “ঠিক আছে মন্তি, আমার সব ক’টা ব্যাঙ্ক একাউন্টের হিসেব করে আমি তৈরী থাকব। আর তুমি এখন ব্যস্ত আছ। তাই আর তোমার সময় নষ্ট করছি না। রাত ন’টার পর যে কোনও সময় ফোন করো। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “ঠিক আছে বৌদি, তাই হবে। রাখছি এখন, বাই” বলে ফোন কেটে মিঃ অধিকারীর নাম্বারে ফোন করে জানতে পারল যে অধিকারীবাবু রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে রওনা হচ্ছেন। সীমন্তিনী তাকে অনুরোধ করল উনি যেন আগামীকাল কালচিনির বাড়ি তৈরীর ব্যাপারে একটা রাফ এস্টিমেট বানিয়ে সীমন্তিনীর সাথে দেখা করেন।
***************
অফিসে আজ খুব বেশী কাজের চাপ না থাকায় সীমন্তিনী তার থানার বড়বাবুর হাতে দায়িত্ব দিয়ে দুপুর একটা নাগাদই বাড়িতে চলে এল। অর্চনার সাথে লাঞ্চ করতে করতে জেনে নিল যে আগের দিনে কেনা সব পোশাকই অর্চনার খুব পছন্দ হয়েছে। লাঞ্চের পর একটু বিশ্রাম নিয়েই সীমন্তিনী অর্চনাকে নিয়েই বসাক গারমেন্টসে চলে এল। পথে অর্চনার মুখেই শুনে নিল ডাক্তার সোম কালচিনিতে একাই থাকেন তার কোয়ার্টারে। তার স্ত্রী আর দশ বছরের ছেলে থাকে মালবাজারে তাদের পৈতৃক বাড়িতে। তার ঊণিশ বছরের মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে বিডিএস পড়ছে। এ’সব কথা রচনার কাছ থেকেই জানা গেছে। নবনীতার কাউন্টারে ভিড় আজ আরও বেশী। তাই তার কাউন্টারে না গিয়ে সীমন্তিনী অন্য এক কাউন্টারে গিয়ে ডাক্তার সোমের ফ্যামিলির সকলের জন্যে পোশাক কিনে বাড়ি ফিরে এল।
সন্ধ্যে হতে তখনও অনেক বাকি। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতেই লক্ষ্মী চা নিয়ে এল। সীমন্তিনী তার হাত থেকে চা নিয়ে বলল, “অর্চুর চা কোথায়? ও খাবে না”?
লক্ষ্মী জবাব দিল, “সোনাদি বাথরুম থেকে এখনও বেরোন নি তো”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমাদের দু’জনের চা-ও আমার ঘরেই নিয়ে এস। একসাথে বসে গল্প করতে করতে খাব সবাই। অর্চুকেও এখানে আসতে বলো”।
খানিক বাদে তিনজনে একসাথে চা খাবার সময় সীমন্তিনী অর্চনাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে অর্চু? রচুর সাথে আজ তোর কথা হয়েছে নিশ্চয়ই। আমি তো শুধু অফিসে যাবার সময় ওর সাথে অল্প একটু সময় কথা বলেছি। কাল ওরা কোথায় গিয়েছিল, কেমন মজা হয়েছে, এসব বলেছে তোকে”?
অর্চনা মিষ্টি করে হেসে বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, অনেকক্ষণ কথা হয়েছে গো আমাদের। ও বলল, আগে নাকি ও যেতেই চাইছিল না। তুমিই নাকি ওকে বলে কয়ে রাজি করিয়েছিলে। কিন্তু পরিতোষবাবুর সঙ্গে দমদমে তার ওই বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওদের নাকি খুব ভাল লেগেছে। ওই ডাক্তারবাবু ... কি যেন নামটা বলল ... ও হ্যাঁ, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, উনি নাকি কোলকাতার নামকরা একজন সার্জন। তার স্ত্রী দীপা যিনি আমাদের কালচিনি হাসপাতালের ডাক্তার সোমের বোন, আর তাদের বারো তের বছরের মেয়ে আকংক্ষাকে নাকি খুব ভাল লেগেছে। ওই বাচ্চা মেয়েটা রতুদাকে মামা আর রচুকে মামী বলে ডেকেছে। ওদের আবার যেতে বলেছে বারবার। কলকাতা যাবার পর এত খুশী নাকি ওরা কখনও হয়নি। আর তোমার বন্ধুর কথাও খুব করে বলছিল। অমন ব্যস্ত সমস্ত এক বড় পুলিশ অফিসার নিজে সঙ্গে করে ওদের নিয়ে গেছেন, আবার বাড়ি অব্দি পৌঁছেও দিয়েছেন এ’সব কথা বলতে বলতে তো রচু খুশীতে হাঁপিয়ে উঠছিল দিদিভাই। খুব প্রশংসা করছিল পরিতোষবাবুর” বলে হেসে ফেলে বলল, “ও যে কী পাগলামী শুরু করে দিয়েছিল না দিদিভাই সে কি বলব তোমাকে। ও ওই ডাক্তার বাবুর কথা বলবে, না তার স্ত্রীর মেয়ের কথা বলবে না তোমার পরিতোষবাবুর কথা বলবে তা যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর খুশী দেখে আমারও খুব ভাল লেগেছে গো। কিন্তু বেচারী তো জানেও না যে ওর ওপর ........”
সীমন্তিনী চট করে অর্চনার হাত ধরে চোখের ঈশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি। রচু আর দাদাভাই কাল সন্ধ্যেটা খুব ভাল উপভোগ করেছে। আসলে জানিস অর্চু, রচুর মনটা খুব খারাপ ছিল। ওর নাকি ক’দিন ধরে রাজগঞ্জের সকলের জন্য, বিশেষ করে আমাদের সবচেয়ে ছোট বোন চন্দুর জন্য ওর মনটা খুব বিষণ্ণ ছিল। রচুকে তো ও বাড়ির সকলেই বিয়ের পরদিন থেকেই খুব ভালবাসে। কিন্তু চন্দু প্রথম দিন থেকেই রচুর এত নেওটা হয়ে গিয়েছিল যে যতক্ষণ বাড়িতে থাকত ততক্ষণ রচুর সাথেই সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করত। রচু কলকাতা চলে যাবার পর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল ও। কেউ ওকে আয়ত্বে আনতে পারেনি। তারপর রচুই ফোনে ফোনে কথা বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পথে এনেছিল। আর কাল তো শুনলিই, কাকু কি বললেন। চন্দু রোজ ঘুম থেকে উঠে আর শুতে যাবার আগে রচুর ছবিতে প্রণাম করে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে যাতে রচুর মত রেজাল্ট করতে পারে। তাহলে বুঝতেই পারছিস, রচুকে ও কতখানি ভালবাসে”।
এ’কথা শুনে লক্ষ্মীদি বলল, “বৌদিমণি আসলেই তো অমন গো দিদিমণি। অমন মেয়েকে কেউ ভাল না বেসে থাকতে পারে। সে যে রূপে সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী আর গূণে মা সরস্বতী গো। আর ঠিক তেমনই আমার এই সোনাদিদিও” বলে অর্চনার দিকে ঈশারা করে বলল, “সত্যি এমন দুটো মেয়ের জন্ম যিনি দিয়েছেন তিনি যে সত্যিই খুব ভাগ্যবতী গো দিদিমণি। আমার তো খুব ইচ্ছে করে সেই জন্মদাত্রীটিকে একটিবার দেখতে। কবে যে আমার সে ইচ্ছে পূরণ হবে কে জানে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোমার সে ইচ্ছে পূর্ণ হতে আরে খুব বেশী দেরী নেই গো লক্ষ্মীদি। আমি তো তোমাকে আগেই কথা দিয়েছিলুম যে তোমার বৌদিমণির মা বাবাকে তুমি দেখতে পাবে। আর বেশী অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়। খুব শিগগীরই তুমি আমার মাসি মেসো ভাই সব্বাইক দেখতে পাবে গো। এই ঘরে বসেই দেখতে পাবে তাদের”।
লক্ষ্মী আর অর্চনা দু’জনেই প্রায় একসাথে বলে উঠল, “সত্যি বলছ”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “হ্যাঁরে। সামনের মাসের বারো তারিখে তারা সবাই এখানে আসছেন। মাসি, মেসো ভাই সবাই আমাকে সে কথা দিয়েছে। আর এই যে কাল তাদের জন্য পূজোর কাপড় চোপড় কিনলুম সেগুলো তখনই তাদের হাতে দেব। তার আট ন’দিন বাদেই তো পূজো”।
লক্ষ্মী সীমন্তিনীর পায়ে উপুড় হয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক প্রণাম গো দিদিমণি। তোমার জন্যেই আমার এমন সৌভাগ্য হল। ঈশ, বৌদিমণির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই তাকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল আমার। আর সে ইচ্ছে যেদিন পূর্ণ হল সেদিন থেকেই তার মা বাবাকে দেখার সখ হয়েছিল। এখন তোমার দয়ায় সে সখও আমার পূর্ণ হবে। আমি তোমাকে কি বলব গো দিদিমণি। তুমি যে কল্পতরুর মত আমার সব সাধ পূর্ণ করছ গো। আমি তো মুখ্যু সুখ্যু গরীব মানুষ। তোমাকে এর কোন প্রতিদান দেবার সাধ্যিও তো আমার নেই। তবে, আমি আমার জীবনটাই তোমার পায়ে সঁপে দিলাম। সারা জীবন আমি তোমাকে ছেড়ে যাবনা গো দিদিমণি”।
সীমন্তিনী লক্ষ্মীর কাঁধ ধরে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আঃ লক্ষ্মীদি, এভাবে আমার পায়ে পড়ে আমাকে কেন পাপের ভাগী করছ গো। তুমি তো বয়সে আমার থেকে বড়। ওঠো ওঠো। তোমার কাছ থেকে কোনও প্রতিদানও আমি চাইনে। তুমি ভাল থেক আর আমাদের সবাইকে ভাল রেখ, তাহলেই হবে”।
অর্চনা সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে আদুরে গলায় বলল, “ও দিদিভাই, আমার একটা আবদার রাখবে গো”?
সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ওমা, এমন করে বলছিস কেন রে? তোদের জন্যে আমি তো সবকিছু করতে রাজী আছি। বলনা কী বলবি”?
অর্চনা সীমন্তিনীর কোলের দিকে ঈশারা করে বলল, “আমাকে একটু তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে দেবে”?
সীমন্তিনী আদর করে অর্চনার মাথা টেনে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে তার মাথাটাকে নিজের কোলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “ঈশ, ধাড়ি মেয়ের বায়না দেখ লক্ষ্মীদি। যেন দুধের শিশু একটা”।
অর্চনা সীমন্তিনীর কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে বলল, “আহ, কী শান্তি গো দিদিভাই। মনে হচ্ছে আমার পুরো শরীর মন একেবারে হাল্কা হয়ে গেল”।
সীমন্তিনী পরম মমতায় অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে অর্চনা বলল, “কার কাছে তুমি কী, তা আমি জানিনে দিদিভাই, কিন্তু আমার কাছে তুমি সত্যিই এক পরশমণি গো। তিনমাস আগেও তো আমি ভাবতে পারিনি এমন একটি কোলে মাথা রেখে আমি কখনও শুতে পারব। জানিনা, আমি রচু ভাই বা মা-বাবা কে কোন পূণ্য করেছিল। কিন্তু আমাদের জীবনে তোমাকে পাওয়া সত্যি কোন বিরাট পূণ্যের ফল। জানো দিদিভাই, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন ভাই আর রচুর মুখে তোমার কথা শুনেছিলুম, সেদিনই মনে হয়েছিল রচুই বুঝি আমাদের পূণ্যের ফল। আমরা রচুকে পেয়েছিলুম বলেই না তোমাকে পেয়েছি। নইলে অমন ভাবে তোমার সাথে তার পরিচয় হত”?
সীমন্তিনীও ফোন বন্ধ করে রচনার কান্নার ব্যাপারে ভাবতে লাগল। তার নিজের মনটাও ভারী হয়ে উঠল। রচনাকে যেমন রাজগঞ্জের বাড়ির প্রত্যেকে ভালবাসে, তেমনি রচনাও তো বিয়ের পর থেকেই ও বাড়ির সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। আর চন্দু তো রচনার সবচেয়ে আদরের ছিল ও বাড়িতে। কলকাতা যাবার সময় তো সারাটা পথেই ও চন্দুর কথা ভেবে ভেবে কেঁদেছে। এদিকে চন্দুটারও খুব করুণ অবস্থা হয়েছিল তখন। অনেক কষ্টে বাড়ির লোকেরা ওকে বোঝাতে পারলেও অমন হাসিখুশী মেয়েটা সেই থেকে নাকি খুব চুপচাপ হয়ে গেছে, সীমন্তিনীর নিজেরও খুব ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে চন্দুকে একটু কাছে পেতে। তিন বছর হয়ে গেল, ও বাড়ির কাউকে সে দেখতে পায়নি। চন্দুটা নাজানি কত বড় হয়ে গেছে এতদিনে। ভাবতে ভাবতে সীমন্তিনীর চোখ দিয়েও জল গড়াতে লাগল।
সীমন্তিনীকে কাঁদতে দেখে নবনীতা আর অর্চনা ঘাবড়ে গেল। তারা সীমন্তিনীকে সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সীমন্তিনী একটু ধাতস্থ হয়ে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “ঠিক আছে, ছাড় আমাকে, আমাকে আরেকটা ফোন এখনই করতে হবে” বলে চন্দ্রকান্তবাবুর নাম্বার ডায়াল করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ও’পাশ থেকে চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “কীরে, মন্তি? এতো রাতে ফোন করেছিস কেন? কি হয়েছে রে মা? তুই ঠিক আছিস তো”?
সীমন্তিনী ভারী গলায় বলল, “না কাকু, কিচ্ছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। আসলে বাড়ির সকলের কথা খুব মনে পড়ছে গো আজ। তাই ফোনটা করলুম। আচ্ছা কাকু, চন্দু কেমন আছে গো? ঠিকমত পড়াশোনা করছে তো? আগের মত হাসিখুশী থাকছে তো”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁরে চন্দু তো ভালই আছে। পড়াশোনাতেও আগের চেয়ে অনেক ভাল রেজাল্ট করছে। ওর কলেজের মাষ্টার মশাইরা তো বলছেন যে চন্দুই বোধহয় এবার ওদের ক্লাসে প্রথম হবে। তা তুই কি ওর সাথে কথা বলতে চাইছিস? কিন্তু ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে রে মা”।
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “না না কাকু, ওকে ডাকতে হবে না। আসলে রচু একটু আগে ফোন করে বলল যে চন্দুকে অনেকদিন ধরে দেখতে পাচ্ছে না বলে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই আমি ফোনটা করলুম চন্দুর খবর নেবার জন্যে। এর আগে তুমি বলেছিলে যে চন্দু আগের মত হাসি খুশী নেই, খেলাধূলোও করে না, হৈ হুল্লোড় করা তো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। এখনও কি অমনই আছে কাকু”?
চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “আমরা তো আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি রে মা। কিন্তু চন্দু কিছুতেই আর আগের মত উচ্ছল প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে নারে। তবে বড়বৌমার কথাতেই ও খাওয়া দাওয়া পড়াশোনা সবকিছুই ঠিকঠাক মত করছে। শরীর স্বাস্থ্যও ঠিক আছে। শুধু আগের সেই উচ্ছলতাটাই হারিয়ে ফেলেছে। ওর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান এখন বড়বৌমার মত ভাল রেজাল্ট করা। আর জানিস মন্তি? রোজ ঘুম থেকে উঠে আর শুতে যাবার আগে ও বড়বৌমার ছবিতে প্রণাম করে। এসব দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানিস, বড়বৌমা বোধহয় ওকে কোনও যাদুতে বন্দী করে রেখেছে”।
সীমন্তিনী খুব ধীর গলায় বলল, “রচু তো আমাদের সবাইকেই যাদুতে বন্দী করে রেখেছে কাকু। আচ্ছা যাক সে কথা। শোনো, আজ এখান থেকে তোমাদের সকলের জন্য কিছু কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। কার জন্যে কোনটা, তা সব লিখে দিয়েছি। তবে প্রায় তিন বছর যাবৎ তোমাদের কাউকে আমি দেখিনি। মাপ আন্দাজ করে কিনেছি। কারো পোশাক যদি মাপে ছোটবড় হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিও দেরী না করে। আর সে জন্যেই হাতে সময় থাকতেই ওগুলো পাঠালাম। যাতে বদলাতে হলেও পূজোর আগেই সেটা করে ফেলা যায়। আর হ্যাঁ কাকু, এবার তো আমার হয়ে প্রণাম করবার কেউ নেই বাড়িতে। তাই তোমরা সবাই আমার প্রণাম নিও” বলে কেঁদে ফেলল।
চন্দ্রকান্তবাবু ওদিক থেকে সীমন্তিনীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মন্তি মা, এমন অভিমান করে এভাবে আর কতদিন থাকবি মা? একবারটি আয় না মা দু’দিনের জন্য। তোকেও তো আমাদের দেখতে ইচ্ছে হয় রে। কিন্তু তুই তো তোর মাথার দিব্যি দিয়ে আমাদের তোর কাছে যাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছিস চিরতরে। আর তুইও যে ভেতরে ভেতরে কেঁদে মরছিস, সেটাও তো আমি খুব ভালই জানিরে মা। একবার আয় না লক্ষ্মী মা আমার ......”
চন্দ্রকান্তবাবুর কথা শেষ না হতেই সীমন্তিনী ফোন কেটে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। অর্চনা আর নবনীতা সীমন্তিনীর হতভম্ব অবস্থা দেখে কী করবে না করবে ভেবে পেল না। তারা দু’জনে দু’দিক থেকে সীমন্তিনীর গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শুধু সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
প্রায় মিনিট দশেক বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবার পর সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে নবনীতা আর অর্চনাকে তাদের ঘরে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিল। আর নিজেও মোবাইলে ভোর পাঁচটার এলার্ম সেট করে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়ল।
*****************
এলার্মের শব্দেই সীমন্তিনী উঠে পড়ল। লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে ঘরের মেঝেতে একটা শতরঞ্চী পেতে প্রাণায়াম আর যোগাচর্চা করল। প্রায় সাতটা নাগাদ নিজের ঘর থেকে বেরোতেই অর্চনাকে ট্রেতে করে চায়ের কাপ হাতে তার ঘরের দিকে আসতে দেখে বলল, “গুড মর্নিং, অর্চু সোনা। এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস তোরা”?
অর্চনাও মিষ্টি করে হেসে বলল, “গুড মর্নিং দিদিভাই। কোথায় বসবে? ডাইনিং টেবিলে না তোমার ঘরে”?
সীমন্তিনী ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “ডাইনিং টেবিলেই বসি চল। তা নীতা লক্ষ্মীদি ওরা সব কোথায়”?
অর্চনাও সীমন্তিনীর পাশে পাশে যেতে যেতে বলল, “ওরা রান্নাঘরে আছে। আসছে এখনই। তুমি বোসো”।
সীমন্তিনী একটা চেয়ারে বসতেই লক্ষ্মী আর নবনীতাও রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। সীমন্তিনীর নির্দেশেই রোজ সকালে তারা চারজনে একসাথে বসে সকালের চা খায়। চা খেতে খেতে সীমন্তিনী বলল, “অর্চু, কাল তো ফিরতে ফিরতে আমাদের বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা কাজ আর করতে পারিনি। কিন্তু আমাকে তো একটু পরেই বেড়িয়ে যেতে হবে। তাই তোকে একটা কাজের ভার দিচ্ছি। নীতা অবশ্য জানে, কাল আমরা কিছু কাপড় চোপড় মার্কেটিং করে এনেছি। কালচিনির সকলের জন্যে। আমি বেড়িয়ে যাবার পর তুই আর নীতা প্যাকেটটা খুলে সেসব বের করে দেখবি। সবগুলো তোর পছন্দ হয় কিনা সেটা নীতাকে বলবি। অপছন্দ হলে সেগুলো পাল্টে আনতে হবে। আর নীতা, একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে রে। আমার ইচ্ছে ছিল কালচিনির ডাক্তার সোমের জন্যেও কিছু একটা নেব। আমাদের জন্যে লোকটা যা করেছে তার বিনিময়ে একটা ছোট উপহার তো তাকে দেওয়াই উচিৎ। কিন্তু কাল কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি। ওদিকে ডাক্তার সোমের বোনের সাথে রচু আর দাদাভাইয়ের পরিচয় হল কাল। ডাক্তার সোমের বোন দীপা নাকি দাদাভাই আর রচুকে নিজের ভাই বোন বানিয়ে নিয়েছেন। তাই কিছু একটা না দিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। তাই আমার হয়ে তোকে দুটো কাজ করতে হবে। আমি বেড়িয়ে যাবার পরে পরেই তুই রচুর সাথে কথা বলে জেনে নিবি, ডাক্তার সোমের ফ্যামিলীতে তার স্ত্রী ছাড়া আর কে কে আছে? মানে ছেলে মেয়ে ক’জন আর তাদের বয়স কেমন, এসব জেনে নিবি। তারপর তোদের শোরুমে গিয়ে ডাক্তার সোমের জন্যে ভালো একসেট পাঞ্জাবী আর পাজামা, তার স্ত্রীর জন্যে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি, আর বাচ্চাদের জন্যে কিছু পোশাক, তোর পছন্দ মত বেছে রাখিস। আমি আজ দুপুরের দিকেই অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ব। তারপর তোদের শোরুম থেকে ওগুলো নিয়ে আসব। আর হ্যাঁ, কাল যেগুলো এনেছি ওগুলোর মধ্যে অর্চুর অপছন্দ হওয়া জিনিসগুলোও নিয়ে যাস। ওগুলোও একসাথে পাল্টে আনব। তোর অসুবিধে হবে না তো”?
নবনীতা বলল, “অসুবিধের কি আছে দিদি? কিন্তু দিদি, তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোরা দুটো আমার দুটো বোন। বোন হয়ে দিদিকে সব রকম কথা বলার অধিকার তোদের আছে। এতে এত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন? তবে তুই কী বলবি তা বোধহয় আমি আন্দাজ করতে পারছি। তুই পরি কিংবা রচু বা দাদাভাইয়ের ব্যাপারেই কিছু বলবি, তাই না”?
নবনীতা একটু লাজুক মুখে জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদি। তবে এত লোকের জন্যে এতকিছু কিনতে তোমার কত টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। সেদিন আমাদের এ বাড়ির সকলের জন্য সবকিছু আনলে। কাল রাজগঞ্জের বাড়ির সকলের জন্য, কালচিনির সকলের জন্য কত খরচ হল। আবার এখন ডাক্তার সোমের ফ্যামিলির জন্যে আবার কত খরচ হবে কে জানে। আমি তো সবে কাজে ঢুকলাম। আমার পক্ষে তো কাউকেই কিছু দেওয়া সম্ভব না এখন। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে ছিল, যদি রতুদা, বৌদি আর পরির জন্যেও কিছু একটা কিনে পাঠাতে পারতুম”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুই কি ভেবেছিস নীতা? দাদাভাই, রচু ওদের কথা ভুলে গিয়ে আমি অন্য সকলের কথা ভাবছি? আরে পাগলী, আমি আগেই রচুর একাউন্টে পঁচিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিরে। তবে সে কথাটা এখনও ওদের বলিনি। পূজোর আগে আগে ওদের বলব যে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলে ওরা যেন নিজেদের পছন্দ মত কিছু পোশাক কিনে নেয়। ওদের জন্য ইচ্ছে করেই এখানে থেকে আর কিছু নিলাম না। ওখানে অনেক দোকানপাট আছে। ওরা অনেক দেখেশুনে পছন্দসই জিনিস কিনে নিতে পারবে। আর পরি আর তোর মহিমা ম্যাডামেকেও কিছু একটা দিতে বলব”।
সীমন্তিনীর কথা শুনে অর্চনা আর নবনীতা দু’জনেই অবাক চোখে তার দিকে চাইল। সীমন্তিনী চা খাওয়া শেষ করে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি সকালের খাবারটা বানিয়ে ফেলো। আমি চান সেরে আসছি”।
****************
অফিসে যাবার পথে রচনার সাথে সংক্ষেপে কথা হল। অফিসে এসে নানারকম কাজে ঘন্টা তিনেক ডুবে থাকবার পর সীমন্তিনী একটু ব্রেক নিয়ে মহিমাকে ফোন করল। দু’বার রিং হতেই মহিমা সাড়া দিল। সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “বৌদি, তুমি কি খুব ব্যস্ত আছ নাকি এখন”?
মহিমা সীমন্তিনীর ফোন পেয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় জবাব দিল, “না না মন্তি, আমি ফ্রি আছি। ইনস্টিটিউট বন্ধ করে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে খুব ভাল লাগল”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “বৌদি, তোমার ব্যাপারে একটা নতুন প্ল্যান আমার মাথায় এসেছে। তবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে অনেক সময় লাগবে। আমি তো এখন অফিসে আছি। তাই ভাবছি আজ রাতে তোমার সাথে ও ব্যাপারে কথা বলব। তুমি শুধু একটা কথা আমায় বল বৌদি। তুমি কি সত্যিই তোমার ওই ব্যবসাটা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তই নিয়েছ? আর তোমার হাতে যে টাকা গুলো জমেছে, তা কি সত্যি তোমার মেয়েদের ওপর খরচ করতে রাজী আছ”?
মহিমা প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল, “হ্যাঁ মন্তি। এর আগের দিন তোমার সাথে কথা বলার পর আমি ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক ভেবেছি। তারপর মনে হয়েছে, তোমার সাজেশান অনুযায়ী অমন কিছু করতে পারলেই হয়ত আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব। জীবনে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য অনেক পাপ করে ফেলেছি আমি। এখন আমি সত্যিই মানসিক ভাবে খুব ক্লান্ত মন্তি। অনেক ভেবে দেখেছি, আমার এখন শুধু মাত্র তিনটে ইচ্ছে পূরণ হলেই আমি শান্তিতে বাঁচতে বা মরতে পারব। এরমধ্যে প্রথম ইচ্ছেটা হল, আমি এই ব্যবসাটা পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করে দিতে চাই। দ্বিতীয় ইচ্ছে হল, আমার মেয়েগুলোকে সৎপথে বাঁচবার সুযোগ করে দিতে চাই, যাতে ওদের ভবিষ্যতে আর এভাবে নিজেদের শরীর বিক্রী করে বেঁচে থাকার রসদ যোগাড় করতে না হয়। আর তৃতীয় ইচ্ছেটা হচ্ছে, ওই রাহু বিমলের হাত থেকে যেন আমি মুক্তি পাই। এছাড়া আমার আর জীবনে কিছুটি চাইবার নেই গো”।
সীমন্তিনী বলল, “আমি তোমাকে আগেও বলেছি বৌদি যে তুমি এমনটা চাইলে আমি তোমার পাশে থাকব। আজও আবার একই কথা বলছি। কিন্তু বৌদি, এখন আমার হাতে সময় খুব বেশী নেই। তোমার সাথে আমি রাতে কথা বলব। কিন্তু ইন দা মিন টাইম, তুমি একটা কাজ করে রাখবে প্লীজ”?
মহিমা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো না কী করতে হবে আমার”?
সীমন্তিনী এক মূহুর্ত চুপ থেকে বলল, “তুমি তো বলেছিলে যে নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক একাউন্টে তোমার অনেক টাকা জমে আছে। সব একাউন্ট মিলিয়ে তোমার কাছে এখন কত টাকা আছে, আর এরমধ্যে থেকে কত টাকা তুমি তোমার মেয়েদের পেছনে খরচ করতে পার, সেটার একটা রাফ হিসেব করে রাখবে প্লীজ। তারপর রাতে আমরা এ ব্যাপারে ডিটেইলস আলোচনা করব, কেমন”?
মহিমা জবাব দিল, “ঠিক আছে মন্তি, আমার সব ক’টা ব্যাঙ্ক একাউন্টের হিসেব করে আমি তৈরী থাকব। আর তুমি এখন ব্যস্ত আছ। তাই আর তোমার সময় নষ্ট করছি না। রাত ন’টার পর যে কোনও সময় ফোন করো। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “ঠিক আছে বৌদি, তাই হবে। রাখছি এখন, বাই” বলে ফোন কেটে মিঃ অধিকারীর নাম্বারে ফোন করে জানতে পারল যে অধিকারীবাবু রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে রওনা হচ্ছেন। সীমন্তিনী তাকে অনুরোধ করল উনি যেন আগামীকাল কালচিনির বাড়ি তৈরীর ব্যাপারে একটা রাফ এস্টিমেট বানিয়ে সীমন্তিনীর সাথে দেখা করেন।
***************
অফিসে আজ খুব বেশী কাজের চাপ না থাকায় সীমন্তিনী তার থানার বড়বাবুর হাতে দায়িত্ব দিয়ে দুপুর একটা নাগাদই বাড়িতে চলে এল। অর্চনার সাথে লাঞ্চ করতে করতে জেনে নিল যে আগের দিনে কেনা সব পোশাকই অর্চনার খুব পছন্দ হয়েছে। লাঞ্চের পর একটু বিশ্রাম নিয়েই সীমন্তিনী অর্চনাকে নিয়েই বসাক গারমেন্টসে চলে এল। পথে অর্চনার মুখেই শুনে নিল ডাক্তার সোম কালচিনিতে একাই থাকেন তার কোয়ার্টারে। তার স্ত্রী আর দশ বছরের ছেলে থাকে মালবাজারে তাদের পৈতৃক বাড়িতে। তার ঊণিশ বছরের মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে বিডিএস পড়ছে। এ’সব কথা রচনার কাছ থেকেই জানা গেছে। নবনীতার কাউন্টারে ভিড় আজ আরও বেশী। তাই তার কাউন্টারে না গিয়ে সীমন্তিনী অন্য এক কাউন্টারে গিয়ে ডাক্তার সোমের ফ্যামিলির সকলের জন্যে পোশাক কিনে বাড়ি ফিরে এল।
সন্ধ্যে হতে তখনও অনেক বাকি। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতেই লক্ষ্মী চা নিয়ে এল। সীমন্তিনী তার হাত থেকে চা নিয়ে বলল, “অর্চুর চা কোথায়? ও খাবে না”?
লক্ষ্মী জবাব দিল, “সোনাদি বাথরুম থেকে এখনও বেরোন নি তো”।
সীমন্তিনী বলল, “তোমাদের দু’জনের চা-ও আমার ঘরেই নিয়ে এস। একসাথে বসে গল্প করতে করতে খাব সবাই। অর্চুকেও এখানে আসতে বলো”।
খানিক বাদে তিনজনে একসাথে চা খাবার সময় সীমন্তিনী অর্চনাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে অর্চু? রচুর সাথে আজ তোর কথা হয়েছে নিশ্চয়ই। আমি তো শুধু অফিসে যাবার সময় ওর সাথে অল্প একটু সময় কথা বলেছি। কাল ওরা কোথায় গিয়েছিল, কেমন মজা হয়েছে, এসব বলেছে তোকে”?
অর্চনা মিষ্টি করে হেসে বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, অনেকক্ষণ কথা হয়েছে গো আমাদের। ও বলল, আগে নাকি ও যেতেই চাইছিল না। তুমিই নাকি ওকে বলে কয়ে রাজি করিয়েছিলে। কিন্তু পরিতোষবাবুর সঙ্গে দমদমে তার ওই বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওদের নাকি খুব ভাল লেগেছে। ওই ডাক্তারবাবু ... কি যেন নামটা বলল ... ও হ্যাঁ, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, উনি নাকি কোলকাতার নামকরা একজন সার্জন। তার স্ত্রী দীপা যিনি আমাদের কালচিনি হাসপাতালের ডাক্তার সোমের বোন, আর তাদের বারো তের বছরের মেয়ে আকংক্ষাকে নাকি খুব ভাল লেগেছে। ওই বাচ্চা মেয়েটা রতুদাকে মামা আর রচুকে মামী বলে ডেকেছে। ওদের আবার যেতে বলেছে বারবার। কলকাতা যাবার পর এত খুশী নাকি ওরা কখনও হয়নি। আর তোমার বন্ধুর কথাও খুব করে বলছিল। অমন ব্যস্ত সমস্ত এক বড় পুলিশ অফিসার নিজে সঙ্গে করে ওদের নিয়ে গেছেন, আবার বাড়ি অব্দি পৌঁছেও দিয়েছেন এ’সব কথা বলতে বলতে তো রচু খুশীতে হাঁপিয়ে উঠছিল দিদিভাই। খুব প্রশংসা করছিল পরিতোষবাবুর” বলে হেসে ফেলে বলল, “ও যে কী পাগলামী শুরু করে দিয়েছিল না দিদিভাই সে কি বলব তোমাকে। ও ওই ডাক্তার বাবুর কথা বলবে, না তার স্ত্রীর মেয়ের কথা বলবে না তোমার পরিতোষবাবুর কথা বলবে তা যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর খুশী দেখে আমারও খুব ভাল লেগেছে গো। কিন্তু বেচারী তো জানেও না যে ওর ওপর ........”
সীমন্তিনী চট করে অর্চনার হাত ধরে চোখের ঈশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি। রচু আর দাদাভাই কাল সন্ধ্যেটা খুব ভাল উপভোগ করেছে। আসলে জানিস অর্চু, রচুর মনটা খুব খারাপ ছিল। ওর নাকি ক’দিন ধরে রাজগঞ্জের সকলের জন্য, বিশেষ করে আমাদের সবচেয়ে ছোট বোন চন্দুর জন্য ওর মনটা খুব বিষণ্ণ ছিল। রচুকে তো ও বাড়ির সকলেই বিয়ের পরদিন থেকেই খুব ভালবাসে। কিন্তু চন্দু প্রথম দিন থেকেই রচুর এত নেওটা হয়ে গিয়েছিল যে যতক্ষণ বাড়িতে থাকত ততক্ষণ রচুর সাথেই সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করত। রচু কলকাতা চলে যাবার পর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল ও। কেউ ওকে আয়ত্বে আনতে পারেনি। তারপর রচুই ফোনে ফোনে কথা বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পথে এনেছিল। আর কাল তো শুনলিই, কাকু কি বললেন। চন্দু রোজ ঘুম থেকে উঠে আর শুতে যাবার আগে রচুর ছবিতে প্রণাম করে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে যাতে রচুর মত রেজাল্ট করতে পারে। তাহলে বুঝতেই পারছিস, রচুকে ও কতখানি ভালবাসে”।
এ’কথা শুনে লক্ষ্মীদি বলল, “বৌদিমণি আসলেই তো অমন গো দিদিমণি। অমন মেয়েকে কেউ ভাল না বেসে থাকতে পারে। সে যে রূপে সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী আর গূণে মা সরস্বতী গো। আর ঠিক তেমনই আমার এই সোনাদিদিও” বলে অর্চনার দিকে ঈশারা করে বলল, “সত্যি এমন দুটো মেয়ের জন্ম যিনি দিয়েছেন তিনি যে সত্যিই খুব ভাগ্যবতী গো দিদিমণি। আমার তো খুব ইচ্ছে করে সেই জন্মদাত্রীটিকে একটিবার দেখতে। কবে যে আমার সে ইচ্ছে পূরণ হবে কে জানে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোমার সে ইচ্ছে পূর্ণ হতে আরে খুব বেশী দেরী নেই গো লক্ষ্মীদি। আমি তো তোমাকে আগেই কথা দিয়েছিলুম যে তোমার বৌদিমণির মা বাবাকে তুমি দেখতে পাবে। আর বেশী অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়। খুব শিগগীরই তুমি আমার মাসি মেসো ভাই সব্বাইক দেখতে পাবে গো। এই ঘরে বসেই দেখতে পাবে তাদের”।
লক্ষ্মী আর অর্চনা দু’জনেই প্রায় একসাথে বলে উঠল, “সত্যি বলছ”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “হ্যাঁরে। সামনের মাসের বারো তারিখে তারা সবাই এখানে আসছেন। মাসি, মেসো ভাই সবাই আমাকে সে কথা দিয়েছে। আর এই যে কাল তাদের জন্য পূজোর কাপড় চোপড় কিনলুম সেগুলো তখনই তাদের হাতে দেব। তার আট ন’দিন বাদেই তো পূজো”।
লক্ষ্মী সীমন্তিনীর পায়ে উপুড় হয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক প্রণাম গো দিদিমণি। তোমার জন্যেই আমার এমন সৌভাগ্য হল। ঈশ, বৌদিমণির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই তাকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল আমার। আর সে ইচ্ছে যেদিন পূর্ণ হল সেদিন থেকেই তার মা বাবাকে দেখার সখ হয়েছিল। এখন তোমার দয়ায় সে সখও আমার পূর্ণ হবে। আমি তোমাকে কি বলব গো দিদিমণি। তুমি যে কল্পতরুর মত আমার সব সাধ পূর্ণ করছ গো। আমি তো মুখ্যু সুখ্যু গরীব মানুষ। তোমাকে এর কোন প্রতিদান দেবার সাধ্যিও তো আমার নেই। তবে, আমি আমার জীবনটাই তোমার পায়ে সঁপে দিলাম। সারা জীবন আমি তোমাকে ছেড়ে যাবনা গো দিদিমণি”।
সীমন্তিনী লক্ষ্মীর কাঁধ ধরে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আঃ লক্ষ্মীদি, এভাবে আমার পায়ে পড়ে আমাকে কেন পাপের ভাগী করছ গো। তুমি তো বয়সে আমার থেকে বড়। ওঠো ওঠো। তোমার কাছ থেকে কোনও প্রতিদানও আমি চাইনে। তুমি ভাল থেক আর আমাদের সবাইকে ভাল রেখ, তাহলেই হবে”।
অর্চনা সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে আদুরে গলায় বলল, “ও দিদিভাই, আমার একটা আবদার রাখবে গো”?
সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ওমা, এমন করে বলছিস কেন রে? তোদের জন্যে আমি তো সবকিছু করতে রাজী আছি। বলনা কী বলবি”?
অর্চনা সীমন্তিনীর কোলের দিকে ঈশারা করে বলল, “আমাকে একটু তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে দেবে”?
সীমন্তিনী আদর করে অর্চনার মাথা টেনে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে তার মাথাটাকে নিজের কোলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “ঈশ, ধাড়ি মেয়ের বায়না দেখ লক্ষ্মীদি। যেন দুধের শিশু একটা”।
অর্চনা সীমন্তিনীর কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে বলল, “আহ, কী শান্তি গো দিদিভাই। মনে হচ্ছে আমার পুরো শরীর মন একেবারে হাল্কা হয়ে গেল”।
সীমন্তিনী পরম মমতায় অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে অর্চনা বলল, “কার কাছে তুমি কী, তা আমি জানিনে দিদিভাই, কিন্তু আমার কাছে তুমি সত্যিই এক পরশমণি গো। তিনমাস আগেও তো আমি ভাবতে পারিনি এমন একটি কোলে মাথা রেখে আমি কখনও শুতে পারব। জানিনা, আমি রচু ভাই বা মা-বাবা কে কোন পূণ্য করেছিল। কিন্তু আমাদের জীবনে তোমাকে পাওয়া সত্যি কোন বিরাট পূণ্যের ফল। জানো দিদিভাই, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন ভাই আর রচুর মুখে তোমার কথা শুনেছিলুম, সেদিনই মনে হয়েছিল রচুই বুঝি আমাদের পূণ্যের ফল। আমরা রচুকে পেয়েছিলুম বলেই না তোমাকে পেয়েছি। নইলে অমন ভাবে তোমার সাথে তার পরিচয় হত”?
(To be cont'd ......)
______________________________