21-03-2020, 07:12 PM
(Update No. 183)
সীমন্তিনী নবনীতাকে বোঝাবার প্রয়াস করতে করতে বলল, “আরে পাগলী, সে তো দিয়েছে। তবু এখন যখন আমরা অর্চুকে ওর জন্যে পছন্দ করেই ফেলেছি, তখন ওর সাথে একবার কথা বলা খুবই দরকারী। অবশ্য কাল রাতেই পরিতোষকে আমি বলেছিলুম যে আমি ওর মোবাইলে একটা মেয়ের ছবি পাঠাচ্ছি, সে মেয়েটাকে ওর পছন্দ হয় কিনা তা যেন আমাকে জানায়। কিন্তু পরিতোষ ওই বিমল আগরওয়ালার কেসটা নিয়ে বড্ড বাজে ভাবে ব্যস্ত আছে বলে জানাল। ও আশা করছে, আর দিন সাতেকের ভেতরেই বিমলের বিরূদ্ধে অপারেশনটা শেষ হয়ে যাবে। তাই সে এই সাতদিনে আর অন্য কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাইছে না। আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর ওকে কিছু বলিনি। অর্চুর ছবিও এখনও পাঠাঁইনি ওর কাছে। অবশ্য তখনও ও একই কথা বলেছে যে তুই আর আমি পছন্দ করলেই হবে। তবু ফাইনালি বিয়ের ব্যাপারে মাসি মেসোদের সাথে কথা বলবার আগে, অর্চুর ছবি পরিতোষকে দেখানোটা খুবই জরুরী। আর তার পছন্দ হওয়াটাই সমান জরুরী। তাই সেটার জন্যে এ’ ক’টা দিন আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে”।
নবনীতা নিজের খুশী চেপে রাখতে পারছিল না যেন। সে আবার বলে উঠল, “তুমিও যে অর্চুকে পছন্দ করেছ এটা জেনে আমার ভেতরে ভেতরে যে কী খুশীর জোয়ার বইছে দিদি, আমি তোমায় সেটা বলে বোঝাতে পারব না গো। ঈশ, আমার এখন কি ইচ্ছে করছে জানো দিদি? আমার ইচ্ছে করছে এখনই উঠে ধেই ধেই করে নাচি”।
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “নাচতে ইচ্ছে করছে তো বাড়ির সামনে গিয়ে নাচিস। তবে ঘরে ঢোকবার আগে। অর্চু যেন তোর নাচ না দেখে ফেলে, সেদিকে খেয়াল রাখিস। কারন আমাদের উদ্দেশ্যটা সফল হোক বা না হোক, অর্চুকে কোনও কষ্ট পেতে দেব না আমি। আমি তোর কাছ থেকেও ঠিক সেটাই চাই নীতা”।
নবনীতা এবার খানিকটা শান্ত হয়ে বলল, “আমার মন বলছে দিদি, তেমন কিছুই হবে না। দ্যাখো, সেদিন আমরা যখন অর্চুকে আবার বিয়ে করবার কথা বলছিলুম, সেদিন অর্চুও তো বলেছে তুমি যা বলবে ও তাই মেনে নেবে। আর পরিও একই কথা বলেছে। তাই এ ব্যাপারে আর কোনও জটিলতার তো কিছুই নেই। তুমি কেন এত নিগেটিভ ভাবছ”?
সীমন্তিনী শান্ত গলায় আবার বলল, “সে সব ঠিক আছে নীতা। তবু আমি চাইছি বিয়ের পিড়িতে বসবার আগে ওরা দু’জন দু’জনকে একবার দেখে নিক। কিন্তু সেটা করতে হলে হয় অর্চুকে নিয়ে আমাকে কলকাতা যেতে হবে, নয়তো পরিকে এখানে অথবা কালচিনিতে আসতে হবে। কিন্তু আমি আর পরি দু’জনেই এখন অনেক ক’টা ব্যাপারে খুব ব্যস্ত। আমি যেমন একদিকে অর্চুকে নিয়ে ভাবছি, আবার ও’দিকে কালচিনির বাড়ি বানাবার কথা ভাবছি। আবার মহিমা বৌদির ব্যাপারেও একটা প্ল্যান করছি। তুই হয়ত জানিস না, তোর মহিমা ম্যাডাম আর তার ওই এসকর্টের ব্যবসা করতে চাইছেন না। তাই উনি এ ব্যাপারে আমার সাহায্য চাইছেন। তবে হ্যাঁ, একটা কথা মনে পড়ে গেলরে হঠাৎ। শোন নীতা, আমি যে পুলিশ অফিসার, এ’কথাটা তুই যেন তোর মহিমা ম্যাডামকে বলে ফেলিস না। তাকে এসকর্ট ব্যবসা থেকে বাইরে বের করে আনার পর সেটা তার কাছে প্রকাশ করব। তুই প্লীজ, কথাটা সব সময় মনে রাখিস। আর হ্যাঁ, ওদিকে দাদাভাই, রচু আর পরিকে নিয়েও আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। আবার ভাইয়ের হায়ার স্টাডিজের ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে। তাই আমার পক্ষে এ মূহুর্তে কলকাতা যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আর পরিও এখন কিছুদিন এমন ব্যস্ততার মধ্যে আছে যে ওকে এখানে বা কালচিনিতে আসতেও বলা যাচ্ছে না। তাই আপাততঃ আমি ভাবছি যে অর্চু আর পরি দু’জনকেই দু’জনের ছবি দেখিয়ে তাদের মতামত চাইব। তবে অর্চুকে আগেই পরির ছবিটা দেখাব না, আগে পরিকে অর্চুর ছবি দেখাতে হবে। বুঝলি”?
নবনীতা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবল। তারপর কিছুটা কাতর গলায় বলল, “ও দিদি, আমাদের ভাবনা যেন সত্যি হয় গো। পরির সাথে অর্চুর বিয়েটা যেন আমরা দিতে পারি গো। আমার মন বলছে দিদি, এ বিয়েটা হলে পরি আর অর্চু দু’জনেই খুব সুখী হবে। যে ভাবেই হোক এটা আমাদের করতেই হবে” বলেই আবার একটু থেমে বলল, “আচ্ছা দিদি, তোমার কি মনে হয়, বৌদির মা বাবা কিংবা রতীশদা বা বৌদি এরা কেউ কি এ বিয়ের ব্যাপারে অমত প্রকাশ করতে পারে”?
সীমন্তিনী মুচকি হেসে বলল, “তুই কি ভাবিস, কাল আমি কালচিনি গিয়েছিলাম এমনি এমনি? কাল কালচিনি যাবার পেছনে মূল উদ্দেশ্য আমার এটাই ছিল রে। মাসি মেসো ভাই, সব্বাই রাজী হয়েছেন রে। আর দাদাভাই আর রচুও রাজী”।
নবনীতা আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “সত্যি দিদি”?
সীমন্তিনী চাপা কন্ঠে নবনীতাকে শান্ত থাকতে বলে বলল, “হ্যাঁরে সত্যি বলছি। আমাদের এখন শুধু দুই দেবাদেবির মনের ইচ্ছেটাই শুধু জানতে হবে। সেটা তুই আর আমি মিলে অবশ্যই করব। মন তো বলছে, ওরা কেউই অরাজী হবে না। তবু ওদের মুখ থেকে সেটা শোনা খুব দরকার। তবে তুই একটু সাবধান থাকিস। পরির সাথে কথা বলবার আগে অর্চুকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোন আঁচ দিস নে। কালচিনির বাড়ির সবাইকে, দাদাভাই আর রচুকেও এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছি। ওরাও কেউ আমার কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল না পাওয়া অব্দি অর্চুকে কিছু জানাবে না। তুইও প্লীজ এ’কথাটা মাথায় রাখিস বোন”।
নবনীতা বলল, “ঠিক আছে দিদি। আমি তোমাকে কথা দিলাম। পরির সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত আমিও অর্চুকে কিছু বুঝতে দেব না এ ব্যাপারে। এবার চল, আমরা উঠি। অর্চুটা ওদিকে বৌদির সাথে কথা বলতে না পেরে চিন্তায় আছি। আমাদেরও কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেল। তাই এখন আর একদম দেরী করা ঠিক হবে না, চলো”।
বাড়ি ফেরার পথেই সীমন্তিনী অর্চনাকে ফোন করে বলল, “অর্চু সোনা, আজ তোকে অনেকক্ষণ একা থাকতে হলরে। কিছু মনে করিস নে বোন। আসলে একটা জরুরী কাজ শেষ করতে খুব দেরী হয়ে গেল রে। আর নীতাটাকেও আমি আমার সাথেই আটকে রেখে দিয়েছিলুম। তোর খুব খারাপ লেগেছে নারে”?
অর্চনা ও’পাশ থেকে জবাব দিল, “না না দিদিভাই, তোমরা তো আর আমাকে একা ছেড়ে কোথাও মজা করতে যাও নি। কাজ থাকলে সে তো করতেই হবে। শুধু তোমাদের ফিরতে দেরী হচ্ছিল বলেই একটু চিন্তা হচ্ছিল। আর ওদিকে দেখোনা, রচুকে সন্ধ্যের পর থেকে তিন তিনবার ফোন করলুম। একবারও ও ফোনটা ধরছে না। বাড়িতে ফোন করতে ভাইও বলল যে ও বাড়ির কেউও জানে না। সেজন্যেই আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে গো? ও দিদিভাই, তুমি কি জানো, রচু ওরা এখন কোথায়”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে আশ্বস্ত করতে বলল, “ঈশ দেখেছিস? কাজের চাপে আমি এ খবরটাও তোকে দিতে ভুলে গেছিরে। আরে রচু আর দাদাভাই আজ এক জায়গায় বেড়াতে গেছে রে। তাই হয়তো তোর ফোন ধরেনি। হয়তো ফোনটা ব্যাগের মধ্যে আছে। বা সাইলেন্ট করা আছে। তুই ভাবিসনে। দুপুরেই আমি এ খবরটা পেয়েছিলুম। ভেবেছিলুম বাড়ি ফিরে তোকে বলব। কিন্তু বাজারে এসে একটা জরুরী কাজ সারতে সারতে তোকে কথাটা জানাতেও ভুলে গেছি রে বোন। প্লীজ, কিছু মনে করিস নে”।
অর্চনা খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও তাই বুঝি? কিন্তু ও তো ঘর থেকে বেরোবার আগে আমাকে বা ভাইকে কথাটা জানিয়ে দিতে পারতো। আমি এদিকে চিন্তায় মরছি। কিন্তু ও দিদিভাই, ওরা যে বিপদের মধ্যে আছে, এরমধ্যে আবার বাইরে বেড়াতে যাবার দরকারটা কি ছিল বলো তো”?
সীমন্তিনী মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “আঃ অর্চু, কি হচ্ছে? লক্ষ্মীদি তো শুনে ফেলতে পারে তোর কথা। তখন আমার মাথা খেয়ে ফেলবে”।
অর্চনা চাপা গলায় বলল, “না না দিদিভাই, লক্ষ্মীদি এখন রান্নায় ব্যস্ত আছে। আমি তো আমাদের ঘর থেকে কথা বলছি তোমার সাথে। শুনতে পাবে না। কিন্তু দিদিভাই, ওরা যখন তোমাকে বাইরে বেড়াতে যাবার কথা বললো, তখন তুমি বাধা দাওনি কেন বলো তো? ওরা না জানুক, তুমি তো জানো ওরা কতটা খারাপ সময়ের মধ্যে আছে”।
সীমন্তিনী হাল্কা করে হেসে বলল, “আরে পাগলী, ভয়ের কিচ্ছু নেই রে। ওদের সাথে পরিও আছে। তাই আমি বারণ করিনি। এবার বুঝেছিস”?
অর্চনা এবার পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও তাই বলো। যাক, এখন নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু আমি কিন্তু আজ রচুকে খুব বকবো দিদিভাই। বাইরে কোথাও গেলেই কি ফোন করা বা ফোন ধরা মানা”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “সে তুই তোর ছোট বোনকে বকতেই পারিস। এর ভেতর আমার আর কি বলার থাকতে পারে বল। তা সন্ধ্যেয় চা জল খাবার খেয়েছিস তো? না আমরা বাড়ি নেই বলে তুইও না খেয়ে আছিস”?
অর্চনাও হেসে বলল, “তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম তো। তাই একটু দেরী হয়ে গেছে। তারপর যখন শুনলাম তুমি বাজারের দিকে গেছ, তখন আমি আর লক্ষ্মীদি খেয়ে নিয়েছি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আর রাত আটটার সময় যে ওষুধ ছিল তোর? সেটা খেয়েছিস তো”?
অর্চনা আবারও হেসে বলল, “না খেয়ে উপায় আছে? ঘড়ির কাটায় আটটা বাজতে না বাজতেই লক্ষ্মীদি ওষুধ নিয়ে এসে হাজির”।
সীমন্তিনী এবার আদুরে সুরে বলল, “খুব ভাল করেছিস। সোনা বোন আমার। আর শোন, আমরা প্রায় এসেই গেছি। আর চার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব। তাই ছাড়ছি এখন, হ্যাঁ? বাই”।
ও’পাশ থেকে অর্চনাও ‘বাই’ বলতে সীমন্তিনী ফোন পকেটে পুরতেই নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “পরি সত্যি রতীশদা আর বৌদিকে নিয়ে বাইরে কোথাও গেছে দিদি? কী দরকার ছিল এতটা ঝুঁকি নেবার বলো তো”?
সীমন্তিনী চাপা গলায় বলল, “আস্তে, ড্রাইভার শুনে ফেলতে পারে। আর তুই এত ভাবছিস কেন? রচু আর দাদাভাইয়ের দায়িত্ব তো পরিই নিয়েছে। পরি যদি তাদের কোথাও নিয়ে যায় এতে তোর আমার চিন্তার কি আছে? ঝুঁকি আছে কি না, বা কিজন্যে পরি এমন করছে, সেটা তো ও নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে ভাল বুঝবে। আর বুঝে শুনেই করবে। তুই আর আমি এতদুর থেকে সবকিছু তো আর জানতে বুঝতে পারব না। তাই পরির ওপরেই তো আমরা ভরসা করে বসে আছি। তবে পরি আমাকে ব্যাপারটা আজ সকালেই জানিয়েছিল। কিন্তু কোথায় কেন নিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে আমার বিশ্বাস পরি কিছু একটা প্ল্যান করেই এ’সব করছে। তবে ও নিয়ে মিছে ভাবিসনে। পরে ঠিকই জানতে পারব আমরা”।
একটু থেমে সীমন্তিনী আবার বলল, “আর শোন নীতা, অর্চুকে পরির ছবি দেখাবার আগে বা আমরা যে তাদের দু’জনের বিয়ে দিতে চাই, এ কথাটা জানাবার আগে তুই কিন্তু একটা কাজ করতে পারিস”।
নবনীতা উৎসুক ভাবে বলল, “কী কাজ দিদি”?
সীমন্তিনী বলল, “অর্চুর সাথে পরির ব্যাপারে মাঝে মাঝেই গল্প করবি। পরির স্বভাব চরিত্র, ব্যবহার, ওর একাকীত্ব, পরের উপকার করবার নেশা, ওর গুণাগুণ, ওর বাড়ির পরিবেশ আর আরও যা কিছু মনে পড়ে তোর, সে সব কিছু নিয়ে খুব খুব গল্প করবি। যাতে পরির সম্বন্ধে ওর মনে একটা ধারণা জন্মে যায়। তবে কিছু বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলবি না, বুঝেছিস"?
নবনীতা খুশী হয়ে বলল, “ঠিক বলেছ দিদি। আগে থেকে পরির সম্বন্ধে ওর মনে একটা পজিটিভ ধারণা জন্মালে যখন আমরা ওকে পরির ছবি দেখাব, আর যখন ও জানতে পারবে যে ওর বাবা-মাও পরিকে পছন্দ করেছেন, তখন ও আর একেবারেই অমত করবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো দিদি। এ দায়িত্ব আমি খুব ভালভাবে পালন করব”।
বলতে না বলতেই গাড়ি কোয়ার্টারের গেটে এসে পৌঁছলো। কিন্তু গাড়ির শব্দ পেয়েই অর্চনা ঘরের দড়জা খুলে বাইরে এসেছিল বলে নবনীতা আর নাচতে নাচতে সীমন্তিনীকে চুমু খেতে পারল না।
*******************
রাতের ডিনার সেরে সীমন্তিনীর ঘরে যখন মন্তি, নবনীতা আর অর্চনা এসে বসল, তখনই রচনার ফোন এল সীমন্তিনীর ফোনে। সীমন্তিনী ফোনটা অর্চনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নে অর্চু। তোর বোন ফোন করেছে। তুই তো তখন থেকে উতলা হয়ে আছিস। তুই আগে কথা বলে নে, তারপর আমরা কথা বলব”।
অর্চনা ফোন হাতে নিয়ে কল রিসিভ করেই ফোনটাকে স্পীকার মোডে দিয়ে বলল, “হ্যাঁরে রচু, তুই কী রে? সন্ধ্যের পর থেকে আমি তিন তিনবার তোকে ফোনে করেছি, ভাই তোকে ফোন করেছে। তুই কারুর ফোন ধরছিস না। কি ব্যাপার রে তোদের”?
রচনা অপরাধীর মত গলা করে জবাব দিল, “সত্যিরে দিদি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে রে আমার। রাগ করিসনে লক্ষ্মীটি। আসলে হয়েছে কি জানিস, আজ পরিতোষদার সাথে আমি আর উনি দমদমের দিকে পরিতোষদার পরিচিত একজনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলুম। আর ফোনটাকে আমার পার্সের ভেতরে রেখে দিয়েছিলুম। ও বাড়িতে গিয়ে দীপাদির বেডরুমে বসে গল্প করছিলুম, আর পার্সটা রেখে দিয়েছিলুম ওদের ড্রয়িং রুমের সোফায়। আমরা ওনাদের বেডরুমে ঢুকে যাবার পর পরিদা আর ডাক্তার বাবুও আরেক ঘরে গিয়ে গল্প করছিলেন। তাই ফোনের শব্দ আমরা কেউই টের পাইনি। সবাই মিলে খুব মজা করে রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ যখন বেড়োলাম ওখান থেকে তখনই ফোনটা বের করে দেখি তোর আর ভাইয়ের অনেকগুলো মিস কল। আর সেটা দেখেই সাথে সাথে আগে ভাইকে ফোন করলুম। তারপর দিদিভাইয়ের নাম্বারে ফোন করলুম তোদের সকলের সাথে কথা বলব বলে। রোজ নিয়ম করে দিদিভাইকে রাত আটটার দিকে আমি ফোন করি। আজ ও বাড়িতে গিয়ে সব যেন একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম। হ্যাঁরে দিদি, দিদিভাই নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন না রে? নইলে নিজে ফোনটা না ধরে তোকে দিয়ে দিতেন”?
অর্চনা এবার মোলায়েম স্বরে বলল, “দিদিভাই তো জানতেনই যে তোরা পরিতোষবাবুর সাথে কোথাও বেড়িয়েছিস। তবে দিদিভাইয়েরও আজ বাড়ি ফিরতে অনেক দেরী হয়েছে। রাত প্রায় সাড়ে ন’টার দিকে এসেছেন। নীতাদিও তার সাথে একই সাথে এসেছেন। দুপুর থেকে বাড়িতে শুধু আমি আর লক্ষ্মীদি ছিলুম। তোকে ফোন করে না পেয়ে আমিই দিদিভাইকে ফোন করেছিলুম। কিন্তু তিনি মার্কেটের দিকে কোথাও কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলেই তখন নীতাদিই ফোনটা ধরেছিলেন। পরে অবশ্য দিদিভাইয়ের কাজ শেষ হতেই উনি আমাকে ফোন করেছিলেন। তখনই শুনলুম তোরা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিস। এখন দিদিভাই আর আমরা সবাই একসাথেই বসে আছি। তুই ফোন করেছিস দেখেই, আমি তোর সাথে কথা বলবার জন্যে খুব উতলা ছিলাম বলে উনি আমাকেই আগে কথা বলতে বললেন। এই নে, তার সাথে কথা বল”।
সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়েই বলল, “কিরে পাগলী, খুব তো যাব না যাব না বলছিলিস। আমিই তো তোকে জোর করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠালুম। আর ওখানে গিয়ে এতই মজে গেলি যে রাত সাড়ে এগারটায় ওখান থেকে বেড়োলি তোরা? দিদিভাইকে ফোন করতেও ভুলে গেলি একেবারে? আমি তো ওই ডাক্তার আর তার পরিবারের কাউকে চিনি না। এমন কি ছিলরে ওখানে”?
রচনা উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল, “ও দিদিভাই, তোমাকে কি বলব গো। ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়ার স্ত্রী যে কী ভাল মহিলা না? কী বলব তোমাকে। আর জানো দিদিভাই, ওই দীপাদির আপন দাদাই আমাদের কালচিনি হাসপাতালের ওই ডাক্তার সোম গো। ও বাড়িতে যাবার পরে পরেই তার অমন পরিচয় পেয়েই তো আমি গলে গিয়েছিলুম। আর কী ভাল যে সে মহিলা কি বলব তোমাকে দিদিভাই। তোমার দাদাভাইকে তো সে প্রথমেই নিজের ভাই বানিয়ে নিলেন। আর তাদের মেয়েটা আকাঙ্ক্ষা, কী মিষ্টি সে মেয়েটা গো দিদিভাই। ওকে দেখেই তো আমার চন্দুর কথা মনে পড়ে গেছে। ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু মামী মামী বলে আমাকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। সারাটা সময় আমার গায়ে গায়ে লেগেছিল ও। বারবার আদর করছিল আমাকে। আমার তো ওর দিকে তাকালেই চন্দুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। চন্দুটাকে কতদিন ধরে দেখি না। আজ আকাঙ্ক্ষাকে দেখবার পর চন্দুটার জন্যে ভীষণ মন খারাপ ......” বলতে বলতেই থেমে গেল।
সীমন্তিনী বেশ কয়েকবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করেও আর সাড়া পাচ্ছিল না। একটু বাদে রতীশের গলা ভেসে এল, “ও কেঁদে ফেলেছে রে মন্তি। তবে শোন, এখন আমরা রাস্তায় আছি। পরিতোষদার গাড়িতেই আমরা বাড়ির দিকে ফিরছি। তবে কলকাতা আসবার পর এত সুন্দর সন্ধ্যে এই প্রথম কাটল আমাদের দু’জনের। সত্যি বলছি মন্তি, আজকের সন্ধ্যেটার জন্য তোকে আর পরিতোষদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ রে। তবে শোন, এখন রচুকে সামলাতে হচ্ছে। তাছাড়া আজ তো অনেক রাতও হয়ে গেল। তাই কাল বাকি কথা শুনিস। আমিও পরে তোর সাথে কথা বলব। গুডনাইট” বলে ফোন কেটে দিল।
*****************
______________________________
সীমন্তিনী নবনীতাকে বোঝাবার প্রয়াস করতে করতে বলল, “আরে পাগলী, সে তো দিয়েছে। তবু এখন যখন আমরা অর্চুকে ওর জন্যে পছন্দ করেই ফেলেছি, তখন ওর সাথে একবার কথা বলা খুবই দরকারী। অবশ্য কাল রাতেই পরিতোষকে আমি বলেছিলুম যে আমি ওর মোবাইলে একটা মেয়ের ছবি পাঠাচ্ছি, সে মেয়েটাকে ওর পছন্দ হয় কিনা তা যেন আমাকে জানায়। কিন্তু পরিতোষ ওই বিমল আগরওয়ালার কেসটা নিয়ে বড্ড বাজে ভাবে ব্যস্ত আছে বলে জানাল। ও আশা করছে, আর দিন সাতেকের ভেতরেই বিমলের বিরূদ্ধে অপারেশনটা শেষ হয়ে যাবে। তাই সে এই সাতদিনে আর অন্য কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাইছে না। আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর ওকে কিছু বলিনি। অর্চুর ছবিও এখনও পাঠাঁইনি ওর কাছে। অবশ্য তখনও ও একই কথা বলেছে যে তুই আর আমি পছন্দ করলেই হবে। তবু ফাইনালি বিয়ের ব্যাপারে মাসি মেসোদের সাথে কথা বলবার আগে, অর্চুর ছবি পরিতোষকে দেখানোটা খুবই জরুরী। আর তার পছন্দ হওয়াটাই সমান জরুরী। তাই সেটার জন্যে এ’ ক’টা দিন আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে”।
নবনীতা নিজের খুশী চেপে রাখতে পারছিল না যেন। সে আবার বলে উঠল, “তুমিও যে অর্চুকে পছন্দ করেছ এটা জেনে আমার ভেতরে ভেতরে যে কী খুশীর জোয়ার বইছে দিদি, আমি তোমায় সেটা বলে বোঝাতে পারব না গো। ঈশ, আমার এখন কি ইচ্ছে করছে জানো দিদি? আমার ইচ্ছে করছে এখনই উঠে ধেই ধেই করে নাচি”।
সীমন্তিনীও হেসে বলল, “নাচতে ইচ্ছে করছে তো বাড়ির সামনে গিয়ে নাচিস। তবে ঘরে ঢোকবার আগে। অর্চু যেন তোর নাচ না দেখে ফেলে, সেদিকে খেয়াল রাখিস। কারন আমাদের উদ্দেশ্যটা সফল হোক বা না হোক, অর্চুকে কোনও কষ্ট পেতে দেব না আমি। আমি তোর কাছ থেকেও ঠিক সেটাই চাই নীতা”।
নবনীতা এবার খানিকটা শান্ত হয়ে বলল, “আমার মন বলছে দিদি, তেমন কিছুই হবে না। দ্যাখো, সেদিন আমরা যখন অর্চুকে আবার বিয়ে করবার কথা বলছিলুম, সেদিন অর্চুও তো বলেছে তুমি যা বলবে ও তাই মেনে নেবে। আর পরিও একই কথা বলেছে। তাই এ ব্যাপারে আর কোনও জটিলতার তো কিছুই নেই। তুমি কেন এত নিগেটিভ ভাবছ”?
সীমন্তিনী শান্ত গলায় আবার বলল, “সে সব ঠিক আছে নীতা। তবু আমি চাইছি বিয়ের পিড়িতে বসবার আগে ওরা দু’জন দু’জনকে একবার দেখে নিক। কিন্তু সেটা করতে হলে হয় অর্চুকে নিয়ে আমাকে কলকাতা যেতে হবে, নয়তো পরিকে এখানে অথবা কালচিনিতে আসতে হবে। কিন্তু আমি আর পরি দু’জনেই এখন অনেক ক’টা ব্যাপারে খুব ব্যস্ত। আমি যেমন একদিকে অর্চুকে নিয়ে ভাবছি, আবার ও’দিকে কালচিনির বাড়ি বানাবার কথা ভাবছি। আবার মহিমা বৌদির ব্যাপারেও একটা প্ল্যান করছি। তুই হয়ত জানিস না, তোর মহিমা ম্যাডাম আর তার ওই এসকর্টের ব্যবসা করতে চাইছেন না। তাই উনি এ ব্যাপারে আমার সাহায্য চাইছেন। তবে হ্যাঁ, একটা কথা মনে পড়ে গেলরে হঠাৎ। শোন নীতা, আমি যে পুলিশ অফিসার, এ’কথাটা তুই যেন তোর মহিমা ম্যাডামকে বলে ফেলিস না। তাকে এসকর্ট ব্যবসা থেকে বাইরে বের করে আনার পর সেটা তার কাছে প্রকাশ করব। তুই প্লীজ, কথাটা সব সময় মনে রাখিস। আর হ্যাঁ, ওদিকে দাদাভাই, রচু আর পরিকে নিয়েও আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। আবার ভাইয়ের হায়ার স্টাডিজের ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে। তাই আমার পক্ষে এ মূহুর্তে কলকাতা যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আর পরিও এখন কিছুদিন এমন ব্যস্ততার মধ্যে আছে যে ওকে এখানে বা কালচিনিতে আসতেও বলা যাচ্ছে না। তাই আপাততঃ আমি ভাবছি যে অর্চু আর পরি দু’জনকেই দু’জনের ছবি দেখিয়ে তাদের মতামত চাইব। তবে অর্চুকে আগেই পরির ছবিটা দেখাব না, আগে পরিকে অর্চুর ছবি দেখাতে হবে। বুঝলি”?
নবনীতা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবল। তারপর কিছুটা কাতর গলায় বলল, “ও দিদি, আমাদের ভাবনা যেন সত্যি হয় গো। পরির সাথে অর্চুর বিয়েটা যেন আমরা দিতে পারি গো। আমার মন বলছে দিদি, এ বিয়েটা হলে পরি আর অর্চু দু’জনেই খুব সুখী হবে। যে ভাবেই হোক এটা আমাদের করতেই হবে” বলেই আবার একটু থেমে বলল, “আচ্ছা দিদি, তোমার কি মনে হয়, বৌদির মা বাবা কিংবা রতীশদা বা বৌদি এরা কেউ কি এ বিয়ের ব্যাপারে অমত প্রকাশ করতে পারে”?
সীমন্তিনী মুচকি হেসে বলল, “তুই কি ভাবিস, কাল আমি কালচিনি গিয়েছিলাম এমনি এমনি? কাল কালচিনি যাবার পেছনে মূল উদ্দেশ্য আমার এটাই ছিল রে। মাসি মেসো ভাই, সব্বাই রাজী হয়েছেন রে। আর দাদাভাই আর রচুও রাজী”।
নবনীতা আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “সত্যি দিদি”?
সীমন্তিনী চাপা কন্ঠে নবনীতাকে শান্ত থাকতে বলে বলল, “হ্যাঁরে সত্যি বলছি। আমাদের এখন শুধু দুই দেবাদেবির মনের ইচ্ছেটাই শুধু জানতে হবে। সেটা তুই আর আমি মিলে অবশ্যই করব। মন তো বলছে, ওরা কেউই অরাজী হবে না। তবু ওদের মুখ থেকে সেটা শোনা খুব দরকার। তবে তুই একটু সাবধান থাকিস। পরির সাথে কথা বলবার আগে অর্চুকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোন আঁচ দিস নে। কালচিনির বাড়ির সবাইকে, দাদাভাই আর রচুকেও এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছি। ওরাও কেউ আমার কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল না পাওয়া অব্দি অর্চুকে কিছু জানাবে না। তুইও প্লীজ এ’কথাটা মাথায় রাখিস বোন”।
নবনীতা বলল, “ঠিক আছে দিদি। আমি তোমাকে কথা দিলাম। পরির সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত আমিও অর্চুকে কিছু বুঝতে দেব না এ ব্যাপারে। এবার চল, আমরা উঠি। অর্চুটা ওদিকে বৌদির সাথে কথা বলতে না পেরে চিন্তায় আছি। আমাদেরও কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেল। তাই এখন আর একদম দেরী করা ঠিক হবে না, চলো”।
বাড়ি ফেরার পথেই সীমন্তিনী অর্চনাকে ফোন করে বলল, “অর্চু সোনা, আজ তোকে অনেকক্ষণ একা থাকতে হলরে। কিছু মনে করিস নে বোন। আসলে একটা জরুরী কাজ শেষ করতে খুব দেরী হয়ে গেল রে। আর নীতাটাকেও আমি আমার সাথেই আটকে রেখে দিয়েছিলুম। তোর খুব খারাপ লেগেছে নারে”?
অর্চনা ও’পাশ থেকে জবাব দিল, “না না দিদিভাই, তোমরা তো আর আমাকে একা ছেড়ে কোথাও মজা করতে যাও নি। কাজ থাকলে সে তো করতেই হবে। শুধু তোমাদের ফিরতে দেরী হচ্ছিল বলেই একটু চিন্তা হচ্ছিল। আর ওদিকে দেখোনা, রচুকে সন্ধ্যের পর থেকে তিন তিনবার ফোন করলুম। একবারও ও ফোনটা ধরছে না। বাড়িতে ফোন করতে ভাইও বলল যে ও বাড়ির কেউও জানে না। সেজন্যেই আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে গো? ও দিদিভাই, তুমি কি জানো, রচু ওরা এখন কোথায়”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে আশ্বস্ত করতে বলল, “ঈশ দেখেছিস? কাজের চাপে আমি এ খবরটাও তোকে দিতে ভুলে গেছিরে। আরে রচু আর দাদাভাই আজ এক জায়গায় বেড়াতে গেছে রে। তাই হয়তো তোর ফোন ধরেনি। হয়তো ফোনটা ব্যাগের মধ্যে আছে। বা সাইলেন্ট করা আছে। তুই ভাবিসনে। দুপুরেই আমি এ খবরটা পেয়েছিলুম। ভেবেছিলুম বাড়ি ফিরে তোকে বলব। কিন্তু বাজারে এসে একটা জরুরী কাজ সারতে সারতে তোকে কথাটা জানাতেও ভুলে গেছি রে বোন। প্লীজ, কিছু মনে করিস নে”।
অর্চনা খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও তাই বুঝি? কিন্তু ও তো ঘর থেকে বেরোবার আগে আমাকে বা ভাইকে কথাটা জানিয়ে দিতে পারতো। আমি এদিকে চিন্তায় মরছি। কিন্তু ও দিদিভাই, ওরা যে বিপদের মধ্যে আছে, এরমধ্যে আবার বাইরে বেড়াতে যাবার দরকারটা কি ছিল বলো তো”?
সীমন্তিনী মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “আঃ অর্চু, কি হচ্ছে? লক্ষ্মীদি তো শুনে ফেলতে পারে তোর কথা। তখন আমার মাথা খেয়ে ফেলবে”।
অর্চনা চাপা গলায় বলল, “না না দিদিভাই, লক্ষ্মীদি এখন রান্নায় ব্যস্ত আছে। আমি তো আমাদের ঘর থেকে কথা বলছি তোমার সাথে। শুনতে পাবে না। কিন্তু দিদিভাই, ওরা যখন তোমাকে বাইরে বেড়াতে যাবার কথা বললো, তখন তুমি বাধা দাওনি কেন বলো তো? ওরা না জানুক, তুমি তো জানো ওরা কতটা খারাপ সময়ের মধ্যে আছে”।
সীমন্তিনী হাল্কা করে হেসে বলল, “আরে পাগলী, ভয়ের কিচ্ছু নেই রে। ওদের সাথে পরিও আছে। তাই আমি বারণ করিনি। এবার বুঝেছিস”?
অর্চনা এবার পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও তাই বলো। যাক, এখন নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু আমি কিন্তু আজ রচুকে খুব বকবো দিদিভাই। বাইরে কোথাও গেলেই কি ফোন করা বা ফোন ধরা মানা”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “সে তুই তোর ছোট বোনকে বকতেই পারিস। এর ভেতর আমার আর কি বলার থাকতে পারে বল। তা সন্ধ্যেয় চা জল খাবার খেয়েছিস তো? না আমরা বাড়ি নেই বলে তুইও না খেয়ে আছিস”?
অর্চনাও হেসে বলল, “তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম তো। তাই একটু দেরী হয়ে গেছে। তারপর যখন শুনলাম তুমি বাজারের দিকে গেছ, তখন আমি আর লক্ষ্মীদি খেয়ে নিয়েছি”।
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আর রাত আটটার সময় যে ওষুধ ছিল তোর? সেটা খেয়েছিস তো”?
অর্চনা আবারও হেসে বলল, “না খেয়ে উপায় আছে? ঘড়ির কাটায় আটটা বাজতে না বাজতেই লক্ষ্মীদি ওষুধ নিয়ে এসে হাজির”।
সীমন্তিনী এবার আদুরে সুরে বলল, “খুব ভাল করেছিস। সোনা বোন আমার। আর শোন, আমরা প্রায় এসেই গেছি। আর চার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব। তাই ছাড়ছি এখন, হ্যাঁ? বাই”।
ও’পাশ থেকে অর্চনাও ‘বাই’ বলতে সীমন্তিনী ফোন পকেটে পুরতেই নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “পরি সত্যি রতীশদা আর বৌদিকে নিয়ে বাইরে কোথাও গেছে দিদি? কী দরকার ছিল এতটা ঝুঁকি নেবার বলো তো”?
সীমন্তিনী চাপা গলায় বলল, “আস্তে, ড্রাইভার শুনে ফেলতে পারে। আর তুই এত ভাবছিস কেন? রচু আর দাদাভাইয়ের দায়িত্ব তো পরিই নিয়েছে। পরি যদি তাদের কোথাও নিয়ে যায় এতে তোর আমার চিন্তার কি আছে? ঝুঁকি আছে কি না, বা কিজন্যে পরি এমন করছে, সেটা তো ও নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে ভাল বুঝবে। আর বুঝে শুনেই করবে। তুই আর আমি এতদুর থেকে সবকিছু তো আর জানতে বুঝতে পারব না। তাই পরির ওপরেই তো আমরা ভরসা করে বসে আছি। তবে পরি আমাকে ব্যাপারটা আজ সকালেই জানিয়েছিল। কিন্তু কোথায় কেন নিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে আমার বিশ্বাস পরি কিছু একটা প্ল্যান করেই এ’সব করছে। তবে ও নিয়ে মিছে ভাবিসনে। পরে ঠিকই জানতে পারব আমরা”।
একটু থেমে সীমন্তিনী আবার বলল, “আর শোন নীতা, অর্চুকে পরির ছবি দেখাবার আগে বা আমরা যে তাদের দু’জনের বিয়ে দিতে চাই, এ কথাটা জানাবার আগে তুই কিন্তু একটা কাজ করতে পারিস”।
নবনীতা উৎসুক ভাবে বলল, “কী কাজ দিদি”?
সীমন্তিনী বলল, “অর্চুর সাথে পরির ব্যাপারে মাঝে মাঝেই গল্প করবি। পরির স্বভাব চরিত্র, ব্যবহার, ওর একাকীত্ব, পরের উপকার করবার নেশা, ওর গুণাগুণ, ওর বাড়ির পরিবেশ আর আরও যা কিছু মনে পড়ে তোর, সে সব কিছু নিয়ে খুব খুব গল্প করবি। যাতে পরির সম্বন্ধে ওর মনে একটা ধারণা জন্মে যায়। তবে কিছু বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলবি না, বুঝেছিস"?
নবনীতা খুশী হয়ে বলল, “ঠিক বলেছ দিদি। আগে থেকে পরির সম্বন্ধে ওর মনে একটা পজিটিভ ধারণা জন্মালে যখন আমরা ওকে পরির ছবি দেখাব, আর যখন ও জানতে পারবে যে ওর বাবা-মাও পরিকে পছন্দ করেছেন, তখন ও আর একেবারেই অমত করবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো দিদি। এ দায়িত্ব আমি খুব ভালভাবে পালন করব”।
বলতে না বলতেই গাড়ি কোয়ার্টারের গেটে এসে পৌঁছলো। কিন্তু গাড়ির শব্দ পেয়েই অর্চনা ঘরের দড়জা খুলে বাইরে এসেছিল বলে নবনীতা আর নাচতে নাচতে সীমন্তিনীকে চুমু খেতে পারল না।
*******************
রাতের ডিনার সেরে সীমন্তিনীর ঘরে যখন মন্তি, নবনীতা আর অর্চনা এসে বসল, তখনই রচনার ফোন এল সীমন্তিনীর ফোনে। সীমন্তিনী ফোনটা অর্চনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নে অর্চু। তোর বোন ফোন করেছে। তুই তো তখন থেকে উতলা হয়ে আছিস। তুই আগে কথা বলে নে, তারপর আমরা কথা বলব”।
অর্চনা ফোন হাতে নিয়ে কল রিসিভ করেই ফোনটাকে স্পীকার মোডে দিয়ে বলল, “হ্যাঁরে রচু, তুই কী রে? সন্ধ্যের পর থেকে আমি তিন তিনবার তোকে ফোনে করেছি, ভাই তোকে ফোন করেছে। তুই কারুর ফোন ধরছিস না। কি ব্যাপার রে তোদের”?
রচনা অপরাধীর মত গলা করে জবাব দিল, “সত্যিরে দিদি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে রে আমার। রাগ করিসনে লক্ষ্মীটি। আসলে হয়েছে কি জানিস, আজ পরিতোষদার সাথে আমি আর উনি দমদমের দিকে পরিতোষদার পরিচিত একজনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলুম। আর ফোনটাকে আমার পার্সের ভেতরে রেখে দিয়েছিলুম। ও বাড়িতে গিয়ে দীপাদির বেডরুমে বসে গল্প করছিলুম, আর পার্সটা রেখে দিয়েছিলুম ওদের ড্রয়িং রুমের সোফায়। আমরা ওনাদের বেডরুমে ঢুকে যাবার পর পরিদা আর ডাক্তার বাবুও আরেক ঘরে গিয়ে গল্প করছিলেন। তাই ফোনের শব্দ আমরা কেউই টের পাইনি। সবাই মিলে খুব মজা করে রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ যখন বেড়োলাম ওখান থেকে তখনই ফোনটা বের করে দেখি তোর আর ভাইয়ের অনেকগুলো মিস কল। আর সেটা দেখেই সাথে সাথে আগে ভাইকে ফোন করলুম। তারপর দিদিভাইয়ের নাম্বারে ফোন করলুম তোদের সকলের সাথে কথা বলব বলে। রোজ নিয়ম করে দিদিভাইকে রাত আটটার দিকে আমি ফোন করি। আজ ও বাড়িতে গিয়ে সব যেন একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম। হ্যাঁরে দিদি, দিদিভাই নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন না রে? নইলে নিজে ফোনটা না ধরে তোকে দিয়ে দিতেন”?
অর্চনা এবার মোলায়েম স্বরে বলল, “দিদিভাই তো জানতেনই যে তোরা পরিতোষবাবুর সাথে কোথাও বেড়িয়েছিস। তবে দিদিভাইয়েরও আজ বাড়ি ফিরতে অনেক দেরী হয়েছে। রাত প্রায় সাড়ে ন’টার দিকে এসেছেন। নীতাদিও তার সাথে একই সাথে এসেছেন। দুপুর থেকে বাড়িতে শুধু আমি আর লক্ষ্মীদি ছিলুম। তোকে ফোন করে না পেয়ে আমিই দিদিভাইকে ফোন করেছিলুম। কিন্তু তিনি মার্কেটের দিকে কোথাও কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলেই তখন নীতাদিই ফোনটা ধরেছিলেন। পরে অবশ্য দিদিভাইয়ের কাজ শেষ হতেই উনি আমাকে ফোন করেছিলেন। তখনই শুনলুম তোরা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিস। এখন দিদিভাই আর আমরা সবাই একসাথেই বসে আছি। তুই ফোন করেছিস দেখেই, আমি তোর সাথে কথা বলবার জন্যে খুব উতলা ছিলাম বলে উনি আমাকেই আগে কথা বলতে বললেন। এই নে, তার সাথে কথা বল”।
সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়েই বলল, “কিরে পাগলী, খুব তো যাব না যাব না বলছিলিস। আমিই তো তোকে জোর করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠালুম। আর ওখানে গিয়ে এতই মজে গেলি যে রাত সাড়ে এগারটায় ওখান থেকে বেড়োলি তোরা? দিদিভাইকে ফোন করতেও ভুলে গেলি একেবারে? আমি তো ওই ডাক্তার আর তার পরিবারের কাউকে চিনি না। এমন কি ছিলরে ওখানে”?
রচনা উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল, “ও দিদিভাই, তোমাকে কি বলব গো। ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়ার স্ত্রী যে কী ভাল মহিলা না? কী বলব তোমাকে। আর জানো দিদিভাই, ওই দীপাদির আপন দাদাই আমাদের কালচিনি হাসপাতালের ওই ডাক্তার সোম গো। ও বাড়িতে যাবার পরে পরেই তার অমন পরিচয় পেয়েই তো আমি গলে গিয়েছিলুম। আর কী ভাল যে সে মহিলা কি বলব তোমাকে দিদিভাই। তোমার দাদাভাইকে তো সে প্রথমেই নিজের ভাই বানিয়ে নিলেন। আর তাদের মেয়েটা আকাঙ্ক্ষা, কী মিষ্টি সে মেয়েটা গো দিদিভাই। ওকে দেখেই তো আমার চন্দুর কথা মনে পড়ে গেছে। ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু মামী মামী বলে আমাকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। সারাটা সময় আমার গায়ে গায়ে লেগেছিল ও। বারবার আদর করছিল আমাকে। আমার তো ওর দিকে তাকালেই চন্দুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। চন্দুটাকে কতদিন ধরে দেখি না। আজ আকাঙ্ক্ষাকে দেখবার পর চন্দুটার জন্যে ভীষণ মন খারাপ ......” বলতে বলতেই থেমে গেল।
সীমন্তিনী বেশ কয়েকবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করেও আর সাড়া পাচ্ছিল না। একটু বাদে রতীশের গলা ভেসে এল, “ও কেঁদে ফেলেছে রে মন্তি। তবে শোন, এখন আমরা রাস্তায় আছি। পরিতোষদার গাড়িতেই আমরা বাড়ির দিকে ফিরছি। তবে কলকাতা আসবার পর এত সুন্দর সন্ধ্যে এই প্রথম কাটল আমাদের দু’জনের। সত্যি বলছি মন্তি, আজকের সন্ধ্যেটার জন্য তোকে আর পরিতোষদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ রে। তবে শোন, এখন রচুকে সামলাতে হচ্ছে। তাছাড়া আজ তো অনেক রাতও হয়ে গেল। তাই কাল বাকি কথা শুনিস। আমিও পরে তোর সাথে কথা বলব। গুডনাইট” বলে ফোন কেটে দিল।
*****************
______________________________