21-03-2020, 07:10 PM
(Update No. 181)
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সীমন্তিনী অফিস থেকে বেড়িয়ে নিজের কোয়ার্টারে না এসে বাজারের দিকে চলল। সে কথাটা আগেই মনে মনে ভেবে রেখেছিল যে বিয়ের ব্যাপারে অর্চনার মতামত নেবার আগে নবনীতার সাথে কথা বলাটা খুব প্রয়োজন। পরির তরফ থেকে কোনও বাধা যে আসবে না, এ ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত। নবনীতা পরিতোষকে বিয়ে করতে রাজী না হলেও একটা সময় সে তো পরিকে ভাল বেসেছিল। তাই পরিতোষের ওপর সামান্য কিছু দুর্বলতা তার এখনও থাকতেই পারে। যদিও সে নিজে মুখেই বলেছে যে সীমন্তিনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়েই সে পরিতোষের জন্য একটা ভাল পাত্রীর সন্ধান করবে। কিন্তু নিজের ভালবাসার লোককে অন্যের হাতে তুলে দিতে অনেকেরই বুক কেঁপে ওঠে। তার মনে পড়ে গেল রাজগঞ্জের বাড়িতে কাটানো সেই রাতটার কথা। রতীশ আর রচনার বিয়ের আগে শেষবার যখন সে রাজগঞ্জ গিয়েছিল। নিজের ভালবাসার লোকটাকে চিরদিনের জন্য রচনার হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে রতীশ আর তার ভেতরে সে রাতে রতীশের ঘরে তার যখন কথা হচ্ছিল, তখন মুখে তার সামান্য স্মিত হাসি থাকলেও তার বুকের ভেতরটায় ওই সময়গুলোতে যে কষ্ট হয়েছিল, সে কষ্ট সহ্য করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। বুকের ভেতরটা সে রাতে তার ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। যার কথা একমাত্র তার অন্তরাত্মা ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি। সে নিজে যেমন ছোট্ট বয়স থেকেই জানত যে তার ভালোবাসা কোনদিন পরিণতি পাবে না, নবনীতা তো তেমন জানত না। সে নিজে যেমন জানত যে তার প্রেমিককে সে সারা জীবনেও নিজের স্বামী রূপে কাছে পাবে না, নবনীতার ক্ষেত্রে তো তেমন ছিল না। একটা সময় পরিতোষের বাবা নবনীতাকে তার হবু পুত্রবধূরূপে আশীর্বাদ করেছিলেন। নবনীতার পরিবারও তো পরিতোষ আর তার বিয়েতে রাজী হয়েছিল। হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য বশতঃ নবনীতার সে স্বপ্নটা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু এতদিন বাদেও তো পরিতোষ তাকে নিজের করে নিতে রাজী আছে। এ’কথা তো নবনীতাও খুব ভাল করে জানে। আজও যদি নবনীতা নিজের মত বদলে ফেলতে পারে, তাহলে পরিতোষ তাকে নিশ্চয়ই বিয়ে করতে রাজী হবে। কিন্তু সে যদি নিজের চিন্তাধারা বদলাতে না পারে, সে যখন বুঝতে পারবে যে তার ভালবাসার পাত্রটি অন্য আরেকটা মেয়েকে চিরতরে তার জীবনসঙ্গী করে নিতে চলেছে, তখন হয়ত চেপে রাখা আবেগ আর সামলে রাখতে পারবে না সে। তাই ওর সাথে পরিষ্কার করে আরেকবার আলোচনা করে নেওয়াটা ভীষণ দরকার। যদি দেখা যায় পরিকে বিয়ে করতে নবনীতা একটু হলেও নিমরাজীও হয়েছে, তখন অর্চু আর পরির বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আর এগোনো যাবে না। তেমন হলে নবনীতার সাথেই পরির বিয়েতে সায় দেবে সে। আর নবনীতা যদি এখনও আগের মতই পরিতোষের সঙ্গে সংসার করতে অরাজী হয়, তাহলে পরির সাথে অর্চনার বিয়ের কথা ভাবাই যেতে পারে। কিন্তু অর্চনার অনুপস্থিতিতেই নবনীতার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। কিন্তু সে যতক্ষণ নবনীতাকে কাছে পায়, ততক্ষণ অর্চনাও তাদের ধারে কাছেই থাকে। তাই বাড়িতে নবনীতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করা একেবারেই সম্ভব হবে না। তাই এখন তাকে বসাক গারমেন্টসে গিয়েই নবনীতার সাথে কথা বলতে হবে।
বসাক গারমেন্টসের সামনে গাড়ি থেকে নেমে সে শোরুমের ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেল একটা কাউন্টারে নবনীতা কয়েকজন খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত। বেশ কয়েকজন খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে। নবনীতার সাথে তার চোখাচোখিও হল না। তাকে ব্যস্ত দেখে সীমন্তিনী পাশের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। জয়া বসাকের চেম্বারের খোলা দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ভেতরে আসতে পারি ম্যাডাম”?
জয়া বসাক মুখ তুলে দড়জার দিকে তাকিয়ে সীমন্তিনীকে দেখেই প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন, “আরে ম্যাডাম আপনি? হোয়াট এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ! আসুন আসুন প্লীজ”।
সীমন্তিনী ঢুকে একটা চেয়ারে বসবার আগেই ইন্টারকমের সুইচ টিপে জয়া বসাক দু’কাপ কফির অর্ডার দিলেন। তারপর সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে খুশী ভরা মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “সরি ম্যাডাম, একটু বিজি ছিলাম বলে সিসিটিভিতে ঠিক চোখ ছিল না। তাই আপনার আসার ব্যাপারটা চোখে ধরা পড়েনি। তা কিছু কিনতে এসেছিলেন নাকি”?
সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “বিনা নোটিসে এসে আপনাকে ডিসটার্ব করে ফেললুম না তো”?
জয়া বসাক সাথে সাথে বললেন, “আরে কী বলছেন আপনি ম্যাম। কোনও ডিস্টার্ব হয়নি আমার। আমি তো আপনাকে আগেই বলে দিয়েছি, আপনি যে কোন সময় আমার কাছে আসতে পারেন”।
সীমন্তিনী বলল, “ম্যাডাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলুম। আপনারা কি হোম ডেলিভারি করেন”?
জয়া বসাক বললেন, “এমন ছোট শহরে কোলকাতার মত হোম ডেলিভারি সিস্টেম এখনও শুরু হয়নি ম্যাম। তবে অল্প ডিস্ট্যান্সের মধ্যে কোনও ভাল্যিয়ুড কাস্টমারের পক্ষ থেকে তেমন অর্ডার পেলে আমরা হোম ডেলিভারী দিয়ে থাকি। তবে অবশ্যই অর্ডারটা ভাল এমাউন্টের হলেই সেটা করে থাকি। তা আপনার কোয়ার্টারে পাঠাবার জন্য হোম ডেলিভারির দরকার কি ম্যাম? নবনীতাই তো ফেরার পথে নিয়ে যেতে পারবে। বাই দি বাই, নবনীতা কি আপনাকে এখানে আসতে দেখেছে”?
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “না ম্যাম, নীতার কাউন্টারে বেশ কয়েকজন কাস্টমার দেখেছি। ও তাদের এন্টারটেইন করতেই ব্যস্ত ছিল। আমিও ওর কাউন্টারের সামনে যাই নি। সোজা আপনার চেম্বারে চলে এসেছি”।
জয়া বসাক, “নিজের সামনের ল্যাপটপের দিকে দেখে বলল, “হ্যাঁ, ওর কাউন্টারে কয়েকজন কাস্টমার আছে। আচ্ছা বলুন তো হোম ডেলিভারির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন কেন”?
সীমন্তিনী বলল, “আসলে ম্যাম, আপনি হয়তো জানেন না, আমার আসল বাড়ি হচ্ছে রাজগঞ্জে। সেখানে আমাদের বেশ বড় পরিবার। জয়েন্ট ফ্যামিলী। পূজোর তো খুব বেশীদিন দেরী নেই আর। কিন্তু আমি কাজে এমনই ব্যস্ত যে এবার পূজোয় বাড়ি যেতে পাচ্ছি না। কিন্তু বাড়ির সকলের জন্যে পূজোর জামা কাপড় কিছু না পাঠাতে পারলেও তো মনটা ভাল লাগবে না। তাই ভাবছিলুম এখানে থেকেই যদি সেখানে ও’সব পাঠিয়ে দিতে পারতুম, তাহলে খুব ভাল হত। কিন্তু আপনারা যখন শুধু লোকাল কাস্টমারদের ......”
জয়া বসাক সীমন্তিনীর কথার মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বুঝেছি বুঝেছি ম্যাম। আর বলতে হবে না। হয়ে যাবে। আপনার জন্য আমি ও’টুকু নিশ্চয়ই করতে পারব। আপনি শুধু পোষাকগুলো পছন্দ করে দিন। পূজোর আগেই সেগুলো আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ”।
জয়া বসাকও মিষ্টি করে হেসে বললেন, “মেনশন নট ম্যাম। আপনি আমার যত বড় একটা উপকার করেছেন, তার বিনিময়ে আপনার জন্য এটুকু করা কোন ব্যাপারই না”।
সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি আপনার এমন কী উপকার করেছি ম্যাম? উল্টে নীতাকে আপনার এখানে কাজ দিয়ে আপনিই তো আমার উপকার করেছেন”।
সীমন্তিনীর কথা শেষ হতেই একটা বেয়ারা টাইপের ছেলে এসে দু’কাপ কফি টেবিলে নামিয়ে রেখে জয়া বসাককে বলল, “আর কিছু লাগবে ম্যাম”?
জয়া বসাক সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাম, অল্প কিছু লাইট রিফ্রেশমেন্ট নিতে আপত্তি নেই তো”?
সীমন্তিনী জলের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, “না না ম্যাম, প্লীজ, আর কিছু নয় এখন। ইটস ওকে”।
জয়া বসাকের ঈশারায় ছেলেটা চলে যেতেই তিনি বললেন, “নিন ম্যাম, কফি নিন। আর নবনীতার কথা বলছিলেন না? সেটাই তো বলছিলুম আমি। নবনীতাকে আমার কাছে কাজে দিয়েই তো অতবড় উপকারটা আমার করেছেন। এই তো নিজের চোখেই দেখে এলেন, ওর কাউন্টারেই সবচেয়ে বেশী ভিড়। জানিনা, ও নিজে আপনাকে কিছু বলেছে কি না। তবে খুব অল্প দিনেই ও সেলস গার্লের কাজে খুব এক্সপার্ট হয়ে উঠেছে। জানেন ম্যাম, গত কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, বেশীর ভাগ খদ্দেরই নবনীতার কাউন্টারে যেতে চাইছে। ওর মিষ্টি মুখ আর সুমিষ্ট কথায় খদ্দেররা ওর কাউন্টারের প্রতিই বেশী আকৃষ্ট হয়। আর নীতাও সাংঘাতিক দক্ষতার সাথে সবাইকে হাসিমুখে সার্ভিস দিয়ে সন্তুষ্ট করে। আজ আপনি যদি আর ঘন্টাখানেক আগে আসতেন, তবে দেখতে পেতেন যে ওর কাউন্টারে খদ্দেররা লাইন করে দাঁড়িয়েছিল। দু’একটা কাউন্টার তখন পুরো খালি হওয়া সত্বেও খদ্দেররা সে’সব কাউন্টারে যায় নি। নতুন নতুন খদ্দের অনেক আসছে আমাদের শো রুমে। তাই বুঝতেই পাচ্ছেন, সেলও বেশী হচ্ছে আমাদের। সত্যি, বড্ড মিষ্টি মেয়েটা। আর খুব চমৎকার স্বভাব আর তেমনি মিষ্টি ওর ব্যবহার। আমিও তো ওকে ভালবাসতে শুরু করেছি। এই ক’টা দিনেই ও একেবারে এক্সপার্ট সেলসগার্ল হয়ে উঠেছে। কলিগদের সাথেও খুব ভাল ব্যবহার করে। সবাই ওকে ভালবাসে। এমন একটা মেয়ে আমায় দেবার বিনিময়ে একটা ধন্যবাদ তো আপনার প্রাপ্যই ম্যাম”।
সীমন্তিনীও খুব খুশী হয়ে বলল, “আপনার কাছ থেকে এমন কথা শুনে আমি সত্যি খুব খুশী হলাম ম্যাম। মেয়েটা সত্যিই খুব দুঃখী। ও যদি নিজের পায়ে একটু দাঁড়াতে পারে, তাহলেই আমার উদ্দেশ্য স্বার্থক হবে”।
জয়া বসাক বললেন, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাম। নবনীতা আপনাকে একদম হতাশ করবে না। আমি শুনেছি, কারখানার কাজও ও খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে। ডিজাইনিংটা তো অনেকটাই রপ্ত করে নিয়েছে এ ক’দিনে। এখন শুধু কাটিং টেলারিংএর কাজটা শিখে ফেলতে পারলেই ও নিজের কোন ব্যবসা শুরু করতে পারবে” বলে একটু হেসে বললেন, “অবশ্য সেদিনের কথা ভেবে, মনে মনে একটু ভয়ই হচ্ছে আমার। আমার দোকানের কাস্টমার না কমে যায়”।
সীমন্তিনীও হেসে বললেন, “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না ম্যাম। কৃতজ্ঞতা বোধ ওর ভালই আছে। আপনার কাছে কাজ শিখে ও নিশ্চয়ই আপনার ক্ষতি করতে চাইবে না। আর তাছাড়া, ওকে নিয়ে আমার একটু অন্য রকম ভাবনা চিন্তা আছে। আপনার শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ পেলে ও একদিন ওর নিজের ব্যবসা অবশ্যই চালু করবে। তবে সেটা এ শহরে হবে না, হবে অন্য কোথাও। তাই আপনার গ্রাহক কমে যাবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। বরং এমনও হতে পারে যে ও আপনাদের এখান থেকেও অনেক মাল টেনে নেবে ও”।
জয়া বসাক এবার বললেন, “আপনার বোনের ওপর আমার আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা সব সময় থাকবে ম্যাম। তবে এবারে আপনি রাজগঞ্জে যে ডেলিভারীটা দিতে চাইছেন, আমরা বরং সে ব্যাপারেই কথা বলি। বলুন তো ঠিক কি কি পোশাক আপনি পাঠাতে চাইছেন”?
সীমন্তিনী কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমার বাবা, জেঠু আর কাকুর জন্যে খুব ভাল কোয়ালিটির পাঞ্জাবী আর ধুতি চাই। সঙ্গে গেঞ্জী আর আন্ডারওয়ারও। আর জেঠীমা, মা আর কাকিমার জন্যে ভাল শাড়ী। ব্লাউজ চাই নে, কারন কার শরীরের মাপ কতটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার সঠিক জানা নেই। তাই শাড়ি গুলো এমন হওয়া চাই যাতে ব্লাউজ পিচ অবশ্যই থাকে। তারা ওখানে বানিয়ে নিতে পারবেন। সঙ্গে ম্যাচিং পেটিকোট দেবেন। আর দু’ভাইয়ের জন্য খুব ভাল কোয়ালিটির শার্ট আর জীনস দেবেন। এদের দু’জনেরই ফুল লেংথ পোশাক দেবেন। আর এক ভাই তের বছর বয়সী। তার জন্যেও মাপ মত খুব ভাল শার্ট আর জীনসের প্যান্ট দেবেন। একটা ছোট বোন আছে, এগারো বছর বয়স। তার জন্যে মাপ মত একটা সুন্দর লহংগা চুড়িদার দেবেন। এ ছাড়া বাড়ির কাজের দু’জন মহিলা আছে আর দু’জন পুরুষ আছে, তাদের জন্যেও শাড়ি আর ধুতি শার্ট নিতে হবে”।
জয়া বসাক সব শুনে বললেন, “হয়ে যাবে ম্যাম। আমি একজনকে বলে দিচ্ছি। আপনি তার সাথে গিয়ে পোশাকগুলো পছন্দ করে ফেলুন। দামের জন্য ভাববেন না, আপনার জন্যে আমি স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেবই”।
সীমন্তিনী বলল, “ম্যাম বলছিলুম কি, অন্য কাউকে আমার সাথে না দিয়ে নীতাকেই কি এ কাজটা দিতে পারেন না? মানে বলছিলাম কি, তাহলে আমরা দু’জনে মিলেই পোশাকগুলো চয়েস করতে পারতুম, আর তাতে সময়টাও কম লাগত”।
জয়া বসাক হেসে বললেন, “আচ্ছা আমি দেখছি” বলে ল্যাপটপে সিসিটিভি ক্যামেরা গুলোর অনস্ক্রীন ফুটেজের দিকে দেখতে দেখতে ইন্টারকম তুলে কাউকে বললেন, “স্বপন, একটা কাজ করো তো। শুভার কাউন্টারে দেখছি এখন কাস্টমার নেই। ওকে নবনীতার কাউন্টারে দিয়ে নবনীতাকে আমার চেম্বারে পাঠিয়ে দাও, এখুনি” বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বললেন, “নবনীতা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে ম্যাম। আপনি ওর সাথে গিয়ে কাজগুলো সেরে আসুন। বাকিটা আমি দেখে নেব”।
সীমন্তিনী মহিলাকে ধন্যবাদ জানাল। এমন সময় সীমন্তিনীর মোবাইল বেজে উঠল, সীমন্তিনী নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল অর্চনার ফোন। জয়া বসাকের অনুমতি নিয়ে কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ সোনা, বল”।
অর্চনা ওপার থেকে বলল, “দিদিভাই, তুমি কোথায়? এখনও বাড়ি আসছ না যে? অফিস থেকে বেরোওনি এখনও”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “সরি, রে সোনা, আমি তোকে বলতে ভুলে গেছি রে। আসলে আমি একটু বাজারের দিকে এসেছি। একটু কাজ আছে এখানে। একটু সময় লাগবে। তুই ভাবিস নে কিছু। তুই আর লক্ষীদি জল খাবার খেয়ে নে। আমার ফিরতে একটু দেরী হবে। আমি নীতার সাথেই ফিরছি আটটা নাগাদ”।
মিনিট পাঁচেক বাদেই নবনীতা জয়া বসাকের চেম্বারে ঢুকে সীমন্তিনীকে দেখে যার পর নাই অবাক হল। কিন্তু সে কিছু বলে ওঠার আগেই জয়া বসাক তাকে বললেন, “নবনীতা তোমার দিদিকে নিয়ে ওপরের তলায় চলে যাও। উনি যা যা পছন্দ করেন সেগুলো বাছাই করা হয়ে গেলে ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে আমার এখানে এসো”।
নবনীতা মাথা ঝাঁকিয়ে “আচ্ছা ম্যাম” বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “এসো দিদি”।
নবনীতার সাথে ওপরে আসতে আসতে সীমন্তিনী তাকে রাজগঞ্জ আর কালচিনির সকলের জন্য পূজোর পোশাক পছন্দ করবার কথা বলল। সকলের পোশাক পছন্দ করতে করতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল যে রাজগঞ্জের পোশাকগুলো যেন আলাদা প্যাকেট করা হয়। সেগুলো এখান থেকে রাজগঞ্জে হোম ডেলিভারী দেওয়া হবে। আর কালচিনির পোশাকগুলো আলাদা প্যাক করবার নির্দেশ দিল। সে প্যাকেটটা নিজেরা সঙ্গে নিয়ে যাবে বলল।
নবনীতা সেভাবেই পোশাকগুলোকে আলাদা আলাদা লটে সাজিয়ে একটা বেয়ারাকে বুঝিয়ে দিয়ে সীমন্তিনীকে নিয়ে আবার দোতলায় জয়া বসাকের চেম্বারে এসে হাজির হল। জয়া বসাক তখন নবনীতাকে বললেন, “তোমাকে আর এখন কাউন্টারে বসতে হবে না নীতা। আমি ম্যানেজারকে যা বলার বলে দিয়েছি। তুমি তার সাথে দেখা করে তোমার ব্যাগ নিয়ে আবার এখানে এসো। ম্যাম তোমার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করবেন ততক্ষণ, কেমন”?
নবনীতা কোন কথা না বলে সম্মতি জানিয়ে চলে যেতে জয়া বসাক সীমন্তিনীকে বললেন, “ম্যাম, কিছুই তো খেলেন না আপনি। তবে আরেকবার একটু কফির কথা বলি”?
সীমন্তিনী বলল, “না ম্যাম, এখন আর ও’সব কিছু নেব না। আমি বরং এখানে বসে না থেকে একটু বিলিং কাউন্টারে গিয়ে পেমেন্টটা করে আসি”।
জয়া বসাক আপত্তি করে বললেন, “আপনি বসুন তো এখানে। কোত্থাও যেতে হবে না আপনাকে। বিল রেডি হয়ে গেলে নবনীতাই নিয়ে আসবে সেটা”।
সীমন্তিনী বলল, “না ম্যাম, আসলে আমি তো কার্ডে পেমেন্ট করব। তাই কাউন্টারে তো যেতেই হবে”।
জয়া বসাক হেসে বললেন, “সে সব এখানে বসেই হয়ে যাবে, ভাববেন না। আপনি বরং ততক্ষণ আপনার রাজগঞ্জের বাড়ির ঠিকানাটা আমায় লিখে দিন”।
সীমন্তিনী জয়া বসাকের এগিয়ে দেওয়া প্যাডে রাজগঞ্জের বাড়ির ঠিকানা লিখে দিতে দিতেই নবনীতার সাথে দুটো প্যাকেট হাতে আরেকজন বেয়ারা চেম্বারে এসে ঢুকল। বেয়ারা চেম্বারের এক কোনায় একটা টেবিলে প্যাকেটগুলো রাখতেই নবনীতা বলল, “দিদি, এ’দুটো কালচিনির প্যাকেট। বাকি গুলো আলাদা প্যাক করা হচ্ছে রাজগঞ্জে পাঠাবার জন্য। আর সব মিলিয়ে বিল হল ছেষট্টি হাজার সাতশ’ তেত্রিশ টাকা। তোমার কার্ডটা দাও”।
সীমন্তিনী নিজের পার্সের ভেতর থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করতে করতে জয়া বসাক ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ফাইভ পার্সেন্ট স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে কি না, জেনে নিলেন। নবনীতা সীমন্তিনীর কার্ড পজ মেশিনে পাঞ্চ করে মেশিনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই সীমন্তিনী তাতে নিজের পিন নাম্বার দিয়ে পেমেন্ট শেষ করে বলল, “ম্যাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আজ তাহলে উঠি আমরা”।
জয়া বসাক বেয়ারাটাকে বলল, “ম্যাডামের প্যাকেটটা তার গাড়িতে তুলে দে। আর নবনীতা, তোমারও তো কাজ শেষ হয়েছে, তুমি বরং ম্যামের সাথেই বেড়িয়ে পড়ো”।
*******************
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল, “কাজে কাজেই তো পুরো সময়টা কেটে গেলরে নীতা। তোর সাথে কিছু প্রাইভেট কথা আলোচনা করব ভেবেছিলুম। সেটা তো আর গাড়িতে বসে করা ঠিক হবে না”।
নবনীতা বলল, “আমরা তো বাড়িতেই যাচ্ছি দিদি। বাড়িতে গিয়েই তো কথা বলতে পারব”।
সীমন্তিনী বলল, “তুই আমার কথাটা ঠিক মত শুনিস নি। আমি বললুম প্রাইভেট কথা। বাড়িতে গিয়ে সেটা অর্চুর সামনে বলা যাবে না”।
নবনীতা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, “ওহ, সরি দিদি। কিন্তু কথাটা কি অর্চুর ব্যাপারেই? আবার কি হল ওর”?
সীমন্তিনী বলল, “কিছু হয়নি। কিন্তু আলোচনাটা ওকে নিয়েই। তাই ওর সামনে আমি সেটা করতে চাই নে। শুধু তোর সাথেই আলোচনাটা করা দরকার। এক কাজ করি, চল সামনের ওই রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতেই না হয় আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক। আর ওই দ্যাখ, খগেন তার রিক্সা নিয়ে তোর অপেক্ষায় আছে। ওকে বলে দে আজ তুই ওর রিক্সাতে যাবি না। আমার সাথে যাবি”।
______________________________
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সীমন্তিনী অফিস থেকে বেড়িয়ে নিজের কোয়ার্টারে না এসে বাজারের দিকে চলল। সে কথাটা আগেই মনে মনে ভেবে রেখেছিল যে বিয়ের ব্যাপারে অর্চনার মতামত নেবার আগে নবনীতার সাথে কথা বলাটা খুব প্রয়োজন। পরির তরফ থেকে কোনও বাধা যে আসবে না, এ ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত। নবনীতা পরিতোষকে বিয়ে করতে রাজী না হলেও একটা সময় সে তো পরিকে ভাল বেসেছিল। তাই পরিতোষের ওপর সামান্য কিছু দুর্বলতা তার এখনও থাকতেই পারে। যদিও সে নিজে মুখেই বলেছে যে সীমন্তিনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়েই সে পরিতোষের জন্য একটা ভাল পাত্রীর সন্ধান করবে। কিন্তু নিজের ভালবাসার লোককে অন্যের হাতে তুলে দিতে অনেকেরই বুক কেঁপে ওঠে। তার মনে পড়ে গেল রাজগঞ্জের বাড়িতে কাটানো সেই রাতটার কথা। রতীশ আর রচনার বিয়ের আগে শেষবার যখন সে রাজগঞ্জ গিয়েছিল। নিজের ভালবাসার লোকটাকে চিরদিনের জন্য রচনার হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে রতীশ আর তার ভেতরে সে রাতে রতীশের ঘরে তার যখন কথা হচ্ছিল, তখন মুখে তার সামান্য স্মিত হাসি থাকলেও তার বুকের ভেতরটায় ওই সময়গুলোতে যে কষ্ট হয়েছিল, সে কষ্ট সহ্য করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। বুকের ভেতরটা সে রাতে তার ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। যার কথা একমাত্র তার অন্তরাত্মা ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি। সে নিজে যেমন ছোট্ট বয়স থেকেই জানত যে তার ভালোবাসা কোনদিন পরিণতি পাবে না, নবনীতা তো তেমন জানত না। সে নিজে যেমন জানত যে তার প্রেমিককে সে সারা জীবনেও নিজের স্বামী রূপে কাছে পাবে না, নবনীতার ক্ষেত্রে তো তেমন ছিল না। একটা সময় পরিতোষের বাবা নবনীতাকে তার হবু পুত্রবধূরূপে আশীর্বাদ করেছিলেন। নবনীতার পরিবারও তো পরিতোষ আর তার বিয়েতে রাজী হয়েছিল। হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য বশতঃ নবনীতার সে স্বপ্নটা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু এতদিন বাদেও তো পরিতোষ তাকে নিজের করে নিতে রাজী আছে। এ’কথা তো নবনীতাও খুব ভাল করে জানে। আজও যদি নবনীতা নিজের মত বদলে ফেলতে পারে, তাহলে পরিতোষ তাকে নিশ্চয়ই বিয়ে করতে রাজী হবে। কিন্তু সে যদি নিজের চিন্তাধারা বদলাতে না পারে, সে যখন বুঝতে পারবে যে তার ভালবাসার পাত্রটি অন্য আরেকটা মেয়েকে চিরতরে তার জীবনসঙ্গী করে নিতে চলেছে, তখন হয়ত চেপে রাখা আবেগ আর সামলে রাখতে পারবে না সে। তাই ওর সাথে পরিষ্কার করে আরেকবার আলোচনা করে নেওয়াটা ভীষণ দরকার। যদি দেখা যায় পরিকে বিয়ে করতে নবনীতা একটু হলেও নিমরাজীও হয়েছে, তখন অর্চু আর পরির বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আর এগোনো যাবে না। তেমন হলে নবনীতার সাথেই পরির বিয়েতে সায় দেবে সে। আর নবনীতা যদি এখনও আগের মতই পরিতোষের সঙ্গে সংসার করতে অরাজী হয়, তাহলে পরির সাথে অর্চনার বিয়ের কথা ভাবাই যেতে পারে। কিন্তু অর্চনার অনুপস্থিতিতেই নবনীতার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। কিন্তু সে যতক্ষণ নবনীতাকে কাছে পায়, ততক্ষণ অর্চনাও তাদের ধারে কাছেই থাকে। তাই বাড়িতে নবনীতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করা একেবারেই সম্ভব হবে না। তাই এখন তাকে বসাক গারমেন্টসে গিয়েই নবনীতার সাথে কথা বলতে হবে।
বসাক গারমেন্টসের সামনে গাড়ি থেকে নেমে সে শোরুমের ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেল একটা কাউন্টারে নবনীতা কয়েকজন খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত। বেশ কয়েকজন খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে। নবনীতার সাথে তার চোখাচোখিও হল না। তাকে ব্যস্ত দেখে সীমন্তিনী পাশের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। জয়া বসাকের চেম্বারের খোলা দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ভেতরে আসতে পারি ম্যাডাম”?
জয়া বসাক মুখ তুলে দড়জার দিকে তাকিয়ে সীমন্তিনীকে দেখেই প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন, “আরে ম্যাডাম আপনি? হোয়াট এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ! আসুন আসুন প্লীজ”।
সীমন্তিনী ঢুকে একটা চেয়ারে বসবার আগেই ইন্টারকমের সুইচ টিপে জয়া বসাক দু’কাপ কফির অর্ডার দিলেন। তারপর সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে খুশী ভরা মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “সরি ম্যাডাম, একটু বিজি ছিলাম বলে সিসিটিভিতে ঠিক চোখ ছিল না। তাই আপনার আসার ব্যাপারটা চোখে ধরা পড়েনি। তা কিছু কিনতে এসেছিলেন নাকি”?
সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “বিনা নোটিসে এসে আপনাকে ডিসটার্ব করে ফেললুম না তো”?
জয়া বসাক সাথে সাথে বললেন, “আরে কী বলছেন আপনি ম্যাম। কোনও ডিস্টার্ব হয়নি আমার। আমি তো আপনাকে আগেই বলে দিয়েছি, আপনি যে কোন সময় আমার কাছে আসতে পারেন”।
সীমন্তিনী বলল, “ম্যাডাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলুম। আপনারা কি হোম ডেলিভারি করেন”?
জয়া বসাক বললেন, “এমন ছোট শহরে কোলকাতার মত হোম ডেলিভারি সিস্টেম এখনও শুরু হয়নি ম্যাম। তবে অল্প ডিস্ট্যান্সের মধ্যে কোনও ভাল্যিয়ুড কাস্টমারের পক্ষ থেকে তেমন অর্ডার পেলে আমরা হোম ডেলিভারী দিয়ে থাকি। তবে অবশ্যই অর্ডারটা ভাল এমাউন্টের হলেই সেটা করে থাকি। তা আপনার কোয়ার্টারে পাঠাবার জন্য হোম ডেলিভারির দরকার কি ম্যাম? নবনীতাই তো ফেরার পথে নিয়ে যেতে পারবে। বাই দি বাই, নবনীতা কি আপনাকে এখানে আসতে দেখেছে”?
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “না ম্যাম, নীতার কাউন্টারে বেশ কয়েকজন কাস্টমার দেখেছি। ও তাদের এন্টারটেইন করতেই ব্যস্ত ছিল। আমিও ওর কাউন্টারের সামনে যাই নি। সোজা আপনার চেম্বারে চলে এসেছি”।
জয়া বসাক, “নিজের সামনের ল্যাপটপের দিকে দেখে বলল, “হ্যাঁ, ওর কাউন্টারে কয়েকজন কাস্টমার আছে। আচ্ছা বলুন তো হোম ডেলিভারির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন কেন”?
সীমন্তিনী বলল, “আসলে ম্যাম, আপনি হয়তো জানেন না, আমার আসল বাড়ি হচ্ছে রাজগঞ্জে। সেখানে আমাদের বেশ বড় পরিবার। জয়েন্ট ফ্যামিলী। পূজোর তো খুব বেশীদিন দেরী নেই আর। কিন্তু আমি কাজে এমনই ব্যস্ত যে এবার পূজোয় বাড়ি যেতে পাচ্ছি না। কিন্তু বাড়ির সকলের জন্যে পূজোর জামা কাপড় কিছু না পাঠাতে পারলেও তো মনটা ভাল লাগবে না। তাই ভাবছিলুম এখানে থেকেই যদি সেখানে ও’সব পাঠিয়ে দিতে পারতুম, তাহলে খুব ভাল হত। কিন্তু আপনারা যখন শুধু লোকাল কাস্টমারদের ......”
জয়া বসাক সীমন্তিনীর কথার মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বুঝেছি বুঝেছি ম্যাম। আর বলতে হবে না। হয়ে যাবে। আপনার জন্য আমি ও’টুকু নিশ্চয়ই করতে পারব। আপনি শুধু পোষাকগুলো পছন্দ করে দিন। পূজোর আগেই সেগুলো আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার”।
সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ”।
জয়া বসাকও মিষ্টি করে হেসে বললেন, “মেনশন নট ম্যাম। আপনি আমার যত বড় একটা উপকার করেছেন, তার বিনিময়ে আপনার জন্য এটুকু করা কোন ব্যাপারই না”।
সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি আপনার এমন কী উপকার করেছি ম্যাম? উল্টে নীতাকে আপনার এখানে কাজ দিয়ে আপনিই তো আমার উপকার করেছেন”।
সীমন্তিনীর কথা শেষ হতেই একটা বেয়ারা টাইপের ছেলে এসে দু’কাপ কফি টেবিলে নামিয়ে রেখে জয়া বসাককে বলল, “আর কিছু লাগবে ম্যাম”?
জয়া বসাক সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাম, অল্প কিছু লাইট রিফ্রেশমেন্ট নিতে আপত্তি নেই তো”?
সীমন্তিনী জলের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, “না না ম্যাম, প্লীজ, আর কিছু নয় এখন। ইটস ওকে”।
জয়া বসাকের ঈশারায় ছেলেটা চলে যেতেই তিনি বললেন, “নিন ম্যাম, কফি নিন। আর নবনীতার কথা বলছিলেন না? সেটাই তো বলছিলুম আমি। নবনীতাকে আমার কাছে কাজে দিয়েই তো অতবড় উপকারটা আমার করেছেন। এই তো নিজের চোখেই দেখে এলেন, ওর কাউন্টারেই সবচেয়ে বেশী ভিড়। জানিনা, ও নিজে আপনাকে কিছু বলেছে কি না। তবে খুব অল্প দিনেই ও সেলস গার্লের কাজে খুব এক্সপার্ট হয়ে উঠেছে। জানেন ম্যাম, গত কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, বেশীর ভাগ খদ্দেরই নবনীতার কাউন্টারে যেতে চাইছে। ওর মিষ্টি মুখ আর সুমিষ্ট কথায় খদ্দেররা ওর কাউন্টারের প্রতিই বেশী আকৃষ্ট হয়। আর নীতাও সাংঘাতিক দক্ষতার সাথে সবাইকে হাসিমুখে সার্ভিস দিয়ে সন্তুষ্ট করে। আজ আপনি যদি আর ঘন্টাখানেক আগে আসতেন, তবে দেখতে পেতেন যে ওর কাউন্টারে খদ্দেররা লাইন করে দাঁড়িয়েছিল। দু’একটা কাউন্টার তখন পুরো খালি হওয়া সত্বেও খদ্দেররা সে’সব কাউন্টারে যায় নি। নতুন নতুন খদ্দের অনেক আসছে আমাদের শো রুমে। তাই বুঝতেই পাচ্ছেন, সেলও বেশী হচ্ছে আমাদের। সত্যি, বড্ড মিষ্টি মেয়েটা। আর খুব চমৎকার স্বভাব আর তেমনি মিষ্টি ওর ব্যবহার। আমিও তো ওকে ভালবাসতে শুরু করেছি। এই ক’টা দিনেই ও একেবারে এক্সপার্ট সেলসগার্ল হয়ে উঠেছে। কলিগদের সাথেও খুব ভাল ব্যবহার করে। সবাই ওকে ভালবাসে। এমন একটা মেয়ে আমায় দেবার বিনিময়ে একটা ধন্যবাদ তো আপনার প্রাপ্যই ম্যাম”।
সীমন্তিনীও খুব খুশী হয়ে বলল, “আপনার কাছ থেকে এমন কথা শুনে আমি সত্যি খুব খুশী হলাম ম্যাম। মেয়েটা সত্যিই খুব দুঃখী। ও যদি নিজের পায়ে একটু দাঁড়াতে পারে, তাহলেই আমার উদ্দেশ্য স্বার্থক হবে”।
জয়া বসাক বললেন, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাম। নবনীতা আপনাকে একদম হতাশ করবে না। আমি শুনেছি, কারখানার কাজও ও খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে। ডিজাইনিংটা তো অনেকটাই রপ্ত করে নিয়েছে এ ক’দিনে। এখন শুধু কাটিং টেলারিংএর কাজটা শিখে ফেলতে পারলেই ও নিজের কোন ব্যবসা শুরু করতে পারবে” বলে একটু হেসে বললেন, “অবশ্য সেদিনের কথা ভেবে, মনে মনে একটু ভয়ই হচ্ছে আমার। আমার দোকানের কাস্টমার না কমে যায়”।
সীমন্তিনীও হেসে বললেন, “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না ম্যাম। কৃতজ্ঞতা বোধ ওর ভালই আছে। আপনার কাছে কাজ শিখে ও নিশ্চয়ই আপনার ক্ষতি করতে চাইবে না। আর তাছাড়া, ওকে নিয়ে আমার একটু অন্য রকম ভাবনা চিন্তা আছে। আপনার শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ পেলে ও একদিন ওর নিজের ব্যবসা অবশ্যই চালু করবে। তবে সেটা এ শহরে হবে না, হবে অন্য কোথাও। তাই আপনার গ্রাহক কমে যাবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। বরং এমনও হতে পারে যে ও আপনাদের এখান থেকেও অনেক মাল টেনে নেবে ও”।
জয়া বসাক এবার বললেন, “আপনার বোনের ওপর আমার আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা সব সময় থাকবে ম্যাম। তবে এবারে আপনি রাজগঞ্জে যে ডেলিভারীটা দিতে চাইছেন, আমরা বরং সে ব্যাপারেই কথা বলি। বলুন তো ঠিক কি কি পোশাক আপনি পাঠাতে চাইছেন”?
সীমন্তিনী কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমার বাবা, জেঠু আর কাকুর জন্যে খুব ভাল কোয়ালিটির পাঞ্জাবী আর ধুতি চাই। সঙ্গে গেঞ্জী আর আন্ডারওয়ারও। আর জেঠীমা, মা আর কাকিমার জন্যে ভাল শাড়ী। ব্লাউজ চাই নে, কারন কার শরীরের মাপ কতটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার সঠিক জানা নেই। তাই শাড়ি গুলো এমন হওয়া চাই যাতে ব্লাউজ পিচ অবশ্যই থাকে। তারা ওখানে বানিয়ে নিতে পারবেন। সঙ্গে ম্যাচিং পেটিকোট দেবেন। আর দু’ভাইয়ের জন্য খুব ভাল কোয়ালিটির শার্ট আর জীনস দেবেন। এদের দু’জনেরই ফুল লেংথ পোশাক দেবেন। আর এক ভাই তের বছর বয়সী। তার জন্যেও মাপ মত খুব ভাল শার্ট আর জীনসের প্যান্ট দেবেন। একটা ছোট বোন আছে, এগারো বছর বয়স। তার জন্যে মাপ মত একটা সুন্দর লহংগা চুড়িদার দেবেন। এ ছাড়া বাড়ির কাজের দু’জন মহিলা আছে আর দু’জন পুরুষ আছে, তাদের জন্যেও শাড়ি আর ধুতি শার্ট নিতে হবে”।
জয়া বসাক সব শুনে বললেন, “হয়ে যাবে ম্যাম। আমি একজনকে বলে দিচ্ছি। আপনি তার সাথে গিয়ে পোশাকগুলো পছন্দ করে ফেলুন। দামের জন্য ভাববেন না, আপনার জন্যে আমি স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেবই”।
সীমন্তিনী বলল, “ম্যাম বলছিলুম কি, অন্য কাউকে আমার সাথে না দিয়ে নীতাকেই কি এ কাজটা দিতে পারেন না? মানে বলছিলাম কি, তাহলে আমরা দু’জনে মিলেই পোশাকগুলো চয়েস করতে পারতুম, আর তাতে সময়টাও কম লাগত”।
জয়া বসাক হেসে বললেন, “আচ্ছা আমি দেখছি” বলে ল্যাপটপে সিসিটিভি ক্যামেরা গুলোর অনস্ক্রীন ফুটেজের দিকে দেখতে দেখতে ইন্টারকম তুলে কাউকে বললেন, “স্বপন, একটা কাজ করো তো। শুভার কাউন্টারে দেখছি এখন কাস্টমার নেই। ওকে নবনীতার কাউন্টারে দিয়ে নবনীতাকে আমার চেম্বারে পাঠিয়ে দাও, এখুনি” বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বললেন, “নবনীতা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে ম্যাম। আপনি ওর সাথে গিয়ে কাজগুলো সেরে আসুন। বাকিটা আমি দেখে নেব”।
সীমন্তিনী মহিলাকে ধন্যবাদ জানাল। এমন সময় সীমন্তিনীর মোবাইল বেজে উঠল, সীমন্তিনী নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল অর্চনার ফোন। জয়া বসাকের অনুমতি নিয়ে কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ সোনা, বল”।
অর্চনা ওপার থেকে বলল, “দিদিভাই, তুমি কোথায়? এখনও বাড়ি আসছ না যে? অফিস থেকে বেরোওনি এখনও”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “সরি, রে সোনা, আমি তোকে বলতে ভুলে গেছি রে। আসলে আমি একটু বাজারের দিকে এসেছি। একটু কাজ আছে এখানে। একটু সময় লাগবে। তুই ভাবিস নে কিছু। তুই আর লক্ষীদি জল খাবার খেয়ে নে। আমার ফিরতে একটু দেরী হবে। আমি নীতার সাথেই ফিরছি আটটা নাগাদ”।
মিনিট পাঁচেক বাদেই নবনীতা জয়া বসাকের চেম্বারে ঢুকে সীমন্তিনীকে দেখে যার পর নাই অবাক হল। কিন্তু সে কিছু বলে ওঠার আগেই জয়া বসাক তাকে বললেন, “নবনীতা তোমার দিদিকে নিয়ে ওপরের তলায় চলে যাও। উনি যা যা পছন্দ করেন সেগুলো বাছাই করা হয়ে গেলে ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে আমার এখানে এসো”।
নবনীতা মাথা ঝাঁকিয়ে “আচ্ছা ম্যাম” বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “এসো দিদি”।
নবনীতার সাথে ওপরে আসতে আসতে সীমন্তিনী তাকে রাজগঞ্জ আর কালচিনির সকলের জন্য পূজোর পোশাক পছন্দ করবার কথা বলল। সকলের পোশাক পছন্দ করতে করতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল যে রাজগঞ্জের পোশাকগুলো যেন আলাদা প্যাকেট করা হয়। সেগুলো এখান থেকে রাজগঞ্জে হোম ডেলিভারী দেওয়া হবে। আর কালচিনির পোশাকগুলো আলাদা প্যাক করবার নির্দেশ দিল। সে প্যাকেটটা নিজেরা সঙ্গে নিয়ে যাবে বলল।
নবনীতা সেভাবেই পোশাকগুলোকে আলাদা আলাদা লটে সাজিয়ে একটা বেয়ারাকে বুঝিয়ে দিয়ে সীমন্তিনীকে নিয়ে আবার দোতলায় জয়া বসাকের চেম্বারে এসে হাজির হল। জয়া বসাক তখন নবনীতাকে বললেন, “তোমাকে আর এখন কাউন্টারে বসতে হবে না নীতা। আমি ম্যানেজারকে যা বলার বলে দিয়েছি। তুমি তার সাথে দেখা করে তোমার ব্যাগ নিয়ে আবার এখানে এসো। ম্যাম তোমার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করবেন ততক্ষণ, কেমন”?
নবনীতা কোন কথা না বলে সম্মতি জানিয়ে চলে যেতে জয়া বসাক সীমন্তিনীকে বললেন, “ম্যাম, কিছুই তো খেলেন না আপনি। তবে আরেকবার একটু কফির কথা বলি”?
সীমন্তিনী বলল, “না ম্যাম, এখন আর ও’সব কিছু নেব না। আমি বরং এখানে বসে না থেকে একটু বিলিং কাউন্টারে গিয়ে পেমেন্টটা করে আসি”।
জয়া বসাক আপত্তি করে বললেন, “আপনি বসুন তো এখানে। কোত্থাও যেতে হবে না আপনাকে। বিল রেডি হয়ে গেলে নবনীতাই নিয়ে আসবে সেটা”।
সীমন্তিনী বলল, “না ম্যাম, আসলে আমি তো কার্ডে পেমেন্ট করব। তাই কাউন্টারে তো যেতেই হবে”।
জয়া বসাক হেসে বললেন, “সে সব এখানে বসেই হয়ে যাবে, ভাববেন না। আপনি বরং ততক্ষণ আপনার রাজগঞ্জের বাড়ির ঠিকানাটা আমায় লিখে দিন”।
সীমন্তিনী জয়া বসাকের এগিয়ে দেওয়া প্যাডে রাজগঞ্জের বাড়ির ঠিকানা লিখে দিতে দিতেই নবনীতার সাথে দুটো প্যাকেট হাতে আরেকজন বেয়ারা চেম্বারে এসে ঢুকল। বেয়ারা চেম্বারের এক কোনায় একটা টেবিলে প্যাকেটগুলো রাখতেই নবনীতা বলল, “দিদি, এ’দুটো কালচিনির প্যাকেট। বাকি গুলো আলাদা প্যাক করা হচ্ছে রাজগঞ্জে পাঠাবার জন্য। আর সব মিলিয়ে বিল হল ছেষট্টি হাজার সাতশ’ তেত্রিশ টাকা। তোমার কার্ডটা দাও”।
সীমন্তিনী নিজের পার্সের ভেতর থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করতে করতে জয়া বসাক ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ফাইভ পার্সেন্ট স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে কি না, জেনে নিলেন। নবনীতা সীমন্তিনীর কার্ড পজ মেশিনে পাঞ্চ করে মেশিনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই সীমন্তিনী তাতে নিজের পিন নাম্বার দিয়ে পেমেন্ট শেষ করে বলল, “ম্যাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আজ তাহলে উঠি আমরা”।
জয়া বসাক বেয়ারাটাকে বলল, “ম্যাডামের প্যাকেটটা তার গাড়িতে তুলে দে। আর নবনীতা, তোমারও তো কাজ শেষ হয়েছে, তুমি বরং ম্যামের সাথেই বেড়িয়ে পড়ো”।
*******************
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল, “কাজে কাজেই তো পুরো সময়টা কেটে গেলরে নীতা। তোর সাথে কিছু প্রাইভেট কথা আলোচনা করব ভেবেছিলুম। সেটা তো আর গাড়িতে বসে করা ঠিক হবে না”।
নবনীতা বলল, “আমরা তো বাড়িতেই যাচ্ছি দিদি। বাড়িতে গিয়েই তো কথা বলতে পারব”।
সীমন্তিনী বলল, “তুই আমার কথাটা ঠিক মত শুনিস নি। আমি বললুম প্রাইভেট কথা। বাড়িতে গিয়ে সেটা অর্চুর সামনে বলা যাবে না”।
নবনীতা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, “ওহ, সরি দিদি। কিন্তু কথাটা কি অর্চুর ব্যাপারেই? আবার কি হল ওর”?
সীমন্তিনী বলল, “কিছু হয়নি। কিন্তু আলোচনাটা ওকে নিয়েই। তাই ওর সামনে আমি সেটা করতে চাই নে। শুধু তোর সাথেই আলোচনাটা করা দরকার। এক কাজ করি, চল সামনের ওই রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতেই না হয় আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক। আর ওই দ্যাখ, খগেন তার রিক্সা নিয়ে তোর অপেক্ষায় আছে। ওকে বলে দে আজ তুই ওর রিক্সাতে যাবি না। আমার সাথে যাবি”।
______________________________