Thread Rating:
  • 43 Vote(s) - 3.26 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram
#47
ছিন্ন নাড়ির টান

ছোটমা মায়ের জন্য শাড়ি আর বাকি সবার জন্য বিভিন্ন উপহার কেনাকাটায় ব্যাস্ত হয়ে পরে। ছোটমা খুব খুশি, অবশেষে ছোটমা তাঁর কথা রেখেছেন। আমার মুখে হাসি দেখে ছোটমা বাবু দুজনেই অনেক আনন্দিত। আমার সেই হাসি মুখের পেছনের আসল উদ্দেশ্য আমি গোপন করে যাই। আমার জন্মদিন পরের মাসে, আর মাত্র দের মাস বাকি। 

প্রতকে রাতে নিজেকে প্রশ্ন করতাম আমি, তুমি কবে ফিরবে? আমি আর থাকতে পারছিনা তোমাকে ছেড়ে। তোমার স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতি রাতে। আমি রাতে ঘুমাতে পারিনা, সারা রাত বিছানায় জেগে বসে থাকি, তুমি আসবে আর আমাকে ঘুম পারাবে। সেই প্রথম রাতের কথা আমার খুব মনে পরে, কি ঝগড়া না করেছিলাম দুজনে। সেই সকাল, উম, কি সুন্দর তারপরের দিনের সকাল। তুমি কোথায় আমার সাদা ঘোড়া, এবারে আমি তোমার পিঠে চেপে ঘুরব, আর আমি উড়তে চেষ্টা করব না। একবার উড়তে চেষ্টা করে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। এবারে তুমি আমাকে তোমার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে সেই ঢালাও প্রান্তরে ঘুরতে নিয়ে যাবে, সেই উঁচু উঁচু বিপিন দেবদারুর বনে, সেই পাইন কেদার গাছের তলায়। তোমার আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিয়ে শান্তিতে একটু ঘুমাতে চাই।

একদিন দেবব্রত আমাকে ফোন করে বলে যে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি ওদের আমার বাড়িতে ডেকে নেই। সেদিন আবহাওয়া কেমন যেন একটু গুমোট ছিল। বাইরে যেন বাতাস ছিলনা। কয়েক ঘন্টা পরে তিস্তা আর দেবব্রত আমার বাড়ি পৌঁছে যায়। তিস্তা একটা সাধারন সুতির সালোয়ার পরে, আমি ওকে দেখে অবাক।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কিরে কি হয়েছে তোর?”

লাজুক হেসে দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “ও আমার জিন্স পরা পছন্দ করে না তাই সালোয়ার।”

আমি হেসে ফেলি তিস্তার লাজুক চেহারা দেখে, “বাপরে, প্রেম যেন উথলে পড়ছে।”

দেবব্রত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, একটু পরে বলে, “এই দুই বছরে আমরা এত কাছাকাছি থেকেও আজ মনে হচ্ছে যেন আমি তোমাকে চিনি না। সত্যি বলোত তুমি কে? তুমি আমার চেয়ে বড় তাই একবার ...”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কি বলতে চাস?”

দেবব্রত, “না থাক। তোমাকে দেখে আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।”

দেবব্রতর গলা কথা বলার সময়ে ধরে এসেছিল। তিস্তা ওর পিঠে হাথ বুলইয়ে দেয়। তিস্তা আমার দিকে দেখে বলে, “সত্যি মিতা, তুমি আমাদের জন্য যা করলে। তোমাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো জানিনা। তোমাকে দেখে অন্য জগতের মেয়ে বলে মনে হয়। তোমাকে একটা খুব ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি কি?”

আমি জানতাম কি সেই ব্যাক্তিগত প্রশ্ন, আতি আমি আগে থেকেই তিস্তাকে বারন করে দিলাম, “আমি জানি তুই আমাকে কি জিজ্ঞেস করবি। জিজ্ঞেস করিস না, আমি তাঁর উত্তর দিতে পারব না।”

দুজনে আমার উত্তর শুনে মাথা নাড়িয়ে বলে, “ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করব না। শুধু উপরয়ালার কাছে প্রার্থনা করব যার জন্য তুমি এতদিন অপেক্ষা করে আছো, সে যেন তোমার কাছে ফিরে আসে।”

আমি জানি রে সে কথা, শুধু আমার সময় আমার সাথে নয়। 

জুন মাসের মাঝামাঝি, গ্রীষ্ম কাল। আমি সকাল বেলার জলখাবার করতে রান্না ঘরে ব্যাস্ত ছিলাম। ছোটমা কলেজ ফেরত সেদিন আমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিলেন। আমি খুব খুশি ছিলাম যে মায়ের সাথে ছোটমার দেখা হবে। ফোন বেজে ওঠে। 

ছোটমা ফোন ধরে আঁতকে ওঠে, “কি, কখন। না...”

আমি ছোটমা আঁতকে ওঠা শুনে দৌড়ে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে আসি। কার ফোন, কার কি হয়েছে, এইসব ভেবে মনের ভেতরে ভিতির সঞ্চার হয়। ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, ছোটমার চোখে জল দেখে। 

আমি ছোটমার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি, “কার কি হয়েছে, ছোটমা?”

ছোটমা কোন উত্তর দেন না। কোনোরকমে কান্না চেপে ফোনে বলেন, “না, আমরা এখুনি আসছি। ওখানে থাক তোরা, আমি মেয়েকে নিয়ে শ্মশানে যেতে চাইনা রে।”

আমি ছোটমায়ের কথা শুনে তাঁর দিকে দৌড়ে যাই। ছোটমায়ের জল ভরা চোখ আর ঠোঁটের কাপুনি দেখে থেমে থাকতে পারিনা। ছোটমা ফোন ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাবুকে তাড়াতাড়ি একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করতে বলেন। আমি বুঝে উঠতে পারিনা কার কি হয়েছে। বাবু ছোটমায়ের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে কারন জিজ্ঞেস করেন।

ছোটমা আমার মাথা বুকে চেপে ধরে বাবুকে বলেন, “মাসিমা... তাড়াতাড়ি একটা গাড়ি ডাকো তুমি।”

ছোটমায়ের মুখে “মাসিমা” শুনে আমি পাথর হয়ে যাই। আমি চোখ বুজে ফেলি, সারা পৃথিবী আমার চোখের সামনে দুলতে শুরু করে দেয়। আমি ছোটমায়ের কোলে মুখ গুঁজে পরে যাই, তারপরে আর কিছু মনে নেই আমার।

চোখ খুলে দেখি আমি আমার বিছানায় শুয়ে। মাথার কাছে তিস্তা আর দেলিসা। আমি ওদের দেখে পাথর হয়ে যাই। তিস্তা কোনরকমে আমাকে কাপড় পড়িয়ে দেয়। দানিস গাড়ি নিয়ে আসে। আমাকে ধরে ধরে গাড়িতে উঠায়। দুজনে আমার দুপাশে বসে থাকে। মায়ের সেই দুঃসংবাদ আমাকে পাথর করে দেয়।

গাড়ি থেকে নেমে দেখি, আমার মা, অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছে উঠানে, তুলসিতলার পাশে। মাথার কাছে বড়দা বসে। সাদা শালুর কাপরে ঢাকা আমার মা। কষ্টে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুকে যেন কেউ পাথর বসিয়ে দিয়েছে, সেই বিশাল পাথরের নিচে আমার কান্না, আমার কষ্ট আমার বেদনা সব কিছু চাপা পরে যায়। আমি সেই পাথর সরাতে পারিনা, কাঁদতে পারিনা।

আমার ছোটো বৌদি, মৈথিলী সেই এগারো দিন আমার কাছে ছিল, এক মুহূর্তের জন্যেও আমার পাশ ছাড়েনি সে। আমাকে খাওয়ান, আমাকে দেখা সব কিছু ভার সে একা নিয়ে নেয় নিজের হাথে। আমার ভগ্ন হৃদয় জোড়া লাগাতে চেষ্টা করে কিন্তু আমার হৃদয় ততদিনে ভেঙ্গে শত টুকরো হয়ে যায়, কুড়িয়ে কুড়িয়ে সব টুকরো একত্র করে উঠতে পারেনা মৈথিলী। সে এগার দিন আমি নিজেকে আমার ঘরে বন্দিনী করে রাখি।

এগার দিনের কাজে আমার সব আত্মীয় সজ্জন আসেন। ইন্দ্রানিদি, চন্দ্রানিদি আমাকে এসে বলেন যে আমি সব থেকে ভালো হাথে আছি, আমার ছোটমা আর বাবু সর্বদা আমার জন্য আমার পাশে থাকবে। কিন্তু আমি কেউ জানত না যে আমি শুধু মাত্র এক বন্দিনী রাজকুমারীর জীবন জাপন করি সেই সোনার খাঁচায়। আমি জানতাম আমাকে ফিরে যেতে হবে সেই সোনার খাঁচায়, চিরদিনের মতন। আমার নাড়ি ছিঁড়ে গেছে।

দমদমের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগের দিন বিকেল বেলা আমি একা একা বাড়ির পেছনের বাগানে যাই। সেই আম গাছের কাছে গিয়ে দাড়াই। একটা আমের প্পল্লব তুলে নিয়ে রুমালে বেঁধে নেই। সেই গাছের তলা থেকে এক মুঠ মাট নিয়ে আম পল্লবের সাথে রুমালে বাঁধি। 

আমি ওর পোঁতা আম গাছ জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি, “অভিমন্যু, তোমার পরী আজ মারা গেল।”

কিছু দিন আগে পর্যন্ত যে আশার আলো দেখেছিলাম, সেই ক্ষীণ আশার আলো আমার মায়ের সাথে নিভে যায়। এই বাড়ির সাথে, আমার গর্ভধারিণীর সাথে সাথে নাড়ীর টান ছিন্ন হয়ে যায়। আমি ছোটমা আর বাবু পোষা তোতাপাখি, তাঁরা যা বলবেন এবার থেকে আমাকে তাই করতে হবে, তাঁরা যা করবেন সেটাই ঠিক। অনন্ত সাগর তীরে নিজের অজানা ভাগ্যের হাথে নিজেকে সঁপে দিয়ে আমি একাকী দাঁড়িয়ে থাকি।





====== প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ======
[+] 3 users Like Nefertiti's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram - by Nefertiti - 21-03-2020, 10:58 AM



Users browsing this thread: 3 Guest(s)