21-03-2020, 10:51 AM
সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#02)
বুকের মাঝে সযত্নে লুকিয়ে রাখা বাঁধ ভেঙ্গে যায়, বুক কাঁপিয়ে কান্না বেড়িয়ে আসে চোখের কোল থেকে। মায়ের চোখের আড়াল করে কোন সন্তান তাঁর দুঃখ লুকিয়ে রাখতে পারে না। আমি ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করি, কিন্তু আমার বুকের বেদনা ধরে রাখতে পারিনা আমি। আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম মায়ের মতামত জানার জন্য। মা আমার মাথায় হাত স্পর্শ করেন আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। আমার বুকের কান্না মায়ের কাছে আমার ব্যাথার কাহিনী ব্যক্ত করে দেয়। মা চুপ করে থাকেন, আমি কাঁদতে থাকি। মা আমাকে সেইরাতে নিজের কাছে শুতে বলেন। আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরি।
মা আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেন, “জগতের অনেক কিছু আছে যে গুলো মেনে নেওয়া অসম্ভব। আমি সর্বদা তোর হাসি মুখ দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই খুশি যে এইরকম ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাদের সমাজে অনেক নিয়ম কানুন আছে, তাঁর মধ্যে অনেক কিছু আছে যে গুলো সমাজ মেনে নিতে পারেনা।”
আমি কেঁদে জিজ্ঞেস করি, “আমি কি করব মা?”
মা, “সময়ের ওপরে ছেড়ে দে, পরী। সময় বড় বলবান।”
আমি ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম, “কেন মা কেন? আমার জীবনে আজ পর্যন্ত যা এসেছে তাই আমি মুখ বুজে মেনে নিয়েছি, আমি তোমাকে বা দিদিদের কোনদিন প্রশ্ন করিনি যে কেন তোমরা আমাকে ঠিক ভাবে দেখনি।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে মা উত্তর দেন, “পরী, আমাকে কিছু সময় দে ভাবার জন্য। এখুনি আমার মাথায় কিছু কাজ করছে না, আমার কিছু সময় চাই।”
আমি প্রায় বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, “না মা, আমি এখুনি জানতে চাই যে আমি এখন কি করব?”
মা আমাকে শান্ত করে পাশে শুয়ে পড়েন। বিছানার একপাসে আমি, অন্য পাশে মা। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। মায়ের কাছেও আমাদের সম্পর্কের কথা আর লুকিয়ে থাকে না। আমি ভেবে কুলকিনারা পাইনা যে মায়ের উত্তর কি হবে, মা কি মেনে নেবেন আমাদের সম্পর্ক না মা ছোটমায়ের মতন এবারে আমাকে বহিস্কার করে দেবেন। সারা রাত মা ঘুমাতে পারেন না, সারা রাত দুজনে ঘুমানোর ভান করে নিজের নিজের চিন্তায় ডুবে ছিলাম।
সকাল বেলার রোদ পুব আকাশে উঁকি মারে। মা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তুই সারা রাত ঘুমোস নি।”
আমি শান্ত গলায় বলি, “কি করে ঘুম আসে, মা।”
মা বিছানায় উঠে আমার দিকে ফিরে বললেন, “আমার মনে হয়, তোর ছোটমা আর বাবু এই ঘটনায় খুব মর্মাহত হয়েছেন। তারা দুজনেই অনেক রেগে আছেন এখন।”
দুরে আম গাছের বাগানের পেছন থেকে নবীন ঊষার আলো উঁকি দিচ্ছে। মা বললেন, “আগে তোর এমএসসি শেষ হোক, অভিমন্যু তোর সাথে যোগাযোগ করুক। আমাকেও কিছু সময় দে আর তোর ছোটমা আর বাবুকেও কিছু সময় দে। সময় যে বড় বলবান, সব ঘায়ের মলম সময়। সময়ের সাথে সাথে সবার রক্ত, সবার রাগ কমে আসবে। তুই ও বুঝতে পারবি তোরা কি করেছিস, তোর ছোটমাও বুঝতে পারবে ধিরে ধিরে। তোর ছোটমা, তাঁর একমাত্র ছেলেকে এই পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছে, তাঁর বুকের বেদনা একটু বুঝতে চেষ্টা করে দেখ, তুই যাতে বড় হতে পারিস সেই জন্য তোর ছোটমা এই সব করেছে। সঠিক সময়ে সব কিছু সঠিক হবে।”
আমি শান্ত গলায় উত্তর দেই, “ছোটমা আর বাবু আমাকে খুব ভালবাসে আর সেই কথা আমি মনে প্রানে জানি। কিন্তু আমার মন রাখার জন্য ছোটমা কোনদিন নিজের আত্মসন্মান বলিদান দেবেন না।”
বুকের মাঝে ধরে রাখা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা আমাকে বলেন, “পরী, সময়ের চেয়ে বলবান কোন ওষুধ আজ পর্যন্ত জগতে নেই। সময় সব ব্যাথা বেদনার মলম, সেটা মনের হোক বা শরীরের হোক। আমাকে কথা দে, যে তোর এমএসসি শেষ হওয়া পর্যন্ত তুই এই নিয়ে কারুর সাথে কোন কথা বলবি না। আমরা আমাদের ভবিতব্য বদলাতে পারিনা পরী, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে পারি। তোর এমএসসি শেষ হোক আগে, অভি দেশে ফিরে আসুক। অভিকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস, তারপরে আমি দেখি কি করতে পারি।”
আমি মাকে দুহাতে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমার মা আমাদের ভালবসার প্রতি বিরূপ না হয়ে মেনে নেন, সেটাই আমার সব থেকে বড় সম্বল ছিল। মা আর আমি দুজনেই কেঁদে ফেলেছিলাম। মা আমাকে বললেন, “আমার সেদিন বুঝে নেওয়া উচিত ছিলরে, ওইদিন পুজোর ঘরে আমার কাছে আমার খেলার পুতুল চেয়েছিল।”
আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে হেসে বলেন, “এবারে খুশি? এবারে হাস, আর কথা দে পরশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই কথা আর মুখে আনবি না।”
আমি সেদিনের পর থেকে অনেক খুশি, আমার মা আমাদের সম্পর্ক মেনে নেন। মনের মধ্যে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়, আমি যেন সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। চোখের দুষ্টুমি ফিরে আসে, গালের লালিমা ফিরে আসে, একবার মনে হয় যেন সেই পুরানো পরী ফিরে এসেছে আমার মধ্যে। বুকের মাঝের সেই অনন্ত কালো শূন্যতা যেন ভরে যায় মায়ের কথায়।
একদিন আমি বাড়ির পেছনের বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে জাছচিলাম মাথের দিকে। গ্রীষ্ম কালের পড়ন্ত রোদ পশ্চিম আকাশে, আমের বাগানে মাএর গন্ধে মম মম করছে, কাঁঠাল গুলো গাছের গুঁড়ির সাথে ঝুলে আছে, লিচু গাছে লাল লাল লিচু ভর্তি। ফলের গন্ধে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা তার সাথে আমার মনের আমেজ মাতোয়ারা। আমি পুকুর পাড়ের সেই ওর পোঁতা আমের গাছের দিকে হেঁটে গিয়েছিলাম। সেই আম গাছের গুঁড়ি ছুঁতেই এক দমকা হাওয়া এসে আমার মুখে লাগে, আমার যেন মনে হয় ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার গালে হাত রেখে। আমি আম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি, কাঁচা পাকা আমে ভর্তি সেই আমের গাছ।
আমি গাছ খানা জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বলেছিলাম, “তোর মনের মানুষ তোর জন্য আসছে একটু সবুর কর।”
আমার হৃদয় সপ্তম আসমানে ছিল, মা আমার ভালোবাসার প্রতি বিরূপ হননি। কিন্তু মায়ের সাবধান বানী আমার কানে বাজে, এমএসসি শেষ করার আগে যেন আমি আমার মনের ভাব কাউকে খুলে না জানাই। আমি সেই মিলন বেলার অধির প্রতীক্ষা করেছিলাম। মৈথিলী বুঝতে পারে আমার গালের লালিমা ফিরে এসেছে।
একদিন বিকেলে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আম খাচ্ছিলাম, এমন সময়ে মৈথিলী এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। আমার দিকে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “খুব খুশি মনে হচ্ছে?”
আমি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করি, “কেন, আনন্দে থাকা কি পাপ, আমি আমার বাড়িতে অনেক দিন পড়ে এসেছি তাই আমি খুশি।”
মৈথিলী, “হুম, মনে হচ্ছে অভিমন্যুর খবর এসেছে, তাই না।”
আমি ওকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম সেদিন, “হ্যাঁ, এসেছে।”
মৈথিলী, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি কি?”
অনেক দিন ধরেই আমি অপেক্ষা করছিলাম সেই প্রশ্নের, আমি মাথা নাড়াই, “জিজ্ঞেস করো।”
মাথা নিচু করে, পায়ের নখে ছাদের মেঝে খুঁটতে খুঁটতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ওকে একবার জিজ্ঞেস করত ও কি চায় আমাদের কাছ থেকে?”
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “কেন, তুমি ভালো করে জানো ও কি চায় আবার সেই প্রশ্ন কেন? যাই হোক, এখন ও দেশের বাইরে, যখন আমাকে ফোন করবে আমি জিজ্ঞেস করে নেব।”
মাথা নাড়ায় মৈথিলী, “ঠিক আছে।”
আমি ওকে আশস্ত করে বলি, “পরের বার ফোন করলে আমি বাড়ির ফোন নাম্বার দিয়ে দেব, তুমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলে নিও।”
আমার বুকের মাঝে এক নতুন সাহস জেগে ওঠে, আমি যেন সেইসময়ে অপরাজিতা ছিলাম।
এক রাতে আমি বিছানায় শুতে যাবো, এমন সময়ে দুষ্টু এসে বায়না ধরে পিসি একটা গল্প বলো। বেশির ভাগ দিন আমি ওকে ডায়রিতে লেখা ওর কবিতা গুলি দুষ্টুকে পড়ে শুনাতাম, অনেক কবিতার কোন মাথা মুন্ডু থাকত না, পড়তে পড়তে দুজনেই হেসে ফেলতাম। দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করত, যে এই সব গালগল্প কে লিখেছে। আমি ওকে বলতাম যে ওর অভি কাকু যখন ছোটো ছিল তখন এই সব গালগল্প লিখত।
দিন কেটে যায়, গরমের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসে। এর মাঝে ছোটমা ফোন করে জানায় যে ছুটির শেষে আমাকে নিতে আসবে। ছোটমায়ের কথা শুনে একটু মন খারাপ হয়ে যায়, আবার মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “মা এবারে আমার সাথে ওই বাড়ি চলো।”
মা আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, “তোর কাছে তোর ছোটমা আছে কিন্তু সুমন্তর এই জগতে আর কেউ নেই, আমি চলে গেলে ওকে কে দেখবে রে, তাই আমি কোথাও যেতে পারিনা।”
দমদমের বাড়িতে ফিরে যাবার ঠিক একদিন আগের রাতে, দুষ্টু আমার কাছে এসে গল্প শোনার বায়না ধরে। আমাকে আদর আর অভিমান করে জিজ্ঞেস করে, “পরের পুজোতে অভি কাকুকে বাড়িতে আসতে বলবে।”
আমি ওর দিকে মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক আছে বলে দেব, কিন্তু একটা সর্তে।”
আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে দুষ্টু। আমি ওকে বলি, “তুই আমাকে তোর অভির কাকুর শুনান গল্পটা যদি বলিস তাহলে।”
আমার গালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে শয়তান ছেলে আমাকে বলে, “ও ওই গল্পটা, সে গল্পত আমি ভুলে গেছি।”
আমি ওর দিকে মৃদু অভিমান করে তাকিয়ে বলি, “তাহলে তোর অভি কাকুকে সঙ্গে নিয়ে আসছি না।”
এই বলে আমি ওকে কাতুকুতু দিতে শুরু করি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে দুষ্টু, শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই গল্প বলে। আমার বাম হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে শুয়ে গল্প শুরু করে।
“অনেক অনেক দিন আগের কথা, এক দূর দেশে এক পরীর দেশের রানী থাকতেন। তাঁর কুঠিরের চারপাশ অনেক উঁচু উঁচু গাছে ঘেরা আর একপাসে অনন্ত ঘাসের মাঠ। পরীরানীর কুঠিরের পেছনে একটা ছোট্ট জলাশয় ছিল, সেই জলাশয়ে পদ্ম শালুক আরও অনেক জলের ফুল ফুটে থাকতো। কুঠিরের সামনের ফুলের বাগানে অনেক রঙ বেরঙের ফুল ফুটে থাকে, সেই ফুলের মধু খেতে রোজ নানান রঙের পাখিরা উড়ে আসত আর তাঁর সাথে নিয়ে আসত মৌমাছি আর ভ্রমর। একদিন সেই জলাশয়ে পরী রানী লক্ষ্য করেন যে একটা ছোট্ট পদ্মের কুঁড়ি ফুটে আছে। বেশ কিছু দিন যায়, সেই পদ্মের কুঁড়ি আর ফুলে পরিনত হয় না। অনেক ভেবে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি নিজের কুঠিরে নিয়ে আসেন আর একটা কাঁচের গামলায় জল দিয়ে রেখে দেন। রোজ সকালে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ির ওপরে শিশিরের জল, মিষ্টি মধু আর দুধ ঢেলে দিতেন যাতে সেই কুঁড়ি একদিন ফুলে পরিনত হয়ে উঠতে পারে।”
“এইভাবে দিন কেটে যায়। একদিন সকাল বেলা পরী রানী ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে কাঁচের গামলায় সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি আর নেই, সেই জায়গায় একটা ছোট্ট মিষ্টি পরী শুয়ে সকালের মিষ্টি রোদের সাথে খেলা করছে। ত্বকের রঙ দুধে আলতা, মাথায় ঘন কালো চুল। পিঠের ওপরে ছোটো ছোটো দুটি রঙ বেরঙের পাখনা। ছোট্ট দশ আঙুল দিয়ে সেই ছোট্ট পরী কাঁচের গামলা আঁচরে দেয়, বার বার সেই কাঁচের গামলা ছেড়ে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে। ছোট্ট দুটি নীল চোখে আসে পাশের নতুন পৃথিবী দেখে জুলু জুলু করে। পরী রানী আনন্দে কেঁদে ফেলে। তাঁর সযত্নে রাখা পদ্মের কুঁড়ি একটা ছোট্ট পরী হয়ে গেছে। পরী রানী সেই ছোট্ট পরীকে কাঁচের গামলা থেকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরী রানী রোজ দিন সেই ছোট্ট পরীকে মধু আর শিশিরের জল খেতে দিতেন, তার সাথে দিতেন নানান মিষ্টি ফল।”
“দিনে দিনে সেই ছোট্ট পরী বড় হয়ে এক সুন্দরী পরী হয়ে যায়। সেই সুন্দরী পরীর ডানা অনেক বড় আর প্রচুর রঙ্গে মাখা। ঝলমলে ডানা যেন সাত রঙের রামধনু নিয়ে আসে সেই কুঠিরে। কিন্তু পরীর ডানা বড় হলেও ওর উড়ে যাওয়ার মতন শক্তি ছিলনা। পরী রানী পরীকে উড়তে শেখায় না কোনদিন। পরী রানী চাইতেন না, যে পরী তাকে ছেড়ে চলে যাক। সেই সুন্দরী পরী কুঠিরের সামনের মাঠে খেলা করত সূর্যের আলোয় স্নান করত। সামনের ফুলের বাগানে ফুলের দেখাশুনা করত। রোজ সকালে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরের জল নিয়ে খেত আর বাগানের মিষ্টি ফল খেত। মৌমাছিরা ওই পরীর জন্য দূর দুরান্ত থেকে মধু যোগাড় করে নিয়ে আসত। দিনে দিনে সেই সুন্দরী পরীর মাথার ঘন কালো চুল কাঁধ ছাড়িয়ে মাটিতে নেমে আসে। বাগানের ফুল গেঁথে পরী নিজের গলার মালা আর হাতের বাজু বানিয়ে নিজেকে সাজিয়ে রাখত।”
“একরাতে পরী রানী কোন এক কাজে কুঠির ছেড়ে বাইরে চাঁদের আলোয় ঘুরতে গিয়েছিলেন। সুন্দরী পরী, কুঠিরে একা, রাতে ঘুম আসেনা দুই কাজল কালো চোখে। জানালার ধারে বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল পরী। ঘন নীল আকাশের বুকে শত সহস্র তারা উঁকি মেরে ওকে যেন ডাক দেয়। এমন সময়ে কোন আওয়াজ শুনে সুন্দরী পরীর ধ্যান ভেঙ্গে যায়। আসেপাসে তাকিয়ে দেখে কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পায়না। চুপিচুপি দরজা খুলে বাইরে তাকায় পরী, দরজার সামনে একটা অতি সুন্দর শ্বেত শুভ্র ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ঘোড়া দেখে অবাক হয়ে যায় সুন্দরী পরী, ভেবে পায়না কি করা উচিত। সুন্দরী পরী সেই ঘোড়ার কাছে এসে ওর ঘাড়ে হাত রেখে আদর করে দেয়। ঘোড়া ওকে দেখে চিঁহি করে ডাক ছাড়ে, ডাক শুনে ভয় পেয়ে যায় পরী, পেছনে সরে আসে। কিন্তু সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া সুন্দরী পরীর গালে নিজের ঘাড় ঘষে আসস্থ করে যে ওর কোন ভয় নেই। সুন্দরী পরী ঘোড়াটাকে কুঠিরের ভেতরে নিয়ে আসে। ঘোড়ার দিকে দীর্ঘকাল ধরে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুন্দরী পরী। একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।”
“সকাল বেলার প্রথম সূর্যের আলো সুন্দরী পরীর পায়ের কাছে এসে লুটপুটি খায়, পায়ে নতুন ঊষার আলোর উষ্ণতা পেয়ে জেগে ওঠে সুন্দরী পরী। কাজল কালো চোখ মেলে দেখে একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে ওর কাছে আর সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া কুঠিরের ভেতরে নেই। সেই সুদর্শন যুবক কে দেখে ভয় পেয়ে যায় পরী, ভয়ে চিৎকার করতে চেষ্টা করে, ঠিক সেই সময়ে সেই যুবক পরীর ঠোঁট চেপে ধরে চিৎকার করতে বারন করে। ভয়ে জড়সড় হয়ে কুঠিরের এক কোনে বসে থাকে পরী, ভেবে পায়না, কি করে সেই ঘোড়া উধাও হয়ে গেল আর তার জায়গায় এই সুদর্শন যুবক কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করল।”
“সেই সুদর্শন যুবক পরীকে জানায় যে ও একটা তস্কর, পরী রানীর কুঠিরে পরী রানীর জাদুর পুতুল চুরি করার জন্য এসেছিল। কিন্তু জানালা দিয়ে সুন্দরী পরীকে দেখে সেই জাদু পুতুলের কথা ভুলে যায়। রুপ বদলে এক শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। সুন্দরী পরী ওই সুদর্শন যুবকের কথা মন দিয়ে শোনে। সুদর্শন যুবক সুন্দরী পরীকে জিজ্ঞেস করে যে পরী উড়তে চায় কিনা। উড়ে ওই উঁচু গাছের জঙ্গল পেরিয়ে দূর দেশে পারি দিতে চায় কিনা, শুনতে চায় কি ভাবে নদী নিজের খেয়ালে গান করে আর নেচে নেচে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলে? সুন্দরী পরী সেই সুদর্শন যুবকের গুরু গম্ভির গলার স্বর শুনে মোহিত হয়ে যায়। পরী মৃদু মাথা নাড়িয়ে নিজের ইচ্ছে প্রকট করে, উড়ে বেড়াতে চায়।”
“সেই সুদর্শন তস্কর পরীকে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়ে কুঠিরের মেঝে খুঁড়তে শুরু করে। খুঁড়ে চলে তস্কর, সেই বিশাল ঘাসের ময়দানের নিচ দিয়ে, সেই ঘন জঙ্গলের নিচ দিয়ে। এক সময়ে জঙ্গল অতিক্রম করে অন্য পাশে বের হয় যায় দুইজনে। সামনে উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সুন্দরী পরী।”
“সুদর্শন তস্কর সুন্দরী পরীকে কে জিজ্ঞেস করে ও উড়তে চায় কি না? সুন্দরী পরী মাথা নাড়ায়, কিন্তু জানায় যে ও উড়তে জানেনা। সুদর্শন তস্কর পরীকে কোলে নিয়ে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয়, পরী প্রাণপণে ডানা মেলে ধরে, বারেবারে পাখনার ঝাপটা মেরে উড়তে চেষ্টা করে, কিন্তু উড়তে সক্ষম হয় না। পরী পরে যায় আর সুদর্শন তস্কর ওকে মাটিতে পড়ার আগেই কোলে ধরে ফেলে। কিছু পরে সুদর্শন তস্কর আবার পরীকে কোলে করে নিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দেয়, এইবারে পরী নিজের পাখা মেলে উড়ে যায়। উড়তে উড়তে অনেক উপরে উঠে যায় সুন্দরী পরী, নিচে তাকিয়ে দেখে সেই সুদর্শন তস্কর রুপ বদলে শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে ঘাসের মাঠের ওপরে দিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে থাকে। পরী উড়তে উড়তে সেই বরফ ঢাকা পাহারে চলে যায় আর সেই শ্বেতশুভ্র তস্কর পরীর ছায়া অনুসরন করে পাহাড়ে দিকে চলে যায়।”
গল্প শেষ করে দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করে, “গল্প এখানে শেষ, তুমি জানো এরপরের ওদের কি হয়?”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন, গল্প কি এখানে শেষ?”
মাথা নাড়ায় দুষ্টু, “হ্যাঁ, অভি কাকু এই পর্যন্ত গল্প শুনিয়েছে।”
আমি গল্পের কথা ভাবি, এই গল্প আমার হৃদয় তস্করের, সেই তস্কর পরী রানীর কাছ থেকে সুন্দরী পরীকে চুরি করে সুদূর পাহাড়ে চলে যায়। সেই তস্কর পরীকে উড়তে শেখায়। হ্যাঁ, পরী তারপরে উড়তে শেখে, কিন্তু উড়তে উড়তে একসময়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে সেই তস্কর আর নেই। একবার ভাবে সেই তস্কর হয়ত ওর জন্য খাবার আনতে গেছে, অপেক্ষা করে পরী, কিন্তু সেই তস্কর ফেরে না।
আজও অপেক্ষা করে আছে সেই সুন্দরী পরী তার প্রানের সুদর্শন তস্করের জন্য।
আমি দুষ্টুর টোপা গাল টিপে বলেছিলাম, “এখন ঘুমিয়ে পর, আমি অভি কাকুকে বলে দেব, পরের বার এসে ও যেন তোকে বাকি গল্প টুকু বলে দেয়।”
বুকের মাঝে সযত্নে লুকিয়ে রাখা বাঁধ ভেঙ্গে যায়, বুক কাঁপিয়ে কান্না বেড়িয়ে আসে চোখের কোল থেকে। মায়ের চোখের আড়াল করে কোন সন্তান তাঁর দুঃখ লুকিয়ে রাখতে পারে না। আমি ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করি, কিন্তু আমার বুকের বেদনা ধরে রাখতে পারিনা আমি। আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম মায়ের মতামত জানার জন্য। মা আমার মাথায় হাত স্পর্শ করেন আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। আমার বুকের কান্না মায়ের কাছে আমার ব্যাথার কাহিনী ব্যক্ত করে দেয়। মা চুপ করে থাকেন, আমি কাঁদতে থাকি। মা আমাকে সেইরাতে নিজের কাছে শুতে বলেন। আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরি।
মা আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেন, “জগতের অনেক কিছু আছে যে গুলো মেনে নেওয়া অসম্ভব। আমি সর্বদা তোর হাসি মুখ দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই খুশি যে এইরকম ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাদের সমাজে অনেক নিয়ম কানুন আছে, তাঁর মধ্যে অনেক কিছু আছে যে গুলো সমাজ মেনে নিতে পারেনা।”
আমি কেঁদে জিজ্ঞেস করি, “আমি কি করব মা?”
মা, “সময়ের ওপরে ছেড়ে দে, পরী। সময় বড় বলবান।”
আমি ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম, “কেন মা কেন? আমার জীবনে আজ পর্যন্ত যা এসেছে তাই আমি মুখ বুজে মেনে নিয়েছি, আমি তোমাকে বা দিদিদের কোনদিন প্রশ্ন করিনি যে কেন তোমরা আমাকে ঠিক ভাবে দেখনি।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে মা উত্তর দেন, “পরী, আমাকে কিছু সময় দে ভাবার জন্য। এখুনি আমার মাথায় কিছু কাজ করছে না, আমার কিছু সময় চাই।”
আমি প্রায় বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, “না মা, আমি এখুনি জানতে চাই যে আমি এখন কি করব?”
মা আমাকে শান্ত করে পাশে শুয়ে পড়েন। বিছানার একপাসে আমি, অন্য পাশে মা। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। মায়ের কাছেও আমাদের সম্পর্কের কথা আর লুকিয়ে থাকে না। আমি ভেবে কুলকিনারা পাইনা যে মায়ের উত্তর কি হবে, মা কি মেনে নেবেন আমাদের সম্পর্ক না মা ছোটমায়ের মতন এবারে আমাকে বহিস্কার করে দেবেন। সারা রাত মা ঘুমাতে পারেন না, সারা রাত দুজনে ঘুমানোর ভান করে নিজের নিজের চিন্তায় ডুবে ছিলাম।
সকাল বেলার রোদ পুব আকাশে উঁকি মারে। মা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তুই সারা রাত ঘুমোস নি।”
আমি শান্ত গলায় বলি, “কি করে ঘুম আসে, মা।”
মা বিছানায় উঠে আমার দিকে ফিরে বললেন, “আমার মনে হয়, তোর ছোটমা আর বাবু এই ঘটনায় খুব মর্মাহত হয়েছেন। তারা দুজনেই অনেক রেগে আছেন এখন।”
দুরে আম গাছের বাগানের পেছন থেকে নবীন ঊষার আলো উঁকি দিচ্ছে। মা বললেন, “আগে তোর এমএসসি শেষ হোক, অভিমন্যু তোর সাথে যোগাযোগ করুক। আমাকেও কিছু সময় দে আর তোর ছোটমা আর বাবুকেও কিছু সময় দে। সময় যে বড় বলবান, সব ঘায়ের মলম সময়। সময়ের সাথে সাথে সবার রক্ত, সবার রাগ কমে আসবে। তুই ও বুঝতে পারবি তোরা কি করেছিস, তোর ছোটমাও বুঝতে পারবে ধিরে ধিরে। তোর ছোটমা, তাঁর একমাত্র ছেলেকে এই পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছে, তাঁর বুকের বেদনা একটু বুঝতে চেষ্টা করে দেখ, তুই যাতে বড় হতে পারিস সেই জন্য তোর ছোটমা এই সব করেছে। সঠিক সময়ে সব কিছু সঠিক হবে।”
আমি শান্ত গলায় উত্তর দেই, “ছোটমা আর বাবু আমাকে খুব ভালবাসে আর সেই কথা আমি মনে প্রানে জানি। কিন্তু আমার মন রাখার জন্য ছোটমা কোনদিন নিজের আত্মসন্মান বলিদান দেবেন না।”
বুকের মাঝে ধরে রাখা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা আমাকে বলেন, “পরী, সময়ের চেয়ে বলবান কোন ওষুধ আজ পর্যন্ত জগতে নেই। সময় সব ব্যাথা বেদনার মলম, সেটা মনের হোক বা শরীরের হোক। আমাকে কথা দে, যে তোর এমএসসি শেষ হওয়া পর্যন্ত তুই এই নিয়ে কারুর সাথে কোন কথা বলবি না। আমরা আমাদের ভবিতব্য বদলাতে পারিনা পরী, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে পারি। তোর এমএসসি শেষ হোক আগে, অভি দেশে ফিরে আসুক। অভিকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস, তারপরে আমি দেখি কি করতে পারি।”
আমি মাকে দুহাতে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমার মা আমাদের ভালবসার প্রতি বিরূপ না হয়ে মেনে নেন, সেটাই আমার সব থেকে বড় সম্বল ছিল। মা আর আমি দুজনেই কেঁদে ফেলেছিলাম। মা আমাকে বললেন, “আমার সেদিন বুঝে নেওয়া উচিত ছিলরে, ওইদিন পুজোর ঘরে আমার কাছে আমার খেলার পুতুল চেয়েছিল।”
আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে হেসে বলেন, “এবারে খুশি? এবারে হাস, আর কথা দে পরশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই কথা আর মুখে আনবি না।”
আমি সেদিনের পর থেকে অনেক খুশি, আমার মা আমাদের সম্পর্ক মেনে নেন। মনের মধ্যে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়, আমি যেন সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। চোখের দুষ্টুমি ফিরে আসে, গালের লালিমা ফিরে আসে, একবার মনে হয় যেন সেই পুরানো পরী ফিরে এসেছে আমার মধ্যে। বুকের মাঝের সেই অনন্ত কালো শূন্যতা যেন ভরে যায় মায়ের কথায়।
একদিন আমি বাড়ির পেছনের বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে জাছচিলাম মাথের দিকে। গ্রীষ্ম কালের পড়ন্ত রোদ পশ্চিম আকাশে, আমের বাগানে মাএর গন্ধে মম মম করছে, কাঁঠাল গুলো গাছের গুঁড়ির সাথে ঝুলে আছে, লিচু গাছে লাল লাল লিচু ভর্তি। ফলের গন্ধে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা তার সাথে আমার মনের আমেজ মাতোয়ারা। আমি পুকুর পাড়ের সেই ওর পোঁতা আমের গাছের দিকে হেঁটে গিয়েছিলাম। সেই আম গাছের গুঁড়ি ছুঁতেই এক দমকা হাওয়া এসে আমার মুখে লাগে, আমার যেন মনে হয় ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার গালে হাত রেখে। আমি আম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি, কাঁচা পাকা আমে ভর্তি সেই আমের গাছ।
আমি গাছ খানা জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বলেছিলাম, “তোর মনের মানুষ তোর জন্য আসছে একটু সবুর কর।”
আমার হৃদয় সপ্তম আসমানে ছিল, মা আমার ভালোবাসার প্রতি বিরূপ হননি। কিন্তু মায়ের সাবধান বানী আমার কানে বাজে, এমএসসি শেষ করার আগে যেন আমি আমার মনের ভাব কাউকে খুলে না জানাই। আমি সেই মিলন বেলার অধির প্রতীক্ষা করেছিলাম। মৈথিলী বুঝতে পারে আমার গালের লালিমা ফিরে এসেছে।
একদিন বিকেলে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আম খাচ্ছিলাম, এমন সময়ে মৈথিলী এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। আমার দিকে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “খুব খুশি মনে হচ্ছে?”
আমি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করি, “কেন, আনন্দে থাকা কি পাপ, আমি আমার বাড়িতে অনেক দিন পড়ে এসেছি তাই আমি খুশি।”
মৈথিলী, “হুম, মনে হচ্ছে অভিমন্যুর খবর এসেছে, তাই না।”
আমি ওকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম সেদিন, “হ্যাঁ, এসেছে।”
মৈথিলী, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি কি?”
অনেক দিন ধরেই আমি অপেক্ষা করছিলাম সেই প্রশ্নের, আমি মাথা নাড়াই, “জিজ্ঞেস করো।”
মাথা নিচু করে, পায়ের নখে ছাদের মেঝে খুঁটতে খুঁটতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ওকে একবার জিজ্ঞেস করত ও কি চায় আমাদের কাছ থেকে?”
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “কেন, তুমি ভালো করে জানো ও কি চায় আবার সেই প্রশ্ন কেন? যাই হোক, এখন ও দেশের বাইরে, যখন আমাকে ফোন করবে আমি জিজ্ঞেস করে নেব।”
মাথা নাড়ায় মৈথিলী, “ঠিক আছে।”
আমি ওকে আশস্ত করে বলি, “পরের বার ফোন করলে আমি বাড়ির ফোন নাম্বার দিয়ে দেব, তুমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলে নিও।”
আমার বুকের মাঝে এক নতুন সাহস জেগে ওঠে, আমি যেন সেইসময়ে অপরাজিতা ছিলাম।
এক রাতে আমি বিছানায় শুতে যাবো, এমন সময়ে দুষ্টু এসে বায়না ধরে পিসি একটা গল্প বলো। বেশির ভাগ দিন আমি ওকে ডায়রিতে লেখা ওর কবিতা গুলি দুষ্টুকে পড়ে শুনাতাম, অনেক কবিতার কোন মাথা মুন্ডু থাকত না, পড়তে পড়তে দুজনেই হেসে ফেলতাম। দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করত, যে এই সব গালগল্প কে লিখেছে। আমি ওকে বলতাম যে ওর অভি কাকু যখন ছোটো ছিল তখন এই সব গালগল্প লিখত।
দিন কেটে যায়, গরমের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসে। এর মাঝে ছোটমা ফোন করে জানায় যে ছুটির শেষে আমাকে নিতে আসবে। ছোটমায়ের কথা শুনে একটু মন খারাপ হয়ে যায়, আবার মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “মা এবারে আমার সাথে ওই বাড়ি চলো।”
মা আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, “তোর কাছে তোর ছোটমা আছে কিন্তু সুমন্তর এই জগতে আর কেউ নেই, আমি চলে গেলে ওকে কে দেখবে রে, তাই আমি কোথাও যেতে পারিনা।”
দমদমের বাড়িতে ফিরে যাবার ঠিক একদিন আগের রাতে, দুষ্টু আমার কাছে এসে গল্প শোনার বায়না ধরে। আমাকে আদর আর অভিমান করে জিজ্ঞেস করে, “পরের পুজোতে অভি কাকুকে বাড়িতে আসতে বলবে।”
আমি ওর দিকে মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক আছে বলে দেব, কিন্তু একটা সর্তে।”
আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে দুষ্টু। আমি ওকে বলি, “তুই আমাকে তোর অভির কাকুর শুনান গল্পটা যদি বলিস তাহলে।”
আমার গালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে শয়তান ছেলে আমাকে বলে, “ও ওই গল্পটা, সে গল্পত আমি ভুলে গেছি।”
আমি ওর দিকে মৃদু অভিমান করে তাকিয়ে বলি, “তাহলে তোর অভি কাকুকে সঙ্গে নিয়ে আসছি না।”
এই বলে আমি ওকে কাতুকুতু দিতে শুরু করি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে দুষ্টু, শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই গল্প বলে। আমার বাম হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে শুয়ে গল্প শুরু করে।
“অনেক অনেক দিন আগের কথা, এক দূর দেশে এক পরীর দেশের রানী থাকতেন। তাঁর কুঠিরের চারপাশ অনেক উঁচু উঁচু গাছে ঘেরা আর একপাসে অনন্ত ঘাসের মাঠ। পরীরানীর কুঠিরের পেছনে একটা ছোট্ট জলাশয় ছিল, সেই জলাশয়ে পদ্ম শালুক আরও অনেক জলের ফুল ফুটে থাকতো। কুঠিরের সামনের ফুলের বাগানে অনেক রঙ বেরঙের ফুল ফুটে থাকে, সেই ফুলের মধু খেতে রোজ নানান রঙের পাখিরা উড়ে আসত আর তাঁর সাথে নিয়ে আসত মৌমাছি আর ভ্রমর। একদিন সেই জলাশয়ে পরী রানী লক্ষ্য করেন যে একটা ছোট্ট পদ্মের কুঁড়ি ফুটে আছে। বেশ কিছু দিন যায়, সেই পদ্মের কুঁড়ি আর ফুলে পরিনত হয় না। অনেক ভেবে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি নিজের কুঠিরে নিয়ে আসেন আর একটা কাঁচের গামলায় জল দিয়ে রেখে দেন। রোজ সকালে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ির ওপরে শিশিরের জল, মিষ্টি মধু আর দুধ ঢেলে দিতেন যাতে সেই কুঁড়ি একদিন ফুলে পরিনত হয়ে উঠতে পারে।”
“এইভাবে দিন কেটে যায়। একদিন সকাল বেলা পরী রানী ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে কাঁচের গামলায় সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি আর নেই, সেই জায়গায় একটা ছোট্ট মিষ্টি পরী শুয়ে সকালের মিষ্টি রোদের সাথে খেলা করছে। ত্বকের রঙ দুধে আলতা, মাথায় ঘন কালো চুল। পিঠের ওপরে ছোটো ছোটো দুটি রঙ বেরঙের পাখনা। ছোট্ট দশ আঙুল দিয়ে সেই ছোট্ট পরী কাঁচের গামলা আঁচরে দেয়, বার বার সেই কাঁচের গামলা ছেড়ে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে। ছোট্ট দুটি নীল চোখে আসে পাশের নতুন পৃথিবী দেখে জুলু জুলু করে। পরী রানী আনন্দে কেঁদে ফেলে। তাঁর সযত্নে রাখা পদ্মের কুঁড়ি একটা ছোট্ট পরী হয়ে গেছে। পরী রানী সেই ছোট্ট পরীকে কাঁচের গামলা থেকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরী রানী রোজ দিন সেই ছোট্ট পরীকে মধু আর শিশিরের জল খেতে দিতেন, তার সাথে দিতেন নানান মিষ্টি ফল।”
“দিনে দিনে সেই ছোট্ট পরী বড় হয়ে এক সুন্দরী পরী হয়ে যায়। সেই সুন্দরী পরীর ডানা অনেক বড় আর প্রচুর রঙ্গে মাখা। ঝলমলে ডানা যেন সাত রঙের রামধনু নিয়ে আসে সেই কুঠিরে। কিন্তু পরীর ডানা বড় হলেও ওর উড়ে যাওয়ার মতন শক্তি ছিলনা। পরী রানী পরীকে উড়তে শেখায় না কোনদিন। পরী রানী চাইতেন না, যে পরী তাকে ছেড়ে চলে যাক। সেই সুন্দরী পরী কুঠিরের সামনের মাঠে খেলা করত সূর্যের আলোয় স্নান করত। সামনের ফুলের বাগানে ফুলের দেখাশুনা করত। রোজ সকালে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরের জল নিয়ে খেত আর বাগানের মিষ্টি ফল খেত। মৌমাছিরা ওই পরীর জন্য দূর দুরান্ত থেকে মধু যোগাড় করে নিয়ে আসত। দিনে দিনে সেই সুন্দরী পরীর মাথার ঘন কালো চুল কাঁধ ছাড়িয়ে মাটিতে নেমে আসে। বাগানের ফুল গেঁথে পরী নিজের গলার মালা আর হাতের বাজু বানিয়ে নিজেকে সাজিয়ে রাখত।”
“একরাতে পরী রানী কোন এক কাজে কুঠির ছেড়ে বাইরে চাঁদের আলোয় ঘুরতে গিয়েছিলেন। সুন্দরী পরী, কুঠিরে একা, রাতে ঘুম আসেনা দুই কাজল কালো চোখে। জানালার ধারে বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল পরী। ঘন নীল আকাশের বুকে শত সহস্র তারা উঁকি মেরে ওকে যেন ডাক দেয়। এমন সময়ে কোন আওয়াজ শুনে সুন্দরী পরীর ধ্যান ভেঙ্গে যায়। আসেপাসে তাকিয়ে দেখে কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পায়না। চুপিচুপি দরজা খুলে বাইরে তাকায় পরী, দরজার সামনে একটা অতি সুন্দর শ্বেত শুভ্র ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ঘোড়া দেখে অবাক হয়ে যায় সুন্দরী পরী, ভেবে পায়না কি করা উচিত। সুন্দরী পরী সেই ঘোড়ার কাছে এসে ওর ঘাড়ে হাত রেখে আদর করে দেয়। ঘোড়া ওকে দেখে চিঁহি করে ডাক ছাড়ে, ডাক শুনে ভয় পেয়ে যায় পরী, পেছনে সরে আসে। কিন্তু সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া সুন্দরী পরীর গালে নিজের ঘাড় ঘষে আসস্থ করে যে ওর কোন ভয় নেই। সুন্দরী পরী ঘোড়াটাকে কুঠিরের ভেতরে নিয়ে আসে। ঘোড়ার দিকে দীর্ঘকাল ধরে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুন্দরী পরী। একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।”
“সকাল বেলার প্রথম সূর্যের আলো সুন্দরী পরীর পায়ের কাছে এসে লুটপুটি খায়, পায়ে নতুন ঊষার আলোর উষ্ণতা পেয়ে জেগে ওঠে সুন্দরী পরী। কাজল কালো চোখ মেলে দেখে একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে ওর কাছে আর সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া কুঠিরের ভেতরে নেই। সেই সুদর্শন যুবক কে দেখে ভয় পেয়ে যায় পরী, ভয়ে চিৎকার করতে চেষ্টা করে, ঠিক সেই সময়ে সেই যুবক পরীর ঠোঁট চেপে ধরে চিৎকার করতে বারন করে। ভয়ে জড়সড় হয়ে কুঠিরের এক কোনে বসে থাকে পরী, ভেবে পায়না, কি করে সেই ঘোড়া উধাও হয়ে গেল আর তার জায়গায় এই সুদর্শন যুবক কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করল।”
“সেই সুদর্শন যুবক পরীকে জানায় যে ও একটা তস্কর, পরী রানীর কুঠিরে পরী রানীর জাদুর পুতুল চুরি করার জন্য এসেছিল। কিন্তু জানালা দিয়ে সুন্দরী পরীকে দেখে সেই জাদু পুতুলের কথা ভুলে যায়। রুপ বদলে এক শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। সুন্দরী পরী ওই সুদর্শন যুবকের কথা মন দিয়ে শোনে। সুদর্শন যুবক সুন্দরী পরীকে জিজ্ঞেস করে যে পরী উড়তে চায় কিনা। উড়ে ওই উঁচু গাছের জঙ্গল পেরিয়ে দূর দেশে পারি দিতে চায় কিনা, শুনতে চায় কি ভাবে নদী নিজের খেয়ালে গান করে আর নেচে নেচে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলে? সুন্দরী পরী সেই সুদর্শন যুবকের গুরু গম্ভির গলার স্বর শুনে মোহিত হয়ে যায়। পরী মৃদু মাথা নাড়িয়ে নিজের ইচ্ছে প্রকট করে, উড়ে বেড়াতে চায়।”
“সেই সুদর্শন তস্কর পরীকে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়ে কুঠিরের মেঝে খুঁড়তে শুরু করে। খুঁড়ে চলে তস্কর, সেই বিশাল ঘাসের ময়দানের নিচ দিয়ে, সেই ঘন জঙ্গলের নিচ দিয়ে। এক সময়ে জঙ্গল অতিক্রম করে অন্য পাশে বের হয় যায় দুইজনে। সামনে উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সুন্দরী পরী।”
“সুদর্শন তস্কর সুন্দরী পরীকে কে জিজ্ঞেস করে ও উড়তে চায় কি না? সুন্দরী পরী মাথা নাড়ায়, কিন্তু জানায় যে ও উড়তে জানেনা। সুদর্শন তস্কর পরীকে কোলে নিয়ে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয়, পরী প্রাণপণে ডানা মেলে ধরে, বারেবারে পাখনার ঝাপটা মেরে উড়তে চেষ্টা করে, কিন্তু উড়তে সক্ষম হয় না। পরী পরে যায় আর সুদর্শন তস্কর ওকে মাটিতে পড়ার আগেই কোলে ধরে ফেলে। কিছু পরে সুদর্শন তস্কর আবার পরীকে কোলে করে নিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দেয়, এইবারে পরী নিজের পাখা মেলে উড়ে যায়। উড়তে উড়তে অনেক উপরে উঠে যায় সুন্দরী পরী, নিচে তাকিয়ে দেখে সেই সুদর্শন তস্কর রুপ বদলে শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে ঘাসের মাঠের ওপরে দিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে থাকে। পরী উড়তে উড়তে সেই বরফ ঢাকা পাহারে চলে যায় আর সেই শ্বেতশুভ্র তস্কর পরীর ছায়া অনুসরন করে পাহাড়ে দিকে চলে যায়।”
গল্প শেষ করে দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করে, “গল্প এখানে শেষ, তুমি জানো এরপরের ওদের কি হয়?”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন, গল্প কি এখানে শেষ?”
মাথা নাড়ায় দুষ্টু, “হ্যাঁ, অভি কাকু এই পর্যন্ত গল্প শুনিয়েছে।”
আমি গল্পের কথা ভাবি, এই গল্প আমার হৃদয় তস্করের, সেই তস্কর পরী রানীর কাছ থেকে সুন্দরী পরীকে চুরি করে সুদূর পাহাড়ে চলে যায়। সেই তস্কর পরীকে উড়তে শেখায়। হ্যাঁ, পরী তারপরে উড়তে শেখে, কিন্তু উড়তে উড়তে একসময়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে সেই তস্কর আর নেই। একবার ভাবে সেই তস্কর হয়ত ওর জন্য খাবার আনতে গেছে, অপেক্ষা করে পরী, কিন্তু সেই তস্কর ফেরে না।
আজও অপেক্ষা করে আছে সেই সুন্দরী পরী তার প্রানের সুদর্শন তস্করের জন্য।
আমি দুষ্টুর টোপা গাল টিপে বলেছিলাম, “এখন ঘুমিয়ে পর, আমি অভি কাকুকে বলে দেব, পরের বার এসে ও যেন তোকে বাকি গল্প টুকু বলে দেয়।”