19-03-2020, 03:16 PM
(Update No. 178)
রচনা বলল, “দাদা, কথায় কথায় আমাদের দু’জনকেই অনেক সহজ করে তুলেছেন সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু সত্যি বলছি দাদা, পুরোপুরি অচেনা অজানা কারো বাড়িতে যেতে কেমন যেন লাগছে আমার। আসলে তারা যেমন আমাদের অচেনা, ঠিক তেমনি আমরা দু’জনও তো তাদের অচেনা। সেখানে দু’পক্ষের কেউই হয়ত পুরোপুরি সহজ হয়ে উঠতে পারব না”।
পরিতোষ আগের মতই শান্তভাবে জবাব দিল, “আমি জানি রচু, এখন আমি তোমাদের যত কিছুই বোঝাই বা বলি না কেন তোমাদের মনের সঙ্কোচ কিন্তু এতে পুরোপুরি কাটবে না। তবে একটা কথা বলছি, ও বাড়িতে দশ মিনিট কাটাবার পরেও যদি তোমাদের মনে হয় তোমাদের মনের অস্বস্তি কাটছে না, বা এমন যদি মনে হয় যে ওনারাও তোমাদের সাথে পুরোপুরি ফ্রি হচ্ছেন না, তাহলে তোমরা আমাকে শুধু একটু ঈশারা করে দিও। আমি তোমাদের নিয়ে ঠিক তখনই বেড়িয়ে আসব। ঠিক আছে তো? এবার তোমরা দু’জনেই একটু চুপটি করে বোসো, আমি একটা ফোন কল সেরে নিই”।
পরিতোষ নিজের মোবাইল থেকে ডক্টর বড়ুয়াকে ফোন করতেই ও’পাশ থেকে সাড়া পেয়ে বলল, “গুড ইভিনিং ডক্টর। পরিতোষ বলছি”।
ও’পাশ থেকে ডক্টর দিব্যেন্দুর আনন্দিত স্বর ভেসে এল, “ভেরি গুড ইভিনিং স্যার। বড্ড চমকে দিয়েছেন সত্যি। তা বলুন কেমন আছেন? আপনার সাথে আর ও ব্যাপারে কোনও কথাই তো হল না”।
পরিতোষ বড় রাস্তা থেকে একটা গলিতে গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “সে জন্যেই তো এখন ফোন করছি স্যার। বলছিলাম কি, বৌদি আর মামনি কি বাড়িতে আছে না তারা বাইরে কোথাও বেড়িয়েছে”?
ডক্টর বড়ুয়া জবাব দিলেন, “না না ওরা বাড়িতেই আছে। আসলে আজ তো আমার অফ ডে। তাই ওদের নিয়ে একটু মার্কেটিংএ যাবার প্ল্যান করছি। তা আপনার সাথে কোথায় আমাকে দেখা করতে হবে বলুন তো? আমি ওদেরকে সাথে নিয়েই যেতে পারি আজ। ওরাও খুব খুশী হবে”।
পরিতোষ বলল, “স্যার, আমি আমার এক ভাই আর বোনকে নিয়ে দমদমের এদিকেই একটা কাজে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল যে ব্যস্ততার মধ্যে তো মামনির সাথে দেখা করতেই পারছি না। তাই ভাবছিলাম, আজ এখনই আপনার বাড়ি যেতাম। কিন্তু আপনারা যখন বলছেন যে আপনারা বেরোবার প্ল্যান করছেন, তাহলে বরং থাক। অন্য কোনদিন চেষ্টা করব”।
ডক্টর বড়ুয়া প্রায় সাথে সাথেই বললেন, “না না স্যার, প্লীজ ফিরে যাবেন না। এই প্রথমবার আপনি আমার ঘরে আসতে চেয়েও ঘুরে যাবেন তা কখনোই হতে পারে না। আমরা আমাদের প্রোগ্রাম ক্যানসেল করছি আজ। আপনি প্লীজ আসুন। আমাদের মার্কেটিং এমন কিছু জরুরী নয় যে আজ না গেলেই নয়। আচ্ছা এই নিন, দীপা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে। নিন ওর সাথে কথা বলুন”।
পরক্ষনেই ডক্টর দিব্যেন্দুর বৌ দীপার গলা শোনা গেল, “স্যার, আপনি যদি আজ আমাদের বাড়ির এত কাছাকাছি এসেও ফিরে যান, তাহলে কিন্তু বড় দুঃখ পাব আমরা। এমন করবেন না প্লীজ। আমাদের মার্কেটিং আজ না করলেও আমাদের কোন অসুবিধে হবে না। আপনি একদম দ্বিধা করবেন না। প্লীজ এত কাছে এসেও দেখা না করে যাবেন না, প্লীজ স্যার”।
পরিতোষ ততক্ষণে গাড়িটা রাস্তার পাশে একজায়গায় সাইড করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দীপার কথা শুনে একবার রচু আর রতুর দিকে দেখে এবার একটু আমতা আমতা করে বলল, “আসলে বৌদি, আমার এক ভাই আর তার স্ত্রীও আমার সাথে আছে। ওরা তো আপনাদের পরিচিত নয়। তাই আমার সাথে আপনাদের বাড়ি ঢুকতে ওদের একটু সঙ্কোচ হচ্ছে। আর ওদিকে আপনাদেরও যখন বাইরে যাবার প্রোগ্রাম আছে, তাই ভাবছি ....”
পরিতোষের কথা শেষ না হতেই দীপা বলল, “প্লীজ স্যার, এভাবে বলবেন না। গত আড়াইটে বছরে আমি ওকে কতবার বলেছি একবার আপনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবার জন্য। একটিবার আপনাকে চোখের দেখা দেখবার জন্য ওর কাছ কত মিনতি করেছি। কিন্তু ও নিজের কাজ ছাড়া আর কিছু করবারই ফুরসৎ পায় না। আর আপনিও ভাইজ্যাগ থেকে এখানে এসেও তো একই রকম ব্যস্ত থাকেন, সেটাও জানি। তাই বলছি, আজ যখন কাছাকাছি এসেই পড়েছেন, তাহলে প্লীজ এভাবে ফিরে যাবেন না স্যার। প্লীজ স্যার। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার ভাই আর তার স্ত্রীর আপ্যায়নে আমি কোনও খামতি রাখব না”।
পরিতোষ তখন বলল, “আচ্ছা বৌদি, ঠিক আছে। আপনি মন খারাপ করবেন না। আমরা আসছি” বলে ফোন কেটে দিয়েই গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “নেমে এসো রতু। আমরা এসে গেছি”।
রচনা গাড়ি থেকে নেমে নিজের পড়নের শাড়িটা টেনে টুনে ঠিক ঠাক করতে করতে বলল, “তাহলে বোঝা যাচ্ছে পরিদা, আপনি যে আজ এ বাড়িতে আসবেন, আর আমাদের দু’জনকেও যে সঙ্গে নিয়ে আসবেন, এ ব্যাপারে আপনার ডাক্তার বন্ধু বা তার পরিবার একেবারেই কিছু জানত না। আর এটাও আমি বেশ ভালই বুঝতে পাচ্ছি যে এখানে আসবার পেছনে আপনার কিছু একটা গভীর উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু এদের সাথে আমাদের তো কোনও পরিচয়ই নেই। আর এটাও মনে হচ্ছে না যে আপনি আমাদের ঘুঁটি বানিয়ে দাবার চাল চালবেন। তবে আমাদের কেন নিয়ে এলেন বলুন তো”?
পরিতোষ মনে মনে রচনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না। রচনাকে সঙ্গে আনবার পেছনে তার যে উদ্দেশ্য আছে সেটা ডক্টর বড়ুয়া আর রচনাই কেন শুধু, অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তিই সেটা এখন অব্দি জানে না। এমনকি সীমন্তিনী পর্যন্ত। কিন্তু সে’কথা এখনই এদের খুলে বলা যাবে না। আবার খুলে না বললেও রচনা হয়ত এ প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করতে পারে। তাই কিছু একটা বলে তার মুখটাকে আপাততঃ বন্ধ করে দিতেই হবে। রাস্তার এপাশে ও’পাশে সামনে পেছনে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে গাড়ির দরজা লক করে বলল, “রচু সোনা, তুমি সত্যিই খুব বুদ্ধিমতী। কিন্তু বোন, আমায় যখন দাদা বলে মেনেই নিয়েছ, তাহলে এই দাদার ওপর একটু ভরসা করতে পারছ না? তুমি আমার মন্তির রচু সোনা। তোমাকে বা রতুকে কি আমি কোনও বিপাকে ফেলতে পারি বোন? তবে তোমার প্রশ্নের জবাবে বলি, উদ্দেশ্য একটা আমার আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা যে কী, তা এখন তো নয়ই, আরোও কিছুদিনের মধ্যেও তোমাকে জানাতে পারব না বোন। তবে, একদিন তোমাদের কাছে সেটা প্রকাশ পাবেই। সেদিনই তোমরা সেটা জানতে পারবে। তার আগে নয়। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পার, যে আমি তোমার বা রতুর বা যে বাড়িতে যাচ্ছি সে বাড়ির কারোর বিয়ের সম্বন্ধ করতে যাচ্ছি না”।
রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ঈশ, পরিদা, আপনি যে কী না, ধ্যাৎ। আচ্ছা চলুন চলুন। দেখি আপনার বন্ধু বন্ধুপত্নী কে কেমন”?
রতীশও পরিতোষের কথা শুনে হেসে ফেলেছিল। পরিতোষ পেছনের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয়ে দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে একদিকে এগিয়ে চলল। একটা আটতলা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে ঢুকে লিফটে চড়ে পাঁচ তলায় এসে লিফট থেকে বেরিয়ে একটা দড়জার কলিং বেল বাজাবার সাথে সাথেই বছর বারো তেরোর এক কিশোরী দরজা খুলেই “আঙ্কল” বলে পরিতোষকে জড়িয়ে ধরল।
মেয়েটার পেছন পেছন এক সুন্দরী মহিলা আর একজন পুরুষকে দেখেই রচনা আর রতীশ বুঝতে পারল এনারাই সেই ডাক্তার দম্পতী। ডক্টর বড়ুয়া আর স্ত্রী। তারা দু’জনেই রচনা আর রতীশের হাত ধরে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘরের ভেতর টেনে নিলেন।
পরিতোষ মেয়েটার মুখটাকে দু’হাতে ধরে তার কপালে আদরের চুমু দিয়ে বলল, “কেমন আছ, মামনি”?
আকাঙ্ক্ষা পরিতোষকে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকবার পর তাকে ছেড়ে একপা পিছু হটে অভিমানী গলায় বলল, “এই কথা তুমি দিয়েছিলে আমাকে তাই না”?
পরিতোষ চট করে মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, “সরি মামনি। আমি জানি তোমাকে দেওয়া কথার খেলাপ করে ফেলেছি আমি। তবে সেটা যে কারনেই হোক, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল আমি তোমাকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারিনি। সেজন্যে আমি দুঃখিত। তুমি চাইলে আমাকে শাস্তি দিতেই পার”।
আকাঙ্ক্ষা এবার আরো এক পা পেছনে গিয়ে বলে উঠল, “ও মা, দেখ না আঙ্কল কী বলছে? আমি কী বলেছি আমি তাকে পানিশমেন্ট দেব”? বলে নিজেই পরিতোষের হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলল, “প্লীজ আঙ্কল, এমন করে আমাকে দুঃখ দিও না”।
পরিতোষও সাথে সাথে উঠেই আকাঙ্ক্ষার হাত ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ আমি কি আমার মামনিটাকে কষ্ট দিতে পারি? তাহলে তো আমার অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু মামনি, আমার অপরাধের শাস্তি মুকুব হল কিনা সেটা তো আগে জানতে হবে”?
আকাঙ্ক্ষা পরিতোষের হাত ধরে ঘরের ভেতর নিতে নিতে বলল, “মুকুব হচ্ছে না মশাই। তবে পোস্টপন্ড রইল আপাততঃ। এবার এসে বোসো তুমি। তোমার সাথে আমি খুব ঝগড়া করব”।
পরিতোষ হেসে বলল, “ওকে ডার্লিং। ঝগড়া কোর। কিন্তু দ্যাখ মামনি, আমাকে তো তুমি চেনই। কিন্তু আমার সাথে যে আরেক আঙ্কল আর আন্টি এসেছে, তাদের সাথে কথা বলবে না তুমি”?
আকাঙ্ক্ষা জিভে কামড় দিয়ে বলল, “ঈশ, আই মেড আ ব্লান্ডার। সরি আঙ্কল। সরি আন্টি। আপনারা প্লীজ কিছু মনে করবেন না” বলেই রচনার হাত ধরে আন্তরিক সুরে বলল, “আমি আকাংসা। আকাংসা বড়ুয়া”।
রচনা আকাঙ্ক্ষার চিবুক ধরে আদর করে বলল, “ভারী মিষ্টি মেয়ে তুমি”।
পরিতোষ ঘরের প্রায় মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে বলল, “ডক্টর বড়ুয়া, বৌদি, এরা আমার এক ভাই রতীশ আর তার স্ত্রী রচনা। রতীশ একজন যোগা এক্সপার্ট। খুব শিগগীরই কলকাতায় একটা যোগা ইনস্টিটিউট খুলবে। আর রচনা ওর যোগ্য সহধর্মিনী এবং গৃহবধূ। আর রতু, ইনি ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া, সার্জন হিসেবে কলকাতায় বেশ সুনাম আছে এনার। আর ইনি তার স্ত্রী দীপা বৌদি, আর আকাঙ্ক্ষা মামনির পরিচয় তো পেয়েই গেছ তোমরা। এনাদের একমাত্র সন্তান”।
ডক্টর বড়ুয়া আর তার স্ত্রী দু’জনেই হাতজোড় করে রতীশ আর রচনাকে নমস্কার জানালেন। রতীশ আর রচনা তাদের প্রতি নমস্কার করতেই আকাঙ্ক্ষা সকলের হাত ধরে সোফায় বসাতে বসাতে বলল, “হয়েছে হয়েছে, পরিচয় পর্ব নিয়ে আর বেশী সময় কাটানো চলবে না। তোমরা সবাই প্লীজ বসো এবার”।
দীপা এসে রচনার পাশে বসে তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “সত্যি স্যার, আজ আপনারা আসাতে আমরা সকলেই যে কী পরিমান খুশী হয়েছি, সেটা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। আড়াই বছর ধরে এ দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। তবে আজ আপনার সাথে সাথে বোনাস হিসেবে এদেরকে পেয়ে সত্যি ভাল লাগাটা দ্বিগুন হয়ে গেছে”।
ডক্টর বড়ুয়া এবার জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, রতীশবাবু কি আপনার নিজের ভাই”?
পরিতোষ ম্লান হেসে জবাব দিল, “সে অর্থে আমার নিজের বলতে তো কেউই নেই স্যার। তবে আপনাদের মত এদের মত সকলের সাথে বিভিন্ন রকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হবার চেষ্টা করি আমি। তবে ওই যে সেদিন আপনাকে বলছিলাম না, আমার খুব কাছের এক প্রিয়জনের কথা। এই রচনার ব্যাপারেই সেদিন কথাগুলো বলেছিলাম। এই রতীশের বোন মন্তির সাথে গত তিন চার বছরে আমার এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে যে সে এখন আমার জীবনের খুব কাছের এক প্রিয়বন্ধু। আর সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই এদেরকেও আমি আমার আত্মীয় বলে ভাবি”।
ডক্টর দিব্যেন্দু চোখ বড় বড় করে রচনাকে দেখতে দেখতে প্রায় অবিশ্বাসের সুরে বললেন, “কী বলছেন আপনি স্যার? ইনিই ...”
পরিতোষ সাথে সাথে চোখের ঈশারায় ডক্টরকে চুপ করবার নির্দেশ দিয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, এই রচনা আর রতীশই আমার বন্ধু মন্তির প্রাণ বলতে পারেন”।
ডক্টর বড়ুয়া আবার কিছু একটা বলবার জন্য মুখ খুলতেই দীপা রচনাকে বলল, “আমিও কিন্তু তোমাকে তাহলে বোন বলেই ডাকব ভাই। আর রতীশও আজ থেকে আমার একটা ভাই। তোমরা আপত্তি করবে না কিন্তু একেবারেই। তা রচনা, তোমার শ্বশুর বাড়ি কি কলকাতাতেই”?
রচনা জবাব দেবার আগেই আকাঙ্ক্ষা বলল, “মা তোমার ভাই হলে তো আমি ওনাকে আঙ্কল বলব না। মামু বলব। ইশ, এতদিনে এখানে মামু বলে ডাকবার মত কাউকে পেলাম। আমার নিজের মামু দু”টাকে তো আমি কাছেই পাই না”।
রতীশ হেসে তার পাশে বসা আকাঙ্ক্ষার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আপত্তি করব কেন মামনি। আজ থেকে আমি তোমার মামুই হলাম। আর ইনি তোমার মামী হলেন”।
আকাঙ্ক্ষা খুশী হয়ে রতীশের একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি কিন্তু তাহলে তোমাদের দু’জনকে মামা মামী বলেই ডাকব। আঙ্কল আন্টি বলব না”।
এবার রচনাও আকাঙ্ক্ষার একটা হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলল, “আচ্ছা তাই ডেকো সোনা। আমারও ওই ইংরেজী স্টাইলের আঙ্কল আন্টি ডাক শুনতে ভাল লাগে না। কে যে কাকা, কে যে জেঠু, কে পিসি, কে মাসি তা বোঝাই যায় না। বাংলা সম্বোধনটাই ভাল” বলে দীপার দিকে চেয়ে বলল, “আমরাও কিন্তু তাহলে আপনাকে দিদি বলে ডাকব। তবে দিদি, আপনি যেটা বলছিলেন, আমার শ্বশুর বাড়ি বাপের কোনটাই কলকাতায় নয়। আসলে আপনার ভাই একটা যোগা ইনস্টিটিউট খুলবে বলেই আমাদের কলকাতায় আসা। এমনিতে আমার শ্বশুর বাড়ি হচ্ছে রাজগঞ্জে, জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্টে। আর আমার বাপের বাড়ি হচ্ছে কালচিনিতে। সেটাও আগে জলপাইগুড়িতে জেলার ভেতরে থাকলেও এখন সেটা আলিপুরদুয়ার জেলায়”।
আকাঙ্ক্ষা রচনার কথা শুনেই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও মা, বড়মামুও কি ওই কালচিনিতেই থাকে নাকি গো”?
দীপা বলল, “হ্যাঁ সোনা, তোমার বড়মামুও কালচিনিতেই থাকেন”।
এবার রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা সেকি দিদি? তোমার বাপের বাড়িও কালচিনিতেই নাকি? কিন্তু কৈ তোমাকে কখনও সেখানে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না”!
দীপা জবাব দিল, “না ঠিক তা নয় রচনা। আমার বাপের বাড়ি আসলে মালবাজারে। তবে আমার এক দাদা মানে আমার আপন বড়দা কালচিনি হাসপাতালে আছেন এখন, উনিও ডাক্তার। এখন তিনি কালচিনি হাসপাতালের ইনচার্জ”।
রচনা আর রতীশ দু’জনেই এবার অবাক চোখে দীপার দিকে তাকাল। রতীশ বলল, “তাই নাকি দিদি? কিন্তু কালচিনি হাসপাতালে এখন যে ইনচার্জ তার নাম তো ডঃ শিবরঞ্জন সোম”!
দীপা উৎফুল্ল হয়ে বলল, “হ্যাঁ, সেই তো আমার বড়দা। তোমরা তাকে চেনো নাকি”?
রচনা আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, “কী বলছ দিদি? ডঃ সোম তোমার দাদা? উনি যে আমাদের কত বড় উপকার করেছেন তার জন্য সারা জীবন আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার দিদি তো প্রায় মরেই যাচ্ছিল। ডঃ সোমই তো তাকে বাচিয়েছেন। আমরাও দিদির অমন খবর পেয়ে কালচিনি গিয়েছিলুম এখান থেকে। এই তো মাত্র মাস দুয়েক আগের কথা। তাই না গো”? বলে রতীশের দিকে চাইল।
রতীশ রচনার কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ দিদি, রচু একদম ঠিক বলছে। ডঃ সোমের সাথে আমাদের কথাও হয়েছে। সত্যিই খুব ভাল মানুষ। এখনও তো অর্চুদি তার ট্রিটমেন্টেই আছেন”।
দীপা জিজ্ঞেস করল, “অর্চুদি কে”?
______________________________
রচনা বলল, “দাদা, কথায় কথায় আমাদের দু’জনকেই অনেক সহজ করে তুলেছেন সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু সত্যি বলছি দাদা, পুরোপুরি অচেনা অজানা কারো বাড়িতে যেতে কেমন যেন লাগছে আমার। আসলে তারা যেমন আমাদের অচেনা, ঠিক তেমনি আমরা দু’জনও তো তাদের অচেনা। সেখানে দু’পক্ষের কেউই হয়ত পুরোপুরি সহজ হয়ে উঠতে পারব না”।
পরিতোষ আগের মতই শান্তভাবে জবাব দিল, “আমি জানি রচু, এখন আমি তোমাদের যত কিছুই বোঝাই বা বলি না কেন তোমাদের মনের সঙ্কোচ কিন্তু এতে পুরোপুরি কাটবে না। তবে একটা কথা বলছি, ও বাড়িতে দশ মিনিট কাটাবার পরেও যদি তোমাদের মনে হয় তোমাদের মনের অস্বস্তি কাটছে না, বা এমন যদি মনে হয় যে ওনারাও তোমাদের সাথে পুরোপুরি ফ্রি হচ্ছেন না, তাহলে তোমরা আমাকে শুধু একটু ঈশারা করে দিও। আমি তোমাদের নিয়ে ঠিক তখনই বেড়িয়ে আসব। ঠিক আছে তো? এবার তোমরা দু’জনেই একটু চুপটি করে বোসো, আমি একটা ফোন কল সেরে নিই”।
পরিতোষ নিজের মোবাইল থেকে ডক্টর বড়ুয়াকে ফোন করতেই ও’পাশ থেকে সাড়া পেয়ে বলল, “গুড ইভিনিং ডক্টর। পরিতোষ বলছি”।
ও’পাশ থেকে ডক্টর দিব্যেন্দুর আনন্দিত স্বর ভেসে এল, “ভেরি গুড ইভিনিং স্যার। বড্ড চমকে দিয়েছেন সত্যি। তা বলুন কেমন আছেন? আপনার সাথে আর ও ব্যাপারে কোনও কথাই তো হল না”।
পরিতোষ বড় রাস্তা থেকে একটা গলিতে গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “সে জন্যেই তো এখন ফোন করছি স্যার। বলছিলাম কি, বৌদি আর মামনি কি বাড়িতে আছে না তারা বাইরে কোথাও বেড়িয়েছে”?
ডক্টর বড়ুয়া জবাব দিলেন, “না না ওরা বাড়িতেই আছে। আসলে আজ তো আমার অফ ডে। তাই ওদের নিয়ে একটু মার্কেটিংএ যাবার প্ল্যান করছি। তা আপনার সাথে কোথায় আমাকে দেখা করতে হবে বলুন তো? আমি ওদেরকে সাথে নিয়েই যেতে পারি আজ। ওরাও খুব খুশী হবে”।
পরিতোষ বলল, “স্যার, আমি আমার এক ভাই আর বোনকে নিয়ে দমদমের এদিকেই একটা কাজে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল যে ব্যস্ততার মধ্যে তো মামনির সাথে দেখা করতেই পারছি না। তাই ভাবছিলাম, আজ এখনই আপনার বাড়ি যেতাম। কিন্তু আপনারা যখন বলছেন যে আপনারা বেরোবার প্ল্যান করছেন, তাহলে বরং থাক। অন্য কোনদিন চেষ্টা করব”।
ডক্টর বড়ুয়া প্রায় সাথে সাথেই বললেন, “না না স্যার, প্লীজ ফিরে যাবেন না। এই প্রথমবার আপনি আমার ঘরে আসতে চেয়েও ঘুরে যাবেন তা কখনোই হতে পারে না। আমরা আমাদের প্রোগ্রাম ক্যানসেল করছি আজ। আপনি প্লীজ আসুন। আমাদের মার্কেটিং এমন কিছু জরুরী নয় যে আজ না গেলেই নয়। আচ্ছা এই নিন, দীপা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে। নিন ওর সাথে কথা বলুন”।
পরক্ষনেই ডক্টর দিব্যেন্দুর বৌ দীপার গলা শোনা গেল, “স্যার, আপনি যদি আজ আমাদের বাড়ির এত কাছাকাছি এসেও ফিরে যান, তাহলে কিন্তু বড় দুঃখ পাব আমরা। এমন করবেন না প্লীজ। আমাদের মার্কেটিং আজ না করলেও আমাদের কোন অসুবিধে হবে না। আপনি একদম দ্বিধা করবেন না। প্লীজ এত কাছে এসেও দেখা না করে যাবেন না, প্লীজ স্যার”।
পরিতোষ ততক্ষণে গাড়িটা রাস্তার পাশে একজায়গায় সাইড করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দীপার কথা শুনে একবার রচু আর রতুর দিকে দেখে এবার একটু আমতা আমতা করে বলল, “আসলে বৌদি, আমার এক ভাই আর তার স্ত্রীও আমার সাথে আছে। ওরা তো আপনাদের পরিচিত নয়। তাই আমার সাথে আপনাদের বাড়ি ঢুকতে ওদের একটু সঙ্কোচ হচ্ছে। আর ওদিকে আপনাদেরও যখন বাইরে যাবার প্রোগ্রাম আছে, তাই ভাবছি ....”
পরিতোষের কথা শেষ না হতেই দীপা বলল, “প্লীজ স্যার, এভাবে বলবেন না। গত আড়াইটে বছরে আমি ওকে কতবার বলেছি একবার আপনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবার জন্য। একটিবার আপনাকে চোখের দেখা দেখবার জন্য ওর কাছ কত মিনতি করেছি। কিন্তু ও নিজের কাজ ছাড়া আর কিছু করবারই ফুরসৎ পায় না। আর আপনিও ভাইজ্যাগ থেকে এখানে এসেও তো একই রকম ব্যস্ত থাকেন, সেটাও জানি। তাই বলছি, আজ যখন কাছাকাছি এসেই পড়েছেন, তাহলে প্লীজ এভাবে ফিরে যাবেন না স্যার। প্লীজ স্যার। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার ভাই আর তার স্ত্রীর আপ্যায়নে আমি কোনও খামতি রাখব না”।
পরিতোষ তখন বলল, “আচ্ছা বৌদি, ঠিক আছে। আপনি মন খারাপ করবেন না। আমরা আসছি” বলে ফোন কেটে দিয়েই গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “নেমে এসো রতু। আমরা এসে গেছি”।
রচনা গাড়ি থেকে নেমে নিজের পড়নের শাড়িটা টেনে টুনে ঠিক ঠাক করতে করতে বলল, “তাহলে বোঝা যাচ্ছে পরিদা, আপনি যে আজ এ বাড়িতে আসবেন, আর আমাদের দু’জনকেও যে সঙ্গে নিয়ে আসবেন, এ ব্যাপারে আপনার ডাক্তার বন্ধু বা তার পরিবার একেবারেই কিছু জানত না। আর এটাও আমি বেশ ভালই বুঝতে পাচ্ছি যে এখানে আসবার পেছনে আপনার কিছু একটা গভীর উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু এদের সাথে আমাদের তো কোনও পরিচয়ই নেই। আর এটাও মনে হচ্ছে না যে আপনি আমাদের ঘুঁটি বানিয়ে দাবার চাল চালবেন। তবে আমাদের কেন নিয়ে এলেন বলুন তো”?
পরিতোষ মনে মনে রচনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না। রচনাকে সঙ্গে আনবার পেছনে তার যে উদ্দেশ্য আছে সেটা ডক্টর বড়ুয়া আর রচনাই কেন শুধু, অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তিই সেটা এখন অব্দি জানে না। এমনকি সীমন্তিনী পর্যন্ত। কিন্তু সে’কথা এখনই এদের খুলে বলা যাবে না। আবার খুলে না বললেও রচনা হয়ত এ প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করতে পারে। তাই কিছু একটা বলে তার মুখটাকে আপাততঃ বন্ধ করে দিতেই হবে। রাস্তার এপাশে ও’পাশে সামনে পেছনে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে গাড়ির দরজা লক করে বলল, “রচু সোনা, তুমি সত্যিই খুব বুদ্ধিমতী। কিন্তু বোন, আমায় যখন দাদা বলে মেনেই নিয়েছ, তাহলে এই দাদার ওপর একটু ভরসা করতে পারছ না? তুমি আমার মন্তির রচু সোনা। তোমাকে বা রতুকে কি আমি কোনও বিপাকে ফেলতে পারি বোন? তবে তোমার প্রশ্নের জবাবে বলি, উদ্দেশ্য একটা আমার আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা যে কী, তা এখন তো নয়ই, আরোও কিছুদিনের মধ্যেও তোমাকে জানাতে পারব না বোন। তবে, একদিন তোমাদের কাছে সেটা প্রকাশ পাবেই। সেদিনই তোমরা সেটা জানতে পারবে। তার আগে নয়। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পার, যে আমি তোমার বা রতুর বা যে বাড়িতে যাচ্ছি সে বাড়ির কারোর বিয়ের সম্বন্ধ করতে যাচ্ছি না”।
রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ঈশ, পরিদা, আপনি যে কী না, ধ্যাৎ। আচ্ছা চলুন চলুন। দেখি আপনার বন্ধু বন্ধুপত্নী কে কেমন”?
রতীশও পরিতোষের কথা শুনে হেসে ফেলেছিল। পরিতোষ পেছনের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয়ে দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে একদিকে এগিয়ে চলল। একটা আটতলা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে ঢুকে লিফটে চড়ে পাঁচ তলায় এসে লিফট থেকে বেরিয়ে একটা দড়জার কলিং বেল বাজাবার সাথে সাথেই বছর বারো তেরোর এক কিশোরী দরজা খুলেই “আঙ্কল” বলে পরিতোষকে জড়িয়ে ধরল।
মেয়েটার পেছন পেছন এক সুন্দরী মহিলা আর একজন পুরুষকে দেখেই রচনা আর রতীশ বুঝতে পারল এনারাই সেই ডাক্তার দম্পতী। ডক্টর বড়ুয়া আর স্ত্রী। তারা দু’জনেই রচনা আর রতীশের হাত ধরে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘরের ভেতর টেনে নিলেন।
পরিতোষ মেয়েটার মুখটাকে দু’হাতে ধরে তার কপালে আদরের চুমু দিয়ে বলল, “কেমন আছ, মামনি”?
আকাঙ্ক্ষা পরিতোষকে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকবার পর তাকে ছেড়ে একপা পিছু হটে অভিমানী গলায় বলল, “এই কথা তুমি দিয়েছিলে আমাকে তাই না”?
পরিতোষ চট করে মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, “সরি মামনি। আমি জানি তোমাকে দেওয়া কথার খেলাপ করে ফেলেছি আমি। তবে সেটা যে কারনেই হোক, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল আমি তোমাকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারিনি। সেজন্যে আমি দুঃখিত। তুমি চাইলে আমাকে শাস্তি দিতেই পার”।
আকাঙ্ক্ষা এবার আরো এক পা পেছনে গিয়ে বলে উঠল, “ও মা, দেখ না আঙ্কল কী বলছে? আমি কী বলেছি আমি তাকে পানিশমেন্ট দেব”? বলে নিজেই পরিতোষের হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলল, “প্লীজ আঙ্কল, এমন করে আমাকে দুঃখ দিও না”।
পরিতোষও সাথে সাথে উঠেই আকাঙ্ক্ষার হাত ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ আমি কি আমার মামনিটাকে কষ্ট দিতে পারি? তাহলে তো আমার অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু মামনি, আমার অপরাধের শাস্তি মুকুব হল কিনা সেটা তো আগে জানতে হবে”?
আকাঙ্ক্ষা পরিতোষের হাত ধরে ঘরের ভেতর নিতে নিতে বলল, “মুকুব হচ্ছে না মশাই। তবে পোস্টপন্ড রইল আপাততঃ। এবার এসে বোসো তুমি। তোমার সাথে আমি খুব ঝগড়া করব”।
পরিতোষ হেসে বলল, “ওকে ডার্লিং। ঝগড়া কোর। কিন্তু দ্যাখ মামনি, আমাকে তো তুমি চেনই। কিন্তু আমার সাথে যে আরেক আঙ্কল আর আন্টি এসেছে, তাদের সাথে কথা বলবে না তুমি”?
আকাঙ্ক্ষা জিভে কামড় দিয়ে বলল, “ঈশ, আই মেড আ ব্লান্ডার। সরি আঙ্কল। সরি আন্টি। আপনারা প্লীজ কিছু মনে করবেন না” বলেই রচনার হাত ধরে আন্তরিক সুরে বলল, “আমি আকাংসা। আকাংসা বড়ুয়া”।
রচনা আকাঙ্ক্ষার চিবুক ধরে আদর করে বলল, “ভারী মিষ্টি মেয়ে তুমি”।
পরিতোষ ঘরের প্রায় মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে বলল, “ডক্টর বড়ুয়া, বৌদি, এরা আমার এক ভাই রতীশ আর তার স্ত্রী রচনা। রতীশ একজন যোগা এক্সপার্ট। খুব শিগগীরই কলকাতায় একটা যোগা ইনস্টিটিউট খুলবে। আর রচনা ওর যোগ্য সহধর্মিনী এবং গৃহবধূ। আর রতু, ইনি ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া, সার্জন হিসেবে কলকাতায় বেশ সুনাম আছে এনার। আর ইনি তার স্ত্রী দীপা বৌদি, আর আকাঙ্ক্ষা মামনির পরিচয় তো পেয়েই গেছ তোমরা। এনাদের একমাত্র সন্তান”।
ডক্টর বড়ুয়া আর তার স্ত্রী দু’জনেই হাতজোড় করে রতীশ আর রচনাকে নমস্কার জানালেন। রতীশ আর রচনা তাদের প্রতি নমস্কার করতেই আকাঙ্ক্ষা সকলের হাত ধরে সোফায় বসাতে বসাতে বলল, “হয়েছে হয়েছে, পরিচয় পর্ব নিয়ে আর বেশী সময় কাটানো চলবে না। তোমরা সবাই প্লীজ বসো এবার”।
দীপা এসে রচনার পাশে বসে তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “সত্যি স্যার, আজ আপনারা আসাতে আমরা সকলেই যে কী পরিমান খুশী হয়েছি, সেটা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। আড়াই বছর ধরে এ দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। তবে আজ আপনার সাথে সাথে বোনাস হিসেবে এদেরকে পেয়ে সত্যি ভাল লাগাটা দ্বিগুন হয়ে গেছে”।
ডক্টর বড়ুয়া এবার জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, রতীশবাবু কি আপনার নিজের ভাই”?
পরিতোষ ম্লান হেসে জবাব দিল, “সে অর্থে আমার নিজের বলতে তো কেউই নেই স্যার। তবে আপনাদের মত এদের মত সকলের সাথে বিভিন্ন রকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হবার চেষ্টা করি আমি। তবে ওই যে সেদিন আপনাকে বলছিলাম না, আমার খুব কাছের এক প্রিয়জনের কথা। এই রচনার ব্যাপারেই সেদিন কথাগুলো বলেছিলাম। এই রতীশের বোন মন্তির সাথে গত তিন চার বছরে আমার এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে যে সে এখন আমার জীবনের খুব কাছের এক প্রিয়বন্ধু। আর সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই এদেরকেও আমি আমার আত্মীয় বলে ভাবি”।
ডক্টর দিব্যেন্দু চোখ বড় বড় করে রচনাকে দেখতে দেখতে প্রায় অবিশ্বাসের সুরে বললেন, “কী বলছেন আপনি স্যার? ইনিই ...”
পরিতোষ সাথে সাথে চোখের ঈশারায় ডক্টরকে চুপ করবার নির্দেশ দিয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, এই রচনা আর রতীশই আমার বন্ধু মন্তির প্রাণ বলতে পারেন”।
ডক্টর বড়ুয়া আবার কিছু একটা বলবার জন্য মুখ খুলতেই দীপা রচনাকে বলল, “আমিও কিন্তু তোমাকে তাহলে বোন বলেই ডাকব ভাই। আর রতীশও আজ থেকে আমার একটা ভাই। তোমরা আপত্তি করবে না কিন্তু একেবারেই। তা রচনা, তোমার শ্বশুর বাড়ি কি কলকাতাতেই”?
রচনা জবাব দেবার আগেই আকাঙ্ক্ষা বলল, “মা তোমার ভাই হলে তো আমি ওনাকে আঙ্কল বলব না। মামু বলব। ইশ, এতদিনে এখানে মামু বলে ডাকবার মত কাউকে পেলাম। আমার নিজের মামু দু”টাকে তো আমি কাছেই পাই না”।
রতীশ হেসে তার পাশে বসা আকাঙ্ক্ষার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আপত্তি করব কেন মামনি। আজ থেকে আমি তোমার মামুই হলাম। আর ইনি তোমার মামী হলেন”।
আকাঙ্ক্ষা খুশী হয়ে রতীশের একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি কিন্তু তাহলে তোমাদের দু’জনকে মামা মামী বলেই ডাকব। আঙ্কল আন্টি বলব না”।
এবার রচনাও আকাঙ্ক্ষার একটা হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলল, “আচ্ছা তাই ডেকো সোনা। আমারও ওই ইংরেজী স্টাইলের আঙ্কল আন্টি ডাক শুনতে ভাল লাগে না। কে যে কাকা, কে যে জেঠু, কে পিসি, কে মাসি তা বোঝাই যায় না। বাংলা সম্বোধনটাই ভাল” বলে দীপার দিকে চেয়ে বলল, “আমরাও কিন্তু তাহলে আপনাকে দিদি বলে ডাকব। তবে দিদি, আপনি যেটা বলছিলেন, আমার শ্বশুর বাড়ি বাপের কোনটাই কলকাতায় নয়। আসলে আপনার ভাই একটা যোগা ইনস্টিটিউট খুলবে বলেই আমাদের কলকাতায় আসা। এমনিতে আমার শ্বশুর বাড়ি হচ্ছে রাজগঞ্জে, জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্টে। আর আমার বাপের বাড়ি হচ্ছে কালচিনিতে। সেটাও আগে জলপাইগুড়িতে জেলার ভেতরে থাকলেও এখন সেটা আলিপুরদুয়ার জেলায়”।
আকাঙ্ক্ষা রচনার কথা শুনেই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও মা, বড়মামুও কি ওই কালচিনিতেই থাকে নাকি গো”?
দীপা বলল, “হ্যাঁ সোনা, তোমার বড়মামুও কালচিনিতেই থাকেন”।
এবার রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা সেকি দিদি? তোমার বাপের বাড়িও কালচিনিতেই নাকি? কিন্তু কৈ তোমাকে কখনও সেখানে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না”!
দীপা জবাব দিল, “না ঠিক তা নয় রচনা। আমার বাপের বাড়ি আসলে মালবাজারে। তবে আমার এক দাদা মানে আমার আপন বড়দা কালচিনি হাসপাতালে আছেন এখন, উনিও ডাক্তার। এখন তিনি কালচিনি হাসপাতালের ইনচার্জ”।
রচনা আর রতীশ দু’জনেই এবার অবাক চোখে দীপার দিকে তাকাল। রতীশ বলল, “তাই নাকি দিদি? কিন্তু কালচিনি হাসপাতালে এখন যে ইনচার্জ তার নাম তো ডঃ শিবরঞ্জন সোম”!
দীপা উৎফুল্ল হয়ে বলল, “হ্যাঁ, সেই তো আমার বড়দা। তোমরা তাকে চেনো নাকি”?
রচনা আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, “কী বলছ দিদি? ডঃ সোম তোমার দাদা? উনি যে আমাদের কত বড় উপকার করেছেন তার জন্য সারা জীবন আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার দিদি তো প্রায় মরেই যাচ্ছিল। ডঃ সোমই তো তাকে বাচিয়েছেন। আমরাও দিদির অমন খবর পেয়ে কালচিনি গিয়েছিলুম এখান থেকে। এই তো মাত্র মাস দুয়েক আগের কথা। তাই না গো”? বলে রতীশের দিকে চাইল।
রতীশ রচনার কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ দিদি, রচু একদম ঠিক বলছে। ডঃ সোমের সাথে আমাদের কথাও হয়েছে। সত্যিই খুব ভাল মানুষ। এখনও তো অর্চুদি তার ট্রিটমেন্টেই আছেন”।
দীপা জিজ্ঞেস করল, “অর্চুদি কে”?
______________________________