19-03-2020, 03:15 PM
(Update No. 177)
গাড়িতে চেপে অফিসে যেতে যেতেই সীমন্তিনী পরিতোষকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে রচু পরিতোষের সাথে যাবে ঠিকই তবে ও একা যাবে না, ও রতীশকেও সঙ্গে নেবে। পরিতোষ সে’কথা শুনে শুধু বলল “নো প্রব্লেম”।
আবার বারোটা নাগাদ রতীশকে ফোন করে পরিতোষের সাথে বিকেলে বেরোবার কথা বুঝিয়ে দিল। রতীশ সীমন্তিনীর কথা এককথায় মেনে নিলেও জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে মন্তি, তুই কি চাইছিস যে অর্চুদির ব্যাপারে আমরা পরিতোষদার সাথে কোনরকম আলোচনা করি”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “দাদাভাই আজই বা এখনই সেসব কিছু দরকার নেই রে। আসলে পরিতোষ আগামী সাতদিন সাংঘাতিক রকম ব্যস্ত থাকবে। তাই ভেবেছি, সাত দিন পরেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা শুরু করব। তবে কাল রাতে একবার আমি সে চেষ্টা করেছিলুম। তখন আমি আসলেই জানতুম না যে ও এতটা ব্যস্ত আছে। প্রসঙ্গটা তুলতেই ও ওর ব্যস্ততার কথা বলল। আর অবশ্য সাথে এ’কথাও বলেছে যে আমার আর নীতার পছন্দই ও চোখ বুজে মেনে নেবে। তাই ও ব্যাপারটা নিয়ে আমি আরও আশাবাদী হয়ে উঠেছি সত্যি, কিন্তু ওর ব্যস্ততার ধরণটা বুঝতে পেরে আমি নিজেও বুঝতে পারছি যে, ও যে ব্যাপারটা নিয়ে এখন ব্যস্ত আছে সেটা শেষ না হওয়া অব্দি ওর মাথায় এখন আর অন্য কোন কথাই ঢুকবে না। তাই তুই আজ ও ব্যাপারে ওকে কোনরকম হিন্টস দিস না প্লীজ। ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি সময়মত কাকে কখন কী করতে হবে সেইমত তাদের সেগুলো করতে বলব। তবে দাদাভাই, ইন দা মিন টাইম, তুই কিন্তু একটা কাজ একটু এগিয়ে রাখতে পারিস”।
রতীশ জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ রে? বল না”?
সীমন্তিনী এক সেকেন্ড ভেবে বলল, “দ্যাখ দাদাভাই, পূজোর পরে পরেই আমি কালচিনির বাড়িতে নতুন ঘর বানাবার কাজ শুরু করতে চাইছি। তখন প্রায় গোটা বাড়িটাই ভাঙা পড়বে। তখন হয়তো একটা টেম্পোরারি শেড বানিয়ে মাসি মেসোদের থাকতে হবে। আবার ওদিকে অর্চুর বিয়েটাও ভাবছি অঘ্রান মাসেই কোন একটা সময়ে দেব। কিন্তু ততদিনে তো বাড়ির কাজটা শেষ হবে না। আর তাছাড়া অর্চুর বিয়েটা বোধহয় এমনিতেও কালচিনি থেকে দেওয়া সহজ হবে না। ', ঘরের বিধবা মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ছোট জায়গায় এমন ব্যাপারে স্বভাবতঃই একটু বেশী কানাঘুষো বা হৈ চৈ হয়ে থাকে। মাসি মেসোরা হয়ত সেটা বরদাস্ত করে উঠতে পারবেন না। তাই বিয়েটা কালচিনি ছাড়া অন্য কোথাও আয়োজন করতে পারলেই ভাল হয়। কিন্তু দ্যাখ, আমি তো থাকি অফিসিয়াল কোয়ার্টারে। তাই আমার এখান থেকে বিয়েটা তো আর দেবার বন্দোবস্ত করা যাবে না। হয়তো আলিপুরদুয়ার বা জলপাইগুড়ির কোন একটা বিবাহ ভবন ভাড়া করে আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু মন থেকে আমি সেটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না রে। কারন অমন বিয়েতে বিয়ের সত্যিকারের মজাটাই উপভোগ করা যায় না। একটা ঘরোয়া পরিবেশ না হলে বিয়ে সাদির ব্যাপারটা আসলেই জমে না। এখন এ ছাড়া আর অলটারনেটিভ বলতে আমাদের হাতে একটাই মাত্র উপায় থাকে। আর সেটা হল আমাদের রাজগঞ্জের বাড়ি থেকে যদি বিয়েটা দেওয়া যায়। তাহলে মাসি মেসোরাও অতটা অস্বস্তি ফীল করবেন না, আর তোরাও সকলে বিয়েতে ভরপুর স্ফুর্তি করতে পারতিস। তাই বলছি, তুই বড়মা বা জেঠুর সাথে এ ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলিস না দাদাভাই। যদি তাদের ওখানে তাদের নিজেদের কারো কোন অসুবিধে না হয়, তাহলে বিয়ের আয়োজনটা ওখানে করলেই সবথেকে ভাল হয়রে। অবশ্য কারো পরীক্ষা টরীক্ষার সাথে ক্ল্যাস করলে অবশ্য অন্যভাবে ভাবতেই হবে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভাই বোন কারো পরীক্ষা থাকতেই পারে, সে ব্যাপারটাও কনসিডারেশনে নিস”।
রতীশ সীমন্তিনীকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বলল যে সে তার মা বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে। তখন সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা দাদাভাই শোন আরেকটা কথা আছে। তুই নাকি রচুকে বলেছিস যে পূজোর সময় রাজগঞ্জে গিয়ে মাত্র দু’তিনদিন থাকবি? এ’কথা কেন বলেছিস রে”?
রতীশ জবাব দিল, “হ্যাঁরে অমন কথা বলেছি ঠিকই। আর রচু যে এ’কথা শুনে খুশী হয়নি তাও বুঝেছি। কিন্তু কি করব আমি বল তো? বৌদি তো আমাকে এখন একটা দিনের জন্যেও ছুটি দিতে চাইছেন না। কিন্তু যখন আমি তার ওখানে কাজে ঢুকেছিলাম তখন কিন্তু বৌদি অন্য কথা বলেছিলেন। তখন উনি বলেছিলেন যে আমার বাড়ি দুরে বলে উনি আমাকে নিয়মের বাইরেও কিছু এক্সট্রা ছুটি দেবেন। অবশ্য তেমনটা যে তিনি করেন নি তাও নয় একেবারে। অর্চুদি যখন হাসপাতালে, সে খবর শুনেই আমি চাকরিতে জয়েন করবার আগেই তিনি আমাকে বেশ ক’দিনের ছুটি দিয়েছিলেন কালচিনি যাবার জন্য। আর শুধু ছুটি দেওয়াই নয়, উনি তো আমার আর রচুর যাতায়াতের টিকিটও করে দিয়েছিলেন। তাই তার ওপর শুরু থেকেই কৃতজ্ঞ ছিলুম আমি। কিন্তু এখন যে কেন তিনি এমন করছেন, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না রে। আর তোকে তো আগেও বলেছি, ইদানীং বৌদিকে খুব টেন্সড দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সব সময় কোন একটা দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু এমন অবস্থায় তার কাছে আমি লম্বা ছুটি কিকরে চাই বল তো”?
সীমন্তিনী রতীশের কথা শুনে বলল, “ও এই ব্যাপার? ঠিক আছে, ও নিয়ে তুই ভাবিস নে। আমি তোর মহিমা বৌদির সাথে সময়মত এ ব্যাপারে আলাপ করব। আচ্ছা ঠিক আছে দাদাভাই, এখন ছাড়ছি তাহলে আমি। আর হ্যাঁ, পরিতোষ এলে ওকে ফিরিয়ে দিসনে যেন। রচুকে বুঝিয়ে বলিস। ও-ও যেন যেতে অরাজী না হয় কেমন”?
রতীশ সম্মতি জানাতেই সীমন্তিনী ফোন কেটে দিল।
*****************
বিকেল তখন ঠিক পাঁচটা। পরিতোষ সিভিল ড্রেসে রতীশদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করে বলল, “হ্যাঁ শোন, আমি একটু বাদেই এ দু’জনকে নিয়ে বেরোবো। দমদমের দিকে যাচ্ছি। তোদের একটা টিম এখানে এদের ঘরের ওপর নজর রাখবি। আর একটা মোবাইল টিম আমার গাড়িটাকে ফলো করবি। যদিও কোন ঘটণা ঘটবে বলে মনে হয় না, তবুও সঙ্গে আর্মস রাখবি। আর সব সময় আমার গাড়ির ওপর কড়া নজর রাখবি। দমদমে এক জায়গায় গিয়ে গাড়িটা একটা গলির ভেতর রেখে আমরা একটা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যাব। সেখান থেকে বেরোতে বেশ দেরী হবে। রাত দশটা এগারটাও হতে পারে, আবার তার আগেও যে কোন সময় বেরিয়ে আসতে পারি। কিন্ত আমরা যতক্ষণ ওই অ্যাপার্টমেন্টে থাকব, ততক্ষণ আমাদের গাড়িটার ওপর কড়া নজর রাখবি। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু আমার নিজের গাড়িটা নিই নি। এ বিল্ডিংএর ঠিক সামনেই রাস্তার ধারে তাকিয়ে দেখ। একটা ব্লু কালারের ওয়াগন আর পার্ক করা আছে। আমরা ওই গাড়িতেই যাচ্ছি। আর ফিরে এখানে না আসা পর্যন্ত তোরা কন্টিনিউয়াস শার্প ওয়াচ রাখবি এ গাড়ির ওপর” বলে ফোন কেটে দিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।
রতীশদের ঘরের কলিং বেল বাজাতেই রচনা আর রতীশ দু’জনেই সহর্ষে পরিতোষকে স্বাগত জানাল। তাদের দু’জনকেই পোশাকে দেখে পরিতোষ বলল, “বাঃ, আপনারা তৈরীই আছেন দেখছি। তাহলে চলুন দাদা, আমরা আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়ি”।
রতীশ পরিতোষের একটা হাত ধরে বলল, “দাদা, এর আগে যেদিন আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেদিন আমরা সকলেই এমন একটা বিজি সিডিউলের মধ্যে ছিলুম যে আপনার সাথে ভাল করে কথাও বলতে পারিনি। আজ হয়ত বেশ কিছুটা সময় আপনার সাথে কাটবে আমাদের। কিন্তু দাদা, দুটো কথা আমরা ঘর থেকে বেরোবার আগেই আপনাকে বলতে চাই”।
পরিতোষ মনে মনে একটু অবাক হলেও মুখের স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখেই বলল, “বেশ তো, বলুন না”।
রতীশ পরিতোষের হাত ধরে তাকে সামনের ঘরের সোফার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “আসুন, বসে কথা বলা যাক”।
রচনা ভেতরে ঢুকে গেল। পরিতোষকে এক সোফায় বসিয়ে রতীশ উল্টোদিকের সোফায় বসে বলল, “দাদা, আপনি মন্তির বন্ধু হলেও ওর থেকে বয়সে এবং সার্ভিসে সিনিয়র। আমি আর মন্তি প্রায় সমবয়সী। তাই বুঝতেই পারছেন আমি আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট। আর রচুর কথা নাই বা বললাম। অবশ্য রচুকে আপনি আগে থেকেই তুমি করে বলছেন। কিন্তু দাদা, আমিও কিন্তু আপনার কাছ থেকে তুমি সম্মোধনটাই শুনতে চাই”।
পরিতোষ মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, “ওকে, ব্রাদার, ডান। আর দ্বিতীয় কথাটা কি শুনি”।
রতীশ কিছু বলবার আগেই রচনা দুটো প্লেটে কিছু মিষ্টি আর খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে, আজ আপনি প্রথম আমাদের ঘরে পা রেখেছেন। তাই আপনাকে একটু মিষ্টিমুখ করতেই হবে। না বললে শুনছি না কিন্তু”।
পরিতোষ হা হা করে বলে উঠল, “বৌদি প্লীজ, এসব করতে গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি শুধু একটা মিষ্টি উঠিয়ে নিচ্ছি”।
রচনা বলল, “উহু, ওসব হবে না। আর খুব বেশী কিছু তো আমি দিই নি দাদা। মিষ্টির সাথে দুটো স্ন্যাক্স আর নিজের হাতে বানানো একটু পায়েসই তো শুধু দিয়েছি। বোন হয়ে কি এটুকুও করবার অধিকার নেই আমার শুনি”?
রচনার এমন সুমিষ্ট কথা শুনে পরিতোষ আর কোন কথা না বলে রচনার হাতে ধরা ট্রে থেকে একটা প্লেট উঠিয়ে নিয়ে গপগপ করে খেতে লাগল। তা দেখে রচনা হেসে বলল, “এমা, অত তাড়াতাড়ি খেতে হবে না। শেষে বিষম টিষম খাবেন তো। আপনি ধীরে সুস্থে খান, দাদা। আমি চা আনছি”।
পরিতোষ হাত তুলে বাধা দেবার আগেই রচনা ভেতরে ঢুকে গেল। চা না খেয়ে পরিতোষ আর এখান থেকে বেরোতে পারবে না বুঝে গেল। কিন্তু রচনার হাতের পায়েস খেয়ে তার মনে হল এমন সুস্বাদু খাবার সে বুঝি তার জীবনে আজই প্রথম খেলো। কিন্তু খাবারের প্রশংসা করে সময় নষ্ট একেবারেই করতে চাইল না সে ওই মূহুর্তে। তাই চা খাবার পর আর একটা মিনিটও দেরী না করে রচনা আর রতীশকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এল।
পেছনের সীটে রচনা আর রতীশকে বসিয়ে পরিতোষ গাড়ি ছেড়েই বলল, “রতুদা আর বৌদি, তোমরা দু’জনেই হয়ত খুব অবাক হয়েছ এভাবে তোমাদের কোথাও নিয়ে যাচ্ছি দেখে। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করতে পারো, এর পেছনে আমার কোনও বদ মতলব নেই। তবে হ্যাঁ, মতলব একটা অবশ্যই আছে। সেটা আমি এখনই তোমাদের কাছে প্রকাশ করে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। নইলে তোমরা মনে মনে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে থাকবে। তবে তারও আগে আমি আরেকটা কথা বলে নিতে চাই, নইলে কথাটা হয়ত পরে আমার মাথা থেকে বেড়িয়েই যাবে। ভাগ্যিস আমার আপত্তিতে কান না দিয়ে তুমি জোর করেই আমাকে তোমার হাতের বানানো পায়েসটুকু খাইয়ে ছিলে বৌদি। ঈশ, না খেলে সত্যি বড্ড মিস করতাম। এটা ছিল আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুস্বাদু খাবার। এত সুস্বাদু পায়েস এই প্রথম আমার কপালে জুটল আজ”।
রচনা প্রায় সাথে সাথে বলল, “এ মা, কী বলছেন দাদা আপনি? তবে, এ’কথাটা তখন বলেন নি কেন? আরো ছিল তো! আরেকটু দিতে পারতুম তো আপনাকে। ঈশ, দেখেছেন, আপনি ঘরে ঢোকবার সাথে সাথে এমন তাড়া দিলেন যে আমি আর সাহস করে দ্বিতীয়বার আপনাকে সাধতে সাহস পাইনি। তখন ভেবেছিলুম, তাতে করে আপনি হয়ত সময় নষ্ট হচ্ছে বলে বিরক্ত হবেন। ঈশ, ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা বলুন তো”?
পরিতোষ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে মাথা ঘুরিয়ে রচনা আর রতীশদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “সত্যি বৌদি, এখন আমার খুব আফসোস হচ্ছে। তবে এ পায়েস খাবার লোভেই হয়ত তোমাদের ওখানে আবার আমি ছুটে যাব কোনদিন। আর সেদিন আগে থেকে নোটিস দিয়েই যাব। একটু বেশী করে খাইও প্লীজ”। বলে হাঃ হাঃ করে হেসে দিল।
রচনা একটু অভিমানী সুরে বলল, “সে যেদিন আবার আমার ভাগ্য হবে, সেদিন হয়তো সেটা হবে। কিন্তু আজ যখন আমাদের ফিরিয়ে এনে আবার বাড়িতে নামিয়ে দেবেন, তখন কিন্তু আপনাকে আমাদের ঘরে ঢুকতেই হবে। আরেকটু পায়েস আপনাকে খেয়ে যেতেই হবে”।
পরিতোষ আবার হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে বৌদি। সেটা দেখা যাবে’খন। তবে কখন যে ফিরব, সেটা তো আমি নিজেও জানিনা। দেরী হলে প্লীজ তোমরা কেউ আমার ওপর রেগে যেও না। আসলে তোমাদের নিয়ে আমি আজ যেখানে যাচ্ছি, তারা আমাকে খুবই স্নেহ করেন। ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া আর তার স্ত্রী দীপা বড়ুয়া আমাকে যতটা স্নেহ করেন, তার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসে তাদের মেয়ে আকাঙ্ক্ষা। অসম্ভব মিষ্টি মেয়েটা। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো রতুদা, ওদের সাথে এর আগে আমার শুধু একদিনই দেখা হয়েছিল, তাও আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে। ভাইজ্যাগে। এ আড়াই বছরের মধ্যে তারা বহুবার আমাকে তাদের ওখানে যেতে বলেছেন। কিন্তু আমি কাজে এতই ব্যস্ত থাকি যে ইচ্ছে করলেও গিয়ে উঠতে পারিনি। আর ডক্টর বড়ুয়াও খুব ব্যস্ত ডাক্তার। এতদিন বাদে এই সেদিন আবার ডক্টর বড়ুয়ার সাথে আমার দেখা হয়েছে কাজের সূত্রেই। আর উনি এমন করে বললেন যে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগল। আর মন্তিও দুপুরে ফোন করে বলল যে বাড়ির লোকজনদের কথা ভেবে ভেবে বৌদির মনটাও নাকি খুব খারাপ। তাই তোমাদের দু’জনকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে। তখনই হঠাৎ মনে হল, তাহলে একসাথে দুটো কাজই আজ সেরে ফেলা যাক। ডক্টর বড়ুয়াদের সাথে দেখা করবার সাথে সাথে একসাথে তোমাদের নিয়ে একটু ঘোরাও হয়ে যাবে। মন্তির অনুরোধটাও রক্ষা করা হবে। তবে বৌদি আর রতুদা, অচেনা একজনের বাড়িতে তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি বলে তোমরা কোনও রকম মন খারাপ কোর না প্লীজ। আসলে জানো কি? আমার তো আর পৃথিবীতে নিজের বলতে কেউ নেই। তোমাদের মত, মন্তি বা নীতার মত আরও কয়েক জনকে নিজের আত্মীয় বানিয়ে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিই। আর এদের সকলের কাছে যেটুকু স্নেহ ভালবাসা আমি পাই তাতেই নিজেকে সুখী বলে ভাবতে চেষ্টা করি। এই আর কি”।
রতীশ এতক্ষণ পরে প্রথম কথা বলল, “না না দাদা, আপনি আমাদের জন্য অযথা চিন্তা করবেন না। মন্তি তো আমাকে আগেই ফোন করে বলে দিয়েছিল। তাই আমরাও মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম”।
রচনা বলল, “দাদা, একটা কথা বলব”?
পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ বৌদি, বলো না”।
রচনা একটু হেসে বলল, “বলছিলাম কি এই যে আপনি ওকে নাম ধরে আর আমাকে বৌদি বলে সম্বোধন করছেন না? এ ব্যাপারটা ঠিক জমছে না। আমি আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট। আমাকে যখনই আপনি বৌদি বলে ডাকছেন, আমার মনে হচ্ছে আমি যেন বুড়িয়ে গেছি। আপনি তো দিদিভাইয়ের বন্ধু। সম্পর্কে আমি তার বৌদি হলেও দিদিভাই শুরু থেকেই আমাকে নাম ধরেই ডাকেন। আসলে আমি তার মুখে অমন ডাক শুনতেই ভালবাসি। আপনিও যদি আমাকে অমন ভাবে নাম ধরে ডাকেন তাহলে আমার আরও বেশী ভাল লাগবে। বৌদি ডাকটা আপনার মুখে থেকে শুনতে আমার একদম ভাল লাগছে না। প্লীজ দাদা, আমি আপনার বৌদি হতে চাইনে। আপনি আমায় আপনার ছোট বোন বলে ভাবুন না” বলেই রতীশের উদ্দেশ্যে বলল, “কিগো তুমি বল না দাদাকে, উনি যেন আমাকে বৌদি বলে না ডাকেন”।
রতীশ সাথে সাথেই বলল, “হ্যাঁ দাদা, রচু কিন্তু ঠিক কথাই বলেছে। আর আমাকেও আপনি রতুদা বা রতীশদা না বলে শুধু আমার ডাক নাম ধরে রতু বলে ডাকুন, আমার সেটাই বেশী ভাল লাগবে। আসলে সত্যিই আপনি যখন ওকে বৌদি বলে ডাকছেন, তখন ডাকটা আমার কানেও শ্রুতিকটু লাগছে। আর রচু হয়তো মনে মনে নিজেকে আপনার ছোট বোনের মতই ভাবছে”।
রচনা সাথে সাথে রতীশের হাত চেপে ধরে ঈশারায় চুপ করতে বলল। তবে পরিতোষও এবার একটু হেসে বলল, “বেশ তো, তোমরা দু’জনেই যদি এটাই চাও, তাহলে তা-ই নাহয় বলব। কিন্তু আমারও তাহলে একটা আবদার আছে। মন্তি যখন তোমায় রচু সোনা বলে ডাকে তখন সত্যি বলছি ডাকটা আমার কাছে খুব মিষ্টি মনে হয়। আমিও কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে ওভাবেই ‘রচু সোনা’ বলে ডেকে ফেলতে পারি। তখন কিন্তু রাগ করতে পারবে না। অবশ্য আমার গলা তো আর মন্তির গলার কত অমন মিষ্টি নয়। আমার হেড়ে গলায় ‘রচু সোনা’ ডাকটা তোমাদের কানে বেখাপ্পা বা বিসদৃশ্য মনে হতেই পারে। কিন্তু ছুটটা কিন্তু আমাকে দিতেই হবে। নইলে আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকতে পারব না”।
রচনা খুশী হয়ে বলল, “এতে আর আমাদের অনুমতি চাইবার কি আছে দাদা। আপনার যদি সেভাবে ডাকতে ভাল লাগে, তাহলে ডাকবেন। তবে এতে লাভ তো আমারই হচ্ছে। আমরা দু’বোন এক ভাই। ভাইটা সকলের ছোট। তাই আমাদের দাদা বলে কেউ ছিল না এতদিন। আজ থেকে একটা দাদা পেয়ে গেলাম আমি”।
রতীশও খুশী মনে রচনার কথায় সায় দিতেই, রচনা আবার পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কিন্তু পরিদা? একটা কথা ভেবে কিন্তু ......” বলেই নিজের ভুল ধরতে পেরে বলল, “ঈশ, ছিঃ ছিঃ, আপনাকে আমি নাম ধরে ডেকে ......”
তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই পরিতোষ হেসে বলল, “বেশ করেছ। তোমার মুখে ‘পরিদা’ ডাক শুনে আমারও অন্য রকম লাগছে। আসলে জানো রচু, ওই একটু আগেই বললাম না যে আমার নিজের বলতে কেউ না থাকলেও অনেকেই আমাকে স্নেহ করেন, ভালবাসেন। কিন্তু তারা কেউ আমাকে পরিদা বলে ডাকে না। কেউ ‘দাদা’ বলে, কেউ ‘আঙ্কল’ বলে, কেউ ‘মামা’ বলে। কেউ কেউ ‘ভাই’ বলেও ডাকে। আর বেশীর ভাগই ‘স্যার’ বলে। আমার মনের সবচেয়ে কাছের দুটো মানুষ আমাকে পরি বলে ডাকে। কিন্তু পরিদা বলে ডাকবার কেউ নেই। তুমি যদি আমাকে সেভাবেই ডাকো তাহলে বেশী খুশী হব। আচ্ছা কি বলছিলে সেটা বলে ফ্যালো। আমরা কিন্তু আর একটু বাদেই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাব”।
______________________________
গাড়িতে চেপে অফিসে যেতে যেতেই সীমন্তিনী পরিতোষকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে রচু পরিতোষের সাথে যাবে ঠিকই তবে ও একা যাবে না, ও রতীশকেও সঙ্গে নেবে। পরিতোষ সে’কথা শুনে শুধু বলল “নো প্রব্লেম”।
আবার বারোটা নাগাদ রতীশকে ফোন করে পরিতোষের সাথে বিকেলে বেরোবার কথা বুঝিয়ে দিল। রতীশ সীমন্তিনীর কথা এককথায় মেনে নিলেও জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে মন্তি, তুই কি চাইছিস যে অর্চুদির ব্যাপারে আমরা পরিতোষদার সাথে কোনরকম আলোচনা করি”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “দাদাভাই আজই বা এখনই সেসব কিছু দরকার নেই রে। আসলে পরিতোষ আগামী সাতদিন সাংঘাতিক রকম ব্যস্ত থাকবে। তাই ভেবেছি, সাত দিন পরেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা শুরু করব। তবে কাল রাতে একবার আমি সে চেষ্টা করেছিলুম। তখন আমি আসলেই জানতুম না যে ও এতটা ব্যস্ত আছে। প্রসঙ্গটা তুলতেই ও ওর ব্যস্ততার কথা বলল। আর অবশ্য সাথে এ’কথাও বলেছে যে আমার আর নীতার পছন্দই ও চোখ বুজে মেনে নেবে। তাই ও ব্যাপারটা নিয়ে আমি আরও আশাবাদী হয়ে উঠেছি সত্যি, কিন্তু ওর ব্যস্ততার ধরণটা বুঝতে পেরে আমি নিজেও বুঝতে পারছি যে, ও যে ব্যাপারটা নিয়ে এখন ব্যস্ত আছে সেটা শেষ না হওয়া অব্দি ওর মাথায় এখন আর অন্য কোন কথাই ঢুকবে না। তাই তুই আজ ও ব্যাপারে ওকে কোনরকম হিন্টস দিস না প্লীজ। ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি সময়মত কাকে কখন কী করতে হবে সেইমত তাদের সেগুলো করতে বলব। তবে দাদাভাই, ইন দা মিন টাইম, তুই কিন্তু একটা কাজ একটু এগিয়ে রাখতে পারিস”।
রতীশ জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ রে? বল না”?
সীমন্তিনী এক সেকেন্ড ভেবে বলল, “দ্যাখ দাদাভাই, পূজোর পরে পরেই আমি কালচিনির বাড়িতে নতুন ঘর বানাবার কাজ শুরু করতে চাইছি। তখন প্রায় গোটা বাড়িটাই ভাঙা পড়বে। তখন হয়তো একটা টেম্পোরারি শেড বানিয়ে মাসি মেসোদের থাকতে হবে। আবার ওদিকে অর্চুর বিয়েটাও ভাবছি অঘ্রান মাসেই কোন একটা সময়ে দেব। কিন্তু ততদিনে তো বাড়ির কাজটা শেষ হবে না। আর তাছাড়া অর্চুর বিয়েটা বোধহয় এমনিতেও কালচিনি থেকে দেওয়া সহজ হবে না। ', ঘরের বিধবা মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ছোট জায়গায় এমন ব্যাপারে স্বভাবতঃই একটু বেশী কানাঘুষো বা হৈ চৈ হয়ে থাকে। মাসি মেসোরা হয়ত সেটা বরদাস্ত করে উঠতে পারবেন না। তাই বিয়েটা কালচিনি ছাড়া অন্য কোথাও আয়োজন করতে পারলেই ভাল হয়। কিন্তু দ্যাখ, আমি তো থাকি অফিসিয়াল কোয়ার্টারে। তাই আমার এখান থেকে বিয়েটা তো আর দেবার বন্দোবস্ত করা যাবে না। হয়তো আলিপুরদুয়ার বা জলপাইগুড়ির কোন একটা বিবাহ ভবন ভাড়া করে আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু মন থেকে আমি সেটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না রে। কারন অমন বিয়েতে বিয়ের সত্যিকারের মজাটাই উপভোগ করা যায় না। একটা ঘরোয়া পরিবেশ না হলে বিয়ে সাদির ব্যাপারটা আসলেই জমে না। এখন এ ছাড়া আর অলটারনেটিভ বলতে আমাদের হাতে একটাই মাত্র উপায় থাকে। আর সেটা হল আমাদের রাজগঞ্জের বাড়ি থেকে যদি বিয়েটা দেওয়া যায়। তাহলে মাসি মেসোরাও অতটা অস্বস্তি ফীল করবেন না, আর তোরাও সকলে বিয়েতে ভরপুর স্ফুর্তি করতে পারতিস। তাই বলছি, তুই বড়মা বা জেঠুর সাথে এ ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলিস না দাদাভাই। যদি তাদের ওখানে তাদের নিজেদের কারো কোন অসুবিধে না হয়, তাহলে বিয়ের আয়োজনটা ওখানে করলেই সবথেকে ভাল হয়রে। অবশ্য কারো পরীক্ষা টরীক্ষার সাথে ক্ল্যাস করলে অবশ্য অন্যভাবে ভাবতেই হবে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভাই বোন কারো পরীক্ষা থাকতেই পারে, সে ব্যাপারটাও কনসিডারেশনে নিস”।
রতীশ সীমন্তিনীকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বলল যে সে তার মা বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে। তখন সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা দাদাভাই শোন আরেকটা কথা আছে। তুই নাকি রচুকে বলেছিস যে পূজোর সময় রাজগঞ্জে গিয়ে মাত্র দু’তিনদিন থাকবি? এ’কথা কেন বলেছিস রে”?
রতীশ জবাব দিল, “হ্যাঁরে অমন কথা বলেছি ঠিকই। আর রচু যে এ’কথা শুনে খুশী হয়নি তাও বুঝেছি। কিন্তু কি করব আমি বল তো? বৌদি তো আমাকে এখন একটা দিনের জন্যেও ছুটি দিতে চাইছেন না। কিন্তু যখন আমি তার ওখানে কাজে ঢুকেছিলাম তখন কিন্তু বৌদি অন্য কথা বলেছিলেন। তখন উনি বলেছিলেন যে আমার বাড়ি দুরে বলে উনি আমাকে নিয়মের বাইরেও কিছু এক্সট্রা ছুটি দেবেন। অবশ্য তেমনটা যে তিনি করেন নি তাও নয় একেবারে। অর্চুদি যখন হাসপাতালে, সে খবর শুনেই আমি চাকরিতে জয়েন করবার আগেই তিনি আমাকে বেশ ক’দিনের ছুটি দিয়েছিলেন কালচিনি যাবার জন্য। আর শুধু ছুটি দেওয়াই নয়, উনি তো আমার আর রচুর যাতায়াতের টিকিটও করে দিয়েছিলেন। তাই তার ওপর শুরু থেকেই কৃতজ্ঞ ছিলুম আমি। কিন্তু এখন যে কেন তিনি এমন করছেন, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না রে। আর তোকে তো আগেও বলেছি, ইদানীং বৌদিকে খুব টেন্সড দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সব সময় কোন একটা দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু এমন অবস্থায় তার কাছে আমি লম্বা ছুটি কিকরে চাই বল তো”?
সীমন্তিনী রতীশের কথা শুনে বলল, “ও এই ব্যাপার? ঠিক আছে, ও নিয়ে তুই ভাবিস নে। আমি তোর মহিমা বৌদির সাথে সময়মত এ ব্যাপারে আলাপ করব। আচ্ছা ঠিক আছে দাদাভাই, এখন ছাড়ছি তাহলে আমি। আর হ্যাঁ, পরিতোষ এলে ওকে ফিরিয়ে দিসনে যেন। রচুকে বুঝিয়ে বলিস। ও-ও যেন যেতে অরাজী না হয় কেমন”?
রতীশ সম্মতি জানাতেই সীমন্তিনী ফোন কেটে দিল।
*****************
বিকেল তখন ঠিক পাঁচটা। পরিতোষ সিভিল ড্রেসে রতীশদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করে বলল, “হ্যাঁ শোন, আমি একটু বাদেই এ দু’জনকে নিয়ে বেরোবো। দমদমের দিকে যাচ্ছি। তোদের একটা টিম এখানে এদের ঘরের ওপর নজর রাখবি। আর একটা মোবাইল টিম আমার গাড়িটাকে ফলো করবি। যদিও কোন ঘটণা ঘটবে বলে মনে হয় না, তবুও সঙ্গে আর্মস রাখবি। আর সব সময় আমার গাড়ির ওপর কড়া নজর রাখবি। দমদমে এক জায়গায় গিয়ে গাড়িটা একটা গলির ভেতর রেখে আমরা একটা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যাব। সেখান থেকে বেরোতে বেশ দেরী হবে। রাত দশটা এগারটাও হতে পারে, আবার তার আগেও যে কোন সময় বেরিয়ে আসতে পারি। কিন্ত আমরা যতক্ষণ ওই অ্যাপার্টমেন্টে থাকব, ততক্ষণ আমাদের গাড়িটার ওপর কড়া নজর রাখবি। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু আমার নিজের গাড়িটা নিই নি। এ বিল্ডিংএর ঠিক সামনেই রাস্তার ধারে তাকিয়ে দেখ। একটা ব্লু কালারের ওয়াগন আর পার্ক করা আছে। আমরা ওই গাড়িতেই যাচ্ছি। আর ফিরে এখানে না আসা পর্যন্ত তোরা কন্টিনিউয়াস শার্প ওয়াচ রাখবি এ গাড়ির ওপর” বলে ফোন কেটে দিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।
রতীশদের ঘরের কলিং বেল বাজাতেই রচনা আর রতীশ দু’জনেই সহর্ষে পরিতোষকে স্বাগত জানাল। তাদের দু’জনকেই পোশাকে দেখে পরিতোষ বলল, “বাঃ, আপনারা তৈরীই আছেন দেখছি। তাহলে চলুন দাদা, আমরা আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়ি”।
রতীশ পরিতোষের একটা হাত ধরে বলল, “দাদা, এর আগে যেদিন আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেদিন আমরা সকলেই এমন একটা বিজি সিডিউলের মধ্যে ছিলুম যে আপনার সাথে ভাল করে কথাও বলতে পারিনি। আজ হয়ত বেশ কিছুটা সময় আপনার সাথে কাটবে আমাদের। কিন্তু দাদা, দুটো কথা আমরা ঘর থেকে বেরোবার আগেই আপনাকে বলতে চাই”।
পরিতোষ মনে মনে একটু অবাক হলেও মুখের স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখেই বলল, “বেশ তো, বলুন না”।
রতীশ পরিতোষের হাত ধরে তাকে সামনের ঘরের সোফার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “আসুন, বসে কথা বলা যাক”।
রচনা ভেতরে ঢুকে গেল। পরিতোষকে এক সোফায় বসিয়ে রতীশ উল্টোদিকের সোফায় বসে বলল, “দাদা, আপনি মন্তির বন্ধু হলেও ওর থেকে বয়সে এবং সার্ভিসে সিনিয়র। আমি আর মন্তি প্রায় সমবয়সী। তাই বুঝতেই পারছেন আমি আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট। আর রচুর কথা নাই বা বললাম। অবশ্য রচুকে আপনি আগে থেকেই তুমি করে বলছেন। কিন্তু দাদা, আমিও কিন্তু আপনার কাছ থেকে তুমি সম্মোধনটাই শুনতে চাই”।
পরিতোষ মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, “ওকে, ব্রাদার, ডান। আর দ্বিতীয় কথাটা কি শুনি”।
রতীশ কিছু বলবার আগেই রচনা দুটো প্লেটে কিছু মিষ্টি আর খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে, আজ আপনি প্রথম আমাদের ঘরে পা রেখেছেন। তাই আপনাকে একটু মিষ্টিমুখ করতেই হবে। না বললে শুনছি না কিন্তু”।
পরিতোষ হা হা করে বলে উঠল, “বৌদি প্লীজ, এসব করতে গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি শুধু একটা মিষ্টি উঠিয়ে নিচ্ছি”।
রচনা বলল, “উহু, ওসব হবে না। আর খুব বেশী কিছু তো আমি দিই নি দাদা। মিষ্টির সাথে দুটো স্ন্যাক্স আর নিজের হাতে বানানো একটু পায়েসই তো শুধু দিয়েছি। বোন হয়ে কি এটুকুও করবার অধিকার নেই আমার শুনি”?
রচনার এমন সুমিষ্ট কথা শুনে পরিতোষ আর কোন কথা না বলে রচনার হাতে ধরা ট্রে থেকে একটা প্লেট উঠিয়ে নিয়ে গপগপ করে খেতে লাগল। তা দেখে রচনা হেসে বলল, “এমা, অত তাড়াতাড়ি খেতে হবে না। শেষে বিষম টিষম খাবেন তো। আপনি ধীরে সুস্থে খান, দাদা। আমি চা আনছি”।
পরিতোষ হাত তুলে বাধা দেবার আগেই রচনা ভেতরে ঢুকে গেল। চা না খেয়ে পরিতোষ আর এখান থেকে বেরোতে পারবে না বুঝে গেল। কিন্তু রচনার হাতের পায়েস খেয়ে তার মনে হল এমন সুস্বাদু খাবার সে বুঝি তার জীবনে আজই প্রথম খেলো। কিন্তু খাবারের প্রশংসা করে সময় নষ্ট একেবারেই করতে চাইল না সে ওই মূহুর্তে। তাই চা খাবার পর আর একটা মিনিটও দেরী না করে রচনা আর রতীশকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এল।
পেছনের সীটে রচনা আর রতীশকে বসিয়ে পরিতোষ গাড়ি ছেড়েই বলল, “রতুদা আর বৌদি, তোমরা দু’জনেই হয়ত খুব অবাক হয়েছ এভাবে তোমাদের কোথাও নিয়ে যাচ্ছি দেখে। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করতে পারো, এর পেছনে আমার কোনও বদ মতলব নেই। তবে হ্যাঁ, মতলব একটা অবশ্যই আছে। সেটা আমি এখনই তোমাদের কাছে প্রকাশ করে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। নইলে তোমরা মনে মনে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে থাকবে। তবে তারও আগে আমি আরেকটা কথা বলে নিতে চাই, নইলে কথাটা হয়ত পরে আমার মাথা থেকে বেড়িয়েই যাবে। ভাগ্যিস আমার আপত্তিতে কান না দিয়ে তুমি জোর করেই আমাকে তোমার হাতের বানানো পায়েসটুকু খাইয়ে ছিলে বৌদি। ঈশ, না খেলে সত্যি বড্ড মিস করতাম। এটা ছিল আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুস্বাদু খাবার। এত সুস্বাদু পায়েস এই প্রথম আমার কপালে জুটল আজ”।
রচনা প্রায় সাথে সাথে বলল, “এ মা, কী বলছেন দাদা আপনি? তবে, এ’কথাটা তখন বলেন নি কেন? আরো ছিল তো! আরেকটু দিতে পারতুম তো আপনাকে। ঈশ, দেখেছেন, আপনি ঘরে ঢোকবার সাথে সাথে এমন তাড়া দিলেন যে আমি আর সাহস করে দ্বিতীয়বার আপনাকে সাধতে সাহস পাইনি। তখন ভেবেছিলুম, তাতে করে আপনি হয়ত সময় নষ্ট হচ্ছে বলে বিরক্ত হবেন। ঈশ, ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা বলুন তো”?
পরিতোষ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে মাথা ঘুরিয়ে রচনা আর রতীশদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “সত্যি বৌদি, এখন আমার খুব আফসোস হচ্ছে। তবে এ পায়েস খাবার লোভেই হয়ত তোমাদের ওখানে আবার আমি ছুটে যাব কোনদিন। আর সেদিন আগে থেকে নোটিস দিয়েই যাব। একটু বেশী করে খাইও প্লীজ”। বলে হাঃ হাঃ করে হেসে দিল।
রচনা একটু অভিমানী সুরে বলল, “সে যেদিন আবার আমার ভাগ্য হবে, সেদিন হয়তো সেটা হবে। কিন্তু আজ যখন আমাদের ফিরিয়ে এনে আবার বাড়িতে নামিয়ে দেবেন, তখন কিন্তু আপনাকে আমাদের ঘরে ঢুকতেই হবে। আরেকটু পায়েস আপনাকে খেয়ে যেতেই হবে”।
পরিতোষ আবার হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে বৌদি। সেটা দেখা যাবে’খন। তবে কখন যে ফিরব, সেটা তো আমি নিজেও জানিনা। দেরী হলে প্লীজ তোমরা কেউ আমার ওপর রেগে যেও না। আসলে তোমাদের নিয়ে আমি আজ যেখানে যাচ্ছি, তারা আমাকে খুবই স্নেহ করেন। ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া আর তার স্ত্রী দীপা বড়ুয়া আমাকে যতটা স্নেহ করেন, তার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসে তাদের মেয়ে আকাঙ্ক্ষা। অসম্ভব মিষ্টি মেয়েটা। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো রতুদা, ওদের সাথে এর আগে আমার শুধু একদিনই দেখা হয়েছিল, তাও আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে। ভাইজ্যাগে। এ আড়াই বছরের মধ্যে তারা বহুবার আমাকে তাদের ওখানে যেতে বলেছেন। কিন্তু আমি কাজে এতই ব্যস্ত থাকি যে ইচ্ছে করলেও গিয়ে উঠতে পারিনি। আর ডক্টর বড়ুয়াও খুব ব্যস্ত ডাক্তার। এতদিন বাদে এই সেদিন আবার ডক্টর বড়ুয়ার সাথে আমার দেখা হয়েছে কাজের সূত্রেই। আর উনি এমন করে বললেন যে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগল। আর মন্তিও দুপুরে ফোন করে বলল যে বাড়ির লোকজনদের কথা ভেবে ভেবে বৌদির মনটাও নাকি খুব খারাপ। তাই তোমাদের দু’জনকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে। তখনই হঠাৎ মনে হল, তাহলে একসাথে দুটো কাজই আজ সেরে ফেলা যাক। ডক্টর বড়ুয়াদের সাথে দেখা করবার সাথে সাথে একসাথে তোমাদের নিয়ে একটু ঘোরাও হয়ে যাবে। মন্তির অনুরোধটাও রক্ষা করা হবে। তবে বৌদি আর রতুদা, অচেনা একজনের বাড়িতে তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি বলে তোমরা কোনও রকম মন খারাপ কোর না প্লীজ। আসলে জানো কি? আমার তো আর পৃথিবীতে নিজের বলতে কেউ নেই। তোমাদের মত, মন্তি বা নীতার মত আরও কয়েক জনকে নিজের আত্মীয় বানিয়ে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিই। আর এদের সকলের কাছে যেটুকু স্নেহ ভালবাসা আমি পাই তাতেই নিজেকে সুখী বলে ভাবতে চেষ্টা করি। এই আর কি”।
রতীশ এতক্ষণ পরে প্রথম কথা বলল, “না না দাদা, আপনি আমাদের জন্য অযথা চিন্তা করবেন না। মন্তি তো আমাকে আগেই ফোন করে বলে দিয়েছিল। তাই আমরাও মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম”।
রচনা বলল, “দাদা, একটা কথা বলব”?
পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ বৌদি, বলো না”।
রচনা একটু হেসে বলল, “বলছিলাম কি এই যে আপনি ওকে নাম ধরে আর আমাকে বৌদি বলে সম্বোধন করছেন না? এ ব্যাপারটা ঠিক জমছে না। আমি আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট। আমাকে যখনই আপনি বৌদি বলে ডাকছেন, আমার মনে হচ্ছে আমি যেন বুড়িয়ে গেছি। আপনি তো দিদিভাইয়ের বন্ধু। সম্পর্কে আমি তার বৌদি হলেও দিদিভাই শুরু থেকেই আমাকে নাম ধরেই ডাকেন। আসলে আমি তার মুখে অমন ডাক শুনতেই ভালবাসি। আপনিও যদি আমাকে অমন ভাবে নাম ধরে ডাকেন তাহলে আমার আরও বেশী ভাল লাগবে। বৌদি ডাকটা আপনার মুখে থেকে শুনতে আমার একদম ভাল লাগছে না। প্লীজ দাদা, আমি আপনার বৌদি হতে চাইনে। আপনি আমায় আপনার ছোট বোন বলে ভাবুন না” বলেই রতীশের উদ্দেশ্যে বলল, “কিগো তুমি বল না দাদাকে, উনি যেন আমাকে বৌদি বলে না ডাকেন”।
রতীশ সাথে সাথেই বলল, “হ্যাঁ দাদা, রচু কিন্তু ঠিক কথাই বলেছে। আর আমাকেও আপনি রতুদা বা রতীশদা না বলে শুধু আমার ডাক নাম ধরে রতু বলে ডাকুন, আমার সেটাই বেশী ভাল লাগবে। আসলে সত্যিই আপনি যখন ওকে বৌদি বলে ডাকছেন, তখন ডাকটা আমার কানেও শ্রুতিকটু লাগছে। আর রচু হয়তো মনে মনে নিজেকে আপনার ছোট বোনের মতই ভাবছে”।
রচনা সাথে সাথে রতীশের হাত চেপে ধরে ঈশারায় চুপ করতে বলল। তবে পরিতোষও এবার একটু হেসে বলল, “বেশ তো, তোমরা দু’জনেই যদি এটাই চাও, তাহলে তা-ই নাহয় বলব। কিন্তু আমারও তাহলে একটা আবদার আছে। মন্তি যখন তোমায় রচু সোনা বলে ডাকে তখন সত্যি বলছি ডাকটা আমার কাছে খুব মিষ্টি মনে হয়। আমিও কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে ওভাবেই ‘রচু সোনা’ বলে ডেকে ফেলতে পারি। তখন কিন্তু রাগ করতে পারবে না। অবশ্য আমার গলা তো আর মন্তির গলার কত অমন মিষ্টি নয়। আমার হেড়ে গলায় ‘রচু সোনা’ ডাকটা তোমাদের কানে বেখাপ্পা বা বিসদৃশ্য মনে হতেই পারে। কিন্তু ছুটটা কিন্তু আমাকে দিতেই হবে। নইলে আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকতে পারব না”।
রচনা খুশী হয়ে বলল, “এতে আর আমাদের অনুমতি চাইবার কি আছে দাদা। আপনার যদি সেভাবে ডাকতে ভাল লাগে, তাহলে ডাকবেন। তবে এতে লাভ তো আমারই হচ্ছে। আমরা দু’বোন এক ভাই। ভাইটা সকলের ছোট। তাই আমাদের দাদা বলে কেউ ছিল না এতদিন। আজ থেকে একটা দাদা পেয়ে গেলাম আমি”।
রতীশও খুশী মনে রচনার কথায় সায় দিতেই, রচনা আবার পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কিন্তু পরিদা? একটা কথা ভেবে কিন্তু ......” বলেই নিজের ভুল ধরতে পেরে বলল, “ঈশ, ছিঃ ছিঃ, আপনাকে আমি নাম ধরে ডেকে ......”
তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই পরিতোষ হেসে বলল, “বেশ করেছ। তোমার মুখে ‘পরিদা’ ডাক শুনে আমারও অন্য রকম লাগছে। আসলে জানো রচু, ওই একটু আগেই বললাম না যে আমার নিজের বলতে কেউ না থাকলেও অনেকেই আমাকে স্নেহ করেন, ভালবাসেন। কিন্তু তারা কেউ আমাকে পরিদা বলে ডাকে না। কেউ ‘দাদা’ বলে, কেউ ‘আঙ্কল’ বলে, কেউ ‘মামা’ বলে। কেউ কেউ ‘ভাই’ বলেও ডাকে। আর বেশীর ভাগই ‘স্যার’ বলে। আমার মনের সবচেয়ে কাছের দুটো মানুষ আমাকে পরি বলে ডাকে। কিন্তু পরিদা বলে ডাকবার কেউ নেই। তুমি যদি আমাকে সেভাবেই ডাকো তাহলে বেশী খুশী হব। আচ্ছা কি বলছিলে সেটা বলে ফ্যালো। আমরা কিন্তু আর একটু বাদেই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাব”।
______________________________