19-03-2020, 03:14 PM
(Update No. 176)
এলার্মের শব্দে পরিতোষের ঘুম ভাঙতেই সে প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। তড়িঘড়ি বাথরুমের কাজ সেরে কিচেনে গিয়ে চট করে এক কাপ চা বানিয়ে তার অগোছালো ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেই নিজের প্রাইভেট মোবাইল থেকে বিট্টুকে ফোন করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর তারপর সাড়া পেতেই বলল, “গুড মর্নিং বিট্টু, পরিতোষ হিয়ার”।
বিট্টু খুব উৎফুল্লিত স্বরে জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা গুড মর্নিং। কিন্তু কি ব্যাপার, অনেক দিন ধরে আমাদের বাড়ি আসছেন না তো”?
পরিতোষ বলল, “যাব রে যাব। আসলে এত কাজের চাপ পড়েছে না, কি বলব তোকে? আচ্ছা মাসিমার শরীর কেমন আছে রে”?
বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা, মা মোটামুটি ভালই আছেন। কালও আপনার কথা বলছিলেন যে আপনি অনেকদিন আসছেন না”।
পরিতোষ বলল, “এ সপ্তাহটা খুব বিজি আছি রে। মাসিমাকে বলিস পরের সপ্তাহে কোন একদিন অবশ্যই যাব। আচ্ছা ভাই, আমার ছোট্ট একটা কাজ করে দিবি প্লীজ”।
বিট্টু বলল, “এমন করে কেন বলছেন দাদা? বলুননা কি করতে হবে? তবে আমার তো কলেজ আছে, সে তো আপনি জানেনই”।
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “আরে সে তো জানিই। তোকে কলেজ কামাই করতে হবে না। ইন ফ্যাক্ট তোকে কোথাও যেতেও হবে না। শুধু দুটো ফোনেই কাজটা সারতে পারবি। আসলে আমি নিজে ফোনটা করতে চাইছি না। বুঝিসই তো আমাকে কত ভাবে কত কী করতে হয়”।
বিট্টু সাথে সাথে বলল, “বুঝেছি দাদা। আপনি এবার কাজের কথাটা বলুন দেখি”।
পরিতোষ বলল, “তোকে আমি এখনই ডঃ দিব্যেন্দু বড়ুয়ার কন্টাক্ট নাম্বার এসএমএস করে পাঠাচ্ছি। উনি একজন সার্জন। তুই এখনই তাকে ফোন করবি। আর তাকে বলবি এক পেশেন্টের অপারেশনের ব্যাপারে তুই তার সাথে একটু কনসাল্ট করতে চাস। কথায় কথায় জানতে চাইবি যে তার অফ ডে কবে, আর অফ ডেতে উনি বাড়িতেই থাকেন না অন্য কোথাও, সেটা জানতে হবে। আর কবে কোন সময় তার বাড়িতে তাকে পাওয়া যায়। আসলে আমি আজ বা আগামীকালের মধ্যেই তার সাথে তার বাড়িতে দেখা করতে চাই। তাই এ দু’দিনের মধ্যে ঠিক কোনসময় ওনাকে বাড়িতে পাব সেটাই আমি জানতে চাইছি। কিন্তু আমি নিজে এটা তার কাছ থেকে জানতে চাইছি না, একটু অসুবিধে আছে বলেই তোকে বলছি। এটুকু খবর নিতে পারবি না একটু বুদ্ধি করে”?
বিট্টু এক মূহুর্ত চুপ করে থেকেই বলল, “খবর তো যোগাড় করতে পারব। কিন্তু দাদা, অনেক ডাক্তারই তো ফোন কল ধরতেই চায় না। আর আমার নাম্বার তো তার কাছে আননোন। আননোন নাম্বারের কল যদি উনি রিজেক্ট না করে দেন তাহলে খবর আমি নিতে পারবই”।
পরিতোষ এবার অনুনয়ের সুরে বলল, “তুই এখনই একবার কল করে দেখ না ভাই। একবারে কল রিসিভ না করলে দু’ তিনবার ট্রাই কর। তারপরেও যদি রেসপন্স না পাস তাহলে আমাকে জানাস। আমি অন্য ব্যবস্থা করব তখন। তবে ব্যাপারটা খুব আর্জেন্ট। তাই এখনই কাজটা করিস”।
বিট্টু বলল, “ঠিক আছে দাদা, আপনি এসএমএসটা পাঠিয়ে দিন, আমি দেখছি”।
পরিতোষ আর কথা না বলে ফোন কেটে দিয়ে সাথে সাথেই ডঃ বড়ুয়ার কন্টাক্ট নাম্বারটা অভিকে এসএমএস করে দিল। তারপর তাড়াহুড়ো করে ঘরোয়া পাজামা পাঞ্জাবী পড়েই পার্সোনাল মোবাইলটা পকেটে নিয়ে সে ঘরে তালা মেরে সামনের গুমটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। সেখানে ডালপুরি দিয়ে সকালের ব্রেকফাস্ট করতে করতে বিট্টুর ফোন এল। বিট্টু বলল, “দাদা, কথা হয়েছে। প্রতি সোমবার নাকি তার অফ ডে। তাই আজ ওনার হাসপাতাল ডিউটি নেই। কায়দা করে জেনে নিয়েছি আজ সারাদিন উনি বাড়িতেই থাকবেন। অবশ্য সন্ধ্যের দিকে বৌ আর মেয়েকে নিয়ে একটু শপিংএ যাবার সম্ভাবনাও আছে, এমনটাই বললেন”।
পরিতোষ মনে মনে খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ বিট্টু। তুই সত্যি দারুণ উপকার করলি রে ভাই। আচ্ছা, নেক্সট উইক তোদের বাড়ি আসছি। এখন রাখছি কেমন? বাই”।
ফোন কেটে আরেককাপ চা খেতে খেতে ভাবল রচনাকে ফোনটা করা যাক। কিন্তু পরের মূহুর্তেই মনে হল না সেটা হয়ত ঠিক হবে না। রচনা তাকে চিনলেও এভাবে এ উদ্দেশ্য নিয়ে ফোন করলে তার অস্বস্তি হতে পারে। একবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাতটা পঞ্চান্ন। তার মানে মন্তি এখনও কোয়ার্টারেই থাকবে হয়ত। এ’কথা মনে হতেই আর এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে সে সীমন্তিনীকে ফোন করল। তিনবার রিং হতেই ও’পাশ থেকে সীমন্তিনীর সাড়া পেয়ে পরিতোষ বলল, “গুড মর্ণিং ম্যাডাম। বাড়ির বাইরে চায়ের দোকানে বসে তোমাকে ফোন করছি। বেশী লম্বা ডিসকাশনের সময় নেই। আমি যদি বৌদিকে মানে তোমার রচু সোনাকে আজ বিকেলে আমার সঙ্গে কোথাও নিয়ে যাই, তাহলে তোমার আপত্তি আছে”?
সীমন্তিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হোয়াট? তুমি রচুকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাবে... মানেটা কী”?
পরিতোষ গলায় অধৈর্যের সুর এনে বলল, “প্লীজ কোনও কাউন্টার কোয়েশ্চেন করো না। আই অ্যাম রানিং শর্ট অফ টাইম। শুধু যা জানতে চাইছি, সেটার জবাব দাও প্লীজ”।
সীমন্তিনী তবু কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকবার পর বলল, “ওকে ওকে, অবশ্যই নিয়ে যেতে পার। কিন্তু এ ব্যাপারে একটুও হিন্টস দেবে না”?
পরিতোষ সে’ কথার জবাব না দিয়ে বলল, “ওকে, দেন প্লীজ ডু মি এ ফেভার। তুমি বৌদিকে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি দুপুরের পর যে কোনও সময় তার ওখানে যাব। আর তাকে একটু তৈরী হয়ে থাকতে বোলো। তাকে বোলো যে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আর তার বৌ এবং মেয়ে আমার বৌদিটাকে মানে তোমার রচু সোনাকে দেখতে চেয়েছে বলেই আমি তাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। নাথিং সিরিয়াস,ওকে? ও হ্যাঁ, তোমার দাদাভাইকেও জানিয়ে রেখো ব্যাপারটা। ফিরে আসতে একটু রাত হতে পারে। ওনার চিন্তা হতে পারে। তাই জানিয়ে রাখা ভাল। আর বৌদি আমার সাথে যেতে রাজী আছেন কিনা বা যাবেন কি না, এটা আমাকে কনফার্ম করো অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল, বাট পজিটিভলি বিফোর নুন। আর বাকি কথা পরে হবে, ওকে”?
কথা শেষ করেই চায়ের বিল মিটিয়ে বাড়ি অভিমুখে চলল।
******************
পরিতোষ ফোন কেটে দেবার আধঘণ্টা বাদে যখন সীমন্তিনীরা তিনজনে মিলে ব্রেকফাস্ট করছিল তখনই রচনার ফোন এল, “গুড মর্নিং দিদিভাই”।
সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতার দিকে এক নজর দেখে হেসে বলল, “গুড মর্নিং, রচু সোনা” বলে ফোনটা অর্চনা আর নবনীতার দিকে এগিয়ে ধরতে তারা দু’জনেও “গুড মর্নিং রচু” আর “গুড মর্নিং বৌদি” বলতে সীমন্তিনী ফোনটা স্পীকার মোডে দিয়ে টেবিলে রেখে বলল, “সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছি বলে ফোনটা স্পীকারে রাখলুম রে। অর্চু আর নীতাও তাহলে তোর কথা শুনতে পারবে। তাই আজেবাজে বেফাঁস কিছু বলে ফেলিস না যেন। দাদাভাই নিশ্চয়ই চলে গেছেন। তুই সকালের খাবার খেয়েছিস”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, খেয়েছি। এখন চা খেতে খেতে কথা বলছি। আর তোমার দাদাভাই তো রোজকার মতই সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে গেছেন”।
সীমন্তিনী বলল, “তা খবর টবর কি? সব ঠিক ঠাক চলছে তো”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সব ঠিকই আছে। কিন্তু বাড়ির জন্যেই মনটা ক’দিন ধরে খুব টানছে গো। কতদিন দেখিনি কাউকে।”
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “কোন বাড়ির কথা বলছিস? কালচিনির”?
রচনা বলল, “কালচিনির জন্যে ভাবিনে গো দিদিভাই। কালচিনির সব দায়িত্ব তো তুমিই নিয়েছ। তাই ও বাড়ি নিয়ে আমি একদম ভাবি না। রাজগঞ্জের জন্যেই মনটা খারাপ লাগছে। বিশেষ করে মেজদাভাই, সূর্য্য চঞ্চু আর চন্দুর জন্য। অবশ্য সূর্য্য তো এখন ভূবনেশ্বরে। কিন্তু বড্ড ইচ্ছে করছে গো চন্দুটাকে একটি বার দেখতে” বলতে বলতে রচনার গলাটা ভারী হয়ে এল।
সীমন্তিনী রচনাকে আশ্বস্ত করতে বলে উঠল, “মন খারাপ করিসনে সোনা বোন আমার। এই তো আর মাত্র ক’টা দিনের ব্যাপার। সামনের মাসেই তো পূজো। তখন তো তোরা বাড়ি যাবিই”।
রচনা একটু খেদের সাথে বলল, “হ্যাঁ, যাব তো ঠিকই, কিন্তু তোমার দাদাভাই কি বলছেন জানো? উনি বলছেন সপ্তমীর দিন গিয়ে দশমীর পরের দিনই নাকি আমাদের চলে আসতে হবে। উনি নাকি তার ম্যাডামের কাছ থেকে এর বেশী ছুটি চাইতে পারবেন না। এখন তুমিই বল তো দিদিভাই, যেতে আসতেই তো দুটো দিন বরবাদ হয়ে যাবে। তার মানে ওখানে শুধু তিনটে দিন থাকতে পারব। এতে কি মন ভরে বলো তো? এতদিন বাদে গিয়ে ......”
সীমন্তিনী আবার সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তুই মন খারাপ করিস নে। আমি এ ব্যাপারে দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখব। কিন্তু তোর যখন এত খারাপ লাগে তখন বিকেলের দিকে দাদাভাইকে নিয়ে একটু ঘুরতে টুরতে তো যেতে পারিস। কলকাতায় কত জায়গা আছে ঘোরবার। একটু এদিক ওদিক গেলে মনটা তো ভাল হবে”।
রচনা বলল, “মাঝে মাঝে তো যাই দিদিভাই। এটা ওটা সংসারের জিনিস কিনতে তো বেরোই আমরা”।
সীমন্তিনী বলল, “আরে মার্কেটিং করাকে কি আর ঘোরা বলে, বোকা মেয়ে কোথাকার। বেলুর মঠ, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির এ’সব তো তোদের ওখান থেকে বেশী দুরে নয়। ও’সব জায়গায় গেলে কত ভাল লাগে। দাদাভাই তো এখন দুপুরের পর থেকে পুরো ফ্রিই থাকে। কোনকোনও দিন তো দিনের বেলার প্রেমটা স্থগিত রেখে দুটিতে মিলে ও’সব জায়গায় যেতে পারিস। দেখবি গিয়ে ....”
রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ইস দিদিভাই, তুমি কী গো? এসব কথা বলতে আছে? ছিঃ ছিঃ। দিদি, নীতাদি সবাই তো শুনছে। এ মা”।
সীমন্তিনী একবার অর্চু ও নীতার মুখের দিকে চেয়ে দেখল তারা দু’জনেই ঠোঁট টিপে আসছে। চোখের ঈশারায় তাদের চুপ করে থাকতে বলে ফোনের কাছে মুখ এনে বলল, “ঈশ, মেয়ের লজ্জা দেখ। যেন আমার শাশুড়ি মা। আরে তুই যে আমার বৌদি, বোন, বান্ধবী সবকিছু এ’কথা অর্চু আর নীতা দু’জনেই জানে। বৌদি বান্ধবীর সাথে এ’সব কথা বলব না তো কার সাথে বলব? আচ্ছা আচ্ছা, তোকে আর লজ্জা দেব না। কিন্তু আমি যেমন বলছি, তেমন একবার গিয়েই দেখ না। আমি নিশ্চিত জানি দক্ষিনেশ্বর গেলে তোর খুব ভাল লাগবে। একবার গেলে পরে বারবার যেতে চাইবি, দেখিস। এছাড়া আশে পাশে কত পার্ক টার্কও আছে। সেখানে ছোট ছোট বাচ্চারা ছাড়াও স্বামী-স্ত্রীরা, প্রেমিক প্রেমিকারা কত মজা করে গিয়ে। এই বয়সে ও’সব জায়গায় গিয়েই সবাই এনজয় করে। দাদাভাইকে নিয়ে মাঝে মাঝে যেতেই তো পারিস”।
রচনা এবার নকল রাগের ভাণ করে বলল, “ছাড়ো তো তোমার ফালতু কথা। ও’সব করবার কোন দরকার নেই আমার। আমি শুধু আমার কাছের মানুষগুলোর মুখ দেখতে পেলেই খুশী। আর কিচ্ছু চাইনে আমি”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “তুই একটা কী যে না, উঃ, তোকে আর মানুষ করতে পারলুম না আমি। আচ্ছা শোন, আজ বিকেলে বরং কোথাও ঘুরে আয়। যা মনটা ভাল লাগবে”।
রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা! আজ বিকেলে আবার কোথায় যাব”?
সীমন্তিনী বলল, “এক কাজ কর। আমি পরিতোষকে বলে দিচ্ছি। ও নাহয় তোকে কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। কিরে? যাবি তো? না কি পরিতোষের সাথে ঘুরতে যেতে তোর মনে কোন দ্বিধা আছে”?
রচনা প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “পরিতোষদা! পরিতোষদা আমায় নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়? আর উনি যে ব্যস্ত সমস্ত মানুষ, তার কি অমন সময় হবে”?
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “ও তোকে নিয়ে যাবে কিনা বা ওর সে সময় হবে কিনা বা ও চায় কিনা, সেটা ছেড়ে তুই এটা বল, তার সাথে যাবি তো? না ভয় পাচ্ছিস”?
রচনা একটু সময় কিছু একটা ভেবে বলল, “পরিতোষদার সাথে বেরোতে আমার কোন সঙ্কোচ নেই দিদিভাই। কিন্তু সত্যি করে বলো তো? তোমার কি অন্য কিছু প্ল্যান আছে? তুমি কি পরিতোষদাকে ওই ব্যাপারে কিছু বলেছ নাকি”?
সীমন্তিনী খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “দুর পাগলী, অন্য প্ল্যান আবার কি থাকবে। আর শোন, এখন ওসব আলতু ফালতু কথা বলবি নে একদম, বুঝেছিস তো? পরিকে আমি কিছুই বলিনি এখনও। তুই সারাটা দিন ঘরে একা একা বসে থাকিস। আবোল তাবোল ভাবিস, তাই বলছি। তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলে আমি এখনই পরিতোষকে বলে দেব”।
রচনা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “না গো দিদিভাই। সেটা ঠিক হবে না বোধহয়। আমি তো আজ অব্দি তোমার দাদাভাই ছাড়া অন্য কোন লোকের সাথে কোথাও বেরোইনি। তাই কেমন কেমন যেন লাগছে। আর তাছাড়া আমি একা থাকি তো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্তই। দুপুরের পর তো তোমার দাদাভাই বাড়ি এসেই পড়েন। তারপর তো আমার আর একা একা লাগে না”।
সীমন্তিনী এবার মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “আসলে হয়েছে কি জানিস, কথাটা আমি তোকে বলিনি ঠিকই। কিন্তু পরিতোষ আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে যে ওর বিশেষ পরিচিত এক ডাক্তারের পরিবারের সাথে ওর বিশেষ ঘণিষ্ঠতা আছে। ওই ডাক্তার আর তার স্ত্রীর সাথে বোধ হয় কথায় কথায় ও তোর কথা বলে ফেলেছিল কোনদিন। হয়তো তোর কিছু প্রশংসাও করেছিল। তারপর থেকেই তারা বারবার করে তোকে দেখতে চাইছেন। আর তুইও যখন আজ বলছিস যে ঘরে মন টিকছে না, তাই ভাবলুম পরির সাথে ওই ডাক্তারদের ওখানেই না হয় একটু ঘুরে আয়। তাতে তোরও যেমন সময়টা ভাল কাটবে, তেমনি পরিতোষও খুশী হবে। তুই বোধহয় জানিস না, তোকে দেখার পর থেকে পরি তোকে মুখে বৌদি বলে ডাকলেও আসলে ও তোকে নিজের বোন বলে ভাবতে শুরু করেছে। আমার সাথে যখনই ওর কথা হয় তখন তোর ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবেই নেবে। তাই বলছিলাম”।
রচনা এবারেও দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, “পরিতোষদা তো সত্যি খুব ভাল মানুষ দিদিভাই। প্রথম দিন দেখার পর থেকেই তাকে আমিও মনে মনে শ্রদ্ধা করি। তার জীবনটা সুখের হোক, এ প্রার্থণা আমি রোজই ঠাকুরের কাছে করি। কিন্তু দিদিভাই তোমার দাদাভাইকে ছাড়া আমি একা কখনই তার সাথে কোথাও গিয়ে অপরিচিত কোন ফ্যামিলির সাথে পরিচিত হতে চাই নে গো। তুমি প্লীজ, আমাকে ভুল বুঝো না। পরিতোষদা আমাদের বাড়ি এলে আমি খুশীই হব। প্রয়োজনে তুমি বললে আমি তার সাথেও কোথাও দেখা করতে পারি। কিন্তু অন্য কারুর সাথে নতুন করে পরিচিত হবার জন্যে আমি একা তার সাথে যেতে চাইনে গো”।
সীমন্তিনী রচনার চিন্তাধারা বুঝতে পেরে মনে মনে খুব খুশী হয়ে বলল, “এই না হলে তুই আমার বোন? সত্যি আমি তোকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্ক্স না দিয়ে পারছি না। আমি তো তোকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম রে পাগলী। আমার বোনটা কলকাতা শহরের হাওয়া খেয়ে কতখানি পাল্টাল সেটাই দেখছিলাম”।
রচনা এবার আরও অভিমানী গলায় বলল, “আমাকে বাজিয়ে দেখতে গেলে কোনদিন তোমায় কোন ছল চাতুরীর সাহায্য নেবার দরকার নেই দিদিভাই। তুমি স্পষ্ট করে জানতে চেও। আমি এতদিন যেমন করেছি ঠিক তেমনি করে স্পষ্ট ভাষায় তোমার কথার সত্যি জবাব দেব”।
এবার সীমন্তিনী কিছু বলবার আগেই অর্চনা আর থাকতে না পেরে বলল, “একদম ঠিক বলেছিস রচু। কাছে থাকলে আমি এখন তোকে খুব করে আদর করতুম রে। দিদিভাই তো বুঝবেন না যে তিনি আমাদের কাছে কী। দিদিভাই যে একটা বট গাছ। আর আমরা সবাই যে পরগাছার মত তাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি, এটা তিনি হয়ত কোনদিনই মানতে বা বুঝতে চাইবেন না। কিন্তু তুই, আমি আমাদের মা-বাবা ভাই .........”
সীমন্তিনী অর্চনার মুখে হাত চেপে ধরে ফোনে বলল, “হয়েছে হয়েছে আর ইমোশনাল ড্রামা করতে হবে না আমার বোন দুটোকে। এই শোন রচু, আমি সত্যি বলছি, অফিসে গিয়ে আমি দাদাভাইকে বলে দেব। তুই আর দাদাভাই দু’জনেই পরিতোষের সাথে বেড়াতে যাবি আজ বিকেলে। আমি পরিতোষকেও সে’কথা বলে দেব। তোরা সেইমত তৈরী থাকিস। রাখছি, বাই” বলেই ফোন কেটে দিল।
ততক্ষণে সবারই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সীমন্তিনী নিজের ঘরে ঢুকে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্তু খানিক বাদেই অর্চনা আর নবনীতা তার ঘরে এল। অর্চনা সীমন্তিনীর পাশে দাঁড়িয়ে তার একটা হাত হাতে নিয়ে বলল, “ও দিদিভাই, একটু খুলে বলো না ব্যাপারটা কি। পরিতোষদার সাথে তুমি রচু আর রতুদাকে এভাবে কোথায় পাঠাতে চাইছ গো”?
সীমন্তিনী নিজের লম্বা চুলগুলোকে ভালমত খোঁপা করে বেঁধে অর্চনাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “এ আরেক পাগলীকে নিয়ে পড়েছি আমি। আরে বাবা, রচুর বা তোদের কারো কোন অসুবিধে হোক এমন কিছু কি আমি, নীতা, লক্ষ্মীদি বা পরি কেউ করতে পারি? কিন্তু তোর যখন মনে কিছু আশঙ্কা হচ্ছেই তাহলে বলি শোন। পরিতোষ সত্যি ওদের আজ এক জায়গায় নিয়ে যাবে। তবে তার উদ্দেশ্যটা কী, সেটা আমাকেও খুলে বলেনি। তবে ওর ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে দাদাভাই আর রচুকে ও সব সময় নিরাপদেই রাখবে। তবে আমার মনে হয় ওই বিমল আগরওয়ালার ব্যাপারে পরি যা কিছু প্ল্যান করছে, এটা তারই একটা অঙ্গ। তবে, তোরা কেউ একদম দুশ্চিন্তা করিস না। পরে একসময় আমরা ঠিকই জানতে পারব পরি এটা কেন করছে। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাক, রচু বা দাদাভাইয়ের কোন কিছু হবে না। এবার বুঝেছিস তো? আমি যদি রচুকে বলতাম যে পরি ওদের এক জায়গায় কোন একটা উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে চাইছে, তাহলে ওদের মনে একটা সন্দেহ দেখা দেবে না? আমরা তো বিমল আগরওয়ালাকে নিয়ে যা কিছু প্ল্যান করছি, তা তো ওদের কাছে গোপন রেখেছি। তাই এ ব্যাপারটাও আমাকে এভাবে সারতে হল। পরিতোষ যদি সরাসরি দাদাভাই বা রচুকে বলত ওর সাথে যেতে তাহলেও ওদের মনে কোন না কোন সংশয় হতই। তাই পরি আমাকে দায়িত্বটা দিয়েছে রচু আর দাদাভাইকে রাজি করাবার। আমার এটাই মনে হচ্ছে। তুই এ ব্যাপারে একেবারে দুশ্চিন্তা করিসনে বোন”।
বলে নবনীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “নীতা, তুই এ পাগলিটাকে সামলা। আমি বেরোচ্ছি” বলে দাঁড়িয়ে অর্চুর চিবুকটা নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আর মন খারাপ করে থাকিস না বোন। আমি বেরোচ্ছি। তুই কিন্তু একদম টেনশন নিস না প্লীজ, আমি আসছি হ্যাঁ”?
অর্চনা জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলে মাথা নাড়ল।
______________________________
এলার্মের শব্দে পরিতোষের ঘুম ভাঙতেই সে প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। তড়িঘড়ি বাথরুমের কাজ সেরে কিচেনে গিয়ে চট করে এক কাপ চা বানিয়ে তার অগোছালো ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেই নিজের প্রাইভেট মোবাইল থেকে বিট্টুকে ফোন করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর তারপর সাড়া পেতেই বলল, “গুড মর্নিং বিট্টু, পরিতোষ হিয়ার”।
বিট্টু খুব উৎফুল্লিত স্বরে জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা গুড মর্নিং। কিন্তু কি ব্যাপার, অনেক দিন ধরে আমাদের বাড়ি আসছেন না তো”?
পরিতোষ বলল, “যাব রে যাব। আসলে এত কাজের চাপ পড়েছে না, কি বলব তোকে? আচ্ছা মাসিমার শরীর কেমন আছে রে”?
বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা, মা মোটামুটি ভালই আছেন। কালও আপনার কথা বলছিলেন যে আপনি অনেকদিন আসছেন না”।
পরিতোষ বলল, “এ সপ্তাহটা খুব বিজি আছি রে। মাসিমাকে বলিস পরের সপ্তাহে কোন একদিন অবশ্যই যাব। আচ্ছা ভাই, আমার ছোট্ট একটা কাজ করে দিবি প্লীজ”।
বিট্টু বলল, “এমন করে কেন বলছেন দাদা? বলুননা কি করতে হবে? তবে আমার তো কলেজ আছে, সে তো আপনি জানেনই”।
পরিতোষ একটু হেসে বলল, “আরে সে তো জানিই। তোকে কলেজ কামাই করতে হবে না। ইন ফ্যাক্ট তোকে কোথাও যেতেও হবে না। শুধু দুটো ফোনেই কাজটা সারতে পারবি। আসলে আমি নিজে ফোনটা করতে চাইছি না। বুঝিসই তো আমাকে কত ভাবে কত কী করতে হয়”।
বিট্টু সাথে সাথে বলল, “বুঝেছি দাদা। আপনি এবার কাজের কথাটা বলুন দেখি”।
পরিতোষ বলল, “তোকে আমি এখনই ডঃ দিব্যেন্দু বড়ুয়ার কন্টাক্ট নাম্বার এসএমএস করে পাঠাচ্ছি। উনি একজন সার্জন। তুই এখনই তাকে ফোন করবি। আর তাকে বলবি এক পেশেন্টের অপারেশনের ব্যাপারে তুই তার সাথে একটু কনসাল্ট করতে চাস। কথায় কথায় জানতে চাইবি যে তার অফ ডে কবে, আর অফ ডেতে উনি বাড়িতেই থাকেন না অন্য কোথাও, সেটা জানতে হবে। আর কবে কোন সময় তার বাড়িতে তাকে পাওয়া যায়। আসলে আমি আজ বা আগামীকালের মধ্যেই তার সাথে তার বাড়িতে দেখা করতে চাই। তাই এ দু’দিনের মধ্যে ঠিক কোনসময় ওনাকে বাড়িতে পাব সেটাই আমি জানতে চাইছি। কিন্তু আমি নিজে এটা তার কাছ থেকে জানতে চাইছি না, একটু অসুবিধে আছে বলেই তোকে বলছি। এটুকু খবর নিতে পারবি না একটু বুদ্ধি করে”?
বিট্টু এক মূহুর্ত চুপ করে থেকেই বলল, “খবর তো যোগাড় করতে পারব। কিন্তু দাদা, অনেক ডাক্তারই তো ফোন কল ধরতেই চায় না। আর আমার নাম্বার তো তার কাছে আননোন। আননোন নাম্বারের কল যদি উনি রিজেক্ট না করে দেন তাহলে খবর আমি নিতে পারবই”।
পরিতোষ এবার অনুনয়ের সুরে বলল, “তুই এখনই একবার কল করে দেখ না ভাই। একবারে কল রিসিভ না করলে দু’ তিনবার ট্রাই কর। তারপরেও যদি রেসপন্স না পাস তাহলে আমাকে জানাস। আমি অন্য ব্যবস্থা করব তখন। তবে ব্যাপারটা খুব আর্জেন্ট। তাই এখনই কাজটা করিস”।
বিট্টু বলল, “ঠিক আছে দাদা, আপনি এসএমএসটা পাঠিয়ে দিন, আমি দেখছি”।
পরিতোষ আর কথা না বলে ফোন কেটে দিয়ে সাথে সাথেই ডঃ বড়ুয়ার কন্টাক্ট নাম্বারটা অভিকে এসএমএস করে দিল। তারপর তাড়াহুড়ো করে ঘরোয়া পাজামা পাঞ্জাবী পড়েই পার্সোনাল মোবাইলটা পকেটে নিয়ে সে ঘরে তালা মেরে সামনের গুমটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। সেখানে ডালপুরি দিয়ে সকালের ব্রেকফাস্ট করতে করতে বিট্টুর ফোন এল। বিট্টু বলল, “দাদা, কথা হয়েছে। প্রতি সোমবার নাকি তার অফ ডে। তাই আজ ওনার হাসপাতাল ডিউটি নেই। কায়দা করে জেনে নিয়েছি আজ সারাদিন উনি বাড়িতেই থাকবেন। অবশ্য সন্ধ্যের দিকে বৌ আর মেয়েকে নিয়ে একটু শপিংএ যাবার সম্ভাবনাও আছে, এমনটাই বললেন”।
পরিতোষ মনে মনে খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ বিট্টু। তুই সত্যি দারুণ উপকার করলি রে ভাই। আচ্ছা, নেক্সট উইক তোদের বাড়ি আসছি। এখন রাখছি কেমন? বাই”।
ফোন কেটে আরেককাপ চা খেতে খেতে ভাবল রচনাকে ফোনটা করা যাক। কিন্তু পরের মূহুর্তেই মনে হল না সেটা হয়ত ঠিক হবে না। রচনা তাকে চিনলেও এভাবে এ উদ্দেশ্য নিয়ে ফোন করলে তার অস্বস্তি হতে পারে। একবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাতটা পঞ্চান্ন। তার মানে মন্তি এখনও কোয়ার্টারেই থাকবে হয়ত। এ’কথা মনে হতেই আর এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে সে সীমন্তিনীকে ফোন করল। তিনবার রিং হতেই ও’পাশ থেকে সীমন্তিনীর সাড়া পেয়ে পরিতোষ বলল, “গুড মর্ণিং ম্যাডাম। বাড়ির বাইরে চায়ের দোকানে বসে তোমাকে ফোন করছি। বেশী লম্বা ডিসকাশনের সময় নেই। আমি যদি বৌদিকে মানে তোমার রচু সোনাকে আজ বিকেলে আমার সঙ্গে কোথাও নিয়ে যাই, তাহলে তোমার আপত্তি আছে”?
সীমন্তিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হোয়াট? তুমি রচুকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাবে... মানেটা কী”?
পরিতোষ গলায় অধৈর্যের সুর এনে বলল, “প্লীজ কোনও কাউন্টার কোয়েশ্চেন করো না। আই অ্যাম রানিং শর্ট অফ টাইম। শুধু যা জানতে চাইছি, সেটার জবাব দাও প্লীজ”।
সীমন্তিনী তবু কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকবার পর বলল, “ওকে ওকে, অবশ্যই নিয়ে যেতে পার। কিন্তু এ ব্যাপারে একটুও হিন্টস দেবে না”?
পরিতোষ সে’ কথার জবাব না দিয়ে বলল, “ওকে, দেন প্লীজ ডু মি এ ফেভার। তুমি বৌদিকে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি দুপুরের পর যে কোনও সময় তার ওখানে যাব। আর তাকে একটু তৈরী হয়ে থাকতে বোলো। তাকে বোলো যে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আর তার বৌ এবং মেয়ে আমার বৌদিটাকে মানে তোমার রচু সোনাকে দেখতে চেয়েছে বলেই আমি তাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। নাথিং সিরিয়াস,ওকে? ও হ্যাঁ, তোমার দাদাভাইকেও জানিয়ে রেখো ব্যাপারটা। ফিরে আসতে একটু রাত হতে পারে। ওনার চিন্তা হতে পারে। তাই জানিয়ে রাখা ভাল। আর বৌদি আমার সাথে যেতে রাজী আছেন কিনা বা যাবেন কি না, এটা আমাকে কনফার্ম করো অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল, বাট পজিটিভলি বিফোর নুন। আর বাকি কথা পরে হবে, ওকে”?
কথা শেষ করেই চায়ের বিল মিটিয়ে বাড়ি অভিমুখে চলল।
******************
পরিতোষ ফোন কেটে দেবার আধঘণ্টা বাদে যখন সীমন্তিনীরা তিনজনে মিলে ব্রেকফাস্ট করছিল তখনই রচনার ফোন এল, “গুড মর্নিং দিদিভাই”।
সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতার দিকে এক নজর দেখে হেসে বলল, “গুড মর্নিং, রচু সোনা” বলে ফোনটা অর্চনা আর নবনীতার দিকে এগিয়ে ধরতে তারা দু’জনেও “গুড মর্নিং রচু” আর “গুড মর্নিং বৌদি” বলতে সীমন্তিনী ফোনটা স্পীকার মোডে দিয়ে টেবিলে রেখে বলল, “সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছি বলে ফোনটা স্পীকারে রাখলুম রে। অর্চু আর নীতাও তাহলে তোর কথা শুনতে পারবে। তাই আজেবাজে বেফাঁস কিছু বলে ফেলিস না যেন। দাদাভাই নিশ্চয়ই চলে গেছেন। তুই সকালের খাবার খেয়েছিস”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, খেয়েছি। এখন চা খেতে খেতে কথা বলছি। আর তোমার দাদাভাই তো রোজকার মতই সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে গেছেন”।
সীমন্তিনী বলল, “তা খবর টবর কি? সব ঠিক ঠাক চলছে তো”?
রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সব ঠিকই আছে। কিন্তু বাড়ির জন্যেই মনটা ক’দিন ধরে খুব টানছে গো। কতদিন দেখিনি কাউকে।”
সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “কোন বাড়ির কথা বলছিস? কালচিনির”?
রচনা বলল, “কালচিনির জন্যে ভাবিনে গো দিদিভাই। কালচিনির সব দায়িত্ব তো তুমিই নিয়েছ। তাই ও বাড়ি নিয়ে আমি একদম ভাবি না। রাজগঞ্জের জন্যেই মনটা খারাপ লাগছে। বিশেষ করে মেজদাভাই, সূর্য্য চঞ্চু আর চন্দুর জন্য। অবশ্য সূর্য্য তো এখন ভূবনেশ্বরে। কিন্তু বড্ড ইচ্ছে করছে গো চন্দুটাকে একটি বার দেখতে” বলতে বলতে রচনার গলাটা ভারী হয়ে এল।
সীমন্তিনী রচনাকে আশ্বস্ত করতে বলে উঠল, “মন খারাপ করিসনে সোনা বোন আমার। এই তো আর মাত্র ক’টা দিনের ব্যাপার। সামনের মাসেই তো পূজো। তখন তো তোরা বাড়ি যাবিই”।
রচনা একটু খেদের সাথে বলল, “হ্যাঁ, যাব তো ঠিকই, কিন্তু তোমার দাদাভাই কি বলছেন জানো? উনি বলছেন সপ্তমীর দিন গিয়ে দশমীর পরের দিনই নাকি আমাদের চলে আসতে হবে। উনি নাকি তার ম্যাডামের কাছ থেকে এর বেশী ছুটি চাইতে পারবেন না। এখন তুমিই বল তো দিদিভাই, যেতে আসতেই তো দুটো দিন বরবাদ হয়ে যাবে। তার মানে ওখানে শুধু তিনটে দিন থাকতে পারব। এতে কি মন ভরে বলো তো? এতদিন বাদে গিয়ে ......”
সীমন্তিনী আবার সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তুই মন খারাপ করিস নে। আমি এ ব্যাপারে দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখব। কিন্তু তোর যখন এত খারাপ লাগে তখন বিকেলের দিকে দাদাভাইকে নিয়ে একটু ঘুরতে টুরতে তো যেতে পারিস। কলকাতায় কত জায়গা আছে ঘোরবার। একটু এদিক ওদিক গেলে মনটা তো ভাল হবে”।
রচনা বলল, “মাঝে মাঝে তো যাই দিদিভাই। এটা ওটা সংসারের জিনিস কিনতে তো বেরোই আমরা”।
সীমন্তিনী বলল, “আরে মার্কেটিং করাকে কি আর ঘোরা বলে, বোকা মেয়ে কোথাকার। বেলুর মঠ, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির এ’সব তো তোদের ওখান থেকে বেশী দুরে নয়। ও’সব জায়গায় গেলে কত ভাল লাগে। দাদাভাই তো এখন দুপুরের পর থেকে পুরো ফ্রিই থাকে। কোনকোনও দিন তো দিনের বেলার প্রেমটা স্থগিত রেখে দুটিতে মিলে ও’সব জায়গায় যেতে পারিস। দেখবি গিয়ে ....”
রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ইস দিদিভাই, তুমি কী গো? এসব কথা বলতে আছে? ছিঃ ছিঃ। দিদি, নীতাদি সবাই তো শুনছে। এ মা”।
সীমন্তিনী একবার অর্চু ও নীতার মুখের দিকে চেয়ে দেখল তারা দু’জনেই ঠোঁট টিপে আসছে। চোখের ঈশারায় তাদের চুপ করে থাকতে বলে ফোনের কাছে মুখ এনে বলল, “ঈশ, মেয়ের লজ্জা দেখ। যেন আমার শাশুড়ি মা। আরে তুই যে আমার বৌদি, বোন, বান্ধবী সবকিছু এ’কথা অর্চু আর নীতা দু’জনেই জানে। বৌদি বান্ধবীর সাথে এ’সব কথা বলব না তো কার সাথে বলব? আচ্ছা আচ্ছা, তোকে আর লজ্জা দেব না। কিন্তু আমি যেমন বলছি, তেমন একবার গিয়েই দেখ না। আমি নিশ্চিত জানি দক্ষিনেশ্বর গেলে তোর খুব ভাল লাগবে। একবার গেলে পরে বারবার যেতে চাইবি, দেখিস। এছাড়া আশে পাশে কত পার্ক টার্কও আছে। সেখানে ছোট ছোট বাচ্চারা ছাড়াও স্বামী-স্ত্রীরা, প্রেমিক প্রেমিকারা কত মজা করে গিয়ে। এই বয়সে ও’সব জায়গায় গিয়েই সবাই এনজয় করে। দাদাভাইকে নিয়ে মাঝে মাঝে যেতেই তো পারিস”।
রচনা এবার নকল রাগের ভাণ করে বলল, “ছাড়ো তো তোমার ফালতু কথা। ও’সব করবার কোন দরকার নেই আমার। আমি শুধু আমার কাছের মানুষগুলোর মুখ দেখতে পেলেই খুশী। আর কিচ্ছু চাইনে আমি”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “তুই একটা কী যে না, উঃ, তোকে আর মানুষ করতে পারলুম না আমি। আচ্ছা শোন, আজ বিকেলে বরং কোথাও ঘুরে আয়। যা মনটা ভাল লাগবে”।
রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা! আজ বিকেলে আবার কোথায় যাব”?
সীমন্তিনী বলল, “এক কাজ কর। আমি পরিতোষকে বলে দিচ্ছি। ও নাহয় তোকে কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। কিরে? যাবি তো? না কি পরিতোষের সাথে ঘুরতে যেতে তোর মনে কোন দ্বিধা আছে”?
রচনা প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “পরিতোষদা! পরিতোষদা আমায় নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়? আর উনি যে ব্যস্ত সমস্ত মানুষ, তার কি অমন সময় হবে”?
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “ও তোকে নিয়ে যাবে কিনা বা ওর সে সময় হবে কিনা বা ও চায় কিনা, সেটা ছেড়ে তুই এটা বল, তার সাথে যাবি তো? না ভয় পাচ্ছিস”?
রচনা একটু সময় কিছু একটা ভেবে বলল, “পরিতোষদার সাথে বেরোতে আমার কোন সঙ্কোচ নেই দিদিভাই। কিন্তু সত্যি করে বলো তো? তোমার কি অন্য কিছু প্ল্যান আছে? তুমি কি পরিতোষদাকে ওই ব্যাপারে কিছু বলেছ নাকি”?
সীমন্তিনী খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “দুর পাগলী, অন্য প্ল্যান আবার কি থাকবে। আর শোন, এখন ওসব আলতু ফালতু কথা বলবি নে একদম, বুঝেছিস তো? পরিকে আমি কিছুই বলিনি এখনও। তুই সারাটা দিন ঘরে একা একা বসে থাকিস। আবোল তাবোল ভাবিস, তাই বলছি। তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলে আমি এখনই পরিতোষকে বলে দেব”।
রচনা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “না গো দিদিভাই। সেটা ঠিক হবে না বোধহয়। আমি তো আজ অব্দি তোমার দাদাভাই ছাড়া অন্য কোন লোকের সাথে কোথাও বেরোইনি। তাই কেমন কেমন যেন লাগছে। আর তাছাড়া আমি একা থাকি তো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্তই। দুপুরের পর তো তোমার দাদাভাই বাড়ি এসেই পড়েন। তারপর তো আমার আর একা একা লাগে না”।
সীমন্তিনী এবার মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “আসলে হয়েছে কি জানিস, কথাটা আমি তোকে বলিনি ঠিকই। কিন্তু পরিতোষ আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে যে ওর বিশেষ পরিচিত এক ডাক্তারের পরিবারের সাথে ওর বিশেষ ঘণিষ্ঠতা আছে। ওই ডাক্তার আর তার স্ত্রীর সাথে বোধ হয় কথায় কথায় ও তোর কথা বলে ফেলেছিল কোনদিন। হয়তো তোর কিছু প্রশংসাও করেছিল। তারপর থেকেই তারা বারবার করে তোকে দেখতে চাইছেন। আর তুইও যখন আজ বলছিস যে ঘরে মন টিকছে না, তাই ভাবলুম পরির সাথে ওই ডাক্তারদের ওখানেই না হয় একটু ঘুরে আয়। তাতে তোরও যেমন সময়টা ভাল কাটবে, তেমনি পরিতোষও খুশী হবে। তুই বোধহয় জানিস না, তোকে দেখার পর থেকে পরি তোকে মুখে বৌদি বলে ডাকলেও আসলে ও তোকে নিজের বোন বলে ভাবতে শুরু করেছে। আমার সাথে যখনই ওর কথা হয় তখন তোর ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবেই নেবে। তাই বলছিলাম”।
রচনা এবারেও দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, “পরিতোষদা তো সত্যি খুব ভাল মানুষ দিদিভাই। প্রথম দিন দেখার পর থেকেই তাকে আমিও মনে মনে শ্রদ্ধা করি। তার জীবনটা সুখের হোক, এ প্রার্থণা আমি রোজই ঠাকুরের কাছে করি। কিন্তু দিদিভাই তোমার দাদাভাইকে ছাড়া আমি একা কখনই তার সাথে কোথাও গিয়ে অপরিচিত কোন ফ্যামিলির সাথে পরিচিত হতে চাই নে গো। তুমি প্লীজ, আমাকে ভুল বুঝো না। পরিতোষদা আমাদের বাড়ি এলে আমি খুশীই হব। প্রয়োজনে তুমি বললে আমি তার সাথেও কোথাও দেখা করতে পারি। কিন্তু অন্য কারুর সাথে নতুন করে পরিচিত হবার জন্যে আমি একা তার সাথে যেতে চাইনে গো”।
সীমন্তিনী রচনার চিন্তাধারা বুঝতে পেরে মনে মনে খুব খুশী হয়ে বলল, “এই না হলে তুই আমার বোন? সত্যি আমি তোকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্ক্স না দিয়ে পারছি না। আমি তো তোকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম রে পাগলী। আমার বোনটা কলকাতা শহরের হাওয়া খেয়ে কতখানি পাল্টাল সেটাই দেখছিলাম”।
রচনা এবার আরও অভিমানী গলায় বলল, “আমাকে বাজিয়ে দেখতে গেলে কোনদিন তোমায় কোন ছল চাতুরীর সাহায্য নেবার দরকার নেই দিদিভাই। তুমি স্পষ্ট করে জানতে চেও। আমি এতদিন যেমন করেছি ঠিক তেমনি করে স্পষ্ট ভাষায় তোমার কথার সত্যি জবাব দেব”।
এবার সীমন্তিনী কিছু বলবার আগেই অর্চনা আর থাকতে না পেরে বলল, “একদম ঠিক বলেছিস রচু। কাছে থাকলে আমি এখন তোকে খুব করে আদর করতুম রে। দিদিভাই তো বুঝবেন না যে তিনি আমাদের কাছে কী। দিদিভাই যে একটা বট গাছ। আর আমরা সবাই যে পরগাছার মত তাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি, এটা তিনি হয়ত কোনদিনই মানতে বা বুঝতে চাইবেন না। কিন্তু তুই, আমি আমাদের মা-বাবা ভাই .........”
সীমন্তিনী অর্চনার মুখে হাত চেপে ধরে ফোনে বলল, “হয়েছে হয়েছে আর ইমোশনাল ড্রামা করতে হবে না আমার বোন দুটোকে। এই শোন রচু, আমি সত্যি বলছি, অফিসে গিয়ে আমি দাদাভাইকে বলে দেব। তুই আর দাদাভাই দু’জনেই পরিতোষের সাথে বেড়াতে যাবি আজ বিকেলে। আমি পরিতোষকেও সে’কথা বলে দেব। তোরা সেইমত তৈরী থাকিস। রাখছি, বাই” বলেই ফোন কেটে দিল।
ততক্ষণে সবারই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সীমন্তিনী নিজের ঘরে ঢুকে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্তু খানিক বাদেই অর্চনা আর নবনীতা তার ঘরে এল। অর্চনা সীমন্তিনীর পাশে দাঁড়িয়ে তার একটা হাত হাতে নিয়ে বলল, “ও দিদিভাই, একটু খুলে বলো না ব্যাপারটা কি। পরিতোষদার সাথে তুমি রচু আর রতুদাকে এভাবে কোথায় পাঠাতে চাইছ গো”?
সীমন্তিনী নিজের লম্বা চুলগুলোকে ভালমত খোঁপা করে বেঁধে অর্চনাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “এ আরেক পাগলীকে নিয়ে পড়েছি আমি। আরে বাবা, রচুর বা তোদের কারো কোন অসুবিধে হোক এমন কিছু কি আমি, নীতা, লক্ষ্মীদি বা পরি কেউ করতে পারি? কিন্তু তোর যখন মনে কিছু আশঙ্কা হচ্ছেই তাহলে বলি শোন। পরিতোষ সত্যি ওদের আজ এক জায়গায় নিয়ে যাবে। তবে তার উদ্দেশ্যটা কী, সেটা আমাকেও খুলে বলেনি। তবে ওর ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে দাদাভাই আর রচুকে ও সব সময় নিরাপদেই রাখবে। তবে আমার মনে হয় ওই বিমল আগরওয়ালার ব্যাপারে পরি যা কিছু প্ল্যান করছে, এটা তারই একটা অঙ্গ। তবে, তোরা কেউ একদম দুশ্চিন্তা করিস না। পরে একসময় আমরা ঠিকই জানতে পারব পরি এটা কেন করছে। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাক, রচু বা দাদাভাইয়ের কোন কিছু হবে না। এবার বুঝেছিস তো? আমি যদি রচুকে বলতাম যে পরি ওদের এক জায়গায় কোন একটা উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে চাইছে, তাহলে ওদের মনে একটা সন্দেহ দেখা দেবে না? আমরা তো বিমল আগরওয়ালাকে নিয়ে যা কিছু প্ল্যান করছি, তা তো ওদের কাছে গোপন রেখেছি। তাই এ ব্যাপারটাও আমাকে এভাবে সারতে হল। পরিতোষ যদি সরাসরি দাদাভাই বা রচুকে বলত ওর সাথে যেতে তাহলেও ওদের মনে কোন না কোন সংশয় হতই। তাই পরি আমাকে দায়িত্বটা দিয়েছে রচু আর দাদাভাইকে রাজি করাবার। আমার এটাই মনে হচ্ছে। তুই এ ব্যাপারে একেবারে দুশ্চিন্তা করিসনে বোন”।
বলে নবনীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “নীতা, তুই এ পাগলিটাকে সামলা। আমি বেরোচ্ছি” বলে দাঁড়িয়ে অর্চুর চিবুকটা নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আর মন খারাপ করে থাকিস না বোন। আমি বেরোচ্ছি। তুই কিন্তু একদম টেনশন নিস না প্লীজ, আমি আসছি হ্যাঁ”?
অর্চনা জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলে মাথা নাড়ল।
______________________________