19-03-2020, 03:12 PM
(Update No. 172)
বিধুবাবু সীমন্তিনীর কথার কোন জবাব দেবার আগেই কিংশুকের সাথে বিভাদেবী জলের গ্লাস হাতে ঘরে ঢুকে বললেন, “তুই কি ভাবছিস মন্তি, আমরা কেউ তোর কথা অমান্যি করতে পারি” বলে বিধুবাবুর মুখের কাছে জলের গ্লাসটা তুলে ধরে বলল, “নাও তো, একটুখানি জল খেয়ে নাও”।
বিধুবাবু দু’ঢোক জল খেয়ে নিতে বিভাদেবী শাড়ির খুট দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে মমতাভরা গলায় বললেন, “ভগবানের অশেষ করুণাতেই তো আমরা এ মেয়েটাকে পেয়েছি। এবার শান্ত হয়ে ওকে তোমার মতামতটা জানাও। ও তো আবার থানাতেও যাবে বলছে। তাই ওকে আর খুব বেশীক্ষণ আটকে রাখা ঠিক হবে না। আরও কতটা পথ তো ওকে যেতে হবে”।
বিধুবাবু তার স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে চেয়ে বললেন, “আর বলার কি কিছু আছে গো? তুমি কি এতদিনেও এ মেয়েটাকে চিনতে পারলে না? ও সমস্ত আটঘাট বেঁধে সবকিছু মনে মনে সাজিয়ে নিয়েই তবে আজ ওর সিদ্ধান্তে শেষ শিলমোহরটা পড়াবে বলেই এসেছে। ভুলে গেছ? রচুর বিয়ের এক দেড় বছর আগে থেকে এ বাড়ি এসে ও কিভাবে আমাদের সবাইকে বশ করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিল? কাউকে কিচ্ছুটি বলার অবকাশ ও দিয়েছিল? আমাদের সঙ্গে যে বেয়াই মশাইদের পরিবারের মত অমন একটা সম্ভ্রান্ত এবং ভাল পরিবারের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেটা তো ওর জন্যেই। রচু তো সুখে আছে। ওকে ওর স্বামী আর শ্বশুর বাড়ির সকলেই খুব ভালবাসে। এর বেশী কিছু কি আমরা চেয়েছি কখনও? যতটুকু পেয়েছি সেটুকুও যে স্বপ্নাতীত। আজও আবার হয়ত সে’রকমেরই কোন ঘটণার অবতারনা হতে চলেছে। আজও আমাদের মুখ ফুটে কোন কথা বলার অবকাশ নেই। কিন্তু মন্তি মা, তুমি তো রচুর বিয়ের পর পরই হায়দ্রাবাদে গিয়েছিলে। আর তুমি বলছ সেখানে গিয়েই এ ছেলেটার সাথে তোমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছে। তার মানে মা, আমি কি ধরে নিতে পারি যে তোমাদের ভেতরের এই বন্ধুত্বটা গত তিন বছর ধরেই অক্ষুণ্ণ অটুট আছে”?
সীমন্তিনী বিধুবাবুর একটা হাত নিজের হাতে ধরে রেখেই মিষ্টি হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ মেসো। তুমি একদম ঠিক বলেছ। হায়দ্রাবাদের ট্রেনিং শেষ হয়ে যাবার পর কর্মসুত্রে আমরা আলাদা আলাদা জায়গায় আছি ঠিকই। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এতে কমজোড় তো হয়ই নি। বরং দাদাভাই আর রচু কলকাতা যাবার পর আমাদের দু’জনের বন্ধুত্বটা আরও সুদৃঢ় হচ্ছে দিনে দিনে। তাই তো ওর সম্পর্কে আমি জোর দিয়ে এসব কথা বলতে পারছি নিশ্চিন্তে। আমি ওর ব্যাপারে যা যা তোমাদের বললাম তা একটুও বাড়িয়ে বলিনি কিন্তু মেসো”।
বিভাদেবী উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে, তার মানে রচু রতু ওরাও কি ছেলেটাকে চেনে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যাঁ মাসি, চেনে। তবে আগে থেকে ওরা ওকে চিনত না। আগেরবার যখন আমি কলকাতা গিয়েছিলুম, মানে যখন আমি নীতাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছিলুম তখন পরিতোষের সাথে রচুর আর দাদাভাইয়ের পরিচয় হয়েছে। তবে দাদাভাই বা রচু এটা এখনও জানেনা যে ওই পরির সাথেই আমি অর্চুর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। তবে দু’তিনদিন আগে আমি ওদেরকে জানিয়েছি যে অর্চুর আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছি আমরা। আর ওদেরকেই তোমাদের সাথে প্রথম কথা বলতে বলেছিলাম। ওরা বোধহয় গত কাল বা পরশু রাতে তোমাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছে। কাল রচু ফোনে বলছিল যে তোমরা নাকি এ প্রস্তাবে রাজী হওনি”।
বিভাদেবী বললেন, “হ্যাঁরে মা, কাল দুপুরেই জামাই ঘরে আসবার পর ওরা আমাদের ফোন করেছিল। এ ব্যাপারেই কথা বলছিল। কিন্তু তোর মেসো বা আমি দু’জনেই অতটা তলিয়ে ভাবিনি তখন। তাই সমাজের ভয়েই ওদের বলেছিলাম যে আমরা আর অর্চুর বিয়ে দেবার ব্যাপারে কিছু ভাবছি না। আর তাছাড়া সে সামর্থ্যই বা কোথায় বল। কিন্তু তখন তো আমরা জানতুম না যে এ সবের পেছনে তুই আছিস”।
বিধুবাবু এবার সীমন্তিনীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, “ওই ছেলেটা, কি যেন নাম বললে? ও হ্যাঁ হ্যাঁ পরিতোষ সান্যাল। সে কি তোমার ওখানে বা অন্য কোথাও আমাদের অর্চুকে দেখেছে? অর্চুকে কি ওর পছন্দ হয়েছে”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “না মেসো, অর্চু আর পরি ওরা কেউ কাউকে দেখেনি এখনও। অবশ্য আমার বন্ধু বলেই অর্চু আমার আর নীতার মুখে পরিতোষের কথা কিছু কিছু শুনেছে। কিন্তু এ’কথা আমি এখনও কাউকে জানাইনি যে পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দেবার কথা আমি ভাবছি। তবে মেসো, একটা কথা কিন্তু আমি তোমাদের কাছে এখনও বলিনি। সেটা এবারে বলছি। যে মেয়েটাকে পরি ভালবাসতো, মানে যার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল একটা সময়, সে মেয়েটা আমাদের নীতা, যে এখন আমার সাথে আছে”।
বিভাদেবী আঁতকে উঠে বললেন, “ওমা সেকি রে? নীতা তো খুব ভাল মেয়ে শুনেছি। তাহলে ছেলেটা ওকেই বিয়ে করছে না কেন”?
সীমন্তিনী এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “মাসি সে কথা বলতে গেলে আরও অনেকটা সময় লেগে যাবে। আজ অতকথা বলতে গেলে আমার আর ফিরে যাওয়াই হবে না। কিন্তু আমাকে যে আর আধঘন্টার ভেতরেই মিঃ রায়ের সাথে দেখা করতে হবে। তবে আপাততঃ এটুকু জেনে রাখো, অল্প কিছুদিন আগেই পরিতোষ অবশেষে সাত বছর বাদে ওকে খুঁজে পেয়েছে। তারপরেও এখনও ও মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজি আছে। কিন্তু নীতার জীবনে ওই সাতটা বছরে এমন এমন কতগুলো ঘটণা ঘটে গেছে যে ও আর পরিতোষকে বিয়ে করতে চাইছে না। আর সব কিছু জেনে আমিও ওকে সমর্থন করেছি। কিন্তু আমি আর নীতা দু’জনেই চাই যে পরি এবার বিয়ে থা করে সংসার শুরু করুক। তাই জোর করে পরিকে বিয়ে করতে রাজী করিয়েছি। এখন পরিস্থিতিটা এমন যে আমরা মেয়ে পছন্দ করে না দিলে পরিতোষ বিয়ে করবে না। তাই পরির বিয়ে দেবার দায়িত্বটাও আমিই কাঁধে তুলে নিয়েছি”।
বিধুবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তা হ্যাঁরে মা, এই মেয়েটাকে নিয়ে ভবিষ্যতে আবার কোন গোল বাঁধবে না তো”?
সীমন্তিনী এবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই মেসো। তোমরা তো নীতাকে দেখ নি। মেয়েটা সত্যিই খুব চমৎকার গো। বড্ড মিষ্টি স্বভাবের। মনের দিক থেকে খুব সৎ। অর্চু আর পরির সংসারে ও দুর থেকেই শুভেচ্ছা জানাবে চিরটা কাল। পরি আর অর্চুর উপকার ছাড়া অনিষ্ট ও কোনদিন করবে না। এ ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত। নীতাকে নিয়ে এমন দুর্ভাবনা একেবারেই করতে হবে না তোমাদের। ওর সাথে তোমাদের একবার পরিচয় হলে, ও-ও দেখবে তোমাদের আরেকটা মেয়ে হয়ে উঠবে। আর হ্যাঁ, আরেকটা ভাল কথা মনে পড়েছে, শোনো। এবার পুজো শুরু হচ্ছে সামনের মাসের একুশ তারিখে। আমি অক্টোবরের বারো তারিখ থেকে চৌদ্দ তারিখ পর্যন্ত তিনদিনের জন্যে ছুটির দরখাস্ত করেছি। হয়তো পেয়ে যাব। তখন তোমরা তিনজন, মানে তুমি, মাসি আর ভাই, তোমাদের তিনজনকেই কিন্তু আমার ওখানে যেতে হবে এগারো তারিখে। বিকেলের দিকে গেলেও চলবে। কিন্তু না করবে না কিন্তু। আমি তাহলে কষ্ট পাব। দু’দিন থাকবে তোমরা সবাই আমার ওখানে। তখন তোমরা গিয়ে নীতার সাথে ভাল করে কথা বলে পরির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে নিতে পারবে। আর শোনো আমাকে এখন উঠতেই হবে। তাই তাড়াতাড়ি আরও কয়েকটা কথাও আমি আজই তোমাদের বলে যাচ্ছি। মনে হয় পরি অর্চুকে বিয়ে করতে অরাজী হবে না। তাই তোমরা ধরেই রাখো যে সামনের অঘ্রান মাসেই মানে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে বিয়েটা হবে। তবে ওই সময় কিন্তু তোমাদের এ বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। কারন বাড়িতে তখন নতুন ঘর বানাবার কাজ চলতে থাকবে। ইচ্ছে আছে পুজোর পর পরই বাড়ি তৈরীর কাজটা শুরু করে দেব। আর বাড়ির কাজ তো দু এক সপ্তাহেই শেষ হবে না। কম করেও মাস ছয়েক সময় তো লেগেই যাবে মনে হয়। তাই পুজোর পর কাজ শুরু করলেও সামনের এপ্রিল বা মে মাসের আগে কাজ শেষ হবে না। কিন্তু পরি রাজি হলে বিয়েটা ততদিন ফেলে রাখা যাবে না। তবে ধরে রাখো, বিয়েটা মোটামুটি ফাইনাল। শুধু দিনক্ষন আর জায়গাটা পরে ঠিক করতে হবে। তবে মাসি, আমার একটা অনুরোধ কিন্তু তোমরা তিনজন অবশ্যই রাখবে। আমরা যে অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে আজ এমন সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটা কিন্তু এখনই কোন পাড়া প্রতিবেশী বা আর অন্য কাউকে জানাবে না। অর্চুকেও না। অর্চু তো আমার সাথেই থাকবে পুজো অব্দি। আমি ওকে সময় সুযোগ মত ব্যাপারটা জানাব। তোমরা যখন পুজোর আগে আমার ওখানে যাবে তার আগেই হয়ত আমি সব কিছু ফাইনাল করে ফেলতে পারব। তখনই নীতার সাথে কথা বলে তোমাদের মনের আশঙ্কা কেটে গেলেই অর্চুকে তোমরা সব কথা খুলে জানাতে পারবে। তখন আর আমি বাধা দেব না। তবে তার আগে অব্দি অর্চু, নীতা বা অন্য কেউ যেন এ ব্যাপারে কিছু না জানে। আমি নিজেই অর্চু আর নীতাকে সামলে রাখব। শুধু তোমরা ওদেরকে এ বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা বলো না। আর সামনের সতের তারিখ অর্চুকে আমিই কোর্টে নিয়ে যাব। তোমরা ওটা নিয়ে ভেব না। ঠিক আছে”?
বিধুবাবু এতক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকবার পর এবার বললেন, “তুমি আমাদের আর কত ঋণী করবে মা গো। রচুর বিয়ে, খোকার লেখাপড়া, আমার চিকিৎসা, ব্যবসা, অর্চুকে ফিরিয়ে আনা, ওকে সুস্থ করে তোলা, কোর্টের মামলা, এতসবের পর এখন আবার বাড়ি আর ....”
তাকে থামিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী খাট থেকে উঠে বলল, “নাহ, আর বসবার উপায় নেই। আমাকে এবার যেতেই হবে” বলে পাশের অর্চুর ঘরে ঢুকে গেল।
মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই নিজের ইউনিফর্ম পড়ে বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নেমে বলল, “ও মাসি, আমি তাহলে আসছি গো। তোমরা সবাই ভালভাবে থেক। আর ভাই ফোন করো”।
বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুক সকলেই তখন উঠোনে নেমে এসেছে। কিংশুক সীমন্তিনীর কাছে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, “ও দিদিভাই, এ সুখবরটা ছোড়দিকেও জানাতে বারণ করছ কেন গো তুমি”?
সীমন্তিনী কিংশুকের মুখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ঠিক আছে ভাই, তোমার ছোড়দিকে তুমিই কথাটা জানিও। তবে এখন আমি বেরিয়ে যাবার অন্ততঃ আধ ঘন্টা পর তাকে জানিও। এখন আমি না বেরোলে ওসির সাথে আমার মিটিংটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাকে বলে দিও সে যেন তোমার রতুদা ছাড়া আর কাউকে কিচ্ছুটি না বলে আপাততঃ। আমার বারণ রইল রাজগঞ্জের বাড়ির কারুর সাথে আর অর্চু বা নীতার সাথেও ওরা কেউ যেন আপাততঃ আর কোন কথা না বলে এ ব্যাপারে। এ’কথাটা বারবার রিপিট করে ভালমত বুঝিয়ে দেবে কিন্তু ভাই। তবে তোমার ছোড়দি আর জামাইবাবু অবশ্য একজনের সাথেই এসব নিয়ে আলোচনা করার অনুমতি পেতে পারে। বল তো, সে কে”?
কিংশুক সীমন্তিনীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “সে আমার দিদিভাই। ঠিক না”?
সীমন্তিনী হেসে কিংশুকের মাথায় আরেকটা স্নেহ-চুম্বন একে দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছ, লক্ষ্মী সোনা ভাই আমার”।
বিভাদেবী একটা বেশ বড়সড় কৌটো সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে যা মা, তোরা সবাই মিলে খাস। কয়েকটা নাড়কেলের নাড়ু বানিয়াছিলুম তোদের দেব বলে”।
সীমন্তিনী কৌটোটা হাতে নিয়ে বিধুবাবুকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল, “মেসো, তুমি তোমার ওষুধ পত্র ঠিক ঠিক সময় মত খাচ্ছ তো”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা, ও নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তা কোর না। আমি একদম ঘড়ি ধরে সময় মিলিয়ে মিলিয়ে সব ওষুধ খাচ্ছি। এখন পুরোপুরি ভাল আছি”।
সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে প্রণাম করে আর কিংশুককে আদর করে বাড়ি থেকে বেরোল।
******************
কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়ের সাথে আলোচনা সেরে সীমন্তিনীর গাড়ি যখন ফেরার পথ ধরেছে তখনই সীমন্তিনীর পকেটের ভেতর তার পার্সোনাল মোবাইলটা বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইল বের করতেই স্ক্রীনে ‘রচুসোনা কলিং’ দেখে মুচকি হেসে কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগিয়ে কিছু বলে ওঠার আগেই ওদিক থেকে রচনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ও দিদিভাই, ভাই এ’সব কী শুনলুম গো? সত্যি পরিতোষদার সাথে দিদির বিয়ে হবে? উঃ আমি যে ভাবতেই পাচ্ছিনা গো! আমার দিদির কপালে কি এত সুখ লেখা আছে! আমি যে শুনে বিশ্বেসই করতে পারছিনে গো দিদিভাই! ও দিদিভাই, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি কি এখনও কালচিনি থানাতেই আছ নাকি গো? সন্ধ্যে তো হতে চলল। নাগরাকাটায় কখন ফিরবে তাহলে? তোমাদের তো অনেক রাত হয়ে যাবে ফিরতে তাহলে! আঃ কথা বলছ না কেন তুমি”?
সীমন্তিনী শান্ত গলায় বলল, “ওরে পাগলী, তুই আমাকে কথা বলার সুযোগ দিলে তো কথা বলব। ঝড়ের বেগে তো তুইই একের পর এক কথা বলে যাচ্ছিস, প্রশ্ন করছিস। শোন, খুব ভাল সময়ে ফোনটা করেছিস তুই। এ কথাগুলো আমি লক্ষ্মীদি, নীতা বা অর্চুর সামনে বলতে চাইনে এখনই। আরেকপক্ষের মত না পাওয়া অব্দি কাউকে কিছু বলতে চাই না আমি। আর তুইও কিন্তু অর্চু বা নীতাকে এসব কথা একদম বলবি নে। আর, কালচিনি থানা থেকে একটু আগেই বেরিয়েছি আমরা। এখন গাড়িতে আছি। বাড়ির দিকে ফিরছি। আর হয়ত ঘন্টা খানেকের ভেতরেই পৌঁছে যাব। আর ভাই তোকে কি কি বলে থাকতে পারে, তার আন্দাজ আমি করতে পারছি। কিন্তু তুই কি শুধু ভাইয়ের সাথেই কথা বলেছিস? মাসি মেসোর সাথে কথা বলিস নি”?
রচনা আগের মতই উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁ, মায়ের সাথেও কথা হয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু বাবা তখন দোকানে চলে গিয়েছিলেন বলে তার সাথে আর কথা হয়নি। পরশু তো মা বাবা দু’জনেই আমাদের প্রস্তাব এককথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন। তবে আমার বিশ্বাস ছিল তুমি তাদের ঠিক রাজী করাবে। আমি জানতুম মা বাবা কক্ষনো তোমার কথা ফেলতে পারবেন না। তুমি যে তাদের মা লক্ষ্মী, মা দুর্গা, মা অন্নপূর্না গো। উঃ কী যে আনন্দ হচ্ছে না দিদিভাই। তোমাকে এই মূহুর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে খুব খুব করে আদর করতে ইচ্ছে করছে জানো”?
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, তোর সে ইচ্ছে তো এখনই পূর্ণ হবার নয়। এখন বল দেখি যে ছেলেটার সাথে আমি অর্চুর বিয়ে দিতে চাইছি, তাকে তোর আর দাদাভাইয়ের পছন্দ কি না? কারন পরিকে তো তোরা দেখেছিস। আর ওর ব্যাপারে তোরা দু’জনেই অনেক কিছু জেনে গেছিস এতদিনে। আর এটাও জানিস যে আমি ওর ডার্লিং প্রেয়সী সুইটহার্ট আরও কত কি। আর এখন পর্যন্ত নীতাই যে ওর একমাত্র ভালবাসার পাত্রী, এ’কথাও তুই জানিস। এমন ছেলের সাথে তোর দিদির বিয়ে দিতে চাইবি তুই”?
রচনা বলল, “তোমাদের তিন দেবাদেবীর ইতিহাস তো আমি জানিই দিদিভাই। তবু বলছি দিদিকে যদি সত্যি পরিদা বিয়ে করতে রাজী হন, তাহলে তো ভাবতে হবে যে দিদি আগের জন্মে নিশ্চয়ই খুব পুণ্য করেছে। নইলে পরিদার মত একটা বর তো সব মেয়ের কাম্য। আর তোমাকে আমি আগে কখনো এ’কথা বলেছি কিনা মনে পড়ছে না। পরিদা আর নীতাদির ঘটণাগুলো শোনবার পর থেকে যখনই তার কথা মনে পড়ে তখন আমার খুব কষ্ট হয় গো। মনে মনে কবে যে আমি তাকে দাদার আসনে বসিয়ে ফেলেছি তা আমি নিজেও জানিনা। আমি রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি যেন সে সুখী হয়। তার ছন্নছাড়া জীবনটা যেন একটা সুন্দর ছন্দে ফিরে আসে। দিদির সাথে বিয়ে হলে আমি নিশ্চিত জানি তার জীবনটাই আমূল পাল্টে যাবে। দিদি পরিদা দু’জনেই খুব সুখী হবে, এটাই আমার বিশ্বাস। তোমার দাদাভাইও আমার সাথে একমত”।
সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বলল, “তাহলে বোঝা গেল যে মেয়ের মা বাবা ভাই বোন ভগ্নীপতী সবাই এ বিয়েতে রাজী। এখন শুধু মিঞা বিবি রাজী হয়ে গেলেই আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে”।
রচনা হেসে বলল, “মিঞা তো আগেই তোমার ওপরেই সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে বসে আছে। আর বিবির কাছে তোমার কথাই তো বেদবাক্য এ তো আমরা সবাই জানি। আচ্ছা দিদিভাই, নীতাদি আর দিদিকে তো এখনও পরিদার কথা বলোনি। আর তোমার নির্দেশ আছে বলে আমিও তাদের আর কিছু জানাচ্ছি না। কিন্তু আমার তো মনে হয়না যে নীতাদি এ বিয়েতে কোন রকম বাধা দেবে। তাই বিয়েটা যে হচ্ছেই, এ ব্যাপারে আর আমার কোন সন্দেহ নেই। উঃ, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব গো দিদিভাই”।
সীমন্তিনী এ’কথা শুনে বলল, “এই দুষ্টু, কি বললি? ধন্যবাদ? মারব এক চাটি”।
রচনা সাথে সাথে বলল, “সরি সরি দিদিভাই। কথাটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে গো। প্লীজ কিছু মনে কোর না। লক্ষ্মী দিদিভাই আমার”।
সীমন্তিনী এবার মনে মনে হেসে বলল, “আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। আর ন্যাকামি করতে হবে না। তবে শোন, আমি গ্রীন সিগন্যাল না দেওয়া পর্যন্ত কিন্তু রাজগঞ্জের কাউকে আর নীতা বা অর্চুকে কিন্তু কিচ্ছুটি বলবি না। আর পরিকেও না। আসলে অর্চুকে ফিরে পাবার পর থেকেই আমার মনের ভেতর একটা ইচ্ছে জেগে উঠেছিল রে। কিন্তু সে ইচ্ছে বোধহয় আর পূর্ন হবে না। তাই পরির ব্যাপারে ভাবছি। তবু ফাইনাল ডিসিশনটা নেবার আগে আরও কিছুটা অপেক্ষা আমাকে করতেই হবে। তাই আপাততঃ এ সম্মন্ধের সব কিছু আমি গোপন রাখতে চাইছি”।
রচনা তখন বলল, “ওঃ দিদিভাই আনন্দের চোটে তো আমি আরেকটা কথা ভুলেই গেছি গো। আচ্ছা মা বললেন যে মেজদাভাই নাকি কোন এক মেয়েকে ভালবাসে? সত্যি নাকি গো”?
সীমন্তিনী মনে মনে এ ভয়টাই করেছিল। সতুর ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেনি বিভাদেবীকে। রচনার প্রশ্নের উত্তরে তাই সে বলল, “ওঃ, মাসি তোকে কথাটা বলে ফেলেছেন! অবশ্য তার দোষ দেওয়া যায় না। তাড়াহুড়োতে আমিই তাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে সতুর কথাটাও সকলের কাছে আপাততঃ গোপন রাখতে হবে। আচ্ছা যাক, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। শোন রচু, তুই দাদাভাইকেও বলে দিস সতুর ব্যাপারটা যেন রাজগঞ্জের বাড়িতে না জানায়। সতু সেদিন কথায় কথায় আমাকে কথাটা বলেছে। আর কেউ এ ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না। তবে মেয়েটা কে, কেমন, কী করে এসব ব্যাপারে কিছু বলেনি আমাকে। কিন্তু জানিস রচু, আমি মনে মনে ভেবেছিলুম যে সতু একটা চাকরি বাকরি পেলেই ওর সাথে বিয়ে দিয়ে অর্চুকেও আমাদের বাড়ির আরেকটা বৌ করে আনব। কিন্তু সতুর মুখে ওর ভালবাসার পাত্রীর কথা শুনেই মনে হচ্ছে যে সেটা আর সম্ভব হবে না। কারন কারুর ভালবাসাকে আমি ছোট করে দেখি না কখনো। তবু আমি ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখব। তারপরেই পরি আর অর্চুর ব্যাপারে ফাইনাল ডিসিশনটা নেব। বুঝেছিস তো”?
রচনা বলল, “বুঝেছি দিদিভাই। তবে মেজদাভাই তো ব্যাঙ্কের রিটেন টেস্টে কোয়ালিফাই করেই ফেলেছে। আর ভাইভা নাকি সামনের মাসেই হবে। ঠাকুরের আশীর্বাদে দেখো মেজদাভাই ঠিক চাকরি পেয়ে যাবে। তবে তার প্রেমিকার ব্যাপারে আমরা বা বাড়ির কেউ এখনও কিছু জানেনা। আজ দুপুরেও তো মামনির সাথে মেজমার সাথে অনেকক্ষণ কথা হল। কই, তারাও তো আজ অব্দি কেউ এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি। আর তুমি যেটা বলছ, সেটা সত্যি হলে আমার খুশী তো দ্বিগুণ হত। কিন্তু মেজদাভাই যখন নিজেই কাউকে পছন্দ করে ফেলেছেন, তার পছন্দকে অগ্রাহ্য করে দিদির সাথে তার বিয়ে দিলে হয়ত সুখের চেয়ে অশান্তিই বেশী হতে পারে। তাই সেটা না করাই ভাল”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁরে রচু, তুই একদম ঠিক বলেছিস। আর এটা ভেবেই আমি পরির দিকে ঝুঁকেছি। তবে সতু যে মেয়েটাকে ভালবেসেছে তার সম্মন্ধেও একটু খোঁজ খবর আমার করা উচিৎ। তাই একটু অপেক্ষা করছি। আর সেজন্যেই তোকে বলছি, সতুর ব্যাপার আর অর্চু-পরির ব্যাপার আপাততঃ সকলের কাছেই গোপন রাখতে হবে। তবে পরি যে অরাজী হবে না সে ব্যাপারেও আমার খুব একটা সন্দেহ নেই। তবু নীতা আর পরির মৌখিক সম্মতিটা নিতেই হবে। তবে সে নিয়ে তুই কিছু ভাবিস না। সেটা আমিই করে নেব। আর শোন, দাদাভাইকেও সবটা বুঝিয়ে বলিস, কেমন”?
রচনা বলল, “তোমার দাদাভাই তো আমার পাশে বসেই তোমার সব কথা শুনছেন দিদিভাই। তিনিই কি আর তোমার কথার অন্যথা করতে পারেন নাকি? তুমি ও নিয়ে ভেবো না দিদিভাই”।
এবার রতীশের গলা শোনা গেল, “হ্যাঁরে মন্তি, আমি সব শুনেছি। আর মনে হচ্ছে অর্চুদির ব্যাপারে তুই বেশ ভাল একটা সিদ্ধান্তই নিয়েছিস। তুই ভাবিস না। আমরা কেউ তোর নির্দেশ অমান্য করব না। কিন্তু সতুর ব্যাপারে যে কথাটা বললি, তাতে তো একটু চিন্তাই হচ্ছে রে। প্রেম করছে, সেটা কোন সমস্যার নয়। বাড়ির লোকেরা মেনে নিলে আর মেয়েটা ভাল হলেই হল। কিন্তু মেয়েটা কেমন সেটাই তো দেখার। আমাদের পরিবারের উপযুক্ত হলে তো চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু একান্নবর্তী এক পরিবারে মানিয়ে চলতে পারবে কিনা, শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদদের ভালবাসতে পারবে কিনা সেটাই চিন্তার বিষয়। কিন্তু সেটা নিয়ে তো আমরা কিছু করতে পারব না। সেটা তো সকলের আগে সতুরই ভেবে দেখা দরকার ছিল। ও কি ভেবে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে তা তো আর আমরা কেউ জানিনা। এখন বাড়ীতে বাবা কাকারা আছেন। যথাসময়ে তারাই বরং এ ব্যাপারটা যাচাই করে দেখুক। তোর কথার অন্যথা হয়ত বাড়ির কেউই করবে না। কিন্তু তারা নিজেরা কেউ কি তোর পরামর্শ চাইবেন”?
______________________________
SS_SEXY
বিধুবাবু সীমন্তিনীর কথার কোন জবাব দেবার আগেই কিংশুকের সাথে বিভাদেবী জলের গ্লাস হাতে ঘরে ঢুকে বললেন, “তুই কি ভাবছিস মন্তি, আমরা কেউ তোর কথা অমান্যি করতে পারি” বলে বিধুবাবুর মুখের কাছে জলের গ্লাসটা তুলে ধরে বলল, “নাও তো, একটুখানি জল খেয়ে নাও”।
বিধুবাবু দু’ঢোক জল খেয়ে নিতে বিভাদেবী শাড়ির খুট দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে মমতাভরা গলায় বললেন, “ভগবানের অশেষ করুণাতেই তো আমরা এ মেয়েটাকে পেয়েছি। এবার শান্ত হয়ে ওকে তোমার মতামতটা জানাও। ও তো আবার থানাতেও যাবে বলছে। তাই ওকে আর খুব বেশীক্ষণ আটকে রাখা ঠিক হবে না। আরও কতটা পথ তো ওকে যেতে হবে”।
বিধুবাবু তার স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে চেয়ে বললেন, “আর বলার কি কিছু আছে গো? তুমি কি এতদিনেও এ মেয়েটাকে চিনতে পারলে না? ও সমস্ত আটঘাট বেঁধে সবকিছু মনে মনে সাজিয়ে নিয়েই তবে আজ ওর সিদ্ধান্তে শেষ শিলমোহরটা পড়াবে বলেই এসেছে। ভুলে গেছ? রচুর বিয়ের এক দেড় বছর আগে থেকে এ বাড়ি এসে ও কিভাবে আমাদের সবাইকে বশ করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিল? কাউকে কিচ্ছুটি বলার অবকাশ ও দিয়েছিল? আমাদের সঙ্গে যে বেয়াই মশাইদের পরিবারের মত অমন একটা সম্ভ্রান্ত এবং ভাল পরিবারের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেটা তো ওর জন্যেই। রচু তো সুখে আছে। ওকে ওর স্বামী আর শ্বশুর বাড়ির সকলেই খুব ভালবাসে। এর বেশী কিছু কি আমরা চেয়েছি কখনও? যতটুকু পেয়েছি সেটুকুও যে স্বপ্নাতীত। আজও আবার হয়ত সে’রকমেরই কোন ঘটণার অবতারনা হতে চলেছে। আজও আমাদের মুখ ফুটে কোন কথা বলার অবকাশ নেই। কিন্তু মন্তি মা, তুমি তো রচুর বিয়ের পর পরই হায়দ্রাবাদে গিয়েছিলে। আর তুমি বলছ সেখানে গিয়েই এ ছেলেটার সাথে তোমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছে। তার মানে মা, আমি কি ধরে নিতে পারি যে তোমাদের ভেতরের এই বন্ধুত্বটা গত তিন বছর ধরেই অক্ষুণ্ণ অটুট আছে”?
সীমন্তিনী বিধুবাবুর একটা হাত নিজের হাতে ধরে রেখেই মিষ্টি হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ মেসো। তুমি একদম ঠিক বলেছ। হায়দ্রাবাদের ট্রেনিং শেষ হয়ে যাবার পর কর্মসুত্রে আমরা আলাদা আলাদা জায়গায় আছি ঠিকই। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এতে কমজোড় তো হয়ই নি। বরং দাদাভাই আর রচু কলকাতা যাবার পর আমাদের দু’জনের বন্ধুত্বটা আরও সুদৃঢ় হচ্ছে দিনে দিনে। তাই তো ওর সম্পর্কে আমি জোর দিয়ে এসব কথা বলতে পারছি নিশ্চিন্তে। আমি ওর ব্যাপারে যা যা তোমাদের বললাম তা একটুও বাড়িয়ে বলিনি কিন্তু মেসো”।
বিভাদেবী উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে, তার মানে রচু রতু ওরাও কি ছেলেটাকে চেনে”?
সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যাঁ মাসি, চেনে। তবে আগে থেকে ওরা ওকে চিনত না। আগেরবার যখন আমি কলকাতা গিয়েছিলুম, মানে যখন আমি নীতাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছিলুম তখন পরিতোষের সাথে রচুর আর দাদাভাইয়ের পরিচয় হয়েছে। তবে দাদাভাই বা রচু এটা এখনও জানেনা যে ওই পরির সাথেই আমি অর্চুর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। তবে দু’তিনদিন আগে আমি ওদেরকে জানিয়েছি যে অর্চুর আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছি আমরা। আর ওদেরকেই তোমাদের সাথে প্রথম কথা বলতে বলেছিলাম। ওরা বোধহয় গত কাল বা পরশু রাতে তোমাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছে। কাল রচু ফোনে বলছিল যে তোমরা নাকি এ প্রস্তাবে রাজী হওনি”।
বিভাদেবী বললেন, “হ্যাঁরে মা, কাল দুপুরেই জামাই ঘরে আসবার পর ওরা আমাদের ফোন করেছিল। এ ব্যাপারেই কথা বলছিল। কিন্তু তোর মেসো বা আমি দু’জনেই অতটা তলিয়ে ভাবিনি তখন। তাই সমাজের ভয়েই ওদের বলেছিলাম যে আমরা আর অর্চুর বিয়ে দেবার ব্যাপারে কিছু ভাবছি না। আর তাছাড়া সে সামর্থ্যই বা কোথায় বল। কিন্তু তখন তো আমরা জানতুম না যে এ সবের পেছনে তুই আছিস”।
বিধুবাবু এবার সীমন্তিনীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, “ওই ছেলেটা, কি যেন নাম বললে? ও হ্যাঁ হ্যাঁ পরিতোষ সান্যাল। সে কি তোমার ওখানে বা অন্য কোথাও আমাদের অর্চুকে দেখেছে? অর্চুকে কি ওর পছন্দ হয়েছে”?
সীমন্তিনী জবাবে বলল, “না মেসো, অর্চু আর পরি ওরা কেউ কাউকে দেখেনি এখনও। অবশ্য আমার বন্ধু বলেই অর্চু আমার আর নীতার মুখে পরিতোষের কথা কিছু কিছু শুনেছে। কিন্তু এ’কথা আমি এখনও কাউকে জানাইনি যে পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দেবার কথা আমি ভাবছি। তবে মেসো, একটা কথা কিন্তু আমি তোমাদের কাছে এখনও বলিনি। সেটা এবারে বলছি। যে মেয়েটাকে পরি ভালবাসতো, মানে যার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল একটা সময়, সে মেয়েটা আমাদের নীতা, যে এখন আমার সাথে আছে”।
বিভাদেবী আঁতকে উঠে বললেন, “ওমা সেকি রে? নীতা তো খুব ভাল মেয়ে শুনেছি। তাহলে ছেলেটা ওকেই বিয়ে করছে না কেন”?
সীমন্তিনী এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “মাসি সে কথা বলতে গেলে আরও অনেকটা সময় লেগে যাবে। আজ অতকথা বলতে গেলে আমার আর ফিরে যাওয়াই হবে না। কিন্তু আমাকে যে আর আধঘন্টার ভেতরেই মিঃ রায়ের সাথে দেখা করতে হবে। তবে আপাততঃ এটুকু জেনে রাখো, অল্প কিছুদিন আগেই পরিতোষ অবশেষে সাত বছর বাদে ওকে খুঁজে পেয়েছে। তারপরেও এখনও ও মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজি আছে। কিন্তু নীতার জীবনে ওই সাতটা বছরে এমন এমন কতগুলো ঘটণা ঘটে গেছে যে ও আর পরিতোষকে বিয়ে করতে চাইছে না। আর সব কিছু জেনে আমিও ওকে সমর্থন করেছি। কিন্তু আমি আর নীতা দু’জনেই চাই যে পরি এবার বিয়ে থা করে সংসার শুরু করুক। তাই জোর করে পরিকে বিয়ে করতে রাজী করিয়েছি। এখন পরিস্থিতিটা এমন যে আমরা মেয়ে পছন্দ করে না দিলে পরিতোষ বিয়ে করবে না। তাই পরির বিয়ে দেবার দায়িত্বটাও আমিই কাঁধে তুলে নিয়েছি”।
বিধুবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তা হ্যাঁরে মা, এই মেয়েটাকে নিয়ে ভবিষ্যতে আবার কোন গোল বাঁধবে না তো”?
সীমন্তিনী এবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই মেসো। তোমরা তো নীতাকে দেখ নি। মেয়েটা সত্যিই খুব চমৎকার গো। বড্ড মিষ্টি স্বভাবের। মনের দিক থেকে খুব সৎ। অর্চু আর পরির সংসারে ও দুর থেকেই শুভেচ্ছা জানাবে চিরটা কাল। পরি আর অর্চুর উপকার ছাড়া অনিষ্ট ও কোনদিন করবে না। এ ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত। নীতাকে নিয়ে এমন দুর্ভাবনা একেবারেই করতে হবে না তোমাদের। ওর সাথে তোমাদের একবার পরিচয় হলে, ও-ও দেখবে তোমাদের আরেকটা মেয়ে হয়ে উঠবে। আর হ্যাঁ, আরেকটা ভাল কথা মনে পড়েছে, শোনো। এবার পুজো শুরু হচ্ছে সামনের মাসের একুশ তারিখে। আমি অক্টোবরের বারো তারিখ থেকে চৌদ্দ তারিখ পর্যন্ত তিনদিনের জন্যে ছুটির দরখাস্ত করেছি। হয়তো পেয়ে যাব। তখন তোমরা তিনজন, মানে তুমি, মাসি আর ভাই, তোমাদের তিনজনকেই কিন্তু আমার ওখানে যেতে হবে এগারো তারিখে। বিকেলের দিকে গেলেও চলবে। কিন্তু না করবে না কিন্তু। আমি তাহলে কষ্ট পাব। দু’দিন থাকবে তোমরা সবাই আমার ওখানে। তখন তোমরা গিয়ে নীতার সাথে ভাল করে কথা বলে পরির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে নিতে পারবে। আর শোনো আমাকে এখন উঠতেই হবে। তাই তাড়াতাড়ি আরও কয়েকটা কথাও আমি আজই তোমাদের বলে যাচ্ছি। মনে হয় পরি অর্চুকে বিয়ে করতে অরাজী হবে না। তাই তোমরা ধরেই রাখো যে সামনের অঘ্রান মাসেই মানে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে বিয়েটা হবে। তবে ওই সময় কিন্তু তোমাদের এ বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। কারন বাড়িতে তখন নতুন ঘর বানাবার কাজ চলতে থাকবে। ইচ্ছে আছে পুজোর পর পরই বাড়ি তৈরীর কাজটা শুরু করে দেব। আর বাড়ির কাজ তো দু এক সপ্তাহেই শেষ হবে না। কম করেও মাস ছয়েক সময় তো লেগেই যাবে মনে হয়। তাই পুজোর পর কাজ শুরু করলেও সামনের এপ্রিল বা মে মাসের আগে কাজ শেষ হবে না। কিন্তু পরি রাজি হলে বিয়েটা ততদিন ফেলে রাখা যাবে না। তবে ধরে রাখো, বিয়েটা মোটামুটি ফাইনাল। শুধু দিনক্ষন আর জায়গাটা পরে ঠিক করতে হবে। তবে মাসি, আমার একটা অনুরোধ কিন্তু তোমরা তিনজন অবশ্যই রাখবে। আমরা যে অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে আজ এমন সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটা কিন্তু এখনই কোন পাড়া প্রতিবেশী বা আর অন্য কাউকে জানাবে না। অর্চুকেও না। অর্চু তো আমার সাথেই থাকবে পুজো অব্দি। আমি ওকে সময় সুযোগ মত ব্যাপারটা জানাব। তোমরা যখন পুজোর আগে আমার ওখানে যাবে তার আগেই হয়ত আমি সব কিছু ফাইনাল করে ফেলতে পারব। তখনই নীতার সাথে কথা বলে তোমাদের মনের আশঙ্কা কেটে গেলেই অর্চুকে তোমরা সব কথা খুলে জানাতে পারবে। তখন আর আমি বাধা দেব না। তবে তার আগে অব্দি অর্চু, নীতা বা অন্য কেউ যেন এ ব্যাপারে কিছু না জানে। আমি নিজেই অর্চু আর নীতাকে সামলে রাখব। শুধু তোমরা ওদেরকে এ বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা বলো না। আর সামনের সতের তারিখ অর্চুকে আমিই কোর্টে নিয়ে যাব। তোমরা ওটা নিয়ে ভেব না। ঠিক আছে”?
বিধুবাবু এতক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকবার পর এবার বললেন, “তুমি আমাদের আর কত ঋণী করবে মা গো। রচুর বিয়ে, খোকার লেখাপড়া, আমার চিকিৎসা, ব্যবসা, অর্চুকে ফিরিয়ে আনা, ওকে সুস্থ করে তোলা, কোর্টের মামলা, এতসবের পর এখন আবার বাড়ি আর ....”
তাকে থামিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী খাট থেকে উঠে বলল, “নাহ, আর বসবার উপায় নেই। আমাকে এবার যেতেই হবে” বলে পাশের অর্চুর ঘরে ঢুকে গেল।
মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই নিজের ইউনিফর্ম পড়ে বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নেমে বলল, “ও মাসি, আমি তাহলে আসছি গো। তোমরা সবাই ভালভাবে থেক। আর ভাই ফোন করো”।
বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুক সকলেই তখন উঠোনে নেমে এসেছে। কিংশুক সীমন্তিনীর কাছে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, “ও দিদিভাই, এ সুখবরটা ছোড়দিকেও জানাতে বারণ করছ কেন গো তুমি”?
সীমন্তিনী কিংশুকের মুখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ঠিক আছে ভাই, তোমার ছোড়দিকে তুমিই কথাটা জানিও। তবে এখন আমি বেরিয়ে যাবার অন্ততঃ আধ ঘন্টা পর তাকে জানিও। এখন আমি না বেরোলে ওসির সাথে আমার মিটিংটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাকে বলে দিও সে যেন তোমার রতুদা ছাড়া আর কাউকে কিচ্ছুটি না বলে আপাততঃ। আমার বারণ রইল রাজগঞ্জের বাড়ির কারুর সাথে আর অর্চু বা নীতার সাথেও ওরা কেউ যেন আপাততঃ আর কোন কথা না বলে এ ব্যাপারে। এ’কথাটা বারবার রিপিট করে ভালমত বুঝিয়ে দেবে কিন্তু ভাই। তবে তোমার ছোড়দি আর জামাইবাবু অবশ্য একজনের সাথেই এসব নিয়ে আলোচনা করার অনুমতি পেতে পারে। বল তো, সে কে”?
কিংশুক সীমন্তিনীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “সে আমার দিদিভাই। ঠিক না”?
সীমন্তিনী হেসে কিংশুকের মাথায় আরেকটা স্নেহ-চুম্বন একে দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছ, লক্ষ্মী সোনা ভাই আমার”।
বিভাদেবী একটা বেশ বড়সড় কৌটো সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে যা মা, তোরা সবাই মিলে খাস। কয়েকটা নাড়কেলের নাড়ু বানিয়াছিলুম তোদের দেব বলে”।
সীমন্তিনী কৌটোটা হাতে নিয়ে বিধুবাবুকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল, “মেসো, তুমি তোমার ওষুধ পত্র ঠিক ঠিক সময় মত খাচ্ছ তো”?
বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা, ও নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তা কোর না। আমি একদম ঘড়ি ধরে সময় মিলিয়ে মিলিয়ে সব ওষুধ খাচ্ছি। এখন পুরোপুরি ভাল আছি”।
সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে প্রণাম করে আর কিংশুককে আদর করে বাড়ি থেকে বেরোল।
******************
কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায়ের সাথে আলোচনা সেরে সীমন্তিনীর গাড়ি যখন ফেরার পথ ধরেছে তখনই সীমন্তিনীর পকেটের ভেতর তার পার্সোনাল মোবাইলটা বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইল বের করতেই স্ক্রীনে ‘রচুসোনা কলিং’ দেখে মুচকি হেসে কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগিয়ে কিছু বলে ওঠার আগেই ওদিক থেকে রচনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ও দিদিভাই, ভাই এ’সব কী শুনলুম গো? সত্যি পরিতোষদার সাথে দিদির বিয়ে হবে? উঃ আমি যে ভাবতেই পাচ্ছিনা গো! আমার দিদির কপালে কি এত সুখ লেখা আছে! আমি যে শুনে বিশ্বেসই করতে পারছিনে গো দিদিভাই! ও দিদিভাই, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি কি এখনও কালচিনি থানাতেই আছ নাকি গো? সন্ধ্যে তো হতে চলল। নাগরাকাটায় কখন ফিরবে তাহলে? তোমাদের তো অনেক রাত হয়ে যাবে ফিরতে তাহলে! আঃ কথা বলছ না কেন তুমি”?
সীমন্তিনী শান্ত গলায় বলল, “ওরে পাগলী, তুই আমাকে কথা বলার সুযোগ দিলে তো কথা বলব। ঝড়ের বেগে তো তুইই একের পর এক কথা বলে যাচ্ছিস, প্রশ্ন করছিস। শোন, খুব ভাল সময়ে ফোনটা করেছিস তুই। এ কথাগুলো আমি লক্ষ্মীদি, নীতা বা অর্চুর সামনে বলতে চাইনে এখনই। আরেকপক্ষের মত না পাওয়া অব্দি কাউকে কিছু বলতে চাই না আমি। আর তুইও কিন্তু অর্চু বা নীতাকে এসব কথা একদম বলবি নে। আর, কালচিনি থানা থেকে একটু আগেই বেরিয়েছি আমরা। এখন গাড়িতে আছি। বাড়ির দিকে ফিরছি। আর হয়ত ঘন্টা খানেকের ভেতরেই পৌঁছে যাব। আর ভাই তোকে কি কি বলে থাকতে পারে, তার আন্দাজ আমি করতে পারছি। কিন্তু তুই কি শুধু ভাইয়ের সাথেই কথা বলেছিস? মাসি মেসোর সাথে কথা বলিস নি”?
রচনা আগের মতই উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁ, মায়ের সাথেও কথা হয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু বাবা তখন দোকানে চলে গিয়েছিলেন বলে তার সাথে আর কথা হয়নি। পরশু তো মা বাবা দু’জনেই আমাদের প্রস্তাব এককথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন। তবে আমার বিশ্বাস ছিল তুমি তাদের ঠিক রাজী করাবে। আমি জানতুম মা বাবা কক্ষনো তোমার কথা ফেলতে পারবেন না। তুমি যে তাদের মা লক্ষ্মী, মা দুর্গা, মা অন্নপূর্না গো। উঃ কী যে আনন্দ হচ্ছে না দিদিভাই। তোমাকে এই মূহুর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে খুব খুব করে আদর করতে ইচ্ছে করছে জানো”?
সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, তোর সে ইচ্ছে তো এখনই পূর্ণ হবার নয়। এখন বল দেখি যে ছেলেটার সাথে আমি অর্চুর বিয়ে দিতে চাইছি, তাকে তোর আর দাদাভাইয়ের পছন্দ কি না? কারন পরিকে তো তোরা দেখেছিস। আর ওর ব্যাপারে তোরা দু’জনেই অনেক কিছু জেনে গেছিস এতদিনে। আর এটাও জানিস যে আমি ওর ডার্লিং প্রেয়সী সুইটহার্ট আরও কত কি। আর এখন পর্যন্ত নীতাই যে ওর একমাত্র ভালবাসার পাত্রী, এ’কথাও তুই জানিস। এমন ছেলের সাথে তোর দিদির বিয়ে দিতে চাইবি তুই”?
রচনা বলল, “তোমাদের তিন দেবাদেবীর ইতিহাস তো আমি জানিই দিদিভাই। তবু বলছি দিদিকে যদি সত্যি পরিদা বিয়ে করতে রাজী হন, তাহলে তো ভাবতে হবে যে দিদি আগের জন্মে নিশ্চয়ই খুব পুণ্য করেছে। নইলে পরিদার মত একটা বর তো সব মেয়ের কাম্য। আর তোমাকে আমি আগে কখনো এ’কথা বলেছি কিনা মনে পড়ছে না। পরিদা আর নীতাদির ঘটণাগুলো শোনবার পর থেকে যখনই তার কথা মনে পড়ে তখন আমার খুব কষ্ট হয় গো। মনে মনে কবে যে আমি তাকে দাদার আসনে বসিয়ে ফেলেছি তা আমি নিজেও জানিনা। আমি রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি যেন সে সুখী হয়। তার ছন্নছাড়া জীবনটা যেন একটা সুন্দর ছন্দে ফিরে আসে। দিদির সাথে বিয়ে হলে আমি নিশ্চিত জানি তার জীবনটাই আমূল পাল্টে যাবে। দিদি পরিদা দু’জনেই খুব সুখী হবে, এটাই আমার বিশ্বাস। তোমার দাদাভাইও আমার সাথে একমত”।
সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বলল, “তাহলে বোঝা গেল যে মেয়ের মা বাবা ভাই বোন ভগ্নীপতী সবাই এ বিয়েতে রাজী। এখন শুধু মিঞা বিবি রাজী হয়ে গেলেই আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে”।
রচনা হেসে বলল, “মিঞা তো আগেই তোমার ওপরেই সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে বসে আছে। আর বিবির কাছে তোমার কথাই তো বেদবাক্য এ তো আমরা সবাই জানি। আচ্ছা দিদিভাই, নীতাদি আর দিদিকে তো এখনও পরিদার কথা বলোনি। আর তোমার নির্দেশ আছে বলে আমিও তাদের আর কিছু জানাচ্ছি না। কিন্তু আমার তো মনে হয়না যে নীতাদি এ বিয়েতে কোন রকম বাধা দেবে। তাই বিয়েটা যে হচ্ছেই, এ ব্যাপারে আর আমার কোন সন্দেহ নেই। উঃ, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব গো দিদিভাই”।
সীমন্তিনী এ’কথা শুনে বলল, “এই দুষ্টু, কি বললি? ধন্যবাদ? মারব এক চাটি”।
রচনা সাথে সাথে বলল, “সরি সরি দিদিভাই। কথাটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে গো। প্লীজ কিছু মনে কোর না। লক্ষ্মী দিদিভাই আমার”।
সীমন্তিনী এবার মনে মনে হেসে বলল, “আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। আর ন্যাকামি করতে হবে না। তবে শোন, আমি গ্রীন সিগন্যাল না দেওয়া পর্যন্ত কিন্তু রাজগঞ্জের কাউকে আর নীতা বা অর্চুকে কিন্তু কিচ্ছুটি বলবি না। আর পরিকেও না। আসলে অর্চুকে ফিরে পাবার পর থেকেই আমার মনের ভেতর একটা ইচ্ছে জেগে উঠেছিল রে। কিন্তু সে ইচ্ছে বোধহয় আর পূর্ন হবে না। তাই পরির ব্যাপারে ভাবছি। তবু ফাইনাল ডিসিশনটা নেবার আগে আরও কিছুটা অপেক্ষা আমাকে করতেই হবে। তাই আপাততঃ এ সম্মন্ধের সব কিছু আমি গোপন রাখতে চাইছি”।
রচনা তখন বলল, “ওঃ দিদিভাই আনন্দের চোটে তো আমি আরেকটা কথা ভুলেই গেছি গো। আচ্ছা মা বললেন যে মেজদাভাই নাকি কোন এক মেয়েকে ভালবাসে? সত্যি নাকি গো”?
সীমন্তিনী মনে মনে এ ভয়টাই করেছিল। সতুর ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেনি বিভাদেবীকে। রচনার প্রশ্নের উত্তরে তাই সে বলল, “ওঃ, মাসি তোকে কথাটা বলে ফেলেছেন! অবশ্য তার দোষ দেওয়া যায় না। তাড়াহুড়োতে আমিই তাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে সতুর কথাটাও সকলের কাছে আপাততঃ গোপন রাখতে হবে। আচ্ছা যাক, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। শোন রচু, তুই দাদাভাইকেও বলে দিস সতুর ব্যাপারটা যেন রাজগঞ্জের বাড়িতে না জানায়। সতু সেদিন কথায় কথায় আমাকে কথাটা বলেছে। আর কেউ এ ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না। তবে মেয়েটা কে, কেমন, কী করে এসব ব্যাপারে কিছু বলেনি আমাকে। কিন্তু জানিস রচু, আমি মনে মনে ভেবেছিলুম যে সতু একটা চাকরি বাকরি পেলেই ওর সাথে বিয়ে দিয়ে অর্চুকেও আমাদের বাড়ির আরেকটা বৌ করে আনব। কিন্তু সতুর মুখে ওর ভালবাসার পাত্রীর কথা শুনেই মনে হচ্ছে যে সেটা আর সম্ভব হবে না। কারন কারুর ভালবাসাকে আমি ছোট করে দেখি না কখনো। তবু আমি ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখব। তারপরেই পরি আর অর্চুর ব্যাপারে ফাইনাল ডিসিশনটা নেব। বুঝেছিস তো”?
রচনা বলল, “বুঝেছি দিদিভাই। তবে মেজদাভাই তো ব্যাঙ্কের রিটেন টেস্টে কোয়ালিফাই করেই ফেলেছে। আর ভাইভা নাকি সামনের মাসেই হবে। ঠাকুরের আশীর্বাদে দেখো মেজদাভাই ঠিক চাকরি পেয়ে যাবে। তবে তার প্রেমিকার ব্যাপারে আমরা বা বাড়ির কেউ এখনও কিছু জানেনা। আজ দুপুরেও তো মামনির সাথে মেজমার সাথে অনেকক্ষণ কথা হল। কই, তারাও তো আজ অব্দি কেউ এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি। আর তুমি যেটা বলছ, সেটা সত্যি হলে আমার খুশী তো দ্বিগুণ হত। কিন্তু মেজদাভাই যখন নিজেই কাউকে পছন্দ করে ফেলেছেন, তার পছন্দকে অগ্রাহ্য করে দিদির সাথে তার বিয়ে দিলে হয়ত সুখের চেয়ে অশান্তিই বেশী হতে পারে। তাই সেটা না করাই ভাল”।
সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁরে রচু, তুই একদম ঠিক বলেছিস। আর এটা ভেবেই আমি পরির দিকে ঝুঁকেছি। তবে সতু যে মেয়েটাকে ভালবেসেছে তার সম্মন্ধেও একটু খোঁজ খবর আমার করা উচিৎ। তাই একটু অপেক্ষা করছি। আর সেজন্যেই তোকে বলছি, সতুর ব্যাপার আর অর্চু-পরির ব্যাপার আপাততঃ সকলের কাছেই গোপন রাখতে হবে। তবে পরি যে অরাজী হবে না সে ব্যাপারেও আমার খুব একটা সন্দেহ নেই। তবু নীতা আর পরির মৌখিক সম্মতিটা নিতেই হবে। তবে সে নিয়ে তুই কিছু ভাবিস না। সেটা আমিই করে নেব। আর শোন, দাদাভাইকেও সবটা বুঝিয়ে বলিস, কেমন”?
রচনা বলল, “তোমার দাদাভাই তো আমার পাশে বসেই তোমার সব কথা শুনছেন দিদিভাই। তিনিই কি আর তোমার কথার অন্যথা করতে পারেন নাকি? তুমি ও নিয়ে ভেবো না দিদিভাই”।
এবার রতীশের গলা শোনা গেল, “হ্যাঁরে মন্তি, আমি সব শুনেছি। আর মনে হচ্ছে অর্চুদির ব্যাপারে তুই বেশ ভাল একটা সিদ্ধান্তই নিয়েছিস। তুই ভাবিস না। আমরা কেউ তোর নির্দেশ অমান্য করব না। কিন্তু সতুর ব্যাপারে যে কথাটা বললি, তাতে তো একটু চিন্তাই হচ্ছে রে। প্রেম করছে, সেটা কোন সমস্যার নয়। বাড়ির লোকেরা মেনে নিলে আর মেয়েটা ভাল হলেই হল। কিন্তু মেয়েটা কেমন সেটাই তো দেখার। আমাদের পরিবারের উপযুক্ত হলে তো চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু একান্নবর্তী এক পরিবারে মানিয়ে চলতে পারবে কিনা, শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদদের ভালবাসতে পারবে কিনা সেটাই চিন্তার বিষয়। কিন্তু সেটা নিয়ে তো আমরা কিছু করতে পারব না। সেটা তো সকলের আগে সতুরই ভেবে দেখা দরকার ছিল। ও কি ভেবে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে তা তো আর আমরা কেউ জানিনা। এখন বাড়ীতে বাবা কাকারা আছেন। যথাসময়ে তারাই বরং এ ব্যাপারটা যাচাই করে দেখুক। তোর কথার অন্যথা হয়ত বাড়ির কেউই করবে না। কিন্তু তারা নিজেরা কেউ কি তোর পরামর্শ চাইবেন”?
______________________________
SS_SEXY