Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 171)

এসপি অফিসে মিটিং শেষ হতে হতে বেলা একটা বেজে গেল। সীমন্তিনী অফিস থেকে বেরিয়েই তার সঙ্গে আসা সিকিউরিটি আর অন্যান্য অফিসারের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে শুনেই সকলকে নিয়ে রওনা হল। আগেই ঠিক করা ছিল ফেরার পথে কালচিনি হয়ে ফিরবে। দেড়টার একটু আগেই বিধুবাবুর বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দুটো এসে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী তাকিয়ে দেখল বিধুবাবুর দোকান বন্ধ। গাড়ি থেকে নামবার আগেই কিংশুক ছুটে এসে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এতক্ষণে এলে দিদিভাই? তুমি আসবে বলে আমি আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছি”।

সীমন্তিনী কিংশুকের মুখটা দু’হাতে ধরে তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “মিটিং শেষ হবার পর একটা মিনিটও সময় নষ্ট করিনি রে ভাই। আমার ভাইটাকে কতক্ষণে দেখব এই ভেবেই মনটা ছটফট করছিল। তা ভাই, মেসো নেই নাকি? দোকান বন্ধ দেখছি যে”?

কিংশুক সীমন্তিনীর হাত ধরে বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, “বাবা বাড়িতেই আছেন দিদিভাই। স্নান টান সেরে তোমার সাথে বসে খাবেন বলে অপেক্ষা করছেন। ওই তো দেখ”।

গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ঘরের বারান্দায় বিধুবাবুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। বিভাদেবীও ছুটে এসে বললেন, “এসেছিস মা? আয় আয়”।

সীমন্তিনী বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে প্রণাম করে বলল, “ও মাসি, রান্না হয়ে গেছে তো? আমার কিন্তু বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে গো”।

বিভাদেবী হেসে বললেন, “হ্যাঁরে, রান্না হয়ে গেছে। আমি বাথরুমে জল ভরে রেখে সাবান তোয়ালে সব রেখে এসেছি। তুই ঘরে গিয়ে কাপড়টা পাল্টে চট করে স্নানটা সেরে আয়। ততক্ষণে আমার থালা বাড়া হয়ে যাবে। যা যা”।

সীমন্তিনী আর কথা না বাড়িয়ে অর্চুর ঘরে ঢুকে নিজের পোশাক ছেড়ে অর্চুর একটা নাইটি পড়ে পেছনে কলঘরে চলে গেল। তাড়াতাড়ি স্নান করে বেরিয়েই বিধুবাবু আর কিংশুককে সাথে নিয়ে রান্না ঘরের মেঝেতে পাতা আসনে বসে পড়ল। বিভাদেবী ভাতের থালা এগিয়ে দেবার আগেই সীমন্তিনী একটু অনুযোগের সুরে বলল, “মেসো এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক করনি তোমরা। আমি আসছি বলে তোমরা সকলেই না খেয়ে বসে থাকবে”?

বিধুবাবু বললেন, “এমন সুযোগ কি আর কপালে রোজ রোজ জোটে মা? সেই কবে তোমার সাথে একসাথে খেয়েছি, মনে আছে তোমার? রচুর বিয়ের পরদিন ওকে বিদেয় করবার পর আমরা দু’ বুড়োবুড়ি একা থাকব বলে তুমি সেদিন এ বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলে। সেই রাতে তুমি নিজে হাতে রান্না করে আমাদের দু’জনের পাশে বসে খেয়েছিলে। তারপর থেকে এই সাড়ে তিন বছরে অমন সুযোগ তো আর পাই নি মা। তাই আজ সুযোগ পেয়ে লোভটা আর সামলাতে পারলুম না”।

বিধুবাবুর মুখের মমতাভরা কথাগুলো শুনে সীমন্তিনীর মনটা যেন হু হু করে উঠল। ভেতর থেকে একটা কান্নার স্রোত যেন উথলে উঠে আসতে চাইছিল। নিজেকে প্রানপণে সংযত রাখবার চেষ্টা করল সে। তারপর বলল, “তুমি ভুলে গেছ মেসো। রচু আর দাদাভাই যেদিন অর্চুকে দেখতে এসেছিল, সেদিনও কিন্তু আমি তোমাদের সাথে এ’ঘরে বসেই পাত পেড়ে খেয়েছিলুম”।

বিভাদেবী সকলের সামনে থালা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, “হ্যাঁরে মা, তোর শরীর স্বাস্থ্য ঠিক আছে তো”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যাঁ গো মাসি। তোমাদের আশীর্বাদে খুব ভাল আছি। আর এখন দু’দুটো বোন আমার সাথে আছে। আমার কি আর আনন্দের সীমা আছে বলো”?

ওদের খাওয়া শুরু হতে বিভাদেবী বললেন, “ছেলেমেয়ে সুখে থাকলে মা বাবারাও সুখে থাকে। কিন্তু মা রে, তুই তো সকলের কথাই ভাবিস। এবার তো অন্ততঃ নিজের কথা একটু ভাব মা”।

সীমন্তিনী গলার গ্রাস গিলে বাঁ হাতে বিভাদেবীর একটা হাত ধরে বলল, “মাসি শোনো, আজ আমি বিশেষ একটা কথা বলার জন্য এখানে এসেছি। কিন্তু আমার হাতে খুব বেশী সময় নেই। তোমাদের এখান থেকে বেড়িয়ে আমাকে আবার এখানকার থানার ওসির সাথে দেখা করতে হবে। আট ন’দিন পরেই অর্চুর কেসটা নিয়ে কোর্টে হিয়ারিং হবে। তাই মিঃ রায়ের সাথে কিছু জরুরী আলোচনা করতে হবে। তাই এখন আর আজে বাজে কথা না উঠিয়ে আমাকে কাজের কাজটা করতে দাও না প্লীজ”।

বিভাদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “কী বলতে এসেছিস তুই”?

সীমন্তিনী আরেক গ্রাস খাবার খেয়ে বলল, “আচ্ছা মেসো, তোমার শরীর স্বাস্থ্য তো আগের চেয়ে ভাল আছে। মাসি আর ভাইও ঠাকুরের কৃপায় ভাল আছে। অর্চুও অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আর তোমাদের ছোট মেয়েও তো ঠিক আছে। তা অর্চুর ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমরা কিছু ভেবেছ কি”?
 

বিধুবাবু সীমন্তিনীর কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “অর্চুর ভবিষ্যতের কথা বলছ তুমি মা? বাবা হয়ে ওর ভবিষ্যৎ তো আমিই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি। আমি তো ওর জীবনটাই বর্বাদ করে ফেলেছি মাগো। ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার কোন অবকাশই তো আর রাখিনি আমি। মনে মনে আমি নিজেকে যে কতটা অপরাধী বলে ভাবি, তা কেবল আমিই জানি, আর জানেন আমার অন্তরাত্মা। আমার মনের ভেতর যে গ্লানি জমে আছে, তা আমৃত্যু আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। এ গ্লানি নিয়েই আমাকে মরতে হবে জানি”।
 

বিভাদেবী এ’ কথা শুনে বললেন, “আঃ কী সব আবোল তাবোল বকছ বলো তো? খেতে বসে এমন সব অলক্ষুণে কথা বলতে আছে”?

এবার সীমন্তিনী দু’জনকে হাতের ঈশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “অতীতের দুঃসময়ের কথা ভেবে বর্তমান আর ভবিষ্যতকে তো অবহেলা করা যায় না মেসো। অর্চু তো আমার থেকেও চার বছরের ছোট। সবে তেইশ পেরিয়েছে ও। সারাটা জীবনই তো ওর সামনে পড়ে আছে। আর তাছাড়া ও এমন তো কোন অপরাধ করেনি যে সারা জীবন ভর ওকে বিনা দোষে এ সাজা বয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে আজ তোমরা ওর পাশে আছ। ভাই, রচু ওর পাশে আছে। আমি আছি। কিন্তু দেখো মাসি, সকলেরই তো দিনে দিনে দায়িত্ব বাড়তে থাকবে। দাদাভাই আর রচুর সংসারেও নতুন নতুন দায়িত্ব আসবে। ভাইয়ের ভবিষ্যতে হায়ার স্টাডিজ, চাকরি তারপর বিয়ে সংসার এসব দায়িত্ব তো অবধারিত ভাবেই আসবে। আজ তোমরা সবাই মিলে অর্চুকে যেভাবে আগলে রাখছ, চিরটা কাল কি তা পারবে? না পারা সম্ভব? তাই আমার মনে হয় ওর আরেকটা বিয়ে দেবার কথা ভাবা উচিৎ আমাদের”।

বিধুবাবু খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে সীমন্তিনীর মুখের দিকে চাইলেন। বিভাদেবী অবশ্য অবাক না হয়ে ব্যথিত গলায় বললেন, “তুই যা বলছিস, তা তো পুরোপুরিই সত্যি রে মা। কিন্তু ', ঘরের বিধবা মেয়ের কি আর বিয়ে হয় রে মা”?
 

বিধুবাবুও বললেন, “হ্যাঁ মা। তুমি যা ভাবছ সমাজের চোখে যে সেটা বড় অপরাধ। সমাজে থেকে বিধবা মেয়ের বিয়ের কথা ভাবা, তাও ',ের বিধবা! এ যে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনে মাগো। সমাজ যে আমাদের একঘরে করে দেবে মা”।
 

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “মেসো, দিনকাল এখন অনেক পাল্টেছে। একসময় তো সদ্য বিধবাদের স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে বাধ্য করা হত। রামমোহন রায় বাল্য বিবাহ, সতীদাহ প্রথা বিলীন করবার জন্য আন্দোলন করে গেছেন। রানী রাসমনিও তাই করেছিলেন। অবশেষ সেই কূ-প্রথা তো ১৮২৯ সালে বৃটিশরাই আইন করে উঠিয়ে দিয়ে গেছে। অবশ্য আইন পাশ করবার সাথে সাথেই যে সে সব কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা নয়। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর যেসকল স্ত্রী সহমরণে যেত না তাদের প্রায় একঘরে করেই রাখার প্রথা চালু করেছিল সে যুগের সমাজের ঠিকেদারেরা। বিধবারা গায়ে কোন গয়না রাখতে পারবে না, কোন পুরুষের সামনে আসতে পারবে না, পরিবারের বাইরের কোনও পুরুষকে তাদের মুখ দেখানো বারণ, তাদের পান খাওয়া বারণ, মাছ, মাংস এবং সব রকম আমিষ খাওয়া বারণ, শাড়ী পড়া বারণ, মাথায় চুল ছোট করে কেটে রাখতে হবে, এমন এমন হাজারটা বিধিনিষেধ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তাদের পূনর্বিবাহ? এ শব্দটা তো উচ্চারণ করাই মহাপাপ বলে ধরা হত সে যুগে। রানী রাসমনি আর রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় আর ইংরেজ সরকারের দৌলতে সতীদাহ প্রথা বেআইনী ঘোষণা করা হলেও, পরবর্তী কালে স্ত্রী-শিক্ষা, বাল্য বিবাহ, এসব নিয়ে অনেক দিন ধরে অনেক স্তরে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। অবশেষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টাতেই ১৮৫৬ সালে বিধবা পুনর্বিবাহ আইন প্রণয়ন হয়েছিল বৃটিশ যুগেই। কিন্তু তা সত্বেও সহজেই বিধবাদের বিবাহ আজও হয় না। বাল্য বিবাহ, পণ প্রথা এখনও অনেক সমাজে অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে। স্ত্রী–শিক্ষা এখনও অনেক সম্প্রদায়ে নিষিদ্ধ বলে মনে করে। কিন্তু এখন বাংলার বড় বড় শহরে এসব প্রথা প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ছোট ছোট গ্রামে গঞ্জে এখনও স্ত্রী-শিক্ষা, বাল্য-বিবাহ, পণ-প্রথা, বিধবা বিবাহের মত ব্যাপারগুলো নিয়ে সমস্যা রয়েই গেছে। কিন্তু কলকাতা বা অন্য বড় বড় শহর গুলোতে গিয়ে দেখো তুমি, কে বিধবা, কে যে সধবা, তুমি আলাদা করে বুঝতেই পারবে না। সধবা স্ত্রীরাও তাদের স্বামী বেঁচে থাকা সত্বেও সধবার কোন চিহ্ন তারা নিজেদের শরীরে রাখতে চায় না। তাদের হাতে না আছে শাঁখা পলা নোয়া, না আছে তাদের সিঁথিতে বা কপালে সিঁদুরের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া। উল্টে বিধবারাই আজকাল সোনার গয়না পড়ে, চুল ফুলিয়ে দামী দামী রঙিন শাড়ী পড়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তাদের নিয়ে কোন মাথা ঘামায় না”।

একটু দম নিয়ে আবার বলল, “আর সমাজের প্রতাপ কি আর আগের যুগের মত আছে? সেটা থাকলে এটা কলিযুগের বদলে সত্য যুগ না হলেও ত্রেতা বা দ্বাপর যুগ হত। আজ সমাজে ভাল নিয়ম বলতে কিছু কি আর বাকি আছে? কাজেই সমাজের ব্যাপারে মাথা না ঘামানোই ভাল। আমি শুধু মানি যে আমাদের সবাইকে শুধু দেশের আইন কানুন মেনে চলা উচিৎ। আর বিধবা বিবাহ আইনের বিপক্ষে নয়। বরং আজ যদি কেউ বিধবা প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ের বিবাহের বিরোধিতা করে, তাহলে সেটাই বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই আমি তোমাদের দু’জনকেই অনুরোধ করছি, তোমরা সমাজের কথা ভাবা ছেড়ে দাও। এ সমাজ কোনও বিধবার ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেয় না। সামাজিক কোন বাধা বিপত্তি এলে তার মোকাবেলা করব আমি। তোমরা শুধু তোমাদের ওই কচি মেয়েটার কথা ভাবো না মেসো। আচ্ছা মাসি, তোমরা কি চাওনা অর্চুর ভবিষ্যৎ জীবনটা সুন্দর হোক? অর্চু যদি আবার একজনকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারে, তাহলে তোমরাও কি সুখী হবে না”?
 

বিভাদেবী শাড়ির আঁচলে মুখে চেপে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, “অমন কথা বলিস নে মা। কোনও মা বাবা কি চাইতে পারে তাদের ছেলে মেয়েরা দুঃখে দিন কাটাক”?

এমন সময় হঠাৎ কিংশুক পাশ থেকে বলে উঠল, “দিদিভাই, তোমার আশীর্বাদে আমি যদি ভবিষ্যতে আমার পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করে তুলতে পারি, তাহলে এ’টুকু কথা তোমাকে আমি দিতে পারি যে আমার মা বাবা, ছোড়দি, বড়দি কাউকে আমি কোনদিন অবহেলা করব না। বড়দি যদি মা-বাবার কথা মত এভাবেই থেকে যায়, তবু আমার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সে আমার আদরের বড়দি হয়েই থাকবে। কিন্তু তবু আমি বলছি দিদিভাই, তুমি যেমন বলছ তাতে আমি তোমার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সমাজ থেকে কোনও বাধা যদি আসেই, তবে তার মোকাবেলা আমি সাহসের সাথে করব। আমি তোমার পাশে আছি দিদিভাই”।

সীমন্তিনী একহাত দিয়ে কিংশুককে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে তার কপালে গাল ঠেকিয়ে বলল, “এই নাহলে আমার ভাই? বেঁচে থাকো ভাই। ভগবান তোমাকে সৎ সাহস আর সুবুদ্ধি দিন। তুমি যেন জীবনের সবক্ষেত্রে সফল হও”।
 

বিধুবাবু এবার অনেকটা শান্ত স্বরে বললেন, “মন্তি মা। তোমার কথা অমান্য করার ইচ্ছে বা স্পর্ধা কোনটাই আমাদের কারুর নেই। কিন্তু মা সমাজের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম। কিন্তু সাত বছর স্বামী শ্বশুরের ঘরে জীবন কাটিয়ে আসা একটা বিধবা মেয়েকে কোন ছেলে বিয়ে করতে চাইবে মা”?

এবার বিভাদেবী বললেন, “সমাজের রক্তচক্ষু নয় আমরা কোনভাবে সয়ে নেব রে মা। যদি কোনও ভাল স্বভাবের ইচ্ছুক ছেলে পেতাম, তবে সে দোজবর বা বয়স্ক হলেও আমরা আপত্তি করব না। এমনকি সে যদি অ',ও হয়, তবু আমরা অর্চুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে মেনে নেব। কিন্তু অমন ছেলে পাব কোথায় রে মা”?
 

সীমন্তিনী শেষ গ্রাসটা গিলে বলল, “আচ্ছা সে’কথায় পরে আসছি। মেসো, তোমার মতামতটা আগে শুনি। তবে আগেই বলে রাখছি, আমি কিন্তু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে অর্চুর আবার বিয়ে দেবই। আর ছেলে খুঁজে বের করব আমিই। তোমাদের কোন দায়িত্ব নিতে হবে না। অবশ্য ভবিষ্যৎ গণনা তো আমি জানিনে। তবে আপাতভাবে যতটুকু ভেবে দেখা যায় তা নিশ্চয়ই করব। অর্চু তো আমারও বোন। ও যাতে ভাল থাকে সুখে থাকে, সেটা তো আমারও কাম্য”।

বিধুবাবুর খাওয়াও শেষ হয়ে গেছে ততক্ষণে। সীমন্তিনীর প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন, “তোমার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবার ইচ্ছে বা স্পর্ধা কোনটাই যে আমার নেই তা তো আগেই বলেছি মা। আর তুমি যেমনটা বলছ, সত্যি সত্যি যদি তেমনটা বাস্তবে সম্ভব হয়, তাহলে সবচেয়ে খুশী তো আমি হব। মেয়েটার ইচ্ছের বিরূদ্ধে তাকে ওভাবে বিয়ে দিয়ে যে পাপ আমি করেছিলাম, তার প্রায়শ্চিত্ত করবার একটা সুযোগ তো অন্ততঃ পাব। আমার বুকের ভেতর যে জগদ্দল পাথরটা চেপে বসে আছে, সে পাথরটা তো অন্ততঃ সরে যাবে। আমার বুকটা হাল্কা হয়ে যাবে। আমি আর .......”

তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই সীমন্তিনী বলে উঠল, “আচ্ছা মাসি, এবার তুমি খেতে বসে পড়ো তো। তোমার খাবার দেরী হয়ে যাবে। আমাদেরও হাত শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত ধুয়ে এসে বাকি কথাগুলো বলছি। মেসো, ভাই চলো হাত ধুয়ে এসে আমরা আবার এখানে বসেই কথা বলি। মাসি তুমি থালা নিয়ে বসো”।

কলপাড় থেকে হাত মুখ ধুয়ে সবাই আবার রান্নাঘরে এসে বসতে সীমন্তিনী বিভাদেবীর পাশে বসে বলল, “মাসি শোনো, আমার এক বন্ধু আছে। সে পুলিশেই চাকরি করে। আমার চেয়ে বড় অফিসার। সান্যাল, রাঢ়ী ',। ভারদ্বাজ গোত্র। ত্রিশ বছর বয়স। ভাল স্বাস্থ্য। স্বভাব চরিত্র খুব ভাল। পরোপকারী। তবে ওর আত্মীয় স্বজন বলতে একেবারেই কেউ নেই। বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ওর বাবাও পুলিশে কাজ করতেন। তবে খুব উঁচু পদে ছিলেন না। ওর মা ওর ছোটবেলাতেই মারা যান। ও নিজে আইপিএস হবার পর ওর নিজের পছন্দের এক মেয়ের সাথে ওর বাবা ওর বিয়ে মোটামুটি ঠিক করেছিলেন। কথা ছিল ওর আড়াই বছরের ট্রেনিং এর পরেই ওদের বিয়ে হবে। কিন্তু সে দিনটা ওদের জীবনে আসবার আগেই ওর বাবা মারা যান। ওর বাবার শ্রাদ্ধ শান্তি চুকে যাবার পর পরই যে মেয়েটার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সে মেয়েটাকে কেউ বা কারা যেন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ও তখন হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং এ। কলকাতার থানা পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মেয়েটাকে আর উদ্ধার করতে পারেনি”।
 

সীমন্তিনী ইচ্ছে করেই নবনীতার নামটা উল্লেখ না করে, একটু দম নিয়ে আবার বলল, “এর প্রায় চার বছর পর ওর সাথে আমার দেখা হয়। আমি তখন হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং এ। চাকরিতে আমার সিনিয়র হলেও ওর মিষ্টি স্বভাব দেখে ওর আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়। সে বন্ধুত্ব আমাদের আজও অটুট আছে। তাই ওর স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে আমি খুব ভালো ভাবেই জানি। ছেলেটা খুবই সৎ এবং সাহসী। অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপোষ করতে দেখিনি ওকে আমি। আর যে কোনও সমস্যা সমাধান করবার অদ্ভুত শক্তি আর বুদ্ধি আছে ওর। সব দিক দিয়ে বিচার করলে ওর মত একটা ছেলেকে যে কোন মেয়েই স্বামী হিসেবে পেতে যাইবে। মাথার ওপর কোন অভিভাবক নেই বলেই ওর বিয়ে নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় নি। তবে তোমাদের বা অর্চুর অপছন্দ করবার মত শুধু একটা ব্যাপারই আছে। স্বামী ছাড়া অন্য কোনও আত্মীয় পরিজন কিন্তু অর্চু সেখানে একেবারেই পাবে না। বিয়ের পর অর্চুকে কিন্তু ও বাড়িতে একাই থাকতে হবে বেশীর ভাগ সময়। কারন ও রাত দশটা এগারোটার আগে ঘরে ফিরতেই পারে না। তবে এখানে আরও একটা কথা আছে। অর্চু কিন্তু রচু আর দাদাভাইয়ের কাছাকাছি থাকতে পারবে। কারন, পরিতোষ মানে ওই ছেলেটা কলকাতাতেই থাকে। তাই রচু আর দাদাভাইয়ের সাথেও ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারবে”। একটু থেমে আবার বলল, “এবারে তোমরা তোমাদের মতামত বলো। আমি কিন্তু তোমাদের তিনজনের মতামতই চাই। তারপর রচু, দাদাভাই আর অর্চুর সাথে কথা বলব আমি”।
 

সীমন্তিনীর কথা শুনতে শুনতে বিভাদেবী খাবার খেতে ভুলে গিয়েছিলেন। চোখ বড়বড় করে সীমন্তিনীর কথাগুলো তিনি যেন গোগ্রাসে গিলছিলেন। এবার সীমন্তিনী থামতেই তিনি তারা দম বন্ধ হয়ে আসা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন, “কী বলছিস মা তুই? এ-ও কি সম্ভব? আমার অর্চুর কপালে কি এত সুখ লিখেছেন বিধাতা? আমি যে বিশ্বেসই করতে পারছিনে রে”।

কিংশুক বাবার পাশ থেকে উঠে এসে সীমন্তিনীর পাশে বসে তার একটা হাত নিজের হাতে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “সত্যি দিদিভাই? সত্যি বলছ তুমি? এমন একটা লোকই তো আমার আদর্শ গো। আমিও যে বড় হয়ে এমন সৎ এবং সাহসী হয়ে উঠতে চাই। অমন একটা জামাইবাবু পেলে আমি তো বর্তে যাব গো। তুমি দ্যাখো দিদিভাই। এমন একটা ছেলের সাথে বড়দির বিয়ে হলে আমি খুব খুশী হব। অবশ্য মানছি দিনগুলো বড়দিকে একা একা ঘরের ভেতর কাটাতে হবে। কথা বলার মত কাউকে তার পাশে পাবে না। কিন্তু ছোড়দি আর রতুদার সাথে তো তার মাঝে মধ্যে দেখা হবেই। আমার মনে হয় না বড়দি সেখানে কষ্ট পাবে। আমি রাজী আছি দিদিভাই। তুমি প্লীজ চেষ্টা করো, দেখো যদি আমাদের এ প্রয়াসটা সার্থক হয়”।
 

সীমন্তিনী বিভাদেবী আর কিংশুকের মনোভাব বুঝতে পেরে মনে মনে খুব খুশী হল। বিভাদেবী তার স্বামীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিগো, তুমি কিছু বলছ না যে? তুমি কি রাজি নও নাকি”?

বিধুবাবু এতক্ষণ মাথা নিচু করে মনে মনে অনেককিছু ভাবছিলেন। তার চোখ দুটো জলে ভরে এসেছিল। এবারে স্ত্রীর কথায় মুখ তুলে হাতের চেটোয় চোখ দুটো মুছে গলাটাকে একটু পরিষ্কার করে বললেন, “কি বলব বিভু? তোমরা হয়ত বুঝতে পাচ্ছ না, কিন্তু আমি বুঝে গেছি আমরা আবার নতুন করে মা অন্নপূর্নার হাত থেকে আরেকটা বরদান পেতে চলেছি” বলে ওপরের দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বললেন, “হে প্রভু, হে ভগবান, জানিনা, কোন জনমে এমন কী পূণ্য আমি কামিয়েছিলাম যে এই বুড়ো বয়সে এসে এমন এক অন্নপূর্ণা মার কোলে আমি আশ্রয় পেয়েছি। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রভু। আ হা হা” বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললেন।
 

সীমন্তিনী বিভাদেবীর পাশ থেকে উঠে বিধুবাবুর পাশে বসে বলল, “মাসি, আমি মেসোকে নিয়ে তোমাদের ঘরে যাচ্ছি। তুমি চট করে খাওয়া শেষ করে ওখানে এসো। ভাই, চলো। আমরা ও ঘরে যাই” বলে বিধুবাবু আর কিংশুককে সাথে করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিধুবাবুর ঘরে এসে তাকে বিছানায় বসাতে বসাতে সীমন্তিনী কিংশুককে বলল, “ভাই, বাবাকে একগ্লাস জল এনে দাও তো তাড়াতাড়ি”।

কিংশুক আবার ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। সীমন্তিনী বিধুবাবুর পিঠে আর বুকে সস্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ও মেসো, তুমি অধীর হয়ো না, শান্ত হও। আমিও তো তোমাদের আরেকটা মেয়ে। অর্চু তো আমারও বোন। আমার বোনটা যাতে সুখে থাকে, ভাল থাকে সেটা দেখা তো আমারও কর্তব্য। তুমি জানোনা মেসো, অর্চুকে আমাদের বাড়ির আরেকটা বৌ করে নিয়ে যাবার ইচ্ছেই আমার ছিল। তোমরা হয়ত জানো না, কিন্তু আমি জানি, রচু কলকাতা চলে যাবার পর আমাদের বাড়ির সকলেই যেন প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। সবাই খাচ্ছে পড়ছে সব কিছু করছে। কিন্তু প্রত্যেকেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। করতে হয় বলেই করছে, খেতে হয় বলেই খাচ্ছে, এমন একটা গা ছাড়া ভাব সকলের মধ্যে। সবাই যেন হাসতে ভুলে গেছে। অর্চুকে ফিরে পাবার পর থেকেই কথাটা আমি ভাবছিলাম। ওকেও যদি আমাদের বাড়ির বৌ করে নিয়ে যেতে পারতুম তাহলে আমাদের বাড়ির সবাই আবার নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠত। কিন্তু যেদিন জানতে পারলুম সতু একটা মেয়েকে ভালবাসে সেদিনই আমার সে স্বপ্নটা ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। তাই আমার মনের ভেতরের স্বপ্নের কথাটা আর কারো কাছে প্রকাশ করিনি। কিন্তু অর্চুর দিকটাও তো আমাকে দেখতে হবেই। তাই অনেক ভেবে পরিতোষের সাথেই ওর বিয়েটা দেব বলে ভাবলুম। তোমার আপত্তি আছে মেসো”?


______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 19-03-2020, 03:11 PM



Users browsing this thread: