17-03-2020, 07:12 PM
(Update No. 167)
রাত সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছিল। নবনীতা সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “ও দিদি, আমার যে আর তর সইছে না গো। এবার তাহলে মাসি মেসোর সাথে কথা বলো। নাকি বৌদিকেই আগে ফোন করবে”?
সীমন্তিনী একটু একটু ভাবতে ভাবতে বলল, “আমি যে কোনটা ছেড়ে কোনটা করি, সেটাই তো ভেবে পাচ্ছিনা রে নীতা। একদিকে দাদাভাই আর রচুকে নিয়ে ভাবছি, একদিকে বাড়ি তৈরীর কথা ভাবছি, একদিকে পরিতোষের কাজ নিয়ে ভাবছি, একদিকে ভাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি, একদিকে বীথিকার কথা, একদিকে মহিমা বৌদিকে নিয়ে ভাবছি। এখন আবার অর্চুর ব্যাপারটা নিয়েও ভাবতে হবেই। তবে ভাইয়ের ভবিষ্যৎ পড়াশোনার ব্যাপারে মাস দুয়েক বাদে ভাবলেও চলবে। আর অর্চুর ব্যাপারেও তড়িঘড়ি করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের এগোতে হবে। তাই এ দুটো ব্যাপার নিয়ে এখনই কিছু করতে চাইছি না আমি। এখন সবচেয়ে আগে আমাকে দাদাভাই আর রচুকে বিপদমুক্ত করা দরকার। আর এর সাথেই জড়িয়ে রয়েছে পরিতোষের কাজ। আর মহিমা বৌদির ব্যাপারেও আমাকে এখনই কিছু একটা ভাবতে হবে। দিন দুয়েকের ভেতরেই একটা প্ল্যান আমাকে বানিয়ে ফেলতে হবে। আর বাড়ি তৈরীর ব্যাপারটাও আমাকে একই সাথে প্ল্যান করে ফেলতে হবে। অবশ্য ফাইনাল না হলেও একটা আনুমানিক আন্দাজ মিঃ অধিকারী আমাকে দিয়েছেন। সেই মতে টাকার আয়োজনটা করতে পারলেই হয়ে যাবে। বাড়ির কনস্ট্রাকশনের কাজ তো পূজোর আগে আর করছি না। তাই ওটা নিয়ে এখন আর কিছু না ভাবলেও চলবে। আমাকে এখন সবচেয়ে আগে যে কাজটা করতে হবে, সেটা হল মহিমা বৌদির ব্যাপারটা। তাই আজকালের মধ্যেই তার সাথে একবার দেখা করতে পারলে খুব ভাল হত। কিন্তু সেটা করতে হলে তো আমাকে আবার কলকাতা যেতে হবে। সেটাও তো এ মূহুর্তেই সম্ভব হচ্ছে না। আর তার আগেও আমাকে মহিমা বৌদির ওই ব্যবসার ব্যাপারে আরও অনেক কথা জেনে নেওয়া দরকার। কিন্তু আমার সাথে তার পরিচয় তো সবে হল। ওই সমস্ত গোপন ব্যাপার সে কি আমার কাছে এত তাড়াতাড়ি খুলে বলতে চাইবে? ওদিকে পরিতোষও হয়ত তোর ম্যাডামের কাছে যেতে পারে কিছু ইনফর্মেশন নিতে। তাই বিমল আগরওয়ালার অপারেশন শেষ হবার আগেই মহিমা বৌদিকে নিয়ে আমার ফাইনাল প্ল্যানটা চক আউট করে ফেলা খুবই দরকার। আর সেটাই আমাকে এখন সবচেয়ে আগে করে ......”
মোবাইল বেজে উঠতেই সীমন্তিনীর কথা থেমে গেল। অর্চনা সীমন্তিনীর মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “রচু ফোন করেছে, নাও দিদিভাই”।
কিন্তু সীমন্তিনী ফোনটা না নিয়ে বিছানা থেকে নেমে বলল, “তুই কথা বলতে থাক অর্চু। আমি বাথরুমে না গিয়ে আর থাকতে পারছিনা। ওকে বলিস আমি ফিরে এসে কথা বলছি। তোরা দু’জন ততক্ষণ কথা বলতে থাক” বলতে বলতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
টয়লেটের কাজ সেরে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কিছু একটা নিয়ে ভাবল। প্রায় মিনিট সাতেক বাদে হাতমুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। তখন নীতা ফোনে রচুকে বলছে, “সে’কথাটা আমি বা অর্চু জানলেও তোমাকে এখনই সেটা বলব না বৌদি। আচ্ছা তুমিই বলো তো? এমন একটা সুখবর তুমি আমাদের মুখ থেকে শুনতে চাও? না তোমাদের দিদিভাইয়ের মুখ থেকে শুনতে চাও”?
ফোনের স্পীকার অন থাকাতে রচনার জবাবও শুনতে পেল সীমন্তিনী বিছানায় এসে বসতে বসতে। রচনা নবনীতার প্রশ্নের জবাবে বলছে, “কিন্তু তোমরাই তো বলছ যে দিদিভাই বাথরুমে আছেন। কতক্ষণ হয়ে গেল, উনি বেরোচ্ছেন না কেন গো? এই দিদি, তুই বাইরে থেকে দিদিভাইকে বল না যে আমি ফোন করেছি। এ’কথা শুনলেই উনি বেরিয়ে আসবেন দেখিস”।
সীমন্তিনীকে দেখে নবনীতা দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিয়ে ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। সীমন্তিনী ফোনটা হাতে ধরে রেখেই জবাব দিল, “ডাকতে হবেনা রে রচু সোনা। আমি এসে গেছি। বল কি বলছিলিস? তার আগে বল তোরা দুটিতে কেমন আছিস”?
রচনা জবাব দিল, “আমরা সবাই ভাল আছি দিদিভাই। কিন্তু নীতাদি কী বলছিল বলো তো? কিসের সুখবর আছে আমার জন্যে”?
সীমন্তিনী বলল, “ও এই বদমাশদুটো তোকে বুঝি সব বলে দিয়েছে”?
রচনা বলল, “না দিদিভাই, তেমন কিছুই বলেনি। শুধু বলল তোমার কাছ থেকে আমি নাকি আজ একটা সুখবর পাবো। আর বলল যে তারা সেটা জানলেও তুমি আমাকে সেটা না বলা পর্যন্ত তারা আমাকে কিছু বলবেন না”।
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “তুই কি চাস বল তো? তুই সত্যি আমার মুখ থেকে না শুনে সেটা নীতা বা অর্চুর কাছ থেকে শুনতে চাস”?
রচনা অধৈর্য হয়ে বলল, “আমি তো তোমার মুখ থেকেই সেটা শুনতে চাই। কিন্তু তুমি তো আধঘন্টা ধরে বাথরুমে গিয়েই বসে আছ”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুই যদি এই মূহুর্তে আমার হাতের কাছ থাকতিস, তাহলে তোকে মজা দেখাতুম। দুষ্টু মেয়ে। সাত মিনিটও লাগেনি আমার বাথরুম সেরে বেরোতে, আর তুই বলছিস আধঘন্টা ধরে ঢুকে বসে আছি”?
রচনা নিজের ভুল স্বীকার করে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ঘাট হয়েছে আমার। এবার আসল কথাটা বলো তো”?
সীমন্তিনী বললো, “হ্যাঁ বলছি, কিন্তু দাদাভাইকেও তোর সাথে থাকতে বল। তুই কেঁদে ফেললে সে যেন তোকে সামলাতে পারে”।
রচনা বলল, “উঃ দিদিভাই, সুখবর শুনে কি কেউ কাঁদে? আমি কাঁদব না। আর তোমার দাদাভাইও আমার সাথেই বসে আছেন। আর আমাদের সব কথা শুনছেনও। এবার দয়া করে বলবে? সুখবরটা কী”?
সীমন্তিনী এবার বলল, “অন্য কেউ সুখবর শুনে হাসলেও তোর মত ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে সবসময়ই সুখবর শুনে কাঁদে। আর এর প্রমাণ আমি আগেও বহুবার পেয়েছি। মনে করিয়ে দেব সে’সব কথাগুলো”?
রচনা এবার ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে বলল, “ওহ, দিদিভাই, আমি সত্যি কিন্তু আর নিতে পারছিনে গো। থাক, তোমায় আর কিছু বলতে হবে না। তুমি বরং তোমার দাদাভাইয়ের সাথেই কথা বলো”।
সীমন্তিনী এবার জোরে হেসে বলল, “এতো রাগ করছিস কেন রচু সোনা। তোর আমার মধ্যে সম্পর্ক কি শুধু একটাই? আচ্ছা শোন, আমি আর নীতা আজ সন্ধ্যের সময় ঠিক করেছি যে আমরা আবার অর্চুর বিয়ে দেব”।
ওদিক থেকে বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অর্চনা লজ্জায় নবনীতার পেছনে মুখ লুকালো। সীমন্তিনীও ইচ্ছে করেই চুপ করে থেকে নবনীতা আর অর্চনাকে দেখতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে রচনা প্রায় ভেঙে যাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কি বলছ তুমি দিদিভাই? তোমরা দিদির আবার বিয়ে দিতে চাইছ”?
সীমন্তিনী এবার বলল, “হ্যাঁ, আমি নীতা লক্ষ্মীদি সবাই এটাই চাইছি। তুই চাইছিস না”?
রচনা এবার খুব ভারী গলায় বলল, “কিন্তু দিদিভাই, এ কি সত্যি সম্ভব হবে? না, তুমি আমার সাথে মজা করছ? দিদি যে বিধবা গো”।
সীমন্তিনী এবার ধমকের সুরে বলল, “আজেবাজে কথা বলিসনে তো রচু। আমি একদম মজা করছিনা তোর সাথে। আর কী বলছিস তুই? বিধবা? অর্চু বিধবা? কিসের বিধবা রে? ওটা কি একটা বিয়ে ছিল? তুই জানিস? অর্চু শারীরিক ভাবে এখনও একটা কূমারী মেয়ে। ওই বাদল আচার্যি কি ওর স্বামী ছিল কখনও”?
রচনা এবার প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, “জানি গো দিদিভাই। কালচিনি হাসপাতালেই দিদি আমাকে ওর ওই সাতটা বছরের প্রায় সব কথাই খুলে বলেছিল। আর দিদির ভবিষ্যৎ নিয়ে যে আমি কিছু ভাবিনি তাও নয়। কিন্তু দিদিভাই, সমাজ সংসারের চোখে তো ও বিধবাই। ', ঘরের বিধবাদের কি চট করে বিয়ে হয়? অন্ততঃ কোন ', ছেলে তো বিধবা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবেই না”?
সীমন্তিনী আবার মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠল, “চুপ কর তো তুই। তুই কি দুনিয়ার সমস্ত লোকের মনের খবর জেনে বসে আছিস নাকি? ', হোক, অ', হোক, কোন একটা ভাল ছেলের সাথেই আমি অর্চুর বিয়ে দেব। এ আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আর শোন রচু, তোকে একটা কাজ করতে হবে। আমি অনেক ক’টা কাজ নিয়ে একসাথে হিমশিম খাচ্ছি। কোনটা ছেড়ে কোনটা আগে করবো, সেটা ঠিক করতে পারছি না। তাই আমি চাই, তুই আগে দাদাভাইয়ের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ কর। তারপর মাসি মেসোর সাথে কথা বল। মাসি মেসোকে যে করেই হোক রাজি করাতে হবে। অর্চুকে সারাটা জীবন আমি এভাবে কিছুতেই কাটাতে দেব না। আমার হাতের জরুরী কয়েকটা কাজ শেষ করে তারপর আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে ফাইনালি কিছু একটা করবো। এই ধর আর দিন সাতেক পর আমি এদিকে মন দিতে পারব। কিন্তু আমি চাই এই সপ্তাহ খানেকের ভেতর তুই মা, বাবা, ভাই আর দাদাভাইয়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভালভাবে আলোচনা কর। আর তাদের কার কী মত, সেটা জানতে চেষ্টা কর। আর আমাকে জানাস। বুঝেছিস? এবার ফোনটা দাদাভাইকে দে”।
এবার ও’পাশ থেকে রতীশ বলল “হ্যাঁ মন্তি, আমি তোর সব কথাই শুনেছি। আমার মনে হচ্ছে তুই খুব ভাল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। কিন্তু কালচিনির বাড়ির কার কি মত হবে জানিনা। তবে রচুর যে এতে কোন আপত্তি থাকবেই না, এটা ধরে নিতে পারিস। তোর পরামর্শ রচু মানবে না এ কি কখনও হতে পারে? আর তুই যেমন বললি, আমরা সেভাবেই কাল পরশুর ভেতরেই কালচিনির সকলের সাথে কথা বলব। আর তাদের মতামত তোকে জানাব”।
সীমন্তিনী এবার শান্ত গলায় বলল, “ঠিক আছে রে দাদাভাই। তা আমার ছিঁচকাঁদুনে সোনাটা কি করছে রে? আমি বকেছি বলে কাঁদছে নাকি”?
রতীশ জবাব দিল, “কাঁদছে তো বটেই। তুই তো ওকে ভাল করেই চিনিস। কিন্তু তুই ও নিয়ে ভাবিস নে। আমি ওকে সামলে নেব”।
সীমন্তিনী কিছু বলার আগেই ও’পাশ থেকে রচনাই কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সকলের সবকিছুর দিকে তোমার নজর আছে। তুমি সকলের ভাল করতে চাও, করেও যাচ্ছ। কিন্তু যাকে আমি সবচেয়ে বেশী ভালবাসি, আমার সেই দিদিভাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েই শুধু ভাবছ না তুমি। কেন দিদিভাই, তুমি কেন এমন করছ বলো তো? না চাইতেই তুমি একের পর এক কত কিছু করে যাচ্ছ আমাদের জন্যে, আমার মা বাবা ভাই বোনদের জন্যে। গত চারটে বছর থেকে আমি তোমার কাছে যে জিনিসটা চাইছি, সেটা আমায় দিতে চাইছ না কেন? নিজের জন্যে কি তুমি এখনও কিছু ভাববে না”?
রচনার কথার কোন জবাব না দিয়ে সীমন্তিনী রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদাভাই, মহিমা বৌদির খবর কী রে? আর এসেছিলেন তোদের ওখানে”?
রতীশ জবাব দিল, “না বৌদি আর এরমধ্যে আমাদের ফ্ল্যাটে আসেননি। তবে রচুর সাথে রোজই অন্ততঃ একবার হলেও ফোনে কথা বলেন। আর আমার সাথে বৃহস্পতি বার বাদে সব দিনই তো দেখা হয় ইনস্টিটিউটে। উনিও বেশ ভালই আছেন। তবে ইদানীং ওনাকে বেশ চিন্তিত আর অন্যমনস্ক লাগে মাঝে মাঝে। মনে হয় কিছু একটা নিয়ে উনি ভীষণভাবে উদ্বিঘ্ন। কিন্তু জানতে চাইলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে অন্য কথা পেড়ে বসেন”।
সীমন্তিনী আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “আচ্ছা দাদাভাই। যে’কথাটা বললুম, সেটা নিয়ে আগে রচুর সাথে ফুরসতে বসে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করবি। তারপর মাসি মেসোদের সাথে আলাপ করে আমাকে জানাস। আর শোন। আমাকে এখনই আবার একটা দরকারী ফোন করতে হবে একজনকে। বেশী রাত হয়ে গেলে তাকে আর লাইনে পাব না। তাই এখন ছাড়ছি, কেমন”?
রতীশ তড়িঘড়ি বলল, “আচ্ছা সে ঠিক আছে মন্তি। কিন্তু অর্চুদি আর নীতাদি কেমন আছে রে? ওনারা দু’জনে ভাল আছেন তো”?
সীমন্তিনী তাড়াতাড়িই জবাব দিল, “হ্যারে দাদাভাই। ওরা দুজনেই ঠিক আছে। আচ্ছা পরে আবার কথা হবে” বলেই ফোন কেটে দিল।
******************
দেয়াল ঘড়ির দিকে দেখে সীমন্তিনী বলল, “ইশ দেরী হয়ে গেল রে। এখনই তো আবার লক্ষ্মীদি খেতে ডাকবে। আচ্ছা অর্চু, নীতা তোরা শোন। আমাকে একটা খুব জরুরী কাজ নিয়ে বসতে হবে এখনই। তাই আজ খাবার খেয়ে আমি সে কাজটা নিয়ে বসব। তোরা গিয়ে লক্ষ্মীদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে তাড়াতাড়ি খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেল প্লীজ”।
কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই সীমন্তিনী খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে যেতে যেতে বলল, “তোমরা সবাই সব কিছু গুটিয়ে গুছিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি কাজে বসছি। কাল সকালে দেখা হবে, গুডনাইট” বলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সবার আগে বিছানাটা পরিস্কার করল। ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে সাইড টেবিলের ওপরে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিল। তারপর নিজের পার্সোনাল মোবাইল থেকে মহিমার নম্বর ডায়াল করল। মাত্র দু’বার রিং হতেই ও’পাশ থেকে মহিমার সাড়া পাওয়া গেল, “ইশ রোজ তোমার ফোনের আশায় বসে থাকি। কিন্তু আজ এগারো দিন পর তোমার ফোন পেলাম মন্তি। আচ্ছা আগে আসল কথাটা বলো তো? কোন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছ তুমি”?
সীমন্তিনী বলল, “উপায় যে খুঁজে বের করতে পেরেছি ঠিক তা নয় বৌদি। তবে অনেক রকম ভাবেই ভেবে ভেবে কয়েকটা উপায় বের করেছি ঠিকই। কিন্তু কোনটাই ঠিক পারফেক্ট হচ্ছে না। ওই লোকটা এতই ক্ষমতাশালী যে ওকে জব্দ করাটা অত সহজ কাজ নয় মোটেও। তবে আমি ইতিমধ্যেই দাদাভাই আর রচুর ওপর নজর রাখবার জন্যে কিছু সিকিউরিটির বন্দোবস্ত করেছি। আর বিমলের পেছনেও লোক লাগিয়েছি। ওর ব্যাপারে অনেক খবরাখবরও যোগার করেছি। লোকটার যে প্রচুর ব্ল্যাকমানি আছে সেটা জানতে পেরেছি। কিন্তু সরকারি বেসরকারি সমস্ত অফিসে লোকটার এতই প্রভাব আছে যে সিবিআই, ইডি, অ্যান্টিকরাপশন ব্যুরো পর্যন্ত তার পেছনে লেগেও তার কিচ্ছু করতে পারেনি। থানা, পুলিশ, কোর্টের উকিল ব্যরিস্টার এমনকি মিনিস্ট্রি লেভেলেও তার ভাল যোগাযোগ আছে। তাই অনেক ভাবে ভাবা সত্বেও কোনও প্ল্যানই পুরোপুরি নিখুঁত ভাবে সাজাতে পারছি না। তবে তুমি ভেবো না বৌদি। খুব শিগগীরই কোন না কোন উপায় ঠিক বের করে ফেলব। কলকাতায় আমার চেনাজানা কিছু লোকের মাধ্যমেই আমি তার ব্যাপারে খবরাখবর সংগ্রহ করছি। কিন্তু বৌদি লোকটার ব্যাপারে আরো অনেক খবর যোগার করতে হবে। নইলে তাকে কব্জা করা খুব মুস্কিল হবে। আমার বন্ধুবান্ধবেরা সে চেষ্টাই করছে। আমরা এটাও জানতে পেরেছি যে লোকটা প্রায় প্রতিদিনই মেয়েমানুষ নিয়ে স্ফুর্তি করে। আমরা তার সেসব খবরও পাচ্ছি। তার ব্যবসা, বাড়ি আর অফিসের ব্যাপারেও অনেক কিছু জানতে পারছি। প্রায় রোজই নতুন নতুন খবর আমার কাছে আসছে। তাই আশা করছি, খুব শিগগীরই আমরা একটা নিখুঁত প্ল্যান বানিয়ে ফেলতে পারব। আচ্ছা বৌদি, তুমি কি তার ব্যাপারে আর কিছু খবরাখবর দিতে পারো আমাকে? যে কোন ব্যাপারে”।
মহিমা একটু মনমরা হয়ে জবাব দিল, “জানি মন্তি, কাজটা তোমার পক্ষেও অতটা সহজ হবে না। বিমল সবদিকে আটঘাট বেঁধেই সব কিছু করে। তবে তুমি এত দুরে থেকেও এ’ কদিনেই যে তার সম্পর্কে এত খবরাখবর যোগার করেছ, সেটাও মুখের কথা নয়। আর তুমি যে রচু আর রতীশের ওপর নজর রাখবার জন্যে সিকিউরিটির বন্দোবস্ত করেছ সেটা শুনে আমি কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারছি। আমার সব সময়েই ভয় হয় যে আমার অপেক্ষায় না থেকে বিমল বোধহয় অন্য কাউকে দিয়ে রচনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি এতসব করলে কী করে বলো তো”?
সীমন্তিনী বললো, “আমার পক্ষে তো আর কাজ ফেলে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয় বৌদি। যা করছি, তা আমার জানাশুনো হিতৈষী আর বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যেই করছি। আমার এক বন্ধু পুলিশে কাজ করে কলকাতায়। সেও এ ব্যাপারে আমাকে খুব সাহায্য করছে। ওহ, হ্যাঁ বৌদি, একটা কথা মনে পড়ল। সেটা তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখি। আমার ওই পুলিশ অফিসার বন্ধু হয়ত তোমার কাছেও যেতে পারে বিমলের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তুমি তাকে একটু সাহায্য করো”।
মহিমা এবার একটু দ্বিধাগ্রস্ত সুরে বলল, “পুলিশ অফিসার? এর মধ্যে আবার পুলিশকেও জড়িয়ে ফেলেছ তুমি মন্তি? কিন্তু তোমাকে তো আগেই বলেছি যে থানা পুলিশ সব বিমলের হাতের মুঠোয়। ওরা কেউ বিমলের কোন ক্ষতি তো করবেই না, উল্টে বিমলকে সাহায্যই করবে। বিমলের কাছ থেকে প্রত্যেক মাসে মাসে তারা নিয়মিত মোটা টাকার মাসোহারা পায়। ওরাই হয়তো বিমলকে সতর্ক করে দেবে যে তুমি বা আমি ওর বিরূদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করছি। তখন উল্টে আমরাই বিপদে পড়ে যাব। আর তাছাড়া, আমি নিজেও তো একটা অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত আছি। তারা তো আমাকে নাজানি কতভাবে ইন্টারোগেশন করবে। তারা যদি আমার ব্যবসার ব্যাপারে কিছু জেনে ফেলে, তাহলে আমিও তো সমস্যায় পড়ে যাব ভাই”।
সীমন্তিনী মনে মনে হেসে বলল, “না গো বৌদি, এ নিয়ে তুমি একেবারেই কিছু ভেব না। এমন কিছুই হবে না। আমার ওই বন্ধু তোমাকে অন্য কোনভাবেই বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে না। এ ব্যাপারে আমি ওকে খুব ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমাকে সে কোনভাবেই হ্যারাস করবে না। আমার দাদাবৌদির বিপদের কথা জেনেই তাদের সে বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই তো তুমি আমাকে সব খুলে বলেছিলে। তোমাকে কি আমি বিপদে ফেলতে পারি? আমার ওপর সে বিশ্বাসটুকু রেখো। এবার তুমি বলো তো, বিমলের ব্যাপারে আর কিছু নতুন কথা কি তুমি আমাকে জানাতে পারো”?
মহিমা জবাব দিল, “রচুকে বিপদ থেকে বাঁচাতে যা যা বলা দরকার, তার সবকিছু আমি তোমাকে আগেই বলেছি মন্তি। নিজের গোপন ব্যবসার কথাও তোমাকে খুলে বলেছি। কিন্তু তুমি ঠিক কিভাবে ওকে ট্যাকল করবার কথা ভাবছ, তা তো জানিনে ভাই। তবে ওর সম্মন্ধে আমি আরও অনেক কিছুই জানি। যেমন বিমলের অফিসের রেস্ট রুম, যেখানে ও ওর অফিসের মেয়েগুলোর সাথে সময় কাটায়। আচ্ছা মন্তি, তুমি কি জানো? দক্ষিণেশ্বরের দিকে ওর একটা ফার্ম হাউস আছে। সেটার ভ্যালুয়েশন প্রায় এগার কোটি টাকা। ভোগ বিলাসের সব উপকরণই সেখানে মজুত আছে। সেই ফার্ম হাউসের গ্রাউন্ডফ্লোরে বিমলের মাষ্টার বেডরুম। সে বেডরুমে বিমলের একটা সিক্রেট আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার আছে। সেটা অনেকটা ব্যাঙ্কের ভল্টের মত। একেবারে পরোপুরি ব্যাঙ্কের স্ট্রংরুমের টেকনিকে সেটা বানানো। ছোট বা মাঝারি ধরণের ডিনামাইট দিয়েও সেটা ভাঙা যাবে না। ওই চেম্বারের ভেতরে বিমলের একটা বিশাল বড় লোহার সেফ দেয়ালের সাথে ফিক্সড করা আছে। কোটি কোটি দু’নম্বরি টাকা আর তার লেনদেন সংক্রান্ত সব কিছু ডকুমেন্ট সে ওই সেফেই রাখে। একবার আমাকেও সেটা দেখিয়েছিল সে। আর ওই চেম্বারে ঢোকার এমন একটা অদ্ভুত সিস্টেম সে করে রেখেছে যে, সেটা আগে থেকে জানা না থাকলে কারুর পক্ষেই সে চেম্বার খোলা একেবারেই অসম্ভব। একবার ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের লোকেরা মাষ্টার বেডরুমটার তলায় কিছু একটা আছে বুঝতে পেরেও তার রাস্তা খুঁজে পায় নি। বিমল যেবার প্রথম আমাকে কুড়ি লাখ টাকা দিয়েছিল, তখন সে ওই চেম্বারের সেফটা থেকেই টাকা বের করে আমাকে দিয়েছিল। সেদিনই আমি সেটা দেখেছিলাম”।
সীমন্তিনী মনে মনে খুব উৎসুক হলেও স্বরে শান্তভাব রেখেই বলল, “অদ্ভুত সিস্টেম কি রকম”?
মহিমা বলল, “চেম্বারে ঢোকবার দরজাটা মাষ্টার বেডরুমের ভেতরে হলেও সে দরজাটা খুলতে আলাদা আলাদা চার জায়গায় চারটে স্টীলের নব ঘোরাতে হয়। প্রথম নবটা আছে গ্রাউন্ডফ্লোরে বিমলের মাষ্টার বেডরুমের সাথে এটাচড বাথরুমের ভেন্টিলেটরের ঠিক পাশে। সে নবটা ঘোরালে ভেন্টিলেটরে লাগানো কাঁচটা একদিকে সরে যায়। তাই সবাই ভাবে যে ওটা ওই ভেন্টিলেটরটা খোলা বা বন্ধ করবার কাজেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ভেন্টিলেটরের কাঁচটার সঙ্গে চেম্বারের প্রথম লকটাও খুলে যায়। দ্বিতীয় লকটা আছে তিনতলার একটা বাথরুমে। সেখানেও একই ভাবে স্টীলের নব ঘোরালে ওই ভেন্টিলেটরের কাঁচের সাথে সাথে সিক্রেট চেম্বারের দ্বিতীয় লকটাও খুলে যায়। কিন্তু প্রথম নবটা আগে থেকে ঘুরিয়ে না রাখলে দ্বিতীয় নব ঘোরালে শুধু ওই ভেন্টিলেটরের কাঁচটাই সরে যাবে। চেম্বারের দ্বিতীয় লকটা কিন্তু খুলবে না। একই সিস্টেমে আরও দুটো নব পরে ঘোরাতে হয়। তৃতীয় নবটা আছে দু’তলার বাথরুমের ভেন্টিলেটরের পাশে। যেটাতে ভেন্টিলেটরের কাঁচের সাথে চেম্বারের থার্ড লকটা খোলে। আর চতুর্থ নবটা আছে বিমলের মাষ্টার বেডরুমের পশ্চিম দিকের দেয়ালে। তবে সে নবটা এমনি এমনি ঘুরবে না। একটা চাবির সাহায্যে সেটা ঘোরাতে হয়। চাবিটা খুব একটা বড় নয়। ইঞ্চি দেড়েকের মত লম্বা আর চ্যাপ্টা। সেটা ঘোরালে দেয়ালের ভেতর সেট করে রাখা একটা আলমাড়ির পাল্লা খুলে যায়। সবাই ভাবে ওটা আলমারি খোলার নবই। কিন্তু আলমারির পাল্লা খোলার সাথে সাথে চেম্বারের ফোর্থ লকটাও খুলে যায়। এভাবে এক নম্বর দু’নম্বর করে সিরিয়ালি চারটে নবকেই ঘোরাতে হয়। সিকোয়েন্সটা মেইন্টেইন না করে উল্টোপাল্টা করে ঘোরালে শুধু ভেন্টিলেটরের কাচ কিংবা দেয়াল আলমারির পাল্লাই শুধু খুলবে। চেম্বারের লকগুলো একটাও খুলবে না। সঠিক সিরিয়ালে নবগুলো ঘোরালে যেমন চার নম্বর নবের পরে দেয়ালের আলমারির পাল্লা খোলার সাথে সাথে চেম্বারের চার নম্বর লকটা খুলে যায়, তখন সাথে সাথে পশ্চিম দেয়ালের কোনার দিকে দেয়ালের একটা বিশেষ অংশ পেছন দিকে হেলে পড়ে আস্তে আস্তে। গোড়াটা দেয়ালের গোঁড়ার ফ্লোরের সাথে সেঁটে থাকে আর মাথার দিকটা ভেতরে ঢুকে নিচের দিকে নেমে গিয়ে একটা ঢালু স্ল্যাবের মত হয়ে যায়। সে স্ল্যাবের ওপর দিয়ে নেমে গেলেই নিচের চেম্বারে পৌঁছে যাওয়া যায়। ওই চেম্বারে প্রায় সাত ফুট উঁচু আর অনেকটা চওড়া একটা বড় গোদরেজের সেফ আছে। সেটা কংক্রীটের দেয়ালের সাথে সেঁটে দেওয়া। সেফের পাল্লাটা ভীষণ ভারী। একজন পুরুষের শরীরের পুরোটা শক্তি প্রয়োগ করেই সেটা খোলা যায়। একটা প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা চাবির সাহায্যে এটা খুলতে হয়। আর এ চাবিটা এবং ওই চার নম্বর নবের চ্যাপ্টা চাবিটা, দুটোই বিমল তার অফিসের লকারে রাখে। এর আগে একবার এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা এসে নব গুলোর হদিশ পেলেও চেম্বারের দরজা তারা খুলতে পারে নি। হয়তো যে নবটা পরে ঘোরাবার কথা সেটা আগে ঘুরিয়েছিল, সিকোয়েন্সটা মেনটেন করেনি। তাই চেম্বারের দরজা খোলে নি। ভেন্টিলেটরের কাঁচ আর দেয়াল আলমারির পাল্লাই শুধু খুলেছিল। কিন্তু ওই আলমারিতে শুধু কিছু কাপড় চোপড়ই তারা দেখতে পেয়েছিল। তাই চেম্বারের খবর জানা থাকলেও, সেটাকে তারা আর খুঁজে বের করতে পারেনি। আর সেফটার অস্তিত্বও তারা জানতে পারেনি”।
______________________________
রাত সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছিল। নবনীতা সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “ও দিদি, আমার যে আর তর সইছে না গো। এবার তাহলে মাসি মেসোর সাথে কথা বলো। নাকি বৌদিকেই আগে ফোন করবে”?
সীমন্তিনী একটু একটু ভাবতে ভাবতে বলল, “আমি যে কোনটা ছেড়ে কোনটা করি, সেটাই তো ভেবে পাচ্ছিনা রে নীতা। একদিকে দাদাভাই আর রচুকে নিয়ে ভাবছি, একদিকে বাড়ি তৈরীর কথা ভাবছি, একদিকে পরিতোষের কাজ নিয়ে ভাবছি, একদিকে ভাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি, একদিকে বীথিকার কথা, একদিকে মহিমা বৌদিকে নিয়ে ভাবছি। এখন আবার অর্চুর ব্যাপারটা নিয়েও ভাবতে হবেই। তবে ভাইয়ের ভবিষ্যৎ পড়াশোনার ব্যাপারে মাস দুয়েক বাদে ভাবলেও চলবে। আর অর্চুর ব্যাপারেও তড়িঘড়ি করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের এগোতে হবে। তাই এ দুটো ব্যাপার নিয়ে এখনই কিছু করতে চাইছি না আমি। এখন সবচেয়ে আগে আমাকে দাদাভাই আর রচুকে বিপদমুক্ত করা দরকার। আর এর সাথেই জড়িয়ে রয়েছে পরিতোষের কাজ। আর মহিমা বৌদির ব্যাপারেও আমাকে এখনই কিছু একটা ভাবতে হবে। দিন দুয়েকের ভেতরেই একটা প্ল্যান আমাকে বানিয়ে ফেলতে হবে। আর বাড়ি তৈরীর ব্যাপারটাও আমাকে একই সাথে প্ল্যান করে ফেলতে হবে। অবশ্য ফাইনাল না হলেও একটা আনুমানিক আন্দাজ মিঃ অধিকারী আমাকে দিয়েছেন। সেই মতে টাকার আয়োজনটা করতে পারলেই হয়ে যাবে। বাড়ির কনস্ট্রাকশনের কাজ তো পূজোর আগে আর করছি না। তাই ওটা নিয়ে এখন আর কিছু না ভাবলেও চলবে। আমাকে এখন সবচেয়ে আগে যে কাজটা করতে হবে, সেটা হল মহিমা বৌদির ব্যাপারটা। তাই আজকালের মধ্যেই তার সাথে একবার দেখা করতে পারলে খুব ভাল হত। কিন্তু সেটা করতে হলে তো আমাকে আবার কলকাতা যেতে হবে। সেটাও তো এ মূহুর্তেই সম্ভব হচ্ছে না। আর তার আগেও আমাকে মহিমা বৌদির ওই ব্যবসার ব্যাপারে আরও অনেক কথা জেনে নেওয়া দরকার। কিন্তু আমার সাথে তার পরিচয় তো সবে হল। ওই সমস্ত গোপন ব্যাপার সে কি আমার কাছে এত তাড়াতাড়ি খুলে বলতে চাইবে? ওদিকে পরিতোষও হয়ত তোর ম্যাডামের কাছে যেতে পারে কিছু ইনফর্মেশন নিতে। তাই বিমল আগরওয়ালার অপারেশন শেষ হবার আগেই মহিমা বৌদিকে নিয়ে আমার ফাইনাল প্ল্যানটা চক আউট করে ফেলা খুবই দরকার। আর সেটাই আমাকে এখন সবচেয়ে আগে করে ......”
মোবাইল বেজে উঠতেই সীমন্তিনীর কথা থেমে গেল। অর্চনা সীমন্তিনীর মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “রচু ফোন করেছে, নাও দিদিভাই”।
কিন্তু সীমন্তিনী ফোনটা না নিয়ে বিছানা থেকে নেমে বলল, “তুই কথা বলতে থাক অর্চু। আমি বাথরুমে না গিয়ে আর থাকতে পারছিনা। ওকে বলিস আমি ফিরে এসে কথা বলছি। তোরা দু’জন ততক্ষণ কথা বলতে থাক” বলতে বলতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
টয়লেটের কাজ সেরে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কিছু একটা নিয়ে ভাবল। প্রায় মিনিট সাতেক বাদে হাতমুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। তখন নীতা ফোনে রচুকে বলছে, “সে’কথাটা আমি বা অর্চু জানলেও তোমাকে এখনই সেটা বলব না বৌদি। আচ্ছা তুমিই বলো তো? এমন একটা সুখবর তুমি আমাদের মুখ থেকে শুনতে চাও? না তোমাদের দিদিভাইয়ের মুখ থেকে শুনতে চাও”?
ফোনের স্পীকার অন থাকাতে রচনার জবাবও শুনতে পেল সীমন্তিনী বিছানায় এসে বসতে বসতে। রচনা নবনীতার প্রশ্নের জবাবে বলছে, “কিন্তু তোমরাই তো বলছ যে দিদিভাই বাথরুমে আছেন। কতক্ষণ হয়ে গেল, উনি বেরোচ্ছেন না কেন গো? এই দিদি, তুই বাইরে থেকে দিদিভাইকে বল না যে আমি ফোন করেছি। এ’কথা শুনলেই উনি বেরিয়ে আসবেন দেখিস”।
সীমন্তিনীকে দেখে নবনীতা দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিয়ে ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। সীমন্তিনী ফোনটা হাতে ধরে রেখেই জবাব দিল, “ডাকতে হবেনা রে রচু সোনা। আমি এসে গেছি। বল কি বলছিলিস? তার আগে বল তোরা দুটিতে কেমন আছিস”?
রচনা জবাব দিল, “আমরা সবাই ভাল আছি দিদিভাই। কিন্তু নীতাদি কী বলছিল বলো তো? কিসের সুখবর আছে আমার জন্যে”?
সীমন্তিনী বলল, “ও এই বদমাশদুটো তোকে বুঝি সব বলে দিয়েছে”?
রচনা বলল, “না দিদিভাই, তেমন কিছুই বলেনি। শুধু বলল তোমার কাছ থেকে আমি নাকি আজ একটা সুখবর পাবো। আর বলল যে তারা সেটা জানলেও তুমি আমাকে সেটা না বলা পর্যন্ত তারা আমাকে কিছু বলবেন না”।
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “তুই কি চাস বল তো? তুই সত্যি আমার মুখ থেকে না শুনে সেটা নীতা বা অর্চুর কাছ থেকে শুনতে চাস”?
রচনা অধৈর্য হয়ে বলল, “আমি তো তোমার মুখ থেকেই সেটা শুনতে চাই। কিন্তু তুমি তো আধঘন্টা ধরে বাথরুমে গিয়েই বসে আছ”।
সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুই যদি এই মূহুর্তে আমার হাতের কাছ থাকতিস, তাহলে তোকে মজা দেখাতুম। দুষ্টু মেয়ে। সাত মিনিটও লাগেনি আমার বাথরুম সেরে বেরোতে, আর তুই বলছিস আধঘন্টা ধরে ঢুকে বসে আছি”?
রচনা নিজের ভুল স্বীকার করে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ঘাট হয়েছে আমার। এবার আসল কথাটা বলো তো”?
সীমন্তিনী বললো, “হ্যাঁ বলছি, কিন্তু দাদাভাইকেও তোর সাথে থাকতে বল। তুই কেঁদে ফেললে সে যেন তোকে সামলাতে পারে”।
রচনা বলল, “উঃ দিদিভাই, সুখবর শুনে কি কেউ কাঁদে? আমি কাঁদব না। আর তোমার দাদাভাইও আমার সাথেই বসে আছেন। আর আমাদের সব কথা শুনছেনও। এবার দয়া করে বলবে? সুখবরটা কী”?
সীমন্তিনী এবার বলল, “অন্য কেউ সুখবর শুনে হাসলেও তোর মত ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে সবসময়ই সুখবর শুনে কাঁদে। আর এর প্রমাণ আমি আগেও বহুবার পেয়েছি। মনে করিয়ে দেব সে’সব কথাগুলো”?
রচনা এবার ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে বলল, “ওহ, দিদিভাই, আমি সত্যি কিন্তু আর নিতে পারছিনে গো। থাক, তোমায় আর কিছু বলতে হবে না। তুমি বরং তোমার দাদাভাইয়ের সাথেই কথা বলো”।
সীমন্তিনী এবার জোরে হেসে বলল, “এতো রাগ করছিস কেন রচু সোনা। তোর আমার মধ্যে সম্পর্ক কি শুধু একটাই? আচ্ছা শোন, আমি আর নীতা আজ সন্ধ্যের সময় ঠিক করেছি যে আমরা আবার অর্চুর বিয়ে দেব”।
ওদিক থেকে বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অর্চনা লজ্জায় নবনীতার পেছনে মুখ লুকালো। সীমন্তিনীও ইচ্ছে করেই চুপ করে থেকে নবনীতা আর অর্চনাকে দেখতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে রচনা প্রায় ভেঙে যাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কি বলছ তুমি দিদিভাই? তোমরা দিদির আবার বিয়ে দিতে চাইছ”?
সীমন্তিনী এবার বলল, “হ্যাঁ, আমি নীতা লক্ষ্মীদি সবাই এটাই চাইছি। তুই চাইছিস না”?
রচনা এবার খুব ভারী গলায় বলল, “কিন্তু দিদিভাই, এ কি সত্যি সম্ভব হবে? না, তুমি আমার সাথে মজা করছ? দিদি যে বিধবা গো”।
সীমন্তিনী এবার ধমকের সুরে বলল, “আজেবাজে কথা বলিসনে তো রচু। আমি একদম মজা করছিনা তোর সাথে। আর কী বলছিস তুই? বিধবা? অর্চু বিধবা? কিসের বিধবা রে? ওটা কি একটা বিয়ে ছিল? তুই জানিস? অর্চু শারীরিক ভাবে এখনও একটা কূমারী মেয়ে। ওই বাদল আচার্যি কি ওর স্বামী ছিল কখনও”?
রচনা এবার প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, “জানি গো দিদিভাই। কালচিনি হাসপাতালেই দিদি আমাকে ওর ওই সাতটা বছরের প্রায় সব কথাই খুলে বলেছিল। আর দিদির ভবিষ্যৎ নিয়ে যে আমি কিছু ভাবিনি তাও নয়। কিন্তু দিদিভাই, সমাজ সংসারের চোখে তো ও বিধবাই। ', ঘরের বিধবাদের কি চট করে বিয়ে হয়? অন্ততঃ কোন ', ছেলে তো বিধবা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবেই না”?
সীমন্তিনী আবার মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠল, “চুপ কর তো তুই। তুই কি দুনিয়ার সমস্ত লোকের মনের খবর জেনে বসে আছিস নাকি? ', হোক, অ', হোক, কোন একটা ভাল ছেলের সাথেই আমি অর্চুর বিয়ে দেব। এ আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আর শোন রচু, তোকে একটা কাজ করতে হবে। আমি অনেক ক’টা কাজ নিয়ে একসাথে হিমশিম খাচ্ছি। কোনটা ছেড়ে কোনটা আগে করবো, সেটা ঠিক করতে পারছি না। তাই আমি চাই, তুই আগে দাদাভাইয়ের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ কর। তারপর মাসি মেসোর সাথে কথা বল। মাসি মেসোকে যে করেই হোক রাজি করাতে হবে। অর্চুকে সারাটা জীবন আমি এভাবে কিছুতেই কাটাতে দেব না। আমার হাতের জরুরী কয়েকটা কাজ শেষ করে তারপর আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে ফাইনালি কিছু একটা করবো। এই ধর আর দিন সাতেক পর আমি এদিকে মন দিতে পারব। কিন্তু আমি চাই এই সপ্তাহ খানেকের ভেতর তুই মা, বাবা, ভাই আর দাদাভাইয়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভালভাবে আলোচনা কর। আর তাদের কার কী মত, সেটা জানতে চেষ্টা কর। আর আমাকে জানাস। বুঝেছিস? এবার ফোনটা দাদাভাইকে দে”।
এবার ও’পাশ থেকে রতীশ বলল “হ্যাঁ মন্তি, আমি তোর সব কথাই শুনেছি। আমার মনে হচ্ছে তুই খুব ভাল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। কিন্তু কালচিনির বাড়ির কার কি মত হবে জানিনা। তবে রচুর যে এতে কোন আপত্তি থাকবেই না, এটা ধরে নিতে পারিস। তোর পরামর্শ রচু মানবে না এ কি কখনও হতে পারে? আর তুই যেমন বললি, আমরা সেভাবেই কাল পরশুর ভেতরেই কালচিনির সকলের সাথে কথা বলব। আর তাদের মতামত তোকে জানাব”।
সীমন্তিনী এবার শান্ত গলায় বলল, “ঠিক আছে রে দাদাভাই। তা আমার ছিঁচকাঁদুনে সোনাটা কি করছে রে? আমি বকেছি বলে কাঁদছে নাকি”?
রতীশ জবাব দিল, “কাঁদছে তো বটেই। তুই তো ওকে ভাল করেই চিনিস। কিন্তু তুই ও নিয়ে ভাবিস নে। আমি ওকে সামলে নেব”।
সীমন্তিনী কিছু বলার আগেই ও’পাশ থেকে রচনাই কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সকলের সবকিছুর দিকে তোমার নজর আছে। তুমি সকলের ভাল করতে চাও, করেও যাচ্ছ। কিন্তু যাকে আমি সবচেয়ে বেশী ভালবাসি, আমার সেই দিদিভাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েই শুধু ভাবছ না তুমি। কেন দিদিভাই, তুমি কেন এমন করছ বলো তো? না চাইতেই তুমি একের পর এক কত কিছু করে যাচ্ছ আমাদের জন্যে, আমার মা বাবা ভাই বোনদের জন্যে। গত চারটে বছর থেকে আমি তোমার কাছে যে জিনিসটা চাইছি, সেটা আমায় দিতে চাইছ না কেন? নিজের জন্যে কি তুমি এখনও কিছু ভাববে না”?
রচনার কথার কোন জবাব না দিয়ে সীমন্তিনী রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদাভাই, মহিমা বৌদির খবর কী রে? আর এসেছিলেন তোদের ওখানে”?
রতীশ জবাব দিল, “না বৌদি আর এরমধ্যে আমাদের ফ্ল্যাটে আসেননি। তবে রচুর সাথে রোজই অন্ততঃ একবার হলেও ফোনে কথা বলেন। আর আমার সাথে বৃহস্পতি বার বাদে সব দিনই তো দেখা হয় ইনস্টিটিউটে। উনিও বেশ ভালই আছেন। তবে ইদানীং ওনাকে বেশ চিন্তিত আর অন্যমনস্ক লাগে মাঝে মাঝে। মনে হয় কিছু একটা নিয়ে উনি ভীষণভাবে উদ্বিঘ্ন। কিন্তু জানতে চাইলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে অন্য কথা পেড়ে বসেন”।
সীমন্তিনী আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “আচ্ছা দাদাভাই। যে’কথাটা বললুম, সেটা নিয়ে আগে রচুর সাথে ফুরসতে বসে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করবি। তারপর মাসি মেসোদের সাথে আলাপ করে আমাকে জানাস। আর শোন। আমাকে এখনই আবার একটা দরকারী ফোন করতে হবে একজনকে। বেশী রাত হয়ে গেলে তাকে আর লাইনে পাব না। তাই এখন ছাড়ছি, কেমন”?
রতীশ তড়িঘড়ি বলল, “আচ্ছা সে ঠিক আছে মন্তি। কিন্তু অর্চুদি আর নীতাদি কেমন আছে রে? ওনারা দু’জনে ভাল আছেন তো”?
সীমন্তিনী তাড়াতাড়িই জবাব দিল, “হ্যারে দাদাভাই। ওরা দুজনেই ঠিক আছে। আচ্ছা পরে আবার কথা হবে” বলেই ফোন কেটে দিল।
******************
দেয়াল ঘড়ির দিকে দেখে সীমন্তিনী বলল, “ইশ দেরী হয়ে গেল রে। এখনই তো আবার লক্ষ্মীদি খেতে ডাকবে। আচ্ছা অর্চু, নীতা তোরা শোন। আমাকে একটা খুব জরুরী কাজ নিয়ে বসতে হবে এখনই। তাই আজ খাবার খেয়ে আমি সে কাজটা নিয়ে বসব। তোরা গিয়ে লক্ষ্মীদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে তাড়াতাড়ি খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেল প্লীজ”।
কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই সীমন্তিনী খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে যেতে যেতে বলল, “তোমরা সবাই সব কিছু গুটিয়ে গুছিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি কাজে বসছি। কাল সকালে দেখা হবে, গুডনাইট” বলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সবার আগে বিছানাটা পরিস্কার করল। ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে সাইড টেবিলের ওপরে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিল। তারপর নিজের পার্সোনাল মোবাইল থেকে মহিমার নম্বর ডায়াল করল। মাত্র দু’বার রিং হতেই ও’পাশ থেকে মহিমার সাড়া পাওয়া গেল, “ইশ রোজ তোমার ফোনের আশায় বসে থাকি। কিন্তু আজ এগারো দিন পর তোমার ফোন পেলাম মন্তি। আচ্ছা আগে আসল কথাটা বলো তো? কোন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছ তুমি”?
সীমন্তিনী বলল, “উপায় যে খুঁজে বের করতে পেরেছি ঠিক তা নয় বৌদি। তবে অনেক রকম ভাবেই ভেবে ভেবে কয়েকটা উপায় বের করেছি ঠিকই। কিন্তু কোনটাই ঠিক পারফেক্ট হচ্ছে না। ওই লোকটা এতই ক্ষমতাশালী যে ওকে জব্দ করাটা অত সহজ কাজ নয় মোটেও। তবে আমি ইতিমধ্যেই দাদাভাই আর রচুর ওপর নজর রাখবার জন্যে কিছু সিকিউরিটির বন্দোবস্ত করেছি। আর বিমলের পেছনেও লোক লাগিয়েছি। ওর ব্যাপারে অনেক খবরাখবরও যোগার করেছি। লোকটার যে প্রচুর ব্ল্যাকমানি আছে সেটা জানতে পেরেছি। কিন্তু সরকারি বেসরকারি সমস্ত অফিসে লোকটার এতই প্রভাব আছে যে সিবিআই, ইডি, অ্যান্টিকরাপশন ব্যুরো পর্যন্ত তার পেছনে লেগেও তার কিচ্ছু করতে পারেনি। থানা, পুলিশ, কোর্টের উকিল ব্যরিস্টার এমনকি মিনিস্ট্রি লেভেলেও তার ভাল যোগাযোগ আছে। তাই অনেক ভাবে ভাবা সত্বেও কোনও প্ল্যানই পুরোপুরি নিখুঁত ভাবে সাজাতে পারছি না। তবে তুমি ভেবো না বৌদি। খুব শিগগীরই কোন না কোন উপায় ঠিক বের করে ফেলব। কলকাতায় আমার চেনাজানা কিছু লোকের মাধ্যমেই আমি তার ব্যাপারে খবরাখবর সংগ্রহ করছি। কিন্তু বৌদি লোকটার ব্যাপারে আরো অনেক খবর যোগার করতে হবে। নইলে তাকে কব্জা করা খুব মুস্কিল হবে। আমার বন্ধুবান্ধবেরা সে চেষ্টাই করছে। আমরা এটাও জানতে পেরেছি যে লোকটা প্রায় প্রতিদিনই মেয়েমানুষ নিয়ে স্ফুর্তি করে। আমরা তার সেসব খবরও পাচ্ছি। তার ব্যবসা, বাড়ি আর অফিসের ব্যাপারেও অনেক কিছু জানতে পারছি। প্রায় রোজই নতুন নতুন খবর আমার কাছে আসছে। তাই আশা করছি, খুব শিগগীরই আমরা একটা নিখুঁত প্ল্যান বানিয়ে ফেলতে পারব। আচ্ছা বৌদি, তুমি কি তার ব্যাপারে আর কিছু খবরাখবর দিতে পারো আমাকে? যে কোন ব্যাপারে”।
মহিমা একটু মনমরা হয়ে জবাব দিল, “জানি মন্তি, কাজটা তোমার পক্ষেও অতটা সহজ হবে না। বিমল সবদিকে আটঘাট বেঁধেই সব কিছু করে। তবে তুমি এত দুরে থেকেও এ’ কদিনেই যে তার সম্পর্কে এত খবরাখবর যোগার করেছ, সেটাও মুখের কথা নয়। আর তুমি যে রচু আর রতীশের ওপর নজর রাখবার জন্যে সিকিউরিটির বন্দোবস্ত করেছ সেটা শুনে আমি কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারছি। আমার সব সময়েই ভয় হয় যে আমার অপেক্ষায় না থেকে বিমল বোধহয় অন্য কাউকে দিয়ে রচনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি এতসব করলে কী করে বলো তো”?
সীমন্তিনী বললো, “আমার পক্ষে তো আর কাজ ফেলে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয় বৌদি। যা করছি, তা আমার জানাশুনো হিতৈষী আর বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যেই করছি। আমার এক বন্ধু পুলিশে কাজ করে কলকাতায়। সেও এ ব্যাপারে আমাকে খুব সাহায্য করছে। ওহ, হ্যাঁ বৌদি, একটা কথা মনে পড়ল। সেটা তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখি। আমার ওই পুলিশ অফিসার বন্ধু হয়ত তোমার কাছেও যেতে পারে বিমলের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তুমি তাকে একটু সাহায্য করো”।
মহিমা এবার একটু দ্বিধাগ্রস্ত সুরে বলল, “পুলিশ অফিসার? এর মধ্যে আবার পুলিশকেও জড়িয়ে ফেলেছ তুমি মন্তি? কিন্তু তোমাকে তো আগেই বলেছি যে থানা পুলিশ সব বিমলের হাতের মুঠোয়। ওরা কেউ বিমলের কোন ক্ষতি তো করবেই না, উল্টে বিমলকে সাহায্যই করবে। বিমলের কাছ থেকে প্রত্যেক মাসে মাসে তারা নিয়মিত মোটা টাকার মাসোহারা পায়। ওরাই হয়তো বিমলকে সতর্ক করে দেবে যে তুমি বা আমি ওর বিরূদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করছি। তখন উল্টে আমরাই বিপদে পড়ে যাব। আর তাছাড়া, আমি নিজেও তো একটা অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত আছি। তারা তো আমাকে নাজানি কতভাবে ইন্টারোগেশন করবে। তারা যদি আমার ব্যবসার ব্যাপারে কিছু জেনে ফেলে, তাহলে আমিও তো সমস্যায় পড়ে যাব ভাই”।
সীমন্তিনী মনে মনে হেসে বলল, “না গো বৌদি, এ নিয়ে তুমি একেবারেই কিছু ভেব না। এমন কিছুই হবে না। আমার ওই বন্ধু তোমাকে অন্য কোনভাবেই বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে না। এ ব্যাপারে আমি ওকে খুব ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমাকে সে কোনভাবেই হ্যারাস করবে না। আমার দাদাবৌদির বিপদের কথা জেনেই তাদের সে বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই তো তুমি আমাকে সব খুলে বলেছিলে। তোমাকে কি আমি বিপদে ফেলতে পারি? আমার ওপর সে বিশ্বাসটুকু রেখো। এবার তুমি বলো তো, বিমলের ব্যাপারে আর কিছু নতুন কথা কি তুমি আমাকে জানাতে পারো”?
মহিমা জবাব দিল, “রচুকে বিপদ থেকে বাঁচাতে যা যা বলা দরকার, তার সবকিছু আমি তোমাকে আগেই বলেছি মন্তি। নিজের গোপন ব্যবসার কথাও তোমাকে খুলে বলেছি। কিন্তু তুমি ঠিক কিভাবে ওকে ট্যাকল করবার কথা ভাবছ, তা তো জানিনে ভাই। তবে ওর সম্মন্ধে আমি আরও অনেক কিছুই জানি। যেমন বিমলের অফিসের রেস্ট রুম, যেখানে ও ওর অফিসের মেয়েগুলোর সাথে সময় কাটায়। আচ্ছা মন্তি, তুমি কি জানো? দক্ষিণেশ্বরের দিকে ওর একটা ফার্ম হাউস আছে। সেটার ভ্যালুয়েশন প্রায় এগার কোটি টাকা। ভোগ বিলাসের সব উপকরণই সেখানে মজুত আছে। সেই ফার্ম হাউসের গ্রাউন্ডফ্লোরে বিমলের মাষ্টার বেডরুম। সে বেডরুমে বিমলের একটা সিক্রেট আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার আছে। সেটা অনেকটা ব্যাঙ্কের ভল্টের মত। একেবারে পরোপুরি ব্যাঙ্কের স্ট্রংরুমের টেকনিকে সেটা বানানো। ছোট বা মাঝারি ধরণের ডিনামাইট দিয়েও সেটা ভাঙা যাবে না। ওই চেম্বারের ভেতরে বিমলের একটা বিশাল বড় লোহার সেফ দেয়ালের সাথে ফিক্সড করা আছে। কোটি কোটি দু’নম্বরি টাকা আর তার লেনদেন সংক্রান্ত সব কিছু ডকুমেন্ট সে ওই সেফেই রাখে। একবার আমাকেও সেটা দেখিয়েছিল সে। আর ওই চেম্বারে ঢোকার এমন একটা অদ্ভুত সিস্টেম সে করে রেখেছে যে, সেটা আগে থেকে জানা না থাকলে কারুর পক্ষেই সে চেম্বার খোলা একেবারেই অসম্ভব। একবার ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের লোকেরা মাষ্টার বেডরুমটার তলায় কিছু একটা আছে বুঝতে পেরেও তার রাস্তা খুঁজে পায় নি। বিমল যেবার প্রথম আমাকে কুড়ি লাখ টাকা দিয়েছিল, তখন সে ওই চেম্বারের সেফটা থেকেই টাকা বের করে আমাকে দিয়েছিল। সেদিনই আমি সেটা দেখেছিলাম”।
সীমন্তিনী মনে মনে খুব উৎসুক হলেও স্বরে শান্তভাব রেখেই বলল, “অদ্ভুত সিস্টেম কি রকম”?
মহিমা বলল, “চেম্বারে ঢোকবার দরজাটা মাষ্টার বেডরুমের ভেতরে হলেও সে দরজাটা খুলতে আলাদা আলাদা চার জায়গায় চারটে স্টীলের নব ঘোরাতে হয়। প্রথম নবটা আছে গ্রাউন্ডফ্লোরে বিমলের মাষ্টার বেডরুমের সাথে এটাচড বাথরুমের ভেন্টিলেটরের ঠিক পাশে। সে নবটা ঘোরালে ভেন্টিলেটরে লাগানো কাঁচটা একদিকে সরে যায়। তাই সবাই ভাবে যে ওটা ওই ভেন্টিলেটরটা খোলা বা বন্ধ করবার কাজেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ভেন্টিলেটরের কাঁচটার সঙ্গে চেম্বারের প্রথম লকটাও খুলে যায়। দ্বিতীয় লকটা আছে তিনতলার একটা বাথরুমে। সেখানেও একই ভাবে স্টীলের নব ঘোরালে ওই ভেন্টিলেটরের কাঁচের সাথে সাথে সিক্রেট চেম্বারের দ্বিতীয় লকটাও খুলে যায়। কিন্তু প্রথম নবটা আগে থেকে ঘুরিয়ে না রাখলে দ্বিতীয় নব ঘোরালে শুধু ওই ভেন্টিলেটরের কাঁচটাই সরে যাবে। চেম্বারের দ্বিতীয় লকটা কিন্তু খুলবে না। একই সিস্টেমে আরও দুটো নব পরে ঘোরাতে হয়। তৃতীয় নবটা আছে দু’তলার বাথরুমের ভেন্টিলেটরের পাশে। যেটাতে ভেন্টিলেটরের কাঁচের সাথে চেম্বারের থার্ড লকটা খোলে। আর চতুর্থ নবটা আছে বিমলের মাষ্টার বেডরুমের পশ্চিম দিকের দেয়ালে। তবে সে নবটা এমনি এমনি ঘুরবে না। একটা চাবির সাহায্যে সেটা ঘোরাতে হয়। চাবিটা খুব একটা বড় নয়। ইঞ্চি দেড়েকের মত লম্বা আর চ্যাপ্টা। সেটা ঘোরালে দেয়ালের ভেতর সেট করে রাখা একটা আলমাড়ির পাল্লা খুলে যায়। সবাই ভাবে ওটা আলমারি খোলার নবই। কিন্তু আলমারির পাল্লা খোলার সাথে সাথে চেম্বারের ফোর্থ লকটাও খুলে যায়। এভাবে এক নম্বর দু’নম্বর করে সিরিয়ালি চারটে নবকেই ঘোরাতে হয়। সিকোয়েন্সটা মেইন্টেইন না করে উল্টোপাল্টা করে ঘোরালে শুধু ভেন্টিলেটরের কাচ কিংবা দেয়াল আলমারির পাল্লাই শুধু খুলবে। চেম্বারের লকগুলো একটাও খুলবে না। সঠিক সিরিয়ালে নবগুলো ঘোরালে যেমন চার নম্বর নবের পরে দেয়ালের আলমারির পাল্লা খোলার সাথে সাথে চেম্বারের চার নম্বর লকটা খুলে যায়, তখন সাথে সাথে পশ্চিম দেয়ালের কোনার দিকে দেয়ালের একটা বিশেষ অংশ পেছন দিকে হেলে পড়ে আস্তে আস্তে। গোড়াটা দেয়ালের গোঁড়ার ফ্লোরের সাথে সেঁটে থাকে আর মাথার দিকটা ভেতরে ঢুকে নিচের দিকে নেমে গিয়ে একটা ঢালু স্ল্যাবের মত হয়ে যায়। সে স্ল্যাবের ওপর দিয়ে নেমে গেলেই নিচের চেম্বারে পৌঁছে যাওয়া যায়। ওই চেম্বারে প্রায় সাত ফুট উঁচু আর অনেকটা চওড়া একটা বড় গোদরেজের সেফ আছে। সেটা কংক্রীটের দেয়ালের সাথে সেঁটে দেওয়া। সেফের পাল্লাটা ভীষণ ভারী। একজন পুরুষের শরীরের পুরোটা শক্তি প্রয়োগ করেই সেটা খোলা যায়। একটা প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা চাবির সাহায্যে এটা খুলতে হয়। আর এ চাবিটা এবং ওই চার নম্বর নবের চ্যাপ্টা চাবিটা, দুটোই বিমল তার অফিসের লকারে রাখে। এর আগে একবার এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা এসে নব গুলোর হদিশ পেলেও চেম্বারের দরজা তারা খুলতে পারে নি। হয়তো যে নবটা পরে ঘোরাবার কথা সেটা আগে ঘুরিয়েছিল, সিকোয়েন্সটা মেনটেন করেনি। তাই চেম্বারের দরজা খোলে নি। ভেন্টিলেটরের কাঁচ আর দেয়াল আলমারির পাল্লাই শুধু খুলেছিল। কিন্তু ওই আলমারিতে শুধু কিছু কাপড় চোপড়ই তারা দেখতে পেয়েছিল। তাই চেম্বারের খবর জানা থাকলেও, সেটাকে তারা আর খুঁজে বের করতে পারেনি। আর সেফটার অস্তিত্বও তারা জানতে পারেনি”।
______________________________