Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 166)

নবনীতা বলল, “দিদি, আমরা যতই ওকে ওই পুরোনো কথাগুলো ভুলে যেতে বলি না কেন, ওর পক্ষে যে সে’গুলো ভুলে যাওয়া একেবারেই সহজ কথা নয়, সেটা আমি নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারি গো। মুখে বলে ফেলাটা খুবই সহজ। কিন্তু সত্যি সত্যি ওর পক্ষে কাজটা যে কতটা কঠিন সেটা আমি বুঝি। তবে নিজেকে দিয়েই বুঝেছি যে ওই কথাগুলো নিজের বুকের ভেতর চেপে না রেখে যদি কারো কাছে খুলে বলা যায়, তাহলে বুকের ভার কিছুটা হলেও হাল্কা হয়। তবু পুরোপুরি ভুলে যাওয়া বোধহয় যায় না। তাই তো আমি আমার সব কথা ওকে আর তোমাকে খুলে বলেছি। ওই দিনগুলো ভুলতে না পারলেও তাতে কিন্তু আমি খুব উপকৃত হয়েছি। এখন কথাগুলো মনে পড়লেও, আগের মত কষ্ট আর হয় না আমার। আর ওর্চুর কথাগুলো নিয়েও আমি অনেক ভেবেছি দিদি। কিন্তু হাজার ভেবেও একটা প্রশ্নের জবাব আমি কিছুতেই পাই নি। আচ্ছা দিদি, ওই বাদল আচার্যি আর ত্রিলোচন আচার্যির উদ্দেশ্যটা কী ছিল বলো তো? মেসোরা যে কোন রকম যৌতুক বা বরপণ দিতে পারবেন না, এ’কথা তো আগেই তাদেরকে বলে দিয়েছিলেন। আর বিয়ের পরেও তারা কিন্তু ছেলে পক্ষের দাবিদাওয়া বা যৌতুকের কথা নিয়ে অর্চুর ওপর কোন অত্যাচার করেনি। শ্বশুর বাড়ির কাছ থেকে কিছু নেবার চেষ্টাও করেনি কখনো। কিন্তু অর্চুকে বাপের বাড়ির কারো সাথে দেখা করতে দিত না তারা। আর অর্চু তেমন মেয়েও নয় যে স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির অন্য লোকদের কথা মেনে চলবে না। আর ও তো খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়ে। কারুর মুখে মুখে কথা বলা বা ঝগড়া করা এসব তো ও করতেই পারে না। বিনাদোষ ওকে শুধু মারধোর করত। এর পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে বলো তো”?

সীমন্তিনী নবনীতার কথার কোন জবাব দেবার আগেই অর্চু নিজেই বলে উঠল, “প্রথম পাঁচ বছর তো আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারিনি নীতাদি। বিয়ের পর থেকে তো একটা দিনের জন্যেও আমি ওকে স্বামীর মত করে পাইনি। পাওয়া তো দুরের কথা, সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি সে তো বাড়ির বাইরেই কাটাত। একটাও কথা বলার সুযোগ পেতুম না। বাড়ি ফিরত রাত বারোটা একটার পর। প্রথম প্রথম তো সে বাড়ি না ফেরা অব্দি আমি না খেয়ে তার অপেক্ষায় জেগে থাকতুম। কিন্তু সে বাইরেই বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে খেয়ে দেয়ে যখন বাড়ি ফিরত, তখন হাতে মদের বোতল নিয়ে এসেই ঘরে ঢুকত। তখন ছেলেরা ঘুমিয়ে না পড়লে তারাও তাদের বাবার সাথে আমার রুমে এসে ঢুকত। যে পাঁচটা বছর লোকটা আমার জীবনে ছিল, আমাকে সে শুধু একটা কথাই বলত। গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢেলে দিতে। প্রথম দিকে দ্বিধা করতুম বলেই বোধহয় আমাকে মারতো। আমি অমনটাই ভেবেছিলুম। কিন্তু তারপর মারের হাত থেকে বাঁচতেই তার আদেশ শুনে আর দ্বিধা করতুম না। তার কথা মতই তিনজনের গ্লাস ভরে দিতুম। কিন্তু তাতেও নিস্তার পেতুম না। আমি গ্লাস ভরে দেবার পরেও একই ভাবে মারধোর করত। মুখে কিচ্ছুটি বলত না। মনে হত আমাকে না মারলে তার গলা দিয়ে বোধহয় ওই বিষ গুলো নামবেই না। কিছুই বুঝতে পারতুম না আমি, কোথায় কী ভুল করছি। আমি যদি জানতে চাইতুম যে আমি কী অন্যায় করেছি, কী ভুল করেছি, তার জবাবেও শুধু মারই খেতুম। মনে হত ওই লোকটা বুঝি ওই একটা কথাই শুধু বলতে শিখেছিল। কেন যে আমাকে সে ওভাবে মারত, কেন আমার সাথে আর অন্য কোন কথাই বলত না, এ’সব প্রশ্নের জবাব কোনদিনই পাইনি আমি। কিন্তু সে চলে যাবার পর অত্যাচারের ধরণ আর কারন একটু বদলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটাও আমি অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম” বলে একটু থামল। তার দু’চোখে বেয়ে অশ্রুর ধারা একনাগাড়ে বয়ে যাচ্ছে।

উদ্গত কান্নাকে চেপে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলল, “এ’কথাটা এতদিন অন্য কাউকে আর আমি বলিনি, বা বলতে পারো বলতে পারিনি। কোর্টেও বলিনি। রচুকেও বলিনি। কিন্তু আজ প্রথমবার তোমাদের সামনে বলছি দিদিভাই। লোকটা চলে যাবার পর শ্বশুর শাশুড়ি আর ছেলেরা একইভাবে আমার ওপর অত্যাচার করত। ছেলে দুটোও রোজ রাতে মদের বোতল নিয়ে আমার ঘরে আসত। আমিও আগের মতই তাদের গ্লাস ভরে ভরে দিতুম। কিন্তু এভাবে দু’ তিন মাস কাটতেই ছেলেরা অন্যভাবে জ্বালাতন করতে শুরু করেছিল। মদ খেয়ে মাতলামি করতে করতে তারা আমার গায়ে হাত দিতে শুরু করেছিল। ওদের মতিগতি সুবিধের নয় দেখেই সন্ধ্যের পর থেকেই আমি ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখতুম। কিন্তু এভাবে রাতের উৎপাত বন্ধ করতে পারলেও দিনের বেলা যখনই ঘর থেকে বেরতুম তখনই আবার তাদের খপ্পরে পড়তুম। নিজের সতীত্ব বাঁচাতে তাই আমি দিনের বেলাতেও ঘর থেকে বেরনো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলুম। মনে মনে ভেবেছিলুম, যা-ই হোক না কেন, ওই লম্পট ছেলেগুলোর কাছে কিছুতেই নিজের সতীত্ব বিসর্জন করব না আমি। তখন থেকেই বলতে গেলে না খেয়ে থাকতে হত আমাকে। শুধু বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলেই ঘর থেকে বেরোতাম। তাও বেরোতাম শুধু তখনই যখন বুঝতে পারতুম যে ছেলেরা বাড়ির বাইরে আছে। কিন্তু যখনই বেরোতাম তখনই শ্বশুর শাশুড়ির গালিগালাজ সহ্য করতে হত। তারাও মাঝে মাঝে মারধোর করত। মা বাবা ভাইদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না। বাবা যে অনেকবার ও বাড়ি গিয়ে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন, এ’কথা তো কালচিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে জানতে পেরেছি আমি। কিন্তু তখন আমি ভেবেছিলুম, এভাবে না খেয়ে না খেয়েই যেন আমি মরে যাই। কিন্তু সেটুকুও করতে পারিনি। না খেয়ে না খেয়ে শরীর যখন দুর্বল হতে শুরু করেছিল আমার, তখন বাথরুমে যাবার সময় বা ফিরে আসবার সময় শ্বশুড় শাশুড়ি দু’জনে মিলে জোর করে আমার মুখে মাঝে মাঝে খাবার ঠুসে দিত। আমাকে তারা না খেয়ে মরতেও দিতে চাইত না। তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরে একদিন যখন কালচিনি থানার ওসির কথায় শ্বশুর আমাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল, সেদিন থানার ওসির মুখে শুনেছিলাম যে আমার স্বামীর প্রভিডেন্ট ফান্ড আর পেনশনের টাকাগুলো সরকারি অফিস থেকে আমাকেই দেওয়া হবে। আর শ্বশুর নিজেরাই সে টাকাগুলো আত্মস্যাৎ করবার প্ল্যান করছে। তখন বুঝতে পেরেছিলুম যে আমি মরে গেলে তারা সে টাকাগুলো পাবে না। তাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখাটা তাদের কাছে খুব জরুরী ছিল। সেদিন থানা থেকে বাড়ি ফিরে আসবার পর থেকে আমাকে আর তারা তেমন মারধোর করতেন না। কিন্তু মৌখিক গালিগালাজ একই রকম চলত। সরকারি অফিস থেকে সে টাকা আদৌ এসেছিল কি না, বা আমার শ্বশুর শাশুড়িই সে টাকা নিয়েছে কিনা, তা আমি আজও জানিনা। তবে তাদের অত্যাচার সইতে না পেরে আমি বেশ কিছু কাগজে আমার সই দিতে বাধ্য হয়েছিলুম। হয়ত তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। আর খুব সম্ভবতঃ যেদিন তারা টাকাগুলো হাতে পেয়েছিল, সেদিন থেকেই তারা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। একটু জলও দিত না। শরীর আমার আগে থেকেই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। চার পাঁচ দিন একেবারে নির্জলা থাকবার পর আমি বোধহয় সেদিন আমার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলুম। তারপর তারা কখন আমার ঘরে ঢুকেছিল, সেটা টেরই পাইনি। দুর্বল শরীরে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েই একটু সময়ের জন্য আমার জ্ঞান ফিরেছিল। তখন দেখেছিলুম দুই ছেলে আর শ্বশুর শাশুড়ি মিলে আমাকে বেধরক মেরে যাচ্ছে। চিৎকার করবার চেষ্টা করেছিলুম। গলা দিয়ে খুব দুর্বল একটু গোঙ্গানীই শুধু বেরিয়েছিল। কিছু বলার আগেই আমি আবার অচেতন হয়ে পড়েছিলুম। তারপর আমার অচেতন দেহটাকে নিয়ে তারা কি করেছে জানিনা। এরপর যখন আমার জ্ঞান ফিরল, তখন আমি কালচিনি হাসপাতালে। ভাইকে আমার পাশে দেখেছিলুম। বাকি কথাটুকু পরে ডাক্তার সোম, মা-বাবা, ভাই আর থানার ওসির কাছ থেকে জানতে পেরেছিলুম” বলে থেমে গেল।

সীমন্তিনী তো আগে থেকেই অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। তার চোখও জলে ভিজে গেছে। লক্ষ্মীও কাঁদছিল। অর্চনা থামতেই লক্ষ্মী বলে উঠল, “ইশ এমন অমানুষও কেউ হতে পারে। কিভাবে এইটুকু একটা নির্দোষ মেয়েকে দিনের পর দিন এভাবে অত্যাচার করে গেছে। তুমি কেঁদো না সোনাদি। ভগবান আছেন তো। ওরা মরার পরে নরকেও বোধহয় জায়গা পাবে না” বলতে বলতে অর্চনার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “আর কেঁদো না। দেরীতে হলেও ভগবান তোমার দিকে তার কৃপা দৃষ্টি তুলে তাকিয়েছেন। তাই তো তুমি এখন আমাদের সাথে আছ। ভগবানের আশীর্বাদে তোমার শরীর এখন সুস্থ হয়ে গেছে। এবার মনটাকে একটু শক্ত করো। তাহলেই তুমি ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারবে”।
 

এবার সীমন্তিনী বলল, “জানিস নীতা, পুলিশ অফিসার হিসেবে ক্রিমিনাল সাইকোলোজি নিয়ে আমাদের অনেক পড়াশোনা করতে হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি তাতে বাদলকে আমি কোন ক্যাটাগরিতেই ফেলতে পারছিনা রে। এমন অদ্ভুত ধরনের মানসিকতার কথা আমি কোন বইয়ে পাইনি। আমার মনে হয় ও একটা মানসিক রোগী ছিল। মানসিক রোগী না হলে এমন অদ্ভুত যুক্তিহীন ব্যবহার সে করতে পারত না। কিন্তু অর্চু সোনা, দেখ যা হবার সেটা তো হয়ে গেছেই। এইটুকু জীবনে অনেক কষ্ট তুই পেয়েছিস বোন। কিন্তু ও’সব কথা নিয়েই সারাটা জীবন তো এভাবে বসে বসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে না। তোর মনে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। তোকে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা তো সবাই তোর পাশে আছিই। যতরকম ভাবে সম্ভব আমরা সবাই তোর পাশে থাকব। তোর সামনে সারাটা জীবনই পড়ে আছে। সুখ, সাধ, আহ্লাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম। ভাল ভাবে বেঁচে থাকবার মত একটা সিকিউরিটির তো খুবই প্রয়োজন। নিজে আরও পড়াশোনা করে একটা চাকরি বাকরি করতে পারলে তুই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতিস। তুই যদি চাস, তাহলে আমি সে ব্যবস্থাও করব। কিন্তু তোর ওপর আমি জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না বোন। তুই নিজেই কয়েকটা দিন ভাল করে ভেবে দেখ। তারপর তোর সিদ্ধান্তটা আমাকে জানাস। আমি তোর ইচ্ছে মতই কাজ করব। তুই যদি আবার কাউকে বিয়ে করতে চাস, তাহলে সেটাই খুলে বলিস আমাকে। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তোর বিয়ে দেব, এ’টুকু কথা আমি তোকে দিতে পারি”।
 

অর্চনা সীমন্তিনীর কোলে মুখ গুঁজে বলল, “পারব না গো দিদিভাই। আমি কিচ্ছুটি ভাবতে পারব না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার কোন ক্ষমতাই নেই আমার। মৃত্যুর মুখে থেকে বেঁচে ফিরে তোমাকে, মা বাবাকে ভাইকে কাছে পেয়েই আমি খুশী। আমি আর কিচ্ছু জানিনে গো। কিচ্ছু জানিনে”।

নবনীতা অর্চুর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “দিদি, আমার মনে হচ্ছে এ’সব ব্যাপারে ভাববার মত ইচ্ছেটাই ওর ভেতরে নেই। ও ভেতরে ভেতরে পুরোপুরি ভেঙে গেছে। আমার মনে হয়, কালচিনির মাসি মেসোর সাথেই এ নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ, নতুন করে বিয়ে সাদির কথা ভাবতে গেলে তাদের সম্মতি তো নিতান্তই দরকার। অর্চুকে আমরা যতই ভালবাসি না কেন, ও তো তাদেরই মেয়ে। তাই তাদের মেয়ের ভবিষ্যতের ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্ত তো তাদেরকেই নিতে হবে। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলার আগে, অর্চুর মনের কথাটা তো জেনে নেওয়া উচিৎ আমাদের, তাই না”?

অর্চু হঠাৎ করেই সীমন্তিনীর কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বলল, “এ তুমি কি বললে দিদিভাই? তুমি আমার কেউ নও? আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত শুধু মা বাবাই নিতে পারেন? তুমি পারো না? এমন কথা তুমি বলতে পারলে দিদিভাই? কালচিনির হাসপাতালে আমি যে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিলুম, সেটা কার জন্যে? যে মায়ের পেটে আমি জন্মেছি, যে বাবার হাত ধরে চলতে শিখেছি, সেই অসহায় লোকগুলো তো আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি, এ খরটুকুও নিতে পারেননি আগের সাতটা বছর ধরে। তুমি আমার খোঁজ পেয়েছিলে বলেই না থানার ওসিকে আমার ওপর নজর রাখতে বলেছিলে। আর তুমি তাকে অমন অনুরোধ করেছিলে বলেই না উনি আমার ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। এ’সব কথা তুমি নিজে মুখে আমাকে না বললেও, থানার ওসি নিজেই আমাকে সে’সব কথা বলেছিলেন। আর সেই মূহুর্তেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম, যে তোমার জন্যেই আমি মরতে মরতে বেঁচে ফিরে এসেছি। তাই হাসপাতালে ভাই আর রচু যখন তোমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল তখন তোমাকে আমি প্রণাম করতে চেয়েছিলুম। খুব ইচ্ছে করছিল, যার দয়াতে আমি সেদিন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিলুম, তার পায়ে হাত দিয়ে একবার প্রণাম করতে। কিন্তু সেদিনও প্রণাম করতে না দিয়ে তুমি আমাকে তোমার বুকে টেনে নিয়েছিলে। আর সেদিন থেকেই আমি মনে মনে নিজেকে তোমার পায়ে সমর্পন করেছি। সেদিনই মনে মনে শপথ করেছি, তোমার উপদেশ ছাড়া কক্ষনো কিচ্ছু করব না। মা বাবা কোন কাজে সম্মতি দিলেও, তুমি যদি তাতে অসম্মত থাকো, তাহলে সে কাজ আমি একেবারেই করব না। তুমি যদি আমার ব্যাপারে কোন ভুল পরামর্শও দাও, আর সে পরামর্শ মত চলে আমি যদি মরেও যাই, তাতেও আমার কোন দুঃখ থাকবে না। তোমার দেখানো পথে যদি আমার মৃত্যুও আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি হাসিমুখে তাকে স্বীকার করে ......”

সীমন্তিনী অর্চনার মুখে হাত চেপে ধরে বলল, “ছিঃ বোন, অমন অলক্ষুনে কথা বলতে নেই। আর কক্ষনো এমন কথা মুখে আনবি না। আর কি বললি? আমি তোকে দয়া করেছি? না রে বোন। আমি তোকে কোন দয়া করিনি রে। আমি যে তোকে তার অনেক আগে থেকেই নিজের আরেকটা বোন বলে ভাবতুম রে। মাসি মেসো ভাই আর রচুর কষ্টের কথা ভেবেই আমি তোকে ওই আচার্যি বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলুম অনেক আগে থেকেই। আমি যদি কালচিনি থানায় থাকতুম তাহলে ওই ঘটণাটা ঘটতেই দিতুম না। তার আগেই তোকে যে ভাবেই হোক, আমি মাসি মেসোর হাতে তুলে দিতুম। তাই এ’কথা ভুলেও কখনো মনে আনবি না যে আমি তোকে দয়া করেছি। দয়া তো আমাকে করেছে রচু। আর আমাকে তাদের আরেকটা মেয়ে বলে স্বীকার করে নিয়ে মাসি মেসো আমাকে দয়া করেছেন। তাদের দয়ার ঋণ যে আমি সারা জীবনেও শোধ করতে পারব না রে। তোরা কেউ হয়ত কথাটা মানতে চাইবি না। কিন্তু আমার অন্তরাত্মা জানে আমি তোদের সকলের কাছে কতখানি ঋণী” বলতে বলতে সীমন্তিনীও কেঁদে ফেলল। আর অর্চনাও “দিদিভাই” বলে সীমন্তিনীকে আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ওদিকে লক্ষ্মীও নিজের আঁচলের খুঁট দিয়ে নিজের চোখ মুছে যাচ্ছিল। নবনীতার চোখেও জল।

নিজের চোখের জল মুছে পরিবেশ হালকা করতে নবনীতা বলে উঠল, “আচ্ছা তোমরা সবাই মিলে এভাবে কান্নাকাটি করলে আসল কাজটা কী করে হবে শুনি? আলোচনা করছিলুম অর্চুর ভবিষ্যৎ নিয়ে। আর তোমরা দু’জনেই একের পর এক অতীতের কথা তুলে ইমোশনাল কথাবার্তা বলে একে অপরকে শুধু কাঁদিয়েই যাচ্ছ। তার সাথে সাথে লক্ষ্মীদি আর আমাকেও কাঁদিয়ে ফেলছ। এটা কি কোনও কাজের কথা হল? লক্ষ্মীদি তুমি ওঠো তো। রান্নাঘরে গিয়ে রাতের খাবার কী বানাবে, বানাও গিয়ে। আর অর্চু, ছাড়ো তো দিদিকে। এদিকে আমার কাছে সরে এসে বোসো। বোন দিদিভাইয়ের প্রেম ভালবাসার প্রমাণ আর নতুন করে দিতে হবে না কাউকে। আমি তো কারো বোনও নই, দিদিভাইও নই। তাই এবার তুমি আমাকে বলো তো, আমরা যদি তোমার জন্যে একটা ভাল সচ্চরিত্র ছেলে খুঁজে পাই, তাহলে কি তুমি বিয়েতে রাজী হবে? না, আর কোন ইমোশনাল কথা চলবে না কিন্তু এখন। শুধু পরিস্কার ভাবে তোমার মনের কথাটুকুই শুধু বলো”।

লক্ষ্মী খালি চায়ের কাপ গুলো ট্রেতে উঠিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অর্চনা সীমন্তিনীকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে বলল, “আমার মনের কথা একটাই নীতাদি। শুধুই দিদিভাইয়ের নির্দেশ মেনে চলা”।

নবনীতা এবার একটু দুষ্টুমি করে বলল, “তাই বুঝি? আচ্ছা বেশ। কিন্তু দিদি, তাহলে তো তোমার কাজটা খুব সহজ হয়ে গেল গো। ওই আমাদের বসাক গারমেন্টসের একটু ওদিকেই যে অন্ধ লোকটা বসে বসে রোজ ভিক্ষে করে, তার সাথেই তুমি অর্চুর বিয়ে পাকা করে দাও। লোকটা ভাল গান করে। গান করেই রোজ তিন চারশ’ টাকা কামায়”।

সীমন্তিনী নবনীতার কথা শুনে হেসে ফেলল। আর অর্চনাও ফিক করে হেসে বলল, “হ্যাঁ, দিদিভাই বললে, আমি তাকেই খুশী মনে বিয়ে করব”।
 

সীমন্তিনী তখন বলল, “কেন রে নীতা, আমার বোনটা কি এতই ফ্যালনা, যে ওর কপালে ওই ভিখিরিটা ছাড়া আর কেউ জুটবে না? ওর মত গুণী, রূপসী মেয়ে তুই আরেকটা খুঁজে বের কর তো দেখি। ওর জন্যে তো আমি সাত সমুদ্র পার থেকে এক রাজকুমারও খুঁজে আনতে পারব রে। শুধু ও রাজী হলেই হল”।

নবনীতা বলল, “আবার রাজী হতে বলছ ওকে? এইমাত্রই তো নিজে মুখেই সে’কথা স্বীকার করল”!

সীমন্তিনী এবার অর্চনার চিবুক ধরে তার মুখটাকে একটু তুলে ধরে তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, “কিরে? সত্যি বলছিস? আমি কাউকে খুঁজে আনলে, তুই সত্যি তাকে বিয়ে করবি”?
 

অর্চনা খানিকটা লজ্জায় সীমন্তিনীর কোলে মুখ গুঁজে বলল, “আমার মত একটা বিধবাকে বিয়ে করতে কে রাজি হবে দিদিভাই”।

নবনীতা অর্চনার মুখের ওপর ঝুঁকে বলল, “উহু, ওসব কথায় কাজ চলবে না। দিদি কাকে খুঁজে আনবে না আনবে সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি শুধু পরিস্কার ভাষায় তোমার ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ টাই জানিয়ে দাও। অবশ্য তোমার যদি ব্যক্তিগত ভাবে কোন পছন্দ অপছন্দ থেকে থাকে, তাহলে সে’সবও খুলে বলতে পারো”।

অর্চনা এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “কোন পছন্দ অপছন্দ নেই আমার। কোন শর্তও নেই। বিয়ে করব কি না, হবে কি না, তাও জানিনে। তবে আমি দিদিভাইয়ের কথাই মেনে নেব। দিদিভাই যা চাইবে আমি তা-ই মেনে নেব। তবে একটাই কথা শুধু বলার আছে। দিদিভাইয়ের কথায় মা বাবা ভাই আর রচুও যদি রাজি হয় তাহলে আমি আরও খুশী হব। কিন্তু খুব ভয় করছে গো নীতাদি। একবার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা ভেবেই নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ......”।

নবনীতা মাঝ পথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ব্যস ব্যস হয়ে গেছে। তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। তবে মনের ওই ভয়টাকে একেবারে আমল দিও না অর্চু। তোমার দিদিভাই তোমার জন্যে অকাল কুষ্মাণ্ড কাউকে খুঁজে আনবে না। সে খুব ভেবেচিন্তে, খুব ভাল ভাবে পরীক্ষা করে তবেই কোন একটা সিদ্ধান্ত নেবে। আর আমি জানি দিদির সিদ্ধান্তে কোন ভুল হবেই না। দিদি, নাও, অর্চুর মনের কথা আমি খুঁচিয়ে বের করলুম। এবার তোমার কাজ তুমি করো”।

সীমন্তিনী অর্চনার কপালে একটা চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক বলছিস”?

অর্চনা সীমন্তিনীর কোলে মুখ গুঁজে সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লো। সীমন্তিনী তখন বলল, “বেশ, আমি তাহলে মাসি, মেসো আর রচুর সাথে আগে কথা বলব। তারপর কোমড় বেধে নামবো। তবে নীতা, এ ব্যাপারে কিন্তু তোর সাহায্যেরও দরকার হতে পারে”।
 

নবনীতাও অর্চুর চিবুক ধরে নাড়িয়ে দিয়ে জবাব দিল, “সে আর বলতে দিদি? আমি তোমাকে পুরোপুরি সাহায্য করব। জান প্রাণ লড়িয়ে দেব আমাদের অর্চু সোনার জন্যে”।
 

*****************
 
(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply


Messages In This Thread
RE: সীমন্তিনী BY SS_SEXY - by riank55 - 17-03-2020, 07:12 PM



Users browsing this thread: 11 Guest(s)