17-03-2020, 07:11 PM
(Update No. 165)
বারান্দায় এসে চা খেতে খেতে পায়চারী করতে করতে সীমন্তিনী ভাবতে লাগল যে অর্চনার যদি পরিতোষের সাথে বিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তো মন্দ হয় না। ঝোঁকের মাথায় পরিতোষের সাথে কথায় কথায় হুট করে তো সে বলেই দিয়েছিল কথাটা আগের দিন। পরিতোষও ',। ছেলে হিসেবে তার কোনও তুলনাই হয় না। নবনীতাও যদি এতে মত দেয় তাহলে পরিতোষের তরফ থেকে আর কোন সমস্যাই থাকবে না। এখন পরিতোষের বয়স প্রায় তিরিশ। আর অর্চনার বয়স এখন তেইশের ওপরে। সাড়ে ছ’ বছর বা সাত বছরের মত তফাৎ হবে দু’জনের মধ্যে। বয়সের পার্থক্যটা কি খুব বেশী হচ্ছে? না বোধহয়। আগেকার দিনে তো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পনেরো কুড়ি বছরের তফাৎও থাকত। এ যুগেও সাত আট বছরের তফাৎ হামেশাই দেখা যায়। আর ছেলে হিসেবে পরিতোষ যেমন চমৎকার তেমনই মেয়ে হিসেবে অর্চনাই বা কম কিসে? হাইট গড়পড়তা বাঙালী মেয়েদের চেয়ে বেশীই। গায়ের রঙ চমৎকার। দেখতেও খুবই সুন্দরী। বিয়ের পর পাঁচ বছর স্বামীর ঘরে কাটালেও সে স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক একেবারেই হয় নি। তাই সে এখনও কূমারী, ঘরকন্যার কাজে ওস্তাদ, রান্নার হাত চমৎকার, সংস্কারি, মিষ্টি ব্যবহার, রচনার মতই অর্চনার মধ্যেও কাছের সবাইকে আপন করে নেবার ক্ষমতা আছে। শুধু লেখাপড়ায় একটু কম। মাধ্যমিক পাশ। আর দুর্ভাগ্যক্রমে সে বিধবা। তবু পরিতোষ অরাজী হবে বলে মনে হয় না। অর্চনার মা বাবাও মনে হয় পরিতোষের মত একটা ছেলে পেলে একেবারেই আপত্তি করবেন না, এটা আশা করাই যায়। রচনা আর কিংশুকও বোধহয় আপত্তি করবে না। কিন্তু সবার আগে জানতে হবে অর্চনার মনের ইচ্ছে। অর্চনা রাজি হলে এ সম্পর্কে আর কোন বাঁধা থাকবে না। সীমন্তিনী একসময় ভেবেছিল যে রচনার মত অর্চনাকেও তাদের বাড়ির বৌ করেই নেবে। ভেবেছিল সতীশের সাথে অর্চনার বিয়ের কথা তুলবে। কিন্তু কিছুদিন আগেই সে জানতে পেরেছে যে সতীশ একটা মেয়েকে ভালোবাসে। বাড়ির লোকেদের সম্মতি পেলে সে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে। তাই সে সম্পর্কে কথা উঠিয়ে কোন লাভ হবে না। তাছাড়া ভালবাসার মর্য্যাদা দিতে সে জানে। সতীশকে তার ভালবাসার মেয়েটার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অর্চনার সাথে বিয়ে দেবার কথা সে আর তাই মনেও আনতে পারছে না। কিন্তু পরিতোষ বা কালচিনির বাড়ির সকলেই যে তার কথা মেনে নেবে, এ ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত হলেও পরিতোষের তিনকুলে কেউ নেই, এ নিয়েই হয়ত অর্চনার বাবা মার মনে খানিকটা দ্বিধা হতে পারে। তবে সীমন্তিনী সেটুকু কাটিয়ে উঠতে পারবে একটু চেষ্টা করলে। কিন্তু সবার আগে জানা উচিৎ অর্চনার মনের কথা। ও যদি রাজি না হয়, তাহলে আর অন্য কারো সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার কোন মানেই হয় না। আর অর্চনা যদি রাজী হয়, তাহলে সবার আগে আলোচনা করতে হবে রচনার সাথে। রচনা পরিতোষকে দেখেছে। পরিতোষের ব্যাপারে অনেক কিছুই সে জানে। এ’দিকে নবনীতা পরিতোষকে যত ভালভাবে চেনে, অর্চনাকেও সে কাছে পেয়েছে। অর্চনার আচার ব্যবহার সহ সব কিছুই সে জানতে বুঝতে পারছে। নবনীতা আর রচনা যদি মত দেয়, তাহলে অন্য সবাইকে রাজী করাতে তার খুব বেশী পরিশ্রম করতে হবে না। তবে সবার আগে কথা বলতে হবে অর্চনার সাথে। আর সীমন্তিনী মনে মনে ভাবল, আজ রাতেই নবনীতা ফিরে আসবার পর সে অর্চনার মতামতটা জানার চেষ্টা করবে।
আবার মহিমার কথাও তার মনে এল। বীথিকার মুখ থেকে যা জানা গেল সেটা যদি সত্যিই হয়, মানে মহিমা যদি তার ওই ব্যবসা সত্যি বন্ধ করতে চায়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে আগে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, এখন অন্ততঃ মহিমার ভেতরে শুভবুদ্ধি জেগেছে। আর এই সুযোগেই তার ভেতরে জেগে ওঠা শুভ চাহিদাটাকে আরও উস্কে দিতে হবে। ব্যবসাটা ছেড়ে দেবার কথা ভেবেও সে সিদ্ধান্তটা নিতে পারছে না কেন, সেটা জানা খুব দরকার। প্রয়োজনে সে তাকে কিছু পরামর্শ দিতে পারে। ছোট খাটো সাহায্যও হয়তো সে করতে পারবে। নবনীতা আর বীথিকার কথা সত্যি বলে ধরলে মেনে নিতেই হয় যে মানুষ হিসেবে মহিমা খুবই ভাল। রতীশ আর রচনাও মহিমার সম্পর্কে একই রকম ধারণা পোষন করে। এমন একজন ভালো মনের মানুষকে একটা অসৎ পথ থেকে সৎ পথে নিয়ে আসবার কোন সুযোগ পেলে, সে সুযোগ একেবারেই হাতছাড়া করা যাবে না। আর ওদিকে পরিতোষের সাহায্যও তো সে পাবেই। মহিমার সাথেও আজ কালের মধ্যেই কথা বলাটা খুব দরকার।
*****************
নবনীতা রাত সওয়া আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরতেই অর্চনার কথায় সীমন্তিনী নিজেই গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। নতুন একটা নাইটি পড়া সীমন্তিনীকে দেখেই নবনীতা বলল, “ওমা, দিদি? এত সুন্দর নাইটিটা কোত্থেকে কিনলে গো? সেদিন তো আমাদের ওখান থেকে এটা কেনো নি”!
সীমন্তিনী দরজা বন্ধ করে হাসতে হাসতে বলল, “এটা তোদের বসাক গারমেন্টসের কালেকশান নয় নীতা। এটা অর্চু’স ডিজাইনস”।
নবনীতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কি? অর্চুস ডিজাইনস? মানে এটা অর্চু বানিয়েছে? সত্যি বলছ তুমি দিদি”? বলতে বলতে নাইটিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
সীমন্তিনী বলল, “তোর মত আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। আর সারপ্রাইজটা কিভাবে দিয়েছে জানিস? আমার বাথরুমে রেখে দিয়েছিল। আমি যখন অফিস থেকে ফিরে এসে গাড়ি থেকে নেমেছি, অমনি অর্চু লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তার এত খুশীর কারন কি জানতে চাইলে বলল, আজ সে বিকেলের চা না খেয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। লক্ষ্মীদি বলল অর্চু আমাদের জন্যে লুচি আর আলুর দম বানিয়েছে”।
নবনীতা আরেকবার চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “অর্চু লুচি আর আলুর দম বানিয়েছে? আমার জন্যে রেখেছো তো”?
সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “তোর জন্যে রাখবে না এটা কি হতে পারে? কিন্তু পরের কথাগুলো শোন না। আমাকে তাড়াতাড়ি স্নানে যেতে বলে সে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। রোজ তো লক্ষ্মীদি আমার সাবান টাওয়েল নাইটি আগে থেকেই বাথরুমে রেখে দেয়। আজও তাই রেখেছে বলে আমি আর কিছু না নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলুম। স্নান সেরে গা মুছে হ্যাঙ্গারের দিকে হাত বাড়াতেই দেখি সেখানে এ নাইটিটা। প্রথমে একটু অবাক হলেও সাথে সাথেই বুঝতে পারলুম অর্চুর খুশীর আসল কারনটা কী। সেটা পড়েই বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে অর্চুর সামনে গিয়ে দাড়িয়েছিলুম”।
নবনীতাও বেশ খুশী হয়ে বলল, “বাঃ সারপ্রাইজটাও তো বেশ ভালই দিয়েছে। কিন্তু দিদি ডিজাইনটা কিন্তু সত্যি দারুণ। একেবারে ফাটাফাটি। কিন্তু অর্চু সত্যি এ’সব জানে”?
সীমন্তিনী নবনীতার বিছানার একপাশে বসে বলল, “শুধু ডিজাইন? কাটিংও নিজে করেছে। আর গোটা নাইটিটা সুচ সুতো দিয়ে নিজে হাতে সেলাই করেছে। ভাবতে পারছিস”?
নবনীতা আরও অবাক হয়ে বলল, “বলছ কি দিদি? অর্চু নিজে কাটিং টেলারিং ডিজাইনিং সব কিছু করেছে”?
সীমন্তিনী খুব উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল, “তবে আর তোকে বলছি কি আমি? একেবারে উপর্য্যুপরি একের পর এক সারপ্রাইজ। ওই তো এসে গেছে, দ্যাখ”।
অর্চুকে ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে নবনীতা কিছু একটা বলতে যেতেই, “অর্চু তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “আগে চট করে হাতমুখটা ধুয়ে এস তো নীতাদি। নইলে লুচিগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। খেতে খেতে যা বলার বলো”।
নবনীতা সাথে সাথেই বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে অর্চনার হাত থেকে থালা নিয়ে খেতে শুরু করল। খাবার মুখে দিয়েই সে ‘বাহ বাহ’ করে উঠল। সীমন্তিনী অর্চনার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে নীতা, কেমন লাগছে আলুর দমটা”?
নবনীতা মুখের মধ্যে গ্রাস পুরে রেখেই জবাব দিল, “উম্মম দারুণ বানিয়েছ অর্চু। মার্ভেলাস”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে বলল, “অর্চু সোনা, লক্ষ্মীদিকে একটু গিয়ে বলে আয় আমাদের সকলের চা যেন সে এ ঘরেই নিয়ে আসে। আর তুইও কথাটা বলে এ ঘরে চলে আসিস। কথা আছে”।
লক্ষ্মীকে চায়ের কথা বলে অর্চনা ফিরে আসতেই সীমন্তিনী আবার তাকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল, “অর্চু সোনা। তোকে এখন কতগুলো কথা বলব আমি। তুই কিন্তু জবাবে তোর মনের কথা বলবি, ঠিক আছে”?
অর্চনা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি তোমার কাছে নিজের মনের কথা না বলে মিথ্যে কথা বলব বলে ভাবছো দিদিভাই? এমন দিন যেন আমার জীবনে না আসে। কি বলবে বলো”?
সীমন্তিনী অর্চনার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে খুব মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করল, “দ্যাখ অর্চু। আমি তোকে পুরনো সব কথা ভুলে গিয়ে নতুন ভাবে জীবনটা কাটাবার কথা ভাবতে বলেছিলুম। আমি জানি, এখন তুই বাবা মা আর ভাইয়ের সাথে খুব ভাল আছিস। কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা কিছু ভেবেছিস কখনও”?
অর্চনা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ভবিষ্যৎ জীবনের কথা মানে? আমি তো তোমার কথা ঠিক বুঝতে পাচ্ছিনা গো দিদিভাই”?
সীমন্তিনী আগের মতই নরম সুরে বলল, “কেন রে? এ আবার না বোঝার কি আছে? আমি তো সহজ ভাষাতেই কথাটা জিজ্ঞেস করলুম। এখন বাড়িতে বাবা মা ভাইয়ের সাথে তুই যে খুব ভালো আছিস, সেটা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ তো হচ্ছে তোর বর্তমানের কথা। সকলেরই তো ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কিছু চিন্তা ভাবনা থাকে। নীতা যেমন এতদিন লক্ষ্যভ্রষ্ট ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে। আমার পরামর্শটা মেনে নিয়ে ও ভবিষ্যতে নিজের একটা বুটিক কিংবা গারমেন্টসের কারখানা খুলবে। তোর ভবিষ্যতের কথা তো তোর মুখে কখনও শুনিনি আমি। তাই জিজ্ঞেস করছি, তুই কি কখনও তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবিস না”?
নবনীতা খেতে খেতেই একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে অর্চনা আর সীমন্তিনীর দিকে দেখে আবার খাবারে মন দিল। অর্চনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিল, “দিদিভাই, ছোটবেলা থেকে আমরা তিন ভাই বোন শুধু দারিদ্রের ছবি দেখতেই অভ্যস্ত ছিলুম। তার বাইরে কোনও কিছু নিয়ে ভাববার বা কোনও স্বপ্ন দেখবার কথা আমি আর রচু কোনদিন ভাবতেও পারতুম না। ভাই তো তখন একেবারেই ছোট ছিল। ওইটুকু রত্তি একটা ছেলের কতটুকুই বা বোধশক্তি থাকতে পারে বলো? তবু ওই বয়সেই ভাইটাও যেন কিভাবে আমাদের দারিদ্রের কথা বুঝতে শিখে গিয়েছিল। আমরা সবাই জানতুম, বাবা মা আমাদের ঘরোয়া শিক্ষা যতই দিন না কেন, আমরা কেউই বেশীদুর লেখাপড়া করতে পারব না। না, এতে বাবার কোন দোষ ছিল না। আমাদের আর্থিক দুরবস্থার জন্যই বাবা সেটা করতে পারেন নি। মাধ্যমিক পাশ করবার পরেই বাবা নিরুপায় হয়ে আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর ঘটকের মিথ্যে কথায় ভুলে আমি সুখে থাকব আর ভাল সরকারি চাকুরে পাত্র পেয়েছে বলে, খুব তাড়াতাড়িই আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। রচুর কপালটা তুলনামূলক ভাবে কিছুটা ভাল নিশ্চয়ই ছিল। তাই তো আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালের সাহায্যে সে বারো ক্লাস অব্দি পড়তে পেরেছিল। তারপর তোমার সাথে আমাদের বাড়ির সকলের পরিচয় হল। রচুর মুখে শুনেছি, তুমি ওকে কলেজে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলে। কিন্তু ও শ্বশুর বাড়ির সকলকে বিয়ের আগে থেকেই এমন ভালবেসে ফেলেছিল যে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ি গিয়ে পড়তেও রাজি হল না। আসলে দিদিভাই, আমাদের দু’বোনের মধ্যে কেউই বোধহয় সেভাবে স্বপ্ন দেখতে শিখিনি গো। তাই তেমন কোন উচ্চাশাও বুঝি আমাদের দু’বোনের মনে কোনদিন জন্মায় নি। তবে তুমি যেভাবে আমাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছ, তাতে ভাই এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শিখেছে। আর বাবাও আগের চেয়ে কত বেশী প্রত্যয়শীল হয়ে উঠেছেন এখন। যে লোকটাকে জন্মের পর থেকে শুধু দুর্ভাবনা ছাড়া আর কিছু করতে দেখিনি, সে লোকটাই এখন যেন কোন এক সঞ্জীবনীর সুধায় উদ্যমী হয়ে উঠছেন, নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। যে লোকটা সংসারের বোঝা সামলাতে না পেরে প্রায় কুঁজো হয়ে পড়েছিলেন, আজ তিনিই শিরদাঁড়া সোজা করে চলছেন, মন দিয়ে নতুন উদ্যমে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তার শরীর স্বাস্থ্যও আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়ে উঠেছে। আর সে সঞ্জীবনী সুধা যে কী, তা আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যই চিনতে পেরেছে। ভাই যদিও কিছু খুলে বলেনি এখনও, কিন্তু ও নিজেও যে কিছু একটা উদ্দেশ্যের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, এটাও বেশ ভালই বুঝতে পেরেছি। আর এটাও হয়েছে ওই সঞ্জীবনীর গুণেই। রচু সেই সঞ্জীবনীর ছোঁয়ায় কোনভাবে আগের চেয়ে বেশী আত্মবিশাসী হয়ে উঠেছে কিনা সেটা আমি ঠিক জানিনা। তবে সে সঞ্জীবনীই যে তার মন প্রাণ হৃদয় জুড়ে আছে, সেটা আমি একদিনেই বুঝে গিয়েছিলুম। সে সঞ্জীবনী তো আমাকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছে পুরোপুরি। কিন্তু আমার শিরদাঁড়াটাই বুঝি ভেঙে গেছে গো দিদিভাই। স্বপ্ন দেখবার, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার দুঃসাহস কিছুতেই যেন করে উঠতে পারছি না আমি। আমি জানিনা আমার ভবিষ্যৎ কী। আমি জানিনা আগামীকাল আমার কী করা উচিৎ। আমি শুধু একটাই কথা জানি এখন। সে শুধু তুমি। তুমি আমাকে নতুন জন্ম দিয়েছ। তাই তুমিই আমার ভগবান, তুমিই আমার সব। অন্য আর কিচ্ছু আমি ভাবতেই পারিনা গো দিদিভাই”।
নবনীতা প্রায় ছুটে গিয়ে নিজের খালি থালাবাটি ডাইনিং টেবিলে রেখে আবার ছুটেই ঘরে এসে ঢুকল। লক্ষ্মীও ট্রেতে করে চার কাপ চা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। সীমন্তিনী তখন অর্চনাকে বলছিল, “কিন্তু অর্চু, সেটা বললে কি হয় রে বোন। তোর আজ মনে হচ্ছে তুই খুব ভাল আছিস। কিন্তু পৃথিবীর সব কিছু যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি মানুষের জীবনেও সময়ে সময়ে কিছু পরিবর্তন অবধারিত ভাবেই এসে থাকে। চিরটা কাল কি আর একভাবে কাটে? তাই সকলকেই নিজ নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেই হয়। আর তোকেও ভাবতে হবে”।
লক্ষ্মী সকলের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে নিচে মেঝেতে বসতে বসতে বলল, “হ্যাঁ গো দিদিমণি, তুমি একদম ঠিক বলেছ গো। এমন সুন্দর ফুটফুটে মিষ্টি একটা মেয়ে, সে সারাটা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে, এ তো ভাবাই যায় না। উনি নিজে যে মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারবেন না, এটা তো আমি খুব ভালভাবেই বুঝে গেছি এ ক’টা দিনে। তুমিই কিছু একটা করো দিদিমণি”।
নবনীতাও প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠল, “হ্যাঁ দিদি, আমিও কিন্তু লক্ষ্মীদির সাথে একমত। কতটুকুই বা অর্চুর বয়স বল তো? এই কচি বয়স থেকেই সারাটা জীবন উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে কাটিয়ে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। তবে ওর কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, ওর ভেতর আত্মবিশ্বাসের খুব অভাব। তবে তার জন্য ওকে তেমন দোষও দেওয়া যায় না। ওকে যেভাবে কষ্ট যাতনা ভোগ করতে হয়েছে, তাতে ওর জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে তারও হয়ত একই অবস্থা হত”।
তারপর অর্চুর হাতের ওপর নিজের একটা হাত রেখে বলল, “অর্চু, তোমাকে তো আমার জীবনের প্রায় সব কথাই খুলে বলেছি। আমি তো গত সাতটা বছরে রোজ রোজ কষ্ট পেয়ে গেলেও, কোনভাবে কোন রাস্তা খুঁজে না পেলেও, মনের এক কোনায় এ বিশ্বাসটুকু ধরে রাখতে পেরেছিলাম, যে একদিন না একদিন আমি ঠিক ওই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। আর সে ইচ্ছেটা ছিল বলেই হয়ত আমি সেটা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সব শেষে যখন বেঁচে থাকার আর কোন রাস্তা খুঁজে না পেয়ে ম্যাডামের কাজে ঢুকলাম, তখন বুঝি আমার আত্মবিশ্বাসও টলমলে হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ভগবানের অশেষ কৃপায় তার মাস খানেক বাদেই দিদি তখন আমার জীবনে এল। আর রূপকথার গল্পের মত, দিদির সোনার কাঠির ছোঁয়ায়, ওই একটা দিনেই আমার জীবনটা আমূল বদলে গেল। আর এখন আমার মনের প্রত্যয়, নিজের আত্মবিশ্বাস তো আরও অনেক বেড়ে গেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আর সে দিকেই লক্ষ রেখে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। মনের মধ্যে একটা আলাদা তাগিদের অস্তিত্ব বুঝতে পারছি। তোমাকেও তো এমনি ভাবে কিছু একটা উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে হবে ভাই। নইলে যে জীবনের কোন মানেই থাকে না”।
অর্চনা অসহায়ের মত বলল, “আমি যে সত্যি কিছু ভেবে উঠতে পারিনা গো নীতাদি। বিশ্বাস করো, আমি একটুও মিথ্যে বলছি না। তোমরাই বলে দাও না আমার কী করা উচিৎ”।
সীমন্তিনী এতক্ষণ ইচ্ছে করেই চুপ করে ছিল। এবারেও সে কোন কথা বলল না। কিন্তু লক্ষ্মী বলে উঠল, “সোনাদি, আমি তো মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। অত সাজিয়ে গুছিয়ে কথা আমি বলতে পারি না। তবে গ্রামের মেয়ে বলে এটুকু জানি যে কোন চাড়া গাছ যদি নিজের ক্ষমতায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না পারে, তাহলে সেই চাড়া গাছের মালিক একটা বাঁশকাঠি পুঁতে দিয়ে গাছটাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। গাছটা তখন সেই বাঁশকাঠির ওপর ভর করেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তোমার অবস্থাও কিন্তু অমন একটা ছোট চাড়া গাছের মতই। তোমারও অমন একটা সহায়ের দরকার। আর তাই আমি বলছি, তোমাকে আবার ভাল কোন একটা ছেলেকে বিয়ে করা উচিৎ”।
অর্চনা লক্ষ্মীর কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। তখন সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল, “নীতা, তুই এ ব্যাপারে কিছু সাজেশান দিতে পারিস? না না, তোকে সেভাবে কোন দায়িত্ব নিয়ে কিছু করতে বলছি না। কিন্তু এখানে আমরা তিনজনই তো অর্চুকে খুব ভালবাসি। ও ভাল থাকুক, সুখে থাকুক, এটাই তো আমরা সবাই চাই, তাই না? লক্ষ্মীদি কিন্তু একটা ভাল পরামর্শ দিয়েছে বলেই আমি মনে করি। তোর মনেও তো এমন কোন কথা থাকতে পারে। তাই জিজ্ঞেস করছি”।
নবনীতা নিজের চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “দিদি, লক্ষ্মীদির কথাটাকে কিন্তু আমিও সাপোর্ট করছি। আমার মনে হয়, অর্চুর ভেতর যখন আত্মবিশ্বাসের এতটাই অভাব আমরা বুঝতে পাচ্ছি, তখন ওকে অন্য কোনভাবে প্রেরণা দিয়েও বুঝি খুব একটা লাভ হবে না। ঘরের বৌ করে তুলতে ছেলের বাড়ির লোকেরা একটা মেয়ের মধ্যে যা কিছু পেতে চায়, তার সবকিছুই ওর মধ্যে আছে। শুধু ওর নামের পাশে একটা বাজে তকমা সেঁটে গেছে। বিধবা। ও যদি রাজি হয়, তাহলে আমরা খুঁজে পেতে এমন কোন ছেলে হয়ত পেতেই পারি, যে ওর গায়ে লেগে থাকা ওই তকমাটাকে একেবারেই গ্রাহ্য করবে না। আর স্বামীর সংসার করবার স্বপ্ন কোন মেয়ে না দেখে বলো তো? আর ও তো পুরোপুরিভাবে একটা ঘরোয়া মেয়ে। ওর বয়সও কম। ওর মনেও এমন একটা ইচ্ছে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। হয়ত লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পাচ্ছে না। কিংবা একবার ওর জীবনে যে দুর্ভোগ এসেছিল, সে’কথা ভেবেই ও আর নতুন করে ও’রকম কোন স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছে। তবে ও যদি একটু সাহস করতে পারে, তাহলে আমরা তিনজনে মিলে চেষ্টা করে ওর মনের ভয় দুর করে দিতে পারব। তাই আমিও কিন্তু সেটাই চাইছি। তবে সবটাই নির্ভর করছে মেইনলি ওরই ওপর। ওকে আগে মনস্থির করতে হবে। অবশ্য কালচিনির মাসি মেসো ভাই আর বৌদির মতামতেরও দরকার আছে। কারন অর্চু তো তাদেরই পরিবারের সদস্য”।
নবনীতা থামতে আর কেউ কোন কথা বলল না। কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে সীমন্তিনী অর্চনাকে একহাতে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কিরে, তুই আর কিছু বলবি”?
অর্চনা মাথা তুলে সীমন্তিনীর চোখের দিকে একবার দেখে আবার মাথা নিচু করে বলল, “আমি কি বলব দিদিভাই। আমি যে সত্যিই কিছু বুঝিনা গো। লক্ষ্মীদি আর নীতাদি যে’সব কথা বলল, তা তো ঠিকই। মাত্র ষোল বছর বয়সেই বিয়ের ইচ্ছে মনে না এলেও বাবার এবং পরিবারের ইচ্ছেয় বিয়েতে রাজী হয়েছিলুম। তখন মনে মনে একটা স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিলুম। ভেবেছিলুম শ্বশুর বাড়ি গিয়ে স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ি আর ছেলেদেরকে খুব ভালবাসব। তাদের প্রিয়জন হয়ে ওঠার চেষ্টা করব। মা আমাদের দু’বোনকে সে শিক্ষাই দিয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবে চেষ্টা করবার সুযোগটাই পাই নি। ফুলসজ্জার রাতেই বেহেড মাতাল হয়ে স্বামী হাতে মদের বোতল আর দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে তাদের গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢেলে দিতে আদেশ করেছিল। তার মুখের মদের গন্ধেই আমার গা গুলিয়ে উঠছিল। ছোটবেলা থেকে এমন পরিবেশ কোথাও চোখে দেখিনি। তাই বোধহয় সামান্য ইতস্ততঃ করেছিলুম। আর তাতেই রেগে উঠে সে একটা লাঠি দিয়ে আমাকে পেটাতে শুরু করেছিল। তার সাথে হাত মিলিয়েছিল ছেলেদুটোও......” বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল।
সীমন্তিনী অর্চনাকে বুকে চেপে ধরে বলল, “থাক অর্চু, ও’সব কথা আর মনে আনিসনে বোন”।
______________________________
বারান্দায় এসে চা খেতে খেতে পায়চারী করতে করতে সীমন্তিনী ভাবতে লাগল যে অর্চনার যদি পরিতোষের সাথে বিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তো মন্দ হয় না। ঝোঁকের মাথায় পরিতোষের সাথে কথায় কথায় হুট করে তো সে বলেই দিয়েছিল কথাটা আগের দিন। পরিতোষও ',। ছেলে হিসেবে তার কোনও তুলনাই হয় না। নবনীতাও যদি এতে মত দেয় তাহলে পরিতোষের তরফ থেকে আর কোন সমস্যাই থাকবে না। এখন পরিতোষের বয়স প্রায় তিরিশ। আর অর্চনার বয়স এখন তেইশের ওপরে। সাড়ে ছ’ বছর বা সাত বছরের মত তফাৎ হবে দু’জনের মধ্যে। বয়সের পার্থক্যটা কি খুব বেশী হচ্ছে? না বোধহয়। আগেকার দিনে তো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পনেরো কুড়ি বছরের তফাৎও থাকত। এ যুগেও সাত আট বছরের তফাৎ হামেশাই দেখা যায়। আর ছেলে হিসেবে পরিতোষ যেমন চমৎকার তেমনই মেয়ে হিসেবে অর্চনাই বা কম কিসে? হাইট গড়পড়তা বাঙালী মেয়েদের চেয়ে বেশীই। গায়ের রঙ চমৎকার। দেখতেও খুবই সুন্দরী। বিয়ের পর পাঁচ বছর স্বামীর ঘরে কাটালেও সে স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক একেবারেই হয় নি। তাই সে এখনও কূমারী, ঘরকন্যার কাজে ওস্তাদ, রান্নার হাত চমৎকার, সংস্কারি, মিষ্টি ব্যবহার, রচনার মতই অর্চনার মধ্যেও কাছের সবাইকে আপন করে নেবার ক্ষমতা আছে। শুধু লেখাপড়ায় একটু কম। মাধ্যমিক পাশ। আর দুর্ভাগ্যক্রমে সে বিধবা। তবু পরিতোষ অরাজী হবে বলে মনে হয় না। অর্চনার মা বাবাও মনে হয় পরিতোষের মত একটা ছেলে পেলে একেবারেই আপত্তি করবেন না, এটা আশা করাই যায়। রচনা আর কিংশুকও বোধহয় আপত্তি করবে না। কিন্তু সবার আগে জানতে হবে অর্চনার মনের ইচ্ছে। অর্চনা রাজি হলে এ সম্পর্কে আর কোন বাঁধা থাকবে না। সীমন্তিনী একসময় ভেবেছিল যে রচনার মত অর্চনাকেও তাদের বাড়ির বৌ করেই নেবে। ভেবেছিল সতীশের সাথে অর্চনার বিয়ের কথা তুলবে। কিন্তু কিছুদিন আগেই সে জানতে পেরেছে যে সতীশ একটা মেয়েকে ভালোবাসে। বাড়ির লোকেদের সম্মতি পেলে সে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে। তাই সে সম্পর্কে কথা উঠিয়ে কোন লাভ হবে না। তাছাড়া ভালবাসার মর্য্যাদা দিতে সে জানে। সতীশকে তার ভালবাসার মেয়েটার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অর্চনার সাথে বিয়ে দেবার কথা সে আর তাই মনেও আনতে পারছে না। কিন্তু পরিতোষ বা কালচিনির বাড়ির সকলেই যে তার কথা মেনে নেবে, এ ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত হলেও পরিতোষের তিনকুলে কেউ নেই, এ নিয়েই হয়ত অর্চনার বাবা মার মনে খানিকটা দ্বিধা হতে পারে। তবে সীমন্তিনী সেটুকু কাটিয়ে উঠতে পারবে একটু চেষ্টা করলে। কিন্তু সবার আগে জানা উচিৎ অর্চনার মনের কথা। ও যদি রাজি না হয়, তাহলে আর অন্য কারো সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার কোন মানেই হয় না। আর অর্চনা যদি রাজী হয়, তাহলে সবার আগে আলোচনা করতে হবে রচনার সাথে। রচনা পরিতোষকে দেখেছে। পরিতোষের ব্যাপারে অনেক কিছুই সে জানে। এ’দিকে নবনীতা পরিতোষকে যত ভালভাবে চেনে, অর্চনাকেও সে কাছে পেয়েছে। অর্চনার আচার ব্যবহার সহ সব কিছুই সে জানতে বুঝতে পারছে। নবনীতা আর রচনা যদি মত দেয়, তাহলে অন্য সবাইকে রাজী করাতে তার খুব বেশী পরিশ্রম করতে হবে না। তবে সবার আগে কথা বলতে হবে অর্চনার সাথে। আর সীমন্তিনী মনে মনে ভাবল, আজ রাতেই নবনীতা ফিরে আসবার পর সে অর্চনার মতামতটা জানার চেষ্টা করবে।
আবার মহিমার কথাও তার মনে এল। বীথিকার মুখ থেকে যা জানা গেল সেটা যদি সত্যিই হয়, মানে মহিমা যদি তার ওই ব্যবসা সত্যি বন্ধ করতে চায়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে আগে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, এখন অন্ততঃ মহিমার ভেতরে শুভবুদ্ধি জেগেছে। আর এই সুযোগেই তার ভেতরে জেগে ওঠা শুভ চাহিদাটাকে আরও উস্কে দিতে হবে। ব্যবসাটা ছেড়ে দেবার কথা ভেবেও সে সিদ্ধান্তটা নিতে পারছে না কেন, সেটা জানা খুব দরকার। প্রয়োজনে সে তাকে কিছু পরামর্শ দিতে পারে। ছোট খাটো সাহায্যও হয়তো সে করতে পারবে। নবনীতা আর বীথিকার কথা সত্যি বলে ধরলে মেনে নিতেই হয় যে মানুষ হিসেবে মহিমা খুবই ভাল। রতীশ আর রচনাও মহিমার সম্পর্কে একই রকম ধারণা পোষন করে। এমন একজন ভালো মনের মানুষকে একটা অসৎ পথ থেকে সৎ পথে নিয়ে আসবার কোন সুযোগ পেলে, সে সুযোগ একেবারেই হাতছাড়া করা যাবে না। আর ওদিকে পরিতোষের সাহায্যও তো সে পাবেই। মহিমার সাথেও আজ কালের মধ্যেই কথা বলাটা খুব দরকার।
*****************
নবনীতা রাত সওয়া আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরতেই অর্চনার কথায় সীমন্তিনী নিজেই গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। নতুন একটা নাইটি পড়া সীমন্তিনীকে দেখেই নবনীতা বলল, “ওমা, দিদি? এত সুন্দর নাইটিটা কোত্থেকে কিনলে গো? সেদিন তো আমাদের ওখান থেকে এটা কেনো নি”!
সীমন্তিনী দরজা বন্ধ করে হাসতে হাসতে বলল, “এটা তোদের বসাক গারমেন্টসের কালেকশান নয় নীতা। এটা অর্চু’স ডিজাইনস”।
নবনীতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কি? অর্চুস ডিজাইনস? মানে এটা অর্চু বানিয়েছে? সত্যি বলছ তুমি দিদি”? বলতে বলতে নাইটিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
সীমন্তিনী বলল, “তোর মত আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। আর সারপ্রাইজটা কিভাবে দিয়েছে জানিস? আমার বাথরুমে রেখে দিয়েছিল। আমি যখন অফিস থেকে ফিরে এসে গাড়ি থেকে নেমেছি, অমনি অর্চু লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তার এত খুশীর কারন কি জানতে চাইলে বলল, আজ সে বিকেলের চা না খেয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। লক্ষ্মীদি বলল অর্চু আমাদের জন্যে লুচি আর আলুর দম বানিয়েছে”।
নবনীতা আরেকবার চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “অর্চু লুচি আর আলুর দম বানিয়েছে? আমার জন্যে রেখেছো তো”?
সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “তোর জন্যে রাখবে না এটা কি হতে পারে? কিন্তু পরের কথাগুলো শোন না। আমাকে তাড়াতাড়ি স্নানে যেতে বলে সে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। রোজ তো লক্ষ্মীদি আমার সাবান টাওয়েল নাইটি আগে থেকেই বাথরুমে রেখে দেয়। আজও তাই রেখেছে বলে আমি আর কিছু না নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলুম। স্নান সেরে গা মুছে হ্যাঙ্গারের দিকে হাত বাড়াতেই দেখি সেখানে এ নাইটিটা। প্রথমে একটু অবাক হলেও সাথে সাথেই বুঝতে পারলুম অর্চুর খুশীর আসল কারনটা কী। সেটা পড়েই বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে অর্চুর সামনে গিয়ে দাড়িয়েছিলুম”।
নবনীতাও বেশ খুশী হয়ে বলল, “বাঃ সারপ্রাইজটাও তো বেশ ভালই দিয়েছে। কিন্তু দিদি ডিজাইনটা কিন্তু সত্যি দারুণ। একেবারে ফাটাফাটি। কিন্তু অর্চু সত্যি এ’সব জানে”?
সীমন্তিনী নবনীতার বিছানার একপাশে বসে বলল, “শুধু ডিজাইন? কাটিংও নিজে করেছে। আর গোটা নাইটিটা সুচ সুতো দিয়ে নিজে হাতে সেলাই করেছে। ভাবতে পারছিস”?
নবনীতা আরও অবাক হয়ে বলল, “বলছ কি দিদি? অর্চু নিজে কাটিং টেলারিং ডিজাইনিং সব কিছু করেছে”?
সীমন্তিনী খুব উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল, “তবে আর তোকে বলছি কি আমি? একেবারে উপর্য্যুপরি একের পর এক সারপ্রাইজ। ওই তো এসে গেছে, দ্যাখ”।
অর্চুকে ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে নবনীতা কিছু একটা বলতে যেতেই, “অর্চু তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “আগে চট করে হাতমুখটা ধুয়ে এস তো নীতাদি। নইলে লুচিগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। খেতে খেতে যা বলার বলো”।
নবনীতা সাথে সাথেই বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে অর্চনার হাত থেকে থালা নিয়ে খেতে শুরু করল। খাবার মুখে দিয়েই সে ‘বাহ বাহ’ করে উঠল। সীমন্তিনী অর্চনার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে নীতা, কেমন লাগছে আলুর দমটা”?
নবনীতা মুখের মধ্যে গ্রাস পুরে রেখেই জবাব দিল, “উম্মম দারুণ বানিয়েছ অর্চু। মার্ভেলাস”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে বলল, “অর্চু সোনা, লক্ষ্মীদিকে একটু গিয়ে বলে আয় আমাদের সকলের চা যেন সে এ ঘরেই নিয়ে আসে। আর তুইও কথাটা বলে এ ঘরে চলে আসিস। কথা আছে”।
লক্ষ্মীকে চায়ের কথা বলে অর্চনা ফিরে আসতেই সীমন্তিনী আবার তাকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল, “অর্চু সোনা। তোকে এখন কতগুলো কথা বলব আমি। তুই কিন্তু জবাবে তোর মনের কথা বলবি, ঠিক আছে”?
অর্চনা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি তোমার কাছে নিজের মনের কথা না বলে মিথ্যে কথা বলব বলে ভাবছো দিদিভাই? এমন দিন যেন আমার জীবনে না আসে। কি বলবে বলো”?
সীমন্তিনী অর্চনার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে খুব মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করল, “দ্যাখ অর্চু। আমি তোকে পুরনো সব কথা ভুলে গিয়ে নতুন ভাবে জীবনটা কাটাবার কথা ভাবতে বলেছিলুম। আমি জানি, এখন তুই বাবা মা আর ভাইয়ের সাথে খুব ভাল আছিস। কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা কিছু ভেবেছিস কখনও”?
অর্চনা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ভবিষ্যৎ জীবনের কথা মানে? আমি তো তোমার কথা ঠিক বুঝতে পাচ্ছিনা গো দিদিভাই”?
সীমন্তিনী আগের মতই নরম সুরে বলল, “কেন রে? এ আবার না বোঝার কি আছে? আমি তো সহজ ভাষাতেই কথাটা জিজ্ঞেস করলুম। এখন বাড়িতে বাবা মা ভাইয়ের সাথে তুই যে খুব ভালো আছিস, সেটা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ তো হচ্ছে তোর বর্তমানের কথা। সকলেরই তো ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কিছু চিন্তা ভাবনা থাকে। নীতা যেমন এতদিন লক্ষ্যভ্রষ্ট ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে। আমার পরামর্শটা মেনে নিয়ে ও ভবিষ্যতে নিজের একটা বুটিক কিংবা গারমেন্টসের কারখানা খুলবে। তোর ভবিষ্যতের কথা তো তোর মুখে কখনও শুনিনি আমি। তাই জিজ্ঞেস করছি, তুই কি কখনও তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবিস না”?
নবনীতা খেতে খেতেই একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে অর্চনা আর সীমন্তিনীর দিকে দেখে আবার খাবারে মন দিল। অর্চনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিল, “দিদিভাই, ছোটবেলা থেকে আমরা তিন ভাই বোন শুধু দারিদ্রের ছবি দেখতেই অভ্যস্ত ছিলুম। তার বাইরে কোনও কিছু নিয়ে ভাববার বা কোনও স্বপ্ন দেখবার কথা আমি আর রচু কোনদিন ভাবতেও পারতুম না। ভাই তো তখন একেবারেই ছোট ছিল। ওইটুকু রত্তি একটা ছেলের কতটুকুই বা বোধশক্তি থাকতে পারে বলো? তবু ওই বয়সেই ভাইটাও যেন কিভাবে আমাদের দারিদ্রের কথা বুঝতে শিখে গিয়েছিল। আমরা সবাই জানতুম, বাবা মা আমাদের ঘরোয়া শিক্ষা যতই দিন না কেন, আমরা কেউই বেশীদুর লেখাপড়া করতে পারব না। না, এতে বাবার কোন দোষ ছিল না। আমাদের আর্থিক দুরবস্থার জন্যই বাবা সেটা করতে পারেন নি। মাধ্যমিক পাশ করবার পরেই বাবা নিরুপায় হয়ে আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর ঘটকের মিথ্যে কথায় ভুলে আমি সুখে থাকব আর ভাল সরকারি চাকুরে পাত্র পেয়েছে বলে, খুব তাড়াতাড়িই আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। রচুর কপালটা তুলনামূলক ভাবে কিছুটা ভাল নিশ্চয়ই ছিল। তাই তো আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালের সাহায্যে সে বারো ক্লাস অব্দি পড়তে পেরেছিল। তারপর তোমার সাথে আমাদের বাড়ির সকলের পরিচয় হল। রচুর মুখে শুনেছি, তুমি ওকে কলেজে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলে। কিন্তু ও শ্বশুর বাড়ির সকলকে বিয়ের আগে থেকেই এমন ভালবেসে ফেলেছিল যে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ি গিয়ে পড়তেও রাজি হল না। আসলে দিদিভাই, আমাদের দু’বোনের মধ্যে কেউই বোধহয় সেভাবে স্বপ্ন দেখতে শিখিনি গো। তাই তেমন কোন উচ্চাশাও বুঝি আমাদের দু’বোনের মনে কোনদিন জন্মায় নি। তবে তুমি যেভাবে আমাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছ, তাতে ভাই এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শিখেছে। আর বাবাও আগের চেয়ে কত বেশী প্রত্যয়শীল হয়ে উঠেছেন এখন। যে লোকটাকে জন্মের পর থেকে শুধু দুর্ভাবনা ছাড়া আর কিছু করতে দেখিনি, সে লোকটাই এখন যেন কোন এক সঞ্জীবনীর সুধায় উদ্যমী হয়ে উঠছেন, নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। যে লোকটা সংসারের বোঝা সামলাতে না পেরে প্রায় কুঁজো হয়ে পড়েছিলেন, আজ তিনিই শিরদাঁড়া সোজা করে চলছেন, মন দিয়ে নতুন উদ্যমে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তার শরীর স্বাস্থ্যও আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়ে উঠেছে। আর সে সঞ্জীবনী সুধা যে কী, তা আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যই চিনতে পেরেছে। ভাই যদিও কিছু খুলে বলেনি এখনও, কিন্তু ও নিজেও যে কিছু একটা উদ্দেশ্যের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, এটাও বেশ ভালই বুঝতে পেরেছি। আর এটাও হয়েছে ওই সঞ্জীবনীর গুণেই। রচু সেই সঞ্জীবনীর ছোঁয়ায় কোনভাবে আগের চেয়ে বেশী আত্মবিশাসী হয়ে উঠেছে কিনা সেটা আমি ঠিক জানিনা। তবে সে সঞ্জীবনীই যে তার মন প্রাণ হৃদয় জুড়ে আছে, সেটা আমি একদিনেই বুঝে গিয়েছিলুম। সে সঞ্জীবনী তো আমাকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছে পুরোপুরি। কিন্তু আমার শিরদাঁড়াটাই বুঝি ভেঙে গেছে গো দিদিভাই। স্বপ্ন দেখবার, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার দুঃসাহস কিছুতেই যেন করে উঠতে পারছি না আমি। আমি জানিনা আমার ভবিষ্যৎ কী। আমি জানিনা আগামীকাল আমার কী করা উচিৎ। আমি শুধু একটাই কথা জানি এখন। সে শুধু তুমি। তুমি আমাকে নতুন জন্ম দিয়েছ। তাই তুমিই আমার ভগবান, তুমিই আমার সব। অন্য আর কিচ্ছু আমি ভাবতেই পারিনা গো দিদিভাই”।
নবনীতা প্রায় ছুটে গিয়ে নিজের খালি থালাবাটি ডাইনিং টেবিলে রেখে আবার ছুটেই ঘরে এসে ঢুকল। লক্ষ্মীও ট্রেতে করে চার কাপ চা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। সীমন্তিনী তখন অর্চনাকে বলছিল, “কিন্তু অর্চু, সেটা বললে কি হয় রে বোন। তোর আজ মনে হচ্ছে তুই খুব ভাল আছিস। কিন্তু পৃথিবীর সব কিছু যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি মানুষের জীবনেও সময়ে সময়ে কিছু পরিবর্তন অবধারিত ভাবেই এসে থাকে। চিরটা কাল কি আর একভাবে কাটে? তাই সকলকেই নিজ নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেই হয়। আর তোকেও ভাবতে হবে”।
লক্ষ্মী সকলের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে নিচে মেঝেতে বসতে বসতে বলল, “হ্যাঁ গো দিদিমণি, তুমি একদম ঠিক বলেছ গো। এমন সুন্দর ফুটফুটে মিষ্টি একটা মেয়ে, সে সারাটা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে, এ তো ভাবাই যায় না। উনি নিজে যে মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারবেন না, এটা তো আমি খুব ভালভাবেই বুঝে গেছি এ ক’টা দিনে। তুমিই কিছু একটা করো দিদিমণি”।
নবনীতাও প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠল, “হ্যাঁ দিদি, আমিও কিন্তু লক্ষ্মীদির সাথে একমত। কতটুকুই বা অর্চুর বয়স বল তো? এই কচি বয়স থেকেই সারাটা জীবন উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে কাটিয়ে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। তবে ওর কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, ওর ভেতর আত্মবিশ্বাসের খুব অভাব। তবে তার জন্য ওকে তেমন দোষও দেওয়া যায় না। ওকে যেভাবে কষ্ট যাতনা ভোগ করতে হয়েছে, তাতে ওর জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে তারও হয়ত একই অবস্থা হত”।
তারপর অর্চুর হাতের ওপর নিজের একটা হাত রেখে বলল, “অর্চু, তোমাকে তো আমার জীবনের প্রায় সব কথাই খুলে বলেছি। আমি তো গত সাতটা বছরে রোজ রোজ কষ্ট পেয়ে গেলেও, কোনভাবে কোন রাস্তা খুঁজে না পেলেও, মনের এক কোনায় এ বিশ্বাসটুকু ধরে রাখতে পেরেছিলাম, যে একদিন না একদিন আমি ঠিক ওই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। আর সে ইচ্ছেটা ছিল বলেই হয়ত আমি সেটা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সব শেষে যখন বেঁচে থাকার আর কোন রাস্তা খুঁজে না পেয়ে ম্যাডামের কাজে ঢুকলাম, তখন বুঝি আমার আত্মবিশ্বাসও টলমলে হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ভগবানের অশেষ কৃপায় তার মাস খানেক বাদেই দিদি তখন আমার জীবনে এল। আর রূপকথার গল্পের মত, দিদির সোনার কাঠির ছোঁয়ায়, ওই একটা দিনেই আমার জীবনটা আমূল বদলে গেল। আর এখন আমার মনের প্রত্যয়, নিজের আত্মবিশ্বাস তো আরও অনেক বেড়ে গেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আর সে দিকেই লক্ষ রেখে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। মনের মধ্যে একটা আলাদা তাগিদের অস্তিত্ব বুঝতে পারছি। তোমাকেও তো এমনি ভাবে কিছু একটা উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে হবে ভাই। নইলে যে জীবনের কোন মানেই থাকে না”।
অর্চনা অসহায়ের মত বলল, “আমি যে সত্যি কিছু ভেবে উঠতে পারিনা গো নীতাদি। বিশ্বাস করো, আমি একটুও মিথ্যে বলছি না। তোমরাই বলে দাও না আমার কী করা উচিৎ”।
সীমন্তিনী এতক্ষণ ইচ্ছে করেই চুপ করে ছিল। এবারেও সে কোন কথা বলল না। কিন্তু লক্ষ্মী বলে উঠল, “সোনাদি, আমি তো মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। অত সাজিয়ে গুছিয়ে কথা আমি বলতে পারি না। তবে গ্রামের মেয়ে বলে এটুকু জানি যে কোন চাড়া গাছ যদি নিজের ক্ষমতায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না পারে, তাহলে সেই চাড়া গাছের মালিক একটা বাঁশকাঠি পুঁতে দিয়ে গাছটাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। গাছটা তখন সেই বাঁশকাঠির ওপর ভর করেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তোমার অবস্থাও কিন্তু অমন একটা ছোট চাড়া গাছের মতই। তোমারও অমন একটা সহায়ের দরকার। আর তাই আমি বলছি, তোমাকে আবার ভাল কোন একটা ছেলেকে বিয়ে করা উচিৎ”।
অর্চনা লক্ষ্মীর কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। তখন সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল, “নীতা, তুই এ ব্যাপারে কিছু সাজেশান দিতে পারিস? না না, তোকে সেভাবে কোন দায়িত্ব নিয়ে কিছু করতে বলছি না। কিন্তু এখানে আমরা তিনজনই তো অর্চুকে খুব ভালবাসি। ও ভাল থাকুক, সুখে থাকুক, এটাই তো আমরা সবাই চাই, তাই না? লক্ষ্মীদি কিন্তু একটা ভাল পরামর্শ দিয়েছে বলেই আমি মনে করি। তোর মনেও তো এমন কোন কথা থাকতে পারে। তাই জিজ্ঞেস করছি”।
নবনীতা নিজের চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “দিদি, লক্ষ্মীদির কথাটাকে কিন্তু আমিও সাপোর্ট করছি। আমার মনে হয়, অর্চুর ভেতর যখন আত্মবিশ্বাসের এতটাই অভাব আমরা বুঝতে পাচ্ছি, তখন ওকে অন্য কোনভাবে প্রেরণা দিয়েও বুঝি খুব একটা লাভ হবে না। ঘরের বৌ করে তুলতে ছেলের বাড়ির লোকেরা একটা মেয়ের মধ্যে যা কিছু পেতে চায়, তার সবকিছুই ওর মধ্যে আছে। শুধু ওর নামের পাশে একটা বাজে তকমা সেঁটে গেছে। বিধবা। ও যদি রাজি হয়, তাহলে আমরা খুঁজে পেতে এমন কোন ছেলে হয়ত পেতেই পারি, যে ওর গায়ে লেগে থাকা ওই তকমাটাকে একেবারেই গ্রাহ্য করবে না। আর স্বামীর সংসার করবার স্বপ্ন কোন মেয়ে না দেখে বলো তো? আর ও তো পুরোপুরিভাবে একটা ঘরোয়া মেয়ে। ওর বয়সও কম। ওর মনেও এমন একটা ইচ্ছে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। হয়ত লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পাচ্ছে না। কিংবা একবার ওর জীবনে যে দুর্ভোগ এসেছিল, সে’কথা ভেবেই ও আর নতুন করে ও’রকম কোন স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছে। তবে ও যদি একটু সাহস করতে পারে, তাহলে আমরা তিনজনে মিলে চেষ্টা করে ওর মনের ভয় দুর করে দিতে পারব। তাই আমিও কিন্তু সেটাই চাইছি। তবে সবটাই নির্ভর করছে মেইনলি ওরই ওপর। ওকে আগে মনস্থির করতে হবে। অবশ্য কালচিনির মাসি মেসো ভাই আর বৌদির মতামতেরও দরকার আছে। কারন অর্চু তো তাদেরই পরিবারের সদস্য”।
নবনীতা থামতে আর কেউ কোন কথা বলল না। কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে সীমন্তিনী অর্চনাকে একহাতে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কিরে, তুই আর কিছু বলবি”?
অর্চনা মাথা তুলে সীমন্তিনীর চোখের দিকে একবার দেখে আবার মাথা নিচু করে বলল, “আমি কি বলব দিদিভাই। আমি যে সত্যিই কিছু বুঝিনা গো। লক্ষ্মীদি আর নীতাদি যে’সব কথা বলল, তা তো ঠিকই। মাত্র ষোল বছর বয়সেই বিয়ের ইচ্ছে মনে না এলেও বাবার এবং পরিবারের ইচ্ছেয় বিয়েতে রাজী হয়েছিলুম। তখন মনে মনে একটা স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিলুম। ভেবেছিলুম শ্বশুর বাড়ি গিয়ে স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ি আর ছেলেদেরকে খুব ভালবাসব। তাদের প্রিয়জন হয়ে ওঠার চেষ্টা করব। মা আমাদের দু’বোনকে সে শিক্ষাই দিয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবে চেষ্টা করবার সুযোগটাই পাই নি। ফুলসজ্জার রাতেই বেহেড মাতাল হয়ে স্বামী হাতে মদের বোতল আর দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে তাদের গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢেলে দিতে আদেশ করেছিল। তার মুখের মদের গন্ধেই আমার গা গুলিয়ে উঠছিল। ছোটবেলা থেকে এমন পরিবেশ কোথাও চোখে দেখিনি। তাই বোধহয় সামান্য ইতস্ততঃ করেছিলুম। আর তাতেই রেগে উঠে সে একটা লাঠি দিয়ে আমাকে পেটাতে শুরু করেছিল। তার সাথে হাত মিলিয়েছিল ছেলেদুটোও......” বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল।
সীমন্তিনী অর্চনাকে বুকে চেপে ধরে বলল, “থাক অর্চু, ও’সব কথা আর মনে আনিসনে বোন”।
______________________________