15-03-2020, 07:16 PM
(Update No. 159)
মিনিট দশেক বাদে অভি রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাইক স্টার্ট করে একদিকে এগিয়ে চলল। প্রায় পাচ’শ গজ যাবার পরেই অভীষ্ট ফার্ম হাউসের সামনে এসে পৌঁছল। ফার্ম হাউসের গেটে বাইক দাঁড় করিয়ে সে হর্ন বাজাতে শুরু করল। কিন্তু গেটের ভেতর যতদুর চোখ যায় কাউকে দেখতে পেল না। কয়েকবার হর্ন বাজিয়েও কোন লাভ হল না।
একসময় বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে বাইকটাকে রাস্তায় রেখেই সে গেটটাকে ভেতরের দিকে একটু ঠেলতেই গেট খুলে গেল। মাথায় হেলমেট সহই অভি একমূহুর্ত দেরী না করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। গেট থেকে ফার্ম হাউসের মূল দরজা প্রায় একশ’ গজ দুরে। অভি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সেদিকে এগিয়ে গেল। মূল দরজার পাশেই ফার্ম হাউসের দুটো গার্ডকে মরার মত পড়ে থাকতে দেখে সে আর এক মূহুর্তও দেরী না করে নিজের পকেট থেকে ছোট একটা চিপ আর খুব সরু আর ধারালো একটা ছুরি বের করল। একজন গার্ডের একটা জুতো তার পা থেকে খুলে একপাশে পড়েছিল। আর অন্য জুতোটা যদিও তার পায়েই ছিল, তবু সেটারও লেস খোলা। অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে খোলা জুতোটা হাতে নিয়ে সে ধারালো চাকুটা দিয়ে জুতোর তলার গোড়ালীর দিকে একটা জায়গায় ছুরিটার প্রায় ইঞ্চি খানেক ঢুকিয়ে দিয়ে একটা চ্যাপ্টা গর্তের মত ফাঁকের সৃষ্টি করল। তারপর প্রায় আধ ইঞ্চি লম্বা চিপটাকে সে ফাঁকের ভেতর দিয়ে গলিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে আরেকটা ছোট সলিউশনের টিউব বের করে জুতোর সোলের ফাঁকের ভেতর খানিকটা সলিউশন ঢুকিয়ে দিল। তারপর হাত দিয়ে চেপে ধরে ফাঁকটাকে ওপর নিচে চাপ দিতেই ফাঁকটা পুরোপুরি ভাবে জোড়া লেগে গেল। আরেক গার্ডের পা থেকে একটা জুতো খুলে সেটাতেও একই রকম ভাবে আরেকটা চিপ ঢুকিয়ে আবার সীল করে দিল। কয়েক সেকেন্ড সেগুলোর দিকে দেখে মনে মনে আশ্বস্ত হয়ে সে আবার খোলা জুতোটাকে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে, চাকু আর সলিউশনের টিউবটা পকেটে পুরে নিয়ে ত্র্যস্ত পায়ে মেন গেটের দিকে এগিয়ে গেল। বিশাল লোহার গেটের কাছে এসে পকেট থেকে সে আরেকটা ছোট চিপসের মত জিনিস বের করে হাঁটু মুড়ে বসল। শার্টের পকেট থেকে সেলোটেপের রোল বের করে তার থেকে দু’ইঞ্চির মত একটা টুকরো কেটে নিল। গেটের সব চেয়ে নিচের হরাইজন্টাল চৌকো রডটার তলার দিকে চিপটাকে সেলোটেপ দিয়ে এমনভাবে সেঁটে দিল, যে বাইরে থেকে বিন্দুমাত্রও বুঝবার জো রইল না। একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখেই সন্তুষ্ট হয়ে সে তড়িঘড়ি গেটের বাইরে এসে গেটটাকে আবার টেনে দিয়ে নিজের বাইক স্টার্ট দিয়ে ফেরবার পথ ধরল।
রেস্টুরেন্টটার কাছে এসে সে একটু থামল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে মোবাইল সেটিং-এ ঢুকে সে কিছু খুটখাট করতেই মোবাইলে বিপ বিপ করে শব্দ হল দুটো। খুশী হয়ে মোবাইল পকেটে পুরে সে আবার বাইক চালালো ফেরার পথে।
***************
পরের দিন রাতে ডিনার শেষ করে নবনীতা আর অর্চনা তাদের ঘরে চলে যাবার সময় সীমন্তিনী তাদের দু’জনকে ফিসফিস করে বলল, “শোন, লক্ষ্মীদি কাজ শেষ করে নিজের ঘরে শুতে চলে গেলে তোরা চুপিচুপি আমার ঘরে চলে আসিস। কাজ আছে”।
নবনীতা আর অর্চনা সম্মতি জানিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যাবার পর সীমন্তিনী নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে তার ব্যাগের ভেতর হাতরাতে হাতরাতে নবনীতার ফোনের সিমকার্ডটা খুঁজে পেল। তারপর সে ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বিছানার পাশে সাইড টেবিলের ওপর রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে নিজের অফিসিয়াল মোবাইল থেকে সিম কার্ডটা খুলে নবনীতার সিমটা ভরে দিয়ে ফোন সুইচ অন করল। কয়েক মূহুর্ত বাদে মোবাইলের স্ক্রীনে মেনু ফুটে উঠতেই সে কন্টাক্ট ফোল্ডারে গিয়ে ঢুকল। আর প্রায় সাথে সাথেই বীথিকার কন্টাক্ট নাম্বারটা পেয়ে গেল। এবার সে তার নিজের পার্সোনাল মোবাইলে বীথিকার নাম্বারটা লিখে নিয়ে নবনীতার সিম ভরা মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিল। তারপর নবনীতার সীমটা মোবাইল থেকে বের করে আবার নিজের ব্যাগের ভেতর ভরে রাখল। আর প্রায় ঠিক তখনই লক্ষ্মীর ঘরের দরজা বন্ধ করবার শব্দ কানে এল।
সীমন্তিনী নিজের অফিসের মোবাইলে আবার আগের সিমটা ঢুকিয়ে মোবাইল সুইচ অন করে বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে গিয়ে ঘরের দরজার লক খুলে দিয়ে দেয়ালের দিকের টেবিল থেকে ল্যান্ডলাইন ফোনটা এনে নিজের বিছানার ওপর রাখল। আর প্রায় সাথে সাথেই তার ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে গেল। নবনীতা চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “দিদি, আমরা আসবো”?
সীমন্তিনী তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে দু’জনকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আস্তে কথা বলবি সবাই। লক্ষ্মীদি যেন কিছু বুঝতে না পারে। যা তোরা বিছানায় গিয়ে বোস” বলে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিল।
নিজের বিছানায় এসে সীমন্তিনী অর্চনার একটা হাত ধরে নিচু গলায় বলল, “অর্চু, নীতা এখন একজনের সাথে ফোনে কথা বলবে। কিন্তু এখন ফোনের স্পীকার অন করে কথা বলা যাবে না। লক্ষ্মীদি টের পেয়ে যেতে পারে। আমি তাকে এখন কিছু জানাতে চাইছি না। নীতা ফোনে কথা বলতে শুরু করলেই তুই কিন্তু একদম চুপ করে থাকবি। মুখ দিয়ে সামান্য একট শব্দও যেন না বেরোয়। আমিও কোনও কথা বলব না। তবে ফোনের সাথে একটা হেডফোন লাগিয়ে আমরা দু’জনে ওদের সব কথাই শুনতে পারব। কিন্তু মুখে কিন্তু টু শব্দটিও করা চলবে না, এটা মনে রাখিস” বলতে বলতে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বিশেষ ধরণের হেডফোন বের করে ল্যান্ডলাইন ফোনের এক পাশের একটা পয়েন্টের সাথে জুড়ে দিয়ে হেডফোনের একটা প্রান্ত অর্চনার কানে আর অন্য প্রান্তটা নিজের কানে লাগিয়ে দিল।
নবনীতা নিজের কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল, “কার সাথে কথা বলতে হবে আমাকে দিদি”?
সীমন্তিনী চাপা গলায় জবাব দিল, “বলছি, কিন্তু তার আগে শোন নীতা। তুই যে আমাদের ঘরে বসেই তার সাথে কথা বলছিস, এটা যেন সে কোনভাবেই বুঝতে না পারে। ফোনটা প্রথমে আমি করব। তারপর ও’পাশ থেকে সাড়া পেলে আমি রিসিভারটা তোর হাতে দেব। এমন ভাব করব যে আমি একটা পিছিও থেকে কথা বলছি। তুই যখন তার সাথে কথা বলবি, তখন ও’পাশ থেকে কে তোর সাথে কথা বলছে সেটা শুনলেই তুই চমকে উঠবি। হয়তো চেঁচিয়ে উঠতে পারিস। কিন্তু সেটা করা একেবারেই চলবে না। তাই আগে থেকেই তোকে জানিয়ে দিচ্ছি। ও’পাশে বীথিকা থাকবে। অবশ্য জানিনা, ও এখন ঘরেই আছে কি না। তবে ও যদি সত্যিই কলটা রিসিভ করে তাহলে তুই তোর ইচ্ছে মত তার সাথে কথা বলতে পারিস। তোর যা কিছু বলতে ইচ্ছে করে বলিস। আমি কোন কিছুতেই বারণ করব না। কিন্তু তুই এখন আসলে কোথায় আছিস সেটা ওকে জানাতে পারবি না। তুই যে আমার সাথে কলকাতা থেকে পালিয়ে এসে আমার এখানেই আছিস, এটাও বলতে পারবি না। আর আমার নাম ঠিকানাটাও তাকে বলবি না। মিথ্যে বলবি যে তুই এখন কাটোয়ায় আছিস। একটা গারমেন্টস কারখানায় কাজ করছিস। মন খুলে ওর সাথে কথা বলবি। তোর যা যা বলতে ইচ্ছে করে বলিস। কিন্তু ওর সাথে কথায় কথায় বিমল আগরওয়ালা আর মহিমা মালহোত্রার ব্যাপারে যতটুকু জানতে পারিস তার চেষ্টা করবি। দাদাভাই আর রচুর প্রতি মহিমার মনোভাব আর ব্যবহার কেমন, মহিমার মনে কি দাদাভাই আর রচুকে তার এসকর্টের ব্যবসায় নামাবার কোনও প্ল্যান আছে কি না, বিমল আগরওয়ালাকে বীথিকা চেনে কি না, বিমলের পরিবারে কে কে আছে। তাদের চালচলন ব্যবহার বা স্বভাব কেমন, তারা কোথায় কোথায় যায়, কি কি করে বেড়ায়, এ’সব সম্বন্ধে যত বেশী কথা জানতে পারিস সে চেষ্টা করবি। বুঝেছিস তো”?
নবনীতা সীমন্তিনীর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে দিদি। আমি বুঝেছি। কিন্তু দিদি, এতসব ব্যাপারে কথা বলতে গেলে তো অনেকটা সময় লাগবে”।
সীমন্তিনী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “লাগুক, তাতে কি হল? হয়তো আমাদের সকলের ঘুমোতে একটু দেরী হয়ে যাবে, এর বেশী তো আর কিছু হবে না। কিন্তু আমার রচুসোনার বিপদ কাটাতে এ টুকু সাহায্য তুই আমাকে করবি না”?
নবনীতা সীমন্তিনীর হাতটা জোরে চেপে ধরে বলল, “ও’কথা বোল না দিদি। বৌদির সুরক্ষার জন্য পরি আর আমি সব সময় তোমার পাশে আছি”।
সীমন্তিনী বলল, “সেটা জানি বলেই তো তোকে আগে থেকে কিছু না জানিয়েই আমি এসবের প্ল্যান করেছি। কত কষ্ট করে বীথিকার নাম্বারটা যোগার করেছি। আচ্ছা শোন, কথা বলে আর সময় নষ্ট করছি না। আমি এবার ফোনটা করছি। সবাই চুপ করে থাকবি” বলে ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে বীথিকার নাম্বার ডায়াল করল। কিন্তু বীথিকার তরফ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। ফোনটা বেজে বেজে একসময় টাইম আউট হয়ে গেল।
সীমন্তিনী দ্বিতীয় বার ডায়াল করতে যেতেই নবনীতা বলল, “এমনও হতে পারে যে ও এখন কাজেই ব্যস্ত আছে”।
দ্বিতীয় বার ডায়াল করেও কাজ হল না। এবারেও একই অবস্থা। সীমন্তিনী দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল রাত প্রায় এগারোটা। নবনীতা চাপা গলায় বলল, “দিদি, হয়তো ও কাজেই ব্যস্ত আছে। ওকে তো মাঝে মধ্যেই হোল নাইট ডিউটি করতে হয়। আর হোল নাইট না হলেও রাত বারোটা একটা পর্যন্ত ডিউটি তো প্রায় সব দিনই করতে হয়”।
সীমন্তিনী আরেকবার ডায়াল করতে করতে বলল, “ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করে দেখাই যাক না”।
এবার ও পাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল। এক মেয়েলী কন্ঠ বলে উঠল, “হ্যালো, কে বলছেন”?
সীমন্তিনী নবনীতার দিকে ঈশারা করে বলল, “আমি কাটোয়ার একটা পিছিও থেকে বলছি। আচ্ছা আপনি কি মিস বীথিকা মল্লিক”?
বীথিকা ও’পাশ থেকে ‘হ্যাঁ’ বলতেই সীমন্তিনী আবার বলল, “আচ্ছা এই নিন, কথা বলুন” বলেই রিসিভারটা নবনীতার হাতে ধরিয়ে দিল। নবনীতা রিসিভার কানে লাগিয়েই বলে উঠল, “বীথি, আমি নীতা বলছি রে”।
ও’পাশ থেকে বীথিকা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “নীতা, তুই? তুই কোত্থেকে বলছিস? আর এটা তোর কেমন ব্যবহার রে? বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলি। এক মাসের ওপর হয়ে গেল তোর একটা খবর পর্যন্ত পাচ্ছি না আমরা। আমি আর ম্যাম তোর জন্যে কত চিন্তা করছি। কোথায় আছিস তুই? নাকি আবার ওই বদমাশটার খপ্পরে পড়েছিস? তোকে কি আবার আসানসোল নিয়ে গেছে ওরা”?
নবনীতা শান্ত গলায় বলল, “নারে বীথি, তেমন কোন ব্যাপার হয়নি রে। কিন্তু তোদেরকে কন্টাক্ট করবার সুযোগই আমি পাইনি রে। আমি জানি তোরা আমার কাছ থেকে কোন খবর না পেয়ে খুব চিন্তায় থাকবি। কিন্তু আসলে কি হয়েছে জানিস। মাস খানেক আগে আমি কোলকাতা ছেড়ে কাটোয়ায় চলে এসেছি। কিন্তু আসবার সময় পথে এক জায়গায় আমার মোবাইলটা হারিয়ে ফেলেছি। তুই তো জানিস আমার স্মৃতি শক্তি খুব কম। তোর বা ম্যাডামের নাম্বার আমার মনে ছিল না। মনে করবার অনেক চেষ্টা করেও তোর মোবাইলের দশটা নাম্বার কিছুতেই মনে পড়ছিল না আমার। প্রথম ছ’টা নাম্বার আমার মনে ছিল। সেই নাম্বারগুলোর সাথে আন্দাজে বাকি চারটে নাম্বার বসিয়ে তোকে রোজ এক একটা পিছিও থেকে ফোন করে যাচ্ছিলাম। আজ হঠাৎ করেই তোর সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল”।
বীথিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কাটোয়ায় আছিস? ওখানে কবে গিয়েছিস আর কেন গিয়েছিস? তুই ভাল আছিস তো? তোর কোন বিপদ আপদ হয়নি তো নীতা”?
নবনীতা আগের মতই শান্ত স্বরে জবাব দিল, “আমি ঠিক আছি রে বীথি। বিপদ আপদ কিছু হয়নি। আর এখানে আমি এসেছি আগষ্টের এগারো তারিখেই। সেদিন সকালেই তোর সাথে আমার শেষ দেখা ও কথা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বেস কর বীথি, যখন আমি তোর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম তখন আমি নিজেও জানতাম না যে আমি সেদিনই কলকাতা ছেড়ে চলে আসব। সেটা আগে থেকে জানা থাকলে আর অন্য কাউকে বলি বা না বলি তোকে অন্ততঃ জানিয়ে আসতাম। সেদিন আসলে আমার এক পুরনো পরিচিত বন্ধুর সাথে দেখা করতেই বেরিয়েছিলাম শুধু। কিন্তু ঘটণাচক্রে এমন একটা সুযোগ তখন হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম যে ওই মূহুর্তেই আমাকে ডিসিশনটা নিতে হয়েছিল। আমার ওই বন্ধুর মাধ্যমেই কাটোয়ার একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিকের সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। আর আমার জীবনের সব কথা শুনে ভদ্রলোক আমায় সেদিনই তার গারমেন্টস ফ্যাক্টরীতে একটা চাকরি দেবার জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তুই তো জানিসই বীথি, ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক, শুধু বেঁচে থাকবার জন্যেই আমাকে নিজের মান সম্মান ইজ্জত সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। আমার ওই বন্ধুর পরিচিত সেই গারমেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিক, খুবই সজ্জন এবং ভদ্রলোক। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে যদি সৎ ভাবে জীবন কাটাতে চাই, তাহলে যেন সেদিনই বিকেলের ট্রেণে আমি তার সাথে কাটোয়া চলে যাই। তুই তো জানিস, সৎ ভাবে বাঁচবার লোভ আমার মনে সব সময়ই ছিল। তাই সেদিন ওই সুযোগ পেয়ে লোভটা আর সামলাতে পারিনি রে। তার কথায় আর আমার বন্ধুর পরামর্শে আমি সেদিনই তার সাথে চলে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ট্রেনে উঠে তোকে আর ম্যাডামকে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দেব। কিন্তু চলতি ট্রেনের টয়লেটে ঢুকে মোবাইল হাতে নিয়ে তোকে ফোন করতে যেতেই হঠাৎ ট্রেনের ঝাকুনিতে সেটটা হাত থেকে ছিটকে টয়লেটের কমোডের ভেতর পড়ে গিয়েছিল। আর ট্রেনের টয়লেটে পড়া মানে যে কি সেটা তো তুই জানিসই। কোনভাবেই সেটা আর ফিরে পাবার সম্ভাবনা ছিল না। তাই তোকে আর ফোন করতে পারিনি। অবশ্য ওই ভদ্রলোক তার নিজের মোবাইল থেকে আমাকে ফোন করতে বলেছিলেন। কিন্তু নাম্বারটা আর কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। তাই তো তোকে আর ফোন করে খবরটা জানাতে পারিনি আমি। নতুন একটা মোবাইল এখনও কিনে উঠতে পারিনি। তবে সেদিন থেকেই একের পর এক নাম্বার আন্দাজ করে বিভিন্ন পিছিও থেকে তোকে ফোন করে চলেছি একনাগাড়ে। শেষমেশ আজ তোকে পেলাম”।
এবার বীথিকা বেশ খুশীর গলায় বলল, “সত্যি বলছিস তুই নীতা? এখন থেকে তোর শরীরটাকে আর নোংড়া কামপিপাসু কোন লোকের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে না? তুই এখন থেকে একটা ভদ্র মেয়ের মত বাঁচতে পারবি”?
নবনীতাও আবেগ ভরা গলায় বলল, “হ্যারে বীথি। এখন আর আমাকে সে’সব করতে হচ্ছে না। এই একটা মাস থেকে আমি সত্যি খুব ভাল আছি রে। আমাদের কারখানার আরেকটা মেয়ের সাথে একসাথে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়েছি। দুপুরের খাবার কারখানা থেকেই দেয়। সকালের ব্রেকফাস্ট আর রাতের খাবার নিজেদের ঘরেই খাই। বেতন পাচ্ছি মাসে আট হাজার। তিন হাজার টাকা ঘর ভাড়ার অর্ধেকটা আমাকে দিতে হয়। বাকি টাকায় একটু কষ্ট হলেও কোনমতে সামলে নিচ্ছি। আর ভাল করে কাজটা শিখে নিতে পারলে মালিক আমার বেতন বাড়িয়ে দেবে বলেছেন। তবে যেটুকু কষ্ট হচ্ছে, তা আগের কষ্টের তুলনায় প্রায় কিছুই না। তোর আমার মত মেয়েরা খুব আনন্দের সাথেই সেটুকু কষ্ট সহ্য করে নিতে পারবে”।
এবার বীথিকা একটু বিমর্ষ ভাবে বলল, “নারে নীতা। আমার বোধহয় আর এই নরক থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না রে। জানিস, বাবার অবস্থা এখনও যদিও একই রকমেরই আছে। পঙ্গু ভাইটা দিন পনেরো আগে রাস্তায় গাড়ির ধাক্কায় বেশ ভাল রকম জখম হয়েছে। ইন্টারনাল হেমারেজও কিছুটা হয়েছিল। এখনও হাসপাতালে আছে। কোমায়। কোন সেন্স নেই। সপ্তাহে সপ্তাহে সত্তর হাজার করে টাকা দিতে হচ্ছে হাসপাতালে। তাই নিজে আরও বেশী ক্লায়েন্ট নিতে শুরু করেছি। তবু কুলোতে পারছি না। ম্যাম নিজেই হাসপাতালের খরচের অনেকটাই বহন করছেন। তাই তো এখনও চালিয়ে যেতে পারছি। কিন্তু ম্যামেরও মন মেজাজ খুব একটা ভাল নেই। যদিও এ ব্যাপারে তিনি আমাকে এখন অব্দি কিছু বলেননি সরাসরি, তবে তার ভাবসাব দেখে আমার মনে হচ্ছে উনি বোধহয় এই এসকর্টের ব্যবসা ছেড়ে দেবার কথাই ভাবছেন। একদিন তো আমাকে জিজ্ঞেসই করলেন যে ‘বীথি, আমি যদি ব্যবসাটা পুরোপুরি তোমার হাতে তুলে দিই, তবে তুমি সামলাতে পারবে’? সেদিনই আমি বুঝে গেছি যে ম্যাম নিজেকে এই ব্যবসা থেকে পুরোপুরি ভাবে সরিয়ে নিতে চাইছেন। কিন্তু চিন্তা বেড়ে গেছে আমার। অবশ্য শুধু আমার কথাই বা বলছি কেন? তুই তো জানিসই নীতা, আমার মত অনেক মেয়ে মহিলাই ম্যাডামের কাছে উপকৃত। ম্যামের ওপরই তারা পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। তারাও সবাই হয়ত বিপদে পড়বে। বাধ্য হয়ে তাদেরকে শহরের অন্যান্য এসকর্ট প্রোভাইডারদের কাছে যেতে হবে। আমাকেও হয়ত সেটাই করতে হবে। তাতে ঝঞ্ঝাট ঝামেলা অনেক বেশী পোয়াতে হবে। ম্যামের এখানে আমরা যত নিশ্চিন্ত, অন্যদের কাছে আমরা ততটাই অসুরক্ষিত হয়ে থাকব। আমাদের সুবিধে অসুবিধের কথা তারা কেউ ভাববে না। যত কষ্টই হোক না কেন, তাদের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। পান থেকে চুনটি খসলে আমাদের পিঠের ছাল চামড়া তারা তুলে নেবে। কিন্তু বাবা আর ভাইকে নিয়ে আমি তো একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছি এখন থেকেই। ম্যাম যদি সত্যিই আমাদের সবাইকে ছুটি দিয়ে তার ব্যবসা বন্ধ করে দেন তাহলে আমাদের যে কী হবে সেটা ভেবেই ভয়ে হাত পা কাঁপতে শুরু করে রে। তুই বেঁচে গেছিস। এখান থেকে চলে গিয়ে ভাল একটা সুযোগ পেয়েছিস শুনে খুব ভাল লাগছে। এতদিনে মনে হয় তোর দুঃখের দিন শেষ হল। ম্যামও তোর জন্যে ভাবছিলেন। তিনিও তোর কথা শুনে খুব খুশী হবেন আমি জানি”।
নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বীথি? ম্যাম খুশী হবেন বলছিস তুই? আমি তো ভেবেছিলাম যে ম্যাম আমার ওপর নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন”।
বীথিকা এবার বলল, “তুই ম্যামকে আর কতটুকু চিনিস নীতা? তুই তো কেবল মাস খানেকই ম্যামের সাথে কাজ করেছিস। আমি তো ম্যামের সবচেয়ে পুরনো স্টাফ। ম্যাম এ ব্যবসা শুরু করবার আগে বেশ আর্থিক চাপে পড়ে নিজেই শুধু কাস্টমার নিতে শুরু করেছিলেন। তখন তার কোন টিম বা এই এজেন্সী ছিল না। আমিই প্রথম ম্যামের টিম মেম্বার হয়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে তার ব্যবসা যত ফুলে ফেঁপে উঠেছে ততই তার এজেন্সীতে ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেড়েছে। এখনও আমিই ম্যামের সবচাইতে কাছের এবং সবচেয়ে বড় বিশ্বাসভাজন। ম্যামের ব্যবসার কথা আমি যতখানি জানি, এমন আর কেউ জানে না। তবে তোকে আগেও বলেছি আমি, আর তুই নিজেও দেখেছিস, ম্যাম কারো ওপর কোন ধরণের জুলুম করেন না। বরং সকলকে তিনি নানা ভাবে সাহায্যই করেন। কেউ ম্যামের ব্যবসা ছেড়ে যেতে চাইলে ম্যাম খুব খুশী মনে তাদের ছেড়ে দেন। তুই যদি চলে যাবার আগে ম্যামকে সব জানাতিস, তাহলে তোকেও তিনি হাসিমুখে ছেড়ে দিতেন। ছেড়ে তো দিতেনই, এমনও হতে পারত যে চলে যাবার সময় ম্যাম তোকে দশ বিশ হাজার টাকাও দিয়ে দিতেন। আজ আমি চলে যেতে চাইলে তিনি আমাকেও বাঁধা দেবেন না, আমি জানি। কিন্তু আমার যে উপায় নেই রে। ভদ্রভাবে বাঁচবার আর কোন পথই যে আমার নেই। ম্যাম ব্যবসা বন্ধ করে দিলে আমাকে অন্য কোন এসকর্ট প্রোভাইডারের কাছেই যেতে হবে। তাতেও কি আর আমি সংসার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারব? রোজ হোল নাইট ডিউটি করলেও বাবা আর ভাইয়ের চিকিৎসার খরচ জোটাতে পারব না। কি যে হবে, কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস নীতা? মনে হয় বাবা আর ভাইকে বিষ খাইয়ে আমিও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করি। কিন্তু মনে যে অতটা জোরও পাচ্ছিনা রে” বলতে বলতে বীথিকা কেঁদে ফেলল।
অর্চনা নিজের মুখ চেপে ধরে কান্না আটকাবার চেষ্টা করছে দেখে সীমন্তিনী প্রায় লাফ দিয়ে তার কাছে গিয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “চুপ অর্চু সোনা। কাঁদিস না বোন। বীথিকা শুনে ফেলবে”।
নবনীতাও বীথির কথা শুনে কেঁদে ফেলল। প্রায় মিনিট খানেক কেউ কোন কথা বলল না। তারপর নবনীতা কান্না ভেজা গলায় বলল, “বীথি, কাঁদিস নে ভাই। নিজেকে শান্ত কর। আমরা সকলেই বোধহয় আগের জন্মের কোন পাপের ফল ভোগ করছি রে। ভগবান সদয় হয়েছেন বলেই বুঝি আমি ওই দুনিয়া ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। তুইও হয়ত কোনদিন ভালভাবে বাঁচতে পারবি। ভেঙে পড়িস না বীথি”।
বীথিকাও নিজের কান্না সামলাতে সামলাতে বলল, “কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। কিন্তু দ্যাখ, একটু ভালভাবে বেঁচে থাকবার ইচ্ছে তো আমাদের সকলের মনেই আছে। আমরা তো সবাই ভাল ভাবে সৎ ভাবে বাঁচবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু উপায় কি আর খুঁজে পাচ্ছি আমরা? ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ তোকে এ পাপের জগৎ থেকে উদ্ধার করেছেন বলে। কিন্তু আমি বোধহয় আগের জন্মে তোর চেয়েও অনেক বেশী পাপ করেছিলাম রে নীতা। তাই আমার পাপের শাস্তি ফুরোবার আর কোন লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি না আমি। এর ওপর ম্যাম যদি সত্যি নিজের ব্যবসা বন্ধ করে দেন, তাহলে যে কী হবে, তা ভাবলেও আমি শিউড়ে উঠি”।
নবনীতা বলল, “আচ্ছা বীথি, তোর কী মনে হয়? ম্যাম কি সত্যিই ওই ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন”?
______________________________
মিনিট দশেক বাদে অভি রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাইক স্টার্ট করে একদিকে এগিয়ে চলল। প্রায় পাচ’শ গজ যাবার পরেই অভীষ্ট ফার্ম হাউসের সামনে এসে পৌঁছল। ফার্ম হাউসের গেটে বাইক দাঁড় করিয়ে সে হর্ন বাজাতে শুরু করল। কিন্তু গেটের ভেতর যতদুর চোখ যায় কাউকে দেখতে পেল না। কয়েকবার হর্ন বাজিয়েও কোন লাভ হল না।
একসময় বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে বাইকটাকে রাস্তায় রেখেই সে গেটটাকে ভেতরের দিকে একটু ঠেলতেই গেট খুলে গেল। মাথায় হেলমেট সহই অভি একমূহুর্ত দেরী না করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। গেট থেকে ফার্ম হাউসের মূল দরজা প্রায় একশ’ গজ দুরে। অভি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সেদিকে এগিয়ে গেল। মূল দরজার পাশেই ফার্ম হাউসের দুটো গার্ডকে মরার মত পড়ে থাকতে দেখে সে আর এক মূহুর্তও দেরী না করে নিজের পকেট থেকে ছোট একটা চিপ আর খুব সরু আর ধারালো একটা ছুরি বের করল। একজন গার্ডের একটা জুতো তার পা থেকে খুলে একপাশে পড়েছিল। আর অন্য জুতোটা যদিও তার পায়েই ছিল, তবু সেটারও লেস খোলা। অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে খোলা জুতোটা হাতে নিয়ে সে ধারালো চাকুটা দিয়ে জুতোর তলার গোড়ালীর দিকে একটা জায়গায় ছুরিটার প্রায় ইঞ্চি খানেক ঢুকিয়ে দিয়ে একটা চ্যাপ্টা গর্তের মত ফাঁকের সৃষ্টি করল। তারপর প্রায় আধ ইঞ্চি লম্বা চিপটাকে সে ফাঁকের ভেতর দিয়ে গলিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে আরেকটা ছোট সলিউশনের টিউব বের করে জুতোর সোলের ফাঁকের ভেতর খানিকটা সলিউশন ঢুকিয়ে দিল। তারপর হাত দিয়ে চেপে ধরে ফাঁকটাকে ওপর নিচে চাপ দিতেই ফাঁকটা পুরোপুরি ভাবে জোড়া লেগে গেল। আরেক গার্ডের পা থেকে একটা জুতো খুলে সেটাতেও একই রকম ভাবে আরেকটা চিপ ঢুকিয়ে আবার সীল করে দিল। কয়েক সেকেন্ড সেগুলোর দিকে দেখে মনে মনে আশ্বস্ত হয়ে সে আবার খোলা জুতোটাকে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে, চাকু আর সলিউশনের টিউবটা পকেটে পুরে নিয়ে ত্র্যস্ত পায়ে মেন গেটের দিকে এগিয়ে গেল। বিশাল লোহার গেটের কাছে এসে পকেট থেকে সে আরেকটা ছোট চিপসের মত জিনিস বের করে হাঁটু মুড়ে বসল। শার্টের পকেট থেকে সেলোটেপের রোল বের করে তার থেকে দু’ইঞ্চির মত একটা টুকরো কেটে নিল। গেটের সব চেয়ে নিচের হরাইজন্টাল চৌকো রডটার তলার দিকে চিপটাকে সেলোটেপ দিয়ে এমনভাবে সেঁটে দিল, যে বাইরে থেকে বিন্দুমাত্রও বুঝবার জো রইল না। একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখেই সন্তুষ্ট হয়ে সে তড়িঘড়ি গেটের বাইরে এসে গেটটাকে আবার টেনে দিয়ে নিজের বাইক স্টার্ট দিয়ে ফেরবার পথ ধরল।
রেস্টুরেন্টটার কাছে এসে সে একটু থামল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে মোবাইল সেটিং-এ ঢুকে সে কিছু খুটখাট করতেই মোবাইলে বিপ বিপ করে শব্দ হল দুটো। খুশী হয়ে মোবাইল পকেটে পুরে সে আবার বাইক চালালো ফেরার পথে।
***************
পরের দিন রাতে ডিনার শেষ করে নবনীতা আর অর্চনা তাদের ঘরে চলে যাবার সময় সীমন্তিনী তাদের দু’জনকে ফিসফিস করে বলল, “শোন, লক্ষ্মীদি কাজ শেষ করে নিজের ঘরে শুতে চলে গেলে তোরা চুপিচুপি আমার ঘরে চলে আসিস। কাজ আছে”।
নবনীতা আর অর্চনা সম্মতি জানিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যাবার পর সীমন্তিনী নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে তার ব্যাগের ভেতর হাতরাতে হাতরাতে নবনীতার ফোনের সিমকার্ডটা খুঁজে পেল। তারপর সে ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বিছানার পাশে সাইড টেবিলের ওপর রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে নিজের অফিসিয়াল মোবাইল থেকে সিম কার্ডটা খুলে নবনীতার সিমটা ভরে দিয়ে ফোন সুইচ অন করল। কয়েক মূহুর্ত বাদে মোবাইলের স্ক্রীনে মেনু ফুটে উঠতেই সে কন্টাক্ট ফোল্ডারে গিয়ে ঢুকল। আর প্রায় সাথে সাথেই বীথিকার কন্টাক্ট নাম্বারটা পেয়ে গেল। এবার সে তার নিজের পার্সোনাল মোবাইলে বীথিকার নাম্বারটা লিখে নিয়ে নবনীতার সিম ভরা মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিল। তারপর নবনীতার সীমটা মোবাইল থেকে বের করে আবার নিজের ব্যাগের ভেতর ভরে রাখল। আর প্রায় ঠিক তখনই লক্ষ্মীর ঘরের দরজা বন্ধ করবার শব্দ কানে এল।
সীমন্তিনী নিজের অফিসের মোবাইলে আবার আগের সিমটা ঢুকিয়ে মোবাইল সুইচ অন করে বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে গিয়ে ঘরের দরজার লক খুলে দিয়ে দেয়ালের দিকের টেবিল থেকে ল্যান্ডলাইন ফোনটা এনে নিজের বিছানার ওপর রাখল। আর প্রায় সাথে সাথেই তার ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে গেল। নবনীতা চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “দিদি, আমরা আসবো”?
সীমন্তিনী তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে দু’জনকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আস্তে কথা বলবি সবাই। লক্ষ্মীদি যেন কিছু বুঝতে না পারে। যা তোরা বিছানায় গিয়ে বোস” বলে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিল।
নিজের বিছানায় এসে সীমন্তিনী অর্চনার একটা হাত ধরে নিচু গলায় বলল, “অর্চু, নীতা এখন একজনের সাথে ফোনে কথা বলবে। কিন্তু এখন ফোনের স্পীকার অন করে কথা বলা যাবে না। লক্ষ্মীদি টের পেয়ে যেতে পারে। আমি তাকে এখন কিছু জানাতে চাইছি না। নীতা ফোনে কথা বলতে শুরু করলেই তুই কিন্তু একদম চুপ করে থাকবি। মুখ দিয়ে সামান্য একট শব্দও যেন না বেরোয়। আমিও কোনও কথা বলব না। তবে ফোনের সাথে একটা হেডফোন লাগিয়ে আমরা দু’জনে ওদের সব কথাই শুনতে পারব। কিন্তু মুখে কিন্তু টু শব্দটিও করা চলবে না, এটা মনে রাখিস” বলতে বলতে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বিশেষ ধরণের হেডফোন বের করে ল্যান্ডলাইন ফোনের এক পাশের একটা পয়েন্টের সাথে জুড়ে দিয়ে হেডফোনের একটা প্রান্ত অর্চনার কানে আর অন্য প্রান্তটা নিজের কানে লাগিয়ে দিল।
নবনীতা নিজের কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল, “কার সাথে কথা বলতে হবে আমাকে দিদি”?
সীমন্তিনী চাপা গলায় জবাব দিল, “বলছি, কিন্তু তার আগে শোন নীতা। তুই যে আমাদের ঘরে বসেই তার সাথে কথা বলছিস, এটা যেন সে কোনভাবেই বুঝতে না পারে। ফোনটা প্রথমে আমি করব। তারপর ও’পাশ থেকে সাড়া পেলে আমি রিসিভারটা তোর হাতে দেব। এমন ভাব করব যে আমি একটা পিছিও থেকে কথা বলছি। তুই যখন তার সাথে কথা বলবি, তখন ও’পাশ থেকে কে তোর সাথে কথা বলছে সেটা শুনলেই তুই চমকে উঠবি। হয়তো চেঁচিয়ে উঠতে পারিস। কিন্তু সেটা করা একেবারেই চলবে না। তাই আগে থেকেই তোকে জানিয়ে দিচ্ছি। ও’পাশে বীথিকা থাকবে। অবশ্য জানিনা, ও এখন ঘরেই আছে কি না। তবে ও যদি সত্যিই কলটা রিসিভ করে তাহলে তুই তোর ইচ্ছে মত তার সাথে কথা বলতে পারিস। তোর যা কিছু বলতে ইচ্ছে করে বলিস। আমি কোন কিছুতেই বারণ করব না। কিন্তু তুই এখন আসলে কোথায় আছিস সেটা ওকে জানাতে পারবি না। তুই যে আমার সাথে কলকাতা থেকে পালিয়ে এসে আমার এখানেই আছিস, এটাও বলতে পারবি না। আর আমার নাম ঠিকানাটাও তাকে বলবি না। মিথ্যে বলবি যে তুই এখন কাটোয়ায় আছিস। একটা গারমেন্টস কারখানায় কাজ করছিস। মন খুলে ওর সাথে কথা বলবি। তোর যা যা বলতে ইচ্ছে করে বলিস। কিন্তু ওর সাথে কথায় কথায় বিমল আগরওয়ালা আর মহিমা মালহোত্রার ব্যাপারে যতটুকু জানতে পারিস তার চেষ্টা করবি। দাদাভাই আর রচুর প্রতি মহিমার মনোভাব আর ব্যবহার কেমন, মহিমার মনে কি দাদাভাই আর রচুকে তার এসকর্টের ব্যবসায় নামাবার কোনও প্ল্যান আছে কি না, বিমল আগরওয়ালাকে বীথিকা চেনে কি না, বিমলের পরিবারে কে কে আছে। তাদের চালচলন ব্যবহার বা স্বভাব কেমন, তারা কোথায় কোথায় যায়, কি কি করে বেড়ায়, এ’সব সম্বন্ধে যত বেশী কথা জানতে পারিস সে চেষ্টা করবি। বুঝেছিস তো”?
নবনীতা সীমন্তিনীর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে দিদি। আমি বুঝেছি। কিন্তু দিদি, এতসব ব্যাপারে কথা বলতে গেলে তো অনেকটা সময় লাগবে”।
সীমন্তিনী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “লাগুক, তাতে কি হল? হয়তো আমাদের সকলের ঘুমোতে একটু দেরী হয়ে যাবে, এর বেশী তো আর কিছু হবে না। কিন্তু আমার রচুসোনার বিপদ কাটাতে এ টুকু সাহায্য তুই আমাকে করবি না”?
নবনীতা সীমন্তিনীর হাতটা জোরে চেপে ধরে বলল, “ও’কথা বোল না দিদি। বৌদির সুরক্ষার জন্য পরি আর আমি সব সময় তোমার পাশে আছি”।
সীমন্তিনী বলল, “সেটা জানি বলেই তো তোকে আগে থেকে কিছু না জানিয়েই আমি এসবের প্ল্যান করেছি। কত কষ্ট করে বীথিকার নাম্বারটা যোগার করেছি। আচ্ছা শোন, কথা বলে আর সময় নষ্ট করছি না। আমি এবার ফোনটা করছি। সবাই চুপ করে থাকবি” বলে ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে বীথিকার নাম্বার ডায়াল করল। কিন্তু বীথিকার তরফ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। ফোনটা বেজে বেজে একসময় টাইম আউট হয়ে গেল।
সীমন্তিনী দ্বিতীয় বার ডায়াল করতে যেতেই নবনীতা বলল, “এমনও হতে পারে যে ও এখন কাজেই ব্যস্ত আছে”।
দ্বিতীয় বার ডায়াল করেও কাজ হল না। এবারেও একই অবস্থা। সীমন্তিনী দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল রাত প্রায় এগারোটা। নবনীতা চাপা গলায় বলল, “দিদি, হয়তো ও কাজেই ব্যস্ত আছে। ওকে তো মাঝে মধ্যেই হোল নাইট ডিউটি করতে হয়। আর হোল নাইট না হলেও রাত বারোটা একটা পর্যন্ত ডিউটি তো প্রায় সব দিনই করতে হয়”।
সীমন্তিনী আরেকবার ডায়াল করতে করতে বলল, “ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করে দেখাই যাক না”।
এবার ও পাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল। এক মেয়েলী কন্ঠ বলে উঠল, “হ্যালো, কে বলছেন”?
সীমন্তিনী নবনীতার দিকে ঈশারা করে বলল, “আমি কাটোয়ার একটা পিছিও থেকে বলছি। আচ্ছা আপনি কি মিস বীথিকা মল্লিক”?
বীথিকা ও’পাশ থেকে ‘হ্যাঁ’ বলতেই সীমন্তিনী আবার বলল, “আচ্ছা এই নিন, কথা বলুন” বলেই রিসিভারটা নবনীতার হাতে ধরিয়ে দিল। নবনীতা রিসিভার কানে লাগিয়েই বলে উঠল, “বীথি, আমি নীতা বলছি রে”।
ও’পাশ থেকে বীথিকা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “নীতা, তুই? তুই কোত্থেকে বলছিস? আর এটা তোর কেমন ব্যবহার রে? বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলি। এক মাসের ওপর হয়ে গেল তোর একটা খবর পর্যন্ত পাচ্ছি না আমরা। আমি আর ম্যাম তোর জন্যে কত চিন্তা করছি। কোথায় আছিস তুই? নাকি আবার ওই বদমাশটার খপ্পরে পড়েছিস? তোকে কি আবার আসানসোল নিয়ে গেছে ওরা”?
নবনীতা শান্ত গলায় বলল, “নারে বীথি, তেমন কোন ব্যাপার হয়নি রে। কিন্তু তোদেরকে কন্টাক্ট করবার সুযোগই আমি পাইনি রে। আমি জানি তোরা আমার কাছ থেকে কোন খবর না পেয়ে খুব চিন্তায় থাকবি। কিন্তু আসলে কি হয়েছে জানিস। মাস খানেক আগে আমি কোলকাতা ছেড়ে কাটোয়ায় চলে এসেছি। কিন্তু আসবার সময় পথে এক জায়গায় আমার মোবাইলটা হারিয়ে ফেলেছি। তুই তো জানিস আমার স্মৃতি শক্তি খুব কম। তোর বা ম্যাডামের নাম্বার আমার মনে ছিল না। মনে করবার অনেক চেষ্টা করেও তোর মোবাইলের দশটা নাম্বার কিছুতেই মনে পড়ছিল না আমার। প্রথম ছ’টা নাম্বার আমার মনে ছিল। সেই নাম্বারগুলোর সাথে আন্দাজে বাকি চারটে নাম্বার বসিয়ে তোকে রোজ এক একটা পিছিও থেকে ফোন করে যাচ্ছিলাম। আজ হঠাৎ করেই তোর সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল”।
বীথিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কাটোয়ায় আছিস? ওখানে কবে গিয়েছিস আর কেন গিয়েছিস? তুই ভাল আছিস তো? তোর কোন বিপদ আপদ হয়নি তো নীতা”?
নবনীতা আগের মতই শান্ত স্বরে জবাব দিল, “আমি ঠিক আছি রে বীথি। বিপদ আপদ কিছু হয়নি। আর এখানে আমি এসেছি আগষ্টের এগারো তারিখেই। সেদিন সকালেই তোর সাথে আমার শেষ দেখা ও কথা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বেস কর বীথি, যখন আমি তোর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম তখন আমি নিজেও জানতাম না যে আমি সেদিনই কলকাতা ছেড়ে চলে আসব। সেটা আগে থেকে জানা থাকলে আর অন্য কাউকে বলি বা না বলি তোকে অন্ততঃ জানিয়ে আসতাম। সেদিন আসলে আমার এক পুরনো পরিচিত বন্ধুর সাথে দেখা করতেই বেরিয়েছিলাম শুধু। কিন্তু ঘটণাচক্রে এমন একটা সুযোগ তখন হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম যে ওই মূহুর্তেই আমাকে ডিসিশনটা নিতে হয়েছিল। আমার ওই বন্ধুর মাধ্যমেই কাটোয়ার একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিকের সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। আর আমার জীবনের সব কথা শুনে ভদ্রলোক আমায় সেদিনই তার গারমেন্টস ফ্যাক্টরীতে একটা চাকরি দেবার জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তুই তো জানিসই বীথি, ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক, শুধু বেঁচে থাকবার জন্যেই আমাকে নিজের মান সম্মান ইজ্জত সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। আমার ওই বন্ধুর পরিচিত সেই গারমেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিক, খুবই সজ্জন এবং ভদ্রলোক। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে যদি সৎ ভাবে জীবন কাটাতে চাই, তাহলে যেন সেদিনই বিকেলের ট্রেণে আমি তার সাথে কাটোয়া চলে যাই। তুই তো জানিস, সৎ ভাবে বাঁচবার লোভ আমার মনে সব সময়ই ছিল। তাই সেদিন ওই সুযোগ পেয়ে লোভটা আর সামলাতে পারিনি রে। তার কথায় আর আমার বন্ধুর পরামর্শে আমি সেদিনই তার সাথে চলে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ট্রেনে উঠে তোকে আর ম্যাডামকে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দেব। কিন্তু চলতি ট্রেনের টয়লেটে ঢুকে মোবাইল হাতে নিয়ে তোকে ফোন করতে যেতেই হঠাৎ ট্রেনের ঝাকুনিতে সেটটা হাত থেকে ছিটকে টয়লেটের কমোডের ভেতর পড়ে গিয়েছিল। আর ট্রেনের টয়লেটে পড়া মানে যে কি সেটা তো তুই জানিসই। কোনভাবেই সেটা আর ফিরে পাবার সম্ভাবনা ছিল না। তাই তোকে আর ফোন করতে পারিনি। অবশ্য ওই ভদ্রলোক তার নিজের মোবাইল থেকে আমাকে ফোন করতে বলেছিলেন। কিন্তু নাম্বারটা আর কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। তাই তো তোকে আর ফোন করে খবরটা জানাতে পারিনি আমি। নতুন একটা মোবাইল এখনও কিনে উঠতে পারিনি। তবে সেদিন থেকেই একের পর এক নাম্বার আন্দাজ করে বিভিন্ন পিছিও থেকে তোকে ফোন করে চলেছি একনাগাড়ে। শেষমেশ আজ তোকে পেলাম”।
এবার বীথিকা বেশ খুশীর গলায় বলল, “সত্যি বলছিস তুই নীতা? এখন থেকে তোর শরীরটাকে আর নোংড়া কামপিপাসু কোন লোকের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে না? তুই এখন থেকে একটা ভদ্র মেয়ের মত বাঁচতে পারবি”?
নবনীতাও আবেগ ভরা গলায় বলল, “হ্যারে বীথি। এখন আর আমাকে সে’সব করতে হচ্ছে না। এই একটা মাস থেকে আমি সত্যি খুব ভাল আছি রে। আমাদের কারখানার আরেকটা মেয়ের সাথে একসাথে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়েছি। দুপুরের খাবার কারখানা থেকেই দেয়। সকালের ব্রেকফাস্ট আর রাতের খাবার নিজেদের ঘরেই খাই। বেতন পাচ্ছি মাসে আট হাজার। তিন হাজার টাকা ঘর ভাড়ার অর্ধেকটা আমাকে দিতে হয়। বাকি টাকায় একটু কষ্ট হলেও কোনমতে সামলে নিচ্ছি। আর ভাল করে কাজটা শিখে নিতে পারলে মালিক আমার বেতন বাড়িয়ে দেবে বলেছেন। তবে যেটুকু কষ্ট হচ্ছে, তা আগের কষ্টের তুলনায় প্রায় কিছুই না। তোর আমার মত মেয়েরা খুব আনন্দের সাথেই সেটুকু কষ্ট সহ্য করে নিতে পারবে”।
এবার বীথিকা একটু বিমর্ষ ভাবে বলল, “নারে নীতা। আমার বোধহয় আর এই নরক থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না রে। জানিস, বাবার অবস্থা এখনও যদিও একই রকমেরই আছে। পঙ্গু ভাইটা দিন পনেরো আগে রাস্তায় গাড়ির ধাক্কায় বেশ ভাল রকম জখম হয়েছে। ইন্টারনাল হেমারেজও কিছুটা হয়েছিল। এখনও হাসপাতালে আছে। কোমায়। কোন সেন্স নেই। সপ্তাহে সপ্তাহে সত্তর হাজার করে টাকা দিতে হচ্ছে হাসপাতালে। তাই নিজে আরও বেশী ক্লায়েন্ট নিতে শুরু করেছি। তবু কুলোতে পারছি না। ম্যাম নিজেই হাসপাতালের খরচের অনেকটাই বহন করছেন। তাই তো এখনও চালিয়ে যেতে পারছি। কিন্তু ম্যামেরও মন মেজাজ খুব একটা ভাল নেই। যদিও এ ব্যাপারে তিনি আমাকে এখন অব্দি কিছু বলেননি সরাসরি, তবে তার ভাবসাব দেখে আমার মনে হচ্ছে উনি বোধহয় এই এসকর্টের ব্যবসা ছেড়ে দেবার কথাই ভাবছেন। একদিন তো আমাকে জিজ্ঞেসই করলেন যে ‘বীথি, আমি যদি ব্যবসাটা পুরোপুরি তোমার হাতে তুলে দিই, তবে তুমি সামলাতে পারবে’? সেদিনই আমি বুঝে গেছি যে ম্যাম নিজেকে এই ব্যবসা থেকে পুরোপুরি ভাবে সরিয়ে নিতে চাইছেন। কিন্তু চিন্তা বেড়ে গেছে আমার। অবশ্য শুধু আমার কথাই বা বলছি কেন? তুই তো জানিসই নীতা, আমার মত অনেক মেয়ে মহিলাই ম্যাডামের কাছে উপকৃত। ম্যামের ওপরই তারা পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। তারাও সবাই হয়ত বিপদে পড়বে। বাধ্য হয়ে তাদেরকে শহরের অন্যান্য এসকর্ট প্রোভাইডারদের কাছে যেতে হবে। আমাকেও হয়ত সেটাই করতে হবে। তাতে ঝঞ্ঝাট ঝামেলা অনেক বেশী পোয়াতে হবে। ম্যামের এখানে আমরা যত নিশ্চিন্ত, অন্যদের কাছে আমরা ততটাই অসুরক্ষিত হয়ে থাকব। আমাদের সুবিধে অসুবিধের কথা তারা কেউ ভাববে না। যত কষ্টই হোক না কেন, তাদের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। পান থেকে চুনটি খসলে আমাদের পিঠের ছাল চামড়া তারা তুলে নেবে। কিন্তু বাবা আর ভাইকে নিয়ে আমি তো একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছি এখন থেকেই। ম্যাম যদি সত্যিই আমাদের সবাইকে ছুটি দিয়ে তার ব্যবসা বন্ধ করে দেন তাহলে আমাদের যে কী হবে সেটা ভেবেই ভয়ে হাত পা কাঁপতে শুরু করে রে। তুই বেঁচে গেছিস। এখান থেকে চলে গিয়ে ভাল একটা সুযোগ পেয়েছিস শুনে খুব ভাল লাগছে। এতদিনে মনে হয় তোর দুঃখের দিন শেষ হল। ম্যামও তোর জন্যে ভাবছিলেন। তিনিও তোর কথা শুনে খুব খুশী হবেন আমি জানি”।
নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বীথি? ম্যাম খুশী হবেন বলছিস তুই? আমি তো ভেবেছিলাম যে ম্যাম আমার ওপর নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন”।
বীথিকা এবার বলল, “তুই ম্যামকে আর কতটুকু চিনিস নীতা? তুই তো কেবল মাস খানেকই ম্যামের সাথে কাজ করেছিস। আমি তো ম্যামের সবচেয়ে পুরনো স্টাফ। ম্যাম এ ব্যবসা শুরু করবার আগে বেশ আর্থিক চাপে পড়ে নিজেই শুধু কাস্টমার নিতে শুরু করেছিলেন। তখন তার কোন টিম বা এই এজেন্সী ছিল না। আমিই প্রথম ম্যামের টিম মেম্বার হয়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে তার ব্যবসা যত ফুলে ফেঁপে উঠেছে ততই তার এজেন্সীতে ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেড়েছে। এখনও আমিই ম্যামের সবচাইতে কাছের এবং সবচেয়ে বড় বিশ্বাসভাজন। ম্যামের ব্যবসার কথা আমি যতখানি জানি, এমন আর কেউ জানে না। তবে তোকে আগেও বলেছি আমি, আর তুই নিজেও দেখেছিস, ম্যাম কারো ওপর কোন ধরণের জুলুম করেন না। বরং সকলকে তিনি নানা ভাবে সাহায্যই করেন। কেউ ম্যামের ব্যবসা ছেড়ে যেতে চাইলে ম্যাম খুব খুশী মনে তাদের ছেড়ে দেন। তুই যদি চলে যাবার আগে ম্যামকে সব জানাতিস, তাহলে তোকেও তিনি হাসিমুখে ছেড়ে দিতেন। ছেড়ে তো দিতেনই, এমনও হতে পারত যে চলে যাবার সময় ম্যাম তোকে দশ বিশ হাজার টাকাও দিয়ে দিতেন। আজ আমি চলে যেতে চাইলে তিনি আমাকেও বাঁধা দেবেন না, আমি জানি। কিন্তু আমার যে উপায় নেই রে। ভদ্রভাবে বাঁচবার আর কোন পথই যে আমার নেই। ম্যাম ব্যবসা বন্ধ করে দিলে আমাকে অন্য কোন এসকর্ট প্রোভাইডারের কাছেই যেতে হবে। তাতেও কি আর আমি সংসার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারব? রোজ হোল নাইট ডিউটি করলেও বাবা আর ভাইয়ের চিকিৎসার খরচ জোটাতে পারব না। কি যে হবে, কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস নীতা? মনে হয় বাবা আর ভাইকে বিষ খাইয়ে আমিও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করি। কিন্তু মনে যে অতটা জোরও পাচ্ছিনা রে” বলতে বলতে বীথিকা কেঁদে ফেলল।
অর্চনা নিজের মুখ চেপে ধরে কান্না আটকাবার চেষ্টা করছে দেখে সীমন্তিনী প্রায় লাফ দিয়ে তার কাছে গিয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “চুপ অর্চু সোনা। কাঁদিস না বোন। বীথিকা শুনে ফেলবে”।
নবনীতাও বীথির কথা শুনে কেঁদে ফেলল। প্রায় মিনিট খানেক কেউ কোন কথা বলল না। তারপর নবনীতা কান্না ভেজা গলায় বলল, “বীথি, কাঁদিস নে ভাই। নিজেকে শান্ত কর। আমরা সকলেই বোধহয় আগের জন্মের কোন পাপের ফল ভোগ করছি রে। ভগবান সদয় হয়েছেন বলেই বুঝি আমি ওই দুনিয়া ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। তুইও হয়ত কোনদিন ভালভাবে বাঁচতে পারবি। ভেঙে পড়িস না বীথি”।
বীথিকাও নিজের কান্না সামলাতে সামলাতে বলল, “কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। কিন্তু দ্যাখ, একটু ভালভাবে বেঁচে থাকবার ইচ্ছে তো আমাদের সকলের মনেই আছে। আমরা তো সবাই ভাল ভাবে সৎ ভাবে বাঁচবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু উপায় কি আর খুঁজে পাচ্ছি আমরা? ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ তোকে এ পাপের জগৎ থেকে উদ্ধার করেছেন বলে। কিন্তু আমি বোধহয় আগের জন্মে তোর চেয়েও অনেক বেশী পাপ করেছিলাম রে নীতা। তাই আমার পাপের শাস্তি ফুরোবার আর কোন লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি না আমি। এর ওপর ম্যাম যদি সত্যি নিজের ব্যবসা বন্ধ করে দেন, তাহলে যে কী হবে, তা ভাবলেও আমি শিউড়ে উঠি”।
নবনীতা বলল, “আচ্ছা বীথি, তোর কী মনে হয়? ম্যাম কি সত্যিই ওই ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন”?
______________________________