15-03-2020, 07:14 PM
(Update No. 157)
রাকেশদের বাড়ি থেকে ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাপটপ, হুইস্কির বোতল আর রাকেশের মা বিনীতাকে নিয়ে পাঁচজন মিলে কামিনীর ফ্ল্যাট অভিমুখে চলল। সারা রাত জুড়ে ব্লু ফিল্ম দেখা-দেখি, ভিডিও করা করি, আর ড্রিঙ্ক করতে করতে সকলে মিলে উদ্যাম যৌনতায় মেতে উঠল। কে কখন কার সাথে মজা নিচ্ছিল তার যেন হদিশই ছিল না। ওয়ান-ওয়ান, থ্রিসাম, ফোরসাম, গ্রুপ, কোনকিছুই বাদ রইল না। কামের উন্মাদনায় আর মদের নেশায় কারুর যেন হুঁশই ছিল না। পূবের আকাশ ফরসা হয়ে আসবার সময় সকলেই যেন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ল। তখন দেখা গেল বেহুঁশ হয়নি শুধু কামিনী। সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার পর কামিনী পাশের রুমের আলমারি থেকে একটা এক্সটারনাল হার্ড ডিস্ক বের করে রাকেশের ল্যাপটপের সাথে জুড়ে দিল। তারপর ল্যাপটপে পুরনো নতুন যতগুলো লাইভ রেকর্ডিং-এর ফাইল ছিল, তার সবগুলোই নিজের হার্ড ডিস্কে কপি করে নিল। তারপর ল্যাপটপ শাট ডাউন না করেই হার্ডডিস্কটাকে আবার পাশের ঘরের আলমারিতে রেখে দিয়ে আবার এ ঘরে ফিরে এসে বিনীতার পাশে শুয়ে চোখ বুজল।
সবিতার সদ্য পরিচিত ওই অচেনা মহিলা কামিনী যে অমন অভূতপূর্ব সুখের অনুভূতির বিনিময়ে সবিতার কাছ থেকে কী নিয়ে গেল তা সে নিজে, তার ছেলে বিকি, রাকেশ, আর তার মা বিনীতা, কেউই কল্পনাও করতে পারল না।
***************
সেপ্টেম্বরের এক তারিখে নবনীতা বসাক গারমেন্টসে কাজে যোগ দিয়েছে। সীমন্তিনী একটা রিক্সাওয়ালাকে মাসিক চুক্তি করে দিয়েছে, রোজ বেলা সাড়ে এগারোটায় এসে সে নবনীতাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে। আর রাত আটটায় বসাক গারমেন্টস থেকে তাকে এনে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে। দুরত্বও খুব একটা বেশী নয়। সীমিন্তনীর কোয়ার্টার থেকে অটোরিক্সায় যেতে মাত্র মিনিট সাতেকের ব্যাপার। অবশ্য বাড়ি থেকে রওনা হয়ে নবনীতাকে বসাক গারমেন্টসের শো রুমে যেতে হয় না। বারোটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত তাকে থাকতে হয় জয়া বসাকদের ফ্যাক্টরীতে। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে লক্ষ্মী আর অর্চনা সাথে বসে নবনীতাকে খাইয়ে দেয়। সীমন্তিনীর মত লক্ষ্মী নবনীতাকেও দুপুরের লাঞ্চ প্যাক করে দেয়। ফ্যাক্টরীতে লাঞ্চ সেরেই নবনীতা সেখান থেকে বসাক গারমেন্টসের শো রুমে চলে যায়। দুরত্বও খুব বেশী নয়। হেঁটে গেলেও ছ’ সাত মিনিটের বেশী লাগে না। রাতে নবনীতাকে একা রিক্সায় চেপে ফিরতে হয় বলে সীমন্তিনী আগে থেকেই বসাক গারমেন্টসের মালিক জয়া বসাককে অনুরোধ করে রেখেছে, যাতে আটটার পর নবনীতাকে আর আটকে রাখা না হয়। জয়া বসাকও সীমন্তিনীকে আশ্বাস দিয়েছেন, আর সেই ভাবেই শো-রুমের ম্যানেজারকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। তবে ঠিক ওই সময়েই নবনীতাকে যদি কোন গ্রাহককে সামলাতে হয়, তবে তো তার বেরিয়ে আসবার সময়ের একটু হের ফের হতেই পারে। সেটুকু তো মেনে নিতেই হবে। আর সীমন্তিনী রিক্সাওয়ালাটাকেও সে ভাবেই বলে রেখেছে। তাই নবনীতার আসা যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে আর কোনও চিন্তা নেই। আজ নবনীতার চাকরির তৃতীয় দিন। গত দু’দিনই নবনীতা রাতে বাড়ি ফেরবার পর সীমন্তিনী আর অর্চনাকে বলেছে যে ফ্যাক্টরীতে আর শো-রুমে দু’জায়গাতেই কাজ করতে তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
দিনের কাজ শেষ হতে সীমন্তিনী গাড়িতে বাড়ি অভিমুখে আসতে আসতে ভাবল, মহিমার সব কথা শোনার আগে অব্দি নবনীতাকে নিয়ে তার একটা চিন্তা ছিল। সেক্স র*্যাকেটের ব্যবসা যারা করে তারা তাদের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে তাদের নাগালের বাইরে যেতে দেয় না। কেউ তাদের চক্র ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে তারা তাদের ছল বল কৌশল সবকিছু প্রয়োগ করে তাকে নিজেদের কব্জায় রাখতে চায়। নবনীতাকে অমন একটা চক্র থেকে বের করে আনতে পুরোপুরি গোপনীয়তা বজায় রাখতে না পারলে যে কোন সময় নবনীতার বিপদ হতে পারে। এ’কথা ভেবেই সে পরিতোষের সাহায্য নিয়ে নবনীতাকে দুটো দিন একটা জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল। পরিতোষের লোকেরাই তাদের দু’জনকে আড়াল থেকে গার্ড করে হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল। তারপর গোটা রাস্তায় সিভিল ড্রেসে পুলিশ এসকর্ট ছিল বলে তাদের আর কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। কিন্তু ভয়টা ছিল এখানে এসে পৌঁছোবার পরের ব্যাপারে। ওই সেক্স র্যােকেটের কেউ যদি গোপনে নবনীতাকে ফলো করে এ জায়গায় চলে আসে, তাহলে যে কোন মূহুর্তে ওকে একা পেলেই তারা আবার তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে সমর্থ হবে। এ ব্যাপারটা নিয়েই সীমন্তিনী একটু চিন্তিত ছিল। কিন্তু নবনীতা যেদিন মহিমার ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলল, আর তারপর সে নিজে যখন মহিমার সাথে কথা বলল, তখন তার মনের ভেতর থেকে এ ভয়টা অনেকটাই চলে গেছে। মহিমাকে ততটা ক্ষতিকারক বলে মনে হয়নি তার। পরে নবনীতার মুখে মহিমার আরও কিছু কথা শোনবার পর থেকে তার মনের আশঙ্কা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। নবনীতার আসা যাওয়ার ব্যাপারে যে রিক্সাওয়ালাকে সীমন্তিনী ঠিক করে দিয়েছে, সে রিক্সাওয়ালাটা পুলিশের ইনফর্মার হিসেবে কাজ করে। পথে ঘাটে নবনীতার ওপর যদি কোন ঝামেলা নেমে আসে তবে ওই মূহুর্তে কী করতে হবে না হবে তা সীমন্তিনী আগে থেকেই খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে।
অফিস থেকে বেরোবার আগেই সীমন্তিনী বাড়িতে ফোন করে অর্চনাকে তৈরী হয়ে থাকতে বলেছিল। তাই কোয়ার্টারের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াতেই লক্ষ্মীর সঙ্গে শালোয়ার কামিজ পরিহিতা অর্চনা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসল। গেটের বাইরে এসেই লক্ষ্মী বলল, “ও দিদিমণি, তুমি কি ঘরে না ঢুকেই এখন বাজারে যেতে চাইছ? হাতমুখ ধুয়ে চা জলখাবারটা তো খেয়ে যেতে পারতে”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে গাড়িতে উঠতে বলে লক্ষ্মীকে বলল, “ওমা, আমি তো আগেই ফোন করে তোমাকে বলে দিয়েছিলুম লক্ষ্মীদি, যে আজ আমরা বাড়িতে জল খাবার খাচ্ছি না। তুমি কি তবু তা করেছ”?
লক্ষ্মী বলল, “না তা তো করিনি দিদিমণি। কিন্তু করতে আর কতক্ষণ লাগবে বল? তুমি হাত মুখ ধুতে ধুতেই আমি করে ফেলতে পারব”।
অর্চনা ততক্ষণে গাড়ির পেছনের সীটে বসেছে। সীমন্তিনী বলল, “তুমি নিজের জন্যে কিছু বানিয়ে খেয়ে নিও। আমরা নীতার ওখানে যাচ্ছি। নীতার মালিকই আজ তার সাথে বসে চা জলখাবার খাবার নিমন্ত্রন করেছে গো। তাই যাচ্ছি। তা বাজার থেকে কি আর কিছু আনতে টানতে হবে নাকি লক্ষ্মীদি”?
লক্ষ্মী জবাব দিল, “আমি তো বিকেলে গিয়ে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে এসেছি দিদিমণি। আর কিছু আনবার নেই আপাততঃ”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে, আমরা তাহলে আসছি” বলে ড্রাইভারকে ঈশারা করতেই রামসিং গাড়ি স্টার্ট করল।
বসাক গারমেন্টসে ঢুকতেই অর্চনা আর সীমন্তিনী দেখতে পেল নবনীতা তার কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো দু’জন গ্রাহকের সাথে ব্যস্ত আছে। নবনীতাও তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বেশ বড়সড় শো রুম। ইউ শেপে মোট ন’টি কাউন্টার। ছ’টা কাউন্টারে সেলসম্যান, আর তিনটে কাউন্টারে তিনজন সেলসগার্ল। সীমন্তিনী অর্চনার হাত ধরে নবনীতার কাউন্টার আর তার পরের আরেকটা কাউন্টার পেরিয়ে গিয়ে একটা ফাঁকা কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতে একজন সেলসম্যান এগিয়ে এল। সীমন্তিনী তাকে বলল, “ভাল রেডিমেড চুড়িদার সেট আর ভাল কোয়ালিটির সূতীর শাড়ি দেখাবেন”।
সেলসম্যানটা খুব বিনয়ের সাথে বলল, “আপনারা বসুন ম্যাডাম। আমি একজন সেলসগার্ল পাঠিয়ে দিচ্ছি এখানে” বলে লোকটা তার পাশের কাউন্টারের মেয়েটিকে এ কাউন্টারে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ওই কাউন্টারে বসা পুরুষ গ্রাহকদের দায়িত্ব নিল।
অর্চনা সীমন্তিনীর পাশের টুলে বসতে বসতে চাপা গলায় বলল, “ইশ, নীতাদির কাউন্টারে তো খদ্দের আছে। নইলে তাকে পেলেই ভাল হত”।
অর্চনার কথার জবাব দেবার আগেই সীমন্তিনী কাউন্টারে এসে দাঁড়ানো মেয়েটিকে বলল, “ভাল রেডিমেড চুড়িদার আর কটনের ভাল শাড়ি দেখান প্লীজ”।
দু’সেট চুড়িদার আর দুটো শাড়ি পছন্দ করতে সেলসগার্ল সেগুলো নিয়ে সামনের দিকে কাঁচে ঘেরা একটা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সীমন্তিনীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা এদিকে আসুন ম্যাম”।
সীমন্তিনী আর অর্চনা সেই কাঁচে ঘেরা কাউন্টারের দিকে যাবার আগে নবনীতার কাউন্টারে কোন লোক নেই দেখে তার কাছে এসে দাঁড়াতেই অর্চনা খুশী গলায় বলে উঠল, “তোমাকে এ ইউনিফর্মে খুব সুন্দর লাগছে গো নীতাদি”।
নবনীতা অর্চনার হাত ধরে একটু হেসে সীমন্তিনীকে বলল, “শাড়ি আর চুড়িদার নিয়েছ সেটা তো দেখেছি। ভাগ্যিস আমার কাউন্টারে আসনি তোমরা। ওই সেকশনের প্রোডক্টগুলোর ব্যাপারে আমি এখনও পুরোপুরি শিখতে পারিনি। কিন্তু দিদি, তুমি যে তোমার অফিস ইউনিফর্ম পড়েই এসেছ? বাড়িতে যাও নি নাকি”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “বাড়ি গিয়েছিলাম শুধু অর্চুকে গাড়িতে তুলে নিতে। ভেতরে ঢুকিনি আমি। আর শোনো, তুমি খগেনকে ফোন করে বলে দাও যে আজ ওকে আর আটটার সময় আসতে হবে না। তুমি আমাদের সাথেই ফিরবে”।
নবনীতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস বলল, “কিন্তু দিদি, আমার ছুটি হতে তো এখনও ঘন্টাখানেক দেরী আছে”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে নিয়ে কাঁচে ঘেরা কেবিনটার দিকে যেতে যেতে বলল, “ও নিয়ে তুমি ভেবো না। তুমি শুধু ওকে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দাও”।
কাঁচে ঘেরা কেবিনটার সামনে যেতেই ভেতরে বসা ম্যানেজার সীমন্তিনীকে বলল, “গুড ইভিনিং ম্যাম”।
সীমন্তিনীও তাকে গুড ইভিনিং বলতে সে বলল, “ম্যাম, আপনার মোট বিল হয়েছে সাত হাজার ন’শ ষাট টাকা। তা, ম্যাম, আপনি কি ক্যাশে........”?
ম্যানেজারের মুখের কথা শেষ হবার আগেই তার টেবিলের ওপর রাখা ইন্টারকমটা ঝিঁঝিঁ শব্দে বেজে উঠল। রিসিভার ওঠাতে ওঠাতে সে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “এক মিনিট ম্যাম” বলে রিসিভার কানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ওকে, ম্যাম। ঠিক আছে। আমি তাই করছি”।
রিসিভার নামিয়ে রেখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি ম্যাম, হিসেবটা একটু চেঞ্জ হবে। আমাদের মালিকের অর্ডারে আপনি ফাইভ পার্সেন্ট স্পেশাল ডিস্কাউন্ট পাচ্ছেন” বলে তার সামনের কম্পিউটারের সাহায্যে বিলের ডাটা ইনপুট গুলো মোডিফাই করতে করতে বলল, “আপনি তাহলে সাত হাজার পাঁচশ’ বাষট্টি টাকা দেবেন ম্যাম”।
সীমন্তিনী নিজের পকেট থেকে ডেবিট কার্ড বের করে ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে দিল। ম্যানেজার সেটা নিতে নিতে বলল, “ম্যাম, আপনারা আমাদের মালিকের চেম্বারে চলে যান। উনি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনাদের কেনা জিনিসগুলো প্যাক করে আমি ওখানেই পাঠিয়ে দেব”।
ম্যানেজার ডেবিটকার্ডটা ফেরত দিয়ে পজ মেশিনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই সীমন্তিনী তার পিন নাম্বারটা বসিয়ে দিয়ে “থ্যাঙ্ক ইউ” বলে অর্চনার হাত ধরে শো-রুমের একপাশ দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠতে লাগল অর্চনাকে সঙ্গে নিয়ে।
জয়া বসাক নিজের চেম্বারে সীমন্তিনী আর অর্চনাকে খুব আপ্যায়ন করে বসতে দিলেন। খানিক বাদে নবনীতাকেও সেখানে ডেকে পাঠানো হল। তারপর সকলে মিলে চা জল খাবার খেতে খেতে নানারকম কথা নিয়ে আলাপ আলোচনা করল। সীমন্তিনীর অনুরোধ মেনে নিয়ে জয়া বসাক নবনীতাকে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত হলেন। নবনীতাও কথা দিল, নিজে কাজ শেখার পাশাপাশি সে ফ্যাক্টরী আর শো-রুমের কাজে কোনরকম গাফিলতি করবে না। সীমন্তিনী নবনীতার কথা শুনে মনে মনে আশ্বস্ত হল। মনে মনে ভাবল, আর কোনও নতুন ঝামেলা দেখা না দিলে, নবনীতাকে নিয়ে আর ভাবনা করতে হবে না তেমন। অর্চনাও সীমন্তিনীর এখানে আসবার পর গত দশ এগারো দিনে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। তার মুখশ্রীতে আর চেহারায় একটা উজ্জ্বল আভা ফুটে বেরোতে শুরু করেছে। সীমন্তিনীর ইচ্ছে, অর্চনাকে কম পক্ষেও মাস খানেক নিজের কাছে রাখবে। তাহলেই অর্চনা পুরোপুরি ভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারবে বলে তার ধারণা। কিন্তু রতীশ আর রচনার ওপর যে বিপদের ঝুঁকি নেমে এসেছে, তা অর্চনা জানে। ওদের ঝামেলা মেটবার আগে অর্চনাকে কালচিনি পাঠিয়ে দিলে ও সেখানে গিয়েও ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিঘ্ন থাকবে। ফোনে কথা বলবার সময় সে নিশ্চয়ই সীমন্তিনীর কাছ থেকে কি হল না হল এসব কথা জানতে চাইবে। আর তখন বাড়ির অন্য সকলেও ঘটণাটার আঁচ পেয়ে যাবে। সেটা সীমন্তিনীর একেবারেই কাম্য নয়। পরিতোষ বলেছে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ দিনের ভেতরেই তার অপারেশন শেষ হবে। তারপর থেকে রতীশ আর রচনার ওপর আর কোনও বিপদের আশঙ্কা থাকবে না। সে হিসেব ঠিক হলে আর প্ল্যান মাফিক কাজটা সম্পন্ন হলে, অক্টোবরের ছ’ থেকে দশ তারিখের মধ্যে সব কিছু মিটে যাবে। ততদিন পর্যন্ত যদি অর্চনাকে তার কাছেই রেখে দিতে পারে, তাহলে কালচিনির বাড়ির সকলের কাছে রচনার বিপদের কথাটা লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
ঘরে ফিরে আসবার পর অন্যান্য দিনের মত যখন তিনজন মিলে গল্প করছিল, তখন কথায় কথায় সীমন্তিনী বাজার থেকে কিনে আনা পোশাক গুলো বের করে একটা চুড়িদারের সেট অর্চনাকে, আরেকটা নবনীতাকে দিল। আর লক্ষ্মীকে ডেকে একটা শাড়ি তার হাতে দিল। আর অন্য শাড়িটা নিজের জন্য রেখে বলল, “সামনে পূজো আসছে। কখন কোথায় কিভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তার তো কোনও ঠিক নেই। তাই আগে থেকেই তোমাদের সকলের জন্য এগুলো কিনে আনলাম আজ। তোমরা এ গুলো পূজোর সময় পড়বে”।
অর্চনা আর নবনীতা মৃদু আপত্তি করলেও সীমন্তিনীর উপহার না নিয়ে পারল না। অর্চনা সীমন্তিনীকে প্রণাম করতে চাইতেই সীমন্তিনী তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হয়েছে বোন। আর প্রণাম করতে হবে না। কিন্তু এবার আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। সত্যি সত্যি জবাব দেবে কিন্তু। মনে কোনও দ্বিধা রেখে জবাব দেবে না”।
অর্চনা জিজ্ঞাসু চোখে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “কী কথা দিদিভাই”?
সীমন্তিনী বলল, “অর্চু, নীতা তো দিন তিনেক হল কাজে যেতে শুরু করেছে। আমিও তো সকাল ন’টা নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। ফিরতে ফিরতে আমার সন্ধ্যে হয়ে যায়। দুপুর থেকে তো তোমাকে কেবল লক্ষ্মীদির সাথেই থাকতে হচ্ছে। তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো তাতে বোন”?
অর্চনা বলল, “না দিদিভাই, আমার তো কোন অসুবিধে হচ্ছে না। দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে তো লক্ষ্মীদি সব সময় আমার সাথে বসে গল্প করে”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “তাহলে আমি যদি তোমাকে এখানে পূজো অব্দি থাকতে বলি, তাহলে তুমি রাগ করবে না তো? মা বাবার জন্যে, ভাইয়ের জন্যে মন খারাপ করবে না তো”?
অর্চনা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “পূজো অব্দি? তার মানে তো আরও প্রায় মাস দেড়েক”!
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “হু, প্রায় তাইই হবে। পূজো তো এবার অক্টোবরের একুশ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে। অতদিন থাকতে চাইছ না তুমি”?
অর্চনা কয়েক মূহুর্ত চুপ করে মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, “আমার জীবনটা যে তোমারই দান গো দিদিভাই। তুমিই যে আমার ভগবান। দেড় মাস কেন, তুমি চাইলে আমি সারাটা জীবন তোমার কাছে থাকতে রাজি আছি। আর মা, বাবা, ভাইয়ের জন্য মনই বা কেমন করবে কেন। তাদের সাথে তো আমি যখন খুশী তখনই কথা বলতে পারছি। সব খবরাখবর জানতে পারছি। গত সাতটা বছর আমি তাদের সাথে কথা বলা তো দুর, তারা কে কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনা, সুস্থ আছেন কিনা এ খবরটুকুও জানতে পারতুম না। তোমার দয়াতেই তো সে দুঃসময়টা কেটে গেছে আমার জীবন থেকে। মা বাবা যদি আপত্তি না করেন, আর তারা যদি সুস্থ স্বাভাবিক থাকেন, তাহলে তোমার এখানে থাকতে আমার কোন অসুবিধেই হবে না। কিন্তু ছোট্ট একটা কথা আছে আমার। তোমায় সেটা রাখতে হবে”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে একহাতে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, “বলো কী শর্ত তোমার”?
অর্চনা সীমন্তিনীর কাঁধে নিজের মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, “না গো দিদিভাই, শর্ত নয়। শুধু একটা ছোট্ট অনুরোধ। সেটা তুমি রাখবে”?
সীমন্তিনী অর্চনার কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বলল, “বেশ, আগে শুনি তোমার অনুরোধটা কি। তারপর রাখতে পারি কি না সেটা ভেবে দেখব”।
অর্চনা সীমন্তিনীর একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে তুমি আর ‘তুমি তুমি’ করে বলবে না। রচুকে ভালবেসে তুমি যেমন তুই তোকারি করে কথা বলো, সেটা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে দিদিভাই। আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার মুখ থেকে ওভাবে ডাক শুনতে। আমার এ অনুরোধটা রাখবেনা তুমি”?
ও’পাশ থেকে নবনীতাও প্রায় সাথে সাথে বলে উঠল, “হ্যাঁ দিদি। অর্চু একদম ঠিক বলেছে। তুমি যখন বৌদির সাথে ওভাবে তুই তোকারি করে কথা বল, সেটা শুনতে আমারও খুব ভাল লাগে গো। অবশ্য এটা তো আমরা সবাই জানি যে তোমার দাদাভাই আর তার স্ত্রী, মানে তোমার রচু সোনা, এরা দু’জন তোমার প্রাণ ভোমরা। তাদের জন্য তুমি সব কিছু করতে পারো। কিন্তু তুমি তো আমাদের জন্যেও কত কিছু করেছো এবং এখনও করে যাচ্ছ। আমরাও তো তোমার থেকে বয়সে ছোট। হ্যাঁ আমরা অবশ্য কেউই তোমার বৌদি নই সম্পর্কে। কিন্তু তাই বলে কি ‘তুমি তুমি’ বলে আমাদের এতটা দুরে রাখা ঠিক? আমারও যে খুব ইচ্ছে করে তোমার মুখ থেকে ও’রকম ডাক শুনতে”।
সীমন্তিনী এবার দু’হাতে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওরে দুষ্টুরা, তোমরা বুঝি দু’জনে মিলে আগে থেকে প্ল্যান করে এভাবে বলছ আমায়, তাই না”?
জবাবে তারা কেউই কোন কথা না বলে সীমন্তিনীর দু’কাঁধে দু’জন মাথা চেপে ধরে রইল।
সীমন্তিনী একসময় নিজেই বলল, “বেশ ঠিক আছে। তোদের যখন এমনটাই ইচ্ছে তাহলে এখন থেকে তোদের দু’জনকে তুই তোকারি করেই কথা বলব আমি। এবার খুশী তো”?
*********************
______________________________
রাকেশদের বাড়ি থেকে ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাপটপ, হুইস্কির বোতল আর রাকেশের মা বিনীতাকে নিয়ে পাঁচজন মিলে কামিনীর ফ্ল্যাট অভিমুখে চলল। সারা রাত জুড়ে ব্লু ফিল্ম দেখা-দেখি, ভিডিও করা করি, আর ড্রিঙ্ক করতে করতে সকলে মিলে উদ্যাম যৌনতায় মেতে উঠল। কে কখন কার সাথে মজা নিচ্ছিল তার যেন হদিশই ছিল না। ওয়ান-ওয়ান, থ্রিসাম, ফোরসাম, গ্রুপ, কোনকিছুই বাদ রইল না। কামের উন্মাদনায় আর মদের নেশায় কারুর যেন হুঁশই ছিল না। পূবের আকাশ ফরসা হয়ে আসবার সময় সকলেই যেন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ল। তখন দেখা গেল বেহুঁশ হয়নি শুধু কামিনী। সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার পর কামিনী পাশের রুমের আলমারি থেকে একটা এক্সটারনাল হার্ড ডিস্ক বের করে রাকেশের ল্যাপটপের সাথে জুড়ে দিল। তারপর ল্যাপটপে পুরনো নতুন যতগুলো লাইভ রেকর্ডিং-এর ফাইল ছিল, তার সবগুলোই নিজের হার্ড ডিস্কে কপি করে নিল। তারপর ল্যাপটপ শাট ডাউন না করেই হার্ডডিস্কটাকে আবার পাশের ঘরের আলমারিতে রেখে দিয়ে আবার এ ঘরে ফিরে এসে বিনীতার পাশে শুয়ে চোখ বুজল।
সবিতার সদ্য পরিচিত ওই অচেনা মহিলা কামিনী যে অমন অভূতপূর্ব সুখের অনুভূতির বিনিময়ে সবিতার কাছ থেকে কী নিয়ে গেল তা সে নিজে, তার ছেলে বিকি, রাকেশ, আর তার মা বিনীতা, কেউই কল্পনাও করতে পারল না।
***************
সেপ্টেম্বরের এক তারিখে নবনীতা বসাক গারমেন্টসে কাজে যোগ দিয়েছে। সীমন্তিনী একটা রিক্সাওয়ালাকে মাসিক চুক্তি করে দিয়েছে, রোজ বেলা সাড়ে এগারোটায় এসে সে নবনীতাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে। আর রাত আটটায় বসাক গারমেন্টস থেকে তাকে এনে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে। দুরত্বও খুব একটা বেশী নয়। সীমিন্তনীর কোয়ার্টার থেকে অটোরিক্সায় যেতে মাত্র মিনিট সাতেকের ব্যাপার। অবশ্য বাড়ি থেকে রওনা হয়ে নবনীতাকে বসাক গারমেন্টসের শো রুমে যেতে হয় না। বারোটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত তাকে থাকতে হয় জয়া বসাকদের ফ্যাক্টরীতে। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে লক্ষ্মী আর অর্চনা সাথে বসে নবনীতাকে খাইয়ে দেয়। সীমন্তিনীর মত লক্ষ্মী নবনীতাকেও দুপুরের লাঞ্চ প্যাক করে দেয়। ফ্যাক্টরীতে লাঞ্চ সেরেই নবনীতা সেখান থেকে বসাক গারমেন্টসের শো রুমে চলে যায়। দুরত্বও খুব বেশী নয়। হেঁটে গেলেও ছ’ সাত মিনিটের বেশী লাগে না। রাতে নবনীতাকে একা রিক্সায় চেপে ফিরতে হয় বলে সীমন্তিনী আগে থেকেই বসাক গারমেন্টসের মালিক জয়া বসাককে অনুরোধ করে রেখেছে, যাতে আটটার পর নবনীতাকে আর আটকে রাখা না হয়। জয়া বসাকও সীমন্তিনীকে আশ্বাস দিয়েছেন, আর সেই ভাবেই শো-রুমের ম্যানেজারকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। তবে ঠিক ওই সময়েই নবনীতাকে যদি কোন গ্রাহককে সামলাতে হয়, তবে তো তার বেরিয়ে আসবার সময়ের একটু হের ফের হতেই পারে। সেটুকু তো মেনে নিতেই হবে। আর সীমন্তিনী রিক্সাওয়ালাটাকেও সে ভাবেই বলে রেখেছে। তাই নবনীতার আসা যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে আর কোনও চিন্তা নেই। আজ নবনীতার চাকরির তৃতীয় দিন। গত দু’দিনই নবনীতা রাতে বাড়ি ফেরবার পর সীমন্তিনী আর অর্চনাকে বলেছে যে ফ্যাক্টরীতে আর শো-রুমে দু’জায়গাতেই কাজ করতে তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
দিনের কাজ শেষ হতে সীমন্তিনী গাড়িতে বাড়ি অভিমুখে আসতে আসতে ভাবল, মহিমার সব কথা শোনার আগে অব্দি নবনীতাকে নিয়ে তার একটা চিন্তা ছিল। সেক্স র*্যাকেটের ব্যবসা যারা করে তারা তাদের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে তাদের নাগালের বাইরে যেতে দেয় না। কেউ তাদের চক্র ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে তারা তাদের ছল বল কৌশল সবকিছু প্রয়োগ করে তাকে নিজেদের কব্জায় রাখতে চায়। নবনীতাকে অমন একটা চক্র থেকে বের করে আনতে পুরোপুরি গোপনীয়তা বজায় রাখতে না পারলে যে কোন সময় নবনীতার বিপদ হতে পারে। এ’কথা ভেবেই সে পরিতোষের সাহায্য নিয়ে নবনীতাকে দুটো দিন একটা জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল। পরিতোষের লোকেরাই তাদের দু’জনকে আড়াল থেকে গার্ড করে হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল। তারপর গোটা রাস্তায় সিভিল ড্রেসে পুলিশ এসকর্ট ছিল বলে তাদের আর কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। কিন্তু ভয়টা ছিল এখানে এসে পৌঁছোবার পরের ব্যাপারে। ওই সেক্স র্যােকেটের কেউ যদি গোপনে নবনীতাকে ফলো করে এ জায়গায় চলে আসে, তাহলে যে কোন মূহুর্তে ওকে একা পেলেই তারা আবার তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে সমর্থ হবে। এ ব্যাপারটা নিয়েই সীমন্তিনী একটু চিন্তিত ছিল। কিন্তু নবনীতা যেদিন মহিমার ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলল, আর তারপর সে নিজে যখন মহিমার সাথে কথা বলল, তখন তার মনের ভেতর থেকে এ ভয়টা অনেকটাই চলে গেছে। মহিমাকে ততটা ক্ষতিকারক বলে মনে হয়নি তার। পরে নবনীতার মুখে মহিমার আরও কিছু কথা শোনবার পর থেকে তার মনের আশঙ্কা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। নবনীতার আসা যাওয়ার ব্যাপারে যে রিক্সাওয়ালাকে সীমন্তিনী ঠিক করে দিয়েছে, সে রিক্সাওয়ালাটা পুলিশের ইনফর্মার হিসেবে কাজ করে। পথে ঘাটে নবনীতার ওপর যদি কোন ঝামেলা নেমে আসে তবে ওই মূহুর্তে কী করতে হবে না হবে তা সীমন্তিনী আগে থেকেই খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে।
অফিস থেকে বেরোবার আগেই সীমন্তিনী বাড়িতে ফোন করে অর্চনাকে তৈরী হয়ে থাকতে বলেছিল। তাই কোয়ার্টারের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াতেই লক্ষ্মীর সঙ্গে শালোয়ার কামিজ পরিহিতা অর্চনা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসল। গেটের বাইরে এসেই লক্ষ্মী বলল, “ও দিদিমণি, তুমি কি ঘরে না ঢুকেই এখন বাজারে যেতে চাইছ? হাতমুখ ধুয়ে চা জলখাবারটা তো খেয়ে যেতে পারতে”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে গাড়িতে উঠতে বলে লক্ষ্মীকে বলল, “ওমা, আমি তো আগেই ফোন করে তোমাকে বলে দিয়েছিলুম লক্ষ্মীদি, যে আজ আমরা বাড়িতে জল খাবার খাচ্ছি না। তুমি কি তবু তা করেছ”?
লক্ষ্মী বলল, “না তা তো করিনি দিদিমণি। কিন্তু করতে আর কতক্ষণ লাগবে বল? তুমি হাত মুখ ধুতে ধুতেই আমি করে ফেলতে পারব”।
অর্চনা ততক্ষণে গাড়ির পেছনের সীটে বসেছে। সীমন্তিনী বলল, “তুমি নিজের জন্যে কিছু বানিয়ে খেয়ে নিও। আমরা নীতার ওখানে যাচ্ছি। নীতার মালিকই আজ তার সাথে বসে চা জলখাবার খাবার নিমন্ত্রন করেছে গো। তাই যাচ্ছি। তা বাজার থেকে কি আর কিছু আনতে টানতে হবে নাকি লক্ষ্মীদি”?
লক্ষ্মী জবাব দিল, “আমি তো বিকেলে গিয়ে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে এসেছি দিদিমণি। আর কিছু আনবার নেই আপাততঃ”।
সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে, আমরা তাহলে আসছি” বলে ড্রাইভারকে ঈশারা করতেই রামসিং গাড়ি স্টার্ট করল।
বসাক গারমেন্টসে ঢুকতেই অর্চনা আর সীমন্তিনী দেখতে পেল নবনীতা তার কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো দু’জন গ্রাহকের সাথে ব্যস্ত আছে। নবনীতাও তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বেশ বড়সড় শো রুম। ইউ শেপে মোট ন’টি কাউন্টার। ছ’টা কাউন্টারে সেলসম্যান, আর তিনটে কাউন্টারে তিনজন সেলসগার্ল। সীমন্তিনী অর্চনার হাত ধরে নবনীতার কাউন্টার আর তার পরের আরেকটা কাউন্টার পেরিয়ে গিয়ে একটা ফাঁকা কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতে একজন সেলসম্যান এগিয়ে এল। সীমন্তিনী তাকে বলল, “ভাল রেডিমেড চুড়িদার সেট আর ভাল কোয়ালিটির সূতীর শাড়ি দেখাবেন”।
সেলসম্যানটা খুব বিনয়ের সাথে বলল, “আপনারা বসুন ম্যাডাম। আমি একজন সেলসগার্ল পাঠিয়ে দিচ্ছি এখানে” বলে লোকটা তার পাশের কাউন্টারের মেয়েটিকে এ কাউন্টারে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ওই কাউন্টারে বসা পুরুষ গ্রাহকদের দায়িত্ব নিল।
অর্চনা সীমন্তিনীর পাশের টুলে বসতে বসতে চাপা গলায় বলল, “ইশ, নীতাদির কাউন্টারে তো খদ্দের আছে। নইলে তাকে পেলেই ভাল হত”।
অর্চনার কথার জবাব দেবার আগেই সীমন্তিনী কাউন্টারে এসে দাঁড়ানো মেয়েটিকে বলল, “ভাল রেডিমেড চুড়িদার আর কটনের ভাল শাড়ি দেখান প্লীজ”।
দু’সেট চুড়িদার আর দুটো শাড়ি পছন্দ করতে সেলসগার্ল সেগুলো নিয়ে সামনের দিকে কাঁচে ঘেরা একটা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সীমন্তিনীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা এদিকে আসুন ম্যাম”।
সীমন্তিনী আর অর্চনা সেই কাঁচে ঘেরা কাউন্টারের দিকে যাবার আগে নবনীতার কাউন্টারে কোন লোক নেই দেখে তার কাছে এসে দাঁড়াতেই অর্চনা খুশী গলায় বলে উঠল, “তোমাকে এ ইউনিফর্মে খুব সুন্দর লাগছে গো নীতাদি”।
নবনীতা অর্চনার হাত ধরে একটু হেসে সীমন্তিনীকে বলল, “শাড়ি আর চুড়িদার নিয়েছ সেটা তো দেখেছি। ভাগ্যিস আমার কাউন্টারে আসনি তোমরা। ওই সেকশনের প্রোডক্টগুলোর ব্যাপারে আমি এখনও পুরোপুরি শিখতে পারিনি। কিন্তু দিদি, তুমি যে তোমার অফিস ইউনিফর্ম পড়েই এসেছ? বাড়িতে যাও নি নাকি”?
সীমন্তিনী জবাব দিল, “বাড়ি গিয়েছিলাম শুধু অর্চুকে গাড়িতে তুলে নিতে। ভেতরে ঢুকিনি আমি। আর শোনো, তুমি খগেনকে ফোন করে বলে দাও যে আজ ওকে আর আটটার সময় আসতে হবে না। তুমি আমাদের সাথেই ফিরবে”।
নবনীতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস বলল, “কিন্তু দিদি, আমার ছুটি হতে তো এখনও ঘন্টাখানেক দেরী আছে”?
সীমন্তিনী অর্চনাকে নিয়ে কাঁচে ঘেরা কেবিনটার দিকে যেতে যেতে বলল, “ও নিয়ে তুমি ভেবো না। তুমি শুধু ওকে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দাও”।
কাঁচে ঘেরা কেবিনটার সামনে যেতেই ভেতরে বসা ম্যানেজার সীমন্তিনীকে বলল, “গুড ইভিনিং ম্যাম”।
সীমন্তিনীও তাকে গুড ইভিনিং বলতে সে বলল, “ম্যাম, আপনার মোট বিল হয়েছে সাত হাজার ন’শ ষাট টাকা। তা, ম্যাম, আপনি কি ক্যাশে........”?
ম্যানেজারের মুখের কথা শেষ হবার আগেই তার টেবিলের ওপর রাখা ইন্টারকমটা ঝিঁঝিঁ শব্দে বেজে উঠল। রিসিভার ওঠাতে ওঠাতে সে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “এক মিনিট ম্যাম” বলে রিসিভার কানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ওকে, ম্যাম। ঠিক আছে। আমি তাই করছি”।
রিসিভার নামিয়ে রেখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি ম্যাম, হিসেবটা একটু চেঞ্জ হবে। আমাদের মালিকের অর্ডারে আপনি ফাইভ পার্সেন্ট স্পেশাল ডিস্কাউন্ট পাচ্ছেন” বলে তার সামনের কম্পিউটারের সাহায্যে বিলের ডাটা ইনপুট গুলো মোডিফাই করতে করতে বলল, “আপনি তাহলে সাত হাজার পাঁচশ’ বাষট্টি টাকা দেবেন ম্যাম”।
সীমন্তিনী নিজের পকেট থেকে ডেবিট কার্ড বের করে ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে দিল। ম্যানেজার সেটা নিতে নিতে বলল, “ম্যাম, আপনারা আমাদের মালিকের চেম্বারে চলে যান। উনি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনাদের কেনা জিনিসগুলো প্যাক করে আমি ওখানেই পাঠিয়ে দেব”।
ম্যানেজার ডেবিটকার্ডটা ফেরত দিয়ে পজ মেশিনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই সীমন্তিনী তার পিন নাম্বারটা বসিয়ে দিয়ে “থ্যাঙ্ক ইউ” বলে অর্চনার হাত ধরে শো-রুমের একপাশ দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠতে লাগল অর্চনাকে সঙ্গে নিয়ে।
জয়া বসাক নিজের চেম্বারে সীমন্তিনী আর অর্চনাকে খুব আপ্যায়ন করে বসতে দিলেন। খানিক বাদে নবনীতাকেও সেখানে ডেকে পাঠানো হল। তারপর সকলে মিলে চা জল খাবার খেতে খেতে নানারকম কথা নিয়ে আলাপ আলোচনা করল। সীমন্তিনীর অনুরোধ মেনে নিয়ে জয়া বসাক নবনীতাকে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত হলেন। নবনীতাও কথা দিল, নিজে কাজ শেখার পাশাপাশি সে ফ্যাক্টরী আর শো-রুমের কাজে কোনরকম গাফিলতি করবে না। সীমন্তিনী নবনীতার কথা শুনে মনে মনে আশ্বস্ত হল। মনে মনে ভাবল, আর কোনও নতুন ঝামেলা দেখা না দিলে, নবনীতাকে নিয়ে আর ভাবনা করতে হবে না তেমন। অর্চনাও সীমন্তিনীর এখানে আসবার পর গত দশ এগারো দিনে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। তার মুখশ্রীতে আর চেহারায় একটা উজ্জ্বল আভা ফুটে বেরোতে শুরু করেছে। সীমন্তিনীর ইচ্ছে, অর্চনাকে কম পক্ষেও মাস খানেক নিজের কাছে রাখবে। তাহলেই অর্চনা পুরোপুরি ভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারবে বলে তার ধারণা। কিন্তু রতীশ আর রচনার ওপর যে বিপদের ঝুঁকি নেমে এসেছে, তা অর্চনা জানে। ওদের ঝামেলা মেটবার আগে অর্চনাকে কালচিনি পাঠিয়ে দিলে ও সেখানে গিয়েও ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিঘ্ন থাকবে। ফোনে কথা বলবার সময় সে নিশ্চয়ই সীমন্তিনীর কাছ থেকে কি হল না হল এসব কথা জানতে চাইবে। আর তখন বাড়ির অন্য সকলেও ঘটণাটার আঁচ পেয়ে যাবে। সেটা সীমন্তিনীর একেবারেই কাম্য নয়। পরিতোষ বলেছে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ দিনের ভেতরেই তার অপারেশন শেষ হবে। তারপর থেকে রতীশ আর রচনার ওপর আর কোনও বিপদের আশঙ্কা থাকবে না। সে হিসেব ঠিক হলে আর প্ল্যান মাফিক কাজটা সম্পন্ন হলে, অক্টোবরের ছ’ থেকে দশ তারিখের মধ্যে সব কিছু মিটে যাবে। ততদিন পর্যন্ত যদি অর্চনাকে তার কাছেই রেখে দিতে পারে, তাহলে কালচিনির বাড়ির সকলের কাছে রচনার বিপদের কথাটা লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
ঘরে ফিরে আসবার পর অন্যান্য দিনের মত যখন তিনজন মিলে গল্প করছিল, তখন কথায় কথায় সীমন্তিনী বাজার থেকে কিনে আনা পোশাক গুলো বের করে একটা চুড়িদারের সেট অর্চনাকে, আরেকটা নবনীতাকে দিল। আর লক্ষ্মীকে ডেকে একটা শাড়ি তার হাতে দিল। আর অন্য শাড়িটা নিজের জন্য রেখে বলল, “সামনে পূজো আসছে। কখন কোথায় কিভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তার তো কোনও ঠিক নেই। তাই আগে থেকেই তোমাদের সকলের জন্য এগুলো কিনে আনলাম আজ। তোমরা এ গুলো পূজোর সময় পড়বে”।
অর্চনা আর নবনীতা মৃদু আপত্তি করলেও সীমন্তিনীর উপহার না নিয়ে পারল না। অর্চনা সীমন্তিনীকে প্রণাম করতে চাইতেই সীমন্তিনী তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হয়েছে বোন। আর প্রণাম করতে হবে না। কিন্তু এবার আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। সত্যি সত্যি জবাব দেবে কিন্তু। মনে কোনও দ্বিধা রেখে জবাব দেবে না”।
অর্চনা জিজ্ঞাসু চোখে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “কী কথা দিদিভাই”?
সীমন্তিনী বলল, “অর্চু, নীতা তো দিন তিনেক হল কাজে যেতে শুরু করেছে। আমিও তো সকাল ন’টা নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। ফিরতে ফিরতে আমার সন্ধ্যে হয়ে যায়। দুপুর থেকে তো তোমাকে কেবল লক্ষ্মীদির সাথেই থাকতে হচ্ছে। তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো তাতে বোন”?
অর্চনা বলল, “না দিদিভাই, আমার তো কোন অসুবিধে হচ্ছে না। দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে তো লক্ষ্মীদি সব সময় আমার সাথে বসে গল্প করে”।
সীমন্তিনী এবার বলল, “তাহলে আমি যদি তোমাকে এখানে পূজো অব্দি থাকতে বলি, তাহলে তুমি রাগ করবে না তো? মা বাবার জন্যে, ভাইয়ের জন্যে মন খারাপ করবে না তো”?
অর্চনা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “পূজো অব্দি? তার মানে তো আরও প্রায় মাস দেড়েক”!
সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “হু, প্রায় তাইই হবে। পূজো তো এবার অক্টোবরের একুশ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে। অতদিন থাকতে চাইছ না তুমি”?
অর্চনা কয়েক মূহুর্ত চুপ করে মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, “আমার জীবনটা যে তোমারই দান গো দিদিভাই। তুমিই যে আমার ভগবান। দেড় মাস কেন, তুমি চাইলে আমি সারাটা জীবন তোমার কাছে থাকতে রাজি আছি। আর মা, বাবা, ভাইয়ের জন্য মনই বা কেমন করবে কেন। তাদের সাথে তো আমি যখন খুশী তখনই কথা বলতে পারছি। সব খবরাখবর জানতে পারছি। গত সাতটা বছর আমি তাদের সাথে কথা বলা তো দুর, তারা কে কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনা, সুস্থ আছেন কিনা এ খবরটুকুও জানতে পারতুম না। তোমার দয়াতেই তো সে দুঃসময়টা কেটে গেছে আমার জীবন থেকে। মা বাবা যদি আপত্তি না করেন, আর তারা যদি সুস্থ স্বাভাবিক থাকেন, তাহলে তোমার এখানে থাকতে আমার কোন অসুবিধেই হবে না। কিন্তু ছোট্ট একটা কথা আছে আমার। তোমায় সেটা রাখতে হবে”।
সীমন্তিনী অর্চনাকে একহাতে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, “বলো কী শর্ত তোমার”?
অর্চনা সীমন্তিনীর কাঁধে নিজের মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, “না গো দিদিভাই, শর্ত নয়। শুধু একটা ছোট্ট অনুরোধ। সেটা তুমি রাখবে”?
সীমন্তিনী অর্চনার কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বলল, “বেশ, আগে শুনি তোমার অনুরোধটা কি। তারপর রাখতে পারি কি না সেটা ভেবে দেখব”।
অর্চনা সীমন্তিনীর একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে তুমি আর ‘তুমি তুমি’ করে বলবে না। রচুকে ভালবেসে তুমি যেমন তুই তোকারি করে কথা বলো, সেটা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে দিদিভাই। আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার মুখ থেকে ওভাবে ডাক শুনতে। আমার এ অনুরোধটা রাখবেনা তুমি”?
ও’পাশ থেকে নবনীতাও প্রায় সাথে সাথে বলে উঠল, “হ্যাঁ দিদি। অর্চু একদম ঠিক বলেছে। তুমি যখন বৌদির সাথে ওভাবে তুই তোকারি করে কথা বল, সেটা শুনতে আমারও খুব ভাল লাগে গো। অবশ্য এটা তো আমরা সবাই জানি যে তোমার দাদাভাই আর তার স্ত্রী, মানে তোমার রচু সোনা, এরা দু’জন তোমার প্রাণ ভোমরা। তাদের জন্য তুমি সব কিছু করতে পারো। কিন্তু তুমি তো আমাদের জন্যেও কত কিছু করেছো এবং এখনও করে যাচ্ছ। আমরাও তো তোমার থেকে বয়সে ছোট। হ্যাঁ আমরা অবশ্য কেউই তোমার বৌদি নই সম্পর্কে। কিন্তু তাই বলে কি ‘তুমি তুমি’ বলে আমাদের এতটা দুরে রাখা ঠিক? আমারও যে খুব ইচ্ছে করে তোমার মুখ থেকে ও’রকম ডাক শুনতে”।
সীমন্তিনী এবার দু’হাতে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওরে দুষ্টুরা, তোমরা বুঝি দু’জনে মিলে আগে থেকে প্ল্যান করে এভাবে বলছ আমায়, তাই না”?
জবাবে তারা কেউই কোন কথা না বলে সীমন্তিনীর দু’কাঁধে দু’জন মাথা চেপে ধরে রইল।
সীমন্তিনী একসময় নিজেই বলল, “বেশ ঠিক আছে। তোদের যখন এমনটাই ইচ্ছে তাহলে এখন থেকে তোদের দু’জনকে তুই তোকারি করেই কথা বলব আমি। এবার খুশী তো”?
*********************
______________________________